short-stories-judhorodon

যুদ্ধরোদন

হুমায়ূন কবীর ঢালী

কী এক দুঃস্বপ্নের তোড়ে ভেসে যাচ্ছিল আবুল কাশেম। এসময় একদঙ্গল তাপবাহী বাতাসের আগন্তুক ঘরের জানালা ভেদ করে ঘরে ঢুকে। নাছোড়বান্দা ধাক্কায় তাকে দুঃস্বপ্নের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে। জাগিয়ে তোলে।
তড়াক করে উঠে বসে সে। ঘুমচোখ খুলে আমকাঠের চৌকি থেকে নেমে অন্ধকারের গাঢ় নদীতে ঝাঁপ দেয়। সাঁতার কেটে কূল খুঁজতে থাকে।
পা মেপে মেপে এসে কাঠের দরজার কূল খুঁজে পায়। অনুমানে দরজার কপাটে রাখে হাত। এরপর বন্ধ খিড়কিতে। একটানে কপাট খুলতেই রোদনভরা গরম বাতাসের ধাক্কায় সচেতন হয়। সেইসাথে আলোক-বিচ্ছুরণ আছাড় খায় তার চোখেমুখে।
দরজা পেরিয়ে ঘরের পিড়ায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাতেই কেঁপে ওঠে তার বুক। অজান্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফুট উচ্চারণ,’কুত্তার বাচ্চারা সুন্দরপুর গ্রামেও আগুন দিছে!’
পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতি তিক্ত মনোভাব নিয়ে ঘর ছেড়ে উঠোনে নেমে এসে দাঁড়ায় আবুল কাশেম। হানাদারদের আগুনশিখায় তার গা তপ্ত হয়ে ওঠে। সে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ফাঁকামতন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। সুন্দরপুর গ্রামের ঘরদোর আগুনেপোড়া রাতের অসহায় আলোয় স্থির হয়। তখনই মানুষের করুণ আর্তনাদ আর হাহাকার হেমন্তের মিষ্টি শীতেও আবুল কাশেমের শরীর ভিজতে থাকে চিকনঘামে। ছেলে-বুড়ো-শিশুকন্যার কান্না বাড়তে বাড়তে একসময় আর্তনাদের কুহেলী হয়ে তার চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
সে আর্তনাদের কুহেলীতে পড়ে ঘুরপাক খেতে থাকে আবুল কাশেমও। তার মনে হতে থাকে দোযখের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথিবীর এক অসহায় প্রাণী সে। এই দোযখের মাতবর ওই ইয়াহিয়ার মানুষরূপী জানোয়াররা। যারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে মারছে।
আবুল কাশেমের অনুভূতিতে কেউ এসে ধাক্কা দেয়, ‘কাশেম এখানে দাঁড়িয়ে দেখছ কী! এগিয়ে যাও। সুন্দরপুর গ্রামের দিকে এগিয়ে যাও। মানুষরূপী জানোয়ারগুলোর থেকে ওদের রক্ষা করো। যাও, যাও।’
একসময় নিজের অজান্তেই পা সচল হয় আবুল কাশেমের। বাংলাঘরের উত্তর পাশের প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে নেমে পড়ে বাড়ির কোলঘেঁষা জমিতে। সুন্দরপুর আর সুগন্ধির মাঝের রবিশস্য আগুন আলোয় গোসল করে শীতার্তের মতো মাথা দুলিয়ে কাঁপছে। আবুল কাশেমের ভেতরটা ফাঁকা করে বাতাস বেরিয়ে আসে। এই মাঠ, সোনার বাংলা পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে জানোয়াররা। ওরা একটিবারও ভাবছে না স্বাধিকারের চেতনাবোধ নির্যাতনের স্টিমরোলারে পিঁষে হত্যা করা যায় না।
চেতনা কখনো মরে না। বাঙালি তো নয়ই। বাঙালিদের স্বাধিকার চেতনার মূল অনেক গভীরে। সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, উনসত্তর পেরিয়ে একাত্তর। এই মূল উপড়ে ফেলতে পাকিস্তানী হানাদাররা মরিয়া হয়ে উঠেছে। নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যাসহ যাবতীয় অমানবিক, পৈশাচিক তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আর কতদিন! তোদের হারতে হবেই!’, স্বগতোক্তি করে আবুল কাশেম।
নারী-পুরুষ-শিশুর ভারী আর্তনাদ একত্র হয়ে আবুল কাশেমের কানে বাজে। ভয় পেয়ে যায় সে। সুন্দরপুর গ্রামের কাছাকাছি এসে পরিচিত জনের বাড়ি খুঁজে নেয় দৃষ্টিতে। সরকার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় সে।



দুই
গ্রামের চারপাশের আর্তনাদ আর আগুনের ভয় পাওয়া শব্দে জড়োসড়ো হয়ে ঘরের ভেতরে চকির উপর দুই সন্তান তিন বছরের শিশু কন্যা মিনা ও সাত সছরের পুত্র জয়কে নিয়ে বসে আছে ফজলু সরকারের বউ রোকেয়া বেগম। পাশের ঘরে আছে ফজলু সরকারের বৃদ্ধ বাবা-মা। ভেসে আসা আর্তনাদ শুনে ফজলু সরকারের বাবা-মা চকির নিচে গিয়ে লুকিয়েছে। আর্তস্বরে ছেলেবউকে ডেকে বলেছে যাতে দরজা না খুলে। রোকেয়া দুই সন্তানকে পেটের ভেতরে লুকাতে চাইছে।
ঠিক এ সময় দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ইউনুস মিয়া ও পাঁচজন মিলিটারি। রোকেয়া ভয় পেয়ে যায়। কাঁপতে থাকে। দুই সন্তান মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ে মাথা লুকায়। রোকেয়া সন্তানদের আঁকড়ে ধরে আছে। ইউনুস মিয়া মিলিটারীদের বলে,’ স্যার এই হইল ফজলার বউ। ফজলারে যুদ্ধে পাডাইয়া কী আরামে বইয়া রইছে দেহেন।’
ইউনুস মিয়ার কথায় মেজর সাখাওয়াতের রক্তকণিকা জিগির দিয়ে ওঠে। বলে,’বহুত আচ্ছা খবর দিলে মিয়ার বেটা। এরপর রোকেয়াকে বলল, মুক্তির বউ তোম। বহুত খুবসুরাত! বহুত মজা আইয়ে…!’
মেজর এগিয়ে গিয়ে রোকেয়ার ডান বাহুতে থাবা দেয়। চিৎকার করে ওঠে রোকেয়া। কোলের দুই সন্তান ছিটকে পড়ে একপাশে। ‘মা’ চিৎকার করে সন্তানদ্বয় ছুটে আসে। মেজরের দুই হাত কামড়ে দেয়। ইউনুস মিয়া ভয় পেয়ে যায় রোকেয়ার সন্তানদের প্রতিবাদী রূপ দেখে। কিন্তু মিলিটারী সিপাহীরা এসে জয় ও মিনাকে টেনে নিয়ে ঘরের বাঁশের খুঁটির সঙ্গে রোকেয়ার কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর ইউনুস মিয়া ও সিপাহীরা পাশের ঘরে ঢোকে।
মেজর তার পশুচরিত্র নিয়ে রোকেয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোকেয়া মরিয়া হয়ে নিজেকে রক্ষার জন্যে মেজরের সাথে লড়ে যায়। একসময় হেরে যায় রোকেয়া। তার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মেজর চড়াও হয় রোকেয়ার উপর।এই সময় গুলির শব্দ ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে। সাথে আর্তনাদ।
রোকেয়ার সন্তানেরা মায়ের হেরে যাওয়ার সাথে সাথে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
মেজর সাখাওয়াত উঠে ক্লান্ত বুনো শুয়রের মতো শরীর ঝাড়া দেয়। সিপাহীরা পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে। ইউনুস মিয়া মিলিটারীদের নিয়ে বেরিয়ে যায়। রোকেয়ার নিস্তেজ দেহ পড়ে থাকে আমকাঠের চৌকির উপর।
ঘর থেকে বেরিয়ে মেজরের আদেশ পেয়ে ফজলু সরকারের ঘরের চারপাশে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইউনুস মিয়া গ্যাং।
ঘরের ভেতর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসে। ইউনুস মিয়া আর্তনাদ শুনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মিলিটারীদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।



তিন
ফজলু সরকারের বাড়ির ঘাটে এসে দাঁড়ায় আবুল কাশেম। মাংসপোড়া গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা খায়। তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। গায়ের প্রতিটা লোমকূপ সজাগ হয়। সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। যেন পা চলতে চায় না। কিন্তু ফজলু সরকারের বাড়িতে কী তান্ডব চালিয়েছে জানোয়াররা তাকে জানতে হবে। ফজলু সরকার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। ফজলু সরকারের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাও সে জানে। মিলিটারীদের আক্রোশ এ বাড়ির প্রতি একটু বেশি এ কারণেই।
অনেকটা কষ্টে আবুল কাশেম সরকার বাড়ির ভিটেয় ওঠে। ঘরপোড়া আগুনে এখনো ঘরের অবশিষ্ট কাঠ বাঁশ পুড়ছে। একটু আগের সেই তেজ আর এখন নেই। ধুয়া বেড়েছে। অন্ধকার ভারী হয়েছে আরও। আবুল কাশেম এক বুক বেদনা নিয়ে সরকার বাড়ির উঠানে দাঁড়ায়। উকি-আঁকি দিয়ে বাড়ির মানুষজন খুঁজে ফেরে। কোনো মানুষের হদিস মেলে না। বাড়ির লোকগুলো তাহলে গেল কোথায়? বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে দিয়ে বুকের ভার কমাতে চেষ্টা করে আবুল কাশেম। সে ব্যর্থ হয়। বুক আরও ভারি ঠেকে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দুর্বল আগুনকেও মনে হতে থাকে রূপকথার দৈত্যরা যেন নৃত্য করছে তার সামনে। চোখের চারপাশ থেকে পানি এসে চোখ ধুয়ে দেয়। অতিরিক্ত পানি গড়িয়ে পড়ে তপ্ত মাটিতে। সাথে সাথে একটু আগের উৎকট মাংসপোড়া গন্ধ তার নাকের ভেতরে চট করে ঢুকে। মাথায় ব্যথা অনুভব হয়।
দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয় আবুল কাশেমের। সে সরকার বাড়ির রোদনভরা পোড়া মাটিতে মাথায় হাত চেপে বসে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *