rannaghor-poushlir-pithe-puli

পৌষালির পিঠে – পুলি পার্বণ
পাঞ্চালী দত্ত

(১)



বিকেলের কমলা আভা সারি সারি নারকেল সুপুরিগাছের পাতার ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বেড়ালটা পুকুর ঘাটের এক কোণে গুটিসুটি মেরে দিবানিদ্রাটুকু সারছে। দিনের শেষ মধুটুকু আহরণ করার কাজ চলছে মৌমাছিদের। জনা আট নয় মহিলা নিকানো উঠোনে সংক্রান্তির চাল গুঁড়ো করতে ব্যস্ত। গ্রাম বাংলার মহিলাদের সারাদিনে এই একটু সময় পাওয়া নিজেদের মত করে। প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা একজায়গায় হয়ে এভাবেই পার্বণের কিছু কাজ সারে হাতে হাতে; সঙ্গে গল্প, দু-চার কলি গান, একে অপরের চুল বাঁধার কাজটিও চলে সেইসঙ্গে। মাটির বারান্দার সিঁড়িতে আবছা আলপনায় আর কয়েকদিন পরেই বসবে চালের আঁকিবুঁকি। পৌষ সংক্রান্তিতে শুধুমাত্র বাহারি পিঠে তৈরিই নয়, কার উঠোন কতটুকু আলপনায় সেজে উঠবে, এটাও কিন্তু দেখার মত।
উঠোনের মাঝখানে গাইলচা(এটার মানে হল কাঠের বড় হামনদিস্তা যার গামলার উচ্চতা প্রায় কোমর পর্যন্ত এবং যে দণ্ড দিয়ে পেটাই করা হয় তা একটি মানুষের সমান লম্বা)। তিনজন করে মহিলা এক পর্বের চাল কুটো সারছে। বাকিদের আপাতত বিশ্রাম । তারপর আবার তাদের পালা এলে অন্যরা চালনিতে করে মিহি চাল আলাদা করবে আর পান চিবোবে। দেখতে দেখতে গামলায় গুঁড়ো চাল স্তূপ হয়ে আসবে।
এবারে সন্ধে প্রায় ছুঁই ছুঁই। তুলসিতলায় পিদিম জ্বালতে হবে। আজ এতটুকুই থাক। এখনো আরও তিনদিন বাকি আছে। এভাবেই একসঙ্গে অনেক পরিবারের চাল গুঁড়ো হবে এখানে। চাল নিয়ে আসবে যে যার বাড়ি থেকে। কুটো হওয়ার পর তারপর ভাগ হবে সমানভাবে।
“পৌষ পিঠার গুড়ি কুটা সুখের যন্ত্রণা
ঢেঁকি নাচে থাপুর থুপুর
আর নাচে সোনার নুপুর…”
গানের কলি গুনগুন করতে করতে যে যার বাড়ির পথ ধরে। কাল আবার দেখা হবে সইদের সঙ্গে। সংক্রান্তির আগের দিন বিকেল থেকে শুরু হবে পিঠে তৈরি।

(২)



পৌষ সংক্রান্তির ভোরবেলা কারো মাফ নেই। যতই ঠাণ্ডা পড়ুক না কেন, স্নান সারতেই হবে ছোট বড় সকলকে। হাড়হিম করা ঠাণ্ডায় স্নান সেরে আমরা হাজির হতাম মেরামেরি ঘরে(মেরামেরি ঘর সম্পর্কে একটু পরিচয় করিয়ে দেই। সংক্রান্তির আগেরদিন খড় ও দু চারটে বাঁশ দিয়ে উঠোনে ঘর তৈরি করে বন্ধুরা মিলে। সেদিন রাতে ওই খড়ের ঘরে রান্না করে সবাই মিলে। খাওয়া দাওয়া, গল্প, গান, খেলা চলে বহু রাত পর্যন্ত। পরদিন সকালে পুড়িয়ে দেওয়া হয় সেই ঘর)। জ্যাঠা কাকারা মিলে ততক্ষনে জ্বালিয়ে দিতেন ক্ষণস্থায়ী ঘরটি। মোড়া পেতে আগুনের চারপাশে বসে সবাই। মা, জেঠিরা প্লেট এ পিঠে নিয়ে হাজির। অনেক পরিশ্রমের ফসল! আলুর পিঠে, ছোলার পিঠে, মুগের পিঠে, দুধপুলি, মালপোয়া, পাটিসাপটা, পায়েস, ভাপা পিঠা, চষি পিঠা। আর মিঠা মুখকে ব্যালান্স করতে নিমকি মাস্ট। তারপর এ বাড়ি ও বাড়ি ঘোরা। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ‘পৌষ পার্বণ’-এ ঠিক এরকমই কিছু বর্ণনার সঙ্গে মিল পাই :
“আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর।
গড়িতেছে পিঠেপুলি অশেষ প্রকার।।
বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ, কুটুম্বের মেলা।
হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।।
পেটে জায়গা না থাকার দরুন পরের দিন বন্ধুদের হাত দিয়ে তাদের মায়েরা বাড়িতে পিঠে পাঠিয়ে দিত। বাড়িগুলো সেজে উঠত ধবধবে সাদা আলপনায়। ক্যামেরা নেই, মোবাইল নেই। চোখের লেন্সে বন্দি হয়ে যেত সেইসব নকশা। তারপর কখনো কোন একসময় মায়ের চাল গোলা থেকে একটু আধটু আঁকিবুঁকি করতে শুরু করি। প্রতিবছর একটু একটু করে ধারালো হতে থাকে নকশা। বিভিন্ন ঋতুর গান, সংস্কৃত শ্লোক মায়ের মুখে শুনে কখন যে শিখে ফেলেছিলাম বুঝতেই পারিনি। পৌষ সংক্রান্তির দিন কীর্তনিয়ারা বাড়ি বাড়ি আসতেন। কীর্তন করতেন, লুট দিতেন। সেই লুটের নকুলদানা, বাতাসা, কদমা পাওয়ার লোভে তাদের পিছু পিছু চলে যেতাম প্রতিবেশীদের বাড়ি। সেই থেকে আমার প্রথাগতহীনভাবে কীর্তন শেখা। আজকাল মাঝে মাঝে টিভিতে কীর্তন শুনি। কিন্তু কোথায় সেই আবেগ, কোথায় সেই সুরের মূর্ছনা যে মূর্ছনায় চোখের জল বাঁধ মানে না। স্কুল যাওয়া , বই পড়ার পাশাপাশি এগুলো ছিল আমার আটপৌরে শিক্ষা। সেদিন দুপুর বেলা ঝাল করে রান্না হত পাঁঠার ঝোল। আহা! একেবারে অমৃত! রাতের ঘুমটি তারপর পুষিয়ে নেওয়া হতো ।
(৩)


বাঙালীর ‘মিষ্টি’র স্বাদ যদি আমার কাছে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের গানের মত মনে হয়, তাহলে ‘পিঠেপুলি’ ও কিন্তু উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সুরের থেকে কিছুমাত্র কম নয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কলকাতার ময়রার দোকানের সাজিয়ে রাখা মিষ্টির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সুন্দরী বারনারীর। আমি কিন্তু পিঠেপুলির সঙ্গেও তার মিল খুঁজে পাই বড্ড। তিনি গানটি লিখেছিলেন
“বিম্বাধর, পানতুয়া, বাসিত-চন্দন চুয়া
ভাসিছে হাসির রসে, কিবে সুগঠন।।
… দেহেতে লাবণ্য নীর, যেন পাতা সাজোক্ষীর,
ঢলঢল সর তায়, সুখের যৌবন।
এই ক্ষীর, এই সর, সুমধুর বহুতর,
হায়, আমি কতক্ষণে করিব ভোজন।”
পৌষের শেষ দিন। নতুন চাল ফলানোর আনন্দে গ্রাম বাংলায় শুরু হয়ে যায় পিঠে পুলি তৈরি। এসময় ভারতবর্ষের নানাজায়গায় নবান্ন উৎসবটি হয় তবে বিভিন্ন নামে, যেমন, পাঞ্জাবে লোহরি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, আসামে ভোগালি বিহু ইত্যাদি। ভারতবর্ষে নানা ধর্মাবলম্বীর মানুষের বসবাস। নানারকম আচার ও নিয়ম। এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তাই আমি বাংলার পৌষ পার্বণের গল্পেই আবার ফিরে আসছি।
কবে পিঠেপুলি বাঙালির হেঁশেলে প্রবেশ করেছিল, সেই সময় বা সনের সঠিক হিসেব করাটা মুশকিল। তবে পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে পিঠেপুলি নিয়ে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে তাদের উল্লেখ পাই। যেমন চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে রয়েছে :
“খিরি অমৃ্তগুটিকা খেবাড়া নবাত
মনোহর পুরি দুগ্ধপুলি দুগ্ধজাত
আস্যা নারকেলপুলি শাঁকর কাঁকরা
চন্দ্রকান্তি পাত্রস পরমান্ন শর্করা
… পিঠা পানা ভোজনে বৈষ্ণবে সন্তোষিলা
মাল্য চন্দন দিয়া সভারে ভূষিলা।”
সে যুগে আজকালকার মত এতরকম মিষ্টি উপলব্ধ ছিল না। নারকেল, চিড়া, মুড়ি, খই, চাল, দুধ দিয়ে তৈরি হত নানারকম পিঠে
“কাঞ্জিবড়া দুগ্ধচিড়া দুগ্ধলকলকী
আর যত পিঠা কৈল
কহিতে না শকি
ঘৃতসিক্ত পরমান্ন
মৃৎকুণ্ডিকা ভরি।”
কবি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগর পত্নীর প্রস্তুত খাদ্যসামগ্রীতেও লেখা আছে পিঠের গল্প
“খিড় খিড়িয়া রান্ধ্রে দুগ্ধের পঞ্চপিঠা,
গুড় চিনি দিয়া রান্ধে খাইতে লাগে মিঠা।”
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বাংলার মানুষের খাদ্যদ্রব্যের যে তালিকা দিয়েছেন তাতেও ‘পিঠা’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে “নির্মাণ করিত পিঠা, বিশা দরে কিনে আটা।” মৈমনসিংহ এর লোককবি মলুয়া পালাতে অথিতি অভ্যর্থনায় ‘পাত পিঠা’, ‘বরা পিঠা’, ‘চন্দ্রপুলি’র কথা উল্লেখ করেছেন এবং পিঠার সঙ্গে রসের যে মেলবন্ধন সেটাও তুলে ধরেছেন “‘পাত পিঠা’, ‘বরা পিঠা’ ‘চিত চন্দ্রপুলি’,
পোয়া চই খাইল কত রসে ঢলাঢলি”।
এতো গেল মধ্যযুগের বাংলার পিঠেপুলির কথা। কিন্তু পিঠের কথা রয়েছে বৈদিক যুগেও। তখন যজ্ঞে ব্যবহার হত যব দিয়ে একধরণের পিঠে যার নাম ছিল পুরোডাশ। এটা ছিল সেই যুগে অত্যন্ত পবিত্র একটি মিষ্টির পদ যার উল্লেখ আমরা মহাভারতেও পাই যখন ভীম কর্ণকে (কর্ণ তখন সদ্য অঙ্গরাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন) ব্যাঙ্গোক্তি করে বলেছিলেন ‘কুকুর যজ্ঞের পুরোডাশ খেতে পারে না, তুমিও অঙ্গরাজ্য ভোগ করতে পারো না’।
(৪)


শীত, পিঠে-পুলি আর নতুন গুড়-এ নাহলে বাঙালির পৌষমাস ঠিক জমে না। নতুন গুড় বা নলেন গুড়ের মাধুর্য গোটা শীত ঋতুকে মিঠে আমেজে ভরিয়ে রাখে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ এই তিনমাস ধরে গ্রামে গ্রামে চলে খেজুর রস সংগ্রহ। খুব আহ্লাদি গুড়। অতি যত্নের ‘মেহমান’ তিনি। খেজুর গাছ কাটতে হয় সূর্য ডোবার পরে। গাছ কাটতে হয় খুব সাবধানে। কারণ উল্টোপাল্টা কোপে গাছ মরেও যেতে পারে। রসের মিষ্টতা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি কারণে, যেমন, গাছের বয়স, কতবার গাছটি রসের জন্য কাটা হয়েছে বা জিরান দেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, প্রবীণ ও জিরান (গাছ থেকে রস নেবার পর কয়েকদিন বিশ্রাম দেওয়া) গাছেদের রসের যেমন সুঘ্রান তেমনি মিষ্টি বেশি। ভাল খেজুর গুড়ের জন্য ডাক্তার কিন্তু সিউলি বা গাছি। তারা জানে খেজুর গাছ ও গুড়ের প্রতিটি নাড়ির স্পন্দন। গাছে হাঁড়ি বাঁধতে হয় সূর্যাস্তের পর কারণ দিনের আলোয় সংগ্রহ করা রস ততটা মিষ্ট হয় না। তার আগে হেঁসো (কাস্তের মত অস্ত্রবিশেষ) দিয়ে গাছের কিছু অংশ বিশেষ উপায়ে চেঁছে দিতে হয়। তারপর একটা বাঁশের কঞ্চিকে মাঝখান থেকে ভাগ করে গাছটির কাটা অংশের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হয়। এভাবে কঞ্চির নল দিয়ে রস এসে হাঁড়িতে পড়ে। ভোর রাতে খুব সাবধানে বড় পাত্রে রস ছেঁকে বিশেষ মাটির উনুনে বসাতে হয়। তারপর কয়েক ঘণ্টা ধরে রস জ্বাল দিতে হয়। উনুনকে বলা হয় ‘বাইন’ বা ‘বান’। খুব যত্ন সহকারে রস ফোটাতে হয়। জ্বাল বেশি হলে গুড় কালো হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আর সর্বক্ষণ নজরে না রাখলে পোড়া ধরার সম্ভবনা খুব বেশি। তাই আদুরে এই গুড়কে ময়রাও কিন্তু আদরে সোহাগে পোষ মানিয়ে অবশেষে ছাঁচে ফেলে। একটা মিষ্টি খেতে আমাদের বোধহয় এক মিনিটও লাগে না কিন্তু তার পেছনে পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ধৈর্য-কাগজে লিখে বোঝানো অত সহজ নয়।
সবে আকাশে আলো ফুটছে, কুয়াশা তার চাদর খুব সাবধানে অনাবৃত করছে আর ততক্ষনে সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক স্নিগ্ধতা, প্রীতি, আহ্লাদ ও মধুর রসের ধারা যা আর কয়েকদিন পর আমাদের রসনাকে সিক্ত করে ধন্য ধন্য কুড়োবে। ধন্য জুটবে সেই গুড় বা দোকানীর। কিন্তু যারা অদৃশ্যভাবে ঘুম খাওয়া ভুলে ভালো গুড় বানানোর আপ্রান চেষ্টা করেন, সেই সিউলিদের কথা আমরা মনে রাখি না।
বাঙালি মায়েরা পিঠে পুলির আগে নলেন গুড় দিয়ে পায়েস তৈরি করে পৌষ পার্বণের সূচনা করবে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। শুধু দুধ দিয়ে পায়েস করার যে হ্যাপা, সেটা নলেন গুড়ের পায়েসে অনেক কম কারন গুড়ের মাহাত্ম্যে এমনিতেই পায়েসের স্বাদ বেড়ে যায়। কিন্তু ওই যে বড় আদুরে গুড়! গুড় মেশানোর সময় সাবধানতা অবলম্বন না করলেই দুধ ফেটে দই হয়ে যাওয়ার পুরো গ্যারান্টি। ফুটন্ত দুধে গুড় নৈব নৈব চ। তবে পায়েস কী শুধুমাত্র চাল দিয়েই হয়? উঁহু! বাঙালির রসনা অতই কি সহজ সরল সমীকরণের! এধরণের পায়েস চাল ছাড়াও চষি, খোয়া, গম দিয়েও তৈরি করা হয়। চষি আবার চালের গুঁড়ো দিয়ে অথবা সুজি ও নারকেল দিয়েও বানানো হয়। প্রতিটি পায়েসের স্বাদ আলাদা যদিও ভিত্তি এক। আমি কিন্তু এবারো সেই স্বাদের সুরের স্রোতের স্কেল খুঁজে পাচ্ছি, ঠিক যেমনটি ক্লাসিকাল গানের কোনটা আশাবরী, কোনটা কাহারবা বা দাদরা।
শুধু কি আমরাই পায়েস রাঁধতে জানি? রাজা নল যিনি ছিলেন রান্নায় সিদ্ধহস্ত, তাঁর ‘পাক দর্পণ’ বইটিতেও কিন্তু রয়েছে অনেক ধরনের পায়েসের প্রনালী (পায়সপ্রকারনিরুপনম / types of pudding) ‘অথ ভেদান প্রবক্ষlমি পায়সস্য বিচিত্রকান। ত্বচং লশুনভাগানাং সমুসৃজ্য প্রয়ত্নতঃ।’ এখানে চাল, গম, ফল দিয়ে পায়েসের পাশাপাশি রসুন দিয়েও পায়েস রান্নার কথা উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদে ‘ক্ষীরপাকম ওদনম’ কথাটি পাই যেখানে ওদন শব্দের অর্থ ভাত। তাই ভাত ও ক্ষীর মিলেমিশে পায়েসের মতই সেইসময় কিছু তৈরি হত সম্ভবত। যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে তার নতুন সভাগৃহে ব্রাহ্মন ভোজনের দিন পায়েস খাইয়েছিলেন এবং এটার বিশেষত্ব ছিল মধু মিশ্রিত পায়েস ‘পায়েসেনৈব মধুনা মিশ্রিতেন’। পায়েসের কথা চৈতন্যমঙ্গল কাব্যেও পাই যেখানে নিমাইয়ের স্ত্রী, লক্ষ্মীদেবীর বিয়ের পর হেঁশেলে প্রবেশ, সঙ্গে রয়েছেন শচীমাতাও-
“রন্ধনশালায় প্রবেশিলা লক্ষীমাতা।
শচী ঠাকুরানি গেলা দেখিবারে তথা।।
পঞ্চাশ ব্যঞ্জন অন্ন রান্ধিল কৌতুকে।
পিষ্টক পায়স অন্ন রান্ধিল একে একে।।”
(৫)



দুধ ছাড়া যে মিষ্টি চিনি বা গুড়ে পাক দিয়ে প্রস্তুত করা হয়, তাকে আমরা সাধারনত মোয়া বা নাড়ু বলি। সেই মোয়া বা নাড়ুতে যে নামগুলো জায়গা পায়, তারা হল নারকেল নাড়ু, খইয়ের মোয়া, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, বাদামের নাড়ু, চিড়ার মোয়া ইত্যাদি। আর শীতের মরশুমে পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি মোয়ার কথা উল্লেখ না করলে পাপ হবে এবং সেটা হল ‘জয়নগরের মোয়া’। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় অবস্থিত এই জয়নগর মজিলপুর জায়গাটি। যদিও জয়নগরের মোয়ার জন্মস্থান বহড়ুতে, কিন্তু জয়নগর জায়গাটি বহড়ু অপেক্ষা বড় ও ব্যবসাকেন্দ্রিক অঞ্চল। তাই বহড়ু নামটি শেষমেশ চাপা পড়ে যায় এবং জয়নগর সেখানে প্রাধান্য পেয়ে যায় খুব স্বাভাবিকভাবেই। এই মোয়ার বিশেষত্ব হল কনকচূড় ধানের খই এতে ব্যবহৃত হয়। কনকচূড় খই ও নলেনগুড় দিয়ে তৈরি হয় এই মোয়া। তাই এই মোয়া শীতের অথিতি। ঠিক পরিযায়ী পাখির মত। মোয়ার কথা শেষ করছি ছোট্ট একটা টিপস দিয়ে। যদিও জানেন, তবুও নিজের দক্ষতা বা ব্যর্থতাটুকু আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। মোয়া বা নাড়ুর আসল কাজ হচ্ছে ‘পাক দেওয়া’। সঠিক সময়ে, সঠিক তাপমাত্রায় নাড়ু পাকাতে না পারলে চোখের জলে নাকের জলে পরিশ্রম পণ্ড হবে। স্বয়ং ভুক্তভোগী। প্রথম মোয়া বানানোর সেদিন হাতেখড়ি ছিল আমার। যেই না ফুটন্ত গুড়ে খই ফেলেছি, চুপসে খই ভাত। সেই ভুল থেকে অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতা থেকে শেখা।
পঁচিশ বছর আগে যখন কলকাতা এসেছিলাম, বড্ড মিস করেছিলাম পৌষ পার্বণটি। এখনো করি। ব্যস্ততার শহরে সংক্রান্তির দিন মেলেনি পিঠের কোন গন্ধ। আমার কাছে কলকাতা তখন নতুন শহর। ভেবেছিলাম এখানকার মহিলারা বোধহয় পিঠে তৈরি জানেই না। বাটিতে করে দু-এক বাড়ি থেকে আমার জন্য পায়েস ও পাটিসাপটা এসেছিল, তবে এতটুকুই। পোয়াতি শরীরে সেদিন মনটা আমার ভারাক্রান্ত। মনে পড়ছিল সেই মেরামেরি ঘরটির কথা, ভাইবোনের কথা, পিঠের ম ম গন্ধে ভরা মায়েদের কর্মকাণ্ডের সেই রাতগুলোর কথা। দোকানে পাওয়া যায় শুনে পিঠে আনিয়েছিলাম। নাহ, সেই স্বাদ পাইনি। হয়ত মা কাকী জেঠিদের হাতের ছোঁয়া নেই, তাই মেনে নিতে পারিনি। জানি না। তবে আর কখনো পিঠে আমি কিনে খাইনি। বহু বছর ধরে নিজে বানাই। আসলে পিঠে তৈরির প্রচুর পরিশ্রম। তাই হয়ত অনেকে সাহস করেন না বা ঝামেলা এড়াতে চান। তবে কয়েকবছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ‘পিঠেপুলি উৎসব’ হয়, তাতে দেখেছি মহিলারা নতুন উদ্যমে পিঠে তৈরি করে স্টলে বিক্রি করেন। ক্লাবের পক্ষ থেকে থাকে প্রতিযোগিতা, উপহার ও স্মারক। ফলত কোথাও যেন মানসিকভাবে কাজের উদ্যম বেড়ে যায় এবং এতে আমি লক্ষ্য করেছি যে অনেক হারিয়ে যাওয়া পিঠে ফিরে আসছে আবার। ভাল লাগে এই ইতিবাচক এগিয়ে যাওয়াটা দেখে। এভাবেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বেঁচে থাক শহরের নিয়ন আলোতে, ছোট্ট ছোট্ট প্রশংসা, সম্মান ও স্বীকৃতির মাধ্যমে।
ঠাকুরবাড়িতে পিঠে পুলি ও পায়েসের চল ছিল প্রচুর। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী বিভিন্নধরণের পায়েস তৈরি করতে জানতেন। সেইসব রেসিপি তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন বিস্তারিতভাবে। এছাড়া তিনি যেহেতু অসমিয়া সাহিত্যিক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সহধর্মিণী ছিলেন, তাই অসমিয়া রান্না নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল অসমীয়াদের জনপ্রিয় কিছু পিঠা। সেগুলোর কথা ও রেসিপি তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন খুব সুন্দরভাবে, যেমন সাউ পিঠা, গিলা পিঠা, পোড়া পিঠা, তিল পিঠা, চোঙা পিঠা।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার নানা জেলায় নানারকমের পিঠে বানানো হয়। সেগুলোর রয়েছে প্রচুর গল্প। সেই গল্প আরেকবার হবে। কিন্তু কিছু পিঠের নাম আমি অবশ্যই উল্লেখ করব নাহলে পিঠে পুলি পার্বণের এই লেখা কোথাও যেন অসমাপ্ত থাকবে। আসক্যা পিঠে, খেজুর গুড়ের ভাপা পিঠে, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, দুধ পুলি, পাকন পিঠা, রসবড়া, সিদ্ধ পিঠা, তিল পিঠা, চুষি পিঠা, নকশি পিঠা, ছোলার পিঠা, চিড়ের পিঠা, মুগের পিঠা, চন্দ্রপুলী, গোকুল পিঠা, মাংসের পিঠা, মাছের পিঠা ইত্যাদি।

পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *