short-story-badami-patar-virey

বাদামি পাতার ভিড়ে
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য


উর্দিপরা দারোয়ান বিষাণকে চেনে। এই বাড়ির গেটের সামনে আগেও এসেছে সে। তার বাইকের পিলিয়নে বসা ছিল প্রিয়দত্তা। তবে বিষাণ ভেতরে ঢোকেনি কখনও। প্রিয়দত্তাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে। আজই প্রথম ঢুকতে যাচ্ছে মিত্র ম্যানসনে। তাকে কিছু বলতে হল না মুখ ফুটে। দারোয়ান গেট খুলে দিল বিনীত ভঙ্গিতে।

ঘন সবুজ লন। কংক্রিটের ঢালাই করা রাস্তা এগিয়ে গেছে উঁচু থামওলা বাড়িটার দিকে। অফ হোয়াইট তিনতলা বিল্ডিংটার শরীরে লেপটে আছে গোথিক স্থাপত্যের অভিজ্ঞান। প্রিয়দত্তার ঠাকুর্দা ছিলেন জাঁদরেল আইনজীবী। তিনিই বানিয়েছিলেন এই বাড়ি। পেছনদিকে গ্যারাজ। পাশে একটা ঘর। সার্ভেন্টস কোয়ার্টারস হবে হয়তো। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করল বিষাণ। চাবিটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক দেখল। দ্বিধা জড়ানো পায়ে এগোল সামনের দিকে।

বিষাণের গায়ের রং পরিষ্কার। হাইট ছ-ফিটের কাছাকাছি। নির্মেদ চেহারা। লম্বাটে মুখ। চওড়া কপাল। চৌকো চোয়াল। ব্যাকব্রাশ করা চুল। ডেনিম জিনস পরেছে আজ। গায়ে সাদা ফুলস্লিভ শার্ট। পায়ে স্নিকার। সানগ্লাসটা খুলে বুকপকেটে ঢুকিয়ে প্রিয়দত্তাকে ফোন করল বিষাণ। ডায়াল হয়ে যাচ্ছে। ফোন তুলছে না প্রিয়দত্তা।

ক’দিন আগেই জগদ্ধাত্রী পুজো গেছে। গ্রামেগঞ্জে এ সময় কান পাতলে হেমন্তের পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। মহানগরে হেমন্ত বলে যে একটা ঋতু আছে তা টেরই পাওয়া পাওয়া যায় না। তবে খেয়াল করলে বোঝা যায় কলকাতার বিকেলগুলি আজকাল একটু অন্যরকম। এখন বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ, তবুও বিষাণের কপালে ঘাম জমছে। ভেতরের উদ্বেগ ফুটে উঠছে মুখে। তৃতীয়বারের চেষ্টার পর প্রিয়দত্তা ফোন ধরল। ফিসফিস করে বলল, ফোনটা সাইলেন্ট ছিল বলে বুঝতে পারিনি। চলে এসো। মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে এল বিষাণ। একজন পরিচারক মূল দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। এটা হলঘর। সোফা, দুটো কাউচ, সেন্টার টেবিল মাঝখানে। ওপর থেকে নেমে এসেছে ঝাড়বাতি। টবে ইনডোর প্ল্যান্ট। দেওয়ালে মাউন্ট করে টাঙানো এই পরিবারের মানুষদের ফোটো। সবই সিপিয়া রংয়ে প্রিন্ট করা। এমনকি, সাম্প্রতিক ছবিও। একটা ছবিতে সুট পরা এক পুরুষের পাশে দাঁড়ানো দামি শাড়ি পরা প্রিয়দত্তা। নিশ্চয়ই বিয়ের রিসেপশনের ছবি। একটা ভারী শ্বাস গোপন করল বিষাণ। তার কাছে কিছুই লুকোয়নি প্রিয়দত্তা। বিশ্বরূপের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বিশ্বরূপ বেশিদিন বাঁচেনি ডিভোর্সের পর। অন্য একটা ছবির দিকে চোখ গেল বিষাণের। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা একজনের শবদেহ শোয়ানো এই বাড়িরই লনে। কয়েকজন ঘিরে আছে মৃতদেহটিকে। মৃতের মাথার কাছে বসা প্রিয়দত্তা। ধ্বস্ত চেহারা, চোখ ফুলে আছে, বিস্রস্ত বেশবাস। মৃতের আঙুল নিজের আঙুলে জড়ানো। আন্দাজ করা যায়, মৃতদেহটি বিশ্বরূপের। বিষাণ মুখ ঘোরাল। প্রিয়দত্তা দাঁড়িয়ে ছিল তারই প্রতীক্ষায়। চাপা স্বরে বলল, এসো। আর হ্যাঁ, বি স্টেডি।

প্রিয়দত্তা দামি সিল্কের শাড়ি পরেছে। পলাশ লাল রং। পাড়ে কালো নকশা। চুল ছেড়ে রেখেছে। চোখে আইলাইনার। ঠোঁটে লিপস্টিক। প্রিয়দত্তা তেত্রিশ ছাড়িয়ে গেলেও তাকে দেখে ছাব্বিশ সাতাশের বেশি মনে হয় না। সে এমনিই সুন্দর, এখন তাকে কিন্নরীর মতো দেখতে লাগছে। বিষাণ নার্ভাস গলায় বলল, আমার কেমন ভয় করছে।

প্রিয়দত্তা আয়ত চোখ আরও বড় করে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলল, ভয়ের কী? তুমি কি চুরি করেছ?

হলঘরের মাঝখানে দুটো পাশাপাশি কাউচ। পৃথা মিত্র তার একটায় বসে বিষাণের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিছিয়ে রেখেছেন। প্রিয়দত্তার মুখে শুনে শুনে এই ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে অনেকটাই জেনে ফেলেছে বিষাণ। প্রিয়দত্তার ঠাকুরদা বিপদভঞ্জন মিত্র দীর্ঘদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সুনামের সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছেন। দুঁদে ক্রিমিনাল ল’ইয়ার হিসেবে তাঁর নাম এখনও কোর্ট চত্বরে বলাবলি হয়। প্রিয়দত্তার বাবা ব্রতীশংকর মিত্র ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়াতেন। সেমিনার করতে বিদেশেও গেছেন কয়েকবার। তাঁর লেখা কিছু ইংরেজি বইয়ের প্রকাশক বিখ্যাত একটি পাবলিশিং হাউস। ব্রতীশংকর লাং ক্যানসারে চলে গেছেন। তাঁর লেখা বইগুলোর আজও ভালই কাটতি। ফি বছরের রয়্যালটি স্টেটমেন্ট দেখে সেটা বোঝা যায়।

পৃথা মিত্র অধ্যাপনা করেন। অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের কী একটা জটিল বিষয় নিয়ে পিএইচডি করেছেন। বয়স পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন হবে। ডাই করা চুল। টকটকে গায়ের রং। টিকালো নাক। পাতলা ঠোঁট। এককালে সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। সাজসজ্জায় বনেদিয়ানার ছাপ। ঘি রংয়ের তসরের শাড়ি পরেছেন। শাড়িটার পাড় কালো সুতো দিয়ে তৈরি। সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখে আঁচ করা যায় শাড়িটি বহুমূল্য। গলায় সরু হারের পেনডান্ট। আঙুলে হিরের আংটি। সৌন্দর্য আর আভিজাত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর মধ্যে। জন্ম দিয়েছে ব্যক্তিত্বপূর্ণ গাম্ভীর্যের। ভদ্রমহিলা বললেন, তোমাকে তুমি করেই বলছি। বোসো।

বিষাণ উল্টোদিকের সোফায় বসতে বসতে বলল, না না ঠিক আছে। তুমি করেই বলবেন।

পৃথা মিত্র মেয়ের উদ্দেশে বললেন, তুই যা। ওর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে আয়।

বিষাণ বলল, আমি এখন কিছু খাব না। বাড়ি থেকে একটু আগেই খেয়ে বেরিয়েছি।

কথাটা সত্যি নয়। বিষাণ ছুটির দিন বেলা অবধি ঘুমোয়। ব্রেকফাস্ট স্কিপ করে প্রায়ই। একবারে লাঞ্চ। উইকেন্ডে চারটের আগে তার খাওয়া হয় না। আজ শনিবার হলেও তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। তাদের শরিকি বাড়ি। পেছনদিকে জায়গা আছে বেশ খানিকটা। দুটো নারকেল গাছ ছাড়াও জামরুল, কামরাঙা, লিচু আর পেয়ারা গাছ আছে। বিষাণের ঠাকুরদার নিজে হাতে লাগানো। সব ক’টা গাছে এত ফল হয় যে, খেয়ে শেষ করা যায় না, অর্ধেকটাই দিয়ে দিতে হয় পাড়াপ্রতিবেশীদের। ছুটির দিন দুপুরে ভাত খেয়ে গাছের ছায়ায় ইজিচেয়ারে বসে আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়ে বিষাণ। এটা তার প্রিয় একটা শখ। আজ সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানে গিয়ে কাগজ মুখস্থ করে ফেলার পরও বিষাণ দেখল হাতে অনেকটা সময় আছে। বারোটার মধ্যে স্নান সেরে খেয়ে নিয়েছিল সে। সেই খাওয়া হজম হয়ে গেছে কখন। কিন্তু ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে বলে খিদের বোধ তার নেই।

পৃথা মিত্র বললেন, চা খেতে আপত্তি নেই তো? বিষাণ কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা ইশারা করলেন মেয়েকে। পরিচারক দাঁড়িয়ে ছিল আড়ালে। প্রিয়দত্তা তার কাছে গিয়ে কিছু নির্দেশ দিয়ে ফিরে এল। পৃথা মিত্র মেয়ের উদ্দেশে বললেন, তুমি বোসো। তোমার এখানে থাকা দরকার।

প্রিয়দত্তা বসল তার মায়ের পাশের কাউচে। পৃথা মিত্র বললেন, তোমরা তো এক অফিসে কাজ কর। সেখানেই আলাপ?

বিষাণ ঘাড় নাড়ল। সে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। প্রিয়দত্তাও তাই। ‘ইস্ট ফেস’ নামে একটা মাল্টিন্যাশনাল ইনসুরেন্স কোম্পানিতে বিষাণ ডেটা ম্যানেজার। রাজারহাটে অফিস। সে ডেস্কে বসে। তার পাশের কিউবিকলেই বসে প্রিয়দত্তা। এই কোম্পানির ক্লায়েন্ট আমেরিকার ইস্ট কোস্টের মানুষজন। তাদের পরিষেবা দেওয়াই ইস্ট ফেস-এর কাজ। কর্মীদের নাইট শিফট করতে হয় পালা করে। অফিসের পুলকার কর্মীদের আনা-নেওয়া করে।  

বিষাণের বাড়ি বেলেঘাটা জোড়ামন্দিরে। প্রিয়দত্তা ফুলবাগানের মেয়ে। বিষাণ আইটি ইঞ্জিনিয়ার। এই কোম্পানিতে ঢুকেছে দু’বছর আগে। আগে অন্য কোম্পানিতে ছিল। এখানে প্রিয়দত্তা এসেছে বছরখানেক হতে চলল। গত ছ’মাসে ঘন হয়েছে দুজনের সম্পর্কের রসায়ন। প্রিয়দত্তা ছটফটে স্বভাবের মেয়ে নয়। ধীর স্থির। কথা বলে মার্জিত ভঙ্গিতে। ইস্ট ফেস-এ সুন্দর মুখের মেয়ে যে আর নেই তা নয়, বিষাণের সেকশনেই আছে। তবে প্রিয়দত্তার সৌন্দর্যের মধ্যে একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে যা তাকে স্বকীয়তা দিয়েছে। বিষাণের এমনই পছন্দ। বিয়ে করতে হলে এমন মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়।

কিন্তু প্রিয়দত্তা কী ভাবে তাকে নিয়ে? বিষাণ জানে না। সে নিজের কথা সবটাই জানিয়েছে প্রিয়দত্তাকে। তার বাবা পোস্টমাস্টার ছিল, মা সরকারি অফিসে ক্লারিকাল পোস্টে আছে। দিদির বিয়ে হয়েছে দুর্গাপুরে। জামাইবাবু ফুড সাপ্লাইয়ের ইন্সপেক্টর। অফিসের পুলকার বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় কর্মীদের এক এক করে নামাতে থাকে। শেষে থাকে তারা দুজন। প্রিয়দত্তাকে গাড়ি প্রথমে ড্রপ করে, শেষে তাকে। সেই সামান্য সময়টুকুর জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকে সে। কিন্তু প্রিয়দত্তা সম্বন্ধে বিষাণ ততটুকুই জেনেছে যতটুকু সে তাকে জানিয়েছে। প্রিয়দত্তার বাবা, মা আর ঠাকুরদা যে মানী মানুষ সেটুকু জানত সে। তার যে সাত বছর আগে বিয়ে হয়েছিল, বিয়েটা টেঁকেনি, বিশ্বরূপ যে আর বেঁচে নেই সেসব প্রিয়দত্তাই তাকে জানিয়েছে। বিষাণ এ-ও জানে, বিশ্বরূপের বাড়ি গুয়াহাটিতে। তার বাবা-মা ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। গণেশগুড়িতে মামাবাড়িতে থেকে সে মানুষ। পড়াশোনায় তুখোড় ছিল বিশ্বরূপ। গুয়াহাটি আইআইটি থেকে পাশ করে সে ভাল জায়গায় চাকরি পেয়ে যায়। দিল্লিতে পোস্টিং। ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট থেকে তার বিয়ে হয় প্রিয়দত্তার সঙ্গে।

প্রিয়দত্তা ছাত্রী খারাপ ছিল না। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বেরোতে না বেরোতেই তার বিয়ে হয়ে যায়। প্লেসমেন্টে বসেনি। ভেবেছিল পকেটে ডিগ্রির কাগজটা থাকলে চাকরি জুটে যাবে ঠিক। বিয়ের পর প্রিয়দত্তা চলে যায় দিল্লি। বসন্তবিহারে একটা ফ্ল্যাটে থাকত তারা। দামি গাড়ি কিনেছিল বিশ্বরূপ। উইকেন্ডে দুজন চলে যেত বেড়াতে। কোনও হোটেল বা হলিডে হোমে দু-এক রাত কাটিয়ে পরদিন ফিরে আসত তারা। প্রিয়দত্তা ফরমান জারি করে দিয়েছিল বাড়িতে মদ খাওয়া চলবে না। যেদিন তারা বাইরে নিশিযাপন করত, সেদিন দু-আড়াই পেগ মদ খেত বিশ্বরূপ। ইচ্ছে হলে কখনও সখনও সঙ্গ দিত প্রিয়দত্তাও। তাদের দাম্পত্যের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না।  

দুজনের সম্পর্ক ঝাঁকি গেল বিয়ের বছরখানেক পর। বিশ্বরূপ মুটোতে শুরু করল হঠাৎ। ছেষট্টি থেকে কয়েক মাসের মধ্যেই পৌঁছে গেল আটাত্তর কেজিতে। দুশ্চিন্তায় পড়ল বিশ্বরূপ। কী হল? খারাপ কিছু নয় তো? ডাক্তার দেখিয়ে নানারকম টেস্ট করানো হল। থাইরক্সিন হরমোনের গণ্ডগোল ছাড়া প্রায় সব রিপোর্টই নর্মাল। ডাক্তারবাবু বললেন বিশ্বরূপকে বাড়তি ক্যালরি খরচ করাতে হবে। খাওয়া-দাওয়া কনট্রোল করলেই শুধু হবে না, এক্সারসাইজ করতে হবে রোজ। অফিসের কাছে একটা জিম ছিল। সেখানে জয়েন করল সে। অফিস থেকে বেরিয়ে জিমে ঘাম ঝরিয়ে বাড়ি ফিরত বিশ্বরূপ। তখন কি প্রিয়দত্তা জানত এটাই কাল হয়ে দাঁড়াবে তাদের দাম্পত্যজীবনে?

জিম ইন্সট্রাক্টর শ্যারন রডরিগজ গোয়ানিজ মেয়ে। ডিভোর্সি। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। জিমে গিয়েই শ্যারনের সঙ্গে আলাপ বিশ্বরূপের। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা। আগে জানত না, পরে জেনেছিল প্রিয়দত্তা। কয়েক মাস পর থেকে অফিস ট্যুরের নাম করে বাইরে যেতে শুরু করল বিশ্বরূপ। প্রিয়দত্তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিচ্ছিল এসব বড় দুর্যোগের আভাস। কিন্তু কাকে বলবে তার সন্দেহের কথা? রাশভারী মায়ের কাছে বলতে দ্বিধা হয়। বিশ্বরূপের মামি মারা গিয়েছিলেন আগেই। মামার সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল, তাঁর স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। প্রিয়দত্তার বেস্টফ্রেন্ড বলে কেউ নেই। আত্মীয়স্বজনরা বাইরে বাইরে। যারা আছে তাদের সঙ্গে মাখামাখি নেই। ফলে মনের কথা মনের ভেতরই রেখে দিচ্ছিল সে।

শ্যারনের বানিয়ে দেওয়া ডায়েট চার্ট অনুযায়ী কার্বোহাইড্রেট খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বরূপ। সবজিসেদ্ধ আর সেদ্ধ ডিমের সাদা অংশটুকু শুধু খেত। সঙ্গে প্রোটিন পাউডার, আরও কী কী। সকালে ওটস কিংবা ডালিয়া আর চব্বিশটা সেদ্ধ ডিম খেত। দু’ডজন ডিমের খোসা ছাড়াতে হত প্রিয়দত্তাকে। আঙুল অবশ হয়ে যেত খোসা ছাড়াতে গিয়ে। ভেঙে যেত নখ। শ্যারনের সঙ্গে সম্পর্কটা যখন দানা বাঁধছে সে সময় বিশ্বরূপ শ্যারনের সঙ্গে কথা বলত স্নানঘরে গিয়ে কলের জল ছেড়ে। পরের দিকে সেই রাখঢাক আর থাকল না। সোশাল মিডিয়ায় দুজনের ছবি মাঝেমাঝেই পোস্ট করতে শুরু করল শ্যারন। কিছুদিন অগ্রাহ্য করার পর আর পারল না, শ্যারনকে স্টক করতে শুরু করল প্রিয়দত্তা।

উইকেন্ড স্পেন্ড করতে বাইরে যাওয়ার পাট চুকেছিল আগেই। এবার ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে অশান্তি শুরু হল দুজনের মধ্যে। অফিস ট্যুরের নাম করে তিনদিন বাইরে কাটিয়ে বাড়ি ফিরল বিশ্বরূপ। সে যখন জুতোর ফিতে খুলছে প্রিয়দত্তা তার সামনে এসে দাঁড়াল। পাথুরে গলায় জিজ্ঞেস করল শ্যারন তার সঙ্গে গিয়েছিল কি না। বিশ্বরূপ অবাক হবার ভান করে বলল, ও হঠাৎ আমার সঙ্গে যেতে যাবে কেন? প্রিয়দত্তা মুখে কিছু না বলে মোবাইল বের করে শ্যারনের আগের দিন সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একটা ছবি দেখাল। গুলমার্গে শ্যারন আর বিশ্বরূপের হাসিখুশি অন্তরঙ্গ ছবি। বিশ্বরূপের চোয়াল শক্ত হল। খরচোখে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল প্রিয়দত্তার দিকে।

স্বামী স্ত্রী শুতে শুরু করল আলাদা ঘরে। কেজো কথার বাইরে কথা হত না সেভাবে। এক সকালে বিশ্বরূপ চা খেতে খেতে ক্যাজুয়াল গলায় প্রিয়দত্তাকে বলল, দেড় কোটি টাকা ইনভেস্ট করে গ্রেটার নয়ডায় একটা জিম খুলতে চলেছে সে। শ্যারন তার বিজনেস পার্টনার। ট্রেনার হিসেবে পল কার্টারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাকে সাধ্যসাধনা করে রাজি করিয়েছে শ্যারন। এটা ক্লিক করে গেলে অন্য মেগাসিটিতেও জিম খুলবে তারা। তার পর তাদের ছুটে বেড়াতে হবে এক শহর থেকে অন্য শহরে। চাকরি করে এই দৌড়ঝাঁপ সম্ভব নয়। তাই চাকরিটা গত সপ্তাহে ছেড়ে দিয়েছে সে। প্রিয়দত্তা চাইলে এই ফ্ল্যাটে থাকতে পারে। ইচ্ছে করলে কলকাতা ফিরে যেতে পারে। কোনওটাতেই তার আপত্তি নেই।  

প্রিয়দত্তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। না পেরে ফোন করেছিল বাড়িতে। পৃথা মিত্র স্খলিত গলায় তাকে বললেন বাড়ি ফিরে আসতে। এক ট্র্যাভেল এজেন্টকে দিয়ে দেড়গুণ বেশি ভাড়ায় ফ্লাইটের টিকিট কাটানো হল। একটা ট্রলিতে টুকাটাকি কিছু জামাকাপড় আর কাজের জিনিস নিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা উড়ে এল প্রিয়দত্তা। দ্বারস্থ হল এক চেনা ল’ইয়ারের। বিশ্বরূপ আইনি লড়াইতে গেল না। ছ’মাসের সেপারেশন পর্ব চলার পর সই করে দিল ডিভোর্স পেপারে। মোটা অংকের অ্যালিমনি দাবি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট। সেই প্রস্তাবে পৃথা মিত্র বা প্রিয়দত্তাকে তিনি রাজি করাতে পারলেন না।   

প্রিয়দত্তা কয়েক জায়গায় সিভি পাঠাল, ইন্টারভিউ দিল কিছু। মাস ছয়েকের মাথায় ওয়াক ইন ইন্টারভিউ দিয়ে ঢুকে পড়ল ইস্ট ফেস-এ। সেখানেই বিষাণের সঙ্গে তার পরিচয়। সেই আলাপ ক্রমশ গাঢ় হল। বিষাণের চোখের ভাষা পড়তে অসুবিধে হয়নি প্রিয়দত্তার। বিষাণের চেহারাই যে শুধু পুরুষালি তা নয়, সে সৎ, দায়িত্ববান ও নির্ভরযোগ্য ছেলে। প্রিয়দত্তা নিজের সম্বন্ধে কিছুই লুকোয়নি, সব কথাই বলেছিল বিষাণকে। বিশ্বরূপের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর সে যখন মানসিক ভাবে থিতু হচ্ছে সেই দিনের ঘটনাটার কথাও বলতে দ্বিধা করেনি। তার মনে হয়েছিল বিষাণের সবটাই জানা উচিত।  

ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারের মাঝের সময়। বেশ কুয়াশা পড়েছিল কলকাতায়। পৃথা মিত্র ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছেন রাত ন’টার মধ্যে। তখন রাত প্রায় এগারোটা। গেটের বাইরে থেকে সোরগোল ভেসে আসছিল। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রিয়দত্তা। কুয়াশায় ভাল দেখা যাচ্ছিল না, তবে বোঝা যাচ্ছিল দারোয়ানের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছে কোনও মদ্যপ। গলার আওয়াজটা চেনা। কুয়াশার আড়াল সরে যেতেই চমকে উঠেছিল প্রিয়দত্তা। রংচটা জিনস, ছেঁড়া জ্যাকেট পরা বিশ্বরূপ দাঁড়াতে পারছে না ঠিক করে। মাথার চুল উঠে গেছে অনেক। রোগা হয়ে গেছে খুব। বিশ্বরূপ দেখতে পেয়েছিল প্রিয়দত্তাকে। দারোয়ানকে ঠেলে সরিয়ে ছুটে এসেছিল সামনে। ব্যালকনিতে দাঁড়ানো প্রিয়দত্তাকে দেখে অসহায় গলায় চিৎকার করে উঠেছিল, দত্তা, প্লিজ আমার কথা শোনো, শ্যারন আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।

চোখের পলক পড়ছিল না প্রিয়দত্তার। স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল বিশ্বরূপের দিকে। কলকাতা ফিরে এসে যার সর্বনাশ সে প্রতিনিয়ত কামনা করে এসেছে সেই বিশ্বরূপের প্রতি প্রিয়দত্তার প্রেম ভালবাসা তো পরের কথা, দয়া, মায়া, মমতা বা অনুকম্পার বোধ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। দারোয়ান চলে এসেছিল হন্তদন্ত হয়ে। অপেক্ষা করছিল মালকিনের নির্দেশের। প্রিয়দত্তা তাকিয়ে ছিল তার প্রাক্তন স্বামীর দিকে। বিশ্বরূপের নাক দিয়ে সিকনি গড়াচ্ছিল। জ্যাকেটের হাতায় ঘষছিল মুখ। জড়িয়ে জড়িয়ে বলছিল, তিনটে মেগাসিটিতে জিম খুলব বলে এগারো কোটি টাকা লোন নিয়েছিলাম আমি আর শ্যারন। আমিই ছিলাম গ্যারান্টার। পল কার্টারের সঙ্গে যে শ্যারন তলে তলে সাঁট করেছে সেটা ধরতে পারিনি। সব টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার করে লন্ডনে পালিয়ে গেছে শ্যারন আর পল। দত্তা, বিশ্বাস করো, আমি এখন পথের ভিখিরি।

দারোয়ান ধাক্কা দিতে দিতে বের করে দিয়েছিল বিশ্বরূপকে। টলতে টলতে কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল বিশ্বরূপ। সে রাতে মুখে ভাত তুলতে পারেনি প্রিয়দত্তা। সকালে সব বলেছিল পৃথা মিত্রকে। কপালে ভাঁজ ফেলে তার মা গুম মেরে গিয়েছিলেন। ফোন করে পরামর্শ নিয়েছিলেন এক চেনা অ্যাডভোকেটের। দুদিন বাদে এক সন্ধেবেলা আবার মিত্র ম্যানসনের সামনে এসে হাজির হয়েছিল বিশ্বরূপ। একসময়ের বউয়ের সঙ্গে সে দেখা করতে চায়। সামনাসামনি ক্ষমা চাইতে চায়। সেদিনও তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল বাড়ির বাইরে।

কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। বিশ্বরূপ গুয়াহাটিতে বড় হওয়া ছেলে। কলকাতায় তার আত্মীয়স্বজন নেই। সে সারাদিন কোন চুলোয় থাকত কে জানে কিন্তু সন্ধে হলেই প্রিয়দত্তাদের বাড়ির দরজায় এসে হানা দিতে শুরু করল। মুখে মদের গন্ধ, হতশ্রী দশা, উস্কোখুস্কো চুল। তার বয়স এই ক’দিনে যেন কুড়ি বছর বেড়ে গেছে। যতবার সে আসে, দারোয়ান তাকে গেটের বাইরে বের করে দেয়। রাস্তার লোক জুটে যায়। বিড়ম্বনার একশেষ। দু-চারদিন বাদে বিশ্বরূপ গলা অবধি মদ খেয়ে এল একদিন সাতসকালে। বাড়ির ভেতরে সে ঢুকবেই। বাইরে থেকে প্রিয়দত্তার নাম ধরে ডাকাডাকি করছিল। পথচলতি লোক কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল রাস্তায়। সেদিন দারোয়ানের সঙ্গে তার প্রথমে ঝগড়া, পরে হাতাহাতি হল। অন্য দিনের মতোই দারোয়ান ঠেলে সরিয়ে দিতে গিয়েছিল তাকে। সেদিন ধাক্কাটা একটু বেশিই জোরে হয়ে গিয়েছিল। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বিশ্বরূপ। মাথাটা পড়েছিল শক্ত পাথরের ওপর। রক্তপাত হয়নি খুব একটা, কিন্তু বিশ্বরূপের মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হতে থাকল। চোখের তারা একেবারে স্থির।

শ্বশুরবাড়ির তরফের কারওর সঙ্গেই প্রিয়দত্তার আর যোগাযোগ নেই। বিয়ের পর পরই প্রিয়দত্তা চলে গিয়েছিল দিল্লি। সেখানে থাকতে থাকতেই শুনেছিল তার মামিশাশুড়ি মারা গেছেন। মামা সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে এখন স্মৃতিহীন এক মানুষ। বিশ্বরূপ এতদিন কলকাতার কোথায় ছিল কিছুই জানা নেই প্রিয়দত্তার। বিশ্বরূপের পকেট ঘেঁটে খুচরো কিছু টাকা আর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কিছুই পেল না দারোয়ান। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলেন না পৃথা মিত্র। মাথা কাজ করছিল না প্রিয়দত্তারও। এক ছাদের তলে থাকার সময় তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছে বিশ্বরূপ। তার গায়ে হাত অবধি তুলেছে। কিন্তু এমন মৃত্যু কি কাম্য ছিল মানুষটার? এলাকার কাউন্সিলরকে ফোন করলেন পৃথা মিত্র। তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সহৃদয় মানুষ। তিনি ফোনাফুনি করে দলের ছেলেদের জড়ো করলেন। অ্যামবুল্যান্স এল। স্ট্রেচারে তোলা হল তাকে। হাসপাতালে নিতে নিতেই মারা গেল বিশ্বরূপ। পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করা হল চটজলদি। বিকেলের দিকে বিশ্বরূপের শবদেহ হাসপাতাল থেকে মিত্র ম্যানসনে নিয়ে আসা হল। ছোটখাট ভিড় জমে গেল শবদেহ ঘিরে। পৃথা মিত্র দারোয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলেন শবদেহ সৎকার বাবদ কিছু টাকা। নিমতলা শ্মশানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বিশ্বরূপের নশ্বর শরীর। এই সব গল্পই বিষাণের কাছে একাধিকবার করেছে প্রিয়দত্তা।

চা এল। শব্দ না করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন পৃথা মিত্র। বিষাণের উদ্দেশে বললেন, প্রিয়দত্তার যে একটা অতীত আছে, আই মিন টু সে বিশ্বরূপের ব্যাপারটা, সেটা তুমি নিশ্চয়ই জেনে গেছ? তারপরও কি তুমি এগোতে চাও?

প্রিয়দত্তা নিজের নখ জরিপ করছে। বিষাণ স্বীকারোক্তি করার মতো করে অস্ফুটে বলল, আমি ওকে ভালবাসি।

পৃথা মিত্র প্লাস্টিক হাসি হেসে বললেন, ভালবাসতেই পার, তাতে কোনও অন্যায় নেই। কিন্তু জেনে রেখো, বিয়ে করার দায়িত্ব অনেক বড় ব্যাপার। তোমার বয়সে আবেগের চশমা দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে মানুষ। কিন্তু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা তোমার চাইতে বেশি। টেক ইট ফ্রম মি, এখনই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিও না। একটা সেকেন্ড থট দাও। বাড়ি যাও। বাড়ির বড়দের পরামর্শ নাও। তার পর তোমার মতামত জানাও। প্রিয়দত্তা একবার ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে দিয়ে গেছে। আমি চাই না ও নতুন করে কষ্ট পাক।

আজ রবিবার। বেলা অবধি ঘুমোনোর কথা ছিল। কিন্তু এপাশ ওপাশ করেই রাত কেটেছে। ঘুম হয়নি ভাল। ভোরবেলা উঠে পড়ল বিষাণ। খবরের কাগজ এখনও দেয়নি। দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির পেছন দিকের বাগানে এল বিষাণ। ছানার জলের রঙের ভোর। শীতের মরশুম আসছে। গাছগুলোর বিবর্ণ পাতারা খসে পড়ছে টুপটাপ করে। সব গাছের গোড়ায় বাদামি পাতার স্তূপ। হাওয়া দিচ্ছে। শিরশির করছে গা। হঠাৎ কামরাঙা গাছতলায় বিষাণের চোখ আটকে গেল। বাদামি পাতার ভিড়ে উঁকি মারছে একটা সবুজ পাতা। হেমন্তকালে গাছ কি নতুন পাতা ছাড়ে? ঝুঁকে পাতাটা কুড়িয়ে নিল বিষাণ। নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকল। কামরাঙা পাতার বনজ ঘ্রাণ তাকে পৌঁছে দিল মিত্র ম্যানসনের হলঘরটায়।

প্রিয়দত্তাদের বাড়ির হলঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছিল বেশ কিছু সিপিয়া টোনের পারিবারিক ছবি। তার মধ্যে একটা ফোটো কাল আলাদা করে চোখ টেনেছিল তার। সেই ছবিটা, যাতে বিশ্বরূপের শবদেহ শোয়ানো ছিল মিত্র ম্যানসনের লনে। ইংরেজি ‘সি’ অক্ষরের আকার নিয়ে মৃতদেহ ঘিরে ছোট একটা ভিড়। পৃথা মিত্র দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানে। প্রিয়দত্তা বলেছিল তার কথায় দারোয়ান বিশ্বরূপকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কি প্রিয়দত্তার সায় ছিল? সেই ফোটোটা কি সে কথা বলছে, যে ছবিতে বিশ্বরূপের একটা আঙুল তার নিজের আঙুলে জড়ানো, প্রাক্তন স্বামীর মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়েছে আলুথালু পোশাকের প্রিয়দত্তা, কেঁদে আকুল দু’চোখ?

মানুষের মনের তল পাওয়া মুশকিল। দাম্পত্যজীবনের ওপর দিয়ে তুলকালাম ঝড় বয়ে যাওয়ার পরও প্রিয়দত্তা যে বিশ্বরূপকে গভীরভাবে ভালবাসত তা স্পষ্ট সেই ছবিতে। বিশ্বরূপ যতই শারীরিক আর মানসিক আঘাত দিক তাকে, যতই প্রবঞ্চনা করুক, দুজনের বৈবাহিক সম্পর্কের যতই অবনতি হোক, প্রিয়দত্তা হয়তো তার পরও চেয়েছিল বিশ্বরূপ ফিরে আসুক তার কাছে। কামরাঙা গাছের গোড়ায় জমে থাকা বিবর্ণ পাতাদের ভিড়ে এই সবুজ পাতাটা আলাদা করে নজর কাড়ছে বিষাণের। গতকাল যেমন সিপিয়া রংয়ের ছবিগুলোর মধ্যে তার চোখ টেনে নিয়েছিল সেই ফোটোটা, যে ছবিটা রঙিন হয়ে আছে ভালবাসার অমল আলোয়।

একটা সেকেন্ড থট দিতে বলেছিলেন পৃথা মিত্র। খুব ভুল বলেননি। কারণ এতদিন পর্যন্ত বিষাণের বিশ্বাস ছিল, বিশ্বরূপ আর প্রিয়দত্তার নষ্ট দাম্পত্যে প্রিয়দত্তা যত তিক্ততার মুখোমুখি হয়েছে সেসবের পর বিশ্বরূপের প্রতি আর কোনও কোমল অনুভূতি তার মধ্যে বেঁচে নেই। থাকার কথাও নয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গতকাল বিকেলে একটা সিপিয়া টোনের ছবি বিষাণের ধারণা বদলে দিয়েছে পুরোপুরি। যে ছবিটা মিত্র ম্যানসনের হলঘরের দেওয়ালে আজও ছড়িয়ে যাচ্ছে আলো।

বিষাণ প্রিয়দত্তাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালবেসেছে। এতদূর এগিয়ে আসার পর আর পিছিয়ে যাওয়া যায় না। তার প্রশ্নই নেই। কিন্তু বিষাণ মনে মনে জানবে বিয়ের পর যতবার সে আর প্রিয়দত্তা ঘনিষ্ট হতে চাইবে, ততবারই তাদের মধ্যে এসে পড়বে একজন তৃতীয় ব্যক্তি। এক বিদেহী পুরুষের অস্তিত্ব ঘুণপোকার মতো তাদের দাম্পত্যকে কুড়ে কুড়ে খাবে। সারাজীবন ধরে।




এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

6 thoughts on “short-story-badami-patar-virey

  1. এক সাধারণ গল্প হয়েই শেষ হতে যাচ্ছিল, হঠাৎ মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের জাদু আলো হয়ে উঠল। দ্বিধার কাছে আমরা কতটা ন্যুব্জ, আনত, অতিক্রমের এপাশে দাঁড়িয়ে আমরা যুক্তির আড়ালে কিভাবে আশ্রয় খুঁজে নিই, কিভাবে কখনো একটা ছোট্ট পেরেক গেঁথে যায়, যার নিঃশ্বব্দ রক্তক্ষরণ এড়িয়ে যেতে পারা যায়না ইত্যাদি নিয়ে জটিল, সূক্ষ্ম সুতোর খেলায় বুনে তোলা এক অপরূপ যেন এই গল্প। প্রখর বাস্তব, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সম্পর্কের বিবিধ রসায়নের এক নিখাদ চালচিত্র যেন এই গল্প। বিষাণ ও প্রিয়দত্তার সম্পর্ক শেষপর্যন্ত কোন কিনারে গিয়ে দাঁড়ায় – এই অসম্পূর্ণতা নিয়ে এই গল্পে লেখকের অন্যান্য লেখার মতই শব্দের সাবলীলতায় নির্মিত হয়েছে আটপৌরেয়ানা ও আভিজাত্যের অবিমিশ্র আদল। যার কাছে এসে দাঁড়াতে চায় পাঠক। আপনার পাঠক হওয়া একজন বাঙালীর কাছে কতটা গর্বের ও আনন্দের, মৃগাঙ্কবাবু, এ আপনাকে কিভাবে বোঝাই! ভালো থাকবেন।

Leave a Reply to মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *