rannaghar-gurer-jilapi

গুড়ের জিলাপি
মারজানা ইসলাম মেধা



ভারতীয় উপমহাদেশে এই জিলাপি প্রায় হাজার বছর ধরে স্বমহিমা এবং প্যাঁচ নিয়ে বিরাজ করছে। জিলাপি তার প্যাঁচ অপরিবর্তিত রেখে তুর্কি, মোগল, ইংরেজ, পাকিস্তানি শাসকদের যুগ অতিক্রম করে ডিজিটাল বাংলাদেশে পদার্পণ করেছে। হাজার বছরের বাংলার ইতিহাস নানান উত্থান-পতনের। বড় বড় দ্বিগ্বজ শাসক এ দেশ শাসন করেছেন, দেশের নানান পরিবর্তন ঘটিয়েছেন কিন্তু জিলাপিকে সোজা করতে পারেননি—সে প্যাঁচালোই থেকেছে বরাবর। সেই জন্য গ্রামবাংলায় জিলাপির আড়াই প্যাঁচ বলে একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে।

জিলিপি বলে আমরা যাকে খাই তার জন্ম এশীয় দেশ ইরানে। একটি ঐতিহাসিক রান্না সংক্রান্ত বই মহম্মদ বিন হাসান আল বাগদাদীর লেখা কিতাব উল তাবিক – যা দশম শতকে লেখা। এই বই থেকে জানা যায় জুলবিয়া বলে একটি মিষ্টির কথা। আবার সায়ার ওল ওয়ারাকের লেখা প্রায় এই সময়কারই আরেকটি আরবীয় বই থেকেও ঐতিহাসিকরা ‘জুলবিয়া’র কথা জানতে পারেন। মনে করা হয়, এই ‘জুলবিয়া’ই ভারতে এসে ‘জালেবি’ বা বাংলায় ‘জিলেপি’ হয়েছে। তবে ইহুদিদের দাবী অনুযায়ী তাঁরা নাকি আরো আগেই জিলিপির মত এক মিষ্টির আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তবে সেই বিষয়ে কোনো ঐতিহাসিক পুথি বা বই কিন্তু পাওয়া যায় না।

পারস্যের ‘জুলবিয়া’ই যে আমাদের জিলেপি তার প্রামান্য ইতিহাস পাওয়া যায়। ইরানে আজও নববর্ষের দিন তাদের অধিবাসীদের কাছে ‘জুলবিয়া’ খাওয়ার রেওয়াজ আছে, আবার রমজান মাসে মুসলিমরা দরিদ্রদের মাঝে অকাতরে ‘জুলবিয়া’ বিতরন করে আজও। তারা এতটাই শুভ ভাবে এই মিষ্টান্নকে। এবং সেখানকার রাস্তায় আমাদের বাংলার মতই এই রসালো মিষ্টিটি বিক্রিও হতে দেখা যায়।

তবে এ বিষয়ে জানিয়ে রাখা দরকার যে, ইরানের ‘জুলবিয়া’ আর আমাদের ‘জালেবি’ স্বাদে এবং তৈরির উপকরন প্রায় এক রকম হলেও এর গঠনে কিন্তু তফাৎ রয়েছে। ইরানের জুলবিয়ায় আমাদের এখানকার মত প্যাঁচ নেই, বরং সেগুলো আকারে ফুলের মত। আবার কিছুটা মধ্যপ্রাচ্যে যদি আরো যাওয়া যায় সেখানে দেখা যাবে জালবিয়ার আকারেই একই রকম মিষ্টিই তবে তার স্বাদে কিছুটা ফাঁরাক।চিনির রসের বদলে সেখানে ব্যবহার করা হয় গোলাপজল ও মধু।

এবার আপনাদের অনেকের মনে হতেই পারে যে, এই জালবিয়া কিভাবে আমাদের দেশে জালেবি হয়ে ঢুকে গেলো? সেখানেও কিন্তু আরেক ইতিহাসের গল্প। পনেরশো শতকের শেষ নাগাদ পারস্যের মুসলিম বনিকরা আমাদের দেশে ব্যবসা বানিজ্যের উদ্দেশ্য আসেন। মনে করা হয় তাদের হাত ধরেই এদেশে জালেবির প্রচলন। এবিষয়ে ‘প্রিয়মকর্নপকথ’ বলে ১৪৫০ দশকের একটি জৈন্য গ্রন্হের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানেই কিন্তু প্রথম ভারতীয় মিষ্টি হিসেবে জিলিপির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেই বইতে এর নাম ছিল কুন্ডলিকা বা জলভাল্লিকা। পরবর্তী কালের বেশ কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃত বই যেমন ‘গুণাগুনবোধিনী’, ‘ভোজন কুতহল’ প্রভৃতিতে জিলিবি তৈরির কৌশল ও পদ্ধতি সম্পর্কে লেখা পাওয়া যায়। তবে জালেবি বা জিলিপি তে আড়াই প্যাঁচ থাকার কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তবে কিছুটা পেঁচিয়ে এটা তৈরি করা হত যাতে কিছুটা কড়া পাঁকের হয় তার জন্যই।

আবার, জালেবীর সাথে অন্যান্য অনেক খাবারের মতই ‘মোঘল আমলের’ ও যোগ আছে। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এই ঘিয়ে ভাজা রসে ডোবানো প্যাঁচানো মিষ্টির এতটাই প্রেমে পড়ে যান যে সে জালেবীর নাম দেন তাঁর নিজের নামে জাহাঙ্গীরা। দিল্লিতে আজও বহু জায়গায় জালেবী রূপে জাহাঙ্গীরা কিনতে পাওয়া যায়।

তারমানে এটা বোঝাই গেলো জালেবী বা জিলেপি বিদেশী হলেও এর সাথে গোটা ভারতবাসী তথা বাঙালির কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক। এছাড়া আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল (এখানে এর নাম জেরি), পাকিস্তান, বাংলাদেশেও এর প্রচলন বেশ ভালো ভাবেই রয়েছে। আবার বহু জায়গায় জালেবীর উপকরন বা গঠনেও কিছু বদল এসেছে। আমাদের বাংলায় যেমন ছানা দিয়ে তৈরি হয় ‘ছানার জিলিপি’ তেমনই আবার মধ্যপ্রদেশে ‘মাওয়া জিলিপি’। আবার বাংলাদেশে ঢাকার ‘শাহী জিলিপি’ ‘গুড়ের জিলিপি’ পাওয়া যায় যা পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যকে আজও বহন করছে। সেইসাথে বাংলাদেশেরই ময়মনসিংহ জেলায় চালের গুড়োর সাথে তেতুলের টকের সাথে তৈরি করা হয় ‘টক জিলিপি’ যা চিকেনের সাথেও খাওয়া হয়। এখন এমন কিছু তথ্য বলবো তা শুনে আপনারা আশ্বস্হ হবেনই আর আজ জিলেপি খাবেনই শিওর…

তাহলে শুনুন জিলেপি খেলে হয় শরীরের জন্য অনেক উপকার হয় কিন্তু। একটি জিলিপি খেলে আপনি পাবেন ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিনও। এতসব পুষ্টিগুনে যাদের মাইগ্রেনের ব্যাথা তা দূর হতে পারে তা ডেইলি দুটো জিলিপি খেলে। আবার যাদের ওয়েট বাড়ছে না দূর্বল শরীর তারা যদি প্রতিদিন টক দই এর সাথে দুটো করে জিলিপি খান সকালবেলা তাহলে তার দ্রুত ওয়েট বাড়তে বাধ্য। আবার জিলেপি খেলে মানসিক চাপও নাকি কাটানো যায়। এসব কিন্তু সব ঘরোয়া টোটকা, কোনো ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন নয়। আরে একবার ট্রাই করে দেখুনই না, আর কিছু না হোক রসনার তৃপ্তি তো হবেই। মেলা হোক, বা পাড়ার দোকান কিংবা বিয়ে বাড়ির হাল আমলের স্টলে যেখানে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডেসার্ট সবেতেই বাঙালির প্রিয় এই জিলিপি। যার প্যাঁচে মজে আমরা সবাই।

তাই সময় আর শেষ না করে চলুন বানিয়ে ফেলি ক্যামিকেল মুক্ত “গুড়ের জিলাপি”

উপকরণ

ময়দা ১ কাপ,
বেকিং পাউডার ১/৩ চা চামচ,
মাস কালাইয়ের ডাল ১/৪ কাপ

সিরার উপকরণ:

গুড় ২ কাপ,
লেবুর রস ১ টে চামচ,
এলাচ গুঁড়া ১/২ চা চামচ,
ভাজার জন্য ঘি পরিমাণ মতো,
পানি পরিমাণ মতো

প্রণালি

মাস কালাইয়ের ডাল কয়েক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখার পর ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন। এরপর একটা বড় বাটিতে বেকিং পাউডার আর ময়দা একসাথে ভালো করে মিশিয়ে নিন। এবার এতে পরিমাণ মতো পানি (১/৩ কাপ পানি) দিয়ে পাতলা ব্যাটার তৈরি করে নিন। এরপর ডালের পেস্ট দিয়ে ভালো করে আবার মিশিয়ে নিন। এখন একটা হাঁড়িতে গুড় এবং দেড় কাপ পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে সিরা বানিয়ে নিন। এরপর এলাচ গুঁড়া এবং লেবুর রস দিয়ে মিলিয়ে চুলা বন্ধ করে হাঁড়ি নামিয়ে রাখুন। এবার চুলায় প্যান বসিয়ে ঘি ঢেলে গরম করে পাতলা করে নিন। এখন পাইপিং ব্যাগে অথবা কেচাপের বোতলে ব্যাটার ভরে জিলাপি বানিয়ে মাঝারি আঁচে বাদামি করে ভেজে নিন। তারপর সিরায় ডুবিয়ে দুই পিঠ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ রেখে অন্য পাত্রে তুলে রাখুন।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “rannaghar-gurer-jilapi

  1. অপূর্ব, , বানানোর পদ্ধতি থেকেও ,জিলিপি সম্পর্কে জেনে আমি, পাগল হয়ে গেছি, এই প্যাঁচের যে এত ইতিহাস আমি কেন বহু মানুষের অজানা, খুব ভালো লাগল এত কিছু জেনে, সত্যি ই প্যাঁচ এর প্রেমে পাগল আমরা, আরো নতুন কিছু জানার অপেক্ষা য় রইলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *