ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
বাল্মীকির রামায়ণের বালকাণ্ডে রাজশেখর বসুর বঙ্গানুবাদে একটি চমৎকার বর্ণনা পাই। যেখানে বশিষ্ঠর আশ্রমে বিশ্বামিত্র কেমনভাবে আপ্যায়িত হয়েছিলেন তা খুব প্রাঞ্জল ভাবে বর্ণিত।
“বশিষ্ঠ তাঁর বিচিত্রবর্ণা কামধেনুকে আহ্বান করে বললেন, শবলা, আমি সসৈন্যে রাজা বিশ্বামিত্রের সৎকার করতে চাই। তুমি উত্তম ভোজনের আয়োজন কর। ষড়রসের যে যা চায়, অন্ন, পানীয়, লেহ্য, চূষ্য, সর্বপ্রকার ভোজ্য তুমি সৃষ্টি কর। কাম প্রদায়িনী শবলা ইক্ষু, মধু, লাজ (খই, মুড়ি জাতীয়), উৎকৃষ্ট মদ্য, মহার্ঘ পানীয়, বহু প্রকার ভক্ষ্য, পর্বতপ্রমাণ উষ্ণ অন্নরাশি, পায়স, সূপ (ডাল), দধিকুল্যা (দই), খান্ডব (মিছরি) পূর্ণ অসংখ্য রজতময় ভোজনপাত্র সৃষ্টি করলে”
আবার অযোধ্যা কান্ডে দেখি রাম যখন চোদ্দ বছরের জন্য বনবাসে চলেছেন তখন কুঠারাঘাতে ছিন্ন শালশাখার ন্যায় বিধ্বস্ত, শোকসন্তপ্ত কৌশল্যা কে রাম শান্ত করছেন, মা যাতে নিশ্চিন্ত থাকেন। রাজশেখর বসুর অনুবাদে সেই অংশটি এইরূপ।
“আমার আসনে কি প্রয়োজন? আমি দন্ডকারণ্যে যাচ্ছি। সেখানে চতুর্দশ বর্ষ মুনিদের ন্যায় কুশাসনে বসে আমিষ ত্যাগ করে কন্দফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করতে হবে।”
এই ‘আমিষ’ গ্রহণের ব্যাপারে বলি, বনবাসকালে রাম মৃগয়ালব্ধ মাংস খেতেন এ কথা কিন্তু পরে পাই আমরা। তিলক টীকাকারের মতে আমিষ অর্থে বুঝতে হবে “সুদৈর্বিশিষ্ট সংস্কারসংস্কৃতং মাংসং” অর্থাৎ পাচক যে মাংস মশলা ইত্যাদি দিয়ে রাঁধে… রাম তখন এই রকম মাংস বর্জন করেছিলেন।
এই রামচন্দ্রকেই আবার দেখি প্রয়াগের নিকট যমুনার উত্তর তীরে বৎসদেশে প্রবেশকালে বরাহ, ঋষ্য ও পৃষৎ অর্থাৎ টীকাকারের কথায় শূকর, বিভিন্ন জাতীয় কৃষ্ণসার হরিণ এবং মহারুরু বা শম্বর হরিণ এরূপ চার ধরণের পশু বধ করে তাদের পবিত্র মাংস নিয়ে ক্ষুধার তাড়নায় অরণ্যে প্রবেশ করতে।
কৃত্তিবাসের রামায়ণে সীতার বিবাহ অনুষ্ঠানে জনক রাজা ভোজসভায় কিভাবে অতিথি সৎকারের আয়োজন করেছিলেন, তার বিস্তৃত বর্ণনায় রয়েছে
“ঘৃত দুগ্ধে জনক করিলা সরোবর / স্থানে স্থানে ভাণ্ডার করিল মনোহর।
রাশি রাশি তন্ডুল মিষ্টান্ন কাঁড়ি কাঁড়ি / স্থানে স্থানে রাখে রাজা লক্ষ লক্ষ হাঁড়ি”।
আবার আরেক জায়গায় পাই
“ভারে ভারে দধি দুগ্ধ ভারে ভারে কলা / ভারে ভারে ক্ষীর ঘৃত শর্করা উজলা।
সন্দেশের ভার লয়ে গেল ভারিগণ / অধিবাস করিবারে চলেন ব্রাহ্মণ”।
জলখাবারেও তণ্ডুল বা ধান জাত দ্রব্যাদির ব্যাবহারও প্রাচীন কাল থেকেই চালু ছিল।
কৃত্তিবাসের রামায়ণের ‘অরণ্যখণ্ডে’ হনুমানকেও কবি ভাত খাওয়ালেন। সেখানেও শাকের
উল্লেখ। তারপরে সূপ বা ডাল, ঝোল জাতীয় কিছুর রেওয়াজ।
“প্রথমেতে শাক দিয়া ভোজন আরম্ভ।
তারপর সূপ আদি দিলেন সানন্দ।।
ভাজা ঝোল আদি করি পঞ্চাশ ব্যঞ্জন।
ক্রমে ক্রমে সবাকারে কৈল বিতরণ।।
শেষে অম্বলান্তে হৈল ব্যঞ্জন সমাপ্ত।
দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত।।”
কিন্তু এসব হল সাত্ত্বিক আহার।
এবার আসি রামায়ণের যুগের মাংস খাওয়া নিয়ে। খাদ্য গবেষক, লেখক নীলাঞ্জন হাজরার “কাবাব কিসসা” বইতে পাই রামায়ণের যুগের এক শূলপক্ব মাংসের কথা যার নাম তিনি দিয়েছেন রামায়ণী কাবাব। বইতে আছে রাজস্থানের মেবারে উদ্ধার হওয়া এক রামায়ণ পুঁথির এক রঙিন চিত্রও। রামসীতার বনবাসের সে ছবি যেন কথা বলে ওঠে আজও। সেখানে মন দিয়ে লক্ষ্মণের মত কেউ একজন কাবাব বানাচ্ছেন হাতে ছুঁচলো মুখের দণ্ড বা শিক নিয়ে ও তার মধ্যে মাংসের টুকরো গেঁথে।
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনুদিত বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে আছে
“লক্ষ্মণ বন হইতে মৃগ বধ করিয়া আনিলেন। তদ্দর্শনে রাম পুনরায় তাঁকে কহিলেন, বৎস্য! তুমি গিয়া এই মৃগের মাংস পাক কর;… লক্ষণ প্রদীপ্ত বহ্নি মধ্যে পবিত্র মৃগমাংস নিক্ষেপ করিলেন এবং উহা শোণিত শূন্য ও অত্যন্ত উতপ্ত হইয়াছে দেখিয়া রাম কে কহিলেন। আর্য! আমি এই সর্বাঙ্গপূর্ণ কৃষ্ণবর্ণ মৃগ অগ্নিতে পাক করিয়া আনিলাম, আপনি এক্ষণে গৃহে যাগ আরম্ভ করুণ।”
অতএব ঝলসানো মাংস সে যুগেও ছিল যা এখন কেবাব বা কাবাব নামে সমাদৃত।
সুন্দরবন কাণ্ডের অনুবাদে দেখি সোনার লঙ্কাতেও পানশালায় শূলপক্ব মৃগমাংসের এলাহি প্রস্তুতি।
“ওই পানগৃহে বিবিধরূপে আহার্য প্রস্তুত; মৃগ, মহিষ, বরাহ মাংস স্তূপাকারে সঞ্চিত আছে। প্রশস্ত স্বর্ণপাত্রে অভুক্ত ময়ূর ও কুক্কুট মাংস, বরাহ, বাধ্রীণমাংস এবং শূলপক্ব মৃগ মাংস, নানারূপ কৃকল, ছাগ, অর্ধভুক্ত শশক এবং সুপক্ব এলশল্য মৎস্য প্রচুর পরিমাণে আহৃত আছে” শুধু তাই নয় তা দধি-লবণ সহযোগে রাখা রয়েছে। অর্থাৎ সেই আমাদের মত ম্যারিনেশন।
অতএব আজকের কাবাব আর সে যুগের শূলপক্ব মাংসখণ্ডের বড় একটা তফাত নেই।
বনবাস নাহয় বাদই দিলাম রামায়ণে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আগমনে ও বশিষ্ঠদেব কর্তৃক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজনে দশরথ যে বিশাল ভোজসভা করেছিলেন সেখানে সবাইকে নিমন্ত্রণ করে যেসব খাওয়ানো হয় সেই খাদ্যের সম্ভারে বেশ উদারতা লক্ষণীয়। দেবাতদের উদ্দেশ্যে তিনশত পশু, হাজার পক্ষী, অশ্ব, মৎস্য এবং অন্যান্য জলচর প্রাণী বধ করা হয়েছিল। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ বলে কথা। রাণী কৌশল্যা যজ্ঞের শেষে চরু বা পায়েস ও আম গ্রহণ করেন। সে যুগে উত্তরভারতের কাশী-কোশল-মথুরা সহ অযোধ্যাতেও এই পায়েস-পিঠের সঙ্গে অপুপ, কৃশর, মণ্ডা, প্যাঁড়া, লস্যি, ঘোলের প্রচলন ছিল। তবে রাজখাদ্য ছিল পলান্ন বা মাংসভাত।
মূল রামায়ণের একটি শ্লোকে বনবাসে থাকাকালীন রামচন্দ্র ভাগীরথী কথা দিচ্ছেন এই বলে… “সুরাঘটসহস্রেণ মাংস ভূতৌ দানেন চ” অর্থাৎ ফেরার পথে তিনি সুরা ও পলান্ন দিয়ে নদীকে অর্চনা করবেন। আবার বনবাসের প্রথম রাতেই লক্ষ্মণ ও সীতা কে নিয়ে যা খেয়েছিলেন সেখানেও বরাহ ও মৃগমাংসের উল্লেখ।
“তৌ তত্রা হত্বা চতুরো মহামৃগান বরাহ মৃশ্যং পূজ্যতং মহারুরম”।
রামায়ণের খাওয়াদাওয়া প্রসঙ্গে ‘বাঙালি খাদ্যের অজানা কথা’ প্রবন্ধে লেখক সাইফুর রহমনের লেখাটির গুরুত্ব আছে। “রামায়ণে সীতা রামের সঙ্গে ১৪ বছর দণ্ডকারণ্যে বনবাসে কাটালেও একদিনের জন্যও সীতাকে রান্না করতে দেখা যায় না। সবসময় রামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণকেই খাবারের জোগাড়যন্ত্র করতে দেখা যায়।”
আর এজন্যই বোধহয় বুদ্ধদেব বসু তার ‘ভোজনশিল্পী বাঙালি’ গ্রন্থে আক্ষেপ করে লিখেছেন- ‘বনবাসী রাম-লক্ষ্মণকে আমরা মাঝে-মাঝেই দেখি মৃগয়া-হতে রাশি-রাশি পশু নিয়ে বাড়ি ফিরতে… গোসাপ, বুনো শুয়োর, নানা জাতের হরিণ; পুঁথিতে এও পড়া যায় যে তিনজনেরই প্রিয় খাদ্য ছিল শল্যপক্ক্ব মাংস- যাকে আমরা আজকাল বলি শিক-কাবাব; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত আর কোনো তথ্য জোগানো হয়নি। মৃত পশুর ছাল-চামড়া কে ছাড়াতো, কে কাটতো টুকরো ক’রে, কে ধরাতো উনুন, শিকে বিঁধে আগুনে ঝলসাবার ভার থাকত কার ওপর, কোন ধরনের পানীয়ের সঙ্গে সেই ‘অগ্নিতপ্ত পবিত্র’ মাংস কণ্ঠনালি দিয়ে নামিয়ে দেয়া হ’তো, সঙ্গে থাকত কোন কোন ফল অথবা সবজি – এই সবই স্রেফ আমাদের কল্পনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
মধ্যযুগের বঙ্গসাহিত্যে বাঙালির খাবারদাবারের প্রসঙ্গ রয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে। তিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসেছেন স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র, ‘সূক্ষ্ম অন্ন সহ আর পঞ্চাশ ব্যঞ্জন।’ রাম ভোজনরসিক ছিলেন, না কি পেটুক সে অন্য বিতর্ক। কিন্তু প্রবল পরাক্রমশালী বীরের খাদ্যতালিকায় পঞ্চাশটি ব্যঞ্জন থাকা আশ্চর্যের কিছু নয়। অথচ এই রামই যখন অনার্য গুহকের আতিথ্য গ্রহণ করছেন তখন তিনি খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে সংযত। সেখানে শুধু ফলাহারেই তিনি সন্তুষ্ট— “নানাবিধ ফল খাব কদলী কাঁঠাল। / সরঙ্গ নারঙ্গ আদি পাইব রসাল॥” বাঙালির নিজস্ব ফল খাওয়ার সংস্কৃতি কিন্তু অনেকদিনের।
রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডেই রয়েছে এই গল্প। গুহক মিতার আতিথ্য গ্রহণকালে রামচন্দ্র গুহক ব্যাধের যত্নে দেওয়া খাবার মুখে না তুললেও শুধু ঘোড়ার খাদ্য হিসেবেই তা গ্রহণ করলেন। আবার গুহকের কুটিরের বাইরে এসেই সেই রামচন্দ্র লক্ষ্মণের সঙ্গে মৃগয়া করে হরিণ বধ করে নিয়ে এলেন ও সানন্দে সেই মাংস ভক্ষণ করেন। জাতপাতের ছুতমার্গ দূরে সরিয়ে রেখেই বলি রামচন্দ্রের কিন্তু মাংস ভক্ষণে কোনোরকম আচার বিচার ছিল না।
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য বাল্মীকির রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের দ্বিপঞ্চাশ সর্গে বলেছেন সীতার গঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় গঙ্গাকে গরু নিবেদন করার কথা।
“জানকি গঙ্গার মধ্যস্থলে গিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, গঙ্গে! এই রাজকুমার তোমার কৃপায় নির্বিঘ্নে এই নির্দেশ পূর্ণ করুন। ইনি চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে বাস করিয়া পুনরায় আমাদের সহিত প্রত্যাগমন করিবেন… দেবী! আমি তোমাকে প্রণাম করি। রাম ভালয় ভালয় পৌছিলে এবং রাজ্য পাইলে আমি ব্রাহ্মণগণকে দিয়া তোমারই প্রীতির উদ্দেশ্যে তোমাকে অসংখ্য গো ও অশ্ব দান করিব, সহস্র কলস সুরা ও পলান্ন দিব।”
অতএব হিন্দুশাস্ত্রে বিশেষ উপোস বা পাল পার্বণের দিনে নিরামিষ খাওয়ার বিধান থাকলেও বাকী দিনগুলিতে আমিষ খাওয়ার ব্যাপারে কোনও ছুতমার্গ নেই। রামায়ণ তার অন্যতম প্রমাণ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগল।
Khub bhalo laglo
অনেক অজানা তথ্য সম্বলিত বলে সমৃদ্ধ হলাম 👌💐