short-story-abbaser-bibi

আব্বাসের বিবি
নন্দিনী নাগ


এক

রাত প্রায় দুটো, চোখ থেকে এখনও জল গড়ানো বন্ধ হয়নি শেহনাজের। দু’ঘন্টা ধরে একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে ও, কখনও ফোঁপানি কখনও বা সশব্দে বার হয়ে আসছে কান্না, বালিশে মুখ চেপে ধরেও থামাতে পারছে না এই অবিরাম অশ্রুধারা। খানিকক্ষণ আগে ও ঘর থেকে বার করে দিয়েছে আব্বাসকে, সে অবশ্য যেতে চাইছিল না, বলছিল, “তুমি এমনভাবে কাঁদছ, আমি তোমাকে একা ছেড়ে দিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি!”

শেহনাজ মনে মনে বলেছিল, “সারাজীবনের জন্য একা করে দিতে চলেছ যেখানে, সেখানে একটা রাতের একাকীত্বে কী আসে যায়!”

মুখে অবশ্য উচ্চারণ করেছিল অন্য কথা, কান্না জড়ানো গলায় বলেছিল, “তুমি এখন ঘুমাতে যাও। কাল ডিউটি আছে।”

আর বেশি আপত্তি করেনি আব্বাস, পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

‘ডিউটি’ অবশ্য শেহনাজেরও আছে, ওকে উঠতে হবে আব্বাসের অনেক আগে, তবে সেই কর্তব্যকর্মের সবটাই সংসারের জন্য, কাজেই তার কোনও স্বীকৃতি নেই। কাকভোরে উঠে রান্নাবান্না সেরে আব্বাসের খাবার ঠান্ডা করে টিফিনকৌটোতে ভরে দিতে হয়, তারপর নামতে হয় ঘরের অন্য সব কাজে। আব্বাসের বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে, আব্বু-আম্মি থাকেন একমাত্র ছেলের সঙ্গে, তাদের দেখাশোনার ভার শেহনাজের ওপরেই।

এসব অবশ্য বলার মতো কোনও কথাই নয়, সব বউরাই করে থাকে। আর এসব হাসিমুখে সামলাতে চেয়েই তো দশবছর আগে ও ভালোবেসে নিকাহ্ করেছিল আব্বাসকে। কিন্তু জীবজগতের অন্যান্য স্ত্রী আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ যে দায়িত্ব পালন করে থাকে, সেখানেই খামতি থেকে গেছে শেহনাজের, যা ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারায়। প্রবলভাবে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে শেহনাজ, আর সেই অসহায়তা কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে অবিরত, থামাতে চেয়েও কিছুতেই লাগাম পরাতে পারছে না ও।

শেহনাজের তিরিশবছর বয়সী শরীরটা নিয়মিত আল্লার মাশুল তুলেছে, অথচ এখনো রয়ে গেছে নিস্ফলা।

আব্বাসের আম্মু আগে লুকিয়ে চুরিয়ে বলত, এখন খোলাখুলি গলা তুলে বলে, “ও একটা বাঁজা মেয়েমানুষ। তোর আবার নিকা করাব আমি।”

কথাটা শুনলে শেহনাজের গায়ে ছ্যাঁকা লাগত প্রথম প্রথম, তবে বিগত বছর দুয়েক ধরে শুনতে শুনতে গা-সওয়া হয়ে গেছিল। তবে ওর বিশ্বাস ছিল আব্বাস তার ভালোবাসার দাম দেবে, আম্মুর প্ররোচনায় কখনোই আবার নিকাহ্ করবে না।

বেশ কিছুদিন ধরেই ঘটক লাগিয়েছে আব্বাসের আম্মু, মেয়ে দেখাশোনা চলছে। রাতেরবেলা একলা পেয়ে শেহনাজ যখন স্বামীর মন জানতে চেয়েছিল, তখন সোহাগ কাড়তে আসা মানুষটা বলেছিল, “আম্মুর মন রাখার জন্য মেয়ে দেখছি, পছন্দ হচ্ছে না বলে কায়দা করে সব কাটিয়ে দেব। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।”

বিশ্বাস করেছিল শেহনাজ, যেমনভাবে সব ব্যাপারে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে আব্বাসকে, এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। এই ভরসাটুকুকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিল শেহনাজ আজ দুপুর পর্যন্ত, যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজের কানে শুনেছিল নিজের মৃত্যু পরোয়ানা, “রিস্তা পাক্কা।”

দুপুর থেকে নিজের ঘরেই শুয়ে আছে শেহনাজ, আকাশ-পাতাল ভেবেই চলেছে আর কেঁদেই চলেছে। রাতে রান্না করতেও ওঠেনি, নিজেও খায়নি। আব্বাস বাড়ি ফিরে আসার পর মায়ের কাছে নিশ্চয়ই বউয়ের এই ‘ঢঙ’-এর কথা শুনেছে, তবে একবারের জন্যেও শেহনাজের সামনে আসেনি। সেটা অবশ্য লজ্জায় না মায়ের ভয়ে, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তারপর রাত গভীর হলে, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর চোরের মতো নিঃশব্দে এসে ঢুকেছে নিজের বউয়ের ঘরে, যে ঘরে সদর্পে ঢোকাটাই তার আইনসিদ্ধ অধিকার।

“সবারই তো ইচ্ছে করে সন্তানের মুখ দেখতে। ছেলেপিলে হচ্ছে না বলে আম্মু আব্বার মেজাজ ভালো নেই, সবসময় ঘ্যানর ঘ্যানর করে, কান্নাকাটি করে। তাদের কথাটাও তো আমাকে ভাবতে হবে, তাদের বংশ রক্ষা করাটাও তো আমার কর্তব্য। আমার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা করবা না তুমি? আর তাছাড়া-”

বউকে বোঝাচ্ছিল আব্বাস, হয়তো নিজেকেও। তার কথাগুলো আত্মপক্ষ সমর্থনের মতোই লাগছিল শেহনাজের। এসব যুক্তির উত্তরে অনেক কিছুই বলতে পারত ও, কিন্তু কিছুই বলল না। আব্বাসের ছেড়ে দেওয়া কথাটার সুতোটা ধরিয়ে দেবারও চেষ্টা করল না। অগত্যা আব্বাস নিজেই খেই ধরল, “তাছাড়া তোমাকে তো আমি তালাক দিচ্ছি না। তুমি যেমন আছ, তেমনই থাকবা, শুধু আর একজন মানুষ বাড়বে সংসারে। তাকে ছোটবোনের মতো দেখবা, তালেই সমস্যা মিটে যাবে।”

এতই কি সোজা হিসাব মিটিয়ে দেওয়া! যে মানুষটাকে কেবল নিজের বলে জেনে এসেছে, তাকে অন্য কারো সাথে ভাগ করে নেওয়া কি সহজ কাজ! তারই চোখের সামনে দিয়ে আব্বাস যখন নতুন বউকে নিয়ে ঘরে দোর দেবে, তখন সেটা মেনে নিতে পারবে এমন উদারতা শেহনাজের নেই! তবে কি সে নিজেই ত্যাগ করবে আব্বাসকে? তার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে থাকা মানুষটাকে?

রান্নাঘরে, গনগনে আগুনে পুড়ে খাক হতে হতে ভাবে আর ভাবে শেহনাজ।

সাবিনাকে নিকাহনামা কবুল করিয়ে এ বাড়িতে এনে তোলার পর প্রথম বছরটা খুব কষ্ট হয়েছিল শেহনাজের। প্রত্যেক রাতে, একঘরে যখন আব্বাস তার কচি নতুন বউ নিয়ে প্রথম যৌবনে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন অন্যঘরে শেহনাজ নিজেকে ফেরাতে চাইছে ফেলে আসা ছাত্রীবেলায়। মাধ্যমিক পাশ করে নিকে করে ফেলা শেহনাজ অবেলায় ভর্তি হয়ে এসেছে মুক্ত বিদ্যালয়ে, একেবারে গোপনে। পড়াশোনার আশ্রয়ে সে ভুলতে চায় আব্বাসের উপেক্ষা, মুছে ফেলতে চায় এই সংসার থেকে পাওয়া যাবতীয় অপমান।

শেহনাজদের স্কুলের এক দিদিমনি সবসময় বলতেন, “পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর সবাই, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবে বিয়ে করবি। চাকরি কি সবাই পায় রে? তবে লেখাপড়াটা শিখলে নিজের পেটটা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবি তেমন প্রয়োজন পড়লে।”

তখন দিদিমনির কথায় গুরুত্ব দেয়নি শেহনাজ, এখন নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছে।

সতীনকে ছোটবোন ভাবার চেষ্টা করে দেখেনি কখনো শেহনাজ, ওদিক থেকেও তেমন কোনও ইচ্ছে প্রকাশ পায়নি। নতুনবউ এ বাড়িতে পা রেখেই বুঝে গেছিল আব্বাসের বড়বিবির দিন ফুরিয়েছে, কাজেই তাকে তোয়াজ করে চলা নিষ্প্রয়োজন। বরং নারীসুলভ অনুভূতিতে সে বুঝে গেছিল, তার স্বামীর মনে এখনও কিছুটা জায়গা আছে শেহনাজের জন্য। সেটুকুও কেড়ে নেবার জন্য সাবিনা তার অলস মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে সারাদিন ধরে নানারকম পরিকল্পনা করত, আর রাতে সেসব যথাস্থানে নিবেদন করত। ফলত প্রায় প্রতিদিনই আব্বাস সাবিনার মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে নতুন বউয়ের সাথে দুর্ব্যবহারের জন্য জবাবদিহি চাইত শেহনাজের কাছে, আর সে যখন আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করত, তখন দুজনের ঝগড়া লেগে যেত।

দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানার পর আব্বাসকে মন থেকে ত্যাগ করার চেষ্টা করে করে হন্যে হয়ে গেছিল শেহনাজ, তবু পারেনি। ছেড়ে দেবে ভেবেও মনের মধ্যে রয়ে গেছিল এতদিনের জমিয়ে তোলা বেশ খানিকটা অধিকারবোধ আর অনেকখানি ভালোবাসা। নিত্যদিনের ঘষাঘষিতে নৌকা বাঁধার মোটা কাছিরও সুতোগুলো কাটতে থাকে একটু একটু করে, তারপর একদিন কাছি ছিঁড়ে, বেঁধে রাখা নৌকা ভেসে চলে যায় দরিয়ায়।

শেহনাজেরও তাই হল। যে বাঁধন সে নিজে ছিঁড়তে পারেনি অনেক চেষ্টা করেও, সাবিনার পরিকল্পনা আর আব্বাসের অবিবেচক আচরণের ফলে সেই বাঁধন একদিন ছিঁড়ে গেল হঠাৎ করেই। মুক্ত হয়ে গেল শেহনাজ।


দুই

বছর পনেরো আগে দালানকোঠা বানিয়ে উঠে গেছে আব্বাসরা, উঠোনের এককোণে পুরনো কাঁচাবাড়িটা ভেঙেচুরে অবহেলায় পড়ে আছে ঠিক শেহনাজেরই মতো। ওই কাঁচা একচালা ঘরটা সারিয়েসুরিয়ে নিয়ে শেহনাজ ওখানে থাকার কথা পাড়াতে, ও বাড়ির সকলে খুশিই হল। সাবিনা তখন তৃতীয়বারের জন্য গর্ভবতী, কাজেই বাড়তি একটা ঘর পেলে শুধু সাবিনা কেন, সকলেরই বেশ সুবিধে হয়।

ততদিনে সংসারের চাবি নিজের আঁচলে বেঁধে নিয়েছে সাবিনা, শুধু সংসারের গালে লেগে থাকা আঁচিলের মতো বাড়তি অংশটুকুকেই ঝরাতে পারছিল না বলে তার মনে শান্তি ছিল না। এখন বিনা প্রচেষ্টায় সেটাও সরে গেল বলে ও খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, “সেই ভালো। তোমারটুকু যদি তুমি ওদিকেই ফুটিয়ে নাও, তবে আরও ভালো হয়, চোদ্দবার আর এবাড়ি ওবাড়ি করতে হয় না তোমাকে।”

এই কথাটা সাবিনা না বললেও শেহনাজ সেটাই করত। কারন সে তো জানে, গাছ ওপড়াতে হলে শিকড়সমেতই তুলতে হয়, শিকড় মাটিতে রয়ে গেলে যে কোনও দিন আবার ডালপালা ছড়াতে পারে।

তাছাড়া যার সূত্রে এ বাড়িতে পা রেখেছিল সে, তার থেকেই যখন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পেরেছে, তখন আর কিছুরই পরোয়া করে না শেহনাজ।

সহজাত প্রবৃত্তিতেই স্বামীর বড় বউয়ের ঘরে যাওয়া পছন্দ নয় সাবিনার।

“ভাঙা পুতুল নিয়ে আবার খেলার শখ কেন বাপু!” এমনটাই বক্তব্য ওর।

তবে এ ব্যাপারে ওকে কিছু করতে হয়নি, শেহনাজই আব্বাসকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সাবিনাকে ঘরে তোলার পর আর কখনও শরীরের কাছাকাছি আসতে দেয়নি তাকে, আত্মমর্যাদায় বেঁধেছে তার। আত্মমর্যাদা বাঁচাতেই বাপের ঘরে ফিরে যেতে পারেনি সে, আর সেই কারণেই আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত।

এখনও অনেক ভোরে উঠে রান্না করতে বসে শেহনাজ, তবে সেই পরিশ্রম এযাবৎকালের মতো ভস্মে ঘি ঢালা নয়। সেই শ্রমের বিনিময়ে সে ছিনিয়ে নিতে পেরেছে মাথা সোজা করে বাঁচার অধিকার। ওদের এই অঞ্চলে বিডিও অফিসে যারা কাজ করে তারা সকলেই বেশ দূর থেকে আসে। রান্নার হাত বরাবরই ভালো শেহনাজের, যদিও এতদিন শ্বশুরবাড়িতে রোজকার রান্নার কোনও কদর ছিল না। এখন বিডিওর সহায়তায় তার অফিসের কর্মীদের দুপুরের খাবার যোগান দেবার দায়িত্ব পেয়েছে শেহনাজ। এতে উভয়পক্ষেরই লাভ হয়েছে, বিডিও সমেত তার অফিসের কর্মচারীরা দুপুরে বাড়ির রান্না ভাত তরকারি চেটেপুটে খেয়ে পেটের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে পারে আর শেহনাজেরও মাস গেলে স্থায়ী রোজগার হয়।

এই কাজটা পাবার আগে স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্রে একটা কাজ পেয়েছিল ও, বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ। রান্নার কাজ খানিকটা এগিয়ে রেখে সেখানেই যায় শেহনাজ, তারপর বেলায় ফিরে এসে বাকি রান্না শেষ করে, কৌটোয় খাবার ভরে সাইকেল চালিয়ে বিডিও অফিস।

সন্ধ্যাবেলাটা নিজে পড়াশোনা করে শেহনাজ, প্রাইভেটে বি.এ পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘরের সমস্ত কাজ সেরে, পরেরদিনের রান্নার যোগাড় করে অনেক রাতে যখন বালিশে মাথা রাখতে পারে তখন আর কোনওকিছু ভাববার মতো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না ওর শরীরে। ফলে একই উঠোনে বাস করেও, আব্বাস আর তার ঘরসংসার আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে শেহনাজের মন থেকে।

সেদিন সকালে আচমকাই মুখোমুখি হয়ে গেল আব্বাসের সঙ্গে, অনেকদিন বাদে। দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে আব্বাসকে দেখলে রাগ হত শেহনাজের, আবার তাকে না পাওয়ার জন্য কষ্টও হত। এই দুইয়ের যাঁতাকলে পড়ে বেশ কয়েকটা দিন মনে মেঘ জমে থাকত, বৃষ্টিও ঝরতো কখনো সখনো। তাই ওর মুখোমুখি হওয়াটাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যেত শেহনাজ। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেদিন আব্বাসকে দেখে করুণা ছাড়া আর কিছু অনুভূতি জাগল না শেহনাজের মনে। বেশ রোগা হয়ে গেছে, বুড়িয়ে গেছে ও, যেটা গত দু’বছরে কখনও চোখে পড়েনি শেহনাজের।

রাস্তার কল থেকে দুইহাতে বড় বড় দুই বালতি ভর্তি জল নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল আব্বাস।

“বাড়ির কলে জল আসে না?” শেহনাজ এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল। যেন পড়শীর সঙ্গে কথা বলছে, তাদের সংসারের হালহকিকত জানছে ভদ্রতার বশে, এমনই বোধ হচ্ছিল ওর।

“জলের লাইন খারাপ হয়ে গেছে অনেকদিন, সারানো হয়নি।” শেহনাজের দিকে তাকালো না ও, মাথা নিচু করে চলতে চলতেই উত্তর দিল আব্বাস, তারপর আরও তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকল, যেন পালাতে পারলে বাঁচে।

শেহনাজ সেই যে দালানবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল, তারপর আর কখনও ও বাড়িতে পা রাখেনি। প্রথমবছর ঈদে আব্বাস এসেছিল নতুন কাপড় নিয়ে, সাবিনাও খাবার পাঠিয়েছিল, তারপর থেকে ওই পাটাপাট ঘুচে গেছে। সাবিনা আর আব্বাসের বাচ্চারাও কেউ এদিকটাতে আসে না, ফলে তাদের জন্য কোনওরকম অনুভূতিই তৈরি হয়নি শেহনাজের মনে।

শেহনাজ জীবিত থাকতে তার স্বামী আবার বিয়ে করেছে শুনে বিডিও বলেছিলেন, “তুমি খুব বোকা মেয়ে তো! এটা বেআইনি, কোর্টে গেলে তোমার স্বামীর জেল হবে।”

“তাতে কি আমি তার ভালোবাসা ফিরে পাব দিদি? শুধু-মুধু বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একটা মেয়ে পথে বসবে।”

“তাই বলে তুমি বিনা দোষে কষ্ট করবে?”

“কষ্ট কোথায় দিদি! খাটনিতে কোনও কষ্ট নেই। বরং কষ্ট আছে অসম্মানে।”

বিডিও মুগ্ধ হয়ে গেলেন শেহনাজের কথায়। এমনভাবে যদি সকলে ভাবতে পারত, তবে দেশের ছবিটাই বদলে যেত, ভাবলেন তিনি। মুখে বললেন, “শোনো শেহনাজ! আমি চাই আমার এই ব্লকের মেয়েরা তোমার মত স্বাধীনভাবে রোজগার করার কথা ভাবুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। তুমি দায়িত্ব নিয়ে তোমার এলাকায় মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করো। আমি তোমাদের সবরকমভাবে সাহায্য করব।”

শেহনাজের ওপর এখন অনেক বড় কাজের দায়িত্ব, অনেক নতুন স্বপ্ন ওর চোখে। আব্বাস আর তার পুরনো ঘরসংসারকে এখন একটা বাসি স্বপ্নের মতো মনে হয়। যেন সেসব গতজন্মের ঘটনা, এ জন্মে তার কিছু কিছু কথা আবছা মনে পড়ে মাত্র, বাকি সব ভুলে গেছে।


তিন

আব্বাসের আব্বার ইন্তেকাল হয়েছে ক’দিন হল। তারপর থেকে প্রায় রোজই ও বাড়ি থেকে সাবিনার চিৎকার চেঁচামেচি কানে আসে শেহনাজের, যখন সে ঘরে থাকে। তবে এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ও, মনে কোনও কৌতূহলও হয়নি।

সেদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসতে বেশ দেরিই হয়ে গেছিল, কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার নেমে এসেছিল বেশ ঘন হয়ে। ঘরের সামনের আমগাছটার নিচে অন্ধকারটা আরও গাঢ় মনে হল শেহনাজের, হয়ত কুকুর শুয়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে।

সাইকেলের ঘন্টি বাজাল শেহনাজ, কুকুরটা সরল না। অতএব সাইকেল থেকে নামতে হল ওকে, মুখে আওয়াজ করে একটু এগিয়ে গেল কুকুরটাকে পথ থেকে সরানোর জন্য।

আরে! এ তো মনে হচ্ছে একটা মানুষ!

ভালো করে দেখার জন্য ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বার করে আলো জ্বালল শেহনাজ।

“আপনি!”

মানুষটাকে দেখে চমকে উঠল শেহনাজ। অমন দাপুটে মানুষটাকে এমনভাবে কুন্ডলী পাকিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখবে, এমন কথা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি শেহনাজ।

“উঠুন। ঘরে চলুন।”

“ঘর নাই আমার। ওরা আমায় বার করে দিয়েছে” কোঁকাতে কোঁকাতে বলল বৃদ্ধা।

শেহনাজ যত্ন করে ধরে ধরে তুলল তাকে, তারপর নিজের ঘরে নিয়ে গেল।

“কে বলল আপনার ঘর নেই? এটাও তো আপনার ঘর, আজ থেকে আপনি এখানেই থাকবেন।”

এবার বৃদ্ধার চমকে যাবার পালা।

“আব্বাসের বউ, তুমি আমাকে এই কথা বলছ!” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বৃদ্ধা।

“হ্যাঁ, বলছি। আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। আপনার জন্যই তো, শুধু আপনার জন্যই আমি আজকে ‘আব্বাসের বিবি’ থেকে ‘শেহনাজ বিবি’ হয়ে উঠতে পেরেছি। আমি আপনার কাছে চিরঋণী আম্মু।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

10 thoughts on “short-story-abbaser-bibi

  1. বেশ ভালো লেখা৷সুন্দর ধরা ছাড়া একটা নিটোল সার্থক গল্প৷কতগুলো বিন্দু দিয়ে শেষে একটা বৃৃৃত্তাকারে পরিভ্রমণ ৷সামাজিক গল্প হিসাবে চমৎকার লেখার মুন্সীয়ানায় সার্থক ছোটগল্প হয়েছে৷

  2. নন্দিনী, অনবদ্য ছোটোগল্প তোমার “আব্বাসের বিবি”। শেষ মোচড়টা (ট্যুইস্ট) গল্পের ইউনিক সেলিং পয়েন্ট (USP)! গল্পে সংলাপ এবং ন্যারেটিভ অংশের ভারসাম্য বজায় রেখেছ ঠিকঠাক। উপস্থাপন-গুণে এ গল্প পাঠকের মনছুঁয়ে যাবেই। মেয়েফ্রর জন্যে দেওয়া সামাজিক বার্তা প্রশংসনীয়। এমন শারদ উপহারের জন্যে ধন্যবাদ, থাকছে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

    1. অসাধারণ সুন্দরএকটা ছবি ফুটে উঠল মনে শেহনাজের ছবি -নারীর মুক্তির এক আলোকবর্তিকা সে!
      লেখার গুণে সে আমায় বড় টানলে!
      শেষের অংশে দেখলাম সে তার চরিত্রের কোমলতা বিসর্জন দেয়নি!

  3. খুব সুন্দর উপস্থাপনা নন্দিনীদি।এরকম আরো অনেক লেখা পড়তে চাই।ফেসবুকে শেয়ার করলাম,গল্পের লিংকটা।

  4. অনেকদিন পর এরকম সুন্দর একটি ছোটগল্প পড়ে মনটা ভাল হয়ে গেল।
    শারদীয়ার শুভেচ্ছা রইল আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য ।😊

  5. জাত লেখিকা। প্রনাম নেবেন। একদম ফিনিশিং টাচ এ সিক্সার। 😊 অসাধারন লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *