আফরোজা নাজনীন
সাদা শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। এই ফুল সাধারণত ভারত উপমহাদেশে দেখা যায়। হাওড়-বিল ও দিঘিতে এটি বেশি ফোটে। এই উদ্ভিদ প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সাদা শাপলা বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইয়েমেন, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশের পুকুর ও হ্রদে দেখা যায়। এই ফুল পাপুয়া নিউগিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায়ও দেখা যায়। এই ফুল যেমন দেখা যায় চাষের জমিতে, তেমনই হয় বন্য এলাকায়। কাটা ধান ক্ষেতের জমে থাকা অল্প পানিতে এই ফুল ফুটে থাকতে দেখা যায়। বিশ্বে এই উদ্ভিদের প্রায় ৩৫টি প্রজাতি পাওয়া গেছে।
শাপলা ফুল ভোর বেলা ফোটে এবং দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে পাঁপড়ি বুজে যায়। সরাসরি কাণ্ড ও মূলের সাথে যুক্ত থাকে। শাপলার পাতা আর ফুলের কাণ্ড বা ডাটি বা পুষ্পদণ্ড পানির নিচে মূলের সাথে যুক্ত থাকে। আর এই মূল যুক্ত থাকে মাটির সঙ্গে এবং পাতা পানির উপর ভেসে থাকে। মূল থেকেই নতুন পাতার জন্ম নেয়। পাতাগুলো গোল এবং সবুজ রঙের হয় কিন্তু নিচের দিকে কালো রঙ। ভাসমান পাতাগুলোর চারদিক ধারালো হয়। শাপলা ফুলগুলো দেখতে তারার মত মনে হয়। প্রায় বছরের সব সময় শাপলা ফুটতে দেখা যায় তবে বর্ষা ও শরৎ এই উদ্ভিদ জন্মানোর শ্রেষ্ঠ সময়। শাপলা প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্ন জাতির প্রার্থনা বা বাগান সাজানোর পাশাপাশি খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন: মিশর, চীন, জাপান ও এশিয়ার বিভিন্ন এলাকা শাপলার কাণ্ড বা ডাটা বা পুষ্পদণ্ড সবজী হিসেবে খাওয়া হয়। পূর্ণবিকশিত শাপলা ফুলের গর্ভাশয়ে গুড়িগুড়ি বীজ থাকে। আঠালো এই বীজ বাংলাদেশের গ্রামের মানুষদের খেতে দেখা যায়। এই বীজ ভেজে একধরনের খাবার খৈ তৈরি হয় যার নাম “ঢ্যাপের খৈ”। উদ্ভিদটির গোড়ায় থাকে আলুর মত এক ধরনের কন্দ যার নাম শালুক, অনেকে এটি সব্জি হিসেবে খেয়ে থাকে। এই উদ্ভিদ পানি থেকে তুলে রোদে শুঁকিয়ে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শাপলা ফুল ও শাপলার ডাঁটার কিছু মজাদার রেসিপি নিচে দেয়া হলঃ
উপকরণ :
শাপলার ডাঁটা ২৫০ গ্রাম,
বেসন ১ কাপ,
চালের গুঁড়া ১ টেবিল চামচ,
মরিচ গুঁড়া ১চা চামচ,
রসুন বাটা ১/৪ চা চামচ,
পানি পরিমান মত,
লবণ স্বাদ মত,
তেল পরিমাণ মত।
প্রণালীঃ শাপলার ডাঁটা একটু লম্বা লম্বা করে কেটে ধুয়ে নিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার তেল ছাড়া বাকি সব উপকরণ পরিমাণ মত পানি দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে একটা ঘন গোলা বানিয়ে নিতে হবে। এরমধ্যে কয়েকটা শাপলার ডাঁটা এক সাথে ডুবিয়ে গড়িয়ে নিয়ে গরম ডুবো তেলে বাদামি করে ভেজে নিয়ে গরম গরম চা এর সাথে পরিবেশন করুন।
২। সর্ষে-পোস্ত দিয়ে শাপলার পাতুরি
উপকরণ :
লম্বা করে কাটা শাপলা ৩ কাপ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
কাচা মরিচ ফালি করে কাটা ৩/৪ টা,
পোস্ত বাটা ১/২ চা চামচ,
সরিষা বাটা ১/২ টেবিল চামচ (২টা কাঁচামরিচ দিয়ে বেটে নেয়া),
হলুদ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ,
কালোজিরা ১/৪ চা চামচ,
আস্ত শুকনা মরিচ ২টা,
লবন স্বাদ মত,
সরিষার তেল পরিমান মত।
উপকরণ :
লম্বা করে কাটা শাপলা ৩ কাপ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
কাচা মরিচ ফালি করে কাটা ৩/৪ টা,
পোস্ত বাটা ১/২ চা চামচ,
সরিষা বাটা ১/২ টেবিল চামচ (২টা কাঁচামরিচ দিয়ে বেটে নেয়া),
হলুদ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ,
কালোজিরা ১/৪ চা চামচ,
আস্ত শুকনা মরিচ ২টা,
লবন স্বাদ মত,
সরিষার তেল পরিমান মত।
প্রনালীঃ শাপলা একটু লবন দিয়ে গরম ফুটন্ত পানিতে হাল্কা ভাপিয়ে নিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। গরম তেলে শুকনা মরিচ, কালোজিরা ফোড়ন দিয়ে তাতে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভেজে কাঁচা মরিচ, সরিষা বাটা, পোস্ত বাটা, হলুদ, লবন দিয়ে নেড়ে একটু পানি দিয়ে ভালোভাবে কষিয়ে নিয়ে এতে ভাপ দেয়া শাপলা দিয়ে নেড়ে মিশিয়ে রান্না করে নামিয়ে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন। অথবা কষানো মশলাতে ভাপ দেয়া শাপলা দিয়ে নেড়ে একটু কষিয়ে আগুনের আঁচে কলাপাতা পুড়িয়ে নিয়ে তাতে এই কষানো শাপলাটা দিয়ে মুড়িয়ে কম আঁচে শুকনো তাওয়ার উপর কিছুক্ষণ রান্না করে নামিয়ে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
৩। শাপলা ফুলের পাকোড়া
উপকরণ :
শাপলার ফুল ২ কাপ,
আদা বাটা-রসুন বাটা ১/৪ চা চামচ,
মরিচ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
কাঁচা মরিচ কুচি ২ চা চামচ,
বেসন ১ কাপ,
লবন স্বাদ মত,
তেল পরিমাণ মত।
উপকরণ :
শাপলার ফুল ২ কাপ,
আদা বাটা-রসুন বাটা ১/৪ চা চামচ,
মরিচ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
কাঁচা মরিচ কুচি ২ চা চামচ,
বেসন ১ কাপ,
লবন স্বাদ মত,
তেল পরিমাণ মত।
প্রণালীঃ
শাপলার ফুল কুচি করে কেটে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। পানি ঝড়ানো শাপলার ফুল এর সাথে পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ কুচি, মরিচ গুড়া, আদা-রসুন বাটা, লবন ও পরিমাণ মত বেসন দিয়ে ভালোভাবে মেখে নিতে হবে। মাখানোর সময় দরকার হলে একটু পানি দিতে পারেন। এর থেকে খানিকটা করে নিয়ে পাকোড়ার মত গড়ে নিয়ে গরম ডুবো তেলে ভেজে গরম গরম পরিবেশন করুন মজাদার শাপলার ফুলের পাকোড়া।
৪। চিংড়ি দিয়ে শাপলার চচ্চড়ি
উপকরণ :
লম্বা করে কাটা শাপলা ৩ কাপ,
চিংড়ি মাছ ১ কাপ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
কাঁচা মরিচ ফালি করে কাটা ৩/৪ টা,
পোস্ত বাটা ১/২ চা চামচ,
সরিষা বাটা ১/২ টেবিল চামচ (২টা কাচামরিচ দিয়ে বেটে নেয়া),
হলুদ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ,
আস্ত শুকনা মরিচ ২টা,
লবন স্বাদ মত,
সরিষার তেল পরিমাণ মত।
উপকরণ :
লম্বা করে কাটা শাপলা ৩ কাপ,
চিংড়ি মাছ ১ কাপ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
কাঁচা মরিচ ফালি করে কাটা ৩/৪ টা,
পোস্ত বাটা ১/২ চা চামচ,
সরিষা বাটা ১/২ টেবিল চামচ (২টা কাচামরিচ দিয়ে বেটে নেয়া),
হলুদ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ,
আস্ত শুকনা মরিচ ২টা,
লবন স্বাদ মত,
সরিষার তেল পরিমাণ মত।
প্রণালীঃ
শাপলা একটু লবন দিয়ে গরম ফুটন্ত পানিতে হাল্কা ভাপিয়ে নিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। গরম তেলে শুকনা মরিচ ফোড়ন দিয়ে তাতে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভেজে কাঁচা মরিচ, সরিষা বাটা, পোস্ত বাটা, হলুদ, লবন দিয়ে নেড়ে একটু পানি দিয়ে ভালোভাবে কষিয়ে নিন। তারপর এতে চিংড়ি মাছ দিয়ে নেড়ে কষিয়ে ভাপ দেয়া শাপলা দিয়ে নেড়ে মিশিয়ে রান্না করে নামিয়ে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
৫। শাপলা ফুলের কাবাবের বার্গার
উপকরণ :
শাপলা ফুল কুচি ১ কাপ,
বুটের ডাল ১/২ কাপ,
আদা কুচি ১ চা চামচ,
রসুন কুচি ১/২ চা চামচ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
শুকনা মরিচ কুচি ১ চা চামচ,
কাচা মরিচ কুচি ১/২ চা চামচ,
ডিম ফেটানো পরিমাণমত,
টেম্পুরা পাউডার পরিমাণমত,
লবণ স্বাদমত,
তেল পরিমাণমত,
আস্ত গরম মশলা(এলাচ, দারচিনি,লং, তেজপাতা) প্রতিটা ২টা করে,
উপকরণ :
শাপলা ফুল কুচি ১ কাপ,
বুটের ডাল ১/২ কাপ,
আদা কুচি ১ চা চামচ,
রসুন কুচি ১/২ চা চামচ,
পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ,
শুকনা মরিচ কুচি ১ চা চামচ,
কাচা মরিচ কুচি ১/২ চা চামচ,
ডিম ফেটানো পরিমাণমত,
টেম্পুরা পাউডার পরিমাণমত,
লবণ স্বাদমত,
তেল পরিমাণমত,
আস্ত গরম মশলা(এলাচ, দারচিনি,লং, তেজপাতা) প্রতিটা ২টা করে,
প্রণালীঃ
শাপলার ফুল কুচি করে কেটে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। বুটের ডাল পানিতে আধা ঘন্টা ভিজিয়ে নিতে হবে। পানি ঝড়ানো শাপলার ফুল কুচি এর সাথে বুটের ডাল, পেয়াজ কুচি, শুকনা মরিচ কুচি, আদা-রসুন কুচি, লবন ও গরম মশলা দিয়ে ভালোভাবে মেখে একটু পানি দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে।এমনভাবে সেদ্ধ করতে হবে যাতে কোনো পানি না থাকে। তারপর এটা বেটে নিতে হবে। এরপর এই মিশ্রনে পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ কুচি, ফেটানো ডিম, টেম্পুরা পাউডার দিয়ে ভাল করে মাখিয়ে নিন। এবার মাখানো মিশ্রনটি দিয়ে গোলাকৃতির কাবাব বানিয়ে রাখুন। এখন কড়াইতে তেল গরম করে তাতে বানিয়ে রাখা কাবাব গুলো লাল করে ভেজে নিন। এরপর বার্গার বানের ভিতর মেয়নিজ ও চিলি সস একত্রে মিশিয়ে লাগিয়ে এই শাপলার ফুলের কাবাব দিয়ে পরিবেশন করুন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন