শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
‘যদুবাবু, নমস্কার।’
‘নমস্কার, আপনি কে বলুন তো!’
‘আজ্ঞে, আমার নাম মোহনবাঁশি যশ।’
‘বাঃ, আপনার নামটি তো বেশ! তা ইয়ং ম্যান, আজ এই সময়ে কি আমার সঙ্গে আপনার কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল? কই, আমার লিস্টিতে তো আপনার নাম দেখছি না। আমার চেম্বারে ঢুকলেন কীভাবে? আমার সেক্রেটারি কী করে আপনাকে ঢুকতে দিল?’
‘আপনার সেক্রেটারি আমার কাকা।’
‘ওঃ, তুমি তা হলে কুসুমকুমারের ভাইপো?’
‘যে আজ্ঞে।’
‘কিন্তু তা কী করে হয় বলো তো! তোমার পদবি যশ, আর কুসুমকুমারের পদবি হল আশ। তা ছাড়া যতদূর শুনেছি কুসুমের কোনও ভাইবোন নেই। সে একা, তাও বহু কষ্টে অনেক তাগা-মাদুলি, জলপড়া, ডাক্তার-বদ্যি, মানত, দণ্ডি কেটে তার মা-বাবার বিয়ের দশ বছর বাদে সে কোনওমতে জন্মায়। তা হলে আর ভাই আসছে কোথা থেকে? আর এ কথা কে না জানে যে, ভাই না থাকলে ভাইপোও থাকার কথা নয়।’
‘যে আজ্ঞে। আপনি যথার্থই শুনেছেন। কুসুমকুমারের কোনও ভাই বা বোন নেই। তিনি বড়ই একা। তবে ভাইও নানারকম হয় কিনা। এই ধরুন খুড়তুতো, জেঠতুতো, মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো।’
‘তাও তো বটে হে! আমারও অনেক তুতো ভাইবোন আছে! তা হলে তুমি কুসুমের কীরকম ভাইপো?’
‘আজ্ঞে, কুসুমকুমারের পিসতুতো ভাই হল গে রাখালরাজ যশ। আমি তারই বড় ছেলে।’
‘বুঝেছি। তা, আমার সঙ্গে তোমার দরকারটা কী বলো তো? যদি চাকরি বা লাইসেন্স কিংবা টেন্ডারের জন্য এসে থাকো তা হলে…’
‘আজ্ঞে না। আপনার কাছে আসার কোনও বৈষয়িক প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রয়োজনটা খুবই জরুরি। নইলে কাকাকে ধরা করা করে আপনার সঙ্গে এভাবে দেখা করার ইচ্ছে ছিল না। আপনি একজন ব্যস্ত মানুষ।’
‘তা বটে। সকাল থেকে রাত অবধি আমি ফুরসত কম পাই।’
‘সেটা কি ভালো?’
‘না, মোটেই ভালো নয়। ডাক্তার বলেছে আমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার, এক্সারসাইজ দরকার, এন্টারটেনমেন্ট দরকার। কিন্তু লোকে আমাকে ছাড়লে তো!’
‘লোকে আপনাকে ধরে রাখছে কেন? আপনি কি একজন গায়ক, অভিনেতা, না খেলোয়াড়! আজকাল শুনি এই তিন বস্তুর বাজারে খুব চাহিদা। কিন্তু আমি যত দূর জানি, আপনি একজন সমাজসেবক ছিলেন। একসময়ে আপনি সত্যিই গরিব, দুঃখী, অন্ধ, আতুরদের জন্য বিস্তর কাজ করেছিলেন। তারপর আপনি নিজের এনজিও তৈরি করে এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক। কীভাবে, তা কেউ জানে না।’
‘তুমি বেশ ঠোঁটকাটা লোক আছ তো বাপু! তা, সত্যি কথা বলতে কী, লোকসেবা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলুম বটে, তবে দেখলুম, লোকসেবার মধ্যেও ব্যবসার বীজ লুকিয়ে রয়েছে। তখন ভাবলুম, ভালো রে ভালো, একই সঙ্গে যদি দুটো কাজই হয়, তা হলে খারাপটা কী? কত বড় এনজিও জানো, আমি প্রায় শ’ পাঁচেক কর্মচারীর এমপ্লয়ার। কিন্তু বাপু মোহনবাঁশি, তুমি কি আজ আমার মুখোশ খুলে দেবে বলেই এসেছ?’
‘না যদুবাবু, আমার তেমন কোনও উদ্দেশ্য নেই। আপনি তেমন কিছু খারাপ লোকও নন। আপনি তো চিট ফান্ড করে বড়লোক হননি। আমার একটু অন্যরকম বক্তব্য আছে।’
‘ইয়ং ম্যান, আশা করি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, আমার হাতে সময় খুব কম। বলতে কী, প্রতিদিনই আমাকে সময়ের সঙ্গে দৌড়োতে হয়। আর তুমি তো নিশ্চয়ই জানো, সময়ের মতো দৌড়বাজ স্বয়ং উসেন বোল্টও নয়।’
‘জানি যদুবাবু। বাইরে এখনও প্রায় জনা পঁচিশেক লোক আপনার দর্শনার্থী হয়ে বসে আছে। কেউ ঢুলছে, কেউ হাই তুলছে, কেউ উসখুস করছে। আপনার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। কিন্তু আমার প্রশ্নটাও আপনার এই ব্যস্ততা নিয়েই।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে কথা বলতে আমার আপত্তি নেই। তুমি যখন এত জানো, তখন এটাও নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ যে, অনেকের রুজি-রুটি এই আমার ওপরেই নির্ভরশীল। আর এত লোকের ভাগ্য আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলেই আমার এত ব্যস্ততা, নইলে আমারও কি ইচ্ছে করে না যে, গিয়ে একটা সিনেমা দেখে আসি। কিংবা একটু ক্রিকেট ম্যাচ দেখি, কিংবা একটু কেদার-বদরী-কাশ্মীর ঘুসে আসি। কিন্তু কী করব বলো, আমাকে তিলেক না দেখলে যে মানুষ বড় অসহায় হয়ে পড়ে।’
‘কিন্তু কিছু মানুষ যে দিনের পর দিন আপনার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে, তাদের কী হবে বলুন তো!’
‘তাদের একটু ধৈর্য ধরতে বলো। তারা যেন কুসুমকুমারের খাতায় নাম আর টেলিফোন নম্বর লিখিয়ে রেখে যায়। আশা করি মাসখানেকের মধ্যেই তারা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে যাবে।’
‘সে চেষ্টাও তারা করেছে, তবে কাজ হয়নি। আমার কাকা খাতায় তাদের নাম তুলতে রাজি হননি।’
‘না না, এ তো কুসুমকুমারের ভীষণ অন্যায়। আচ্ছা, তুমিই আমাকে তাদের নাম বলো, আমি তাদের স্পেশ্যাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
‘তা হলে বরং লিখেই নিন। একজনের নাম শ্রীমতী শচী রায়, আর-একজন বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, আর-একজন হল গিয়ে বিপুল মজুমদার।’
‘ঠিক আছে, লিখে রাখলুম।’
‘নামগুলো কি আপনার চেনা চেনা মনে হচ্ছে?’
‘দেখো বাপু, নাম এক আশ্চর্য জিনিস। এই যে আমার নাম যদুগোপাল রায়, খুঁজে দেখলে তুমি এরকম ষাট-সত্তরজন যদুগোপাল রায় খুঁজে পাবে। এই যেমন ধরো, আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার বউয়ের নাম শচী রায়। তা বলে কি ধরে নেব যে, শচী রা আর কেউ হতে পারে না?’
‘তা বটে। তবে এই শচী রায় কিন্তু আপনার স্ত্রী-ই!’
‘স্ত্রী! বলো কী তুমি! সে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট চায় কেন?’
‘কারণ, গত এক মাসের ওপর আপনি আপনাদের সোনারপুরের বাড়িতে যাননি। এবং আপনি সরাসরি ফোন ধরেন না, ধরলেও “সময় নেই” বলে কেটে দেন। অথচ আপনার মেজো মেয়ের বিয়ে আসন্ন এবং আপনার কিছু কর্তব্য আছে।’
‘এই তো মুশকিলে ফেললে বাপু। আমার মেজো মেয়ের কি বিয়ের বয়েস হয়েছে? হয়ে থাকলে তো আমার জানার কথা!’
‘তা তো বটেই। এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি, রাগ করতে পারবেন না কিন্তু!’
‘না না, বলে ফেলো।’
‘আপনার মেজো মেয়ের নামটা কি আপনার মনে আছে?’
‘তার মানে। এ আবার কীরকম রসিকতা? আমার নিজের মেয়ে, তার নাম মনে থাকবে না?’
‘থাকাই তো উচিত। তা হলে বলে ফেলুন দিকি।’
‘দাঁড়াও বাপু, একটু জল খেয়ে নিই। সারাদিন রাজ্যের চিন্তায় মাথাটা গন্ধমাদন হয়ে থাকে তো! চট করে অনেক সহজ কথাই মনে পড়তে চায় না। তা, তুমি কি আমার মেজো মেয়ের নাম জানো?’
‘জানি।‘
‘তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল! জানোই যদি, তা হলে আর আমাকে জিগ্যেস করা কেন?’
‘আপনাকে আপনার পরিস্থিতিটা বোঝানোর জন্য। আপনি স্ত্রীর নাম ভুলে গেছেন, মেজো মেয়ের নাম ভুলে গেছেন।’
‘আহা, তা বলে আর কারও নাম ভুলিনি হে।’
‘তা হলে বলুন দেখি আপনার বড় মেয়ের নাম কী?’
‘এ তো সোজা। বড় খুকি।’
‘স্কুল-কলেজে সবাই কি তাকে বড় খুকি রায় বলে চেনে?’
‘না না, আমার তা মনে হয় না। বড় খুকি রায় বেখাপ্পা শোনাচ্ছে।’
‘আমিও তাই বলি। বড় খুকির একটা পোশাকি নাম থাকার কথা।’
‘আমার কী মনে হচ্ছে জানো?’
‘কী বলুন তো!’
তুমি আগে থেকেই আমাকে জব্দ করার প্ল্যান নিয়ে এসেছ।’
‘আজ্ঞে না। তাতে আমার লাভ নেই। বরং আপনাকে একটু খুশি রাখতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।’
‘তোমার উদ্দেশ্যটা কী?’
‘সেটা রয়েসয়ে বলতে হবে। হুড়োহুড়ি করে বলার মতো নয়।’
‘কিন্তু সময়ের কথাটা খেয়াল না রাখলে তো চলবে না।’
‘যদুবাবু, লোকে যদি জানতে পারে যে, আপনার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, আপনি ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন, তা হলে কাল থেকেই আপনার দপ্তরের ভিড় উধাও হবে।’
‘আহা, আমার কি আর সত্যিই ওসব হয়েছে নাকি? আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম, রাষ্ট্রপতির নাম, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম, এমনকী আমার বাবার নামও বলে দিতে পারি।’
‘শাবাশ! এই তো চাই। আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে, আপনার তিন মেয়ের পর একটি ছেলেও হয়েছিল।’
‘তা তো বটেই। এটা মনে না থাকার মতো কী হল?’
‘ছেলের এখন কোন ক্লাস?’
‘বাপু, এটাও তো দেখছি জামাই ঠকানো প্রশ্ন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার কোথায়?’
‘আপনার বড় খুকি তার শ্বশুরবাড়িতে আছে, তা শ্বশুরবাড়িটা কোথায় তা কি মনে আছে আপনার?’
‘অ্যাঁ! শ্বশুরবাড়ি। বড় খুকির আবার বিয়ে হল কবে? আমি জানি না তো!’
‘আলবত জানেন। আপনি নিজে তাকে সম্প্রদান করেছেন।’
‘তা হবে হয়তো।’
‘আপনার স্ত্রীর মতোই আরও দুজন আপনার নিকট আত্মীয় আপনার দর্শন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে। একজন বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, আপনার বেয়াই, আর বিপুল মজুমদার আপনার বড় শালা।’
‘না হে, মোহনবাঁশি, তুমি আজ আমাকে ভারী বেকায়দায় ফেলে দিয়েছ! বলি, প্যাঁচ কষে কিছু আদায় করতে চাও নাকি?’
‘যদি চাই?’
‘বলতে নেই, তোমাকে দেখে আমার বেশ চোখা-চালাক বলেই মনে হচ্ছে। তুমি আমাকে নানাভাবে জব্দ করার চেষ্টা করলেও তোমার ওপর আমি অপ্রসন্ন হতে পারছি না। তুমি কী চাও সেটা এবার পষ্ট করে বলো তো!’
‘বলছি, আমি একজন ডাক্তার। এমবিবিএস, হার্টে ডিপ্লোমা। আমার চেম্বার সোনারপুর স্টেশনের কাছেই। আর বলতে নেই, আমার প্র্যাকটিস বেশ ভালো। আপনার মতো না হলেও, আমার চেম্বারে সন্ধেবেলা অনেক রুগি হয়। সকালবেলা নার্সিংহোম থাকে। অবশ্য এসব অবান্তর কথা। আসলে সম্প্রতি আমি একটু বিপদে পড়েছি বলেই আপনার কাছে আসা।’
‘আহা, লোকে বিপদে পড়েই তো আমার কাছে আসে।’
‘সোনারপুরের একটি ক্লাবের ফাংশনে সম্প্রতি আমাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেটা যোগশিক্ষা এবং ব্যায়ামের ক্লাব। সেখানে মঞ্চে একটা মেয়ের ব্যায়াম প্রদর্শনী দেখে আমার তাক লেগে গিয়েছিল। মেয়েটা নিজের যে-কোনও পা সটান নিজের মাথার ওপর তুলে দিতে পারে। দাঁড়িয়ে পিছনে মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে শরীর গোল করে, আবার নিজের দাঁড়ানো দুটো পায়ের ফাঁক দিয়ে মুন্ডু বের করতে পারে। অমন ফিটনেস আমার দেখা নেই।’
‘বলো কী হে! এ তো সাংঘাতিক মেয়ে!’
‘যে আজ্ঞে, মেয়েটা দেখতেও বেশ ভালো। মনে মনে আমার একটু দুর্বলতা যে দেখা না-দিয়েছিল, তা নয়। তারপর কিছু ফিসফাস কানে এল যে, মেয়েটা নাকি একটু গুন্ডা প্রকৃতির। শুধু ব্যায়াম নয়, কুংফু জানে, ক্যারাটে ব্ল্যাকবেল্ট। সে প্রায়ই ইভটিজার বা ফক্কড় ছেলে-ছোকরা বা বদমাশ লোককে পেটায়। তার নামে থানায় কয়েকবার এফআইআর-ও হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীর মেয়ে বলে পুলিশ অ্যাকশন নেয়নি।‘
‘আরে কে কত প্রভাবশালী তা আমার জানা আছে। আমাকে নামটা বলো তো, আমি এক্ষুনি ফোন করে মেয়েটাকে অ্যারেস্ট করিয়ে দিচ্ছি।’
‘করবেন। তাড়া কীসের? সবটা শুনে নিন না হয়। এই গত মাসেই আমি বাধ্য হয়ে আমার ভিজিট দুশো থেকে বাড়িয়ে তিনশো করেছি। আর সেটা কি দোষের ব্যাপার, আপনিই বলুন। টাকার দাম তো রোজই দশ পয়সা, কুড়ি পয়সা করে কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া রোগী সামলাতে ভিজিট বাড়ানো হল খুব কার্যকর দাওয়াই। কিন্তু দিন পনেরো আগেই সেই জোরালো চেহারার ব্যায়ামবিদ মেয়েটা আরও তিন-চারজন রোখা চোখা মেয়েকে নিয়ে আমার চেম্বারে হাজির। সোজা আঙুল তুলে কী বলল জানেন?’
‘কী বলল ?’
‘বলল, গরিব দেশের ডাক্তার হয়ে এত ভিজিট চাইতে আপনার লজ্জা করে না? কাল থেকে আগের মতোই দুশো টাকা নেবেন। নইলে এখানে প্র্যাকটিস করতে পারবেন না। আমার রুগিদের সামনেই আমাকে ওই অপমান হজম করতে হল। সোনারপুরে আমি নতুন মানুষ, কাজেই তেমন প্রভাব প্রতিপত্তি নেই। চুপ করে মুখ বুজে হেনস্থা সয়ে নিলুম।’
‘কোন বাড়ির মেয়ে বলো তো? এ তো ভয়ংকর বেয়াদপি। আমি এক্ষুনি ওর বাবাকে বলে মেয়েটাকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করছি। সোনারপুর এখনও আমার কথায় ওঠে বসে।’
‘আজ্ঞে, এইসব দুঃখের কথা জানাতেই তো আপনার কাছে আসা। যেটুকু শুনলেন সেটাই তো সব নয়। রাত তিনটের সময় একদিন ফোন, ফোন তুলেই শুনি একটা মেয়ে ধমক-চমক করে বলছে, শুনুন ডাক্তারদের কিন্তু অমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোলে চলে না। মানুষের মরণ-বাঁচন যাদের হাতে তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোলে তো হবে না! আপনি এখুনি দুখুদের বাড়ি চলে আসুন, দুখুর বাবার ভীষণ শ্বাসকষ্ট, খুব সিরিয়াস অবস্থা। আমি পাঁচ মিনিট বাদে আবার ফোন করব।’
‘সেই মেয়েটাই নাকি মশাই?’
‘যে আজ্ঞে। দুখুদের বাড়ি আমি যথারীতি সাইকেলে চেপে পৌঁছে যাই। একটুও দেরি করিনি। তবু সেই ব্যায়ামবীরাঙ্গনা মেয়েটি চোখ পাকিয়ে কী বলল জানেন! বলল, এত দেরি হল যে! রুজ পাউডার মাখছিলেন নাকি?”
‘কী ভাষা! ছি ছিঃ!’
‘তবেই বুঝুন। যা হোক, আমার চিকিৎসায় রুগি ভদ্রলোক খানিক সামলে ওঠায় আমি তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে ফিরে আসি। ভিজিটটা পর্যন্ত নিইনি। তবু কোনও কৃতজ্ঞতা কেউ প্রকাশ করল না।’
‘নেমক হারাম! নেমক হারাম!’
’ডাক্তারদের কতটা চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়, তা আপনি নিশ্চয়ই জানেন। তার ওপর মানুষের কটুকাটব্য সহ্য করাটা মাঝে মাঝে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ইচ্ছে করে এসব ছেড়ে দিয়ে বরং বিবাগী হয়ে যাই। সিরিয়াসলি আমি একবার সংসার ত্যাগের কথা ভেবেওছিলুম, যেদিন কুশল ব্যানার্জির মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে হেনস্থা হতে হল। কুশল ব্যানার্জিকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন?’
‘তা চিনব না কেন? সোনারপুরের মেলা লোককেই তো আমি চিনি।‘
‘ইনি সোনারপুরের লোক নন। রাজপুরের লোক। বিল্ডিং মেটিরিয়ালসের ব্যবসা। বিস্তর টাকার মালিক, তাঁর মেয়ে অয়নিকারই বিয়ে। অয়নিকা দেখতে তেমন সুবিধের নয়। মেয়েটা কালো। কিন্তু তার জন্য যে-পাত্রটি কুশলবাবু জোগাড় করেছেন তাকে রাজপুত্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। তার ওপর ডাক্তার। ঘটনাক্রমে আবার সেই পাত্রটি আমার পূর্ব পরিচিত। কানাঘুষো শুনলুম, পাত্রকে একটি আস্ত নার্সিংহোমই উপহার দিতে চলেছেন কুশলবাবু। তা সে যাকগে, তো আমি পুরোনো বন্ধু পাত্রটিকে দেখে তার সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। এমন সময় সেই বীরাঙ্গনা মেয়ে তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথি নিয়ে সেখানে হাজির।’
‘ও বাবা, সেই ডাকাতে মেয়েটাও সেখানে নিমন্ত্রিত ছিল নাকি!’
‘থাকারই কথা। সে পাত্রীর বন্ধু কিনা। কিন্তু আমি তাকে দেখে এমন আঁতকে উঠলাম যে, হাতের কফির কাপ থেকে চলকে গরম কফি খানিক আমার হাঁটুর প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। আমার দিকে কটমট করে চেয়ে বলল, এই যে ডাক্তার যশ, নিজের বাজারদর যাচাই করছেন নাকি? আপনার কিলো কত করে বলুন তো?’
‘বলল। বলতে পারল কথাটা।‘
‘আমি তো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তবে আমি ভেড়ুয়া হলেও দেশে পুরুষসিংহের তো অভাব নেই। পাত্রপক্ষের বরযাত্রীদের মধ্যে একজন হেক্কোড় লোক ছিল। আপনি হেক্কোড় মানে জানেন কি?’
‘জাপানি বা জার্মান শব্দ নাকি হে!’
‘আজ্ঞে না। বাংলাই। যতদূর মনে হয়, হেক্কোড় মানে হল মাথামোটা গোঁয়ার গোবিন্দ বা চোয়াড়ে গোছের লোক। তার চেহারাও বেশ ষাঁড়ের মতো ঘাড়ে-গর্দানে। গিলে করা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে সে তেড়ে এসে বলল, মুখ সামলে কথা বলবেন ম্যাডাম! আপনি ডাক্তার যশকে উদ্দেশ্য করে বললেও আপনার ইঙ্গিত আমরা বুঝতে পারছি। ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না, বুঝলেন!’
‘তারপর?’
‘মেয়েটা একটু গরম খেল না। দিব্যি হাসি-হাসি মুখ করে বলল, বাহ, বুঝতে পেরেছেন তা হলে। আপনার আইকিউ তো দারুণ। বলে চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপর সন্ধে লগ্নেই বিয়ে হয়ে গেল। আজকাল হিন্দু বিয়েরও অনেক কাটছাঁট হয়েছে। বড্ড টপ করে হয়ে যায়। সেও একটা বাঁচোয়া, কী বলেন?’
‘সে কথা ঠিক। আমার বিয়ের সময় তো যজ্ঞই চলেছিল ঘণ্টা তিনেক। ধোঁয়ার আর পোড়া ঘি-এর উৎকট গন্ধে নাকের জল চোখের জলে অবস্থা।’
‘বিয়ের কথা তা হলে আপনার মনে পড়ে?’
‘তা আর পড়বে না! তখন তো আমি কেউকেটা হইনি।‘
’বুঝলুম।’
‘তা হলে সেদিন অল্পের ওপর দিয়েই বেঁচে গেলে তো!’
‘বাঁচলে কি এতদূর দৌড়ে আপনার কাছে আসি মশাই! মেয়েটার গুন্ডামি সম্পর্কে আমার তখনও তেমন ধারণাই ছিল না। তবে মেয়েটা ভারী বিবেচক। বিয়ে মেটা পর্যন্ত কোনও ঝামেলা করেনি, কিন্তু গভীর রাতের দিকে যখন বরযাত্রীরা বাসে উঠতে যাবে, তখন মেয়েটা গিয়ে হেক্কোড়টাকে ধরল। পরিষ্কার বলল, এই যে মস্তানমশাই, তখন তো খুব তড়পাচ্ছিলেন, এবার বলুন তো পাঁঠাটাকে কততে বেচে গেলেন। এক কথায় দু’কথায় হেক্কোড়টা রেগে গিয়ে মেয়েটাকে একটা চড় কষিয়েছিল।’
‘মেয়েদের গায়ে হাত! না না, এটা আমি সমর্থন করি না।‘
‘ঠিক। কেউই সমর্থন করে না। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানেন? মেয়েটা অতি ধুরন্ধর। সে ইচ্ছে করে হেক্কোড়টাকে উসকে দিয়ে ইচ্ছে করেই চড়টা খেয়েছিল, যাতে পাবলিক সিমপ্যাথি পাওয়া যায়। আর তারপর যা হল তাতে আমার চোখ ট্যারা।’
‘কী হল?’
‘নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হত না মশাই। একটা ছিপছিপে চেহারার মেয়ে যে ওরকম একটা পাগলা ষাঁড়কে এমন আছাড়ি-পিছাড়ি করে পেটাতে পারে, তা স্বপ্নেরও অগোচরে ছিল মশাই। আমার তো আঁত শুকিয়ে গিয়েছিল।’
‘মেয়েরা যে দিনকে দিন কী ডেঞ্জারাস হয়ে উঠছে তাই ভাবি! না, দিনকাল বড়ই খারাপ পড়েছে দেখছি।’
‘তা, মেয়েটার ওপর দোষ চাপিয়ে তো লাভ নেই মশাই। বাপ-মা’র গাইডেন্স ঠিকমতো না পেলে মেয়েরা একটু বেপরোয়া হয়ে যেতেই পারে। যুগের হাওয়া। তার ওপর মেয়েটা আবার এক ভিআইপি-র মেয়ে। মেয়ের দিকে নজর দেওয়ার সময় তার বাবার নেই কিনা।’
‘রাখো তো, ছোকরা। আমাকে ভিআইপি চেনাতে এসো না। কে কত দরের ভিআইপি তা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। রোজ আমাকে গাদা গাদা ভিআইপি ঘাঁটতে হয়। সব শর্মাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। তা ছাড়া সোনারপুরে আমার ওপর আবার কোন ভিআইপি আছে বলো তো! তার নামটা কী?’
‘দেখুন, আমি সামান্য মানুষ। ভিআইপি-তে ভিআইপি-তে বিবাদ বাধাতে তো আমি আসিনি। আমি বেঘোরে মারা যেতে চাই না।’
‘তা, মেয়েটা হেকোড়টাকে পেটানোর পর পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াল সেটা বলবে তো!’
‘আজ্ঞে, সেটাই বলছি। পাবলিক তো বটেই, বরযাত্রীরা অবধি কেউ মেয়েটার কোনও দোষ দেখল না। বরং সবাই উলটে ওই হেক্কোড়টাকেই হেনস্থা করল। আর মেয়েটার ভূয়সী প্রশংসা হতে লাগল চারদিকে। বুঝলেন?’
‘বুঝলাম। কিন্তু তাতে তোমার সমস্যাটা কী?’
‘আজ্ঞে, সেটাই বলছি। লোকে যতই প্রশংসা করুক, আমি কিন্তু মেয়েটাকে বেজায় ভয় খেতে শুরু করলাম। তার ধমক খেয়ে ভিজিট ফের দুশো টাকায় নামাতে হয়েছে। রাত-বিরেতে কল এলে তড়িঘড়ি যাচ্ছি। ফোন সুইচ অফ রাখার জো নেই। ছেলেবেলায় যেমন জুজুর ভয় পেতাম, এখন তেমনই ওই মেয়েটাকে ভয় পাই। উপায় থাকলে সোনারপুর থেকে অন্য কোনও জায়গায় গিয়ে পসার জমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু প্র্যাকটিসটা বড় জমে গেছে বলে জায়গাটা ছাড়তেও মন চাইছে না।’
‘আহা, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। তুমি মেয়েটার নাম, তার বাবার নাম আর ফোন নম্বরটা আমাকে দিয়ে যাও? আমি সব ঠিক করে দেব। এমন ব্যবস্থা করব, যাতে মেয়েটা আর তোমার ছায়াও মাড়াবে না।’
‘অনেক ধন্যবাদ। তবে কিনা আপনার কিছু পরেশানিও হতে পারে। কারণ, জল আরও একটু গড়িয়েছে।’
‘তাই নাকি! কী ব্যাপার বলো তো?’
‘দিন দশেক আগে হঠাৎ এক রোববারের সকালে আমি এক ভদ্রমহিলার ফোন পেলাম । ভারী আন্তরিক গলা। বলল, আমি অতসীকায়ার মা। আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে যেসব দুর্ব্যবহার করেছে তার জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত। ক্ষমা চাইছি মেয়ের হয়ে। আর বাবা, যদি কিছু মনে না করো, আজ সন্ধেবেলায় আমাদের বাড়িতে তোমাকে আসতে হবে। কোনও অজুহাত কিন্তু চলবে না, আসতেই হবে। আমি জানি তোমার মা নেই, আমি তো তোমার একজন মায়েরই মতন। আসতে হবে কিন্তু।’
‘নেমন্তন্ন পেয়ে যে কারও এমন হৃৎকম্প হতে পারে, তা প্রথম বুঝলুম।’
‘মেয়েটার কী নামটা বললে যেন!’
‘কেন বলুন তো! নামটা কি চেনা-চেনা ঠেকছে?’
‘হ্যাঁ। কোথায় যেন শুনেছি। সাউন্ডস ফ্যামিলিয়ার।’
‘মেয়েটির আরও দুই দিদি আছে। বড়টি মাধবীমায়া, মেজো বিটপীছায়া আর ছোটটি অতসীকায়া। এদের মামা একজন নামকরা কবি। তিনিই এসব কাব্যিক নাম রেখেছেন ভাগনিদের।’
‘কবি! তাই বলো। কবিরা তো একটু মাথা পাগলা, ছিটিয়াল গোছেরই হয়। তবে নামগুলো কেন যেন আমার বড্ড চেনা ঠেকছে। কোথাও শুনেছি। মনে হচ্ছে, এদের আমি চিনিও। তা, তুমি কি নেমন্তন্নে গেলে নাকি?’
‘আজ্ঞে, না গিয়ে উপায় কী বলুন। ঘাড়ে আমার ক’টা মাথা। একে গুন্ডা মেয়ে, তার ওপরে বাবা ভিআইপি।’ একটু ভেবে মোহনবাঁশি জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা আপনি কি শরৎচন্দ্রের বইটই পড়েছেন?’
‘শরৎবাবু! তা হঠাৎ শরৎবাবুর কথা কেন উঠছে বলো তো? তা পড়েছি বই কী! শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, রামের সুমতি, মহেশ … কিন্তু শরৎবাবুকে টানাটানি করতে হচ্ছে কেন?” মাথা চুলকে জানতে চাইলেন যদুবাবু।
‘আজ্ঞে তার কারণ, শরৎচন্দ্রের লেখায় ভালো ভালো মেয়েদের কথা আছে। খুব নারীদরদি লেখক ছিলেন তো! আমি বুদ্ধি করে উপহার হিসেবে শরৎ রচনাসমগ্র নিয়ে গিয়েছিলুম। যদি ওসব পড়ে মেয়েটার মতিগতির বদল হয়। তা জন্মদিনে গিয়ে দেখি, বাড়ি বিয়েবাড়ির মতো সাজানো। এলাহি খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত। সেদিন অবশ্য মেয়েটা বেশ ভালো ব্যবহারই করেছে। ধমক-চমক বিশেষ করেনি।’
‘তা হলে তো ফাঁড়া কেটেই গেছে, কী বলো?’
‘তাই যদি হবে, তা হলে আর আপনার কাছে আসা কেন? ব্যাপারটা তো ওখানেই শেষ হয়নি। মেয়ের মা দুদিন পরেই আমার কাছে এসে হাজির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তাঁর নাকি পাত্র হিসেবে আমাকে ভারী পছন্দ। মেয়েরও নাকি অমত নেই। প্রথমে ঠোঁট ওলটালেও পরে নাকি বলেছে, কোনওরকমে চলে। তবে ঘষামাজা দরকার।’
‘এত্ত বড় সাহস!’
“তা হবে না কেন? আপনিও তো কম ডাকাবুকো নন।’
‘আমি! আমি পিকচারে আসছি কী করে?’
‘আসছেন, কারণ অতসীকায়া আপনারই ছোট খুকি যে!’
‘আমার ছোট খুকি! তাই বলো! তা হলে এতক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিলে কেন? তা বিয়েটা করে বলো তো?’
‘আজ্ঞে, সেটা নিয়ে কথা বলতেই আসা। আমি বিয়ে করে মৃত্যুবরণ করতে চাইছি না। তাই বলছি, আপনি আমাকে এই বিয়েটার হাত থেকে বাঁচান। আপনার ছোট খুকি যদি কোনওদিন রেগে গিয়ে আমার ঘাড়ে একটা ক্যারাটে চপ বসায় বা কিক মারে, তা হলে আমার ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা, না হলেও সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।’
‘তাই তো হে! তোমার দিকটাও তো ভেবে দেখা দরকার। ছোট খুকির এসব বাড়াবাড়ি তো মোটেই ভালো নয়। লোকে নিন্দে করবে। তা কী করা যায় বলো তো!’
‘সেটা তো আপনিই বলবেন।’
‘আমি। আমি শচীর মতামতের ওপর মতামত দেব? খেপেছ নাকি? আমি কি সাধ করে বাড়ি ছেড়ে অফিসে এসে ঘাপটি মেরে থাকি? থাকতে হয় বউয়ের ভয়ে।’
‘সে কী!’
‘আমি বলি কী বাপু, তুমি আর টালবাহানা না করে চোখ বুজে বিয়েটা করেই ফেলো। হাতের কাছে ফার্স্ট এড রেখো। আর যতদূর সম্ভব বউয়ের সঙ্গে একটা ডিসট্যান্স মেনটেন কোরো। রিস্ক নিতে যেয়ো না। বউয়ের মুখের ওপর কথা বলতে নেই।’
‘আপনি কি কাপুরুষ?’
‘না হে। আম আদ্যন্ত কাপুরুষ নই। শুধু ওই একটা জায়গায়। তুমি কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে নাকি?”
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘ভালো। ওতে অক্সিজেন ইনটেক বাড়ে।’
ঘোষণা: পূর্ব প্রকাশিত “অপ্রকাশিত গ্রন্থ” তে
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অনিন্দ্য সাহিত্যকর্ম ‘অতসীকায়া’। পাঠপ্রিয়তা আহরণকারী গল্প। সমৃদ্ধ অন্তর্ভুক্তি এ-বিশেষ সংখ্যায়। শারদ শুভেচ্ছা।