short-story-aatanka

আতঙ্ক
বিপুল দাস


হুইস্পারিং ক্যাম্পেনের মত কথাটা ফিসফাস করে ছড়িয়ে পড়ছিল। অল্প দিনেই কথাটা স্নো-বলের মত হয়ে গেল। ক্রমশ কথার গায়ে কথা জড়াতে লাগল। কথার গোল্লাটা অসম্ভব একটা আকার নিল। প্রথমে শহরে ছড়ালেও দ্রুত গ্রামেগঞ্জে, মাঠেময়দানে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হতে শুরু করল। সামনের অমাবস্যায় নাকি ভয়ংকর এক দুর্যোগ নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু দুর্যোগের চরিত্র নিয়ে কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিল না। গণ-আতঙ্ক বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছলে প্রশাসন থেকে গুজব ছড়াতে বারণ করা হ’ল। গণমাধ্যমে বারে বারে বলা হচ্ছিল অমূলক, অবৈজ্ঞানিক কথায় আতঙ্কিত না হ’তে, আতঙ্ক না ছড়াতে। কারণ, ইতিমধ্যেই কয়েকজন দুর্বল চিত্তের মানুষ শুধু আতঙ্কের কারণেই মারা গিয়েছে।

অনেক রকম কথা বাতাসে ভাসছিল। সেগুলো মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়।

(এক) – প্রশান্ত মহাসাগরের তলা থেকে প্রকাণ্ড এক পাহাড় জেগে উঠছে। খুব দ্রুত সেটি জলের ওপরে উঠে আসবে। শিক্ষিত লোকজন বলল – হতে পারে। এভাবেই তো একদিন টেথিস সমুদ্র থেকে হিমালয় তৈরি হয়েছিল। হতেই পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী সমস্ত দেশ ও মহাদেশ বিলীন হয়ে যাবে। তার ধাক্কা কিছুটা হলেও কলকাতায় পৌঁছবে। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় ভালো প্রভাব পড়বে।

(দুই) – মহাশূন্যের সুদূর প্রান্ত থেকে একটা বিশাল বস্তু অকল্পনীয় গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। সংঘর্ষে যে বিপুল শক্তি নির্গত হবে, জানা এবং অজানা যে সব মারণ রশ্মি নির্গত হবে, তার ফলে মাটির ওপরের কোনও উদ্ভিদ ও প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। ভূগর্ভের কিছু প্রাণী বেঁচে থাকতেও পারে। পৃথিবীর অক্ষ পালটে যাবে।

(তিন) – সূর্য আচমকাই পৃথিবীর অনেক কাছে চলে আসবে। উত্তাপে সব জল বাষ্প হয়ে যাবে। পৃথিবী ঝলসে ঝামা হয়ে যাবে। কারও পক্ষে বেঁচে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

(চার) – হিমালয়ের এক দেড়শ বছরের সন্ন্যাসী ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন স্বয়ং কলি এবার সৃষ্টি নাশ করার জন্য আবির্ভূত হবেন। আর এক কল্পারম্ভ শুরু হবে। এই সন্ন্যাসীই বলেছিলেন হিটলারের কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিদের হেরে যাওয়ার কথা, পরমাণু বোমার কথা, এমন কী চৌত্রিশ বছর পরে বামফ্রন্টের পতনের কথাও খুব সাঁটে বলেছিলেন।

লৌকিক এবং অলৌকিক, নানা রকম সম্ভাবনার কথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। রাস্তাঘাটে, মলে, আইনক্সে, স্কুলকলেজে জনশূন্যতার কারণে আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের অপদার্থতা নিয়ে যাচ্ছেতাই গালাগালি দিচ্ছিল।

ঋষি একসময় খুব নকশাল ছিল। একাত্তরে আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়। সিদ্ধার্থ রায়ের পুলিশ তাকে আলুয়া জোতের পাটখেতের ভেতর থেকে গ্রেফতার করে। সি আর পি এফের বুটের কড়া লাথি তার কোমর নড়বড়ে করে দিয়েছিল। বন্দিমুক্তি পর্বে সে বাড়ি ফিরে আসার পর সবাই দেখল সে বৃদ্ধদের মত কুঁজো হয়ে হাঁটে। ছোট বোন নিলু প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। তার সাধ্য ছিল না দূর শহরের নামকরা হাসপাতালে দাদার চিকিৎসা করানোর। অন্য কোনও অসুবিধা তো নেই, শুধু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নিলু একটা স্টিক দিয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে হাঁটা ঋষির পছন্দ হয়নি। ওই কুঁজো হয়েই সে বেঁচে রইল। ঘরে বসে টিভি দেখে, খবরের কাগজ পড়ে। নিলু তার জন্য চারজন ছাত্র জোগাড় করে দিয়েছিল। দু’তিন বছরের মধ্যে অঙ্কের টিচার হিসেবে সে বেশ সুনাম করে ফেলে। তবে এ হ’ল আশি-নব্বই দশকের কথা। পরবর্তী কালে ঋষি নিজের উদ্যোগে হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্কের সিলেবাস বুঝে নেয়, বাংলা এবং ইংলিশ মিডিয়ামের। ব্যাপারটা রপ্ত করে সে ইলেভেন-টুয়েলভের অঙ্ক শেখাতে শুরু করেছিল। তার পক্ষে কারও বাড়িতে গিয়ে পড়ানো সম্ভব নয়। বাড়িতেই সে ছোট একটা টিউটোরিয়াল খুলে ফেলেছিল। এবার তার রোজগার হঠাৎ প্রায় তিনচার গুণ বেড়ে গেল। নিলুর হাতে প্রায় নিলুর মাইনের সমান টাকা দিতে শুরু করেছিল। শুধু বাথরুমে যাওয়ার সময় তার স্টিক ব্যবহার করতে হ’ত।

দু’হাজার এগারোতে বামফ্রন্টের পতনের পর ২০শে মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, সেদিনই ঋষি স্যার বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যান। প্রবাদপ্রতিম ঋষি মিত্র এবার একেবারেই বসে গেলেন। অঙ্কের বাঘ হিসেবে তার পরিচয় ক্রমে সবাই ভুলে গেল। ঋষি স্যারের কোচিং বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু আশ্চর্য! ঋষি আবার বিছানা ছেড়ে উঠল। আবার ঝুঁকে ঝুঁকেই হাঁটতে লাগল। কোচিং ক্লাস আবার শুরু করতে চাইলেও দেখা গেল তার ছেড়ে যাওয়া চপ্পলে অন্য স্যার পা গলিয়ে নতুন টিউটোরিয়াল চালু করে দিয়েছে। নতুন করে আর ক্লাস জমাতে পারল না ঋষি।

সত্য নামে যে লোকটার এ বাড়িতে অনেক দিনের আসা যাওয়া – ঋষি বুঝতে পারত নিলুর জন্যই লোকটা আসে। প্রথম প্রথম নিলু আড়ষ্ট থাকলেও পরে সত্য এলে নির্লজ্জ ভাবেই তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত। ঋষি ‘’লিমিট টেন্ডস টু জিরো, বাট নট ইকুয়ালস টু জিরো’ – এই বাক্যের রহস্যভেদ যখন করছে, তখন অন্য ঘরে বন্ধ দরজার ওপাশে সত্য আর নিলু কী করছে, সেই ভাবনার ঘরে ঋষি জোর করে তালা মারত।

খবরের কাগজ, টিভি মারফত ঋষিও শুনেছিল সামনের অমাবস্যায় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার কথা। তার মনে পড়ল অনেক আগে এরকম একটা গুজবে মানুষ ভয়ের চোটে ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দিয়েছিল। নাসা থেকে স্কাইল্যাব নামে একটা গবেষণাগার মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছিল। সেটি ভেঙেচুরে পৃথিবীর মাটিতে আছড়ে পড়বে, এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীজুড়ে। তখন টিভি ছিল না। রেডিও আর খবরের কাগজের ওপর পাবলিক কান আর চোখ পেতে রাখত সবসময়। বেশির ভাগ মানুষের মনোবাসনা ছিল পড়ে তো আমেরিকার ওপরেই পড়ুক। তোদের নাসা, তোদের ল্যাব, ভেঙেচুরে অন্য দেশে কেন পড়বে। কিছু মানুষ দিনরাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা করে ফেলেছিল। রকে, বাইরের ঘরের আড্ডায়, চায়ের দোকানে আর কোনও আলোচনার বিষয়ই ছিল না। তখনই অনেক মহাকাশ ও রকেট বিজ্ঞানীর পরিচয় প্রকাশ্যে আসে। এসব মানুষজন এমন ভাবে তাদের মতামত জানাত যেন এরা নাসার নিজের ঘরের লোক। লোকজন হা করে শুনত। স্কাইল্যাব মাথার ওপর ভেঙে পড়তে পারে, এই আতঙ্কে অনেকেই ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ঋষির মনে আছে মাঝে মাঝেই স্কাইল্যাব নিয়ে খবরের কাগজে কার্টুন, মনোবিজ্ঞানীদের প্রবন্ধ, দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। প্রত্যেকেই সেগুলো প্রায় মুখস্থ করে ফেলত। তার সঙ্গে ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ আবার উগরে দিত আড্ডায়।

ঊনিশ ‘শ ঊন আশির ১১ই জুলাই মহাকাশেই স্কাইল্যাব ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসাবশেষ শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ভারত মহাসাগর এবং অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম অংশে। এই গণ-আতঙ্ক আস্তে আস্তে কমে গিয়েছিল।

এরকম আর একটা ঘটনার কথাও ঋষির অস্পষ্ট মনে আছে। সে তখন বোধহয় ফাইভ-সিক্সে পড়ে। নাকি ন’টা গ্রহ এক জায়গায় এসে যাবে। নবগ্রহ সম্মেলন। পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য। সেবার অবাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় খুব ভয় পেয়েছিল। তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই নদীর পারে রামঘাট। সেখানে বিশাল শান্তিযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিল। রাতারাতি মেলা বসে গেল। সেবারই প্রথম ঋষি ‘নওটঙ্কি’’ শব্দটি শুনতে পায়। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেবার নবগ্রহ একসঙ্গে হতে পারেনি। কাশি থেকে কয়েকজন পাওয়ারফুল সাধু এসেছিল। শোনা যায় তারাই গ্রহদের এই অশুভ প্রোগ্রাম বানচাল করে দিয়েছিল। কিছুই হয়নি। ঋষিরা কয়েকজন মিলে গিয়ে দেখেছিল অনেকগুলো জায়গায় যজ্ঞের আগুন জ্বলছে। গেরুয়া ধুতিপরা, মাথায় জটা, বিশাল দাড়ি নিয়ে সাধুসন্ন্যাসীরা জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছে। মাইকে শোনা যাচ্ছিল। কয়েকটা মাইকের মুখ আকাশের দিকে। স্পষ্টই বোঝা যায় ওগুলো গ্রহদের সাবধান করার জন্য। মাঝে মাঝে পিতলের কলস থেকে ঘি ঢালা হচ্ছিল আগুনে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠছিল। অবাঙালি মেয়েবউরা হিন্দিতে অদ্ভুত একঘেয়ে সুরে কী যেন গাইছিল। ঋষিরা তাঁবু ঘেরা একটা জায়গা দেখে বুঝেছিল এখানে নওটঙ্কি থাকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরেছিল। কিছু দেখতে পায়নি। ম্যাজিকওয়ালার তাঁবু দেখে ফিরে এসেছিল।

অমাবস্যা ক্রমশ এগিয়ে আসছিল। পাবলিকের ভেতরে হিস্টিরিয়ার প্রকোপ বাড়ছিল। রাস্তাঘাট জনশূন্য। পাবলিকের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ভয়ে বিবর্ণ মুখ। মৃত্যুভয়ে কেমন স্থবির হয়ে গেছে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে যে সাউন্ড-সিস্টেমে এতদিন দুপুর বেলায় ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে’ বাজত, সেগুলোতে ‘আছে দু:খ, আছে মৃত্যু’ বাজছে, দেবব্রত বিশ্বাসের।

হাটচালার নিচে বসেছিল পাগল সোলেমান। সেও শুনেছিল কেয়ামতের দিন এসে গেছে। প্রবল এক শিঙার আওয়াজে দুনিয়া কেঁপে উঠবে। হাসরের ময়দানে কাতারে লোক দাঁড়াবে। হরিমন্দিরে বাহাত্তর ঘন্টার নাম-সংকীর্তন শুরু হয়েছে। খৃস্টান পাড়ার সবাই কেষ্টপুরের চার্চে ছুটছে ফাদার মাইকেল মণ্ডলের কাছে পাপ স্বীকার করতে।

বাধন উকিলের বউ ফোঁত ফোঁত করে কাঁদছিল। আজ রাতে সে বিয়ের আগে তার প্রাইভেট মাস্টার বাবলুদার সঙ্গে অবৈধ সঙ্গমের কথা বলে যাবে। উকিলবাবু ভাবছিল পাড়াগাঁয়ের চন্দনার কথা বলে দেবে। পেট খসাতে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটা মরেই গেল।

ঋষি তার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। সে জানে কিস্সু হবে না। পৃথিবী যেমন ছিল, তেমনই ঘুরে যাবে। কোনও দিন আর বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাবে না। বন্ধ ঘরের ভেতরে সত্য ভৌমিক আর নীলিমা পরস্পরকে আঁচড়ে কামড়ে শেষবারের মত চূড়ান্ত সুখ পেতে চাইছিল।

ঋষি ভাবছিল – সত্যকে নিয়ে নিলু এ বাড়িতেই থাকুক। বিয়ে করে চলে গেলে তার কী হবে। কে তাকে চা দেবে, ভাত বেড়ে দেবে।

আর যদি সত্যি নিলুকে নিয়ে সত্য কোথাও পালিয়ে যায়… আতঙ্কে ঋষি সাদা হয়ে যাচ্ছিল।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-aatanka

  1. গ্রীসে যখন প্লেগ মহামারির আকার নিয়েছিল,তখন মানুষ এভাবেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। এই লেখা পড়তে পড়তে যেন, আতঙ্কিত চারপাশ ঘিরে ধরছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *