rannaghar-bilashpurer-ek-tukro-goppo

বিলাসপুরের একটুকরো গপ্পো
পাঞ্চালী দত্ত


সকালের শীতের আদর মাখানো রোদের ঝিলিক ব্যালকনিতে পড়ে নাচের তালে দুলছে। বারো তেরো ফুট দূরেই রয়েছে সারি সারি ছাতিম গাছ। তাদের মাথার দুলুনিতেই রোদের ফালিগুলো দুলছে গোটা ব্যালকনি জুড়ে। পরিজ কখনো ছাতিম গাছ দেখেনি। সকালবেলায় মা চিনিয়েছে। শরৎ বলতেই যেমন আমরা বুঝি শিউলি ফুল, ঠিক তেমনি হেমন্তের ফুল হচ্ছে ছাতিম। গোটা হেমন্ত থোকা থোকা সাদা ফুলে ভরে যায় ছাতিম গাছ আর চারপাশে মিষ্টি গন্ধে জানান দেয় বর্তমান ঋতুকে। যদিও দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়াল হোটেলের ছাতিম গাছে ফুল নেই কারণ এখন শীত ঋতু। মা গায়ে আগুন রঙের শাল জড়িয়ে। পরিজ লক্ষ্য করেছে যখনই তারা বাইরে ঘুরতে যায় মা ঠিক যেন পরিজের মতই ছোট হয়ে যায়। রাগ করে না। চোখ বড় করে না। পরিজ মায়ের নাম দিয়েছে মুভিং ক্যামেরা। কিচ্ছুটি ফাঁকি দেবার জো নেই।

বাবা ডাকলেন, পরিজ দেখো, গাছে কী সুন্দর ঝুলে আছে বাবুই পাখির বাসা! তুমি দেখেছো কখনো ?

উহু, পরিজ সেটাও কখনো দেখেনি। কিন্তু কবিতায় পড়ে ও ছবিতে দেখে বাসাটিকে একবার দেখেই চিনে ফেলেছে। তিনজনের চান শেষ। এখন তারা যাবে ব্রেকফাস্ট রুমে। কাল রাতে হাওড়া টু মুম্বাই মেলে সন্ধে ৭:৪৫ এর ট্রেন ধরে সকাল ৭ টায় বিলাসপুর পৌঁছেছে। তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়াল হোটেলে। বাবা আগে থেকেই অনলাইন এ বুকিং করে রেখেছিল রুম। ঝকঝকে চারতারা হোটেলে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল পরিজের। একপাশে পর পর পাম গাছ দাঁড়িয়ে ঠিক মাপা দূরত্বে। ব্রেকফাস্টের জায়গাটা দারুন। পর পর খাবার সাজানো। দুটো বড় জারে রয়েছে ফ্রুট জুস। তাতে লেখা রয়েছে ফ্রেশ ওয়াটারমেলন জুস আর আরেকটায় পাইন্যাপেল জুস। দুটো রঙের জুস ভর্তি জারের দিকেই বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো তার। কিন্তু আগে কিছু খেয়ে তারপর জুস খাবে। তাই ‘ রোলস’ সেকশনের দিকে এগোলো। রয়েছে মাফিনস, ডোনাট, ক্রসান্ট , ব্রেড, হোমমেড চিজ বোরড উইথ গ্রেপল ইত্যাদি। হট বাফেতে রয়েছে স্টিউ ফ্রুটস/ভেজিস, হার্বড গ্রিলড চিকেন, পুরি সবজি, ছোলে ভাটুরে, লুচি ছোলার ডাল, স্টাফড পরোটা, ইডলি বড়া, উত্তাপম সঙ্গে সম্বর চাটনি, উপমা, পটেটো নানাভাবে রয়েছে যেমন বেকড, লেওনেইস, লেবানিজ। টি কাউন্টারে রয়েছে নানারকম হার্বল টি, যেমন তুলসি, হানি, লেমন। আর পাশেই রয়েছে কফি।


বাবা হোটেলকে আগেই গাড়ি ঠিক করে রাখতে বলেছিলেন। সুমোতে আমরা তিনজন উঠে পড়লাম। গন্তব্যস্থল মালহার। প্রাচীন ঐতিহাসিক এই জায়গাটি বিলাসপুর থেকে ৪০ কিমি দূরে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর আগের একটি বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গিয়েছে এখানে। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে রতনপুরার কালাচুরিস রাজত্বকালের কিছু ধ্বংসাবশেষও পাওয়া গিয়েছে। দশম এবং একাদশ শতাব্দীর মন্দির যেমন পাতালেশ্বর, কেদার মন্দির রয়েছে যেখানে গোমুখি শিবলিঙ্গ একটি দ্রষ্টব্য স্থান। কালাচুরিস শাসনকালে দিন্দেশ্বরী মন্দিরটি অন্যতম আকর্ষণীয় মন্দির। সবুজ লনে ঘেরা চত্বর। তার মাঝখানে রয়েছে ভিম কিচক মন্দির এবং সেখানে রয়েছেন শিব। এটাকে দেওর মন্দিরও বলা হয়। গর্ভগৃহের দুই দরজার পাশে গঙ্গা ও যমুনার মুর্তি রয়েছে এবং তার পাশে দ্বারপালের মুর্তি। প্রায় ভগ্নস্তুপ এই মন্দিরে শিবের নানারকম ভঙ্গিমার মূর্তি রয়েছে। এখানে একটি মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে বহু প্রাচীন ভাস্কর্য সংগ্রহে রাখা আছে। নানারকম মূর্তি, মুদ্রা, তাম্রপত্র ইত্যাদির সূত্র ধরে বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু , শৈব এসব ধর্মের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। আশেপাশে স্তূপ করা আছে পাথরের মূর্তির ভগ্নস্তূপ। প্রায় দুটো বাজে। মালহার মোটামুটি দেখা শেষ। এবারে লাঞ্চ সেরে মাডকু দ্বীপ দেখা ও সেখান থেকে হোটেল ফেরা। পরিজরা যেখানেই ঘুরতে যায় সেখানের আঞ্চলিক খাবার অবশ্যই চেখে দেখে। ফলত দুপুরের লাঞ্চ সারা হলো মুঠিয়া, আমাত, চিলা, বড়া, ফারা, বাফুরি, ডুবকি কড়ি দিয়ে। মালহার মন্দির দেখার ফাঁকে ওখানের স্ট্রিট ফুড ভাজিয়া খেয়েছিল। মা সব খাবারগুলোকে একটু আধটু করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। যেমন এখানের ভাজিয়া মূলত বেসন দিয়ে কোট করা হয়। সেটাতে থাকে কখনো লঙ্কা, পেঁয়াজ কিংবা আলু। মুঠিয়া চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করা হয় এবং এটা হলো একধরনের ভাপা আইটেম। এখানে ব্রেকফাস্টে ভীষন চলে। আমাতকে বলা যেতে পারে এখানের লোকাল সম্বর। চিলা হলো চাল ও বিউলি ডালের ব্যটার দিয়ে বানানো একপ্রকার গোলা রুটি। ফারা হলো চালের গুঁড়ো জল দিয়ে মেখে আঙ্গুলের মত লম্বা করে স্টীম করা হয়। তারপর তাতে নানারকম মশলা ফোড়ন দেওয়া হয়। ডুবকি কড়ি রান্নাতে দই দিয়ে গ্রেভি করা হয় এবং তাতে মেশানো হয় পকোড়া। সবগুলোই আমরা অল্প অর্ডার করে খেলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে এবারে গাড়িতে উঠে পড়লাম। লোকেশন … মাডকু দ্বীপ। শিবনাথ নদীর তীরে এই দ্বীপ। বলা হয় ব্যাঙের মতো দ্বীপের আকৃতি বলে এর নাম মাডকু। আরেক মতে, ঋষি মান্ডকু এখানে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তাই এই জায়গার নাম মান্ডকু বা মাডকু। ২৪ হেক্টর জায়গা জুড়ে সবুজ গাছপালা এবং নদী। শুধুমাত্র তাই-ই নয়, এখানে প্রত্নতত্ত্বের বহু খোঁজ পাওয়া গেছে। যেমন নানারকম পাথরের সরঞ্জাম, লিপি, মুদ্রা ও শিলালিপি যেখানে ব্রাহ্মী ও শঙ্খ লিপিতে লেখাও মিলেছে। শিব, গণেশ, পার্বতী, নন্দী এরকম বহু মুর্তি রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা খননের মাধ্যমে ১৯ টা মন্দির এখান থেকে উদ্ধার করেছে যার মধ্যে ১৮ টা মন্দির পূর্বদিকে এবং ঠিক মধ্যখানে যে মন্দিরটি রয়েছে তার মুখ পশ্চিমদিকে। মন্দিরের নমুনা, ভাস্কর্য দেখে অনুমান করা যায় এগুলো কালাচুরিস রাজত্বকালের… সব মিলিয়ে পর্যটকদের জন্য একটি দারুন জায়গা মাডকু দ্বীপ।

হোটেলে ফিরতে বেজে গেল রাত আটটা। ফিরে চান করে আমরা পৌঁছে গেলাম দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়াল এর গোঁরমে গ্লোবাল রেস্তোঁরায়। সবার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। বাবা এইমুহুর্তে ফুল মুডে। স্টার্টার হিসেবে এখানকার সিগনেচার ডিশ অর্ডার করলেন লাত মাই কাই আর অ্যাপল কর্ন কাবাব। আহা! গরমাগরম অপূর্ব! সঙ্গে চাটনি। স্টার্টারের পর মেন কোর্স অর্ডার হলো।

লাহোরি মুরগ তারিওয়ালা, জিরা রাইস, পনির কলিওয়ারা, মিক্স ডাল, পটেটো ফিঙ্গার আর শেষে সিজনিং ব্রাউনি।

মা মন দিয়ে মেনুটা পড়ছিলেন। বাবা মাকে বললেন, মিষ্টি ভালো করে খাবার টেস্ট করে নাও। বাড়ি গিয়ে কিন্তু এরকম রান্না করে খাওয়াতে হবে। মা হেসে ফেললেন। বললেন তাহলে রেস্তোঁরাগুলোর কি হবে! রুমে ফিরে এসে পরদিনের প্ল্যানিং হলো। আগামীকাল রতনপুর। সেখান থেকে যদি সময় বের করা যায় তাহলে তালা এবং তালা থেকে সোজা হোটেল। মজার কথা হচ্ছে যে বিলাসপুর থেকে এই পর্যটনের জায়গাগুলো কাছাকাছি। তাতে সময় অনেকটাই সাশ্রয় হয়। আজ সকালে পরিজ সাউথ ইন্ডিয়ান ফুড দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছে হোটেলে। ইডলি বড়া, উত্তাপম, আর জুস।


বিলাসপুর থেকে ২৫ কিমি দূরত্বে রতনপুর। রতনপুর ফোর্ট, সতীপিঠ এবং প্রচুর মন্দির রয়েছে এখানে। ফোর্ট বলতে পরিজ ভেবেছিল সেই দুবছর আগে দেখা বিকানের, জয়সলমির ফোর্টের মত। কিন্তু রতনপুর ফোর্ট সেরকম বিশাল কিছু নয় এবং যাও ছিল সেটাও প্রায় ভগ্নস্তুপ বর্তমানে। তবে পর্যটকদের জন্য জায়গাটির প্রচুর গুরুত্ব রয়েছে। ফোর্টের সিংহদ্বারে রয়েছে খোদাই করা কিছু মুর্তি যার চাকচিক্য অনেকটাই ম্লান। গণেশদ্বারে গণেশের মুর্তি ও নানারকম পাথরের মুর্তি দিয়ে সাজানো রয়েছে দ্বার ও দেয়াল। দুর্গের ভেতরে রয়েছে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, শিব মন্দির, হাম্মাম ( স্নানাগার ), সবুজে ঘেরা সাজানো বাগান, কুয়ো এবং ফোর্টের প্রধান কিছু জায়গার ধ্বংসাবশেষ। প্রচুর মন্দির ও জলতালা দিয়ে ঘেরা একটি ছোট্ট শহর যেখানে রয়েছে মহামায়া মন্দির, বাহান্ন সতীপিঠের মধ্যে অন্যতম। ১২ থেকে ১৩ শতাব্দীতে এই মন্দিরটি রতনপুরের কালাচুরিস রাজত্বের সময় তৈরি করা হয়েছিল। তখন বর্তমান ছত্তিশগড়ের নাম ছিল কোসাল। তাই এখানের মহামায়া কোসালেশ্বরী দেবী নামেও পরিচিত।

লাঞ্চের সময় বাবা ড্রাইভার দাদাকে বললেন যদি ছত্তিশগড় থালি বলে কিছু থাকে তাহলে আজ সেটা টেস্ট করবেন। সবজায়গাতেই আঞ্চলিক থালি প্রায় দেখা যায় এবং সেটার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় সেই জায়গার রান্নার আসল ফ্লেভার। ড্রাইভারদাদা আমাদের একটা ধাবা মতো রেস্তোঁরায় নিয়ে গেলো। থালিতে এলো ভাত, চৌসেলা ( একধরনের পুরি ), বড়া, চাটনি, ছোলে, কড়ি, ডাল ফ্রাই, করেলা চানা কি সবজি বড়ি, রুটি ঘি আর খুরমি(একধরনের মিষ্টি ) যার মধ্যে গুঁড় ও আটা প্রধান উপকরণ। খাওয়া দাওয়া সেরে রওয়ানা দিলাম তালা। ৭ ফুট বিশিষ্ট রুদ্র শিবের পাথরের মুর্তি। এটাকে দেবরানী ও জেঠানী মন্দিরও বলা হয়। কথিত যে পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাজা রাজপ্রাসাদের দুই রানীর নির্দেশে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। দেবরানী মন্দিরটি লাল পাথর দিয়ে তৈরি যা গুপ্তান শৈলীতে তৈরি আর জেঠানি মন্দিরটি তৈরি কুষাণ শৈলীতে। পাথরের পর পাথরে শুধু খোদাই করা মুর্তি। মুর্তিগুলোকে দেখলে মনে হয় কত ইতিহাসের তারা সাক্ষী বহন করে চলেছে। হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম রেস্তোরাঁয়। পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে টেবিল চেয়ার। অন্দরসজ্জার সঙ্গে রয়েছে মানানসই টেবিল ক্লথ ও আলোকসজ্জা। আজ বাবা অর্ডার করলেন ফিশ রেচাড, দিওয়ানি হান্ডি আর রাইস। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কিছু পছন্দের খাবার অর্ডার করবেন কি না। সেদিন পনির কোলিওয়ারা আমার ভীষন ভালো লেগেছিলো। আজ তাই সেটাকে একটু পাল্টে নিয়ে নিলাম ফিশ কলিওয়ারা। ওহ, আর স্টার্টারে পাঁচফোড়ন গ্রিল চিকেন। বাবা ফুড লাভার। আমিও খুব এনজয় করি। মনে হচ্ছে আজ দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়ালে কিছু প্রাইভেট অনুষ্ঠান রয়েছে। কী যে সুন্দর লাগছে সবুজে মোড়া লন! চারদিকে আলোর রোশনাই। হোটেলের ডেস্কে অর্থাৎ রিসেপশনের দায়িত্বে যিনি থাকেন তিনি বলছিলেন সেদিন যে এখানে ২০০০ থেকে ২৫০০ অতিথি নিয়ে যে কোনো অনুষ্ঠান খুব ভালোভাবে করা যায়। সর্বমোট ৭০ টা রুম রয়েছে হোটেলে ও একটি ব্যানকোয়েট হল। টেবিলে বসে প্ল্যানিং হচ্ছিল আগামীকালের গন্তব্যস্থল এবং সেটা হলো অচানকমার টাইগার রিজার্ভ। কাল ওদিকটা ঘুরে এসে তারপর সম্ভব হলে বিলাসপুর শহরটা দেখা। পরশু সকালে ফিরে যেতে হবে। বাবা এবারে খুব বেশি ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি।


সকালে রওয়ানা দিলাম অচানকমারের উদ্দেশ্য। এই দুদিনে ড্রাইভারদাদার সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেছে। বাবাকে খাবার নিয়ে এত উৎসাহিত দেখে আজ বলেছিল সম্ভব হলে এখানকার ট্র্যাডিশনাল একটা রুটি খাওয়াবে যার নাম অংগাকর রোটি বা পান রোটি। এটা মূলত চালের গুঁড়ো মেখে পাতার মধ্যে মুড়ে উনানে দিয়ে সেঁকে তারপর খাওয়া হয় চাটনি কিংবা তরকারি দিয়ে। যদিও এই খাবারটা পাওয়া খুবই মুশকিল ইদানিং। ড্রাইভারদাদা বলছিল সময় পেলে বাড়ি থেকে তৈরি করে এনে খাওয়াবে। কিন্তু সে আর এযাত্রায় হবে না। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ৭০ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম অচানকমার। শাল, বিজা, সাজা ও বাঁশের জঙ্গল যেখানে রয়েছে বেঙ্গল টাইগার, লেপার্ড, নীলগাই, সম্বর, ডোরাকাটা হায়না, চিতল, বাইসন এধরনের নানারকম পশু। মুঙ্গেলি জেলায় এই রিজার্ভটি। বিকেল সন্ধের মধ্যেই চলে এলাম হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়াল হোটেলের ক্যাফে কাউন্টারে। খুব সুন্দর কফির ফ্লেভারে মেতে উঠেছে আশপাশ। বাবা মা দু কাপ কফি নিল। আমি বললাম আইসক্রিম খাবো। মা বললেন এই ঠান্ডায়! কিন্তু আমার ঠান্ডায় আইসক্রিম খেতে দারুন লাগে। বাবা একজনকে আইস্ক্রিম আনতে বললেন। কিছুক্ষণ পর বিলাসপুর শহরটা একটু বেড়িয়ে এলাম। মন খারাপ। কাল ফিরে যেতে হবে। অনেক কিছু দেখা বাকি থেকে গেলো। বাবা বললেন , কলকাতা থেকে খুব তো দূর নয় ছত্তিশগড়। আবারো ছোট্ট ছুটিতে চলে আসবো। রাতে অর্ডার করলাম কর্ন মাশরুম সুপ। দারুন লাগছিল খেতে।

মেন কোর্সে অর্ডার করা হলো রসা অমলেট। এটা হলো একটা গোয়ানিজ রান্না আর দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়ালের একটা সিগনেচার ডিশ। শুনে উৎসাহটা বেড়ে গেলো। এছাড়া বাঙালি পদ এখানের একটাও চেখে দেখা হয় নি, তাই বাবা অর্ডার করলেন চিংড়ি মালাইকারি আর সাদা ভাত। ভাবছিলাম, গত দুদিন রাতে এখানে বসে পরদিন কোথায় যাবো সেটার প্ল্যান হতো, আর আজ প্ল্যান হচ্ছে আগামিকাল কখন বেরোবো, ট্রেন ধরবো।

আজ ড্রাইভারদাদা বলছিল ৪০ কিমি দূরে রয়েছে কোতমি সোনার। অসাধারণ একটি কুমিরের পার্ক যা ১২০ একর জায়গা ঘিরে রয়েছে এবং তার মধ্যে ৮৫ একর জায়গা জলে পরিপূর্ণ। প্রায় ২০০ টির ওপর রয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক কুমির এবং তার সঙ্গে রয়েছে প্রচুর কুমির ছানা। এছাড়া এখানে নানাধরনের পাখিও দেখা যায় যারা উড়ে আসে বহুদূর থেকে। পাখিদের ডাক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পর্যটকদের পরিপূর্ণভাবে মনপ্রাণ ভরিয়ে তোলে এই জায়গা।


সরগুজা জেলার প্রসিদ্ধ পাহাড়ি এলাকা হল মৈনপাট। এখানে নদী উল্টোদিকে বয়ে চলে। তাই এই জায়গাকে উল্টাপানিও বলা হয়। বৈজ্ঞানিকদের মতে পৃথিবীতে এই ধরনের ৬৪ জায়গা রয়েছে যেখানে মাধ্যাকর্ষণের থেকেও চুম্বকীয় শক্তির প্রভাবে জল উল্টোদিকে বইতে থাকে। বিলাসপুর থেকে মাত্র গাড়িতে ৫ ঘণ্টার জার্নি। এছাড়া খুতাঘাট ড্যামটিও দেখার মত একটি জায়গা। এছাড়া রায়পুর ও ছত্তিশগড়ের অন্যান্য জায়গায় রয়েছে দারুন সব দেখার জায়গা। যত শুনছিল পরিজ, দেখার খিদেটা ততটাই বেড়ে যাচ্ছিলো ঠিক যেমনটি দ্য আনন্দ ইম্পেরিয়ালের

মাল্টিকুইজিন রেস্তোরাঁয় খেতে বসলেই শুধু মনে হয় কোন খাবারটা মিস হয়ে গেলো এবারের মত।

হোটেলের সবার ব্যবহার, সার্ভিস, পরিচ্ছন্নতা, কোভিডকালীন সতর্কতা, সুস্বাদু খাবার সব মিলিয়ে দারুণ অনুভূতি। ড্রাইভারদাদা ট্রেনে তুলে দিল আমাদের। কিছুক্ষণ পর ট্রেন চলতে শুরু করলো। পেছনে ফেলে এলাম রাজাদের কত গল্প, মূর্তি, মন্দির, ইতিহাস, খাবার। সত্যি ভারতবর্ষের মাটিতে, পাহাড়ে, সমুদ্রে, নদীতে, আকাশে, বাতাসে শুধু ইতিহাসের চাপা নিঃশ্বাস। পরিজ শুনতে পায়। তারা ফিসফিস করে কথা বলে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *