এফেয়ার

এফেয়ার
আনোয়ার ইকবাল
মেয়েটির মাথার ওপরে জ্বলছে উজ্জ্বল ছটা ছড়ানো চারটে বাতি। বাতিগুলোর ঠিক নিচে সেলস কাউন্টার, তার ওপরে রাখা ক্যাশ রেজিস্টারের সামনে দাড়িয়ে আছে সে। মাথাটা একটু ঝুঁকে আছে বলে, ওপরের থেকে নামা আলো, তার ঝুলে পড়া কয়েক গোছা চুল বেয়ে নেমে এসে কপালে অনবরত আঁকিবুঁকি কাটছে। চোখে লালচে কালো ফ্রেমের চশমা, নাকের উপর দিয়ে সেটি পিছলে এসে একটু নীচে ঝুলে আছে। ফর্সা মুখে একটি চকচকে আভা, নাকের চুড়োয় জড়ো হয়েছে হাল্কা কয়েক বিন্দু ঘাম, দরজা ঠেলে ভেতরে পা রেখে দৃশ্যটিতে চোখে পড়তেই প্রতিবারের মত এবারও তার হাত পা জমে বরফের মত হয়ে গেল; বুক খালি করে সবটুকু শ্বাস যেন ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ঠিক তখনই ক্যাশ রেজিস্টারে দাঁড়ানো মেয়েটিও মুখ তুলে তার দিকে চাইলো। জাহেদ সাহেবের মনে হল, মেয়েটির ষষ্ট ইন্দ্রিয় কি ওকে কানে কানে বলে দিল, ‘তাকিয়ে দেখ মেয়ে, কে এসেছে?’ চোখাচোখি হতে মেয়েটির ঠোঁটের দুই কোন মুচড়ে গিয়ে উপরের দিকে উঠে গেল। হাসলে, গালে চমৎকার একটি টোল পড়ে। দেখে জাহেদ সাহেবের বুকের গভীরে ঢোলের উথাল পাথাল বাড়ি পড়তে শুরু হয়।

পাসপোর্টে লেখা জন্ম তারিখের হিসেবে তার বয়েস এখন বাষট্টি। প্রাইমারী স্কুলে ভর্তির সময় বাবা সেটা কমিয়ে না লিখলে হত, চৌষট্টি। তা বাষট্টিই হোক, আর চৌষট্টি; মেদহীন সুঠাম শরীর আর দীর্ঘ কাঠামোর জন্যে তাঁকে দেখতে পঞ্চান্নর বেশি মনে হয় না। ইমিগ্রেশন নিয়ে তিনি আমেরিকাতে এসেছেন বছর খানেকের একটু আগে। এটা অবশ্য এই দেশে তাঁর প্রথম আসা নয়। অনেক বছর আগে, ছাত্র হিসেবে একবার এসে গিয়েছেন। কর্মসূত্রে এরপর আরও অনেক বার। পড়াশোনায় সবসময় তিনি একটু বেশি রকমেরই ভাল ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হলে নিজের ডিপার্টমেন্ট তাকে ধরে রাখল লেকচারার হিসেবে। তবে সেটা বেশিদিনের জন্যে নয়। তিনমাস না যেতেই বসে পড়লেন বিসিএস পরীক্ষায়। তা বলতে গেলে একরকম হুজুগের মাথায়। নাজ, তার কলেজ কালের প্রেমিকা; সে তৈরি হচ্ছিল বিসিএসের জন্যে। সেই পরীক্ষার প্রিপারেশনে তাকে সাহায্য করতে করতে জাহেদের মনে হল, তার নিজেরও বেশ ভাল প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষাটা দিয়ে দেখলে কেমন হয়? সেটা করে পড়লেন অন্য এক বিপদে। পরীক্ষাতে উৎরালেন দুজনেই। জাহেদ আবার অতিরিক্ত ভালভাবে। সবগুলো পরীক্ষায় সারাজীবন ফার্স্ট হতে হতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। এবারও সেটা এড়ানো গেল না। পরীক্ষা দেয়াটা ছিল, পুরোই খামখেয়ালিপনা। ফল হাতে আসার পর শুরু হল দুশ্চিন্তা; শিক্ষকতা না আমলাগিরি? অধ্যাপিকা মা বলেন আমলা হতে; আমলা বাবা বলেন শিক্ষকতায় থাকো। এই দ্বন্দ্ব থেকে টেনে বের করে আনল নাজ। চোখ পাকিয়ে বলল, ‘একাডেমীতে কি আমি একা যাব নাকি? কার খপ্পরে পড়ে যাই তার কোন ঠিক ঠিকানা আছে? নাজের হালকা বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহেদের মনে হল, সেটা হতে দেয়া মোটেই ঠিক হবে না। রাতে খেতে বসে মা কে বললেন, মা তোমার কথাই শুনলাম, আমি সিভিল সার্ভিসে যাচ্ছি। তৃপ্ত চেহারা বানিয়ে মা বললেন, ‘আমার লক্ষ্মী ছেলে,’ বলে, বুড়ো ছেলের কপালে সপাং করে একটি চুমু বসিয়ে দিলেন। তারপর বাবার দিকে একটা চ্যালেঞ্জের দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়লেন।

নাজ আর জাহেদের বিয়েটা হয়ে গেল একাডেমীতে যাবার আগেই । ক্যারিয়ার হিসেবে দুজনের পছন্দ প্রশাসন। ট্রেনিং শেষ হবার পর দুজনের পোস্টিং হল একই জেলা শহরে, তবে দুটি ভিন্ন মহকুমায়; ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। মহকুমা দুটির দূরত্ব একটি থেকে আরেকটির তেমন নয়। মাত্র তেষট্টি কিলোমিটার। রাস্তা ভাল হলে এইটুকু পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে বড়জোর ঘণ্টা দেড়েক। অথচ, এই দুটি মহকুমার মধ্যে আসা কিংবা যাওয়াতে সময় লেগে যায় সাড়ে তিন ঘণ্টার উপরে। তাও যেদিন কপাল ভাল, শুধু সেদিন। এইটুকুন পথ পাড়ি দিতে পার হতে হয় দু’-দু’টো ফেরি; মাঝে মধ্যে লক্কড় ঝক্কড় বাহনটিও বিগড়ে বসে রাস্তায়। এসব ঝক্কি সত্বেও, সপ্তা-শেষের ছুটির আগের দিন, বৃহস্পতিবারে, অফিস থেকে আগে আগে বেরিয়ে জাহেদ বাস ধরেন নাজের কাছে যেতে। শুক্র, শনি দু’টো দিন সেখানে কাটিয়ে, খুব ভোরে রওয়ানা দিয়ে ফিরে আসেন নিজের কর্মস্থলে। পালা পার্বণে লম্বা ছুটি হলে অবশ্য এই বিধি পালটে যায়। তখন নাজ আসেন জাহেদের কাছে। প্রথম পোস্টিং-এর তিনটি বছর এভাবে কাটানোর পর, নূতন নিয়োগে, একমাসের ব্যবধানে দুজনে ফিরে এলেন ঢাকায়। ভুল বলা হল; দু’জন নয় তিনজন। পরিবারে ইতিমধ্যে তৃতীয় সদস্য যোগ হয়েছে; ছ’ মাস বয়েসের কন্যা সন্তান রিমা।

সংসার তিল তিল করে গড়ে উঠছিল ভালই। দু’বছর পর সেখানে যোগ হল ছেলে, শাহেদ। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের লেখাপড়া করতে সরকারী বৃত্তিতে তখন তারা দুজনে দেশের বাইরে, যুক্তরাষ্ট্রে। দেশে ফিরলেন আরও একটি বছর পর। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে নূতন করে সংসার পেতে নাজ আর জাহেদ ভাবলেন এবার একটু থিতু হতে হয়।
সেটা হবার নয়। দুজনের বদলীর চাকরী। ছোট পদে থাকতে একই কিংবা পাশাপাশি দু’টি শহরে দুজনের পোস্টিং হত। পদোন্নতির সাথে সাথে সেই সুযোগ কমতে থাকলো। ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলেই দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ছেলেমেয়ে দু’টো বাবা মাকে তাই খুব অল্প সময়ই একসাথে দেখে। ক্যারিয়ারের খাতিরে এটা নিয়ে খুব একটা কিছু করারও জো নেই। অনেকগুলো বছর এভাবে কেটে গেল। মেয়ের বয়েস যখন কুড়ি আর ছেলের আঠারো, জাহেদের পোস্টিং তখন ঢাকায়; সচিবালয়ে। নাজ রাজশাহীতে। লেখাপড়ার সুবিধার জন্যে ছেলেমেয়ে দুটো থাকে ঢাকায়, বাবার সাথে। ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছে। মেয়ে, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। বিভাগীয় কমিশনার শাহনাজ হোসেনের বদলীর আদেশ হল। তিনি ঢাকায় নূতন কর্মস্থলে যোগ দিতে আসছেন। সরকারী গেজেট হাতে পেয়ে জাহেদ আর নাজ দু’জনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কত? জীবনের অধিকাংশ সময় দুজনে দু’জায়গায় থেকে কাটিয়ে দিলেন। নাজের এই পোস্টিং-এর পর আর ঢাকার বাইরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। জাহেদ এই অকেশনটি সেলিব্রেট করার জন্যে চাইলেন রাজশাহীর সংসার গুছিয়ে, গুটিয়ে দিতে নাজের কাছে যাবেন। স্ত্রী কাছে নেই, মেয়ের শাসনে দিন কাটে জাহেদের। মেয়ে ধমক দিয়ে বলল, না! তার ইউনিভার্সিটি বন্ধ। সেই যাবে মাকে সাহায্য করতে। ভাইয়ের পরীক্ষা চলছে, বাবার তার সাথে থাকাটা জরুরী।

যেদিন নাজ আর রিমার ঢাকায় ফেরার কথা, জাহেদ সেদিন অফিস থেকে একটু আগেভাগেই চলে এসেছেন। একটি বই হাতে বারান্দায় বসে তিনি ঘণ্টা দুয়েক ধরে ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন। যে কোন সময় ওরা এসে পড়বে। সকাল দশটায় রওয়ানা দেবার আগে ফোন করে জানিয়েছে, রওয়ানা দিচ্ছি। বড় জিনিসগুলো ট্রাকে আসছে, তারপরও অনেকগুলো পোঁটলা পুঁটলি হয়ে গেছে। তাই তারা প্লেনে না এসে বাই-রোড, গাড়ি নিয়ে আসছে। বইটি উল্টে জাহেদ কব্জি ঘোরালেন। প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। এত দেরি হচ্ছে কেন? ঘড়ি থেকে মুখ তুলে দেখলেন শাহেদ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, “বাবা তোমার ফোন।” থুতনি সামনে বাড়িয়ে ইশারায় জানতে চাইলেন, “কে?” ভ্রু নাচিয়ে শাহেদ জানালো, “জানি না।”

কথা শেষ করে কাঁপা কাঁপা হাতে কর্ড-লেস ফোনটিকে পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখলেন জাহেদ। শাহেদ সেটা ফেরত নিতে হাত বাড়িয়েছিল। তিনি সেটা খেয়ালও করলেন না। বাবার রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে শাহেদ জানতে চাইলো, “কি হয়েছে বাবা, তোমার চেহারা অমন দেখাচ্ছে কেন, কোন খারাপ খবর?”
“না! অফিস থেকে জরুরী খবর এসেছে, আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে; ফিরতে দেরি হতে পারে। তুই খেয়ে নিস।”
“মা আর আপা আসলে আমি একসাথে খাব। ওদের কিছু বলতে হবে?”
“না, কিছু বলতে হবে না। আমিই ফোন করব।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে ঢোকার মুখে দেখা হল গাজীপুরের মহকুমা পুলিশ অফিসারের সাথে। এই ভদ্রলোকই কালিয়াকৈর থেকে তাকে ফোন করে এক্সিডেন্টের খবরটি দিয়েছিলেন। জাহেদকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলেন। জাহেদ বললেন, “ওরা কোথায়?” পুলিশ অফিসার খুব কাতর ভাবে বললেন, “স্যার খবর ভাল নয়, আপনাকে একটু শক্ত হতে হবে।” স্বভাববিরুদ্ধভাবে জাহেদ হুংকার করে উঠলেন, “কোথায় ওরা?”
পাশাপাশি স্ট্রেচারে সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহ দুটি ঘিরে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ অলস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাহেদ হোসেনকে আসতে দেখে তারা স্যালুট দিয়ে তড়িঘড়ি করে একপাশে সরে গেল।

“এনিথিং রঙ?” কানের কাছে অসহিষ্ণু কণ্ঠে একজন কথা বলে উঠতে জাহেদের ভাবনার রেশ কেটে গেল। সামনে ক্যাশ কাউন্টার খালি, এবার তার পালা। তাঁকে না নড়তে দেখে পেছনে দাঁড়ানো মানুষেরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে, কথাটা তাদেরই একজনের থেকে আসা। “ও আই এম সরি!” বিপর্যস্ত মুখে তাকে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসতে দেখে, কাউন্টারের মেয়েটি ঝরঝরিয়ে হেসে উঠল, তাতে তার গালের টোলটি ফের টলমল করে উঠল।
“শুধু সিগারেট, নাকি আজকে আরো কিছু?” কাউন্টারে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে জেনিফার চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে জানতে চাইল।
“এক প্যাকেট মার্লবরো লাইট, আর কিছু নয়।”
জেনিফার জানত। এটা কিনতেই গ্যাস স্টেশন সংলগ্ন কনভিনিয়েন্স স্টোরটিতে এই অদ্ভুত মানুষটি রোজ আসে। শুধু যে সিগারেট কিনতে নয় এটা সে ভাল করেই বোঝে। প্রথম প্রথম পাত্তা দিত না। ফ্লার্ট করতে চায় এমন খদ্দের প্রতিদিনই তিন চারজন থাকে। কেউ কেউ ফ্লার্ট করেও ফেলে। কিন্তু, এই মানুষটি সেটি একদিনও করার চেষ্টা করেনি। সে এলে কেবল মুগ্ধ অপলক চোখে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। অন্যদের মত শরীরের বিভিন্ন স্থানে তার দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে না। চায় কি লোকটা? বললেই পারে। এখানে না বলতে চাইলে অন্য কোথাও গিয়েও বলতে পারে। বয়েস একটু বেশি বটে, মানুষটি কিন্তু হ্যান্ডসাম। যদিও একটু লাজুক টাইপ, সেটি অবশ্য জেনিফারের তেমন পছন্দের বিষয় নয়। দুষ্টুমি ভরা একটি হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে রেখে হাতে ধরা সিগারেটের প্যাকেটটি জাহেদের দিকে সে বাড়িয়ে ধরে। সেদিকে হাত না এগিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত তিনি ওর গালের ওপর কাঁপতে থাকা টোলটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। গুনে গুনে একাত্তর দিনে এই মুখটি তিনি দেখলেন কমপক্ষে একাত্তর বার। ঠিক একাত্তর দিন আগে এখানে প্রথম এসেছিলেন গাড়িতে তেল ভরতে। তেলের পাম্পে ক্রেডিট কার্ড কয়েকবার ঢোকানোর পরও কাজ হচ্ছিল না। মেশিনটি বারবার কার্ড রিজেক্ট করে দিচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে কনভিনিয়েন্স স্টোরের ভেতরে ঢুকলেন বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে। কাউন্টারে দাঁড়ানো জেনিফারকে দেখে থমকে গেলেন। থমকে গিয়ে আবার নিজেই খুব অবাক হয়ে গেলেন। আশ্চর্য! একুশ বছরের একাকী জীবনে এমনটি তো কখনও লাগেনি। মেয়েটি তার হাত থেকে ক্রেডিট কার্ডটি নিতে নিতে বলল,”যাও তেল ভরা হয়ে গেলে, এসে কার্ড নিয়ে যেও।” জাহেদ গাড়ির কাছে ফিরে গেলেন তেল ভরতে। ক্রেডিট কার্ডের সাথে তার মনটি পড়ে রইল কনভিনিয়েন্স স্টোরের ভেতর। কার্ড ফেরত নিতে এসে কাউন্টারের সামনে আবার দাঁড়াতে, দেখলেন, মেয়েটির বুকের সাদা নেম-প্লেটে কালো অক্ষরে লেখা নাম, জেনিফার। মেয়েটি জানতে চাইল, “আর কিছু চাই?”
“কি?” ঘোর লাগা গলায় জাহেদ জিগ্যেস করলেন।
“কি অদ্ভুত, তুমি কি চাও সেটা আমি জানব কি করে?” মেয়েটি হেসে দিল। জাহেদ একদৃষ্টিতে তার গালের ওপরে ওঠা নামা করতে থাকা ভাজটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু অপেক্ষা করে জেনিফার তাড়া দিল, “কি চাও তাড়াতাড়ি বল। তোমার পেছনে অন্য খদ্দের দাঁড়িয়ে রয়েছে। জাহেদের চোখ গেল মেয়েটির পেছনের শেলফে; “আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট দাও।”
“কোনটি?”
“তোমার যেটা ইচ্ছে।”
“তুমি খাবে সিগারেট, বেছে দেব আমি? কি অদ্ভুত!” মাথা নাড়াতে নাড়াতে ও এক প্যাকেট মার্লবরো লাইট সিগারেট এনে হাতে ধরিয়ে দিল।

“বাবা আপনি মেয়েটিকে নিয়ে একটা ডেটে যান।”
বাগানে গাছের গোঁড়া হাতের ছোট খুন্তিটি দিয়ে খুঁচিয়ে দিচ্ছিলেন জাহেদ। মার্লার কথাগুলো কানে আসতেই তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে ঘুরে তাকালেন। মার্লা শাহেদের স্ত্রী। এদেশি মেয়ে। নাজ আর রিমার এক্সিডেন্টের পর শাহেদ একেবারে মনমরা হয়ে গিয়েছিল। যেমন আশা করা গিয়েছিল, ইন্টারমিডিয়েটে তেমনি খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। কিন্তু, ভর্তি পরীক্ষা মন দিয়ে দিল না, কোথাও কোন ইউনিভার্সিটিতে তার চান্স হল না। কারণটা বুঝতে পেরে জাহেদও এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করলেন না। একবার শুধু বললেন, “আশেপাশের কোন কলেজেই না হয় ভর্তি হয়ে যাও, আগামী বছর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করা যাবে।” শাহেদ কোন উত্তর দেয়নি। কয়েকদিন পর সামনে এসে বলল, “বাবা আমাকে আমেরিকাতে পাঠিয়ে দাও।”
“কি ভাবে?”
“আমি মিনেসোটা স্টেটে এপ্লাই করেছিলাম। ওরা আমাকে একসেপ্ট করেছে।”
“আই টুয়েন্টি পাঠিয়েছে?”
“আই টুয়েন্টি লাগবে কেন?”
“ভিসা লাগবে না?”
‘বাবা, আমার যে ভিসা লাগবে না সেটা কি তুমি ভুলে গিয়েছ?”
তাইতো! জাহেদ সত্যি ভুলে গিয়েছিলেন। শাহেদ তো জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
বছর কুড়ি আগে শাহেদ আমেরিকাতে চলে এলো। আর দেশে ফেরা হয়নি। উল্টে বাবার রিটায়ারমেন্টের পর জোরজার করে তাকেই এদেশে নিয়ে এলো। এর ভেতর ওর সাথে মার্লার পরিচয়, প্রেম এবং বিয়ে হয়েছে।
জাহেদ অবাক হয়ে মার্লার মুখের দিকে তাকালেন। দু’মাস বয়েসের তন্বীকে কোলে নিয়ে হাসিহাসি মুখে সে বাড়ির পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে। “কোন মেয়েকে? কি বলছ এসব?”
“বাবা, আমরা আপনার এফেয়ারের কথা সব জানি।” দরজা খুলে ভেতর থেকে শাহেদ এসে দাঁড়িয়েছে, “তুমি যে জেনিফারের জন্যে রোজ শেল গ্যাস স্টেশনে দৌড়োও সেটা আমরা জানি বাবা।”
“কি করে?”
মার্লা উত্তর দিল, “বাবা আপনার ক্লোজেটের ভেতরে গাদা গাদা সিগারেটের প্যাকেট। প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। খেতে বসলে খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে যান। আমরা এই সবই দেখছি। শাহেদ তো ভীষণ উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত আমরা দু’জনে মিলে অন্যায় একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শাহেদ আপনাকে গত দু’সপ্তাহ ধরে ফলো করে করে বের করেছে আপনি রোজ সকালে কোথায় যান, কেন যান।”
“হ্যাঁ বাবা, জানি কাজটা আমি অন্যায় করেছি, তোমার প্রাইভেসী এভাবে লঙ্ঘন করার কোন অধিকার আমার নেই। কিন্তু, তোমার অবস্থা দেখে আমি খুবই টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। একরকম নিরুপায় হয়েই এটা করেছি।”
মার্লা বলে উঠল, “বাবা, অনেকদিন তো একা একা কাটালেন। সবারই সঙ্গী দরকার। আপনি যদি জেনিফারকে পছন্দ করে থাকেন, তবে তাঁকে বলেন না কেন সেটা? দরকার হলে একদিন বাইরে কোথাও ডিনারে নিয়ে যান।”
জাহেদ ওদের দুজনের দিকে আর চাইতে পারছিলেন না। মাথা নিচু করে হাত দিয়ে ফুলের কেয়ারির মাটির ঢেলা ভাঙতে ভাঙতে বললেন, “শাহেদ, মার্লা, তোমরা আমাকে ভুল বুঝছ। যে অর্থে তোমরা এফেয়ার শব্দটি ব্যবহার কর, আমি সে রকম কিছু করছি না। তোমার মা কে অসম্মান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
প্রথম থেকে গম্ভীর হয়ে ছিল শাহেদ। বাবার কথা শুনে আরও বেশি গম্ভীর হয়ে বাবার দিকে চাইল। “বাবা, আমি তোমার ছেলে হলেও তুমি আমাকে সবসময় বন্ধুর মত দেখেছ। তাছাড়া আমিও এডাল্ট। এই বয়েসে তোমার যে একা একা কষ্ট হয় সেটা আমি বুঝি। বটম লাইন হল, তোমার একজন সঙ্গী দরকার। মাকে আমিও মিস করি। তুমি যদি কাউকে পছন্দ করে থাক, তাকে তার জায়গায় রাখ, মা’র জায়গায় তাকে বসাতে হবে কেন? এখানে তাঁকে অসম্মান করার প্রশ্ন আসছে কেন?”
“তাছাড়া, আপনি যদি তার প্রতি অনুরক্ত নাই হোন, তবে কেন প্রত্যেকদিন ওখানে ছুটে যাচ্ছেন? কি চাইছেন আপনি জেনিফারের কাছে? আপনি সিগারেট খান না। তারপরও রোজ ওর কাছে ছুটে যান সিগারেট কেনার ছুতোয়।” মার্লা জানতে চাইল, “কেন বাবা?” জাহেদ মুখ উপরে তুলতে দেখলেন, শাহেদের ডান ভুরুটিও একটু উঁচু হয়ে উঠেছে, নিঃশব্দ ইশারায় সেও জানতে চাইছে, “কেন, বাবা?”
জাহেদ ফুলের কেয়ারি ছেড়ে উঠলেন। একটু এগিয়ে, পাশাপাশি দাঁড়ানো মার্লা আর শাহেদের মুখোমুখি হলেন। তারা দেখল তার হাসি হাসি মুখটিতে সন্ধ্যার অন্ধকার প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। জাহেদ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, “আপাকে মনে পড়ে শাহেদ?”
“কি বল? আপাকে কেন মনে পড়বে না? বসার ঘরে ঢুকলেই মনে হয়, ম্যান্টলে রাখা আমাদের চারজনের ছবিটা থেকে মা আর আপা সবসময় আমাকে কড়া নজরে রাখছে।”

হাতবদল করে মাটি খোঁচানোর খুন্তিটি বাম হাতে নিয়ে, ধুলো মাখা ডান হাতটি জাহেদ ছেলের ঘাড়ে রাখলেন। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না, সবাই চুপচাপ। শাহেদের মনে হল বাবার শরীরের পুরোটা ওজন ধীরে ধীরে তার ঘাড়ে নামিয়ে রাখছেন। জাহেদ অপলক তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মার্লার মনে হয়, বাবার দৃষ্টি শাহেদের চোখের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে পেছনে, বহু দূরে কোথাও কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিছু বলবে বলে মুখ খুলতে যাচ্ছিল ও, তাকে থমকে দিয়ে জাহেদ ভাঙা গলায় জানতে চাইলেন, “হাসলে তোর আপার গালে কেমন টোল পড়ত সেটা তোর মনে আছে শাহেদ?”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “এফেয়ার

  1. এফেয়ার গল্প টা ভালো লাগলো বেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *