Rannaghor – Roja O Iftar

সেকাল ও একালের রোজা ও ইফতার

(আল্পনা হাবিব)

সাধারণত ইসলাম ধর্মে পালনীয় গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রোজা, এবং এই রোজায় বাধ্যতামূলকভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের একমাসব্যাপী উদযাস্ত নির্জলা উপোস করতে হয়। আর এই রোজা আরবি বছরের পবিত্র রমজান মাসকে ঘিরে হয়ে থাকে। রোজার দিন আরবি বছর অনুযায়ী এগারো দিন করে প্রতি বছরে পিছিয়ে যায়। সেই অনুযায়ী কোন বয়সে শীতের সময় রোজা পেয়েছি মনেও পড়ে না। তবে এখন রোজা যত দিন যাচ্ছে গরমের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। দিনের দৈর্ঘ্যও বাড়ছে, কাজেই উপোসের সময়ের পরিমাণেরও ব্যাপ্তি ঘটছে। ছোটবেলা থেকেই রমজান মাস ছিল আমার সব থেকে প্রিয় মাস। যদিও এটা মুসলিম সমাজের জন্য কঠিন সংযমের মাস। তবুও এর যে বিভিন্ন পার্বনিক উপাচারগুলো আছে তা পালন করার মধ্যেও একধরণের আনুষ্ঠানিকতা ও আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

রোজার মধ্যে বিশেষ একটি অংশ হচ্ছে সেহরি ও ইফতার। রাতের শেষ প্রহরে উঠে খাওয়াই হচ্ছে সেহরি, তারপর সারাদিন খাওয়া বন্ধ একেবারে সূর্যাস্ত অবধি। ছোটবেলায় মনে পড়ে যখন বাবা মা উঠতেন এবং আমাদেরকে রোজা রাখতে দেওয়া হতো না তখন মশারি তুলে উঁকি মেরে থাকতাম। মা হেসে আদর করে ডেকে নিতেন আর তারপরে জোর করে খাওয়ানো হতো দুধ, কলা, ভাত।

আসি ইফতারের কথায়। বাংলাদেশের কোন সভ্যতা থেকে এসেছে জানিনা তবে জন্মের পর থেকে দেখে আসছি ইফতার মানেই শরবত, খেজুর, পেঁয়াজি, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি এগুলো যেন একেবারে বাধ্যতামূলক। আমি কলকাতায় দু-একবার রোজার সময়ে গেছি সেখানে নিউ মার্কেট বোধহয় মুসলিমপ্রধান এলাকা বলে দোকানে দোকানে দেখেছি পাতার খুড়িতে কাটা ফল সাজানো হচ্ছে ইফতারের জন্য।

সত্তরের দশকের পর ইফতারের সাথে যোগ হলো হালিম আর দইবড়া। তখন থেকে মানুষ এই দুটো খাবারের স্বাদ রপ্ত করতে শিখেছে। বাড়ীতে তখন এত পদ রান্নার বাহুল্য ছিল না। তবে হ্যাঁ, পুরোনো ঢাকার মানুষরা বেশীরভাগ কেনা ইফতারই খেতেন। কারণ সেখানে চকবাজার বকে একটি জায়গা আছে যেখানে ইফতারের বিশাল বাজার বসত, আজও বসে। সেই ইফতার বাজারে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজি ও বেগুনির পাহাড় ছাড়াও আরো থাকতো ঘিয়ে ভাজা জিলিপি, হালিম, পায়া, আস্ত মুরগির রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, এছাড়া তেহারি, পোলাও, মোরগ পোলাও, ঘুগনি, ফালুদা, লাচ্চি, বুন্দিয়া নানারকমের ফিরনি, খাস্তা পরোটা ও বিভিন্ন ধরনের কাবাব। আমার ছোটবেলায় ইফতারের কথা মনে পড়ে আমাদের বাড়িতে সবসময় কিছু উদ্বৃত্ত ইফতার রাখা থাকতো ফকিরের জন্য। একটি গামলায় কিছু ছোলা মুড়ি আর তার সাথে কিছু পেঁয়াজি বেগুনী ভেঙে মাখিয়ে রাখা হতো। ইফতারের কিছুক্ষণ পরেই একপাল ছোট ছোট বাচ্চারা “আম্মা ইফতারী দিবেন, ইফতারী দিবেন” বলে হল্লা করতে করতে আসতো। ওদের হাতে ঠোঙা থাকতো, আমরা সেই গামলা থেকে মুঠো মুঠো করে ওদের ঠোঙায় ইফতারী ভরে দিতাম। আজকাল তো ফকিরেরও অকাল। রাস্তায় দেখা হলে বাড়িতে আসতে বললে বলে অন্য জায়গায় নাকি দাওয়াত আছে। ঈদের বাজারের তো কোন সকাল সন্ধ্যা নেই। একবার মার্কেটে ইফতারের সময় হয়ে গেল। দেখলাম দোকানে দোকানে সব দোকানদারেরা গোল হয়ে বসে একটি বড় গামলায় পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ সর্ষের তেল আর আদা কুচি দিয়ে ঘুগনি বেগুনি পেঁয়াজি আলুর চপ ছোলা মুড়ি সব একসাথে মাখিয়ে সবাই মুঠো মুঠো করে খাচ্ছে। আমাকে দেখে বললো, “আফা, খাইবেন নাকি একমুঠ ?” খেয়ে দেখলাম, অমৃত ! যারা কাস্টমার তারা কোল্ড ড্রিংক আর কেনা ইফতারের ঠোঙা নিয়ে দোকানের ফুটপাতেও বসে পড়েছে। এই যে সবার একই সাথে একই সময় খেতে বসা, আজানের সাথে সাথে খাওয়া, যার ইফতার জোটেনি তাকে টেনে নিয়ে দলের মধ্যে সামিল করা এটাও কিন্তু একধরণের ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় দেয়।

আগের দিনে যেমন মানুষেরা ধৰ্ম ভীরু ছিল, প্রাপ্ত বয়স্ক সকলেই রোজা রাখতো। আর আজকাল ধর্মান্ধতা বেড়েছে, মানুষ নানান ফতোয়া দিচ্ছে। কিন্তু রোজা রাখার বেলায় যেন একটা অপশনাল ব্যাপার হয়ে উঠেছে। বাড়িতে অনেকেই ইফতার বানায় না, ভিড় জমায় দামী দামী রেস্টুরেন্টের ইফতার বাজারে। গাদা গাদা টাকার শ্রাদ্ধ করে যা কিনে আনে তার স্বাদ তো নয়, যেন টাকা চিবিয়ে খাওয়া। যেসব গৃহবধূরা বা বাড়ির উঠতি বয়সী মেয়েরা ইউটিউবের দৌলতে রান্নাঘরে ঢোকে তাদেরই বরাতে ভালো কিছু জোটে।

আসলে আগেরদিনে পরিবারগুলো বড়ো ছিল। বাড়ির কাজের লোকসহ কতগুলো মানুষের পাত পড়তো একই সাথে, একই সময়ে। দুপুরের পর ইফতারের আয়োজন শুরু হয়ে যেত। বাড়ির গৃহিণীদের সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত থাকতো মহা ব্যস্ততা। বাড়ির মানুষগুলি সারাদিন উপোস করে ভালোমন্দ খাবে, তাতে কত যত্ন, কত ভালোবাসা, কত আন্তরিকতা। আজকাল আণুবীক্ষণিক পরিবার, চারজনের মধ্যে তিনজনই হয়ত রোজা রাখেন না। বাকি অন্যজন হয়তো টিভির সামনে বসে ইফতার খায়।

আমার বাড়িটি কিন্ত এখনো যৌথ পরিবার। আমার সন্তানেরা বেড়ে উঠেছে ছোট বড় সবাই মিলে একসাথে ভাগ বাটোয়ারা করে ইফতার খাওয়ার আনন্দের মধ্যে দিয়ে। সবাই ভাবে আল্পনা হাবিবের বাসায় না জানি কি ইফতার হয়। আসলে বাড়িতে নেমন্তন্ন হলে আমি টেবিলের এমাথা ওমাথা খাবার বানিয়ে সাজাই, আমার ভালো লাগে। কিন্তু রোজকার ইফতারে যাই বানাই না কেন প্রথমে ছোলা, পেঁয়াজি, বেগুনি, জিলাপি লাগবেই। ওই জিনিস খেলে কি আর পেটে জায়গা থাকে ? তাই একটা করে স্পেশাল ডিশ বানাই তার সাথে। সেইরকমই আমার বিশেষ জনপ্রিয় দুটি রান্নার রেসিপি আপনাদের জন্যে তুলে দিলাম।

বাসি চমৎকারি

অতিথি আপ্যায়নে বেঁচে যাওয়া খাবার দিয়ে চমৎকারভাবে আবার অতিথি আপ্যায়ন হয়। তাই এর নাম বাসি চমৎকারি।

কী লাগবে

বাসি পোলাও ৪ কাপ
রান্না করা মাংস ১ কাপ
পেঁয়াজকলি কুচি ১/২ কাপ
কাঁচা মরিচ, ফাড়া ৮-১০টা
ধনেপাতা কুচি ১/২ কাপ
ডিম ৩টা
সরিষার তেল ১/৩ কাপ
টমেটো কুচি ১/২ কাপ
আমের টক-ঝাল আচার ৩ টেবিল চামচ
পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ
লবণ ১ চা চামচ

কী করবেন

০১ রান্না করা মাংস ছোট করে কেটে নিন।

০২ কড়া আঁচে সরিষার তেল গরম করুন। মাংস ভাজা ভাজা করুন। পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ দিয়ে ভাজুন।

০৩ টমেটো কুচি দিয়ে ভাজুন। ডিমগুলো ভেঙ্গে দিয়ে ভাল করে নেড়ে ডিম ঝুরি ঝুরি করে নিন ও ১ চামচ লবণ দিয়ে মেশান।

০৪ ধনেপাতা কুচি দিয়ে ভাজা ভাজা করুন।

০৫ পোলাও দিয়ে মেশান।

০৬ পোলাও ভুনা ভুনা করে তার মধ্যে টক আচার মিশিয়ে দিয়ে ঢেকে অল্প আঁচে ১০ মিনিট দমে দিয়ে রান্না করে পরিবেশন করুন।

 

দহি বড়া

কী লাগবে

বড়ার পানির জন্য:  পানি ৫ লিটার
গোলানো তেঁতুল ১/৪ কাপ
লবণ ২ টেবিল চামচ
দইয়ের মিশ্রণ: মিষ্টি দই ১ কেজি
[বিকল্প: ১ কেজি টক দই, ১ কাপ চিনি]
চিনি ১/২ কাপ, দুধ ১ লিটার
ভাজা শুকনা মরিচ গুঁড়া ১ চা চামচ
রসুন বাটা ১ ১/২ চা চামচ
তেঁতুল গোলা, ঘন ১/২ কাপ
ফোঁড়নের জন্য:
শুকনা মরিচ, আস্ত ১০টা
কারি পাতা ১/৩ কাপ
সরিষা, জিরা, আস্ত ১ চা চামচ
ভাজা শুকনা মরিচ, গুঁড়া ১/২ চা চামচ
বড়ার জন্য:
মাষকলাই-এর ডাল ১ কাপ
আদা বাটা ১ চা চামচ, লবণ ১ চা চামচ
রান্নার তেল ৩ কাপ

কী করবেন

০১ পানি, তেঁতুল ও লবণ একটি পাত্রে মিশিয়ে রাখুন।

০২ সব উপকরণ ফেটে নিন।

০৩ মাষকলাই এর ডাল সারারাত ভিজিয়ে নিন। ডাল ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।

০৪ ডালের সাথে ১ কাপ পানি দিয়ে ব্লেন্ডারে মসৃণ করে ব্লেন্ড করুন।

০৫ ব্লেন্ড করা ডালে আদা বাটা ও ১ চা চামচ লবণ দিন। এগ বিটার দিয়ে ফেটে নিন।

০৬ কড়া আঁচে তেল গরম করুন। বড়া তেলে ছেড়ে জ্বাল ঢিমা করে দিন। ২-৩টি বড়া ছাড়ার সাথে সাথে আগের বড়াগুলো উল্টে দিতে থাকুন। এতে প্রতিটি বড়ার একটি ভাজা স্তর তৈরি হবে, ফলে ভেতর থেকে কাঁচা ডাল আর বের হয়ে আসবে না।

০৭ ঢিমা আঁচে বড়াগুলো সোনালি করে ভাজুন।

০৮ বড়া ভাজা হলে বড়ার পানিতে ঢালুন। ঢেলে ৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন।

০৯ এমন একটি পরিবেশন পাত্র নিন যাতে ২০টি বড়া পাশাপাশি খানিকটা ফাঁক রেখে বসান যায়।

১০ পাত্রে ১/২ কাপ দইয়ের মিশ্রণ ছড়িয়ে একটি স্তর তৈরি করুন।

১১ প্রতিটি বড়া পানি থেকে তুলে এক হাতের তালুতে বসান। আরেক হাতের তালু দিয়ে সাবধানে চাপ দিয়ে পানি নিংড়ে বের করুন।

১২ এবার নিংড়ানো বড়াটি দইয়ের মিশ্রণে ডুবিয়ে পরিবেশন পাত্রে রাখুন।

১৩ বাকি দইয়ের মিশ্রণ বড়াগুলোর ওপর ঢেলে সমানভাবে ছড়িয়ে দিন।

১৪ কড়া আঁচে আলাদা কড়াইয়ে বড়া ভাজার তেল থেকে ৩ টেবিল চামচ তেল দিন।

১৫ তেল গরম হলে ফোঁড়নের আস্ত শুকনা মরিচ দিন। ফোঁড়নের জিরা ও সরিষা দিন। জিরা ও সরিষা ফুটে উঠলে কারি পাতা দিন।

১৬ এবার ফোঁড়নের তেল পরিবেশন পাত্রে বড়ার ওপর ঢেলে সমান ভাবে ছড়িয়ে দিন।

১৭ প্রতিটি বড়ার ওপর ভাজা শুকনা মরিচের গুঁড়া একটু একটু করে ছড়িয়ে দিন।

-সমাপ্ত-

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *