ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
ছোট্ট দেশ সিংহপুর বা সিঙ্ঘপুরা বা সিঙ্গাপুরের স্বপ্ন সাম্পান (চিনে ভাষায় যার নাম ছোটো নৌকো) এ ভাসতে ভাসতে গিন্নীমায়ের এই লেখা। এই প্রবন্ধ দুটি পর্বে- প্রথম পর্বে গিন্নীমায়ের সেখানে রান্নার তোড়জোড় আর দ্বিতীয় পর্বে সিঙ্গাপুরের সুখাদ্য নিয়ে গিন্নীমা যেমন পথ হেঁটে বেড়ালেন ছেলে বৌ কে সঙ্গে নিয়ে।
প্রতিবার প্রবাসে পুত্রের সংসারে পাড়ি দেওয়া মানে আমাদের কালে ঠাম্মা-দিদা-দাদুর মধুপুর-দেওঘরে যাত্রার সমান। দীর্ঘদিন রোগভোগান্তির পর যেন হাওয়া বদল। পশ্চিমে বায়ু পরিবর্তনে শরীর সুস্থ হয়। শীতকাল হলে কাশী অথবা পুরীর ভাড়া নেওয়া বাড়িতে। সঙ্গে যাবে সহকারী, ভৃত্য-অনুচর, পাচক-ঠাকুর অথবা বামুনদিদি। রেলকামরায় তাস খেলা হবে শতরঞ্চি বিছিয়ে। মেয়েরা বিন্তি, ছেলেরা টোয়েন্টিনাইন, ছোটোরা গাধা পেটাপিটি। তুখোড় আঁতেল হলে ব্রিজ। আলাদা আলাদা বাটিতে ইকমিক কুকারে ম্যারিনেটেড দই মাংস আর দমে বসবে মিষ্টি ঘিভাত। যথাসময়ে বেতের বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়বে উগরে নেওয়া গুড় আম অথবা তেঁতুল-আমসত্ত্ব-খেঁজুর-টমেটো। চায়ের সরঞ্জামও দিব্য মজুত। এলুমিনিয়ামের ঢাউস কেটলিতে জল আনবে একজন প্যান্ট্রিকার থেকে অথবা স্টেশনে ট্রেন থামলে চা ওয়ালাকে দুটো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে। ন্যাকড়ার মধ্যে চায়ের পুঁটুলি। সঙ্গে কনডেন্সড মিল্ক অথবা গ্ল্যাক্সোগুঁড়ো। আর সঙ্গে বিশাল ফ্লাস্ক। একটু গরম জল থাকবে, বাচ্ছাদের দুধ গুলে গিলিয়ে দেবার জন্য।
ঠিক তেমনি অবস্থা এখনও হয় আধুনিকা শহুরে গিন্নীমায়েদের। স্থান-কাল-পাত্র বদলে গেছে কিন্তু অনেক কিছুই এক রকম রয়ে গেছে আজো। এহেন শহুরে গিন্নীমা সব যোগাড়যন্ত্র করে কোথায় কৌটো ভরে খেঁজুর গুড়ের পাটালী, লঙ্কার আচার, বিউলির ডালের হিং দেওয়া বড়ি গোছান।
শাশুড়ি মা বেঁচে থাকলে বলতেন আচার, বড়ি অযাত্রা বৌমা। বৌমা বলতেন, তাই বলে ওরা খাবে না? আপনারাও তো সে যুগে ট্রেনে নিতেন সব। তেমন কিছু অঘটন ঘটেছে বলে তো মনে নেই। শাশুড়ি মা এক গাল হেসে সায়ও দিতেন তখন। অগত্যা এই বাবা মায়ের সব দায়িত্ব।
সর্ষের গুঁড়োর প্যাকেট মনে করে। যাতে সম্বচ্ছর সেদেশের মাছ কিনে এনে সর্ষে বাটার অনুরূপ মাছের ঝাল চট করে বানিয়ে খেতে পারে ওরা। পোস্তর দুঃখ তো ভোলাতে হবে। পোস্ত সিঙ্গাপুরে ব্যান্ড। ধরা পড়লে হাজতবাস অবধারিত।
এই যাঃ! ভুলে গেছি বলতে! উত্কৃষ্ট সিমুই ঘিয়ে ভেজে কৌটোবন্দী হল। পায়েস বানাতে হবে না? সে দেশে ড্রাইফ্রুটস বিস্তর মেলে অতএব বলাই বাহুল্য ঘিয়ে ভাজা সিমুই দিয়ে, পাটালীগুড়, ড্রাই ফ্রুটস ছড়িয়ে সেদেশের লো ফ্যাট দুধও কথা বলে উঠবে গিন্নীমায়ের হাতে। ডিহাইড্রেটেড কন্ডেসন্ড মিল্কও মেলে। তবুও অবাঙালী দোকানের খোয়াক্ষীরের গুঁজিয়া চলল সঙ্গে। এই নিয়ে কিছু বচসাও হল কর্তামশাইয়ের সঙ্গে। তাঁরা বুঝবেন না এসব। মায়ের প্রাণের মধ্যে সেই চোরাকুঠুরীর ঘিনঘিনে ব্যাথার কথা। বাধকের যন্ত্রণা যেন। একবার জোরে আসে। আবার একবার হালকা। মায়ের অবিশ্যি কোনোবারই এসব বচনে হেলদোল থাকেনা। গিন্নীমা পেরুতে থাকেন স্মৃতির সরণী। মনে পড়ে যায় ঋতু বৈচিত্র্য অনুযায়ী বাঙালির স্বাদকোরকের কথা।
চৈত্রের বাজারে থরে থরে কাঁচা আম। কাজের মাসীটিকে দিয়ে ছুলিয়ে কেটে আখের গুড়ের গাঢ় রসে উগরেও নিলেন। মধ্যে কয়েকটি কিশমিশ আর একটু আদার কুচি। কিছুটায় পাঁচফোড়ন আর শুকনো লঙ্কার ছঁক। তৈরী হল আমের দু’রকমের মিষ্টি আচার। জ্যামের শিশি ধুয়ে মুছে, শুকনো করে হালকা গরম ঐ মিষ্টি চাটনী শিশির মধ্যে বন্দী হল। তারপর ঢাকনা এঁটে প্ল্যাস্টিকের বুদবুদ র্যাপ জড়িয়ে আঁটোসাঁটো হল স্কচ টেপ দিয়ে শিশির আপাদমস্তক। এবার সোজা চালান হল ঢাউস স্যুটকেসে জামাকাপড়ের মধ্যে।
এতকিছু না গোছালে চলে? সেখানে গিয়ে একা হাতে গিন্নীমা’কে রান্নাবাটি সারতে হবে। গোছ থাকলে রান্না বসাতে কতক্ষণ?
লাস্ট মোমেন্টে পোল ভল্ট দিলেন গিন্নীমা’র গর্ভধারিণী। নাতির বড্ড প্রিয় ধোঁকার ডালনা। কতদিন খায়না বাছা। শোন্ ছোলার ডাল, মটরডাল বেটে নিয়ে হিং, আদা-লঙ্কা দিয়ে নুন মিষ্টি দিয়ে যেমন ধোঁকা বানাস, তেমনি করে শুধু পিস করে ভেজে নিয়ে যাস।
কি মুশকিল! আরে মুশকিলের কি আছে? প্লাসটিকের কতরকমের কৌটো আছে তোর। ভরে নিয়ে চেকড ইন লাগেজে। ওরা যদি বাক্স খোলে মা? এক পিস খাইয়ে দিস। সর্ষের তেলে ভাজা ধোঁকা খেয়ে সিকিউরিটি ভিরমি যাবে। স্মার্টলি বলবি, লেন্টিল কেক। চেখে দেখ, নয়ত পস্তাবে। বিল পাশ হল। কর্তা সায় দিলেন।
মায়ের মেসেজ… এবার আবার কিছু মনে পড়লে বলব। বাক্স যেন বন্ধ করিস নি এখনো।
আরেক্টা অনুরোধ। পাটিসাপটার পুর করে নিবি মনে করে। গিয়ে সুবিধে হবে তোরই।
অগত্যা নারকোল বাটো রে। দুধ ঘন করো রে।
গিন্নীমায়েদের স্ট্রলি ব্যাগের ঢাকনা খোলা আর বন্ধ হয়। স্ট্রলি ব্যাগ শুধু ভরবার জন্যে। স্ট্রলির অন্দর কভু খালি নাহি রয়।
কিন্তু এ তো গেল ঘর থেকে বেরুনোর আগেকার বেত্তান্ত। তারপর? সেখানে পৌঁছে স্ট্রলি ব্যাগ খুলে খাবারদাবার বের করতেই ছেলে বলল, ওসব এখন ফ্রিজে রাখো। এখানকার ক্যুইজিন টেস্ট করতে হবে তো।
অতঃপর সমঝোতা হল মায়েতে ছেলেতে। উইক ডে তে জমিয়ে দিনেরাতে দিশী খাওয়া চলবে মায়ের হাতে। সেখানে বাজারে ভেটকি, রুই, বাগদা পাওয়া যায় খুব ভালো। কেটে, আঁশ ছাড়িয়ে গুছিয়ে দেয় দোকানি। মায়ের হাতের মাছের ঝোল না খেলে চলে? তাই বলে উইকেন্ডে? পারলে দুবেলাই রান্নাঘরের ঝাঁপ বন্ধ থাকবে।
সিঙ্গাপুরে সুউচ্চ আবাসনের ন’তলার বিছানা থেকে মস্ত কাচের জানলায় চোখ রাখলে আদিগন্ত সবুজ চোখে পড়ে। নীচে ঝকঝকে রাস্তা। কেয়ারি করা দৃষ্টিনন্দন বনানী। সবকিছুতেই বড় বেশী নিয়মানুবর্তিতা আর তাই বুঝি একটু বেশিই পরিচ্ছন্নতা চোখের আরাম দেয়। এমন পথে হাঁটাও সুখকর। গাছগাছালি প্রচুর। সেইসঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণেও চব্বিশঘণ্টা তদারকি। হঠাত বৃষ্টি, আবার বৃষ্টি, যখন তখন বৃষ্টির স্বতঃস্ফূর্ত ঝর্ণাধারায় সর্বদা সদ্যস্নাত প্রকৃতি। ঠিক যেমন দেখেছিলাম ইন্দোনেশিয়ায়।
তবে এই স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ভাবের কারণে, সিঙ্গাপুরের এত পরিচ্ছন্নতার মধ্যেই আচমকাই গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাইথন, স্পিটিং কোবরা আর কিং কোবরা নামক সরীসৃপের ঝটিতি আগমন ও প্রস্থানও ঘটে। এরা জঙ্গলের চেয়ে আবাসনকেই বেছে নিয়েছে কারণ সেখানে রডেন্ট গোষ্ঠীর রমরমা।
সাউথ ইষ্ট এশিয়ার বৃষ্টির দেবতা বরুণই যেন প্রকৃতি থেকে মানুষের বাড়িঘরদোর সব্বার প্রতিদিনের ‘ডাস্টিং’ এর দায়িত্বে। তাই মাঝেমধ্যেই বৃষ্টির জলধারা স্প্রে করে দেন তিনি। ধুলো মলিনতা মুছে ঘুচে ঝাঁ চকচকে সবসময়। দূষণও কম কারণ গাড়ীর দাম অযথাই বেশী। সেখানে মানুষ বেশীরভাগ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশ কে দূষণমুক্ত রাখার এ হল আরেক পদক্ষেপ।
তবে স্যাঁতস্যাঁতে বৃষ্টির হাওয়া, সাপ, কথায় কথায় শাস্তির চোখরাঙানি … সবকিছুকে অনায়াসে কয়েকটা গোল দিয়ে দিতেই পারে সিঙ্গাপুরের সুখাদ্যের সম্ভার। তার স্ট্রীটফুডের কদর সারা বিশ্বে।
বাজারে, শপিংমলের ফুড কোর্টে অহোরাত্র সব সুখাদ্যের হাতছানি। নির্ভাবনায় পেটে পোরা যায় কারণ সেখানে কুকিং মিডিয়ামে ট্রান্স ফ্যাট নৈব নৈব চ। সরকারী ভাবে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ না মানলে রেস্তোরাঁ লাটে উঠে যাবে। সেখানে সবার এত কর্মব্যস্ততা। সবাই দৌড়চ্ছে সারাক্ষণ। তাই আম-আদমির রান্নাঘর তুলে দেবার তোড়জোড় চলছে সিঙ্গাপুরে। নাকি পথ রেস্তোরাঁর মালিকরা তাই প্রাণপণে অ্যাক্রেডিশন লাভে মরিয়া। কে কত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করতে পারে। যদিও হকার’স সেন্টারে খাদ্যের গুণমানের এই মাপকাঠি সবসময়ে সবাই মেনে চলে না।
এদেশের প্রশাসন জাত ব্যাবসায়ী কিনা। এদের লক্ষ্য হল দেশের উন্নতির জন্য বিজনেস বাড়ানো। এই কারণে সবসময়েই থিকথিকে ভীড় পথ রেস্তোরাঁয়। কোনও কোনও ফ্যামিলি চারবেলাই বাইরে আহার করেন। কেউ দু’ বেলা। আর লাঞ্চ আওয়ারে অফিস যাত্রীদের ভীড় তো ভরভরন্ত। কেউ অফিস যাওয়ার আগে রোজ শুধু কব্জি ডুবিয়ে প্রাতঃরাশ খেয়েই অফিস যান। কেউ ব্রাঞ্চ। উইকেন্ডে তো আগে থেকে বুকিং না করলে রেস্তোরাঁয় জায়গা পাওয়া দুষ্কর।
সারাবিশ্বের কালিনারি টেস্ট যেন মিলেমিশে একাকার সিঙ্গাপুরে। কতরকমের মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ হয়েছে। ইন্ডিয়ান ফুডের সঙ্গে জাপানিজ, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ইটালিয়ান। সবের যে প্রচুর কাটতি তা নয় তবে ইম্প্রোভাইজেশন আর ফিউশন করতে করতে নতুন নতুন রেসিপি উঠে এসছে সিঙ্গাপুরের কলোনিয়ান ক্যুইজিনে। সেগুলোই এখানকার অথেনটিক ফুড হয়ে উঠেছে কালে কালে।
মালয় খাবারের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ান নাসি গোরেং হয়েছে একরকম। আবার নাসি লেমাক হল পোলাও ভাতের সঙ্গে শুটকি মাছ অথবা চিকেনের ঝোল ঝোল কারি। তার সঙ্গতে স্যালাড আর সম্বল। চাইনিজ ফ্রায়েড রাইসের যেমন ইন্ডিয়ান ভার্শন আমরা পছন্দ করি ঠিক তেমনি এদের জম্পেশ শেফের হাতে পড়ে সিঙ্গাপুরের কুইজিনে প্রধানত ইন্ডিয়ান, মালয়, চাইনিজ, আর ওয়েস্টার্ন সংমিশ্রণ ঘটেছে।
এই যেমন হাইনানিজ চিকেন রাইসের খুব কাটতি সিঙ্গাপুরে। সেটি কিন্তু সম্পূর্ণ রূপে চাইনিজ হাইনান প্রভিন্সের খাবার। হাইনানিজ চিকেন রাইস ছাত্রছাত্রী, চাকুরিজীবির সময়ের অভাবে অর্ডার করা প্রিয় এবং পুষ্টিকর সহজপাচ্য খাদ্যও বটে। আমেরিকার ইউনিভার্সিটির ঠেলাগাড়ির ফুড কোর্টে যার নাম চিকেন ওভার রাইস তেমনি এক চটজলদি খাদ্য এটিও। সেদ্ধ করা বোনলেস মুরগীর টুকরো আর সেই মুরগীর ব্রথেই সেদ্ধ ভাতের মধ্যে সয়াস্যস আর চিলি স্যস ছড়ানো। সঙ্গে থাকে সামান্য শশা কুচি অথবা অন্য আনাজপাতি সেদ্ধ।
এরপরেই মনে পড়ে সাউথ ইস্ট এশিয়ার ট্র্যাডিশানাল স্ট্রীট ফুড নানারকমের নুডলস বা mee এর কথা। এখানে লাসকা হল নারকোলের দুধ দেওয়া স্যুপি নুডল। এটি সিঙ্গাপুরের পেরানাঙ্কান (Peranankan ) ক্যুইজিনের মধ্যে পড়ে। আর এই লাসকা ই হল সিঙ্গাপুরের অথেনটিক খাবার। সারা বিশ্ব জুড়ে এখন সুস্বাদু র্যামেন বা ওয়ানপট স্যুপি নুডলসেরও খুব কদর। র্যামেন হল জাপানী নুডলস। সিঙ্গাপুরেও তার কদর আছে খুব।
ইনস্ট্যান্ট নুডলস আর র্যামেনে একটাই মিল খুঁজে পেলাম। দুটোই স্যুপি নুডলস। র্যামেন ফ্রেশলি বানানো নুডলস দিয়ে তৈরী। এখন অবিশ্যি সব রেস্তোরাঁয় আগে থেকে বানিয়ে রেখে খাওয়া হয়। এমনি তে ইনস্ট্যান্ট নুডলস হল আগে থেকে বানিয়ে রাখা। জাপানিজ নুডলস স্যুপের কায়দার নাম হল র্যামেন। স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় র্যামেনের বাটি উপচে পড়ে মাংস, চিংড়ি, ঝিনুক সেদ্ধ দিয়ে সুসজ্জিত সম্ভারে। বেশীরভাগ সময়েই সবজীর রকমফেরে আর ডিমের পোচের গারনিশিংয়ে মোহময় হয়ে ওঠে র্যামেনের লুক। এসব পড়ে পাঠক বলবেন তাহলে আর এমন কী এই র্যামেন? কীই বা এর বিশেষত্ব? কেনই বা এর এত সুনাম? এর অন্যতম কারণ হল সঙ্গে সঙ্গে বানানো এই হুইট নুডলসের স্বাদের মূলে হল kansui নামে একরকম ক্ষারীয় মিনারাল ওয়াটার। যার মধ্যে থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণে সোডিয়াম কার্বোনেট, পটাসিয়াম কার্বোনেট। এই ফ্লেবারড ব্রথে ইচ্ছেমত মাংস সেদ্ধ করে রান্না করা হয় র্যামেন। মাংসের টুকরো, মাছ, সবজী সব সেদ্ধ হয় এর মধ্যে। ব্রথ, স্যস, নুডলস আর টপিংস এই চারটি প্যারামিটারে সাজানো হয় র্যামেন কে। সিঙ্গাপুরে মূলত পোর্ক রিবস এর ব্রথে সেদ্ধ করে বানানো হয় tonkotsu ramen।
কাম্বোডিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া সর্বত্র হরেক রকমের মাংস, আনাজপাতি আর সিফুড দেওয়া নুডলসের সম্ভার। মোটামুটি টেস্ট একই তবে পরিবেশনের কায়দাকানুন আর স্যসের ঝাঁঝের প্রাবল্যে এক একজায়গায় এক এক রকম। নুডলসের একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে।
নুডলসের মতোই হরেক কিসিমের নাসি বা ভাতের রেসিপি। এখানে ভাত মানেই স্টিকি রাইস মানে একটু গায়ে গায়ে সাঁটানো গলা গলা চাল। ফুরফুরে আর ধবধবে সাদা চাল কেন যে ঝরঝরে খেতে এরা অভ্যস্ত নয় তা বাপু জানিনা। অমনি আমার পুত্র বলে ওঠে “আপ রুচি খানা”।
বলি তা তো বটেই।
অমনি সে বলে ওঠে “আমাদের ফেনা ভাত দেখে তবে এরাও এমন নিন্দেমন্দ করবে মা”।
চুপ করে রণে ভঙ্গ দেন গিন্নীমা।
বিচিত্র সব মাংসের পুর ভরা মোমোর অনুরূপ ডামপ্লিংস বা Dian Xin কিম্বা Dim sums জিভে ঠেকিয়ে কলকাতার মোমোর স্বাদ পাই না। Dim sum হল এখানে স্মল পোরশন। অনেকগুলো প্লেট নিয়ে জম্পেশ আড্ডায় বসে ছাত্রছাত্রীরা। শেয়ার করে খায়। মূলত তা পোর্ক, শ্রিম্প অথবা ভেজ ডামপ্লিংস চাইনিজ মোমো বা জাপানিজ ডামপ্লিংস এখানে ডিম সাম। তবে মোটেই ভালো লাগেনি গিন্নীমায়ের । অতএব সে যাত্রায় সিঙ্গাপুরী মোমোর ফ্যাশন আউট।
ইতালীয় পিতজার নানারকম ইম্প্রোভাইজেশন চোখে পড়ে। বিশ্বায়নের দৌলতে টপিংয়ের বৈচিত্রে এসব আমাদের জানা চেনা সব ঘরোয়া খাবার।
এরপরে আসে আগুনে ঝলসানো, কাঠের শিকে গাঁথা কিমা করা চিকেন, বিফ, মাটন বা পর্ক স্যাটে বা থাই বা চাইনিজ স্প্রিং রোলের অনুরূপ Popiahই হোক অথবা আমাদের পেরাকি, পাই বা সিঙ্গারার মত আলু, চিকেন, ডিম আর সবজীর কারির পুর ভরে বেক করা কারি পাফ। এই হলুদ ছোঁয়া কারির সবেতে যেন আমাদের ঘরোয়া এশিয়ান স্পর্শ।
এখানে গ্রেভিওয়ালা মাংস কে বলে Rendang। এখন বেশীরভাগ জায়গায় থাই কারি পেস্টের মতই rendang curry paste দিয়ে বাড়িতেও দিব্যি বানানো যায়। মূলত নারকোলের দুধ দিয়ে আমাদের কষা মাংসের মত স্লো কুকিং হয়।
সিঙ্গাপুরের খাবারের মধ্যে সবচাইতে যেটা ভালো লাগে তা হল নানারকম স্যস সহযোগে মশলাদার ব্যাপারটা আর সেই সঙ্গে রান্নায় সামান্য মিষ্টির যুগপৎ মেলবন্ধন। সেই কেমিস্ট্রি কখনও আবার মাখোমাখো হয় হলুদ গুঁড়োর ছোঁয়ায়। সেটা বুঝি সাউথ ইষ্ট এশিয়ান ঐতিহ্য ধরে রাখতে রাখতেই খাদ্য সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় স্বাদকোরক সেটাই চায়। তাই বুঝি গিন্নীমাও ফিদা হলেন।
এক বিকেলে রেস্তোরাঁর দিকে এগোই। ভারতীয় পরাঠা গলির সুখ্যাতি সারা বিশ্বে। এখানে দক্ষিণী ধাঁচে মুসলমান রেস্তোরাঁর নাম Prata Alley। সেখানে সব ধরণের ইন্ডিয়ান ব্রেড মজুত। ভাত ছাড়া আসমুদ্র হিমাচলের ভারতবাসীর স্টেপল ফুড পাও, লুচি, পরোটা বা দোসা, উত্তাপম, আপ্পম বা হপার জাতীয় কার্বোহাইড্রেটের সম্ভার। সেখানেও চমৎকার ইম্প্রোভাইজেশন চোখে পড়ল।
হরেক কিসিমের দোসা থেকে, রোটিজন বা পাউরুটির মধ্যে মেয়োনিজ, মাংসের পুর ভরে স্যান্ডুইচের অনুরূপ খাবারটি খুব জনপ্রিয়। পরোটা থেকে কুলচা, ফুলকা, সবকিছুতেই ইম্প্রোভাইজেশন। তবে টেস্ট বেশ অন্যরকম কারণ দক্ষিণী ছোঁয়া প্রতিটি পদে।
সিঙ্গাপুরের অন্যতম স্ট্রীট ফুড মূরতাবাক মানে আমাদের মোগলাই পরোটার অনুরূপ। ডিম, মাটন কিমা, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজের পুর পরোটার মধ্যে। আর আমাদের ছেঁড়া পরোটা বা পেটাই পরোটার মত পরোটা ভেজে ও ছিঁড়ে কুচিকুচি করে মাটন কিমার সঙ্গে মেশানো এক অনবদ্য ডেলিকেসি। আবার সঙ্গে গাজর, লংকা, পেঁয়াজের পুর দিয়ে মেশানো আরেক ধরণের পরোটা খেলাম যার নাম কুত্থু পরোটা। অদ্ভুত এক দোসা পেলাম যার মধ্যে ডিম আর চিজের পুর। স্বাদ অনবদ্য। বলাই বাহুল্য। বৈচিত্র্যময়তায় ভরপুর থরে থরে সাজানো সিঙ্গাপুরের ফুডকোর্ট। যেন একই জিনিষ একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরিবেশিত শুধু সামান্য কায়দা করে।
সবচাইতে সুস্বাদু ছিল আমার নীলের উপোসের দিনে কোকোনাট ড্রিংক। বাড়ি বয়ে হাতে এমন সুস্বাদু, শীতল পানীয় হাতে এলে বড় আনন্দ হয়। সবচাইতে বড় কথা হল পেট ভরা কমপ্লিট মিল এক গ্লাস এই পানীয়। ডাবের জল, ডাবের শাঁস আর সঙ্গে কাঁচামিঠে আমের অপূর্ব এক রসায়ন এই পানীয়ে। আরও সব ফ্লেবার আছে। পছন্দ করে নিলেই হল। স্বাদ অনুসারে চিনি মেশানো যেতেই পারে।
এছাড়াও যে দুটি সিঙ্গাপুরের খাবারের নাম না করলে এ লেখা শেষ হবে না তা হল হাইনানিজ চিকেন রাইস আর কায়া টোস্ট। রাস্তায় ঘাটে যত্রতত্র তাকালেই চোখে পড়বে। এখানে কায়া টোস্ট থাকবেই।
নরম সেদ্ধ ডিমের সঙ্গে পরিবেশিত এই কায়া বা কেয়া টোস্ট এখানে স্টেপল ব্রেকফাস্ট ফুড। গ্রিলড পাউরুটির স্যান্ডুইচ বানানো হয় নারকেল অথবা ডিমের kaya দিয়ে, এবং তারপরে মাখনের পাতলা স্লাইস দিয়ে। হাইক্যাল নিঃসন্দেহে। তবে এক আধবার চলতেই পারে। এখানে অনেকেই দেখলাম নিয়মিত ব্রেকফাস্ট সারে Kopitiam বা কফিশপে গিয়ে। Kopi হল সিঙ্গাপুরে আমাদের কফির নাম। যার মধ্যে কন্ডেনশড মিল্ক আর চিনির সোহাগ উথলে উঠছে। দুধ না দিলে সেটা Kopi-o আর দুধ, চিনি কিছুই না দিলে তা হল Kopi-o-Kosong বা ব্ল্যাককফির মত।
সিঙ্গাপুরের অন্যতম ননভেজ ডেলকেসি হল চিলিক্র্যাব। টেস্ট অনেকটাই আমাদের সুইট অ্যান্ড সাওয়ার চাইনিজের মত। তবে নুডলস বা ভাতের সঙ্গে এক অনুপম সঙ্গত হয় এই চিলি ক্র্যাবের। দুরকম ফ্লেবার পেলাম। একটার কথা বললাম। মিষ্টি ধাঁচের, লালচে মশলার। অন্যটা গোলমরিচের রঙে, ঝাঁঝে, গন্ধে পাগল করা। তবে রেস্তোরাঁর চেয়ে বাড়িতে অর্ডার করে খাওয়াটাই সমীচীন ছিল পোষ্ট প্যান্ডেমিক যুগে। কাঁকড়া খেতে এত সময় লাগে আর সিফুড রেস্তোরাঁতেই এখানে ভীড় থৈ থৈ করে। এখন খাওয়ার সময় মাস্ক খুলে খেতেই হবে, বলাই বাহুল্য। তবে মহার্ঘ্য এই চিলি ক্র্যাব একটু ওভাররেটেড কারণ সমুদ্দুরের ধারেই যদি কাঁকড়ার এত দাম হয় তাহলে পাহাড়ের মাথায় না জানি কী হবে?
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্টেপল এই সম্বল। যে কোনও খাবারের সঙ্গতে সম্বল যেন অপরিহার্য এক achar ba চাটনি সম টক-ঝাল টাকনা। ইন্দোনেশিয়ায় সম্বলের উৎপত্তি কিন্তু এখান এখানকার সব দেশেই চলছে রমরমিয়ে এই সম্বলের ব্যাবহার। লাল বা সবুজ লঙ্কার সঙ্গে রসুন, শ্যালট, লেমনগ্রাস, গলাঙ্গল, ভিনিগার ট্যোম্যাটো …এমন সব আনাজের ভেরিয়েশন আর তার সঙ্গে কুচো চিংড়ি বাটা পড়লে তো আর কথা নেই।
oelek নামের একটি সম্বল যেমন আমেরিকার হট ফেবারিট তেমনি belacan হল সাউথ ইস্ট এশিয়ার জনপ্রিয় এক সম্বল। এর সঙ্গে পাঁপড়ের মত ক্র্যাকার পছন্দ করে স্থানীয় মানুষজন। সারাটা সিঙ্গাপুর দাপিয়ে বেড়ায় সম্বল অ্যান্ড কোম্পানি।
আরেকটি খাবারের নাম না বললেই নয় তা হল Nonya Laksa Lemak. ঘন ভারমিসেলি বা রাইস নারকোলের দুধ আর মুরগীর ব্রথে সেদ্ধ করে গারনিশ করা হয় স্টারফ্রায়েড চিংড়ি কিম্বা কলাপাতায় আমাদের পাতুড়ির মত মোড়া মশলাদার ফিশকেক বা Otak-Otak দিয়ে। এর মধ্যে কোথাও আবার স্প্রাউটেড বিনসও দেওয়া হয়। এই Nonya ক্যুইজিন এখানকার Perannankan ক্যুইজিনের আওতায় পড়ে। সিঙ্গাপুরের স্থানীয় মানুষদের বলা হয় Nonya। এঁরাই হল মালাক্কা স্ট্রেইট থেকে আসা Perannakan জনগোষ্ঠী।
মালাক্কা থেকে এখানে এসেছে Ayam pongteh। এটি সিঙ্গাপুরের মানুষদের পছন্দের স্ট্যু। এই রান্নাটি এসেছে মালাক্কা থেকে। আয়াম এর অর্থ স্ট্যু। এবার সেই সহজপাচ্য স্ট্যুয়ের মধ্যে মুরগী, আলু, মাশরুম, বাঁশের কোঁড় দেওয়া হয়। ফোড়নে আমাদের স্ট্যুয়ের মতই স্টার অ্যানিস, দারচিনি দেওয়া হয়। এই স্ট্যুয়ের প্রসঙ্গে মনে পড়ে Nonya chap chiye র কথা। এটি হল ব্রেইজড বা হালকা স্টার ফ্রাই করা সবজী দিয়ে বদ্ধপাত্রে রাঁধা ভেজিটেবল স্ট্যু।
গ্রিল্ড বাসা ফিশ হল রেস্তোরাঁর আরেকটি কাটতির আইটিম। সামুদ্রিক বাসা খুব নরম মাছ। অলিভ অয়েলে মাছের ফিলে গ্রিল করে পছন্দের সবজী যেমন অ্যাসপারাগাস, বেগুণ অথবা ঢেঁড়সের সঙ্গে সারভ করা হয়। ওপর থেকে লেমন কিম্বা গার্ললিক বাটার স্যস ছড়িয়ে, রোস্টেড সাদা তিল দিয়ে গারনিশ করা হয়।
এই নিবন্ধের মধুরেণ সমাপয়েত হবে সিঙ্গাপুরিয়ানদের পছন্দের স্যুইটডিশ Bo Bo Cha Cha দিয়ে। সমুদ্রের নোনাজলের কোল জুড়ে সাউথ ইষ্ট এশিয়ার নারকোল প্রীতি শয়নে, স্বপনে, জাগরণে। তাই ডেসার্টেও সেই ছোঁয়া। সাবুদানা দিয়ে ঘন করা নারকোলের দুধ। তারমধ্যে পড়বে চিনি। পান্ডান বা স্ক্রুপাইন গাছের পাতার সুগন্ধে নানা রকমের ফলের কুচি ছড়ানো সেই সেমি সলিড ডেসার্ট থাকবে শেষ পাতে। এর মধ্যে আবার কখনও কখনও পড়বে Yam বা সেদ্ধ করা ওল। আমাদের সেটি মোটেও পছন্দ হয়নি যদিও। তবে আইসক্রিম থেকে স্যুইস রোল, কেক, পাউরুটি কিম্বা নন অ্যালকোহলিক বেভারেজের মধ্যে পান্ডান পাতার ভুরভুরে সুগন্ধ বেশ অন্যরকম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন