ঝর্না রহমান
আলোকদিয়া ভ্রামণিক গ্রুপের সাম্প্রতিক ভ্রমণের আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। ভার্চুয়াল প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনীতে গ্যালারি ভাড়া, ছবি বাঁধাই, স্যুভেনির বা অন্যান্য আয়োজনের কোন খরচাপাতি নেই। তাই প্রদর্শনী চলতে পারে যতদিন মানুষ দেখবে ততদিন। প্রথমে প্রদর্শনীটি আলোকদিয়া ফেসবুক পেজেই শুরু হয়েছিল। এরপর সেখানে প্রদর্শিত একটা ছবি ভাইরাল হওয়ার পর সে ছবি পাবলিক সম্পত্তি হলো। তারপর কীভাবে প্রদর্শনীর অ্যালবামের বেশিরভাগ ছবিই পাবলিক পেজে চলে এলো। অসংখ্য লাইক, কয়েকশত কমেন্ট। অধ্যাপক আলী হোসেন মহা খুশি!
সকাল থেকে নেট ভয়াবহ স্লো। কয়েকবার চেষ্টা করেও মেসেঞ্জারে কানেক্ট করতে না পেরে আলী হোসেনকে ফোনে কল দিলেন কবি কামালুদ্দীন বিল্লাহ। কল দেওয়ার আগে ফোনের ব্যালেন্স দেখে নিলেন। একশ বিশ টাকা আছে। মিনিট ত্রিশেক কথা চালানো যাবে। মানে নিজের কথাটি বলার জন্য আলী হোসেনের কথার মধ্যে দু’তিনটা দাঁড়িকমা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
ফোন ধরেই আালী হোসেন কুলকুল খুশিভরা গলায় বললেন, বলেন, বিল্লাহ, তুমি তো ভাই কামাল কইরা ফালাইছো! তোমারে কল দিমু ভাবতাছিলাম। তবে আরও কিছু ছবি এডিট করতাছিলাম। ভাবতাছিলাম নেচারের সাথে শ্রমজীবী মানুষের রিলেশনের ছবিগুলা নিয়া একটা অ্যালবাম করবো। পদ্মাসেতু দেখতে গিয়া তুলছিলাম। খেজুর পাতার পাটি বোনার অনেকগুলা স্ন্যাপ আছে!
-থ্যাংকিউ আলী ভাই! কিন্তু কামাল কিয়া তো সামাল দেয়া যাচ্ছে না!
-দেখ ভাই, এতকাল দ্যাশবিদ্যাশের তো কম জায়গা ঘুইরা বেড়াই নাই, ছবিও তোলাতুলি হইছে কম না! আমার ব্যাংকব্যালেন্স কিছু নাই। বউ বাচ্চা নাই। বেতনের টাকার পুরাডাই খরচা করি ঘুইরা। পিএফ-এর টাকা লোন নিয়া একটা জিনিসই কিনছিলাম, সেইডা অইল একটা দামি ডিএসএলআর ক্যানন ক্যামেরা। জীবনের দশটা সেরা ভ্রমণ নিয়া ’স্বদেশ-বিদেশ-দশদেশ’ নামে সচিত্র বই লেখলাম, কিন্তু কাছের বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমার সেই ভ্রমণের কথাই তেমন কেউ জানলো না, বই তো দূর অস্ত! পয়সা দিয়া বই ছাপায়া বই খাইলো উঁইয়ে! আর এই এক ফেসবুক গ্রুপ কইরা আমাদের কথা দেখতাছি দশ দিগন্তে ছড়ায়া পড়ছে, কামাল না তো কী…..!
ফোন কাঁপিয়ে হাসেন আলী হোসেন।
কামালুদ্দীন দেখলেন, আলী হোসেনের কানে তার কথা ঢোকেনি। নিজের কথাই বলে যাচ্ছেন। ওৎ পেতে থাকেন তিনি। একটা কমা কিংবা হাইফেনও যদি পাওয়া যায়, থামিয়ে দেবেন আলী ভাইকে! এমনিতে কামালুদ্দীনের বাসার ওয়াইফাই কোম্পানিটা তেমন যুতের না। মেসেঞ্জারে কথা বলতে গেলে একটু বেশি সময় লিঙ্গার করলেই হ্যাং হয়ে যায়। হোয়াটস্যাপ বা ভাইবার হলে এই সমস্যাটা হয় না। কিন্তু আলী হোসেনের কোনটাই নেই। তিনি বলেন, আমি হচ্ছি প্রযুক্তি প্রতিবন্ধী মানুষ। এতকাল তো ইনডেক্স দেখে নম্বর ইনপুট দিয়ে ফোন করতাম। অনেক শিখেপড়ে ফেসবুক মেসেঞ্জার চালাতে শিখেছি। এইই যথেষ্ট! আর দরকার নেই।
-শোনো বিল্লাহ, একবার জাপানের হনশু দ্বীপে গিয়া এমন অ্যাঙ্গেলে মাউন্ট ফুজির ছবি তুলছিলাম…
-আলী ভাই, জাপানের ছবি পরে। আপনার মহাস্থানগড়ের ছবিটা…
-আরেহ, কথার মধ্যে কথা বলা তোমার একটা বড় দোষ! চিন্তা কর, মাউন্ট ফুজির মাথায় এক গোছা তুলা টাইপের মেঘ টাইগার লিলির মতন পাপড়ি ছড়ায়া দিয়া খাড়ায়া আছে, অগ্নির কান্ধে হাত রাইখা খাড়াইছে ভগ্নি ধলা মেঘা! দেইখা মনে হয় সাদা আগুন! ঐ ছবিটা ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশনে গেলে আমার অ্যাওয়ার্ড আটকাইতো কে?
-বাপরে! ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরির ছবি তুলেছিলেন?
-তোমার দেখার চক্ষু থাকলে অত বড় আগ্নেয়গিরিরও দরকার হয় না। তুচ্ছ জিনিসেও ইউ ক্যান ডিসকভার অ্যামাজিং সাবলিমিটি! টুকিও টাওয়ারের আগায় বইসা লুকডাউন উইন্ডো ক্যাফেতে কফি খাইলাম। টুনি পাখির বাসার মতন খিলিপাতা কফির কাপ! শুগার কিউব গোলানোর জন্য একটা ওয়ান টাইম চামুচ। কী বলবো ভাই, জাপানি মাইয়াগো মতন ছোট্টখাট্ট চকচকা সুইট চেহারার সেই শুগার স্টিক। স্টিকের আগায় সেক্সি ঠোঁটের লিপস্টিকের মত এক ফোঁটা মারাত্মক আগুনরঙা কফি! তো তুললাম ছবি।
-আপনার দেখার দৃষ্টি অসাধারণ! আপনিই তো কবি, আলী ভাই? তাই তো মহাস্থান গড়ে গিয়ে কূপের অমন একটা ছবি…
-আরে! এতকাল তো রাজা পরশুরামের জিয়ৎ কূপই ফেমাস আছিল! এইবার আমার তোলা ছবির কল্যাণে লখাই আর অর বউ বেউলার সিনানঘরের কুয়া ফেমাস অইয়া হইয়া গেছে! হা হা হা! আর জাপানের যেই ছবিগুলার কথা বলতাছিলাম, সেগুলা পাইলে তো তোমার মাথা খারাপ হইয়া যাইতো! কিয়েটো সিটিতে অগো বিখ্যাত সাগানো বাম্বু ফরেস্ট, গেছ নাকি?
-নাহ আলী ভাই! জাপানে যাইনি আজও। আর গেলেও বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাঁশঝোপ দেখতে যাবো কোন দুঃখে!
-আরে, তোমার তো সেই বাম্বু ফরেস্ট সম্বন্ধে কোনো ধারনাই নাই! সে কি যেমুন তেমুন বাঁশ! কি চকচকা! কী মসৃণ! মনে হয় বাঁশ দিয়া আসমান ঠেকা দেওয়া আছে। অরা কয় ওয়ে অব হেভেন। একদম! স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা! সারি সারি বাঁশ আর বাঁশ! আর রঙ! দেখলে মনে হয় সবুজ রেশমের ইউফরম পইরা সিপাহিরা দাঁড়ায়া আছে! সেই বাঁশবাগানের ছবি! আহ!
-সেই ছবিগুলো আপ করেন না কেন স্যার? কোথায় রেখেছেন সেসব? এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড-এ বসবাস করে এমন ভ্যালুয়্যাবল জিনিস কি ফেলে রাখতে হয়? এখন সংরক্ষণের একটাই জায়গা, তা হল নেট অ্যাকাউন্ট। গুগল অ্যাকউন্ট আছে না আপনার!
-নাহ! ঐ সব আমি বুঝিও না পারিও না।
-আমি অ্যাকাউন্ট করে দেব আপনাকে। খুব সোজা। সেখানে আপনার সব পার্সোনাল তথ্য ছবি ডকুমেন্টস সব রেখে দেবেন। যত ছবি আপনার সেই পুরোনো ডিএসএলআর ক্যামেরার মেমোরিতে রয়ে গেছে সব রেখে দিতে পারবেন।
-আরে সেই কথাই তো কই! আমার তো কপাল চাপড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নাই। আমার সেই ক্যামেরাই তো চুরি হইয়া গ্যাছে! দুই হাজার দশে একবার দিল্লীতে গেলাম। পয়সা বাঁচাইতে গ্যালাম ট্রেনে। কালকা মেইল। ট্রেন তো না, একটা চলন্ত বাজার। বাজারও না, মনে হয় একটা গাও মোচড়ামুচড়ি করা অজগর সাপ! দিল্লীর সেই ঐতিহাসিক গরম তখন। মনে হইতাছিল আসমান থেইকা তুঘলকি আগুন ঝরতাছে। আর ট্রেনের কোচের ভিতরে মানুষজনরে ঠাইসা ঢুকায়া বেক করতাছে। যাত্রীরা বোচকাবুচকি খোকাখুকু লইয়া উইঠ্যাই পরনের ল্যাঙ্গট মার্কা একটা ত্যানা রাইখ্যা বাকি সব ফড়ফড় কইরা খুইল্যা ফালায়। মহিলারা টিফিনকারি আর ট্রাভেল ব্যাগ খুইলা গামছা মামছা পাইত্যা রাবণের গুষ্টির খাওন লইয়া বসে। স্টেশনে স্টেশনে ট্রেন থামে আর মানুষ হুড়মুড়াইয়া বোতল হাতে নামে। ড্রিংকিং ওয়াটার ট্যাপ থেইকা পানি লইয়াসে। পানি তো না, পানিতে ডিম ছাইড়া দিলে দশ সেকেন্ডে ফুল বয়েল হইয়া যাইবো। তাই খায়। মাথায় দেয়। এলাহি কাণ্ড। তিরিশ ঘণ্টা সেই ভ্রমণে কমসে কম তিনশ ছবি তুলছিলাম। মার্ভেলাস একএকটা ছবি! কিন্তু সব শ্যাষ!
-কীভাবে হলো?
-বোকামি কইরা ফালাইছিলাম। ক্যামেরাডা কান্ধে ঝুলায়া স্টেশনে নামছিলাম। দিল্লী রেল স্টেশন একটা সেইরকম তুলকালাম জিনিস। নামার পর সে জায়গাটারে মনে হইল একটা টগবগ কইরা ফুটতে থাকা বাজার। আমি কার কে তোমার অবস্থা! তো স্টেশনে এক জায়গায় সিঁড়ি দিয়া নামতাছি। মনে হইলো কে জানি ধাক্কা মারলো। ভিড় সামাল দিয়া সিড়ি থেইকা নাইমা দেখি আমার কাঁধের ক্যামেরা নাই। স্ট্র্যাপ কাইট্টা নিয়া গেছে। খালি কানতে বাকি রাখছিলাম। থানাপুলিশ করছিলাম। কোনো লাভ হয় নাই। অরা দেয়ালে উৎকীর্ণ বাণী দেখাইল। আপকা মাল সামান সামাল কর রাকখো। প্লিজ কিপ ভ্যালুয়েবল থিংস ইন ইয়োর ঔন রেসপনসিবিলিটি! তো তুমি ইররেসপনসিবল হইলে আমরা কী করুম! এইডা অইল সেই সিকিউরিটিওয়ালাগো অ্যাটিচিউড!
-আর জাপানের ছবিগুলো? প্রিন্ট করেছিলেন না?
কামাল বুঝে গেছেন আলী ভাই জাপান থেকে পুরোপুরি ফিরে না এলে মহাস্থানগড়ে ঢুকবেন না।
-হ, করছিলাম তো! তহন তো ক্যামেরার খোপের ভিৎরে রিল ভইরা চাবি টাইনা টাইনা ছবি তোলা। এক রিল ত্রিশ-বত্রিশটা ছবি! আমি তহন ছোকরা। চাকরিবাকরি অয় নাই। বেকার মানুষ। জাপানে গেছি সোভান মামুর আন্ডারে। বুইঝা শুইন্যা ট্যকাপয়সা খরচ করছি। দেশে ফিরা ভালো ভালো ছবিগুলা প্রিন্ট করছিলাম। কিন্তু প্রিন্ট করা ছবিগুলোও কোথায় চইলা গেছে। সারাজীবন করলাম বদলির চাকরি। আজি এই কলেজে, কাইল ঐ কলেজে। একলা মানুষ! নিজেরে পালতেই আমার দফারফা! আবার ছবি!
-আবার কিন্তু দফা রফা হওয়ার যোগাড় হয়েছে আলী ভাই!
-কী নিয়া দফারফা? হ, কি জানি কইতাছিলা বিল্লাহ। এইবার কও! কথার মধ্যিখানে কথা বললে বিরক্ত লাগে। আমার ছাত্ররা বহুৎ বকা খাইছে! ইফ ইউ হ্যাভ এনি কোয়েশ্চেন, দেন নোট ইট ডাউন। লেট মি ফিনিশ টকিং, নাউ ইউ গো অ্যাহেড উইথ ইয়োর কোয়েশ্চেন অর কোয়্যারি অর সামথিং এলস…
-আপনার যে ছবিটা ভাইরাল হয়েছে, অন্ধকূপ, সেটা নিয়ে কেল্লা ফতেওয়ালারা হেভি খেপেছে! নেকবখত হেকমত জিয়াফৎ কমবখত সব ওয়েবসাইট এককাট্টা হয়েছে। আমরা নাকি ধর্মের অবমাননা করেছি! পর্দানশীন নারীজাতির অপমান করেছি! ওরা রাস্তায় নামবে। রাস্তায় রাস্তায় কুয়ো খুঁড়ে তার ভেতরে কালো পতাকা নিয়ে মেয়েদের দাঁড় করিয়ে রাখবে!
-কালো পতাকার দরকার আছে? আমার ছবিতেই তো দেখা যাইতেছে, কূপের ভিতরে দন্ডায়মান বিজয়িনী কালোপতাকাগণ! উহাদের কৃষ্ণদস্তানা আচ্ছাদিত উত্তোলিত হাতের মুদ্রায় ভি চিহ্ন! হয়তো মুখেও ছিল বিজয়ের হাসি! কিন্তু কালো মেঘা উহাদের মুখমন্ডল আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে! কালো অন্ধকারে নিজেরে মুড়াইয়া লইয়া অন্ধকূপে অবস্থান নিতে সমর্থ হইছে বইলা তারা বিজয় চিহ্ন দেখাইতাছে। কী সর্বনাশা মেসেজ, দেখছ? মহিলাদের কাণ্ড দেখে তো আমি ক্যামেরায় ক্লিক করতেই ভুলে যাচ্ছিলাম!
-কিন্তু ওটা তো প্রত্নকূপ আলী ভাই? ওরা এখন যদি এই সামান্য ঘটনাকে পূঁজি করে রাস্তায় নামে! সত্যি সত্যি কুয়ো খোঁড়ে?
-কুয়ার ব্যাঙগুলার মাথায় এর চায়া ক্রিয়েটিভ কোনো প্ল্যান আসবো নাকি? যত্তসব। লেট দেম ডিগ থাউজ্যান্ড অব ওয়েলস। দেশে কি সরকার নাই? চাইলো আর রাস্তার মইধ্যে গর্ত খুড়লো? সরকার কি ওই কূয়াতে ব্যাঙের পোনা চাষ করবো?
-কিন্তু ওরা পারে আলী ভাই! সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের ইমোশন এক্সপ্লয়েট করার জন্য ওদের কাছে থাকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্ল্যান। রাস্তা আটকানোর জন্য প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে যাওয়া, বাচ্চাদের এনে লাইন করে সামনে রেহেল খুলে বসিয়ে দেওয়া আরও কত কী! আর গভর্নমেন্ট যদি মনে করে ব্যাঙের পোনা বেচে ভোট কেনা যাবে তবে তো চাষ করবেই!
-কিন্তু আমরা তো কিছুই বলিনি! শুধু ছবিটার একটা ক্যাপশন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি! দৃশ্য তো রচনা করেছে অন্যে! আর যাদের ছবি তুলেছি তাদের তো চিনিও না!
-ঐ ক্যাপশনটাই একটা বারুদ আলী ভাই! আপনি কাঠির মুখে বারুদ লাাগিয়ে বাতাসে ছেড়েছেন। জনতা তাতে আগুন দিয়েছে। ওই ছবির ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে একটা অন্ধকার যুগমানস।
-হুম! একটা ভয়াবহ ব্ল্যাকহোলের প্রতীক ওই কূপ! যেখানে মেয়েরা স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিতে নেমে পড়ে আর সেটাকেই মনে করে বিজয়!
বছর দেড়েক আগে কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ ’আলোকদিয়া’ গ্রুপটি গঠন করেন। আগে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে যে-সব দেশ বা জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন তার অভিজ্ঞতাই তাঁরা ফেসবুকে আর ইউটিউবে শেয়ার করতেন। নানারকম মন্তব্য বক্তব্য তথ্য ছবির মধ্য দিয়ে কিছুদিনের মধ্যে এঁদের কয়েকজন একটি ফ্রেন্ড-সার্কেলে পরিণত হন। পরে কবি কামালুদ্দীন বিল্লাহর আগ্রহে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলা হয়। অধ্যাপক আলী হোসেন প্রধান এডমিন আর কামালুদ্দীন সহ এডমিন। আলোকদিয়া নামকরণ করেন আলী হোসেন, তাঁর গ্রামের নামানুসারে।
কামালুদ্দীন বিল্লাহ ফেসবুকে খুব সক্রিয়। সারাক্ষণ তিনি লেখার মধ্যে থাকতে পারেন। এক-একজনের পোস্টে দীর্ঘ মন্তব্য করা, নিজের সংগ্রহের ছবি তথ্য ইত্যাদি মিলিয়ে চমৎকার সব পোস্ট দেওয়াতে কামালুদ্দীনের কোনো ক্লান্তি নেই। পোস্টগুলোতে অন্যদের মন্তব্য কামালুদ্দীন খুব আগ্রহসহকারে ফলো করেন। প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানান কিংবা প্রতিমন্তব্য করেন। সৃজনশীল আর গঠনমূলক মন্তব্যকারী খুব বেশি একটা থাকে না। বেশিরভাগই, দারুণ ছবি, এটা কোথায়? বাহ, চমৎকার, এইসব দায়সারা মন্তব্য নয়তো স্টিকার কমেন্ট। এরই মধ্যে একজনকে পাওয়া যায়, যিনি মনোযোগ দিয়ে ভ্রমণের পোস্টগুলো পড়েন আর সেখানে বুদ্ধিদীপ্ত তথ্যপূর্ণ গঠনমূলক মন্তব্য করেন। তিনি আলী হোসেন। কামালুদ্দীন আলী হোসেনের প্রোফাইল পোক করেন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপক। সত্তরের কাছাকাছি বয়সের বিরলকেশ হাসিখুশি চেহারার একজন মানুষ। নিজের প্রোফাইল পিকচারের ক্যাপশন দিয়েছেন, চাল নেই চুলও নেই! বন্ধুত্ব হতে দেরি হল না। সহজসরল মানুষ। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। গ্রামের নাম আলদি। যা মূলত আলোকদিয়ার লৌকিক উচ্চারণ। বেশিক্ষণ প্রমিত বাংলায় কথা চালাতে পারেন না আলী হোসেন। বিক্রমপুইরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাতেই তাঁর আনন্দ। কিন্তু তাঁর কথার ভেতর লুকিয়ে থাকে মেধা আর জ্ঞানের দ্যুতি। আলী হোসেন চিরকুমার। ঢাকায় কাঁটাবনে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সারাজীবন চাকরি করে ভ্রমণের বাতিকে টাকাপয়সা কিছুই হাতে রাখতে পারেননি তিনি। সরল সাদামাটা জীবনযাপন করেন। তবে একটাই দোষ, প্রচুর কথা বলেন। কামালুদ্দীনের খুব ভালো লেগে যায় টেকো অধ্যাপক আলী হোসেনকে। পেশাগত জীবনে তিনি দেশের ইতিহাসখ্যাত জায়গাগুলো ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিদেশেও গিয়েছেন কয়েকবার। ভেবেছিলেন রিটায়ারের পরে একটু গুছিয়ে বসে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু করোনার দুঃসময়ে ভ্রমণ তো দূরের কথা, ঘর হইতে আঙিনাই বিদেশ হয়ে পড়লো। তবে ফেসবুক গ্রুপটি খোলার পর ভ্রমণের অন্য এক দিগন্ত খুলে গেল। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ছবিসহ ভ্রমণের গল্প বা ধারাবাহিক কাহিনী লিখছে। অজস্র মন্তব্য প্রতি-মন্তব্যে ভরে উঠছে কমেন্ট বক্স। সেসবের কোন কোনটি নিয়ে জমে উঠছে তর্কবিতর্ক কিংবা ভিন্ন কোনো গল্প। গ্রুপে সদস্যসংখ্যার সাথে প্রতিদিন রিকোয়েস্টের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে।
আলী হোসেন কামালুদ্দীনের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ। কামালুদ্দীনই তাকে এই ভার্চুয়াল ভুবনের সন্ধান দিয়েছেন। গ্রুপ খোলার পর তাদের বাস্তবিক ভ্রমণ সম্পন্ন না হলেও ভার্চুয়াল ভুবন ভ্রমণ চলছে। নিয়ম করে চলছে ভ্রমণবিষয়ক লাইভ। এসব লাইভে নিজেদের বলয়ের বাইরে থেকেও বিশিষ্ট ভ্রমণকারীদের অতিথি হিসেব আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, তাঁদের অভিজ্ঞতা শোনা হচ্ছে, ভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই ভ্রামণিক গ্রুপ ‘আলোকদিয়া’ রীতিমত বিখ্যাত হয়ে উঠলো।
দু’হাজার একুশের জানুয়ারির দিকে করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর দেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। করোনার ভ্যাকসিনও চলে এলো দেশে। ফরটি আপ মধ্যবয়স্ক থেকে শুরু করে বুড়োরা সব ভ্যাকসিন নিয়েও নিলেন। ধুমসে চলতে লাগলো সব কিছু। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কিছু খুলে গেল। সবচেয়ে বেশি শুরু হল বিয়ে আর ভ্রমণ। সবাই যেন একবছর থমকে থাকা সব আয়োজন আর ঘোরাঘুরি একসাথে সেরে ফেলতে তৈরি হয়ে গেল। এই জোয়ারে গা ভাসিয়ে আলোকদিয়া গ্রুপের নির্বাহী কমিটির কয়েকজনও বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘুরতে। আই স্পেশালিস্ট দিলোয়ার জাহাঙ্গীর এবং তাঁর এগারো সিটের নোয়া গাড়ির চালক মজনু মিয়া, সস্ত্রীক কামালুদ্দীন, থিয়েটার গ্রুপের পল্লবী সেন আর অধ্যাপক আলী হোসেন মিলে দুদিনের ভ্রমণ। বগুড়া শহরে পল্লবী সেনের ঠাকুর্দা নিখিলেশ সেনের বাড়ি সেনসদনে নাইট হল্ট করে পরের দিন মহাস্থানগড় দেখেটেখে ঢাকায় ফেরা। মহাস্থানগড়ে আগেও আরও কয়েকবার গিয়েছেন আলী হোসেন। কিন্তু সেনসদনটা দেখার লোভটা বেশ তীব্র ছিলো। পল্লবীর দাবী, তার ঠাকুর্দা সুদূর অতীতের পুন্ড্রনগরীর শাসক সেনরাজাদের সহস্রাব্দ উত্তরপুরুষের একজন। এ ছাড়া মহাস্থানগড়ের মত ইতিহাসখ্যাত জায়গা বারবার দেখতে অধ্যাপক আলী হোসেনের কোন ক্লান্তি নেই।
সেই ভ্রমণে আড়াইশ বছরের প্রাচীন সেনসদন সত্যিই একটা দর্শনীয় স্পট ছিলো! বাড়ির ভেতরে ভাঙা মন্দিরের জঙ্গলাকীর্ণ চূড়ো, ভেতরের ছাদে এখনও থেকে-যাওয়া অসাধারণ অলংকরণের টুকরোটাকরা, বড় বড় থাম আর খিলানগাঁথা চওড়া বারান্দা, লাল টুকটুকে সিমেন্ট বাঁধানো ঘোরানো সিঁড়ি, বিশাল দীঘির জলে এখনও ডুবে-থাকা শানবাঁধানো ঘাট, এসব দেখতে দেখতে সবার ক্যামেরা ভরে উঠেছিল ছবিতে। উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে ডঃ দিলোয়ার পল্লবীকে বলতে থাকেন, আমাদেরকে এখানে আরও আগে নিয়ে আসা দরকার ছিলো। পল্লবীও প্রগলভ হয়ে উঠেছিলেন, মাথা ঠিক আছে দিলোয়ার ভাই? আমাদের পরিচয় কত দিনের? ফেসবুকের আগে কি আমরা আমাদের ফেসটুকুও চিনতাম?
পরেরদিনের শিডিউল ছিল মহাস্থানগড়ে। মহস্থানগড়ের বিশাল এরিয়া। কোন জায়গা থেকে আগে শুরু করবেন ঠিক করে না নিলে অনেক বেশি হাঁটতে হবে। মহাস্থানগড় বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিমে মাহিসওয়ারের মাজার শরীফ। প্রথমে সেটাই টার্গেট করা হল। হযরত শাহ সুলতান বলখীর মাজার, যিনি ছিলেন বল্লখ রাজ্যের রাজপুত্র, ১৪শ শতাব্দীতে ইসলামপ্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন। ধর্মপ্রচারকদের নিয়ে নানা অলৌকিক কল্পকাহিনী থাকে। এই বলখী হুজুর এসেছিলেন মাছ আকৃতির নৌকায় চড়ে। কালক্রমে ভক্তদের মুখে মুখে মৎস্যনকশার নৌকা হয়ে গেল সত্যিকারের মাছ। মাছের পিঠে চড়ে এলেন তিনি! নামও হল মাহী সওয়ার। মাহী সওয়ারের মাজার এখন শ্বেতপাথরে মোড়ানো বড় কমপ্লেক্স। সংস্কারের নামে প্রত্নস্থাপনাকে আধুনিক সাজে সাজিয়ে তোলা আমাদের দেশের প্রত্নজ্ঞানীদের কৃতিত্ব!
আলী হোসেন দলবল নিয়ে বের হয়ে আসেন। আরও অনেক কিছু দেখার আছে। করতোয়া নদীর তীরে রাজা পরশুরামের বোন শীলাদেবীর নামে আছে শীলাদেবীর ঘাট, চলো সেখানে! কিন্তু কামালুদ্দীনের স্ত্রী নাসরিন আগে দেখবেন জিয়ৎ কুন্ড। দারুণ ইন্টারেস্টিং এর ইতিহাস! হজরত বলখীর সাথে রাজা পরশুরামের যুদ্ধে অনেক সৈন্য আহত হয়। তখন জিয়ৎকুন্ডের পানি পান করিয়ে আহত সৈন্যদের সুস্থ করে তোলা হত। আর এ কথা জানতে পেরে বলখী চিলের মুখে এক টুকরো গরুর মাংস পাঠিয়ে কূপের পানিতে ফেলে দেন। তাতে কূপ অলৌকিক ক্ষমতা হারায়। এ সবই গল্প। কিংবদন্তি। ইতিহাসের সত্যতা নেই। কিন্তু মিথগুলো দিয়ে একটা সময় ও পরিবেশের জনমানসের পরিচয় পাওয়া যায়।
নাসরিন বলেন, আলী স্যার না এলে আমাদের ভ্রমণটা হত শুধু ঘুরে বেড়ানো, চক্ষু মেলিয়া দেখা হত না। একে একে মহাস্থানগড় জাদুঘর, গোবিন্দ ভিটা, পরশুরামের প্রাসাদ, দেখা শেষ করে ওরা চলে এসেছিলেন গোকূল মেধ বা বেহুলার বাসরঘর স্থাপনায়।
একশো বাহাত্তর কক্ষবিশিষ্ট গোকূল মেধ। অসাধারণ এক স্থাপনা! ঘাসেঢাকা ভগ্ন দেয়ালের ছকের ভেতরে দেড় হাজার বছরের পুরোনো বৌদ্ধবিহারের কক্ষগুলোর ছবি তুলতে তুলতে ওঁরা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন কোন ঘরে বেহুলা লখিন্দরের বাসর হয়েছিল!
-আলী হোসেন হাসতে হাসতে বলেন, তোমরা যারা বাসরঘর দেইখা আসছো তারা এত বাসরঘরের জন্য থার্স্টি কেন বুঝলাম না?
বেড়াতে এসে সবাই প্রগলভ হয়ে ওঠে। বলে, আপনার জন্য খুঁজছি স্যার। এবার যদি আপনার কুমার-জীবনের ইতি হয়!
ঘুরতে ঘুরতে ওঁরা পেয়ে গিয়েছিলেন বেহুলা লখিন্দরের বাসর যাপনের পর শুদ্ধস্নানের আগার। চব্বিশ কোণবিশিষ্ট এক অনুপম স্নানাগার। এখন সংস্কার করে সুন্দর ইঁট দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। ওপর থেকে দেখা যায়, মাঝখানে একটা স্বল্পগভীর বাঁধানো কুয়ো। প্রততত্ত্ব অধিদপ্তরের ইতিহাস-লিপিতে লেখা ঐ কুয়োর গভীরতা আট ফুট। তার মানে ওটা কূপ আকৃতির একটা জলাধার। ঐ কুয়োতে নাকি বেহুলা লখিন্দর তাদের মধুনিশি যাপনের পর স্নান করে শুদ্ধ হতেন।
আলী হোসেন ইতিহাস আওড়াতে থাকেন, বেহুলার গল্প সেন জমানার অনেক আগের। ঐ স্তূপ হলো ৮ম থেকে ৯ম শতকের মধ্যে দেবপাল নির্মিত একটা বৌদ্ধমঠ। মানুষের কল্পনা আর অলৌকিক ঘটনার প্রতি অসীম আকর্ষণ এসব গল্পের জন্ম দেয়। রাজবাড়ি বা যেসব জায়গায় সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেসব জায়গাকে ঘিরে মানুষের কৌতূহল থাকে অনেক। ধীরে ধীরে সামান্য সূত্র ধরে তারা গল্পকাহিনী বানিয়ে ফেলে। এখানে কালিদহ সাগর নামে নদীও আছে! বেহুলার গল্পে এই নদীও একটা চরিত্র হয়ে আসে। তবে গল্প যাই হোক, বেহুলা কিন্তু মহা সাহসী নারী ছিলেন। অধিকার সচেতনও। সাপেকাটা স্বামীকে নিয়ে কলার মান্দাসে চড়ে একলা দেবলোকের উদ্দেশে রওনা করলেন! কোনো ভয়ডর নেই! মাত্রই বিয়ে হয়েছে তাদের। বাসর রাতেই কুপিতা মনসা সাপ পাঠিয়ে স্বামীর জান কবজা করে নেবে, তা হবে না! ইন্দ্র নাচগানপিয়াসী দেবতা। তো নাও নাচগান! এমন নাচ নাচবে বেহুলা যে ইন্দ্রদেবকে বশ হতে হবে, ফিরিয়ে দিতে হবে স্বামীর প্রাণ!
কামালুদ্দীন স্ত্রীর গায়ে সোহাগের ঠেলা দিয়ে বলেছিলেন, স্যারের কথাগুলো ভালো করে শুনছো তো!
গড়ের বিশাল এলাকা ঘুরে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন এক-একজন। স্নানকূপের ছবিটবি তোলা হয়ে গেলে সবাই ওপরে উঠে একটু দূরে গাছের ছায়ায় পা ছড়িয়ে বসেছিলেন। আলী হোসেন স্নানাগারের এক কোণে বাঁধানো চাতালে বসে থাকেন। ওদের বলেন, তোমরা যাও। আমি একটু ধুমপান করি। আর দেখি ধুমা-ঠুমা দেইখা কোনো বেহুলা আসে নাকি! আসতে তো পারেই! বলবে, নিশ্চই গোসলখানায় কোথাও ছিদ্র আছে। ধুয়া বাহির হইতেছে। ওইখান দিয়া মনসার সর্পছানাপোনা ঢুকবো!
সিগ্রেটে সুখটান দিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন আলী হোসেন। একটা কোলাহলে তাঁর ধ্যান ভেঙেছিল। মেয়েদের একটা দল এসে নেমেছে স্নানাগারে। ওদের একজনের হাতে মোবাইল ফোন। ছবি তুলছে। আর সাতআটজন নারী গিয়ে নেমেছে কূপটিতে। তাদের প্রত্যেকের দেহে কালো আচ্ছাদন। আপাদমস্তক কালো রেশমে মোড়া নারীদের কে কোন বয়সী বোঝার উপায় নেই। কিন্তু তারা সমস্বরে কোলাহল করছে! কূপে নামতে পেরে যেন তারা হিমালয়ের শৃঙ্গ জয় করে ফেলেছে!
আলী হোসেন অবাক বিস্ময়ে দেখেন, তারা সবাই কূপের ভেতরে দাঁড়িয়ে দস্তানাঢাকা হাত উঠিয়ে আঙুলে বিজয় চিহ্ন ভি-এর মুদ্রা তুলে পোজ দিয়ে আছে। মোবাইল ক্যামেরা হাতে মেয়েটি নানা অ্যাঙ্গেল থেকে তাদের ছবি তুলে যাচ্ছে!
আলী হোসেন ওদের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না। এই ছবি দিয়ে কী করবে ওরা? কারো চেহারার একটা চিকন ফালিও তো দেখা যাচ্ছে না!
হঠাৎ মোবাইল ফোন-হাতে মেয়েটি এসে আলী হোসেনকে বলে, আমাদের একটা ছবি তুলে দেবেন আঙ্কেল?
চঞ্চল মেয়েটি অনুমতির অপেক্ষা না করেই আলী হোসেনের হাতে ফোনটি তুলে দিয়ে কূপের ভেতরে নেমে পড়ে। তখন ওদের ভেতরে আর একটা উল্লাসের চিৎকার ধ্বনিত হয়। আলী হোসেন ওদের ছবি তুলে নিজের ক্যামেরায়ও কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়েছিলেন।
মহাস্থানগড় থেকে ফিরে প্রদর্শনীর জন্য একশ পঞ্চশটি ছবি বাছাই করে পাঁচটি অ্যালবামে সাজিয়েছিলেন। প্রতিটি ছবির একটা সিগনিফিকেন্ট ক্যাপশন, সাথে প্রয়োজনীয় তথ্য, ইতিহাস, আলোকচিত্রীর নাম ইত্যাদি। প্রথম অ্যালবামেই রাখেন ছবিটি। ক্যাপশন অন্ধকূপ!
তিনদিনের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায় ’অন্ধকূপ’ ছবিটি! কৃষ্ণ অন্ধত্বে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ মুড়ে নিয়ে অন্ধকার কূপের গর্ভে প্রবেশ করে বিজয় প্রদর্শন করছে কয়েকজন নারী! যে দেশের মেয়েদের শতাব্দীকাল আগে অবরুদ্ধতার অন্ধকার থেকে বের করে এনে আলোর মুখ দেখিয়েছিলেন রোকেয়া, সেই দেশের নারী! এ কেমন বিজয়? কেমন করে ললনাগণ এমন কূপপিয়াসী হয়ে উঠলেন? মেয়েদেরকে কারা এই কৃষ্ণবিবরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে! ওদের মস্তিষ্কের ভেতরে এ কোন ভয়াবহ ডিটারজেন্ট ঢুকানো হচ্ছে! অজস্র মন্তব্য!
কিন্তু দুদিন পরেই সচেতন মন্তব্যগুলোকে কেউ কেউ অজস্র অশ্রাব্য গালাগালে ভরিয়ে দিতে থাকে। জঘন্য ভাষায় চলতে থাকে আক্রমণ প্রতি আক্রমণ আর ক্রুদ্ধ তর্কবিতর্ক।
-কমবখত গোষ্ঠির তো বেশি বাড় বেড়েছে। চিটাগাং রোডে কী ম্যাসাকার করেছে দেখেছেন আলী ভাই?
-ম্যাসাকার তো করবেই! এ আর নতুন কি বিল্লাহ! ওদের এক হাতে বেহেশত, আর এক হাতে দোজখ। আগুন-ফাগুন, বাণী-পানি সবই ওদের আছে! সে সব নিয়ে নামলে কেউ বাধা দিতে আসবে না, ওরা জানে।
-কিন্তু স্যার, গভর্নমেন্ট করেটা কী! মুখে বুড়ো আঙুল গুঁজে চুপচাপ খালি দেখে!
-বুড়ো আঙুল গুঁজবে কেন। ফিডারে দুদু ভরে চেঁচান্তি পোলাদের ঠান্ডা রাখবে! বুকভরা মায়ার পরান না!
-আচ্ছা এখন কী করবেন আলী ভাই? কেল্লা ফতে তো অন্ধকূপ ছবিটাকে সাবজেক্ট করে বিশাল বয়ান ছেড়েছে! হেডিং করেছে, পবিত্র নারীজাতি অবমাননাকারী কামুক ক্যামেরা ধ্বংস হোক!
-তাই নাকি? আমি তো দেখিনি! নেট খুব ঝামেলা করছে আমার এখানে। এখন অবশ্য ঠিক আছে! পাঠাও তো দেখি।
কামালুদ্দীন ফোনে সেভ করে রাখা টেক্সটটা আলী হোসেনকে সেন্ড করেন।
আলী হোসেন বয়ান পড়ে হা হা করে হাসেন।
-দেখো, ললনাকূল নাকি বেহুলার মত পতিব্রতা নারী হওয়ার জন্য ঐ কুয়োয় নেমেছিল! এই শুকনো কুয়ো নাকি পুণ্যময়ীদের পদাঘাতে এক সময় পানিতে ভরে উঠবে! আরে ভাই কামাল, আমরা তো এটাও কামাল করে ফেললাম! একদিন হয়তো বেহুলা লখিন্দরের জলাধারের নাম পাল্টে গিয়ে পুণ্যতোয়া কূয়া নামে নতুন মিথ গড়ে উঠবে! কারণ গল্প এগুবে এই ছবিটি কেন্দ্র করে, এই মুর্খদের বাহাস জড়িয়ে, এই জ্ঞানপাপীদের মাসায়েল আর অন্ধ কূপমন্ডুক ধ্যানধারনা নিয়ে। কিন্তু এ মিথ তৈরি হোক, এ তো চাই না! একে থামাতে হবে!
-একটা কাউন্টার পোস্ট কি দেবেন?
-অবশ্যই দেবো! বুঝতে পারিনি ছবিটা নিশিপক্ষিদের বাসায় এমন ঝাঁকুনি দেবে! আমি লিখবো! যেখানে থাকবে লক্ষ্মীবাঈ, সুলতান রাজিয়া, বেহুলা, রোকেয়া, প্রিয়ভাষিণী, মালালা, বিশ্বের আত্মজয়ী নারীদের কথা। টকপিয়াসী লোলুপ নোলাবাজদের ‘টক’ মানে কথাগুলোকে একবার না বারবার ডিফেন্ড করতে হবে!
পরের সপ্তাহেই অধ্যাপক আলী হোসেনের লেখাটি একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়। একটি দুর্দান্ত ইলাস্ট্রেশনও করা হয়েছে। একজন দৃষ্টিহীন মা তার ছোট শিশুটিকে নিয়ে একটি অন্ধকার খাদের দিকে হাঁটছেন। সেই খাদ হলো লকলকে জিভ দোলানো বয়ানকারীর বিশাল হাঁ! আলী হোসেনের টাইমলাইনে লেখাটির লিংক দেওয়া হয়। অভিনন্দন আর প্রশংসার বন্যায় ভেসে যেতে থাকেন। এই পশ্চাদ্ধাবমান সময়ে এ ধরনের লেখার খুব প্রয়োজন! অসংখ্য ফোন রিসিভ করেন। জানা-অজানা বহু নম্বর থেকে কল আসে। ভার্চুয়াল ইন্টারভিউও হয়ে গেল কয়েকটা সংগঠন থেকে। সেসবের বেশিরভাগেরই ওয়ার্লড ওয়াইড লিংক রয়েছে।
এর মধ্যে একটি সংগঠনের আমন্ত্রণ পেলেন আলী হোসেন, তাদের রেডিও-স্টুডিওতে উপস্থিত হয়ে দুটো কথা বলার জন্য। কদিন ধরে রাষ্ট্রীয় বিশেষ আয়োজনে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের আগমন উপলক্ষে নিরাপত্তাজনিত কারণে সরকার ফেসবুকের সার্ভার ডাউন করে রেখেছে। ফেসবুক লাইভগুলো করা যাচ্ছে না। এই সংগঠনটি তাই তাঁর কথা স্টুডিওতে রেকর্ড করার পরিকল্পনা করেছে। তাদের রেকর্ডেড ইন্টারভিউ নাকি বিশ্বের দশটা ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করা হয়। আলী হোসেনের বক্তব্য একটি বৈশ্বিক পরিচিতিও পাবে!
তাহলে তো ভালোই! পরদিন বিকেল চারটায় শিডিউল পেলেন অধ্যাপক আলী হোসেন।
সাক্ষাৎকারের রেকর্ডিংটি শেষ পর্যন্ত কোনো রেডিও ওয়েভ স্টুডিওতে হয় কি না জানা যায় না।
দুদিন পর, সাংবাদিকদের ক্যামেরায় আটষট্টি বৎসরের বৃদ্ধ আলী হোসেনের থেঁতলানো মাথাসহ দেহের অর্ধাংশের ছবি পাওয়া গেল শহর থেকে দূরে, বনের ধারে নির্জন রাস্তায় খুঁড়ে-রাখা একটি গর্তে। তাঁর দেহের বাকি অংশ পুঁতে রাখা হয়েছিল! অনতিদূরে পড়ে-থাকা একটি চিরকুটে লেখা ছিল, অন্ধকূপের পাহারাদার।
মৃত্যুর আগে হয়তো আলী হোসেন নিশ্চিত জেনে গিয়েছিলেন কে বা কারা ছিলো অন্ধকূপের পাহারাদার!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন