prabandho-rabindranath-sanket

রবীন্দ্রনাথ এবং সংকেত
সমৃদ্ধ দত্ত


রবীন্দ্রনাথ জানতে পারলেন যে, অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রাতার মৃত্যু হয়েছে। শোকাকুল অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখলেন নিজের শোকের কথা। অমিয় চক্রবর্তীর মতো এই বয়সে তিনি নিজে যে কতটা নিদারুণ শোক পেয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। বললেন, ‘আমার যে পরমাত্মীয় আত্মহত্যা করে মরেন, শিশুকাল থেকে আমার জীবনের পূর্ণ নির্ভর ছিলেন তিনি। তাই তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমার পায়ের নীচে থেকে যেন পৃথিবী সরে গেল আমার আকাশ থেকে আলো নিভে গেল। আমার জগৎ শূন্য হল, আমার জীবনের স্বাদ চলে গেল। সেই শূন্যতার কুহক কোনোদিন ঘুচবে এমন কথা আমি মনে করতে পারিনি। কিন্তু তার পরে সেই প্রচণ্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করলে। আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানলার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না। মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে, তা বড় দুঃসহ। কিন্তু তার পরে তার ঔদার্য্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে’।

এ পর্যন্ত পাঠ করেই আমরা বুঝতে পারছি যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিকটাত্মীয় কার মৃত্যুর প্রসঙ্গ এখানে উচ্চারণ করলেন। নিয়ে এলেন সেই বেদনার স্মৃতি। তাঁর প্রিয় বৌঠান কাদম্বরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন এক তীব্র অভিমানে। সেই প্রসঙ্গ বহু চর্চিত। সেই ঘটনাও অনেক বছর আগে। ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে।

অথচ ৩৩ বছর পরও কবির মনে যে কোনও মৃত্যুর সংবাদে তাঁর প্রিয় জনের সেই মৃত্যুর বেদনার গোপন অভিঘাত আছড়ে পড়ে।

১৯১৭ সালের ২২ জুন কবি অমিয় চক্রবর্তীকে এই চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা বুঝতে পারছি অমিয় চক্রবর্তীকে শোক সংবরণ করার মন্ত্রগুপ্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন রবীন্দ্রনাথ। ততদিনে কবির জীবনে একের পর এক মৃত্যুর শোক পাওয়া হয়ে গিয়েছে। তিনি জানেন মৃত্যু কীভাবে জীবনকে অনুসরণ করে চলেছে নিরন্তর। অথবা জীবনের মধ্যেই বাস করে মূত্যুর বীজ।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা নিয়ে আলোচনা অথবা চর্চা তো অনেক হয়েছে! তাহলে আবার নতুন করে এই প্রসঙ্গের অবতারণা কেন? কারণ, একটি কুয়াশাঘেরা বাক্য। আমরা এখানে লক্ষ্য করব, রবীন্দ্রনাথের চিঠির একটি অংশকে। তিনি যেখানে লিখছেন, ‘আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানলা থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না’। এই বাক্যটির মধ্যে যে সংকেত আছে সেটির সমাধান কী? এই বাক্যের অর্থই বা কী? ‘জীবনকে মৃত্যুর জানলা দিয়ে না দেখলে’ কথাটি স্পষ্ট নয়। আমাদের তিনি মৃত্যুর তীরভূমি থেকে জীবনের দিকে অবলোকন করতে বলছেন। তার অর্থ হল, আমরা আসলে মৃত্যুর দিকেই বসে আছি? আমাদের সামনে জীবন বয়ে চলেছে? মৃত্যু কি সহজাত? আমরা কি মৃত্যুকে বহন করে নিয়ে চলছি? মানুষ কি আসলে মৃত্যুর মধ্যেই বাস করে! বাইরে চলমান যে জগৎ সেটি জীবন? আর মানুষ মৃত্যুর মধ্যে বাস করে সেই জীবনকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি? মৃত্যুর জানলা থেকে জীবনকে দেখতে বলছেন কবি। তাহলে আমরা কোথায় বাস করি? জীবনে নয়? মৃত্যুতে? নাকি তাও নয়? মৃত্যুর জানলা ঠিক কোনটা? মৃত্যু নামক একটি ঘরে বাস করছি। সেই ঘরের জানলা থেকে বাইরে তাকালে লক্ষ্য করা যায় যে জীবন হেঁটেচলে বেড়ায় অর্থাৎ একদিন যদি সেই জানালা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তার নামই মৃত্যু।

কিন্তু এই জানালা বন্ধ হওয়ার অর্থ তো এই নয় যে, বাইরের জগৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ আমার শরীরের জানালা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু অনন্ত জীবনের কালপ্রবাহ বন্ধ হল না। সেটি বয়ে চলেছে আদি অনন্তকাল ধরেই। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মৃত্যুর জানলা থেকে দেখলে’। কে দেখছে? আমি? মানে আমার আত্মা? মানুষ তাহলে মৃত্যুর মধ্যেই বাস করে? নাকি শরীরের চৈতন্যজগতে একটি কুঠুরিতে থাকে মৃত্যু। আর আমাদের আত্মা আসলে সেই কুঠুরিতে বসবাস করে। যেদিন বসে বসে সেই আত্মা দেখছে জীবনের চলমানতা। যেদিন সেই কুঠুরির জানলা বন্ধ হয়ে গেল, সেদিন জীবনকে দেখার প্রক্রিয়া বন্ধ হল এই শরীরের। এই কি অর্থ?

তাহলে মানুষ মৃত্যুকে বহন করে নিয়ে চলেছে? যে জীবন জন্ম হওয়ার পর থেকে এগিয়ে চলেছে, যাকে বেঁচে থাকা বলছি, সে একা নয়? তার মানে কি এই জীবনের সঙ্গেই মৃত্যুও প্রতিটি শরীরের মধ্যে রয়ে যায় জন্মমুহূর্ত থেকে। প্রতিটি জীবনের জন্ম তৎক্ষণাৎ একটি করে মৃত্যুরও জন্ম দিচ্ছে। তারপর দুজনে চলছে। আত্মা বাস করছে মৃত্যুর সঙ্গে। মৃত্যুর জানলা থেকে সে দেখছে জীবনকে।

এই যে জীবনের মধ্যেই মৃত্যুর বসবাস, তাকেই কি লালন ফকির বলেছিলেন, পড়শি? যে বাস করে বাড়ির কাছে আরশিনগরে!

কী কব সেই পড়শির কথা
ও তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা
নাই রে
সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীরে
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
আমার যমযাতনা যেত
দূরে

সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে

লালন ফকিরে এই পড়শিই কি সেই মৃত্যু? যে আমার বাড়ি কাছে বসে আমাকে লক্ষ্য করে। জানালা থেকে। আমাকে মানে কী? আমার জীবনকে? নাকি সেই জানালায় আসলে আমিই থাকি। যে অন্য আমিকে লক্ষ্য করে মৃত্যুর জানলা থেকে। কাছে বসে? নাকি ভিতরেই বসে থাকে সে? এই যে মানব কাঠামো, অর্থাৎ হাড় মাংস রক্তের শরীর, এর মধ্যেই জীবন ও মৃত্যু দুজনের বসবাস। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু চেতনা সম্পর্কে অনেক রচনা, বিশ্লেষণ, গবেষণা অথবা ব্যাখ্যা রয়েছে। তাই সেই চিন্তার স্তরে নতুন করে তত্ত্বের ভিড় বৃদ্ধি করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমরা বরং সন্ধান করার চেষ্টা করব, মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নানাবিধ জীবন সংকেত হিসেবে দেখছেন। এই যে মৃত্যুর জানলা থেকে জীবনকে দেখা হলে তবেই তাকে সত্যরূপে দেখা যায়, এই বার্তা রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত, শুধুই একটি চিঠিতে উপস্থাপিত করেই নিজেকে সংযত করেননি। বরং, তিনি নিজে আজীবন এই দর্শনকে পালন করেছেন মনের অভ্যন্তরে। মৃত্যুকে তিনি উপেক্ষা করেননি। জীবনের জয়গান গাওয়ার নেশায় অনেকেই হয়ত মৃত্যুকে তাচ্ছিল্য করেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ এখানেই সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি অবশ্যই জীবনকে সত্য এবং সর্বশক্তিমান হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু মৃত্যুকে পরাজিত করে নয়। মৃত্যুকে পাশে নিয়ে। মৃত্যু আছে, থাকবে এটা তিনি জানেন। পাশাপাশি জীবনকে যে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি কোনওদিন মৃত্যু, এই আবহমানকালের প্রকৃতির শক্তির সামনে রবীন্দ্রনাথ অবনত হয়েছেন। তাঁর আজীবনের রচনা সেকথাই বলে। মৃত্যু এসে একটি জগৎ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য জীবনকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দেখছেন জীবন অবিচল এবং উদাসীন।
‘তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে
কাটবে দিন কাটবে,
কাটবে গো দিন আজকের যেমন দিন কাটে, আহা
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি

চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।’

অর্থাৎ জীবন নিজের মনেই অতিবাহিত হচ্ছে। এখানেই রবীন্দ্রনাথ আবার সংকেত নিয়ে আসছেন। একটু আগেই তিনি বলেছেন,
তখন আমায় নাই-বা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাই-বা আবার ডাকলে…

অথচ একেবারে শেষ পংক্তিতে এসে তাঁর প্রশ্ন আমরা শুনতে পেলাম সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। তিনি জানতে চাইছেন,

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি
সকল খেলায় করব খেলা এই আমি, -আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

এই আমি কে? আমার আত্মা। যা অবিনশ্বর। একদিকে তিনি বলছেন তখন আমায় নাই-বা মনে রাখলে! আবার কিছু পরেই তিনি বলছেন, তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি! আপাতভাবে এই দুই বিবৃতি বিপরীতার্থক মনে হতেই পারে। একবার বলা হচ্ছে, এই যে জীবনের প্রবহমানতা, এখানে আমাকে আর মনে রেখো না। আমাকে আর ডেকো না। আবার বলছেন, কে বলল, আমি কোথাও নেই? কিন্তু আদতে হয়ত এতটা সহজ নয়। জীবন এবং মৃত্যু হাত ধরাধরি করে চলে। হঠাৎ একটি জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। সুতরাং মনে হয় জীবনের ইতি হল। কিন্তু জীবনের মধ্যে দুটি অংশ। শরীর ও আত্মা। আর তাই একটি শরীর চলে গেলেও আত্মার হাত ছাড়ল না মৃত্যু। সেই আত্মা এরপর হয়ত কোনও অন্য শরীর ধারণ করবে কিংবা করবেও না। কিন্তু জীবন মৃত্যুর পাশাপাশি হেঁটে চলা চলতেই থাকবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এবং কবিতায় বারংবার শব্দচয়ন আর বার্তাপ্রেরণের মধ্যে রহস্যময়তা এবং কুয়াশাঘেরা কিছু ধাঁধা রেখে দিয়ে যান। তাই সেগুলো পড়ার পর আমাদের মনে হয় রচনাটি সমাপ্ত হল। কিন্তু আদতে কী সমাপন হল? আমাদের মনে বহু ক্ষেত্রে একটি করে অস্বস্তি তৈরি হয়। মনে হয়, কিছু একটা যেন খটকা লাগছে। ঠিক যেন বুঝতে পারিনি। অঙ্কটা মিলেছে দেখতে পাচ্ছি। অথচ মাঝখানের কয়েকটি স্তর যেন বোধগম্যতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তখন সংশয় কাটাতে আবার পড়তে হয়। আবার। এবং তখন একটি শব্দ অথবা একটি বাক্যের দিকে অগ্রসর হয় আমাদের মন। তাদের বোঝার চেষ্টা করতে হয়।

মূত্যুকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে দেখতেন তার হাজারো উদাহরণ নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ভিড়ের অলক্ষ্যে ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ নামক অবিস্মরণীয় এক ক্ষুদ্র প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘রুদ্ধ গৃহ’ নামক প্রবন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিন্তনে আলো ফেলেছেন। আমরা এতকাল জানতাম, মূত্যু একজন চোর। সে জগৎসংসার থেকে জীবনকে চুরি করে নিয়ে পালায় প্রতিনিয়ত। অথচ রবীন্দ্রনাথ বললেন, মৃত্যুর থেকে কোনও অংশে কম পরাক্রমী চোর নয় জীবন।

তিনি বললেন, ‘এ জগতে অবিশ্রাম জীবনের প্রবাহ মৃত্যুকে হু হু করিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়, মৃত কোথাও টিঁকিয়া থাকিতে পারে না। এই ভয়ে সমাধিভবন কৃপণের মতো মৃতকে চোরের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য পাষাণ প্রাচীরের মধ্যে লুকাইয়া রাখে, ভয় তাহার উপরে দিবারাত্রি পাহারা দিতে থাকে। মৃত্যুকেই লোকে চোর বলিয়া নিন্দা করে, কিন্তু জীবনও যে চকিতের মধ্যে মূত্যুকে চুরি করিয়া আপনার বহুবিস্তৃত পরিবারের মধ্যে বাঁটিয়া দেয়, সে কথার কেহ উল্লেখ করে না’। আরও বললেন, ‘পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয়, জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে। পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাইবোনের মতো খেলা করে। এই জীবনমৃত্যুর প্রবাহ দেখিলে, তরঙ্গভঙ্গের উপর ছায়া আলোর খেলা দেখিলে, আমাদের কোনও ভয় থাকে না…….

পৃথিবীতে যাহা আসে, তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্যরক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য ভঙ্গ হয়। জীবন যেমন আসে, জীবন তেমনি যায়; মৃত্যুও যেমন আসে, মৃত্যুও তেমনি যায়। তাহাকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন? হৃদয়টাকে পাষাণ করিয়া সেই পাষাণের মধ্যে তাহাকে সমাহিত করিয়া রাখ কেন। তাহা কেবল অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া ওঠে। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও। জীবন মৃত্যুর প্রবাহ রোখ করিও না। হৃদয়ের দুই দ্বারই সমান খুলিয়া রাখো। প্রবেশের দ্বার দিয়া সকলে প্রবেশ করুক, প্রস্থানের দ্বার দিয়া সকলে প্রস্থান করিবে।’

এই যে আশ্চর্য সংকেতময় বাক্যগুলি বললেন, তার অর্থ হয়ত তিনি মনকে একটি দরজা খোলা ঘরের মতোই মনে করতে বলছেন। নিজেদের সেইমতোই প্রস্ততি করতে আহ্বান করলেন। এই ঘরে জীবন আসছে। এই ঘরে জীবন অন্য দরজা দিয়ে চলেও যাবে। যখন জীবন থাকছে ঘরে, তখন আমরা আনন্দময় সময় কাটাচ্ছি।

আর যখনই জীবন অন্য দ্বার দিয়ে মৃত্যুর হাতছানিতে সাড়া দিয়ে চলে যাবে, সেই যাওয়ার ঘটনাকে আমি আটকে রাখব মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ সেটা চাইছেন না। বারণ করছেন। সেই ঘর বন্ধ করে রাখলে, সেখানে আজীবন মৃত্যুই বাস করবে। যে মৃত্যু জীবনকে নিজের নিয়মে প্রবেশ প্রস্থান করতে আর দিচ্ছে না। তাই কোনও এক প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথাকে আজীবন এভাবে বন্ধ ঘরে অর্থাৎ হৃদয়ে বদ্ধ করে রাখাকে তিনি সমাধিভবনের সঙ্গে তুলনা করলেন। যতবার কোনও সমাধিভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই আমরা, ততবার মূত্যুর কথাই মনে পড়ে। এখানে একজন মানুষের মৃত্যু শায়িত আছে। এরকমই মনে হয়। অথচ সমাধিভবন না থেকে যদি সেই জীবনটি স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃতির এই বিশাল সাম্রাজ্যে কোথায় মিশে গিয়েছে, হয়ত কোথাও আছে, এই মনোভাব রচনা করাই সঙ্গত বলে মনে করছেন রবীন্দ্রনাথ।

‘মহাবিশ্বে মহাকালে’ গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যেন আকাশ ভরা সূর্য তারাকেই নিয়ে এসেছেন। আমরা খুঁজে পাই বিশ্বভরা প্রাণ। আকাশ ভরা সূর্য তারা এবং বিশ্বভরা প্রাণের মধ্যে আমি পেয়েছি যে এই স্থান, এটাই এক মহাবিস্ময়। আর সেই গানের ধাঁচেই যেন বলা হচ্ছে এখানে, মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে / আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে। মহাবিশ্বের এই মহাগজতে একটি জীবনের স্পন্দনের অধিকারী হওয়া চরম বিস্ময়কর রবীন্দ্রনাথের কাছে। এই গানের একটি শব্দে আমাদের চোখ ও মন আটকে যায়। শব্দটি হল, বিশ্বনাথ। বলা হচ্ছে, ‘তুমি আছ, বিশ্বনাথ, অসীম রহস্যমাঝে’। আমাদের চেনা ঈশ্বর মহাদেবকে নিশ্চয়ই বলা হচ্ছে না। তাহলে কে তিনি? জীবন ও মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করা কোন সর্বশক্তিমান? ‘নীরবে একাকী আপন মহিমালয়ে।’

বড় মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ের কয়েকমাস পরই স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যু হয়। মাধুরীলতা একমাত্র বিবাহিত। বাকি সকলের লালন পালনের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। রেণুকার অসুস্থতার সময় রবীন্দ্রনাথ লিখে চললেন, একের পর এক কবিতা। কখনও হয়ত শয্যাপার্শ্বে বসেও। তখনও তো জানেন না যে, এই মেয়েকে রক্ষা করা যাবে না। অথচ তাঁর সেই সব কবিতা যখন স্থান পেল, ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থে, তখন দেখা গেল, কবি যেন মৃত্যুকে অনুভব করছিলেন। তিনি যেন সময়কে এগিয়ে আসতে দেখতে পাচ্ছেন। সৈয়দ মুজতবা আলি স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, ‘পলাতকা’য় মূত্যু সংক্রান্ত এক রাবীন্দ্রিক সংকেত কীভাবে তাঁকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সে বাক্যের রহস্য আজও যেন অধরা হয়ে রয়ে গেল। কবিতার নাম ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’।

‘একটা কথা সদা শুনি, ‘গেছে চলে’ ‘গেছে চলে’
তবু রাখি বলে
বলো না, ‘সে নাই’
সে কথাটা মিথ্যা, তাই
কিছুতেই সহে না যে,
মর্মে গিয়ে বাজে

মানুষের কাছে
যাওয়া আসা ভাগ হয়ে আছে।
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা।
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে সমুদ্রে আছে নাই পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।’

শেষ বাক্যের অর্থ কী? যে সমুদ্রে আছে নাই পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান! জীবন ও মৃত্যু দুই-ই সমান ভারসাম্যে যেখানে জাজ্বল্যমান, সেই হৃদসমুদ্রে অবগাহন করতে বলছেন রবীন্দ্রনাথ।

তাহলে কি মানবজীবনের সর্বোত্তম অন্বেষণ সেই সমুদ্র, যেখানে, ‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে?’

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *