short-story-aasa-jawar-pather-dhare

আসা যাওয়ার পথের ধারে
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী



আবিষ্টের মত পথ চলেছে সে। এক অদ্ভুত আলোকিত সুড়ঙ্গ পথ ধরে সে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে চলেছে। দূরে সরে যাচ্ছে নক্ষত্রমালা। সরে যাচ্ছে চাঁদ আর অসংখ্য গ্রহ তারা। প্রথমে মৃদু আলোর রেশ থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল, ক্রমে আলোর তীব্রতা বেড়ে চলেছে, তবে আশ্চর্য! এ আলোয় কোনো তাপ নেই। সূর্যের মতোই শুভ্র সোনালী এই জ্যোতি! তবে সূর্যের আলোর দিকে তাকানো যায় না, কিন্তু এ আলোতে যেন চেয়ে থাকা যায় অনন্তকাল। ধীরে ধীরে সমস্ত পথটুকু উজ্জ্বল সাদা আলোতে ভরে গেল। সামনে জেগে আছে আরও উজ্জ্বল আলো। আলোর সমুদ্রে অবগাহন করে মন-প্রাণ শুদ্ধ হয়ে গেল তার। এমন আলোর রাজ্যে তার তো কোনো দুঃখ থাকার কথাই নয়! তবুও তার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে। রবি ঠাকুরের গান মনে পড়ে যাচ্ছে তার, ‘নয়নে ধারা বহে, ধেয়ানে আলোর রেখা।’ তবে এ কোনও আলোর রেখা নয়, যেন এ এক আলোর দেশ! তবে কি তার মৃত্যু হয়েছে? মৃত্যু কি তবে এমন মোহময়? এমনই সুন্দর? মনোমুগ্ধকর? “তবে এসো হে সুশীতল মৃত্যু, আমার তাপিত দেহটাকে তোমার আশ্রয় দাও! আমি আমার এই জীর্ণ আর দীর্ণ বাসস্থানটিকে ত্যাগ করে চিরকালের জন্য অনন্তলোকবাসী হতে চাই।”

সে সামনে তাকিয়ে এবার আরও বিস্ময়াবিষ্ট। সেই আলোর রাজ্যে তার সামনে তার চিরকাঙ্খিত, তার ভালবাসা! তার প্রেম জ্যোতিষ্ক! সে কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে! এক প্রবল আনন্দ নিয়ে দ্রুত ছুটে গেল সে, এবং তার দু’হাত দিল বাড়িয়ে। কিন্তু জ্যোতিষ্ক তার সামনে থেকে হঠাৎ যেন কোথায় হারিয়ে গেল। যেন তার দেহটাকে বাষ্পের মত সেই আলোর রাজ্য শোষণ করে নিল হঠাৎ। জেগে উঠেছে অন্য একজন মানুষের খর্বকায় মূর্তি। এ কে? না না না। সুতীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল সে। সে তো এই মানুষটাকে চায় না! কখনও চায়নি!

এবার তার সামনে আর আলো নেই, জেগে উঠেছে একটা সাদা দেওয়াল। সে কি স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ? স্বপ্ন আর বাস্তব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। একটা আধো ঘুম আর জাগরণে বসবাস করছে সে এখন। সে হাত বাড়িয়ে দিল সেই রিক্ত দেওয়ালের দিকে। রক্তশূন্য সাদা হাতখানা তার। শিরা জেগে উঠেছে সমস্ত হাতে, নীল নীল আঁকিবুকির মতো সেইসব শিরা। কোনো শিরা উঁচু হয়ে ফুলে আছে। স্যালাইনের সূঁচের দাগ সেখান থেকে মেলায়নি।

এতক্ষণ পরে সে বাস্তব জগতের মত ত্বকে স্পর্শ অনুভব করল। একটা খসখসে অনুভূতি পেল হাতে। সত্যিই সে দেখতে পেল তার সামনে একটা সাদা দেওয়াল! এবং সে একটা সাদা চাদরের উপর শুয়ে আছে। তার তলপেট ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। তীব্র মূত্রের বেগ এসেছে। কিন্তু সে কিছুতেই মূত্রত্যাগ করতে যেতে পারছে না। তার দুটো হাত কারা যেন খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে এবং সে অসহায় ভাবে ছটফট করছে। তার শরীর থেকে একটা তীব্র আঁশটে গন্ধ আসছে। বিশেষত এখন তাকে এই গন্ধটা সর্বক্ষণই প্রায় ঘিরে রাখে। সে যেন এক পচনশীল পদার্থ। তার মুখের উপর ভনভন করছে কালো আর খুব ছোট ছোট একরকম মাছি।




পদ্মের রেণুর মত গাঢ় হলুদ রংয়ের শাড়ি পরেছে নীলা। চুল না বেঁধে ক্লিপ লাগিয়ে খুলে রেখেছে। এমন ‘চিরুণি ক্লিপ’ এবার পুজোর বাজারে নতুন এসেছে। উপরে মুক্তোর দানার মত সাদা পুঁতি বসানো আর নীচের দিকে আছে চিরুনির মত দাঁত। নীলা জানে তাকে চুল খুলে রাখলে চমৎকার দেখায়। একটা হলুদ প্রজাপতির মত উড়তে উড়তে সে এখন দুর্গাপুজোর অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে চলেছে।

”আরে! আরে চললি কোথায়?”

”দাঁড়া, আমরাও তোর সঙ্গে আসছি। আমার শাড়ি পরা হয়ে গেছে। আমি রেডি।” জয়িতা বলল।

”আর মেজদি? ওর কি হয়েছে? তোদের জন্য আরও দাঁড়াতে হলে তো অষ্টমীর অঞ্জলি দেবার সময়ই শেষ হয়ে যাবে এবার! তোরা আয়। আমরা ততক্ষণে একটু এগোচ্ছি।”

ওরা চারবোন। বড়ো জয়িতা, তারপর রমিতা, নীলা আর পিউ। নীলার থেকে দু’বছরের ছোট হল পিউ। নীলা পিউয়ের হাত ধরে যাচ্ছে তাদের পাড়ার দুর্গামণ্ডপের দিকে। পিউ কখনও শাড়ি পরে না। বরাবরই ওর সাজ খুব সংক্ষিপ্ত। একটা সাদা আর সবুজ ছাপ কামিজের উপর কোথা থেকে একটা গোলাপি রংয়ের ওড়না জড়িয়ে নিয়েছে। এতটুকু যদি সাজগোজর বোধ থাকত বেচারার! একেই ওর গায়ের রং কালো! তায় কখনও একটুও সাজে না। নীলা জানে সে বোনেদের মধ্যে সবথেকে সুন্দর। ওর গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। নিজের সৌন্দর্য্য নিয়ে সে যথেষ্ট সচেতন। পিউ তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“তোকে আজকে একটা হলুদ চন্দ্রমল্লিকার মত দেখতে লাগছে রে দিদি! গোঁসাইদা না দেখলে একদম পাগল হয়ে যাবে।”

বোনের কথার উত্তরে নীলা চোখ বড়ো করে রাগের ভঙ্গি করতে গিয়েও না পেরে হি হি করে হেসে ফেলল।

দুজনেই এবার হাসছে তারা হি হি করে। হাসতে হাসতেই ওরা বাড়ি থেকে আনা নৈবেদ্যর থালা মণ্ডপের পুরুতমশাইকে ধরিয়ে দিয়েছে। ওদের বাড়ির নম্বর লেখা আছে থালার উপর কাগজে। পুজোর পরে ওরা ওই থালা ফেরত পাবে। অঞ্জলি শুরু হয়ে গেছে।

ওরা প্রণাম মন্ত্র বলছে ”ওং সর্বমঙ্গল্যে মাঙ্গল্যে — ”

কোথা থেকে ঠিক নীলার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে গোঁসাই। বড়ো বড়ো চোখ। এক মাথা কোঁকড়া চুল। খাড়া নাক। তবে লম্বা নয় সে খুব একটা। নীলা বুঝতে পারেনি যে গোঁসাই অঞ্জলি দিয়ে ওর হাতের ছেঁড়া ফুলগুলো নিয়ে তার খোলা চুলের উপরে ফেলেছে।

এখনও নীলা নামও জানে না ছেলেটার। শুধু জানে ওদের টাইটেল হল গোস্বামী। সেই থেকে ওদের বাড়িতে ওর ‘কোডনেম’ গোঁসাই চালু হয়েছে। কখনও ওর নাম জানার সুযোগও হয়নি। তবে নীলা যেখানেই যায় ছেলেটা ওর পিছু নেয়। ছেলেটা খুব লাজুক। এতদিনেও কখনও কোনো কথা বলেনি। নীলা স্কুল থেকে ফেরার সময় বাসস্টপে ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত। মাধ্যমিকের টেস্টের সময় সব পরীক্ষার দিনগুলোতে ও স্কুলের গেটের বাইরে চুপচাপ ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। নীলা ফিরলে ও-ও ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরেছে। নীলা এখন ইলেভেনে পড়ে। তার নীরব প্রেমিক এখনও নীরবেই ওকে অনুসরণ করছে। পুজোর দিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আজ ওর চুলে ফুলের টুকরো দিয়ে ও যেন ওর নীরবতা খানিকটা হলেও ভঙ্গ করেছে।

মণ্ডপে দাঁড়িয়ে নীলার নিজেকে মনে হচ্ছে একটা প্রস্ফুটিত সুগন্ধী ফুল। তাকে ঘিরে মুগ্ধ ভ্রমরের গুঞ্জন তার আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নীলার দিদিরা দূর থেকে সব দেখেছে। কাছে এসে ওরা সে কথা বলতেই নীলা গর্ব ভরে হাসল। সে হংসিনীর মতো তার গ্রীবা তুলে রেখেছে। দিদিরা কাছে এসে তার চুল থেকে গাঁদাফুলের পাপড়িগুলো তুলে ফেলে দিচ্ছিল। সতেরো বছরের মেয়েটার চোখে জীবন এখন কেবলই আলোয় আলো।

# # # # #


”আরে! এ কী! আপনি উঠে হঠাৎ কোথায় চলেছেন? উফ! কী ভীষণ দুর্গন্ধ! এই! কে আছো ওঁকে তাড়াতাড়ি ধরো। মনে হয় এই ভদ্রমহিলার মাথা খারাপ। সিস্টার! সিস্টার! এমন পেশেন্ট আন-অ্যাটেন্ডেড থাকে কী করে? আরে ক্যাথিটার পরানো আছে আপনার! বাথরুমে যাবেন বুঝি? উঠতে চাইছেন কেন? টয়লেট? টয়লেট পেয়েছে আপনার? ওটা ক্যাথিটার পরালে অনেকের অনুভূতি হয়। আপনার টয়লেট নিচে ওই থলিটাতে জমা হচ্ছে।”

সিস্টার ছুটে এসেছে। এসেই মুখ বিকৃত করেছে। ভীষণ তীব্র একটা মাংস পচা গন্ধ আসছে।

”এই পেশেন্টের জন্য এখনই আলাদা কেবিন দরকার। কমন ওয়ার্ডে রাখা যাবে না। ইমিডিয়েটলি শিফট করতে হবে। পেশেন্ট পার্টিকে কাল এলেই জানাতে হবে। না হলে তুমি এখনই ওদের একটা ফোন করো।” জুনিয়র সিস্টারকে নির্দেশ দিলেন সিনিয়র নার্স।

“দিদি এঁর গায়ে এমন অসহ্য আঁশটে গন্ধ কেন?”

“ম্যাগট হয়ে গেছে। দেখছো না! ক্যানসার তো! অনেক সময় এমন হয়। ড্রেসিং করা দরকার। আপাতত পেশেন্টকে বেঁধেই রাখো। উনি বিছানা থেকে উঠে পড়ছেন। উঠে একা হাঁটতে গেলে পড়ে যাবেন। শরীরে তো কিছু নেই। একটা জ্যান্ত লাশ! এদিকে মাথারও মনে হয় আর ঠিক নেই। দুহাত দুদিকে মেলে কী যেন বলছেন। ধরো, ধরো ওঁকে তাড়াতাড়ি ধরো গিয়ে!”




নীলা আর জ্যোতিষ্ক বেড়াতে এসেছে। বিয়ের পর প্রায় আটমাস কেটে গেছে। তবুও এতদিন হানিমুন করতে কোথাও যাওয়া হয়নি তাদের। জ্যোতিষ্কর প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে চাকরি। রোজই আউটডোর। তার কোনো রিলিভার নেই। তাকে রোজ ট্রেন-জার্নি করে কলকাতা থেকে সেই হাসপাতালে যেতে হয়। মাঝে মাঝে দুপুরবেলা নীলা উইনিভার্সিটির ক্লাসের পর হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে সোজা জ্যোতিষ্কর সরকারি আবাসনে চলে আসে হঠাৎ করে। সেদিন রাতে জ্যোতিষ্ক আর কলকাতার বাড়িতে ফেরে না। হাসপাতালের গায়ে ওর সরকারি আবাসনেই থেকে যায়। ওখানে জীবনে প্রথম গ্রাম দেখে নীলা আনন্দে একেবারে আত্মহারা। ওখানেই তাদের জ্যোৎস্না রাতে চমৎকার হানিমুন হয়েছে। জ্যোতিষ্ক বলেছে, “হানি আমার পাশে, আর মুন ওই আকাশে। ফাঁকতালে এই অকালকুষ্মাণ্ডটা কোথা থেকে ঢুকে পড়েছে।”

নীলা জ্যোতিষ্কর আদরে জ্যোৎস্নার মত যেন গলে গলে পড়ে। কলেজে পড়তে পড়তে হঠাৎ করেই তার বিয়ে হয়েছে। তবে জ্যোতিষ্ক খুব কঠোর পড়াশুনোর বিষয়ে। জ্যাঠামশাইটি নিজে সঙ্গে করে তাকে এম এ ক্লাশে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। বলেছে, পড়াশুনো বন্ধ করা চলবে না একেবারেই। অতএব নীলাকে কলকাতায় একা একা দিদি শাশুড়ির কাছে থাকতে হয়, আর রোজ সকালে ইউনিভার্সিটি যেতে হয়। ইউকএন্ডে হয় সে যায়, নয়তো জ্যোতিষ্ক কলকাতায় আসে। সপ্তাহে মাত্র একদিন জ্যোতিষ্কর হাসপাতালে আউটডোর বন্ধ থাকে।

অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম করে তারা দুজনে হানিমুনের জন্য অবশেষে একটা জায়গা খুঁজে বের করেছে। জ্যোতিষ্ক ধনেখালিতে তাদের ব্লকের বিএমওএইচ এর মাধ্যমে মাত্র তিনদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে। অবশেষে ওরা যাচ্ছে মাইথন। ডিভিসির কলকাতা অফিস থেকে রুম-বুক করে নিয়েছে জ্যোতিষ্ক। হাওড়া থেকে স্টিল এক্সপ্রেসের এসি চেয়ার-কার এ চেপে নীলা জ্যোতিষ্কর পাশে বসে যেন হাওয়ায় উড়তে উড়তে চলেছে। অনেকদিন পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার মন যেন সত্যিই উড়ছে। কিন্তু জ্যোতিষ্ক কেন যেন একটু ম্লান আর ম্রিয়মান। কেন? জ্যোতিষ্কর মুখটা দেখতে দেখতে নীলা সে কথা ভাবল একবার। পরক্ষণেই তার মনে হল ঠাকুমা বাড়িতে একা আছেন, হয়তো সেজন্য জ্যোতিষ্ক মনে কষ্ট পাচ্ছে। জ্যোতিষ্কর একমাত্র পরিজন হলেন তার ঠাকুমা। ঠাকুমাও তাঁর আদরের জ্যোতিকে বুক দিয়ে সর্বক্ষণ আগলে রাখেন। বিয়ের পরে এতদিনে ফাঁক পেয়ে দুটিতে বেড়াতে যাচ্ছে বলে, ঠাকুমাও খুব খুশি হয়েছেন। জ্যোতিষ্ক পাড়ার একটি বেকার ছেলেকে বাড়িতে রেখে এসেছে তার ঠাকুমার দেখাশুনোর জন্য। সে-ই এই কয়েকদিন বাজার হাট করে দেবে। রাতেও পাশে থাকবে। তাই ওরাও একটু নিশ্চিন্ত মানসিকভাবে। তবে কেন মুখভার জ্যোতিষ্কর?

নীলার মনের খুশির জোয়ার একটু পরেই জ্যোতিষ্ককেও স্পর্শ করল। সে-ও বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেল তারপর। দুজনে জানলার কাছে বসে ঝালমুড়ি খেয়ে আর মনের সুখে গান গেয়ে সময়টুকু পার করে দিল। একবার মাত্র নীলা একটা ব্যাপার দেখে চমকে উঠল। কোন একটা অজানা স্টেশান দিয়ে যাবার সময় তার চোখ হঠাৎ আটকে গেল একটা মানুষকে দেখে। সেই গোঁসাই! একটা মোটর সাইকেলে চেপে সে কোথায় একটা চলেছে। লেভেলক্রসিং এ তার বাইক আটকে আছে। মাথার হেলমেট খুলে হাতে নিয়ে সে মুখের চিটচিটে ঘাম মুছে নিচ্ছে। নীলা অবাক হয়ে বিড়বিড় করে বলে ফেলল ”ও এখানেও? কেন?”

সেই বড়ো বড়ো চোখ। মাথায় ঝাঁকড়া কোকড়ানো চুল।

নীলার সমস্ত ছোটোবেলা জুড়ে বরাবর এই ছেলেটা তাকে অনুসরণ করেছে। বিয়ের পর এখনও তেমনই করে চলেছে নাকি? নীলা বেশ অবাক হয়েছে। মনে মনে সে বলে উঠল, “মরুক গে যাক!” মায়ের কাছে শুনেছিল, ওর ভালো নাম নাকি পরাগ। পদবী যে গোস্বামী এ কথা নীলা অবশ্য আগে থেকেই জানত। তা এই পরাগ গোস্বামী জীবনে বিরাট কিছু একেবারেই করতে পারেনি। সায়েন্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে সে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। এখন কোন একটা গ্রামের দিকে কী একটা সাইটের প্রজেক্ট-ম্যানেজার হয়েছে। শুনেছে, খুবই সামান্য বেতন। হয়তো সেখানেই ও এখন যাচ্ছে। কী হবে ওর কথা ভেবে?

বিয়ের দিন গোঁসাই তাদের বাড়ির ধারে কাছেই ছিল না। তাই নিয়ে দিদিদের সে কী হাসাহাসি। সবাই বলেছিল ”আমাদের নীলার গোঁসাই কি আজ থেকে একেবারেই উধাও হল?” তার সে কথা শুনে মনটা কেবল একটু মেঘলা হয়েছিল, এর বেশি কিছু নয়। তার মনে হয়েছিল আহা বেচারা! তবে কোথায় নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারের সন্তান, মেধাবী আর সুদর্শন চিকিৎসক স্বামী জ্যোতিষ্ক! আর কোথায় এই বেঁটে বামুন গোঁসাই!

বিয়ের পর জ্যোতিষ্কর বিশাল মনের পরিচয় পেয়ে আরও মুগ্ধ হয়েছিল নীলা। জ্যোতিষ্ক চায় নীলার সাফল্য। সব সময় সে তাকে বলেছে, ভবিষ্যতে তাকে প্রফেসর হতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। এমন স্বামী কটা মেয়ে পায়?

জ্যোতিষ্ক মাইথনে ডিভিসির মহারাজা স্যুট বুক করেছে। সেখানে সুবিশাল থাকার ব্যবস্থা। দুটো ঘর আর বারান্দা নিয়ে দুজনের থাকার জায়গা। দোতলায় আর কোনো গেস্ট নেই। নীলা এসেই স্নান করতে চাইল। টাইলস বসানো ঝকঝকে বাথরুম। এক কোণে বিরাট একটা আয়না। নীলা দুষ্টুমি করে বাথরুমের দরজাটা ভেজিয়ে রেখেছে, বন্ধ করেনি। অথচ বাথরুমে একবারও উঁকি দিল না জ্যোতিষ্ক! সে বেশ অবাক হয়েছে। হানিমুনে এসে হঠাৎ জ্যোতিষ্কর হলটা কী? সে বেরিয়ে দেখল, জ্যোতিষ্ক পোশাক বদলে বিছানার একধারে গোমড়া মুখে বসে আছে। দুপুরের খাবার খেয়ে দুজন একটু গড়িয়ে নিল। বিকেলে ড্যাম দেখতে যাবে। দুপুরে এসি চালিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়েই পড়ল জ্যোতিষ্ক। নীলা অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে। তাদের নিরবিচ্ছিন্ন ভালো থাকার মাঝখানে কী একটা কাঁটা যেন খচখচ করছে। নীলা তার অস্তিত্ব বুঝতে পারলেও আর কিছু বুঝতে পারছে না।

ঘুম থেকে উঠে নীলা ঠিক করল আর অভিমান করে জ্যোতিষ্কর কাছ থেকে সে দূরে সরে থাকবে না। নিশ্চয়ই ওর কিছু একটা হয়েছে। জোর করে ওর পরিসরে ঢুকে তা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে, আর তবেই সব সমস্যার সমাধান হবে।

বিকেল হতেই মাইথন ব্রিজে এসেছে ওরা। পর পর ঢেউয়ের মত জলধারা নেমে যাচ্ছে অনেক নীচে। তীব্র গর্জন শুনে চোখ বন্ধ করলে মনে হবে যেন, সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। নীলা চোখ বন্ধ করে ব্রিজের উপর ওর দু’হাত ছড়িয়ে দিল। চোখে মুখে সূক্ষ্ম জলকণা ছিটে আসছে। ভারী ভালো লাগছে। জ্যোতিষ্ক ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে দিল তার। গম্ভীর মুখটা একটু স্বাভাবিক হয়েছে ওর। জ্যোতিষ্কর ভেতর কীসের যেন একটা যুদ্ধ চলছে সর্বক্ষণ।

রাতের খাওয়ার পর নীলা নিজেকে জ্যোতিষ্কর কাছে ফুলের মত সম্পূর্ণ মেলে ধরল। বাইরে লোডশেডিং হয়েছে। ঘরের ভেতর জানলা খুলে দিতে আলোর বিন্দুর মত অনেক জোনাকি এসে ঢুকেছে। তৃতীয়ার রহস্যময়ী চাঁদ উঠেছে আকাশে। নীলা উপুড় হয়ে শুয়ে জ্যোতিষ্কর বুকের উপর মাথা রেখেছে।

”কী হয়েছে তোমার?”

উত্তরে এবার জ্যোতিষ্ক তাকে জড়িয়ে ধরল। নীলা আর কোনো প্রশ্ন করল না। নিজেকে অকপটে উন্মোচিত করল সে। কিন্তু কী যেন এক দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছে যেন জ্যোতিষ্ক। সে কিছুতেই মিলিত হতে পারল না। তার প্রপার ইরেকশান হল না। নীলার দিকে তাকিয়ে বারবার কেমন চমকে উঠছে সে! এমনটা এর আগে কখনও হয়নি তাদের যৌথজীবনে। ঘরের ভেতর চাপ চাপ অন্ধকার। বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। রাত প্রায় বারোটা বাজে। পরপর দু’বার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে জ্যোতিষ্ক। অল্প হাঁপাতে হাঁপাতে নীলা একসময় বিরক্ত গলায় বলল,

”এবার ছাড়ো আমাকে।”

জ্যোতিষ্ক নীলাকে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি দিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল সে। ঘরের বাইরে একটা বসার ঘর আছে এই স্যুটে। বিছানা থেকে উঠে সেখানে চেয়ারে বসল সে। পাশের ঘরে দুটো চেয়ার একটা রাইটিং টেবিল আর ডিভান আছে। নীলা বিছানা ছাড়ল না। শুয়ে শুয়ে অন্ধকারে এলোমেলো নানা চিন্তা করতে লাগল। বিছানায় শুয়ে শুয়েই নাকে সে সিগারেটের গন্ধ পেল। জ্যোতিষ্ক বাইরে বসে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে, সে যেন কী একটা ভাবছে। গভীর চিন্তিত। কখন ঘুম জড়িয়ে ধরল নীলার দু’চোখ। হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখল জ্যোতিষ্ক শার্ট-প্যান্ট পরেছে।

”এ কী! তুমি কোথায় যাবে এত রাতে?”

”সামনের রাস্তায় একটু পায়চারী করব।” তারপর হাতের দুটো আঙুল দেখিয়ে বলল,

”একটা ধরো তো!”

”কেন?”

”ধরোই না!”

নীলা একটা আঙুল চেপে ধরল। জ্যোতিষ্ক হাসল। বলল,

”আমি জানি তো! নীলা তুমি চিন্তা করো না! সব ঠিক হয়ে যাবে।”

”এত রাতে বাইরে যেও না। কী পাগলামি করছো! কীসের সব ঠিক হবে? তুমি আমার পাশে এসে শোও। প্লিজ।”

”না। আমি একটু ঘুরে আসি। একটা সিগারেট খেয়েই ফিরে আসছি। এসে না হয় আবারও একবার ট্রাই করব। এবার সবকিছু ঠিকই হবে।”

”আচ্ছা! কী পাগলামি বলো তো? আমি কি তোমাকে এইজন্য কিছু বলেছি নাকি? আমি শরীর চাই না, কেবল তোমাকে চাই। তুমি শুধু প্রাণভরে আমাকে ভালোবেসো, এইটুকুই। আর কিচ্ছু চাই না। তোমার আমার ভেতর যেন কখনও অভিমানের বরফ না জমে!”

”আমি জানি তুমি আমার খুব সোনাবউ!” জ্যোতিষ্ক মাথা নামিয়ে আলতো করে একটা চুমু খেল নীলার গালে।

তারপর ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

”জ্যোতিষ্কটা গ্রামে থেকে থেকে একদম গেঁয়ো হয়ে গেছে। হাসপাতালের কোয়ার্টারেও রাত বিরেতে সিগারেট খেতে খেতে কম্পাউন্ডের ভেতরে হাঁটে!” মনে মনে বলল নীলা। তারপর কম্বল জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল সে।

জ্যোতিষ্ক কম্পাউন্ডের ভেতর কিছুক্ষণ হাঁটার পর সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখল সিগারেট শেষ। অথচ সিগারেট ছাড়া এখন চলবে না তার। ড্যামের সামনে ব্রীজের কাছে একটা সিগারেটের দোকান আছে। জ্যোতিষ্ক সেদিকে হাঁটতে শুরু করল। তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এত রাতে এই শীতে দোকান খোলা পাবে ভাবেইনি জ্যোতিষ্ক। দোকানে সিগারেট কিনে দড়ির আগুনে ধরিয়ে নিতে পেছন ফিরেছে সে। ঠিক এই সময় একটা বিরাট মাল বোঝাই লরি ঘাতকের মত জ্যোতিষ্কর শরীরটা ধাক্কা দিয়ে তার উপর দিয়ে নিমেষের মধ্যে চলে গেল। ঘটনাটা এমন ভয়ানক দ্রুত হয়ে গেল যে দোকানদারও একেবারে হতভম্ব। জ্যোতিষ্ক রাস্তায় ছিটকে পড়েছে। মাথাটা সম্পূর্ণ থেতলানো। রাস্তার উপর পড়ে আছে ঘিলু আর অনেকটা রক্ত। আঙুলে তার তখনও ধরা আছে জ্বলন্ত সিগারেটটা। এখানে দুর্ঘটনার কোনো খবর পাওয়া গেলে পুলিশ এসে আগে তার হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দোকানটাই প্রথমে হটিয়ে দেবে। দোকানদার চাইল না এই নিয়ে একটুও জলঘোলা হোক। নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। সে জ্যোতিষ্কর শরীরটা টানতে টানতে ড্যামের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে এল। তারপর রেলিংয়ের উপর থেকে ঠেলে নীচে ফেলে দিল। প্রবল জলের ধারা মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে গেল জ্যোতিষ্কর শরীরটা। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে গভীর অন্ধকারে তার শরীরটা কোথায় যে ভেসে গেল, কোথাও এতটুকু আর চিহ্ন পাওয়া গেল না। রাস্তায় কয়েক বোতল জল ঢেলে রক্ত ও সব চিহ্নটুকু নিঃশেষে ধুয়ে ফেলল দোকানী।

নীলা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে দেখল জ্যোতিষ্ক কখন যেন এসে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতগুলো বরফের মত ঠাণ্ডা। জ্যোতিষ্ক তার ডান গালে ওর ঠাণ্ডা হাতটা রেখেছে। নীলা একেবারে চমকে উঠেছে।

”তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? এদিকে ভোর হতে চলল যে। উফ! কী ঠাণ্ডা হাতটা তোমার! শিগগির বিছানায় এসে শুয়ে পড়ো দেখি লক্ষ্মী ছেলের মত!”

হঠাৎ চমক ভাঙল নীলার। ঘুম ভেঙে গেছে তার। সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিল! সত্যিই সবে ভোর হচ্ছে। বাইরে শীতের কুয়াশা মাখা ভোরের সিল্যুয়েট। জানলাটা খোলা। বাইরে থেকে ভোরের তীব্র ঠাণ্ডা হিম আসছে। ঘরে জ্যোতিষ্ক নেই। সে এখনও ফেরেইনি! সমস্ত ঘরটা হঠাৎ যেন হাহাকার করে উঠল নীলার দিকে চেয়ে। ভয়ে বিস্ময়ে শিউরে উঠেছে সে। জ্যোতিষ্ক কোথায় গেছে? সে তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটে গেল। নব্বইয়ের দশক। কারো হাতে তখনও মোবাইল নামক যন্ত্রটি এসে পৌঁছায়নি। জ্যোতিষ্ককে কোথায় খুঁজবে নীলা? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে তার। নীলা হোটেলের অফিসে এল। সব কথা রিসেপশানে খুলে বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। অবশেষে পুলিশ এল। চারদিকে তল্লাশি চলল। এমনকী ড্যামের জলেও লোক নামল। নেই, নেই কোথাও নেই মানুষটা!




“পেশেন্টের অবস্থা ভাল নেই। খুব দুর্বল। যে কোনো সময় যা কিছু হতে পারে। বন্ড-পেপারে একটা সাইন চাই। আপনার নাম্বার আছে আমাদের খাতায়। আপনি পেশেন্ট নীলা মিত্রের কে হন?”

“আমি? — হ্যাঁ, হ্যাঁ লিখুন না— আমি পেশেন্টের বিশেষ পরিচিত। আ-আমি একটু পরেই চলে আসছি। আসলে কাল একবার আমাকে অফিসের কাজে যেতে হয়েছিল। অনেকটা দূর থেকে আমি কলকাতা আসছি। একটা লম্বা ছুটি ম্যানেজ হয়েছে। খরচ? ও নিয়ে আপনারা কিছু ভাববেন না, আমি সব ব্যবস্থা করব। হ্যাঁ আমার নাম পরাগ। পরাগ গোস্বামী।”

বেলা হয়েছে একটু। পিউ রিসেপশনে বসে আছে। তেতাল্লিশ বছরের পিউকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তার মাথার অর্ধেক চুল পাকা। মুখে মেচেতার কালো দাগ। পিউ বিয়ে করেনি। পিউ আর নীলা একসঙ্গেই থাকে। দুজনেই ওরা দুজনের ভরসা। পিউ বায়োমেডিক্যাল পড়ে একটা বেসরকারী ল্যাবে কাজ পেয়েছে। নীলা একটা বেশ বড়ো মাপের নার্সিংহোমের অ্যাকাউন্টস সেকশনে চাকরি করত। সেখানেই এখন কিছুটা কম খরচে তার চিকিৎসা হচ্ছে, না হলে এত খরচ তাদের পরিবার সামলাতে পারত না।

এগারোটা বাজার একটু পরেই পরাগ এসে পিউয়ের পাশে বসল। একটু দূরত্ব রেখে সংকুচিত হয়ে সে বসেছে। পরাগের বয়স সাতচল্লিশ। নীলা পরাগের চেয়ে দু’বছরের ছোট ছিল। আর পিউ নীলার চেয়ে দু’বছরের ছোটো। পরাগের খর্বকায় শরীরে এখন সামান্য ভুঁড়ির আভাস। মাথার অনেক চুল উঠে গেছে। চওড়া কপাল প্রকট হয়ে উঠেছে। চোখে একটা সাধারণ সাদামাঠা ফ্রেমের চশমা। চশমার ভেতর থেকে ওর বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখ দুটো চোখে পড়ছে। গায়ে হালকা ময়লাটে টি শার্ট আর বাদামি রংয়ের প্যান্ট।

ওরা দুজনেই জানে নীলার জীবনের আর কোনো আশা নেই। পিউ হঠাৎ পরাগের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল।

“পরাগদা! আপনি সারাজীবন ধরে এত কষ্ট করে কী পেলেন? কেন এমন করলেন আপনি? বলুনতো? দিদি তো শোকে দুঃখেই রাধার মত শেষ হল। এখন মানুষটাই পচে গলে যাচ্ছে একেবারে। জ্যোতিষ্কদাকে দিদি এখনও নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। এখনও অসহ্য ব্যথা যন্ত্রণার মধ্যে, ঘোরের মধ্যেও জ্যোতিষ্ক জ্যোতিষ্ক করে ওঠে! আপনি তো দেখেছেন সব। জানেনও! ওই পচা গলা মানুষটার জন্য আপনি কেন এখনও সর্বস্ব পণ করেছেন! কেন এমন করে কষ্ট করে চলেছেন? দিদি তো থাকবে না। এটা আপনি মেনে নিন, আর এত খরচ কেন করছেন! এতসব আমি কোথা থেকে শোধ করব? এত টাকা কোথায় পাব আমি?”

“টাকা শোধ করতে হবে না পিউ! আমি কথাটথা অত ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারি না। আমি কিছুতেই নীলার কষ্ট দেখতে পারছি না। আমরা ছাড়া ওর আর কে আছে বলো? এখনও তুমি এত খরচের হিসেব করছো? নার্সিংহোম তো অনেকটা কমও করেছে আমাদের। আর সেটাও নীলারই জন্য!”

“পরাগদা! যান! দেখে আসুন! আমি আর দেখতে পারিনি। কেবিনের ভেতর সিস্টার ইথার ঢেলে ঢেলে ম্যাগট বের করছে। থিকথিক করছে মাছির লার্ভা। দিদির ডান গালের ক্ষত থেকে সমানে সেগুলো বেরিয়ে আসছে। দিদি আহ্ আহ্ করছে যন্ত্রণায়।”

পরাগ উঠে দাঁড়াল। ওর হাতে একটা পেটমোটা কালো ব্যাগ। অফিস থেকে সোজা আসছে। পিউ দেখতে দেখতে ভাবছে হয়তো লোকটার সকাল থেকে কিছু খাওয়াও হয়নি। কতদিন ভালো করে দাড়িও কাটেনি। ব্যাগে হয়তো একটা আধ-ময়লা গামছা আছে, একটু মুড়ি চানাচুরও থাকতে পারে। পেটে মেদ জমেছে, মাথায় টাকের আভাস। অসুন্দর এই লোকটা সারাজীবন ধরে কিছুই পায়নি। বিয়ে করেনি। ওর ব্যথার অর্ঘ্য তার দিদি কখনও গ্রহন করেনি।

জ্যোতিষ্ক নিরুদ্দেশ হবার পর নীলা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিল। অপূর্ব সুন্দরী সে। তার রূপ যেন আলোর মত। নীলা হঠাৎ হঠাৎ জ্যোতিষ্কর গ্রামীন হাসপাতালের সেই কোয়ার্টারে চলে যেত। সেই কোয়ার্টারে তখন আর কেউ থাকত না। জ্যোতিষ্ক নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে তখনও কোনো ডাক্তার আসেনি ওখানে। নীলা একতলা কোয়ার্টারের বাইরের বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে বসে থাকত। চারদিকে বড়ো বড়ো বুক সমান ঘাসের বন। একটু দূর থেকে সন্ধ্যাবেলাতেই শেয়ালের ডাক শোনা যায়। হাসপাতালটাও ডাক্তারের অভাবে বন্ধ তখন। কোয়ার্টারের সামনে একহাঁটু শর-ঘাস, ভাটপাতা, আর আপাংয়ের বন। ইতস্তত বন তুলসীর আগাছা। নীলাকে না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পরাগকে নিয়ে পিউ সেখানে তার দিদিকে ফিরিয়ে আনতে যেত। আসা যাওয়ার গাড়ি ভাড়ার অনেকগুলো টাকা, সবই পরাগ দিত।

নীলাকে ডাকলে সাড়া নিত। হয়তো সব মনে পড়ত ওর। স্থবিরের মত গাড়িতে উঠে বসে থাকত। চোখ থেকে জল পড়ত না ওর, তবে ওর সেই ভেঙে পড়া মুখটা দেখে পিউ আর পরাগের চোখ জলে ভিজে যেত। পরাগই কোথা থেকে নীলার জন্য একটা বেসরকারী স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

পড়াতে পারেনি নীলা। স্কুলে যেত না অর্ধেক দিন। ডাক্তারের কী একটা ওষুধ খাওয়ার পর দিন রাত সে কেবল কাঁদত। একদিন বিকেলে পরাগ চুপচাপ বাইরের ঘরে এসে বসে আছে। নীলা উদভ্রান্তের মত সেখানে ছুটে এল।

“এই যে মিঃ পরাগ গোস্বামী! কী চাও তুমি এখানে? এখানে রোজ কীসের গন্ধ শুকতে আসো বলো তো? বলো কেন তুমি আমাদের পিছু নিয়েছিলে মাইথনে? সেই সেদিন?”

এরপর হঠাৎ তার গলা সপ্তমে চড়ে যায়। তুমি থেকে তুই সম্বোধনে নেমে আসে সে।

”এই শোন্! আমি জানি জ্যোতিষ্কর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয় তোর হাত আছে। আছে না? বল? এখনও কী চাস তুই এখানে?” নীলা নিজের বুকের আঁচল হঠাৎ খসিয়ে দেয়। “দেখ। ভালো করে তাকা। ছোটোলোক! চোখ নামিয়ে নিচ্ছিস কেন? জানোয়ার! স্কাউন্ড্রেল!”

পিউ ছুটে এসে নীলাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। দেখে পরাগ হাউ হাউ করে কাঁদছে। নীলার বাবা মা সেদিন পরাগের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল।

এখন নীলা-পিউয়ের মা বাবা আর কেউ বেঁচে নেই।

পিউ আর নীলার অলিখিত অভিভাবক এখন পরাগ। একবছর পর নীলা যখন কিছুটা স্বাভাবিক হল, তখন সে ভারী গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখ থেকে সব হাসি যেন হারিয়ে গেছে চিরকালের মত। পরাগ তখনও বর্ধমানের কাছে একটা কোম্পানিতে প্রজেক্ট-ম্যানেজার। সপ্তাহে একবার করে সে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে আছে একমাত্র তার বৃদ্ধা অশক্ত মা। পিউ মাঝে মাঝে গিয়ে পরাগের মায়ের দেখভাল করে। নীলাও এখন মাঝে মধ্যে পরাগের বাড়িতে যায়। পরাগ এলে নীলা দুটো একটা কথাও বলে এখন। অবশ্য সে সবই কাজের কথা। ইলেক্ট্রিক বিল জমা দেওয়া, বা বাজার করা এইসব কথা। নীলা কখনও কথা বললে অসম্ভব খুশি হয় পরাগ, আনন্দে ওর চোখমুখ চকচক করে।

নীলা বছরে একবার করে এখনও মাইথনে যায় নিয়ম করে। যেদিন তারা হানিমুনে গেছিল, ঠিক সেইদিন। দুদিন সেখানে কাটিয়ে ফিরে আসে আঁধার মুখে।

দুপুরে খেয়ে শুতে গেলে হঠাৎ হঠাৎ সে ছুটে যায় দরজার দিকে। হঠাৎ হঠাৎ অলীক শব্দ শুনতে পায়। তার মনে হয় খুব ক্ষীণ স্বরে তাকে ডেকে ডেকে জ্যোতিষ্ক ফিরে যেতে পারে। ঘুমে জাগরণে সব সময় জ্যোতিষ্কর ফেরার প্রতীক্ষা করে সে।

আশ্চর্য! জ্যোতিষ্ক নিরুদ্দেশ কেন হবে? যাবার আগে সে বলেছিল, এক্ষুণি ফিরবে, এসে আবার চেষ্টা করবে! চলে যেতে হলে এ কথা কি কেউ বলে যায়? না, কোনো হিসেব মেলেনি নীলার। তাকে সেই রাতে দুটো আঙুলের মধ্যে একটাকে কেন বাছতে বলেছিল জ্যোতিষ্ক? কেন? কেন? জীবনটাই যেন একটা মস্ত ধাঁধা। উত্তর মেলেনি। নীলা সারাদিন ভাবে। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে যায়। তার জীবনের আটটা মাস বড়ো প্রিয়, বড়ো মধুর ছিল তার কাছে।

জ্যোতিষ্ক নিরুদ্দেশ হবার পরে পাঁচ বছর কেটে গেছে। অবশেষে নীলা একটা চাকরি করছে। জ্যোতিষ্কর ঠাকুমা তখনও বেঁচে। ইঁট চাপানো ঘাসের মত ফ্যাকাশে তার চোখ মুখ। নীলা সেখানে আর কখনও যায়নি। আর কোনো কর্তব্য সে করতে পারবে না। সে কারো দায়িত্বও নিতে পারবে না। কে এই বৃদ্ধা? কেন তার দায় নেবে নীলা? তার মন ভেঙে গেছে। তার জীবনের অঙ্ক কেন কিছুতেই মিলছে না?

নীলাদের বাড়িতে একদিন একটা ভাড়া করা গাড়িতে করে এলেন জ্যোতিষ্কর ঠাকুমা। পিউ-নীলার বাবা তখন মারা গেছেন। মাকে ডেকে ফিসফিস করে বললেন,

”আমার যা ক্ষতি হবার হয়েছে। আপনারা মেয়েটার বিয়ে দিন। এবার জোর করুন ওকে। এতটুকু মেয়ে! আমার বুকটা ভেঙে যায় ওকে দেখলে। আমার জ্যোতি ওকে খুব ভালো বাসত। মেয়েটা ভালো থাকুক, এই আমি চাই। ওর জীবনে যে কিছুই রইল না!”

নীলা কারো কথা শোনেনি। শান্ত মেয়েটা বদলে গেছে একেবারে। হাসি নেই, গান নেই, কথা নেই। সব সময় বিরক্ত। তার যেন ধৈর্য্যও অবশিষ্ট নেই। মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে রেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নীলা। অনেক পরে পরাগদের বাড়ি থেকে তাকে গিয়ে ফিরিয়ে আনলো পিউ। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেছে একই ভাবে। পিউ আর নীলা ধীরে ধীরে দুঃখের অগ্নিসাগর পার করে এগিয়ে গেছে। তারপর শোকের অনলে জ্বলে জ্বলে ক্রমে নীলার শরীর ঢলে পড়েছে মৃত্যুর দিকে। কর্কটরোগ এসে বাসা বেঁধেছে তার শরীরে।




সিস্টার একটা কিডনি ট্রে হাতে নিয়ে পরাগের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাদা সাদা পেট মোটা ছোট ছোট কৃমির মতো একরকম কীট ট্রেতে কিলবিল করছে। “এই দেখুন দাদা! এই এত এত পোকা! দেখছেন!”

পরাগ শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তার বিরল কেশ মাথায় একবার হাত বোলায় সে। তার বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয়। নীলা ঘুমাচ্ছে। বাঁদিকে ফিরে শুয়ে থাকলে তাকে অসুস্থই মনে হয় না। ওর মুখের ডানদিকে তুলো গজ দিয়ে ড্রেসিং করা হয়েছে। স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা। অপারেশন আর রেডিয়েশানের পরেও আবার রেকার করেছে। একবছরের মধ্যে এই রোগ আস্ত মানুষটাকে যেন গিলে খেয়ে নিয়েছে। নীলার শীর্ণ শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে। সে নিজের হাতের একটা আঙুল মুঠো করে ধরেছে। মুখে হাসি। নীলা স্বপ্ন দেখছে।

সিস্টার বেরিয়ে যেতেই পরাগ এসে দাঁড়িয়েছে বিছানার পাশে। সে মাথা নীচু করে কাঁদছে। পরাগ একটা কথা অনেকদিন ধরেই বলতে চায় নীলাকে। আসলে কথাটা প্রায় সারাজীবন ধরেই বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু বলতে পারেনি। জ্যোতিষ্ক নিখোঁজ হবার কয়েকদিন আগে জ্যোতিষ্ককে সে বেনামে একটা খারাপ চিঠি পাঠিয়েছিল, ওর হাসপাতালের ঠিকানায়। চিঠিতে নীলার শরীরের নিখুঁত বর্ণনা করেছিল সে। সবই যদিও তার ভাবনা, ঘোর! অথবা অলীক কল্পনা! লিখেছিল, “নীলা আমার। ওর শরীরের প্রতিটা কোণ আমার” কত রাতে পরাগ তাকে স্বপ্নে দেখেছে। জ্যোৎস্না আলোমাখা সেই অলৌকিক সুন্দর নারী শরীর। খুবই সুস্পষ্ট সেই দেখা। চিঠিতে সে নীলার শরীরের বর্ণনা করেছিল তার অলীক কল্পনা দিয়ে। বুকের মাঝখানে একটা কালো তিল। ঠিক তিল নয়, আঁচিল বলা যায় তাকে, আর ডান স্তনের ঠিক নীচে লুকোনো কোণে একটা লাল রংয়ের জড়ুল!”

আর কিছু সে করেনি। এই পাগলামী সে কেন যে করেছিল তা সে জানে না! নীলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার মনের ভেতরটা হঠাৎ কেমন শূন্য হয়ে গেছিল। কিন্তু তারপর জ্যোতিষ্ক কেন কীভাবে কোথায় চলে গেছে? সে সত্যিই কিছু জানে না। পরাগ খুব সন্তর্পণে নীলার বিছানায় এসে বসল। পেশেন্টদের একটা দড়ি বাঁধা ফিকে নীল গাউন পরানো হয়েছে তাকে। বুকের উপর চাপা দেওয়া নীল চাদরটা অসাবধানে কেমন করে যেন একটু সরে গেছে। প্রায় অর্ধ্ব-উলঙ্গ অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে নীলা। তার পোশাক সম্পূর্ণ অবিন্যস্ত। হঠাৎ পরাগের চোখ আটকে গেছে নীলার ডান স্তনের উপর। শীর্ণ স্তনের নীচের দিকে স্পষ্ট একটা লালচে জড়ুল আর দুটো বুকের মাঝখানে একটা কালো আঁচিল! চমকে উঠেছে পরাগ। থরথর করে কাঁপছে সে।

আশ্চর্যভাবে তার কল্পনা হুবহু মিলে গেছে বাস্তবের সঙ্গে। কিন্তু কেবল এইজন্যই কি জ্যোতিষ্ক এমন করে নীলাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে? পরাগ তা বিশ্বাস করে না। এ হতেই পারে না। সে ধীরে ধীরে নীলার গায়ে চাদর চাপা দিয়ে দেয়। খুব আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় পরম মমতায়। তার এতদিনে মনে হয়, নীলা সত্যিই শুধুই তার। প্রকৃতি তাই জ্যোতিষ্ককে সরিয়ে দিয়ে নিজের ভুলটুকু সংশোধন করে নিয়েছে। নীলার ঘুম ভাঙলে, সে একটা কথা আজ তাকে বলবে, আর কোনো বাধা নেই। সে কথাটা পৃথিবীর সব থেকে পুরনো একটা কথা। তার কোনো তাড়া নেই। সারাজীবন তার অপেক্ষাতেই কেটে গেছে, না হয় আরও ঘন্টা খানেক সে অপেক্ষাই করবে!

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *