short-story-anuprerona

অনুপ্রেরণা
সাবিনা ইয়াসমিন রিংকু


হারাধনবাবুকে কাগজ-কলম নিয়ে বসতে দেখেই অনিমাদেবী বুঝে গেলেন লোকটা এখন কবিতা লিখবে। ঢং! সারাজীবন কেরানিগিরি করে এখন ঘাটে যাওয়ার সময় কবি হওয়ার সাধ জেগেছে। বিয়ের পর থেকে হাড়মাস জ্বালিয়ে খেয়েছে লোকটা। ছেলেমেয়ে দুটোকে বলতে গেলে অনিমাই বড় করে তুলেছে। সংসারে শুধু ক’টা টাকা ফেলে দিয়ে লোকটা কর্তব্য পালন করেছে। ছেলের খিঁচুনি, মেয়ের হাঁপানি – – কোনও কিছুর খবর নেয়নি। সংসারের অতিথি যেন! অথচ উদাসীনও নয়। রান্না একটু এধার ওধার হলেই হুলুস্থূল বাঁধাত। শীতকালে স্নানের গরমজল। খুব গরম হলে চলবে না। আবার সহজে হাত ডোবানো যাবে তেমন হালকা গরম হলে সে জল ক্যানসেল। এমন হিসেবি আর কুচুটে লোক কী করে কবিতা লিখবে ভেবে পান না অনিমাদেবী।

হারাধনবাবু ভাবেন অনিমা কী করে বুঝবে তার প্রতিভা? সংসারের বাইরে চোখ তুলে কোনোদিন তাকিয়েছে নাকি! বিয়ের পরে প্রথমদিকে পূর্ণিমার রাতগুলোতে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল দিব্যি। অথচ হারাধনবাবুর থরথর আবেগ চাঁদের আলোতে পাক খেয়ে কীভাবে মুখুজ্জেদের পাঁচিলে গিয়ে আছাড় খেয়েছে টের পেয়েছে কখনও !

তখন মোবাইলে খুটুর খুটুর ক’রে টাইপ করার কথা ভাবা স্বপ্ন। আবেগ স্থায়ীভাবে ধরে রাখার একটাই উপায়। কাগজ কলম। একটা রুলটানা খাতা অফিস থেকে এনেছিলেন হারাধনবাবু। অর্ধেক খাতা ভরাতে পারেননি অনুপ্রেরণার অভাবে। পূর্ণিমা, কালবৈশাখী, কোকিলের কুহুকুহু, দীঘার সমুদ্র, শিলংয়ের পাইনবন…… কেউই হারাধনবাবুকে দশটা লাইন লেখাতে পারেনি। দ্বিতীয় পংক্তিতে এসেই বিশ্রীভাবে আটকে যেত।

সেদিন সীমাদের বাড়িতে আসা নতুন পেয়িংগেষ্টকে দেখে ভাবের উৎসমুখ খুলে গিয়েছে হারাধনবাবুর। যদিও মেয়েটি তাকে প্রথম দেখায় দাদু বলে ডেকেছে।

শুনে হতাশ হয়েছেন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। নাতনির বয়সী মেয়ে দাদু ডেকেছে, বেশ করেছে। তবুও মন ভালো লাগায় ভরে গিয়েছে। অনেকদিন বাদে এরকমটা হল। আগেরবার হয়েছিল অফিসে তিলোত্তমা বলে মেয়েটি যখন জয়েন করল, তখন। মেয়েটি অফিসে ঢুকলেই বা কোনো দরকারে তাঁর কাছে এলেই বুকের মধ্যে ড্রাম বাজত। ড্রাম তিনি ইচ্ছে করে বাজাতেন না। অটোমেটিক্যালি বেজে উঠত। তিনি ভয় পেতেন। হার্ট এ্যাটাক না হয়ে যায়! ঘামটাম মুছে অনেকটা জল খাওয়ার পর ধাতস্থ হতেন। অথচ অনিমাকে যখন তিনি বিয়ে করেছিলেন, কী সুন্দরী যে ছিল! এমন বউ ভাগ্যের জন্য বন্ধুরা তাঁকে রীতিমত হিংসে করত। বউয়ের চাঁদপানা মুখের দিকে তাকিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন হারাধনবাবু। কিন্তু একটা পংক্তিরও জন্ম দিতে পারেননি। এই বয়সে এসে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে হারাধনবাবুর কাছে। তা হল, বউ পাঁচমিনিটে গরম ভাত, ডাল, ডিমভাজা রেডি করে দিতে পারলেও ইন্সপিরিশেন হতে পারে না।

সে যাইহোক, অরূপ পালকে নিয়ে একটু ধন্দে আছেন হারাধন বাবু। বেশ ভাবাচ্ছে তাঁকে। তাঁর থেকে বয়স কিছুটা কম। এই বছরেই রিটায়ার করবে। পাড়ায় নতুন পেয়িংগেষ্ট আসার পরে ওর আচরণ বড় সন্দেহজনক ঠেকছে। যে মানুষ জীবনে সাইকেল পর্যন্ত চালায়নি, সে রোজ ভোরবেলা রাস্তার ওপারে বাচ্চাদের খেলার পার্কে জগিং করা ধরেছে! আর অল্পবয়সী ছেলেপিলেদের কথা না বলাই ভালো! কী যে হ্যাংলামো করছে! সেই দলে হারাধন বাবুর নাতিও আছে। হারাধনবাবু বুঝে গেছেন এই প্রজন্মের ভালো কিছু হওয়া মুশকিল।

সুন্দরী পেয়িংগেষ্টটির জন্য বেহালার এই মদনমোহনতলায় অকালবসন্ত নেমে এসেছে। অনেকদিন পর মদনদেব এই পাড়াটির প্রতি কৃপা করেছেন। ঝিমিয়ে থাকা পাড়া চনমনিয়ে উঠেছে। বুড়োরাও বসে যাওয়া গাল জিভ দিয়ে ফুলিয়ে আয়নায় নিজেকে মেপে নিচ্ছে। অবশ্য পাড়ার মেয়ে বউদের অস্বস্তি বেড়ে গিয়েছে খুব।

সীমা দোতলাটা মেস বানিয়েছে। দুটো ঘরে মোট চারজন থাকে। দু’বেলা খাওয়া দেয়। সকালের চা-টা সীমার তরফ থেকে থাকে। শুধু টিফিনটা নিজেদের জোগাড় করে নিতে হয়। স্বামীহারা সীমার সংসার চলে এই মেস ভাড়া দিয়েই। চাকুরীরতা মেয়েরাই সেখানে থাকে। বেহালা আর আগের মত নেই। এখন প্রচুর যানবাহনের সুবিধা। যেখানে ইচ্ছে সহজে যাওয়া যায়।

মফস্বল থেকে অনেক মেয়ে কলকাতায় চাকরি করতে এসে কর্মস্থলের কাছাকাছি একটা নিরাপদ আস্তানা খোঁজে। সেদিক থেকে সীমার বাড়িটা ভীষণ নিরাপদ। খাওয়া দাওয়া ভালো দেয়। তবে ইউনিভার্সিটির মেয়ে এই প্রথম এল। মেয়েটির নাম তিতলি। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। পাহাড়ি ঝর্নার মত উচ্ছ্বল। চমৎকার ব্যবহার। অথচ ভীষণ গায়ে পড়া নয়। যাদবপুরে ভর্তি হয়েছে। হোস্টেল না পাওয়া পর্যন্ত মদনমোহনতলাই হল তার ঠিকানা। বাড়ি মেদিনীপুরে।

হারাধনবাবু এখন বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন। চাকরি করতেন যখন, তখন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হতো। অফিস ছিল নৈহাটিতে। প্রথমে শেয়ালদা, তারপর রানাঘাট বা কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে অফিস যাওয়া। অবসরের পর বেলা করে ওঠার অভ্যেস করেছেন। এখন তো বাজার করা আর অনিমার ওপর মেজাজ নেওয়া ছাড়া তেমন কোনও কাজ নেই। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। শিলিগুড়িতে থাকে। হারাধনবাবু এবং অনিমার সঙ্গে পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি থাকে। পুত্রবধূ স্কুলের মাস্টারনি। নাতি কলেজে পড়ে। সে বাড়িতে থাকে না বললেই হয়। হারাধনবাবু জানেন মোবাইলে এখন চমৎকার লেখা যায়। কাগজ কলম নিয়ে কবিতা লেখা সবসময় পোষায় না। নাতিকে কতদিন বলেছেন, ” বাংলায় টাইপ করাটা একটু শিখিয়ে দে না, বাবু!”

বাবু খিঁচিয়ে উঠে বলেছে, “আমার সময় নেই। বাবাকে বলো।”

এই বাড়িতে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না। সবাই মোবাইলে ডুবে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই উত্তর দেয়। বেশিরভাগ সময়ই উত্তর দেয় না। তবে অনিমার মোবাইলের নেশা নেই। ওই জন্য ওর ফোনটা ছোট, পুরোনো মডেলের।

সকালে কাজের লোক ঢুকলেই অনিমা চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। বাড়ির সবাই তখন আরামসে ঘুমায়। আরাম হারাম হয়ে যায় অনিমার চিৎকারে আর বাসন মাজার বীভৎস আওয়াজে। একতলায় রান্নাঘরের পেছনে চাতোয়াল লাগোয়া একটা কল আছে। কাজের লোক ওইখানে ঘঁষর ঘঁষর ক’রে বাসন মাজে। অনিমা মাজা কড়াই নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে কাজের মেয়েকে বলেন, ” জবা, এইটা একদম মাজা হয়নি। পাবদা মাছের গন্ধ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। আবার মাজ্।”

“ও ঠাকমা, এর চাইতে ভালো মাজা আর হয় না। আমাকে আরও দুটো বাড়িতে কাজ করতে হবে। তোমাদের বাসনকুসনের কেমুন ছিরি ছিল আমি জানি না! আমার হাতে পড়ে এখুন চাঁদির মতুন ঝকমক করে।”

“দুটো বাড়ি কাজ করতে হবে তো আমি কী করব? তুই আরেকবার কড়াইগুলো মেজে দে।”

রোজ রোজ বুড়ির এই কুচুটেপনা একদম ভাল্লাগে না। খালি খিটিরমিটির। বাড়ির কারও সঙ্গে বুড়ির বনে না।

অথচ বৌদির ব্যবহার কী সোন্দর। মিষ্টি করে কথা কয়। জবার সমসারের খবর নেয়। বলে “কষ্ট হোক,তবুও খাটবে জবা দি। নিজের ভাত নিজে জোগাড় করবে। মাথা উঁচু করে বাঁচবে।”

মাঝেমাঝে হাতে পঞ্চাশ টাকা, একশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, “যা মন চায় কিনে খেও। কাউকে বলার দরকার নেই।”

শাশুড়িটা একেবারে পিচাশ। সব সুমায় ভজর ভজর করে বকবে। পেছুনে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাসুন মেজে তাকে রুটি সবজি আর দালিয়ার খিচুড়ি বানাতে হয়। এইসব করেই সে পালবাবুদের বাড়ি ছুটবে। ওখান থেকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি। তারপর আবার হারাধনবাবুর বাড়ি এসে দুপুরের রান্না করে দিয়ে বাড়ি ফেরার গাড়ি ধরবে।

হারাধনবাবু আজ অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন। অ্যালার্ম না দিলেও প্রতিদিন ভোরবেলা অনিমার হাঁকডাকে একবার ক’রে ঘুম ভেঙে যায়। পাড়ার লোকেরা টগর, জবা পেড়ে নিয়ে যায় ব’লে চোর ধরার জন্য বারান্দায় ওঁৎ পেতে থাকেন অনিমা। কাউকে হাতেনাতে ধরে ফেললে তার গুষ্টি উদ্ধার করেন।

হারাধনবাবু বলেন, “দুটো ফুলই না হয় নিয়েছে! আবার ফুটবে। ভোরবেলার সৌন্দর্যটাকে চিৎকার চেঁচামেচি দিয়ে ভরিয়ে তুলো না।”

সে কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন অনিমাদেবী। ” তোমরা সবাই ঘুমাও আরাম করে। সকলে সবকিছু লুটে নিয়ে চলে যাক।”

আজ হারাধনবাবুকে এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেখে অবাক হলেন অনিমা। “সূর্য কোন দিকে উঠেছে গো? এত সকালে কাজ আছে নাকি কিছু?”

ব্যাস! ফোড়ন কেটে দিল! শুভ কাজে যাচ্ছেন, পণ্ড না হয়ে যায়! অরূপ পালের আগেই পার্কে পৌঁছতে হবে! চট করে একটা লাল রঙের টি- শার্ট গায়ে গলিয়ে নিলেন। এই টি -শার্টটা অনেকদিন আগে মেয়ে কিনে দিয়েছিল। অত ডিপ কালার জীবনে পরেননি বলে আলমারিতে তোলা ছিল। আজ পরতে ইচ্ছে করল। দৌড়তে পারেন না একদম। কোমরে ব্যথা। হাঁটুর অবস্থাও ভালো নয়। তবু বিকট ভুঁড়িটাকে সামলেসুমলে ‘জয় মা’ বলে এগোলেন।

রাস্তায় অনেকে মর্নিংওয়াক করছে। হাতদুটো বাঁই বাঁই করে ঘোরাচ্ছে। সে ঘোরাক। কিন্তু ব্যাটাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। সাধন দৌড়াচ্ছিল। হারাধনবাবুকে দেখে থামল।

বলল “জেঠু, মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছ? আগে তো দেখিনি! ডাক্তার বলেছে বুঝি!”

এদের জ্বালায় নিজের মত থাকার উপায় নেই। সবসময় দারোগাগিরি। খুব বিরক্তি নিয়ে পার্কের দিকে এগিয়ে গেলেন হারাধনবাবু। যা ভেবেছিলেন তাই! তিতলি নামের মেয়েটি ঝপাং ঝপাং করে লাফাচ্ছে আর সামান্য দূরত্বে অরূপ পাল কোমর ঘোরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হারাধনবাবু যেন কিচ্ছু বোঝেন না! অল্পবয়সী কচি মেয়ের সামনে তারুণ্য দেখানোর কী নিষ্ফল প্রচেষ্টা! কিন্তু তিনি এবার কী করবেন! কাগজ কলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসবেন নাকি অরূপ পালকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে কোমর ঘোরাবেন! সেবার সিঁড়িতে পড়ে কোমর ভেঙে গেল। সে কী অবস্থা! অনেকদিন ভুগলেন। কোমরে বেল্ট পরা। কোমর ঘোরাবেন কী করে! অগত্যা মুচকুন্দ গাছের নিচে বাঁধানো বেদীতে বসে কাগজ কলম বের করলেন।

পার্কে বয়স্ক মানুষদের সংখ্যাটা বেশি। তাদের মধ্যে এই মেয়েটিই কমবয়সী। মেয়েটা হেডফোন লাগিয়ে কিছু শুনছে আর লাফাচ্ছে। কখনো কোমর ঝুঁকিয়ে ডান হাতটা বাঁ-পায়ে স্পর্শ করছে। আবার বাঁ হাতটা ডান পায়ে টাচ করছে। অরূপ পাল হাঁ ক’রে দেখেই যাচ্ছে! কী নির্লজ্জ বেহায়া লোকটা! মরার বয়স হতে চলল এতটুকু লজ্জা নেই। প্রচুর মুচকুন্দ চাঁপা পড়ে আছে মাটিতে, বেদীতে। একটা মিষ্টি সুগন্ধে চারপাশটা ভরে আছে। এখনই তো কবিতা লেখার মোক্ষম সময়। মেয়েটা কোনও একটা গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধিতিং ধিতিং করে লাফাচ্ছে। অরূপ পাল অসভ্যের মত মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গে লাফাচ্ছে। যেন পরী আর জাম্বুবান! রাগে অসহায় হয়ে ঘামতে শুরু করলেন হারাধনবাবু। কবিতা এসেও যেন আসছে না। তবুও লিখতে শুরু করলেন, চাঁপার গন্ধে মনটা হল উতল….

উতলের সঙ্গে কী দেওয়া যায়! মন কবিতার দিক থেকে অরূপ পালের দিকে চলে যাচ্ছে বারবার। ধুস! এভাবে কবিতা হয় না কি! দ্বিতীয় লাইনে লিখলেন সে যেন হরিণীর মত চঞ্চল….,উতল আর চঞ্চল…. নট ব্যাড।

নিজের ওপরে বেশ খুশি হলেন হারাধন বাবু।

ভাব এসে গিয়েছে। এবার কবিতা দুর্দাড় ক’রে এগোবে। তৃতীয় লাইনে লিখলেন সে প্রজাপতি হয়ে মেলেছে ডানা….. ধুস! এক্ষুনি হরিণী ছিল, সঙ্গে সঙ্গে প্রজাপতি হয়ে গেল! দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে গেলেন হারাধন বাবু। কবিতায় অবশ্য সব হয়।

ওদিকে অরূপ পাল পিচুটির মত মেয়েটার গায়ে সেঁটে আছে। তাঁকে তাড়াতাড়ি কবিতাটা লিখে ফেলতে হবে। উত্তেজনায় পেনের পেছনটা ছোটবেলার মত দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরছেন বারবার। মেয়েটি সে দৃশ্য দেখে লাফাতে লাফাতে হারাধন বাবুর সামনে এসে বলল ” কী করছ, দাদু?”

হারাধনবাবুর এইটে খুব ভালো লাগে। এই যে নতুন জেনারেশন চেনা অচেনা সবাইকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলে …. খুব ভালো লাগে। আপনজনের মত মনে হয়।

হারাধনবাবু বুক চিতিয়ে কিছু বলবার আগে ভুঁড়িটা চিতিয়ে উঠল। সামলে নিয়ে বললেন, “কবিতা লিখছি। কবিতা লেখা আমার প্যাশন।”

মেয়েটি আহ্লাদী কণ্ঠে বলে উঠল, “হাউ সুইট! এই প্রথম আমি এত কাছ থেকে একজন কবিকে দেখলাম।”

হারাধন বাবুর মনটা আনন্দে ফুস করে চাঁপা গাছের মগডালে উঠে গিয়ে দোল খেতে লাগল। চতুৰ্থ লাইনটা পেয়ে গেলেন… তোমার হৃদয়ে হোক আমার ঠিকানা।

অনেকদিন পর চারটে লাইন লিখতে পারলেন তিনি।

ওদিকে অরূপ পাল মুখিয়েই ছিল। সুযোগ পেয়েই ঝপ করে হারাধনবাবুর কাছে এসে তিতলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ম্যাডাম, আমার কিন্তু একটা আস্ত কবিতার বই আছে! লকডাউনে লিখেছিলাম। চ্যাম্পিয়ন প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে। ভাইরাস- টাইরাস। ঘরে অনেক কটা রয়েছে। তোমাকে কাল এনে দেব।”

অরূপ পালের দিকে ঘুরে গেল মেয়েটি। “হাউ সুইট! আস্ত কবিতার বই! অটোগ্রাফ দিতে হবে কিন্তু কাকু!”

এসব দেখেশুনে কবিতা লেখার ইচ্ছেটা মরে গেল হারাধন বাবুর। আজকে অনেক বড় কবিতা লিখতে পারতেন, কিন্তু ওই অরূপ পালটার জন্য হল না! ভাইরাস – টাইরাস! যত্তসব! সে বই তো কেউ কেনেনি! নিজেই পয়সা দিয়ে প্রকাশ করিয়েছে আর নিজেই কিনেছে।

এখনকার ছেলেমেয়েরা খুব চৌখস। ওদের ঠকানো মুশকিল। কিন্তু মেয়েটি মনে হয় ইচ্ছে করেই ঠকছে!

মুখ চুন করে বাড়ি ঢুকলেন হারাধনবাবু। অনিমা বললেন, “কী হয়েছে তোমার? মনে হচ্ছে মুখে কেউ নুড়ো জ্বেলে দিয়েছে! ঘরে গিয়ে বসো। আজ জবাকে দিয়ে ময়দার লুচি ভাজিয়েছি, ছোলার ডালও আছে।”

হারাধনবাবু রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে গিয়ে বিছানায় গা-টা একটু এলিয়ে দিলেন। শরীরটা কেমন যেন করছে!

….সেই যে শুলেন, উঠলেন পাক্কা বাইশদিন পর। প্রথমে জ্বর। তারপর কাশি এবং চরম শ্বাসকষ্ট। ছেলের এক ডাক্তার বন্ধুর চিকিৎসায় আর হাসপাতাল যেতে হল না। সেরে উঠলেন! কিন্তু প্রচণ্ড দুর্বল। ওই অবস্থাতেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে মর্নিংওয়াকে চললেন। আজকে আর কাগজ পেন নিলেন না। তিনি বুঝে গিয়েছেন, কেবল মন ফুরফুরে থাকলেই কবিতা আসে না, কবিতার জন্য শরীর সুস্থ থাকা জরুরি।

অনিমা বললেন “একি! তোমার শরীরের এই দশা! এত সকালে চললে কোথায়? প’ড়ে যাবে তো! বুকুনকে ডেকে দিই! তোমার সঙ্গে যাক।”

বুকুন ওঁদের নাতি। সারাজীবন স্ত্রীর একটা প্রশ্নেরও উত্তর ঠিকঠাক মতো দেননি হারাধন বাবু। আজকেও দিলেন না।

পায়েও জোর নেই হারাধনবাবুর। তবুও খুব আস্তে আস্তে হেঁটে পার্কে গিয়ে পৌঁছলেন। এতখানি হেঁটে এসে দাঁড়াবার শক্তিটুকু পাচ্ছিলেন না। বসে পড়লেন মুচকুন্দ গাছতলার বেদীতে। হাঁফ ধরে গিয়েছে। অনেকেই মর্নিংওয়াক করছে। কিন্তু অরূপ পাল বা সেই মেয়েটি কোত্থাও নেই। একটু বসে ফিরে গেলেন বাড়ি। দেখলেন গেটের মুখে অনিমা ভ্যানওয়ালার কাছ থেকে সবজি কিনছে। হারাধনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “খবর পেয়েছ?”

স্বভাব অনুযায়ী উত্তর দিলেন না হারাধনবাবু। কেবল একরাশ বিরক্তি নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

অনিমাদেবী সেই বিরক্তি দেখেও দেখলেন না। বললেন “সীমাদের মেসে একটা বাচ্চামত মেয়ে এসেছিল না! কী যেন নাম!….” এবার ঘুরে দাঁড়ালেন হারাধন বাবু। “তিতলি। কেন কী হয়েছে?”

ঝুড়িতে কচি পটলগুলো বেছে রাখতে রাখতে অনিমা বললেন– “মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতি। অরূপ পালের ছোট ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে। পেয়িংগেষ্ট হিসেবে এসে মদনমোহনতলার বউ হয়ে গেল! পয়সা দিয়ে আর সীমাদের বাড়িতে থাকতে হবে না?”

সারাজীবন বউয়ের ওপরে ফাস্ট্রেশন দেখানো হারাধনবাবু জীবনে আজ প্রথমবার সদর দরজার ওপরে হতাশা রাগ ছুঁড়ে দিলেন পা দিয়ে। দরজা একটুও এধার ওধার হল না। কিন্তু হারাধনবাবুর গোড়ালিটা নড়ে গেল।

ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন হারাধন বাবু।

সেদিকে না তাকিয়েই অনিমাদেবী বলে উঠলেন, “মরণ!”

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

7 thoughts on “short-story-anuprerona

  1. স্যাটায়ার ধর্মী লেখাটার মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে বাঁচার অনুপ্রেরণা হিসেবে মানুষ সব সময়ই যেন একটা অবলম্বন খুঁজে পেতে চায় । বেশ উপভোগ করলাম গল্পটি । ভালো লাগলো । লেখিকার কলম এমনভাবেই সচল থাকুক এই শুভকামনাটুকু রেখে গেলাম ।

  2. বরাবরের মতোই মন ছোঁয়া খুব সাবলীল একটি গল্প! এক মুহূর্তের জন্যও থামতে দিল না! সুন্দর একটি বার্তা উঠে এসেছে লেখার মধ্যে দিয়ে!

  3. মজাদার লেখা। খুব উপভোগ করলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *