কলকাতা লোকাল

কলকাতা লোকাল
পূর্বা মুখোপাধ্যায়
কিছু খাবার আছে যা কলকাতার নিজস্ব। সব জায়গাতেই এমন থাকে। স্ট্রীট ফুড বা রেস্তোরাঁর। আজ এই কোভিড নাইন্টিনের কোপে পড়ে পৃথবী জোড়া লকডাউন থেকে ভারত বা কলকাতাও কিন্তু গা বাঁচাতে পারে নি। এও এক বিশ্বায়ন। সমস্ত পৃথিবীটা আজ এক আতঙ্কের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সেই নিরাময় ট্রেনের। কেউ জানে না এর পর কী?
তবে এটা ঠিক যে এই সংকটকালে অনেক সৃষ্টি হবে। বলা যায় না, পরবর্তী সময়ে তা হয়তো নাম নেবে করোনা সাহিত্য, করোনা ফিল্ম, করোনা ফুড, করোনা স্টাইল। ঠিক যেমন বিশ্বজুড়ে বদল দেখেছিল মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। জামা-কাপড়, হেয়ার স্টাইল, ঘর-বাড়ি, ইস্কুল, পাঠ্য বিষয়। আজও বিশ্বসাহিত্যে সেরা যা কিছু তা ঐ বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অথবা তার পরে পরেই লেখা। ঐ গভীরতা বা উচ্চতাকে আর ছোঁয়া যায় নি। আজও বিশ্বযুদ্ধকালীন বিষয় নিয়ে সিনেমার দর্শকসংখ্যা প্রচুর।
ধরুন সাধারণ স্লাইসড ব্রেড। আমাদের রোজকার সকালের প্লেটের। তার সূচনা কিন্তু ঐ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের জন্য। ক্যান্ড ফুড, চিপ্স অথবা চীটোস, এবং ইন্সট্যান্ট কফি। রসবতীর ধারণা নতুন রান্নাবান্না তো আসবেই, তার সাথে সাথে বাইরের খাবার না খাওয়া এবং প্রিয় খাবারগুলো নিজের রান্নাঘরে বানিয়ে পরিবেশন এটাও আসতে চলেছে। মানুষ আর রিস্ক নিতে পারবে না।

রোল জংশন

লকডাউনের কিছুদিন পরেই রসবতীর ফুচকা খেতে ইচ্ছে করতে লাগল। এমনিতে যে সে রোজ ফুচকা খায় এমনটা নয়। কিন্তু আগে চাইলেই গিয়ে খেতে পারত। এখন আর তা সম্ভব নয়। ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে অনেকেই বানিয়ে ফেলছে। তাহলে যেটা ভাবছে রসো, সেটাই। মানুষ সব পারে। বিশেষ করে খাদ্য এমন জিনিস।
আর একটা – রোল। এটাও যে রসো খুব পছন্দ করে তা নয়। কিন্তু সেদিন হঠাৎ কথায় কথায় ক্যম্পারির রোলের কথা উঠল আর রসোর চোখের সামনে ভেসে উঠল সাদা প্লেটে মুচমুচে ঈষৎ বাদামী পরোটার ভেতরে চিকেনের তন্দুরে সেঁকা কাবাব, কাঁচা পেঁয়াজের ঝিরিঝিরি। প্লেটের একপাশে একটা পুরুষ্টু সবুজ কাঁচা লংকা। এই সব রোল কলকাতা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না এত সহজে, গলির মোড়ে মোড়ে। দিল্লি-বম্বের লোকেদের অপেক্ষা করতে হয় দুর্গা পূজা নয়তো ক্যালক্যাটা স্ট্রীট ফুড ফেস্টিভালের। আর আমাদের নিজাম, বাদশা, বেদুইন, হট কাটি, আজাদ হিন্দ, কত বলব! যাদবপুর এইট বি মোড়ে যান সন্ধ্যের দিকে। রোল ভাজার গন্ধে চারদিক ভরা, আর রাশি রাশি মানুষ ইয়াম্মোটা রোল খেতে খেতে হয় আড্ডা দিচ্ছে, নয় পথ চলছে।
কলকাতায় রোলের জন্ম সম্বন্ধে সবাই একমত, বাবার নাম নিজাম। তবে কেউ বলে তা আপিস বাবুদের তাড়াতাড়ির জন্য পরোটার মধ্যে কাবাব মুড়ে দেওয়া আবার কেউ বলে সাহেবরা না কি কাবাবে হাত দিয়ে খাওয়া তেমন লাইক করত না, তাই। সে যাই হোক, ছেলে জম্মেছে এটাই কথা, কেন জম্মালো, ঠিক কী ভাবে কী হল অতশত দরকার নেই। তা যাই হোক, অমন ছেলে জন্মালে ঘরে ঘরে, থুড়ি দোকানে দোকানে সাধ জাগে আমাদের শপে হবে সেই ছেলে কবে! কাজেই রোল নব নব রূপে, নানা স্বাদে ছড়িয়ে পড়ল এবং বাঙালি আহ্লাদে গপগপ করে খেতে লাগল।
রোলের অন্দরে কী থাকবে তা আপনার পছন্দের। মোট কথা কাবাব, চিকেন অথবা মাটনের। এবার রেশমী না বোটি না টিক্কা না শিক এগুলো আপনিই ঠিক করবেন।
রসবতীরও সাধ জাগল রোল খাওয়ার, তাই ঘরেই বানিয়ে ফেলল। রেসিপিটা এমন যা ঘরে সহজেই মিলবে এমন উপকরণাদি দিয়ে। এরপর আপনার সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী।

উপকরণ- ২ টো পরোটা বানানোর ময়দা, নুন, মিষ্টি, তেল ইত্যাদি।
আর চিকেনের জন্য- আড়াইশো গ্রাম বোনলেস, পায়ের দিক থেকে কাটা। এই মাংস সবচেয়ে নরম আর ছিবড়ে ভাবটা থাকে না।
এক টেবিল চামচ করে (১) আদা-রসুন পেস্ট, দই,টমেটো কেচাপ (সামান্য মিষ্টি ভাবটা আসবে এতে), নুন আর
এক চা চমচ করে (১) লাল লংকা (ঝাল না চাইলে কাশ্মিরী) গুঁড়ো, গোল মরিচ গুঁড়ো (ফ্রেশলি গ্রাউন্ড) জিরে গুঁড়ো আর গরম মশলা গুঁড়ো।
আর একটা পেঁয়াজ ঝিরিঝিরি করে কাটা, দুটো লংকা কুচি আর আধখানা ক্যাপ্সিকাম সরু সরু করে কাটা (অপশনাল)।
এবার কড়াইতে ৩-৪ চামচ তেল দিয়ে সমস্ত মশলা দিয়ে মাখা চিকেনগুলো দিয়ে ঢিমে আঁচে নাড়তে থাকুন যতক্ষণ না চিকেন একেবারে সুসিদ্ধ আর বেশ শুকনো হচ্ছে। চিকেন গুলো তুলে নিয়ে তেলটাতে ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ, লংকা কুচি আর ক্যাপসিকাম দিয়ে নরম করে ভেজে তুলে নিন। এখানে একটা কথা আছে। অনেকে কাঁচা পেঁয়াজ দেন। দিতেই পারেন, কোনোই অসুবিধে নেই। অনেকে ভেজে দেন। কাঠি রোলে কিন্তু ভেজেই দেয়। পসন্দ আপনা আপনা। আচ্ছা, কাঠি রোল কেন বলে জানেন তো? কাঠি বা শিকে ঝলসানো কাবাব দিয়ে হয় বলে। আপনি আমি তাও করতে পারি। তবে তাওয়ায় তাড়াতাড়ি হয়। ও, হ্যাঁ আর একটা কথা। ইচ্ছে হলে কাঠকয়লার ধোঁয়াও দিতে পারেন চিকেনটা হয়ে গেলে। ঐ তো একটা বাটিতে একটু ঘি দিয়ে একটা কাঠকয়লা পুড়িয়ে বাটির মধ্যে দিয়ে চিকেনগুলোর মাঝখানে বসিয়ে ঢেকে রাখুন অল্পক্ষণ। আসলে কাবাব তো কাঠকয়লার আগুনে করা হত, তাই এই গন্ধটা ভালো লাগে।
এবার পরোটা। লাচ্ছা পরোটার মতো করে বেলে নিন। না পারলে এমনিই গোল করে ভাজুন। তাও না পারলে, বা ইচ্ছে না হলে বাজারে যে পরোটা কিনতে পাওয়া যায় প্যাকেটে (সুমেরুর মালাবার পরোটা উদাহরণস্বরূপ) তাই ভেজে নিন। এবার একটা চপার বোর্ডে পরোটাটাকে রেখে প্রথমে চিকেনের টুকরো এক লাইনে সাজান। তার পাশের লাইনে পেঁয়াজ ভাজা বা কাঁচা, ওপর থেকে লেবুর রস। চাইলে চাট মশলা ছড়িয়ে দিন অল্প। এবার রোলটাকে যত্নে কিন্তু টাইট করে রোল করুন। ফয়েল বা কিচেন পেপার দিয়ে নীচটাকে মুড়ে দিন (দোকানে দেখেছেন যেভাবে করে ঠিক ঐভাবে)।
এবার একটু বৈচিত্র আনতে চাইলে, পরোটার ওপর একটা ডিম ফেটিয়ে দিন। দেখবেন গলে যেন চারিদিকে বেরিয়ে না যায়। কিছুক্ষণ রেখে ডিমটাকে সেট হতে দিন। তারপর উলটে দিন। এখন একটু বেরিয়ে যাবে পাশ থেকে, সেটা ঠিক আছে। খারাপ লাগবে না। ডিমের দিকটা বেশ ভাজা ভাজা হলে নামিয়ে তার ওপরে ঐ আগের পদ্ধতিতেই চিকেন দিন। এভাবেই কেবল এগ রোল করে ফেলতে পারেন। ঐ ভাবে পরোটার ওপর ডিমের গোলা দিয়ে ভেজে, তার ভেতরে পুরে দিন কাঁচা পেঁয়াজ, শশা আর ছড়িয়ে দিন সামান্য গোল মরিচ আর লেবুর রস।
আরো একটা আছে। চিকেন চীজ রোল। চিকেনটা তৈরি হয়ে গেলে একটা পাত্রে একটু হোয়াইট সস তৈরি করুন এবার তাতে চীজ গ্রেট করে দিয়ে একটা ক্রীমী পেস্ট তৈরি করুন। পরোটা ভাজা হলে চিকেন সাজিয়ে তার ওপর ঐ চীজের মিশ্রণটা আলতো করে ঢেলে দিন। বেশি দেবেন না, যাতে গড়িয়ে বাইরে চলে না আসে, ঠিক মুখ অব্দি থাকবে। এবার রোলটা মুড়ে দিন আগের নিয়মে।
যদি চিকেনে টিক্কা কাবাবের স্বাদ চান তা হলে বাজারে যে টিক্কা মশলা পাওয়া যায় তা মেশান এক চামচ।
মটন রোল চাইলে তাতে এক চামচ কাঁচা পেঁপে মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দেবেন। তারপরে ভাজবেন। বেদুইনে একটা ফিশ টিক্কা রোল পাওয়া যায়। ভেটকি বা যে কোনো বড় মাছ সেদ্ধ করে তার সাথে আদা, রসুন, পেঁয়াজ, নুন, লংকা, ক্যাপসিকাম, গরমমশলা, ধনেপাতা আর কাবাবচিনির গুঁড়ো আর একটা ডিম ভেঙে ভালো করে মিশিয়ে গোল গোল টিক্কার মতো গড়ে ভেজে নিন। এবার পরোটার ভেতরে সেই টিক্কা একটু বড় বড় টুকরো করে ভেঙে পেঁয়াজ, কাঁচা লংকা আর লেবুর রস দিয়ে মুড়ে নিন।
পনীর রোল হলে পনীরে ঐ আগের মতো মশলা দিয়ে, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম আত টমেটো কিউব করে কেটে স্কিউয়ারে গেঁথে আভেনে সেঁকে নিন হাল্কা বাদামী করে।
এভাবে চলুক আপনার নিত্য নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতা। এখন যে রকম ওয়ান পট মীলের চাহিদা বাড়ছে তাতে রোল কিন্তু পুরো ফিট।
তবে এখানে একটা কথা না বলে পারছি না। কলকাতার, বিশেষ করে শহরতলীতে স্ট্রীট ফুড হিসেবে যে সব রোলের দোকান, সেখানে অনেকেই রোলে টমেটো সস আর চিলি সস দিয়ে থাকেন। যদিও আপ রুচি খানা, তাও সস ব্যবহারে কাবাবের যে গন্ধ সেটা মার খায়। আর আলু সেদ্ধ দিয়ে রোলকে অযথা ভারী করবেন না। সমস্ত খাবারেরই একটা নিজস্বতা থাকে, তার অথেন্টিসিটি থাকে। রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্টে সফল হতে গেলে তার রসায়নকে বুঝতে হয়।
তবে যেভাবেই করুন না কেন, গরম গরম পরিবেশন করবেন। ধরে একটা কামড়, আর ইউ রক অ্যান্ড রোল। রসবতীর পাক্কা প্রমিস।

পরের স্টপেজ – ফিশ ওলে

যাঁরা নারায়ণ সান্যালের পঞ্চাশোর্ধ্বে পড়েছেন, এ কাহিনি তাঁদের জানা। নারায়ণবাবুর মেয়ের বিয়ে। বিশিষ্ট অতিথি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এসে পড়েছেন বিকেল বিকেল। এর আগেই নারায়ণ সান্যালের বিখ্যাত বই অজন্তা অপরূপা সংক্রান্ত আলোচনায় ভাষাচার্য লেখকের শ্রদ্ধার আসনের টপ ফ্লোরে। তাই লেখক অতিথি আপ্যায়ণের জন্য কেটারারের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে একটা প্লেট সাজাতে বললেন। সে সময় বিজলী গ্রীলের রমরমা। সমস্ত অভিজাত বিয়েবাড়িতেই, বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতায়, কেটারিং-এর জন্য বরাত পেত বিজলী গ্রিল। আর তাঁদের বিখ্যাত ছিল ফিশ ওলে আর রাশিয়ান স্যালাড, অনেকেরই মনে আছে নিশ্চই। তা, নারায়ণ বাবুর মেয়ের বিয়েতেও ছিল সেই বিখ্যাত আইটেম। কিন্তু লেখক বোধহয় অতশত জানতেন না; ওটা বোধহয় অন্য ডিপার্টমেন্টের হাতে ছিল। তাই প্লেটে ঐ বেগুনির মতো ভাজা বস্তুটি দেখে নারায়ণ বাবু শুধোলেন – এঁকে তো চিনিলাম না! ম্যানেজার নাম বলতে লেখক ভাবলেন দারুণ কিছু হবে বোধহয়। প্লেট এল ভাষাচার্যের সামনে। এবার তিনিও এই অচেনাকে দেখে প্রশ্ন করলেন- এর পরিচয়? নাম বলা হল। গভীর চিন্তায় পড়লেন চাটুয্যে মশাই। জানতে চাইলেন – নিবাস? অর্থাৎ কোথা থেকে আসা হল? খাওয়া ততক্ষণে মাথায় উঠেছে। গভীর কুঞ্চন ওডিবিএল-এর রচয়িতার কপালে। পরবর্তী কথা নিম্নরূপঃ-
“ভেটকি মাছের ফিশ ওলী স্যার! ইয়ে … মানে ফিশ ও’লি”।
– বানান কী?
ম্যানেজার ভদ্রলোক গলার টাইটা একটু আলগা করে দিয়ে বললেন, ‘ও’ আর ‘লয়ে দীর্ঘঈ’।
সুনীতিকুমার গম্ভীর হয়ে বললেন, সেটা তো সাঁত্রাগাছির ওল ‘স্ত্রীয়াম্ ঈপ্’। আমি রোমান হরফে বানানটা জানতে চাইছি।
ম্যানেজার এবার নিজেই অজ্ঞতা স্বীকার করে বললেন, ঠিক জানি না। বোধহয়, OLEE। শুনেছি জার্মান, না জার্মান নয়, ফ্রেঞ্চ ডিশ।
সুনীতিকুমার হাত গুটিয়েছেন। বলেন, উঁহু, জার্মান ভাষায় ভাজাকে বলে gebacken অথবা gebraten; ফরাসী ভাষায় ভাজা মাছ হচ্ছে frito poisons। ‘ওলী’ তো জার্মান-ফরাসী খাদ্য তালিকায় নেই। ‘ওলী’ শব্দটা কোথা থেকে এল?
মাথায় উঠল খাওয়া। উনি আরও ভেবে বললেন, স্প্যানিশ ভাষায় যতদূর মনে পড়ছে মাছ ভাজা হচ্ছে frito pescado – ইতালিয়ান ভাষায় fritte pesce । Olee কোথা থেকে এল?
আমার মেজদা নিরুপায় হয়ে বললেন, আজ্ঞে আপাতত এল রান্নাঘর থেকে। স্রেফ মাছ-ভাজা বলেই ধরে নিন না। ব্যুৎপত্তিগত না হক, উৎপত্তিগত হদিশটা তো পেলেন”।
সুনীতিকুমার বিদায় নেবার পরে বিজলি গ্রীলের ম্যানেজার নারায়ণবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আর ক’জন এমন ভাষাবিদ তাঁর নিমন্ত্রণ তালিকায় আছেন? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতন আর কেউ থাকে না কি? অমন পাণ্ডিত্য হয়?
তবে অর্থ যাই হোক না কেন, বিজলি গ্রীলের ‘ফিশ ওলী’ও কিন্তু একক। আর গল্প না করে বরং সোজা রান্নাঘরে যাই, দেখি কী কী লাগছে?

উপকরণ- অবশ্যই ভেটকি। বাসা নয়। ভালো ভেটকি, ভাজার পর ফ্লেকসে ভাঙবে, আর ফকফকে সাদা, তবেই না আসলি সোয়াদ! আর ফিলে কাটবেন সামান্য মোটা করে। আপনি তো আর ফুটপাথের দোকান দিচ্ছেন না, বাড়ির জন্য রাঁধছেন। মোটা হবে অনেকটা ক্রীম ক্র্যাকার বিস্কিটের মতো, আর চৌকো। চারধারে ছেঁড়াখোঁড়া যেন না থাকে। ধরুন ৬ পিস ফিলে , তাতে আন্দাজমতো পাতি লেবুর রস, নুন, গোলমরিচের গুঁড়ো (ফ্রেশলি গ্রাউন্ড) আর এক টেবিল চামচ আদা-রসুন পেস্ট ভালো করে মাখিয়ে মিনিমাম আধ ঘন্টা রাখুন।
এবার ব্যাটার। ময়দা আর কর্নফ্লাওয়ার সম অনুপাতে মেশান। ৬ টা ফিলের জন্য এক কাপ ময়দা আর এক কাপ কর্নফ্লাওয়ার, ঠিক আছে? এবার তাতে এক চামচ বেকিং পাউডার, নুন, গোলমরিচ আর এক চামচ আদা রসুন পেস্ট দিয়ে মেখে নিন। এবার একটা ডিম। এবার লাগবে এক্কেবারে ঠান্ডা সোডা ওয়াটার। না থাকলে বরফ ঠান্ডা জল। তবে সোডা ওয়াটারে ক্রিস্পি ভাবটা আসে ভালো। বেশ ঘন করে ব্যাটার গুলে নিন। অনেকটা বেগুনি-টেগুনি ভাজতে যেমন কন্সিস্টেন্সি হয়। তেল গরম করুন। ডীপ ফ্রাই হবে। সেই বুঝে তেল দেবেন। অনেক তেল খরচা হবে বলে চিন্তা করছেন? একটা কাজ করতে পারেন। ছোটো কড়াই নিন। গোল। তাতে তেল দিয়ে দুটো দুটো করে ভেজে তুলুন, সোনালি করে। ভালো করে তেল ঝরিয়ে তুলবেন, নইলে নরম হয়ে যাবে আর কিচেন পেপারের ওপর রাখুন। তেল টেনে নেবে। রাশিয়ান স্যালাড না পারেন, কাসুন্দি দিয়ে পরিবেশন করবেন অবশ্যই।


টার্মিনাল স্টেশন – ফাউল কাটলেট

রসোর রান্নাঘরে পড়ে থেকে থেকে যে বইটা তেল হলুদ লেগে রঙীন, জল হাতে পাতা উল্টিয়ে শত ছিন্ন, কিন্তু যেটা প্রায় ডিক্সনারী, সেটা হল পূর্ণিমা ঠাকুরের ঠাকুরবাড়ির রান্না। চাপড়ঘন্ট থেকে শুরু করে পর্ক ভিন্দালু সব রসোর শেখা ঐ বই থেকে।
“ন’মা (ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী) একটি লম্বা, মুদির খাতার মতো দেখতে, রান্নার হাতে লেখা খাতা আমাকে দিয়ে গেছেন। ……
ন’মা নিজে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢোকেন নি- রান্না করা তো দূরের কথা। নেমন্তন্ন বাড়িতে, কিংবা যে কোনো রান্নাই তাঁর ভালো লাগত, তখনই সেটি কী করে রাঁধা হয়েছে জেনে নিয়ে সুন্দর করে লিখে রাখতেন। খাতায় কত যে রান্না আছে কী বলব – সেগুলি যাতে হারিয়ে না যায়, তাই এই বই-” লিখছেন পূর্ণিমা ঠাকুর।
যারাই খেতে বা রাঁধতে ভালোবাসে তারাই এরকম সংগ্রহ করে। রসো অনেক ছোটোখাটো রেস্তোরাঁ থেকে এভাবে রেসিপি জেনেছে। বড়গুলোতে তো চান্স নেই। প্রথম যেবার ক্রিস্পি বেবি কর্ন খেয়েছিল, রাঁধুনিকে গিয়ে বলতেই সে বলে দিয়েছিল কী করে অমন মুচমুচে হয় বেবি কর্নেরা। হ্যাঁ, রসোকে এক আউন্স ন্যাকামি মিশিয়ে বলতে হয় বৈ কি, তবে রসোর তাতে প্রব্লেম নেই। ধাবার শিখ রসুইকারও শিখিয়ে দিয়েছিল টিপিকাল আন্ডা ভুজিয়া।
এভাবেই কলকাতার এক খ্যাতনামা ক্লাবের খানসামা খলিলের কাছ থেকে শেখা ফাউল কাটলেট। উঁহু, চিকেন কাটলেট বললে চলবে না। এ হল সেই সময়ের রেসিপি যখন বাবু-বিবিরা ফার্পোতে গিয়ে অর্ডার দিতেন – ফাউল কাটলেটের। যখন শরদিন্দুর গল্পে ডান হাতে ছুরি আর বাঁ হাতে ফর্ক দিয়ে কেটে এক টুকরো মুখে ফেলত ব্যোমকেশ। এ সব সেই ব্রিটিশ আমলের গল্প। চপ-কাটলেট-ডেভিল-মামলেটের গল্প – সেদিন রসো পড়ল এক অধ্যাপকের লেখা। সত্যিই সে দিন গেছে ঠিকই। কিন্তু রেসিপিকে চাইলেই বাঁচিয়ে রাখা যায়। আর হ্যাঁ, দয়া করে শর্টে মারবেন না। রান্নায় গোঁজামিল ঠিক ধরা পড়ে যায়, রসিকের রসনায়।
এবার জেনে নি রেসিপিটা।

উপকরণ- চিকেন কিমা ৫০০ গ্রাম, তার সাথে পার্সলে, পুদিনা আর ধনেপাতা কুচি, সব মিলিয়ে দু চামচ মতো, নুন, গোলমরিচ, লাল লংকার গুঁড়ো, এক চামচ গরম মশলা আর এক চামচ ভাজা মশলা আর সামান্য টমেটো কেচাপ মিশিয়ে রেখে দিন মিনিট পাঁচেক।
ততক্ষণে একটা চ্যাটালো পাত্রে ডিম, গোটা দুয়েক ফেটিয়ে রাখুন, আর একটা বড়ো ফ্ল্যাট পাত্রে বিস্কুটের গুঁড়ো/ব্রেড ক্রাম্ব রাখুন।
এবার গড়া, খুব ইম্পর্ট্যান্ট এই ব্যাপারটা কিন্তু। – প্রথমে কিমার মিশ্রণটাকে ইকোয়াল আটটা ভাগে ভাগ করুন। তারপর হাতের তেলোয় সামান্য তেল মেখে লম্বা করে নিন। সেটাকে রাখুন ব্রেড ক্রাম্বে। হাতের আলতো চাপে ফ্ল্যাট করুন।
এখানে বলে রাখি, চিকেন কাটলেট নানা জায়গায় নানা শেপের হয়। কোথাও গোল, কোথাও একটু ওভাল আর মাথায় একটা উইংসের হাড় গোঁজা, আর সবচেয়ে প্রাচীন ক্যালকাটা স্টাইল ফাউল কাটলেট হল – একদম পার্ফেক্ট ডায়মন্ড শেপ। সেটা করতে গেলে চপার টাইপের ছুরির সাহায্য নেবেন। গড়া হলে ডিমের গোলায় ডোবান, আবার ব্রেড ক্রাম্বে, আবার গোলায়, আবার ক্রাম্বে। হল?
ব্যস, আর কী? একটা কড়াইতে সাদা তেল গরম করুন। ফ্লেভারের জন্য তাতে এক টেবিল চামচ ঘি মেশান। আর হ্যাঁ, গ্যাস হু হু করে বাড়িয়ে নয়, ঢিমে আঁচে গোল্ডেন মুচমুচে করে ভেজে তুলুন।
সাথে কাসুন্দিটা ভুলবেন না কিন্তু!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “কলকাতা লোকাল

  1. বাঙালি নারীর ক্রিয়েটিভিটি,র অনেক টা জায়গা জুড়ে রয়েছে এই রান্নাবান্না এবং যা সকলের কাছেই বেশ পছন্দের এই লকডাউনে এই রকম রেসিপি জাস্ট মন ভরিয়ে দিল, খুব সুন্দর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *