পাঞ্চালি দত্ত
কিশোরীর মত ছটফট করে চলেছেন সতী। মা, বাবা ও সমাজকে তুচ্ছ করে দিয়ে বৈরাগী স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছেন সতী ও সমস্ত পার্থিব সুখ ছেড়ে কৈলাসবাসী আপাতত। তিনি আজ স্বামীর কথা অমান্য করতে পিছপা হচ্ছেন না একটুও। তাতে দুজনের মধ্যে মত ও বিচারের বিস্তর ব্যবধান গড়ে উঠেছে, কিন্তু সতী এই মুহূর্তে বদ্ধপরিকর। পিতার বাড়িতে যে যেতেই হবে! পিতা দক্ষ এত বড় যজ্ঞের আয়োজন করেছেন, তাতে মেয়ে যাবে না! বিয়ে হয়ে গেলেই কি মেয়ে এতটাই পর হয়ে যায় যে বাবা আমন্ত্রণ না জানালেও যাওয়া যাবে না? সম্পর্কের বাঁধন কি এতই ঠুনকো? এই যজ্ঞে আত্মীয় স্বজন, বোনেরা আসবে। সবাই মিলে কত আনন্দ হবে আর সতী কি না কৈলাসে বসে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে? অগত্যা নাছোড়বান্দা সতীকে মহাদেব যাবার অনুমতি দিলেন তবে সহচর হিসেবে যাবে নন্দী। তিনি যজ্ঞস্থলে উৎসাহের সঙ্গে এলেন কিন্তু
“দেখিলেন মহাধুমধামে যজ্ঞ হয়। সকল দেবতাগণ উপস্থিত রয়।।
কেবল শঙ্করে নাহি করিল আহ্বান। সতীসহ মহেশ্বরে কৈল অপমান।।
তবে সতী পতি নিন্দা সহিতে না পেরে।
অচেতন হয়ে পড়ে যজ্ঞের ভিতরে।। ”
এবং নিজ যোগবলে অগ্নিদগ্ধ হন ও দেহত্যাগ করেন। মহাদেবের কাছে যখন এই খবর পৌঁছয়, তাঁর ক্রোধ, অগ্নিবৎ চোখ, ভয়ঙ্কর রূপ ও গাত্ররোম থেকে সৃষ্টি হল বীরভদ্র। দক্ষের যজ্ঞকে নাশ করে সতীর দেহকে কাঁধে নিয়ে শুরু করলেন তাণ্ডব নৃত্য। সৃষ্টির অবস্থা টলমল। তবে আজ সেই গল্পকে এখানে আর টানছি না কারণ আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য দেবীর ‘নয় অবতার’ ও নয় দিনের বিশেষ প্রসাদকে ঘিরে।
সতী পুনরায় জন্ম নিলেন গিরিরাজ হিমালয় ও মেনার ঘরে। পর্বতরাজ কন্যা, তাই নাম রাখা হলো পার্বতী। তিনি শৈলপুত্রী নামেও পরিচিত। শৈল অর্থাৎ ‘পর্বত’ এবং পুত্রী মানে ‘কন্যা’। তার ডান হাতে ত্রিশূল ও বাঁহাতে গোলাপী পদ্ম। একটি অর্ধচন্দ্র কপালে বিরাজমান। বছরে চারবার নবরাত্রি পালন করা হয়; শারদ নবরাত্রি, চৈত্র নবরাত্রি, মাঘ নবরাত্রি ও আষাঢ় নবরাত্রি। তার মধ্যে শারদ ও চৈত্র নবরাত্রি সমগ্র দেশে বিশেষভাবে পালিত হয়।
যদিও দেবীর প্রিয় খাবার সেভাবে উল্লেখ করা নেই পুরাণে, তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানারকম উপাচারে দেবীকে নৈবেদ্য দেওয়া হয়।
উত্তর ভারতে সেদিন দেবীকে ঘি নিবেদন করা হয়। বিশ্বাস, সেদিন শুদ্ধ ঘি দেবীকে নিবেদন করলে আরোগ্য লাভ হয়। এছাড়া ভোগে দেওয়া হয় মাখনা ক্ষীর, সাবুদানা বড়া, রাজগিরা লাড্ডু। দক্ষিণ ভারতে মাকে চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মিষ্টি, পড়াপ্পু,পায়াসম এধরনের খাবার নিবেদন করা হয়।
শৈলপুত্রী ছোটবেলা থেকেই শিব ভক্ত। দিনরাত শিবের পুজো ও ধ্যানে তিনি রত। শিব তাঁর কল্পনায় স্বামী। এদিকে সতীর দেহত্যাগের পর কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন শিব। সেই সুযোগে শুরু হয় অসুরের অত্যাচার। ব্রহ্মার বরে বলিয়ান তারকাসুর। কারণ ব্রহ্মা তারকাসুরকে অমরত্বের বর দিতে নারাজ হলে তারকাসুর এই বরটি চেয়ে নেয় যে একমাত্র শিবের পুত্র তারকাসুরের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তারকাসুর জানত যে বৈরাগী, শ্মশানচারী শিব কোনোদিনও সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন না। তাই মনে মনে ভেবেছিল যে সে আসলেই অমরত্বের বর পেয়েছে। কিন্তু বিধির বিধান আলাদা। নারদ এলেন পার্বতীর কাছে ও শিবকে স্বামী রূপে কীভাবে পাবেন সেই পথ বাতলে দিলেন।
“নারদের বাক্যমত পর্বত – তনয়া।
পার্বতী সুন্দরী সেই শিখরেতে গিয়া
ভক্তিভরে আপনার সখিদ্বয় সনে।
শঙ্করের পরিচর্যা করিছে যতনে।। ”
কিন্তু শিব অটল, অবিচল ও ধ্যানে গভীর আচ্ছন্ন। অতএব পুরন্দর শরনাপন্ন হন কামদেবের। কিন্তু শিবের ধ্যান ভঙ্গে কামদেবের ভূমিকা জানতে পেরে শিব অত্যন্ত রুষ্ট হন ও তিনি শিব রোষে ভস্মীভূত হন। পার্বতী এবারেও শিবকে পতিরূপে পেতে বিফল হলেন। ব্যথায় জর্জরিত পার্বতী কীভাবে শিবের ঘরণী হবেন এই চিন্তায় যখন কাতর, নারদের আগমন আবারো। পার্বতীকে উপদেশ দিলেন একমাত্র তপস্যা দ্বারা শিবকে স্বামী হিসেবে পেতে পারেন। পিতা মাতা থেকে আজ্ঞা নিয়ে চললেন বনে ধ্যান করতে। পুজো, যোগ, তপস্যা, ব্রত, উপবাসে বছরের পর বছর মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। পার্বতীর এই রূপকে বলা হয় ব্রহ্মচারীনি। শুধুমাত্র বেলপাতা ও জল খেয়ে তপস্যা করেছিলেন বলে শিব তাঁর আরেক নাম রাখেন, অপর্ণা। শ্বেতবস্ত্র আরাধনায় ব্রহ্মচারীনির প্রিয় খাবার চিনি। উত্তর ভারতে সেদিন মা কে চিনি ভোগে দেওয়া হয়। তাতে নাকি আয়ু বৃদ্ধি হয়। এছাড়া রাবড়ি, হালুয়া এরকম খাবারও দেবীকে ভোগে দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতে সেদিন মাকে দেওয়া হয় মিষ্টি বুঁদে, ছোলা ইত্যাদি।
শ্রী শ্রী চণ্ডী বা দেবী সপ্তসতীর উত্তর চরিত্রের সূচনায় দেবী চন্দ্রঘণ্টা মহাসরস্বতীর নবদুর্গা অবতারের তৃতীয় মূর্তি। পুরানমতে, শিব পার্বতীর বিবাহের দিনে অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য তারকাসুর দৈত্যবাহিনী নিয়ে হামলা করে। বিবাহকার্যে যাতে কোন বাধাপ্রাপ্ত না ঘটে তাই দেবী পার্বতী ত্রিনেত্র দশভুজা সিংহবাহিনী রূপে আবির্ভূতা হন ও চন্দ্রসম বিশাল ঘণ্টা বাজিয়ে দৈত্য বিতাড়ন করেন। আরেক মতে, শিব বিবাহকালে বিকট রূপ ধরে এলে মেনকা মূর্ছিতা হন। শিবের এই রূপ দেখে তিনি ধারণ করেন চন্দ্রঘণ্টা রূপ। দেবীর যোদ্ধা রূপ দেখে শিব নিজ রূপ সংবরণ করেন ও বিবাহের জন্য মনোহর চন্দ্রচূড় বা চন্দ্রশেখর রূপে বিবাহ সভায় উপস্থিত হন। দুধ অথবা দুগ্ধজাত কোন মিষ্টি সেদিন নিবেদন করলে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে লোকের বিশ্বাস। উত্তর ভারতে ভোগে দেওয়া হয় ক্ষীর, দুধ পেড়া, কাজু বরফি। দক্ষিণ ভারতে তৃতীয় দিনে মা কে দেওয়া হয় পুলিহরা, রাভা বেসরি।
মহাদেব যেমন সমুদ্র মন্থনের সময় সমস্ত হলাহল পান করে নীলকন্ঠ হয়েছেন , তেমনি দেবী আদ্যাশক্তি জগতের সর্বপ্রকার জ্বালা যন্ত্রণার হাত থেকে সন্তানদের সর্বদা রক্ষা করতে সক্রিয়। ত্রিতাপহারিনী মায়ের তাই আরেক রূপ কুষ্মান্ডা। সূর্য আমাদের জীবনদায়ী এবং দেবী কুষ্মান্ডা নিজেই সূর্যের সেই শক্তি। মালী ও সুমালী নামে দুই পরাক্রমী অসুর ছোটবেলা থেকে শিবের তপস্যা করেছিলেন ভীষন কঠিনভাবে। তপস্যা এতটাই তীব্র ছিল যে তাদের শরীর থেকে নির্গত আয়নের রশ্মি সবসময় প্রখর তেজে জ্বলজ্বল করত। তাতে সূর্যদেবের তাদেরকে দেখার প্রবল ইচ্ছে হল। তিনি তাঁর স্থান ছেড়ে পৃথিবীতে এলেন অসুরদের দেখতে। কিন্তু দুজনে ধ্যানে থাকার ফলে তারা সূর্যদেবের উপস্থিতি টের পেল না। সূর্যের উত্তাপে দুজন ছাই হয়ে গেল। শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন সূর্যের ওপর এবং ত্রিশূল নিক্ষেপ করলেন। সূর্যের মৃত্যু ঘটলে পিতা কাশ্যপ শোকে ভেঙে পড়লেন ও শিবকে অভিশাপ দিলেন যে তিনিও নিজে একদিন তাঁর সন্তানকে হত্যা করবেন। শিব পার্বতীর কাছে ছুটে গেলেন এই বিষয়কে সমাধান করতে। পার্বতী তার তেজের উগ্রতা দিয়ে আগুনের বলয় তৈরি করে পুনরায় সূর্যকে প্রাণ দান করেন। উত্তর ভারতে মাতা কুষ্মান্ডাকে চতুর্থ দিনে ভোগে দেওয়া হয় মালপোয়া। বিশ্বাস যে, এতে বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। দক্ষিণ ভারতে নৈবেদ্য দেওয়া হয় চাল ও গুড় সহযোগে নানা খাদ্যবস্তু। এছাড়া পোঙ্গলের বিশেষ পদগুলোও দেবীকে নিবেদন করা হয়।
কার্তিকেয় এর অপর নাম স্কন্দ এবং সেইজন্য দেবীর পঞ্চম রূপ স্কন্দমাতা হিসেবে পরিচিত। কার্তিকেয় তারকাসুর বধের জন্য জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি শিব পার্বতীর সন্তান। তাই দেবীর কোলে দেখা যায় ছয় মাথা বিশিষ্ট কার্তিক। শৈশবকালে কার্তিক যখন খেলায় মগ্ন ছিলেন তখন তারকাসুর তার সৈন্যদের নিয়ে কুমারকে বধ করতে আসেন। ভগবতী কার্তিককে রক্ষা করতে স্কন্দমাতার রূপ ধারণ করেন এবং সমস্ত অসুরদের বধ করেন। একদিকে তিনি ভীষনরূপা যিনি বিনাশে উদ্যত, অন্যদিকে মাতৃত্বের পরশে সন্তানকে আগলে রেখেছেন সব নকারাত্মক শক্তি থেকে। উত্তর ভারতে স্কন্দমাতার জন্য ভোগে দেওয়া হয় কলা। বলা হয় পঞ্চমীতে কলা অর্পণ করলে শরীর সুস্থ থাকে। দক্ষিণ ভারতের নৈবেদ্য হল পুলিহরা, পেসারা বুরেলু (বিউলি ডাল, গুড়, গোটা মুগ, চালের গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাবার)।
কাত্যায়নী নবদুর্গার ষষ্ঠ রূপ। মহাশক্তির ভীষনা উগ্র রূপ। মহিষাসুর বর প্রাপ্ত হয়েছিল যে একমাত্র নারীর হাতেই তার মৃত্যু হতে পারে। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য শিব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর চোখ মুখ থেকে এমন অগ্নি শিখা নির্গত হল যে ঠিক যেন এক জ্যোতিপুঞ্জ যা ব্রহ্মাণ্ডকে আলোকে ভাসিয়ে দিয়েছে। সেই জ্যোতি থেকে প্রকাশিত হলেন দেবী কাত্যায়ানী। দেবতাদের দেওয়া অস্ত্রে সজ্জিত দেবী তাদের অনুরোধে মহীশূর পাহাড়ে যান। সেখানে তাঁর সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে মহিষাসুর দেবীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। দেবী প্রস্তাব স্বীকার করে বলেন যে যদি মহিষাসুর তাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারে তবেই তিনি বিবাহ করবেন। মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম মহিষাসুরমর্দিনি। উত্তর ভারতে দেবীকে সেদিন মধু নিবেদন করা হয়। এছাড়া কুটটু আটার হালুয়া, সিংহারে কে আটা, বাজরে কে হালুয়া, কুটটু কে পুরি এসব নানা উপাচারে দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। দক্ষিণ বাসী সাধারণত সেদিন মাকে দেন গুড় ভাত, চাল – দুধ – চিনি তৈরি নানরকম খাবার।
কালরাত্রি নবরাত্রির সপ্তম দিনে পূজিতা হন। ভীষনদর্শনা দেবীর কাজলের মত ঘোর কালো গায়ের রং, এলোকেশিনী, ত্রিনয়না, চোখ ব্রহ্মাণ্ডের মত গোলাকার, নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে নির্গত হয় ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা। ভগবৎ পুরাণে কথিত যে কালরাত্রি দেবী চণ্ড ও মুণ্ডর চুলের মুঠি ধরে ধড় থেকে আলাদা করে দেন। সেইজন্য তিনি দেবী চামুণ্ডা রূপেও পূজিত হন। দুই অসুরের নিধনের পর দেবীকে হত্যা করতে এলো রক্তবীজ। কিন্তু যখনই তাকে দেবী হত্যা করতে চাইছেন, তার রক্তের ফোঁটা থেকে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য অসুর। অতএব, দেবী তার রক্ত মাটিতে না ফেলে পান করতে লাগলেন এবং এইভাবে রক্তবীজের মৃত্যুর হল। উত্তর ভারতে সেদিন মা কে গুড় নৈবেদ্য দেওয়া হয়। বলা হয় যে তাতে মানুষের মুক্তিলাভ সম্ভব ও সংকট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া ভোগে দেওয়া হয় মতিচুর লাড্ডু, রাজগিরা থালি পিঠ, জলেবি, আমির্তি, খিচুড়ি। দক্ষিণ ভারতে মাকে ভোগে দেওয়া হয় আটুকুলু (পোহা), চানা ডাল, নারকেল ও গুড়।
শিব একবার পার্বতীকে মজা করে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করেছিলেন তাঁর গায়ের রং কালো বলে (এর পেছনে একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল সৃষ্টিকে বাঁচানোর জন্য)।
“একদিন কথাচ্ছলে দেব পঞ্চানন
কালী নামে উমাকে করেন সম্বোধন।
সেই সম্বোধনে উমা হলেন দুঃখিত
অন্তরে কিঞ্চিৎ দৈন্য হৈল উপস্থিত।
মহেশ্বর প্রতি তবে অভিমান করি
কহিলেন, হে নাথ, শঙ্কর ত্রিপুরারি।
যদি বৃক্ষ ছিন্ন হয় কুঠার দ্বারায়
তাহার উদ্গম হইবেক পুনরায়।
কিন্তু কেহ কটুবাক্যে যদি বিদ্ধ হয়
তার পুনরুত্থান সম্ভব কভু নয়”
বিষয়টা ছিল যে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে একমাত্র কুমারী ও অবিবাহিত পার্বতীর অংশ বধ করতে পারবে। এদিকে পার্বতী নিজের গায়ের রং ফেরানোর জন্য ব্রহ্মার তপস্যা করছেন। ব্রহ্মা পার্বতীকে এই দুই অসুর বধের কথা বললেন এবং গঙ্গার জলে স্নান করার পরামর্শ দিলেন। পার্বতীর দেহ স্বর্ণালী আভায় ভরে গেল। নতুন এই রূপে তিনি পূজিতা হলেন মহাগৌরী নামে।
দেবীর কালো বর্ণের সেই পরিত্যক্ত ত্বক থেকে প্রচন্ড উগ্র মূর্তি রূপে সৃষ্টি হল কৌশিকী দেবী। দেবীর এই নতুন সৃষ্টি অবিবাহিতা ও কুমারী। সংহার করলেন শুম্ভ ও নিশুম্ভ কে। কিন্তু তার ফল হল ভয়াবহ। তিনি ভুলে গেলেন সৃষ্টি ও সংহারের ভেদাভেদ। ধ্বংস করতে লাগলেন সবকিছু। সমস্ত সৃষ্টি তার এই রূপ দেখে ভীত হয়ে পড়ল। দেব দেবীরা উপস্থিত হলেন মহাদেবের কাছে। মহাদেব অসফল হয়ে পড়েন দেবীর এই রূপকে শান্ত করতে। অতএব তিনি একটি উপায় বের করলেন এবং দেবীর চরণতলে শুয়ে পড়লেন। তাই দেখে প্রকান্ডরূপা দেবী থমকে দাঁড়ালেন। মুহুর্তের জন্য স্থির হল সৃষ্টি। লজ্জিত হয়ে জিভ বের করে ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগলেন।
মহাগৌরীকে উত্তর ভারতে সেদিন নিবেদন করা হয় নারকেল। সন্তানের জন্য অত্যন্ত শুভ এই ফল। এছাড়া পান পেঠা, বোম্বে করাচি হালুয়া, পুরি হালুয়া চানা এধরনের ভোগও দেবীকে দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতে নৈবেদ্য দেওয়া হয় গারেলু (মেদু বড়া), আদা লেবুর শরবত।
আদিশক্তি সিদ্ধিদাত্রী হলেন দেবী পার্বতীর মূল রূপ বা আদি রূপ। নবমদিনে এই দেবীর পূজা করা হয়। তমসাচ্ছন্ন ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্ষ্টির রূপ দেওয়ার পেছনে রয়েছে এই মহাশক্তির শক্তি। আটটি সিদ্ধি বা শক্তির অধিকারিণী ছিলেন বলে তিনি সিদ্ধিদাত্রী নামে পূজিতা হন। আটটি সিদ্ধি যথাক্রমে অনিমা (নিজের শরীরকে পরমাণুর আকারে ছোট করা), মহিমা (শরীরকে অসীম আকারে প্রসারিত করা), গরিমা (অসীম ভারী হয়ে যাওয়া), লঘিমা (ওজনহীন হওয়া), প্রাপ্তি (সর্বব্যাপী থাকা), প্রকম্ব্য (যা ইচ্ছে তা অর্জন করা), ঈশিত্ব (পরম প্রভুত্বের অধিকারী), বশিত্ব (সকলকে বশীভূত করার ক্ষমতা)। দেবীকে সেদিন প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় তিল। মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি ও আকস্মিক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে ভক্তেরা তিল অর্পণ করে। এছাড়া ভোগে থাকে সকরকান্দি নারকেল হালুয়া, আলু টিককি, নারকেল বরফি, মুগডাল, ঘি, লাড্ডু, লাউকি বরফি, হরা পায়াসম্। দক্ষিণ ভারতীয়রা সেদিন মাকে নৈবেদ্য দেয় চক্র পোঙ্গলি ( চাল, মুগডাল, ঘি, গুড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি মিষ্টি)।
শেষপাতে বাঙালির শারদীয়া উৎসবের কথা না উল্লেখ করলে অসম্পূর্ণ থাকবে। আমরা সাধারণত নবরাত্রি পালন করি না। তবে ষষ্ঠী থেকে দশমী দুপুর পর্যন্ত মাকে নানারকম ফল, মিষ্টি, ভাত, তরকারি সাজিয়ে ভোগ নিবেদন করি। সকালে ফল, মিষ্টি, সাবু, লুচি, সুজি এধরনের খাবার দেওয়া হয়। সপ্তমীর দুপুরে থাকে ভাত, ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, শুক্তো, ছানার ডালনা, ফুলকপির তরকারি, পটলের দোলমা, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। রাতে সাধারনত মাকে নিদেবন করা হয় দুধ, মিষ্টি বা কখনো লুচি, সুজি। অষ্টমীতে মায়ের খাবারের মেনুতে থেকে খিচুড়ি। সঙ্গে লাবড়া, পাঁচরকম ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। নবমীতে পোলাও, ছানার কোপ্তা, ধোকার ডালনা, আলুর দম এবং নানারকম মিষ্টির পদ। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বনেদি পরিবারের দুর্গাপুজোয় তাদের নানারকম ঐতিহ্যবাহী রান্না থাকে। সেইসব বাড়িতে একসময় ভিয়েন বসিয়ে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ধরনের মিষ্টি তৈরি হত। এখনো ভিয়েন বসে কিছু বনেদি বাড়িতে তবে আগের সেই জৌলুশ প্রায় তলিয়ে। প্রচুর বনেদি বাড়িতে দশমীতে মাকে পান্তা ভাত দেওয়ার রীতি রয়েছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন