short-story-aandharer-mukh

আঁধারের মুখ
অদ্বৈত মারুত


শক্তি মজুমদারকে দেখামাত্র চিনে ফেললাম। না চেনার তেমন বিশেষ কারণ ছিল না। সেই সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, এক মুঠো দাড়ি, কাঁচির মতো চিকন গোঁফ আর ব্যাক ব্রাশ করা সাদা চুল। ফেসবুকের দেয়ালে ঝুলতে থাকা ছবির মতোই হুবহু আছেন। ফলে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পিলপিল করে পিঁপড়ের মতো লাইন ধরে বের হতে থাকা হাজার দুই-আড়াই মানুষ থেকে তাকে আলাদা করে চিনে নিতে এক মিনিটও লাগল না। ছোট একটি হাতব্যাগ ছাড়া সাথে তেমন কিছু নেই। অথচ এ যাত্রা তাকে কতদিন ঢাকা থাকতে হবে, তা মোটেও অনুমানে নেই তার। তবে রণর ব্যাপারটা অনুমান করতে পারলে হয়তো আসতেনই না অথবা এলেও কিছুটা হিসেব-নিকেশ করে আসতেন। অন্তত কয়েকদিন থাকার মতো নিজের কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরতেন। অবশ্য টাকা থাকলে কী না হয়; চাইলে এই শহরে বাঘের দুধ পাওয়াও অসম্ভব নয়। শক্তি মজুমদার তেমন ধরনেরই বাঘা লোক। ইচ্ছে করলে বাঘ আর মহিষকে একই ঘাটের জল পান করানো তার সামান্য ইশারার ব্যাপারমাত্র। এতদিন সামনে যা পেয়েছেন, গাপুসগুপুস খেয়েছেন, হাপুসনয়নে দেখেছেন; ছুঁয়ে ছুঁয়ে কতবার, কতভাবে পরখ করেছেন কতশত নারীর ভেতর-বাহির। পাকা চোখ। চাহনিতেই বোঝা যায়, জহুরি চিনতে তিনি ভুল করেন না। আর ভুল হলে কি গ্রামে বিঘে বিঘে জমির মালিক হতে পারতেন, বড়বাজারে অতগুলো ঘর দখলে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হতো। কিংবা এমপি সাবের বউকে ভাগিয়ে নিতে পারতেন? মোটেও না। অথচ আজ এমন আঠালো কাদায় তিনি পড়তে যাচ্ছেন, এমন এক পরীক্ষার হলে কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে উপস্থিত হতে হবে যে, চাইলেই ফড়িংডানায় ভর করে যখন খুশি তখন ইচ্ছামতো প্রাণভরে এদিক সেদিক উড়ে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।

স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা সিএনজিতে উঠে বসি। সিএনজি চালক আমাদেরই লোক। ফলে নিরাপদে গুদারাঘাট পর্যন্ত খুব দ্রুত এবং সহজে চলে আসতে তেমন কোনো সমস্যা হলো না। অবশ্য সমস্যা হতে পারে ভেবে আগেই সীমান্ত সব ঠিকঠাক করে রেখেছিল। ফলে যাদের কাছ থেকে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তারা বলা যায়, ভান করে থাকল। ঝামেলাটা বাঁধল পরে, গন্তব্যে পৌঁছানোর পর পরই। আমরা যে বাসায় অবস্থান করব বলে শক্তি মজুমদারকে নিয়ে আসছি, রণর আগে থেকেই সেখানে থাকার কথা থাকলেও সিএনজি থেকে নামার পর পরই ওর মোবাইল ফোন থেকে ‘দোস্ত, পাড়ার মাথায় কী যেন একটা হইছে, অনেক জটলা, থানার সব পুলিশ নিয়ে ওসি এলাকা ঘিরে ফেলে রাস্তার মুখে বইসা আছে। কড়া তল্লাশি চালাইতেছে। সাবধানে বাসায় আসিস’ বার্তা পাওয়ার পর কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়লেও পরক্ষণই দূর হয়ে গেল এই ভেবে যে, শক্তি মজুমদার এখন পর্যন্ত জানেন না, তাকে নিয়ে আমরা আসলে কী করতে যাচ্ছি। ফলে তার সাথে আমাদের বহুবছর আগে কোনো কারণে একবার কয়েক মিনিটের জন্য সাক্ষাৎ হলেও তিনি যে আমাদের ঘনিষ্ঠজন এবং এ মুহূর্তে পরমপ্রিয় অতিথি, তার হাসি হাসি মুখ দেখে এবং সিএনজি থেকে নেমেই ‘দাঁড়াও বাবা, তোমাদের জন্য একটু মিষ্টি নিয়া নিই’ বলায় চিন্তার রেখাটা আর কপালে থাকল না। ‘চলেন চাচা’, বলে আমরা বাসার দিকে পা বাড়াতেই একজন সিপাহী আমাদের পথ আটকিয়ে ‘স্যার আপনেরে দাঁড়ায়া থাকতে কয়া গেছেন, আপনে এহানে দাঁড়ায়া থাহেন’ বলেই সাইদুল নামে সিপাহী আমাদের সিএনজিওয়ালা, মানে শম্ভুকে প্রায় ধমকের সুরে বলল, ‘আপনেদের না এহানে একঘণ্টা আগে আসনের কথা ছিল। স্যার দুইঘণ্টা ধইরা খাড়ায়া থাকতে থাকতে একটা মাইয়া লোক বাসার মইধ্যে মইরা পইচা যাওনের গন্ধ পায়া লোকজন হ্যারে ফোন করায় পুরা থানা তুইলা আইনা স্যার এহানে খাড়ায়া রাখছেন। মায়াডা যে কে?’ বলে সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। ফলে এ মুহূর্তে করণীয় কী- রণকে, না সীমান্তকে ফোন দেব, বুঝতে পারছিলাম না। আবার শক্তি মজুমদার সাইদুল সিপাহীর কথাবার্তা কান খাড়া করে শুনতে থাকায় কপালে চিন্তার রেখাটা আবার স্পষ্ট হতে লাগল।

অন্য আরেকটি ভাবনাও মাথায় এসে ঘোঁট পাকাতে লাগল যে, রিংকি নামে যে মেয়েকে নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে রণ বাসায় অবস্থান করছিল, তার আবার কিছু হলো কিনা! এ ভাবনাও ভাবতে হলো যে, যদি রণ উল্টাপাল্টা কোনো ঘটনা ঘটিয়েই ফেলত, নিশ্চয় সে জানাত এবং তখন শক্তি মজুমদারকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা অন্যরকম হতো। কিন্তু শক্তি মজুমদারকে চিন্তিত দেখে ‘ধরা মাছ হাত থেকে ছুটে যাবে কিনা’ ভাবনা এসে মাথায় ভর করতে লাগল।

শক্তি মজুমদারের ভাবনায় ছেদ ঘটাতে চেয়ে ‘পান খাবেন কিনা’ প্রস্তাব দিয়ে বসার পর তিনি একগাদা প্রশ্ন করে বসলেন- ‘বাবা, ঘটনাটা কী আসলে? পুলিশ এখানে থামিয়ে দিল কেন? রণ কি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসেছে? বাতাসে কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছি!’

একটু হালকা করার জন্য- ‘এমন ঘটনা এ পাড়ায় প্রায়ই ঘটে চাচা’, বলার পরও দেখি, কপালে চিন্তারেখা আগের মতোই রয়ে গেছে, যেন কপালে ঢেউ খেলছে; ছোটমাছ গিলে খেতে আসা বড়মাছের নড়াচড়া, হাবভাব দেখলে যেমন ছোটমাছ টের পেয়ে যায়, শক্তি মজুমদার ছোটমাছ জাতীয় কিছু না হলেও এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, তেমন করে ভাবতে বসেছেন এবং দ্রুত মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অবশ্য শক্তি মজুমদার রণর দৌড় সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। সে তাকে কতটুকু প্যাঁচে ফেলাতে পারবে, সেই প্যাঁচ কোন ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে সহজই খুলে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব হবে, তা মনে হয়, মনে মনে আগে থেকেই ঠিক করে এসেছেন। শক্তি মজুমদারের ভয় কেবল এই পুলিশ নিয়ে। যে কোনো ধরনের ব্যাপারে তিনি মোটেও পুলিশের দ্বারস্থ হতে চান না। কারণ তাকে একবার পুলিশ বাগে পেলে দেখা যাবে, কেঁচো খুঁজতে গিয়ে তার কাছ থেকে বের করে আনছে অজগর, অ্যানাকোন্ডা সাপ! বাপ রে বাপ, এমপি সাবের বউ ভাগানোর পর পুলিশি ঝামেলা থেকে কত কায়দা করেই না রেহাই পেয়েছেন। রণ বলেছিল একবার। এও বলেছিল, কাউকে ফাঁদে ফেলানোর আগে তাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে নিতে হয়। লোকটার ভেতর-বাহির সম্পর্কে; তার কোথায় দুর্বলতা, খুঁজে বের করতে না পারলে যত শক্ত জালেই আটকানো হোক না কেন, ফাঁকতালে সে ঠিকই বের হয়ে যাবে।

শক্তি মজুমদার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ভাবছি, এখনই না আবার বলে বসেন যে, ‘রণ এতক্ষণেও ফোন দিল না। ওর তো ফোন করার কথা ছিল। বুঝি ঢাকা নাই। বাসায় আমার গিয়ে কোনো লাভও তো নাই। আমি তাহলে যাই বলে’ হাঁটা পথ না ধরে বসেন। শম্ভু তাই ইশারায় চাচাকে ব্যস্ত রাখতে বলে প্রথমে সীমান্তকে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া গেল। রণকে ফোন দিয়েও পাওয়া গেল না। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর সীমান্তকে পাওয়া গেল বটে, মনে হলো, কেউ ওর ঘাড় চেপে ধরে কিছু একটা স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে আমার মাথাব্যথা ক্রমে শুরু হয়ে গেল। এ অবস্থায় ঘাড় শক্ত হয়ে যায়। চোখ কপালের দিকে উঠতে থাকে। আরক্তিম চোখ দেখে লোকজন ভিন্ন কিছু ভেবে নেয়। আমার অবস্থা তাই হতে লাগল। কপাল থেকে সুতোর মতো এতক্ষণ ঝরা ঘাম পাইপ দিয়ে ঝরঝর করে পড়তে লাগল। রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আর থাকতে না পারায় কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে ওসিকে ফোন দিয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি যা বললেন, তাতে মনে হলো, এখনই পড়ে যাব মাটিতে।

শক্তি মজুমদারকে শম্ভু পানাসক্ত করানোর পর হাতে একটা সিগারেটও তুলে দিয়েছিল। ফলে দুজনের ঘনিষ্ঠ আলাপ ভালোই জমে উঠেছিল। মনে হলো, শক্তি মজুমদার এতক্ষণ বাতাসে যে বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলেন, সেই ঘোর কিছুটা হলেও কেটে গেছে। হু-হু করে বইতে থাকা বাতাসে মহুয়া ফুলের তিনি ঘ্রাণ পাচ্ছেন। আমার দিকে দুজনের কারও যে সামান্য খেয়াল নেই, একবার তাকিয়ে তা সহজেই বোঝা গেল। এখন যা করার আমাকেই করতে হবে ভেবে এবং ওসি এখানে আসার আগেই, তাই ইশারায় শম্ভুকে সিএনজিতে উঠে বসতে বললাম। শক্তি মজুমদারও গিয়ে বসার পর শম্ভু সিএনজি টান দিলে আমি আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে গলিমুখের পাশের অপেক্ষাকৃত মানুষের ভিড়ের গলিতে ঢুকে পড়লাম। দ্রুত একটা রিকশায় উঠে পড়ে সামনের চিপাগলি দিয়ে সামনে যেতে বলেই শম্ভুকে ফোন করে বললাম কমলাপুর রেলস্টেশনে যেতে। রণকে ফোনে পাওয়া গেল না বহুবার ফোন করেও। সীমান্তকে ফোন দিতেই পাওয়া গেল বলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বুক থেকে। কিছুটা হালকা লাগা ভাব অনুভূত হতে লাগল বলে সংক্ষেপে যতটুকু বলা যায় বলে সীমান্তকে কমলাপুর রেলস্টেশনে যেতে বললাম এবং আমি কোন পথ দিয়ে কীভাবে এখন কোথায় আছি, কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছাতে কত সময় লাগতে পারে, তারও কিছুটা ধারণা দিয়ে রাখলাম। মনে মনে চাচ্ছিলাম, সীমান্ত আগে গিয়ে শক্তি মজুমদারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিক। কারণ রণর পারিবারিক এ ঝামেলায় আমি মোটেও জড়াতে চাচ্ছিলাম না। সীমান্তই বেশি আগ্রহ দেখাল এই ভেবে যে, কোনোভাবে শক্তি মজুমদারকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, প্রয়োজনে জোর-জবরদস্তি করে, মোটকথা, যে কোনোভাবেই হোক, যদি রণর জন্য একটা ফ্ল্যাট আর মোটা অংকের টাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, নিশ্চিন্তে আমরা পাঁচ বছর আরামসে রণর সাথে বসবাস করতে পারব। নিদেনপক্ষে একটা ঠিকানা তো হবে। খাওয়া-পরায়ও কোনো সমস্যা হবে না; রণ এমন আশ্বাস দিয়েও রেখেছে আমাদের। ফলে আমি রাজি হয়ে যাই এবং কাজে-অকাজে সিএনজিতে আমাদের ঘোরাঘুরির সার্বক্ষণিক অগ্নিসাক্ষী শম্ভুকে এ কাজের কথা বলামাত্র সেও আমাদের জন্য কিছু করতে পারলে ধন্য হবে বাসনায় রাজি হয়ে যায়।

শক্তি মজুমদার আর রণর মধ্যকার দূরত্বে অর্থ সম্প্রতি মূখ্য হয়ে উঠলেও বড়ছেলে হিসেবে প্রাপ্ত অধিকার থেকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে রণর স্পষ্টত ধারণা। কেননা, এগারো বছর বয়সে মাকে হারিয়ে ছোট দুইবোন রুমা, ঝুমার সাথে তাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে শক্তি মজুমদার মূলত আপদই বিদায় করেছিলেন। কারণ রণর মাকে একঘরে করে শক্তি মজুমদার অন্য নারীসঙ্গ উপভোগ করতে ভালোবাসতেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দুহাতে যেমন ধরতেন, তেমনি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু একাই। কাউকে মানে রণ আর ওর মাকে ভাগ বসাতে দিতেন না। না খেয়ে থাকলেও না। যেদিন রণর মা মারা গেলেন, সেদিন শক্তি মজুমদার পুরো এলাকা নাকি মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। অথচ বিদেশে লোক পাঠানো ব্যবসার শুরুতে রণর ঠাকুরদাই সব ঠ্যালা সামলিয়েছিলেন। কেননা, শক্তি মজুমদার বিভিন্ন গ্রামের বাইশজনের কাছ থেকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে যে তিন লাখ ছিয়াশি হাজার টাকা করে নিয়েছিলেন, পরে তাদের মধ্য থেকে তেরোজনকে গলাকাটা পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিমানে তুলে দিতে পারলেও বাকি নয়জনের টাকাসহ নিজে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তার কোনো হদিস কেউ না পেয়ে সবাই রণর ঠাকুরদাকে চেপে ধরলে তিনি তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অভাবে, শোকে তিনি গত হওয়ার বছর চারেক পর শক্তি মজুমদার ব্যাপক শক্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে প্রথমেই রণর মায়ের ওপর চড়াও হন। তিনটি সন্তান নিয়ে তাকে আলাদা বাড়ি বানিয়ে থাকতে দেওয়া হয়। হাতখরচ বাবদ কিছু টাকা দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই বলা যায়। তবে শক্তি মজুমদার প্রদত্ত এ বৃত্তি রণর মাতৃবিয়োগের পর থেকে আজ অব্দি অব্যাহত রয়েছে, এমনকি আশ্রম, মেস, হোস্টেলে জীবনযাপনেও ওই একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ছিল; যেন রণ বড় হয়নি, হবে না কোনোদিন, হতেই পারে না বড় সে! ফলে সে যে শক্তি মজুমদারের বিশাল সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে, এটা প্রায় নিশ্চিত এবং এ নিয়ে সে প্রায়ই হতাশার কথা আমাদের শুনিয়ে থাকে। কীভাবে শক্তি মজুমদারকে ঢাকা আনা যাবে, এনে সব তার সব সম্পত্তি, টাকা-পয়সা নিজের নামে নেওয়া যাবে, তা নিয়ে রণ আমাদের সাথে যে ধরনের আলাপ করে থাকে, তা আসলে আমলে নেওয়ার মতো না। কারণ রণ এসব কথা যখন বলে, তখন সে ঘোরের মধ্যে থাকে। ফলে আমরা গুরুত্ব দিইনি। সেদিন রণ যখন বলল, ‘বাবুজি ঢাকা আসতেছে এবং আমার কাছেই আসবে, তখন ব্যাপারটা পাত্তা পেল আমাদের কাছে এবং কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে আনার দায়িত্বও আমার উপর বর্তালে এককথায় রাজি হয়ে যাই আমি। যেহেতু তাকে আমরা আটকিয়ে রাখব স্বার্থোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এবং কোনো না কোনো একসময় এ নিয়ে পুলিশি ঝামেলা হতে পারে, তাই থানার ওসি, যার সাথে রণর ওঠাবসা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সীমান্ত আগেভাগে তাকে একটু জানিয়ে রাখার কথা বলে এবং আপাতত কথাটা দ্রুত সে-ই বলবে বলে আমাদের জানিয়েও রাখে।

শম্ভু ছাড়া যেমন রিংকি সম্পর্কে আমার, সীমান্তর ভালো কোনো ধারণা ছিল না, তেমনি থানার ওসির আগ্রাসী মনোভাব সম্পর্কেও আমরা ছিলাম ধোঁয়াচ্ছন্ন। রণর নারীসঙ্গপ্রীতি ছিল ওর বাবার মতো সর্বগ্রাসী। এমন রাত খুব কমই আছে যে, নতুন সঙ্গী ছাড়া সে থেকেছে। ফলে রণর এ বাসা মানে আমার আর সীমান্তের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ে নানা শ্রেণি, পেশার মানুষের ভালো যাতায়াত রয়েছে। ওসির সাথে রণর সম্পর্ক এতই মাখামাখি যে, ইয়ার দোস্তরও বেশি কিছু। সুরাপান আর নারীসঙ্গ লোভে বাসায় প্রায়ই হাজিরা দেন। এইসব মানুষের সাথে আমার আর সীমান্তের সাক্ষাৎ ঘটে বটে, হয়তো তারা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছেন বা নামছেন- এমন সময় অথবা দোরগোড়ায়। হাই-হ্যালো ছাড়া দুজনেরই ওসব বিষয়ে অনাগ্রহের কারণে তেমন কথা কখনো হয়নি বা হয়ে ওঠে না। আর এ কারণে বিশেষ করে রাতে রণর রুমে আমাদের দুজনের কমই ঢোকা হয়েছে বা ঢুকি। গত কয়েকদিন ধরে বাসায় অবস্থান করা রিংকি নামে মেয়েটি সম্পর্কে তাই আমাদের কোনো জানাশোনা নেই; যদি না শম্ভু বলত যে, ‘রণদা কি রিংকি ম্যাডামে ডুইবা গেল গা? এ কয়দিন তো নতুন কাউরে আনতে পাঠাইলো না রণদা। জিগার আঠার মতো ম্যাডাম দেহি আটকায়া রয়া গেল বাসায়!’

রিংকি, মিমি, সাবেরা, কুসুম বা আরও আরও রণর শয্যাসঙ্গী এসব নারী সম্পর্কে মাঝেমধ্যে যেটুকু খবর আমি বা সীমান্ত পাই, তা এই শম্ভুর কাছ থেকেই। ফলে ফোন করার পর রণ সম্পর্কে ওসি আমাকে যা বললেন, তা কিছুটা অবিশ্বাস্য এবং পুরো ব্যাপারটা সাজানো মনে হলেও আসল ঘটনা জানার জন্য শম্ভুর সাথে এ মুহূর্তে সাক্ষাৎ খুব জরুরি ভেবে কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম।

ফোনটা কখন থেকে মিউট হয়ে আছে, তা বের করার পর বুঝলাম। হাতে নিয়ে দেখি দশটা মিসড কল। শম্ভু দিয়েছে। তার মানে ও রেলস্টেশনে পৌঁছে গিয়েছে। শক্তি মজুমদার কোনো প্যাঁচে ফেলল না তো ভেবে ফোন দিতেই শম্ভু কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘দাদা, স্টেশনে আইসেন না। শম্ভু চাচারে ওসি সাব নিয়া গেছে’। ‘কোথায় নিয়ে যেতে পারে’ বলায় শম্ভু বলল, ‘তা ঠিক কইতে পারমু না, তয় ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। মনে হয়, ওসি সাব শক্তি মজুমদার আর রণরে নিয়া ভালোই একটা চাল চালছে।’

সীমান্তকে ফোন দিতেই ধরে বলতে লাগল, ‘মজা করে ফজা ভাই, তোর আর আমার ঘুম কামাই। শালা রণ ওসিরে দিয়া ওর বাপের কাছ থাইকা সব লিখা নিতে চাইছিল না? ওসি বাপ-ব্যাটা দুইডারে বলদ বানায়া সব নিজের নামে লিখা নিবার আয়োজন করছে!’ ফোনে সীমান্তের দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট ভেসে এলো কানে।

‘স্যার, নামেন, আইসা গেছি গা’ বলার পর সম্বিৎ ফিরে এলো মনে, সারা দেহে। চারপাশ থেকে বিকট চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। কেউ রিকশা থেকে, কেউ সিএনজি থেকে, কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছেন প্লাটফর্মের দিকে। কেউ প্লাটফর্ম থেকে নেমে যানবাহনে উঠে পড়ছেন। ফিরে যাবেন নীড়ে। নীড়- সবার জন্য বুঝি খুব প্রয়োজন; দ্রুত চলা, ধীরপায়ে চলা নানা আকার-আকৃতির মানুষের গতিবিধি দেখে অনুমান করা যায়, ঠিকানা একটা থাকা চাই। একটা প্রাইভেট কারের হেড লাইটের আলো চোখ দুটো ঝলসে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। আজ আকাশে তারাবাজি চলছে কিনা, রেলস্টেশনের ঝলমলে আলোয় তার কিছু বোঝা গেল না। মাথার ভেতর থেকে সব স্বপ্ন, সব বোধ একে একে অদ্ভুত আঁধারে মিশে গেলে পথ বড় অচেনা হয়ে যায়। অন্ধকারে ঢেকে যায় মুখ। নিজের হৃদয়কে শেয়াল ও শকুনের খাদ্য ভেবে ঠিকানাহীন এই আমি দূর আকাশের তারাগুলো গুণতে থাকি প্লাটফর্মের বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *