পূরবী বসু
মার্চ, ২০২০। আজ থেকে সাড়ে বাহাত্তর বছর আগে আমার মা আবার বিয়ে করেন। তখন ভরা বর্ষা। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। পুকুর নদী নালা জলে টইটুম্বুর। নববধূর সাজে আবার নতুন করে সাজলেন আমার মা। সানাই বেজে উঠলো। আতসবাজি ফুটলো আকাশে। আলোয় ঝলমল করে উঠলো বসতবাড়ি। সবুজ আর সাদা কাপড়ে শোভিত হলো প্রবেশ পথের উত্থিত দ্বার। যার ডান পাশের উত্তর কোণায় অতি যত্নে বিপিতার কোলে পরম সোহাগে রাজরাণীর মতো বসে আছেন আমাদের মা, যেন কাস্তের মতো চৌকষ চাঁদের কোলে উজ্জ্বল ও সালাঙ্কারা এক তারকা।
এটা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে। তাঁর প্রথম স্বামী আমার জন্মদাতা পিতার সংসারে সুখ পাননি। পিতৃ পরিবারের কৌলীন্য আর ব্রাহ্মণ্যত্ব মাকে প্রতিনিয়ত বিব্রত করেছে। তবু এই ছাড়াছাড়ি চায়নি অনেকেই। ধরা যাক চিত্তজেঠুর কথাই। দু’পক্ষকে কী কম বুঝিয়েছেন তিনি! ফজলুল চাচার সঙ্গে পরামর্শ করে সমঝোতার মাধ্যমে ঘরটা টিকিয়ে রাখার কত চেষ্টাই না করেছেন! চিত্তজেঠু অসময়ে মারা যাবার পরও ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন শরৎ কাকু, হাশিম মামা। কিন্তু মা অনড়। অবিচলিত তাঁর সিদ্ধান্তে। অবশ্য মাকে উৎসাহ দেবার লোকেরও অভাব ছিলো না। যেমন মনসুর মামা, ইব্রাহিম মাস্টার, নাজিম খালু। তাঁরা মাকে বোঝাতেন, এই অবহেলা-অপমান থেকে মুক্তি পাবে; রাজরাণী হয়ে থাকবে নতুন সংসারে।
সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারেই বিয়ে হয়েছিলো মায়ের। আমি তখন খুব ছোট। অন্য ভাই বোন দুটো আমার চাইতে কিছু বড়ো। মা ও তাঁর নতুন স্বামী অর্থাৎ আমাদের নতুন বাবার সঙ্গে চলে এলাম তাঁর নতুন বাড়িতে। প্রথম প্রথম নতুন পরিবেশে সব কিছুই অন্য রকম লাগত। তারপর আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করল। দেখলাম ফজলুল চাচার কথাই ঠিক। এখানকার গ্রামীণ লোকজন বড়ো সহজ সরল, আন্তরিক, বড়ো প্রাণখোলা।
সময় কেটে যাচ্ছিল একরকম মন্দ না। শুধু খারাপ লাগত, কষ্ট হত, যখন বাড়ির সকলে আমার বাবার পরিবারের নিন্দা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখাতে শুরু করল। কী রকম কঠিন, নিষ্ঠুর ও অবিবেচকের মতো মন্তব্য করত সকলে! ভাবখানা এরকম, তোমার মায়ের বিয়ে হয়েছে, সে এখানে এসেছে বাড়ির বউ হয়ে, ভাল কথা। তোমরা বাপু আবার কেন এলে? আসলে যে কেন এলাম আমরাও জানি না। বাবার বাড়ির কেউ কি ছাড়তে চেয়েছিল আমাদের? না, একরকম জোর করেই চলে এসেছি, মাকে যে বড়ো ভালবাসি আমরা। তা আমাদের অবহেলা করে করুক, কিন্তু ব্যাপারটা যে সেখানেই সীমাবদ্ধ রইল না। এক সময় নতুন বাবাও মায়ের ওপর অত্যাচার শুরু করলেন। মনে মনে ভাবলাম, মাগো, বিয়ে যখন আবার করেইছিলে, একজন ব্রাহ্মণকে ছেড়ে সম অবস্থানের একজনকেই যখন বেছে নিয়েছিলে, কেন একবার দেখে নিলে না সে তোমারই ভাষায় কথা বলে কিনা? তোমরা যে পরস্পরের মুখের কথা পর্যন্ত বুঝতে পার না! তোমার প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধই নেই তার। নিজের সংসারে না আছে তোমার একফোটা কর্তৃত্ব, না আছে এতটুকু নিয়ন্ত্রণ। তোমার অতীত জীবন নিয়ে যখন তখন নিষ্ঠুর কটু মন্তব্য করে সে। তোমার গায়ে হাত তোলে পর্যন্ত। এ বিয়ে টেকে কী করে?
নিজের খানদানি ও ভাষার গরিমায় সবসময় বিভোর হয়ে থাকতেন আমার নতুন বাবা। আমরা যে আমাদের মায়ের ভাষাতে কথা বলতাম, সেটা খুবই অপছন্দ ছিলো তাঁর। নতুন বাবা মনে করতেন ওটা ছোটলোকের ভাষা। সম্ভ্রান্ত লোকেরা ওভাবে কথা বলে না। তাঁর নিজের ভাষাকে ঐশ্বরিক শব্দাবলীর মতোই পবিত্র ও শক্তিশালী মনে করতেন তিনি। তাঁর এই অহঙ্কার থেকেই সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটি ঘটল।
মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর সাড়ে চার বছর কেটে গেছে ততোদিনে। ছোট ভাইটি অর্থাৎ বাবার নয়নের মণি সন্তানটি ভয়ানক দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ফাল্গুনের প্রথম দিকের এক ঝলমলে দিন ছিল সেটা। কৃষ্ণচূড়ার রক্তাভ লালিমায় আকাশটা আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো। শনশনে হাওয়া বইছিলো একটু একটু করে। গৃহবধূকে অস্থির ও উন্মনা করে দিয়ে গাছে গাছে কোকিল ডাকছিল অলস সুরে। বাইরে বসে ছোট ভাইটি মনের আনন্দে আধো আধো বোলে আমের মুকুল আর মৌমাছি নিয়ে কী-একটা ছড়া কাটছিল আপন মনে। শুনে পিতার সে কী অগ্নিমূর্তি! যতোবার তাকে ওই ভাষায় কথা বলতে বারণ করে, ততোবারই ভাইটি আরও বেশি করে বলতে থাকে। রাগের চোটে বাবা প্রচন্ডভাবে আঘাত করল ভাইটিকে, সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো সে; আর ফিরলো না সে জ্ঞান। সেটা ছিলো ফাল্গুনের আট তারিখ। পুত্রশোকে মুহ্যমান মা তখনই স্বামীকে ছেড়ে চলে যাবার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু অনুতপ্ত পিতা ও পরিবারের সকলে মাকে খুব করে বোঝালো, ওটা নেহায়েতই দুর্ঘটনা। পুত্রবিয়োগ ও অনুশোচনায় বাবা নিজেও তখন অর্ধ-উন্মাদ। মা তার সকল কষ্ট বুকে চেপে আমাদের কথা ভেবে এর পরও থেকে গেলেন এ সংসারে। তবে একটা শর্তে। আমাদের কথাবার্তা নিয়ে কোন মন্তব্য বা অভিযোগ উঠবে না আর। তা তেমন সরাসরি ওঠেনি ঠিকই, কিন্তু এতে করে বাবার আভিজাত্যের দাপট কমল না একটুও। তার উচ্চমনস্কতা একসময় এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেল যে সব ধৈর্য্যের বাঁধন ভেঙে গেল মায়ের। ততোদিনে সংসারে এসে যোগ হয়েছে আরও কয়েকটি নতুন ভাইবোন।
আমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়েও ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। মা এখন প্রৌঢ়া। একদা সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, ঝলমলে যৌবনে ভরপুর আমাদের সেই মা কিছুটা ক্লান্তও। দ্বিতীয় সংসারের ক্রমাগত টানপোড়েন আর ঝড়ঝাপটা মায়ের জীবনীশক্তি অনেকটাই নিঃশেষ করে দিয়েছে।
আমার মা এখন আর কার্যত কারো দাসী নন। মিথ্যে আভিজাত্য আর বংশমর্যাদার অহঙ্কারে এতোদিন তাঁর উপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, এবার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প করলেন।
কিন্তু সময়টা অনুকূলে ছিল না। সংসারে অভাব। চাকরির বাজারে দারুণ মন্দা। বন্যায় ভেসে গেছে ফসল। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমার সৎ ভাইবোনেরাও কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখে আমাদের আজকাল। আমাদের আড়ালে মাকে শাসায় তারা। এদিকে আমাদের সৎ ভাই বোনেরা নানারকম ফন্দিফিকির করছে মায়ের সংগে তার দ্বিতীয় স্বামীর সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার জন্য। পিতার ঐশ্বর্য, পিতৃপরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি এই বর্তমান আর্থিক দুরবস্থার আশু সমাধানের একমাত্র পথ বলে তারা মনে করছে।
সব দেখেশুনে মায়ের চোখে আবার অবিরল জলের ধারা। দুই স্বামীর কাছ থেকে শুধু নয়, সন্তানের কাছ থেকেও অবিরাম কষ্ট পাচ্ছে। আমার মা। নিজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই ক্রমাগত বচসা, অবিশ্বাস আর ঘৃণা মাকে অস্থির-উন্মনা করে তুলছে। আকাশের দিকে, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মা সকলের জন্য উদারতা ভিক্ষা করেন। তার প্রার্থনা ফিরে আসে ঝড় আর বজ্র হয়ে। প্রার্থিত শান্তির দেখা নেই।
আমাদের এই অতি কষ্টের দিনে, মায়ের এই পরম দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছিলেন মস্ত হৃদয়ের এক দরদী বন্ধু। মাকে, আমাদের ভাইবোনদের বোঝালেন, আর সমঝোতার বৃথা চেষ্টা নয়। নিজের পায়ে স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়াতে হবে মাকে। আমরা সকলে একত্রিত হয়ে মাকে সাহস ও শক্তি যোগাবো এই ব্যর্থ দ্বিতীয় বিবাহের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির আস্বাদ পেতে। দাবদাহে অতিষ্ঠ এক মধ্য বসন্ত থেকে শুরু করে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পার হয়ে তীব্র শীতের মাঝামাঝি পর্যন্ত একটানা দশ মাস রীতিমতো সংগ্রাম করে আমাদের মাকে অবশেষে মুক্ত করা গেল তার নিরন্তর নিষ্ঠুর, অবিবেচক, স্বার্থপর ও নিপীড়ক দ্বিতীয় স্বামীর হাত থেকে।
অবশেষে আমরা সকলে আবার শান্তিতে নিঃশ্বাস নিলাম। কিন্তু আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর কিছু অনুরক্ত অনুচর ষড়যন্ত্র করে এক সর্বনাশ করে বসে। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে মুক্তির দোরে পৌছে দিয়েছিল যে সুহৃদ, যে মহাত্মা, প্রকৃত বন্ধু, রাতের অন্ধকারে তাকে তারা সপরিবারে হত্যা করে ফেলে আর সেটা ঘটায় তারা মায়ের দ্বিতীয় বিবাহের দিনক্ষণ মিলিয়ে- ঠিক একই তারিখে। অর্থাৎ আগস্ট মাসের মধ্য দিনে যেদিন মায়ের দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়েছিলো এই কুলাঙ্গার লোকটির সঙ্গে। তবে যত ভীতি, যতো আস্ফালন-ই দেখাক, তার সঙ্গে মায়ের মিলে-মিশে যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই আর। আমরা ও আমাদের মা আজ পুরোপুরি স্বাধীন ও মুক্ত। আমাদের সাফল্যে, সুখে আমাদের মা এখন বড়ই গর্বিত-আনন্দিত। আমাদের মুখের ভাষা প্রাত্যহিত জীবনে ব্যবহার করার স্বীকৃতি পেতে আমার ভাইয়ের খুন হবার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বড় ও ফলাও করে ছাপানো হয়। এর পর আমাদের জীবিত ভাইবোনদের মিলিত ও অনবরত চেষ্টায় ফাল্গুনের সেই বিশেষ দিনটি এখন বিশ্বজোড়া মানুষ তাদের মাতৃভাষা দিবস বলে পালন করে। এই সম্মান, এই স্বীকৃতি শুধু আমাদের মাতৃভাষা, কেবল আমাদের বর্ণমালায় নয়, আমাদের মায়ের স্বার্থত্যাগ ও দৃঢ় অবস্থানের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন।
আমাদের কল্যাণকামী একান্ত স্বজন ও অভিভাবককে এমন কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করলেও আমার মা এবং আমরা ভাইবোনেরা আজো রয়েছি মুক্ত-স্বাধীন। নানারকম বাধা পেরিয়ে একটু একটু করে ঘর গোছাচ্ছি আর সামনের দিকে এগুচ্ছি। তবু মাঝে মাঝেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ওরা কেউ কেউ। তবে আমরা আগের তুলনায় অনেক সচেতন ও সংগঠিত। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, মায়ের এই স্বাধিকার, এই প্রশান্তি, এই মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে সামনে এগিয়ে চলা কিছুতেই আর থামতে দেবো না। কিছুতেই না। আমাদের মা আজ সর্বাংশেই মুক্ত, স্বাধীন, স্বাবলম্বী। সেই সঙ্গে আমরাও! আঃ! কী শান্তি! কী স্বস্তি !
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন