rannaghar-reetir-anchal

রীতির আঁচল
অর্পিতা বোস


প্রকৃতি সৃষ্টির সাথেই শুরু হয় আবহাওয়ার পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঋতু বদলের স্থানাধিকার করে নিয়েছে। এই ঋতু পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবনধারা। যেখানে খাদ‍্যাভাস সবথেকে বেশি লক্ষণীয়। যে ঋতুতে যে সকল খাদ‍্য পাই আমরা সেগুলোর উপকারিতা বুঝে আমরা আমাদের খাদ‍্যতালিকাভুক্ত করি। আর ঋতু পরিবর্তনের মাঝে একটা বিশেষ দিনকে প্রতিটি দেশেই প্রায় আমরা পালন করি উৎসবের মাঝে।

কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে সাধারণত বিভিন্ন নামে নতুন ফসল নিয়ে একটি উৎসবমুখর দিন পালিত হয়। যেমন ভারতে বিহু পোঙ্গল, লোরি, ইতু পালিত হয়। শুধুমাত্র ভারতেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে। যেমন, আর্জেন্টিনায় ডেন্ডিমিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মিড অটাম ফ‍্যাস্টিভ‍্যাল, জাপানে হোনেন মাতসুরি উৎসব উল্লেখযোগ্য। আবার কখনও এমন উৎসব দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে ভেসে চলে। ভেসে যায় ছিন্নমূল হয়ে। তারপর ঠাঁই পায় যেখানে সেখানের জলবায়ুর সাথে মিশিয়ে তৈরি হয় নতুন পরবের রূপকাঠামো।

ঠিক এমন করেই কিছু উৎসব, পরব প্রাকস্বাধীনতাপর্বের সমগ্র বাংলার রেশ সীমারেখাকে অতিক্রম করতে সম্ভবপর হয়েছে। বিভক্ত বাংলা দুই ভিন্ন দেশের নাম পেলেও আচার, পরব ও খাদ‍্যাভ‍্যাসে আজও স্মৃতিকে জড়িয়ে রাখতে সক্ষম।

বেশ কিছু পূজা যেমন মনসা, দুর্গা, চন্ডীর প্রথা শুরু অধুনা বাংলাদেশে হলেও বর্তমানে ভারতবর্ষের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গেও পালিত হয়। তেমন করেই চৈত্র সংক্রান্তির কিছু খাদ‍্যাভ‍্যাস নিয়ে আমার পিতৃমহী ঠাঁইহারা হয়ে এদেশে আসেন। এদেশে বসতি স্থাপন করতে করতে সেই সব খাদ‍্যাভ‍্যাসকে পশ্চিমবঙ্গের কিছু উপকরণের সাথে মিশিয়ে ওপার বাংলার লাবনকে তৈরি করেন লাবনী রূপে।

লাবন মূলত বাংলাদেশে চৈত্র সংক্রান্তিতে খাওয়া হয়। মূল উপকরণ খইয়ের ছাতু, জিরাগুঁড়ো, গুড় এবং সামান্য কর্পূর। হালকা অথচ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খইকে শুকনো খোলায় ভেজে তারপর গুড়ো করে ছাতু তৈরি করা হয়। চৈত্রের গরমে খই সহজপাচ‍্য এবং এটি প্রোটিন, ভিটামিন সমৃদ্ধ একটি খাদ্য পদার্থ যা রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরলের মাত্রাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। ছাতু পেটকে অনেকটা সময় ভর্তি রাখায় এটি ওজন নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর। এই খইয়ের ছাতুর সাথে মেশানো হয় খালি কড়াইতে ভাজা জিরের গুঁড়ো। যা হজমশক্তিতে সাহায্য করে। এই মিশ্রণে সামান্য কর্পূর মিশিয়ে রাখা হয়। এরপর কড়াইতে গুড় জ্বাল দেওয়া হয়। গুড় অত্যন্ত উপকারী উপাদান যা শরীরের মেদবৃদ্ধি ও শর্করাবৃদ্ধি রোধ করতে এবং পরিপাকতন্ত্রে শোধকের কাজ করতে সহায়তা করে। গুড় অবশ্যই হাড়ের ‍জন‍্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের পরব এবং আচারে পালিত বিভিন্ন খাদ‍্যবস্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুষ্টিকর। আর এই গুড়ের রসে খইয়ের ছাতু, জিরেগুঁড়ো এবং কর্পূরের মিশ্রণ মিশিয়ে একটি মন্ড তৈরি করা হয়। এরথেকে মনমতো আকারে তৈরি করা মিষ্টিকেই লাবন বলা হয়। এই পদ্ধতিতে লাবন আজও তৈরি হয় বাংলাদেশে যা বসন্ত ও গ্রীষ্মের আবহাওয়ায় শরীরের জন্য উপকারী।

সংক্রান্তি উৎসব অর্থাৎ দুই ঋতুর শেষ এবং শুরুর মিলনোৎসব। দুটি ঋতুর আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় খাদ‍্যাভ‍্যাসে পরিবর্তন এনে এবং নতুন ফসলে ঋতুপোযোগী উপকরণে খাদ‍্যকে বিভিন্ন রূপে তৈরি করে পালিত হয় সংক্রান্তি উৎসব। এর সাথে মেশে নিয়মমাফিক বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান অবশ্যই।

বসন্তের শেষে চৈত্র সংক্রান্তিতে এপার ওপার দুই বাংলাই মেতে ওঠে। সাথে থাকে নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার পালাও। তাই চৈত্র সংক্রান্তি এবং পয়লা বৈশাখ এই দুইদিন ধরে বিভিন্নভাবে পালিত হয় উৎসব। আমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও আমার শিকড় অধুনা বাংলাদেশে। তাই ছোট থেকেই চৈত্র সংক্রান্তিতে কাঁটাতারের বেড়ার বাঁধন যেন ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টায় পালিত হতো বিশেষ পরব। এই সংক্রান্তির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হতো বেশ কয়েকদিন আগেই। সবার প্রথম শুরু হতো বাড়ি পরিষ্কার। বারোমাসের বছরকে প্রধানত চৈত্র এবং ভাদ্র এইদুটি সংক্রান্তিতে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কারের একটি নিয়মে রাখার চেষ্টার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। বর্ষা শেষে নদনদীপূর্ণ বাংলার ঘরবাড়ি জলীয় বাষ্পের প্রভাবে অপরিচ্ছন্ন এবং বিভিন্ন পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচাতে ঘরবাড়ি বিশেষত রান্নাঘর পরিষ্কার এবং জামাকাপড়কে বর্ষার স‍্যাঁতস‍্যাঁতে আবহাওয়া ও কীটানুমুক্ত করতে আজও ভাদ্র সংক্রান্তিতে সম্পূর্ণভাবে ঘরবাড়ি পরিষ্কারের রীতি পালিত হয়। ঠিক তেমন করেই শীতের শেষে গরম পোশাক এবং গ্রীষ্মের পোশাকের অদলবদল এবং সেগুলো যত্নে রাখা এবং ষান্মাসিকভাবে সম্পূর্ণ ঘরবাড়ি কীটাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরবাড়ি পরিষ্কারের রীতি পালিত হয়।

বাড়ির পিছনের নিমগাছের পাতাদের খবরের কাগজ চাপা দিয়ে শুকনোর প্রথা শুরু হতো বসন্তেই। রোদে শুকোনো লেপকম্বল ও শীতপোশাক যত্নে তুলে রাখার সময় কাপড়ের পুটুলিতে এই শুকনো নিমপাতা, কালোজিরে এবং শুকনোলঙ্কা বেঁধে রেখে দেওয়া হতো কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচতে।

ঠিক এমন করেই চৈত্র সংক্রান্তির আগেরদিনেই আমাদের বাড়িঘর পরিষ্কারের ধূম লাগতে দেখতাম মা ঠাকুরমার মধ্যে। নারকেলপাতার শলার ঝাড়ু আর সাবানজল দিয়ে পরিষ্কার হতো রান্নাঘরের যত ঝুলকালি। এখনকার মতো কিচেন চিমনি ছিল না তাই ঝুলকালি পরিষ্কার আবশ্যক ছিল। এরপর ছিল তাকের ওপর তুলেরাখা সব বাসন মেজেঘষে শুকিয়ে রাখার পদ্ধতি। উদ্দেশ্য চোখের আড়ালে কোথাও পোকামাকড় বাসা বাঁধলে সেগুলো সাফসুতরো করা।

এরপর সংক্রান্তির আগের রাতে তৈরি হতো পরদিনের খাবারের আয়োজন। খইকে শুকনো কড়াইতে ভেজে তারপর গুড়ো করে রাখা হতো। মাটির পাত্রে দইয়ের ছাঁচের সাথে ঈষদুষ্ণ দুধ মিশিয়ে দই পাতা হতো। দইয়ের খাদ‍্যগুণ অসামান্য। হজমশক্তি বৃদ্ধি ছাড়াও দইয়ের অনেক উপকারিতা আছে। দই সঠিকভাবে জমার জন্য প্রয়োজন উষ্ণতা।যৌথ পরিবারের কর্ত্রী আমার ঠাকুরমা রাতে শোওয়ার আগে নিজে তদারকি করতেন দই জমানোর হাঁড়ির ওপর কম্বল ঠিক মতো চাপা দেওয়া আছে কিনা।

সংক্রান্তির সকালে উঠেই শুরু হতো সংক্রান্তি উৎসব পালনের ব্যস্ততা। সবার আগে স্নান পর্ব সারতে হতো। নিমপাতা হলুদ বাটা মেখে স্নানে যাওয়ার নিয়ম ছিল। বসন্তে ও গরমের শুরুতে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য এই প্রলেপ মাখা উপকারী এটাই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এই প্রথা পালনের। স্নান সেরে নিয়মানুযায়ী নতুন জামা পরতে হতো l আমাদের ছোটবেলায় তখন সাদা জামা ছিল, নাম টেপফ্রকl তাতে রান ফোরে ফুল পাতা, একটি মেনি বিড়ালের প্রতিকৃতি সেলাই করা থাকতো l আর ছেলেদের একটি নতুন স্যান্ডো গেঞ্জিl মা-ঠাকুরমা-কাকিমা-দিদিরা নতুন ছিট কাপড়ের ব্লাউজ পরতেন l অর্থাৎ গরমে সুতির কাপড়ে শরীরের আরাম হবে সেটাই জানান দেওয়া। এরপর নিম, হলুদ আর সাদা পাটালি মুখে দিয়ে পিছু নিতাম বাবা কাকা দাদাদের। শুধুমাত্র বাহ‍্যিকভাবে শরীর রক্ষা নয়, নিমপাতা ও হলুদ শরীরের আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

নতুন জামা পরে বাবা কাকা দাদারা বাড়ির সীমানার ভেতরে চার কোণে মাটিতে চারটে মানুষের প্রতিকৃতি আঁকতেন চকের টুকরো দিয়ে l এরপর পূর্বমুখে তাকিয়ে ওই প্রতিকৃতিগুলোর গলায় হাত দা’র সাহায্যে কোপ দিয়ে শত্রু বলি দিতে দিতে বলতেন,

“শত্রুর মুখে দিয়া ছাই
ছাতু উড়াইয়া বাড়ি যাই”
প্রতিটি আচার পালনেই লুকিয়ে থাকে গভীর ভাবনা।

ত‍ৎকালীন যৌথ পরিবারের পুরুষরা সম্পূর্ণ পরিবারের সুরক্ষা রক্ষার দায়ভার গ্রহণ করতেন। শত্রু বলতে শুধুমাত্র মানবকায়ার শত্রু নন। নিধন হতো মানুষের মনের সমস্ত আঁধার।

এই ভাবনার নিয়ম পালনের পর হতো ওপার বাংলার লাবনের নব‍্যরূপ লাবনীর প্রস্তুতিপর্ব।

লাবনের মূল উপকরণ হলো খৈয়ের ছাতু, ভাজা জিরে গুড়ো, টকদই, নারকেল, কলা, সাদা পাটালি এবং প্রয়োজনে নারকেলের জল মিশিয়ে তৈরি হওয়া এক অতি সুস্বাদু প্রাতরাশ যা আমাদের বাড়িতে সকলের অতি প্রিয়। আর এটি বিশেষভাবে খাদ‍্যগুণপুষ্টও অবশ্যই।

গঙ্গা-পদ্মার ওপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে কালের স্রোতে। ঠাকুরমাও গত হয়েছেন। তবুও শিকড়ের টানের এক অনুষঙ্গ লাবন অথবা নব‍্যরূপের লাবনী আজ এপার বাংলার অনেক ঘরেই তৈরি হয়। রক্তস্রোতে খাঁটি বাঙাল এই আমার হাত ধরে আদি পশ্চিমবঙ্গীয় অর্থাৎ এদেশীয় বাড়িতে সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এই লাবনী প্রাতঃরাশে নিজস্ব জায়গা অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। ঠিক যেমন করে চৈত্র সংক্রান্তির দুপুরের খাবারে গাড়ুর ডাল, অথবা আমের ডাল, সীমের বীজ, সজনে ডাটা, কুমড়ো মিলিয়ে তৈরি পাচন আজ এদেশীয়দেরও জিভে জল আনে। চৈত্র সংক্রান্তির এই সুস্বাদু পদেরা এভাবেই বাঙাল বাড়ির পাঁকঘর থেকে এদেশীয় হেঁশেলে স্বমহিমায় বিরাজমান। এভাবেই হয় এক অনন্য মিলন যা সকল কাঁটাতারের বেড়ার বাঁধনকে উড়িয়ে দিতে পারে।

 

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *