short-story-bagal

বাগাল
সাগরিকা রায়



শীত শুরু না হতেই বৃষ্টি নেমে গেল। দুদিন ধরে অঝোর বৃষ্টিতে জল জমে গেল রাস্তায়। জমির দশা দেখে মাথা খারাপ তন্ময়ের। এখন কি বৃষ্টি হওয়া উচিত? খনা বলেছে ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ধন্য রাজা পুণ্য দেশ। এটা কি মাঘের শেষ? কত তারিখ আজ বাংলার? ধুর ছাই, এই বাংলার তারিখগুলো কোথায় থাকে যে…খবরের কাগজে পাওয়া যাবে। হুম, এই তো। কাগজ খুঁজে বের করে তারিখ দেখে চমকে উঠেছে তন্ময়। এটা তো দোসরা ফাল্গুন। তাহলে…খনা কী বলেছে… ফরফর করে পাতা উলটে চলে তন্ময়। এই যে, খনা বলেছে, ’যদি বর্ষে আগনে/রাজা যায় মাগনে…! আগন মানে অগ্রহায়ণ। চটি বইটা মেলা থেকে কিনে এনেছে তন্ময়। হাতের কাছে রাখে সবসময়। এটা তো অঘ্রাণ মাস! অঘ্রাণে বর্ষে যদি, তাহলে ভিক্ষে করে খেতে হবে? ধান হবে না জমিতে? অথচ ধান না হলে তন্ময় যে মরে যাবে!

ওর অবস্থা দেখে কুহেলি গজদন্ত দেখিয়ে হেসে সারা–সে কি গো? ধান না হলে ভিক্ষে করবে? তুমি? তাহলে কলেজে কেমিস্ট্রি পড়াবে কে?

কুহেলির হাসি ধানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ধবধবে সাদা শস্যের মত দুলতে থাকে। মুগ্ধ হয়ে কুহেলির হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়। সবুজ শাড়িতে কুহেলিকে ধান গাছের মত দেখাচ্ছে! হাসিতে হেলে দুলে উঠছে বলে কুহেলি একটা ধান গাছ এখন। দুলছে ধানের খেত! তন্ময়ের ধান খেত! বৃষ্টির জলে আনন্দে মাতোয়ারা!

মাঝে মাঝে অবাক হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকে তন্ময়! কেমেস্ট্রির লেকচারারের মধ্যে কোন রাস্তা দিয়ে চাষি হওয়ার ইচ্ছেটা ঢুকে পড়েছে, ও বুঝতেই পারেনি! বাপ–ঠাকুর্দার নাকি অনেক জমি ছিল। সে সব কবে কোন রামজন্মে চুকেবুকে গেছে! দিন পালটে গেছে। অন্যের হেল্প নিয়ে কি আর চাষ হয়? কিছুটা ধানী জমি পেয়েছিল হঠাৎ করেই। অফিস কোলিগ সুজিতের পরামর্শে কিনে ফেলেছিল আগুপিছু না ভেবে। তখন ভেবেছিল, ভালই হল। দেখভাল করতে পারবে আরামসে! কোন খাটুনি নেই। কলেজ থেকে ফিরে চায়ের কাপ নিয়ে জমিতে একপাক ঘুরে এল। নিয়ম করে দেখভাল করতে পারবে। অন্যের ওপর ভরসা করতে হবে না। অন্যের হাতের পুতুল হওয়া মানেই বোকা হয়ে থাকা। মা বলতো। বাহ, আইডিয়া ভালই তো! কুহেলিকে বলেছিল কথাটা। খনা বলেছে – বাড়ির কাছে ধান গা/যার মার আছে ছা! উৎসাহ দেখিয়েছে কুহেলি–কিনবেই যখন, কাছাকাছি হলেই তো ভাল! খনা ঠিকই বলেছে! আচ্ছা, হুঁকো চাই তো তোমার? চাষি হলে হুঁকো নিয়ে, মাথায় ভেজা গামছা ভাঁজ করে রাখতে হয় না? তন্ময় কুহেলির চিমটিটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। নিপাট ভালমানুষের চোখ তুলে জানতে চেয়েছে কুহেলি। তন্ময় প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছে – আরে না না! এখন কি সে সব চাষি আছে? সে তুমি গল্পের বইতে ছবি দেখে বলছ। এখন চাষি মানে লেখাপড়া জানা চাষি। সবাই যে, তা নয়। তবে তাদের বাড়িতে মোবাইলের ফোর জি ফান্ডা চলে। মেয়েরা লেখাপড়া জানে। ছেলেদের এগ্রিকালচার পড়াচ্ছে চাষের উন্নতি করতে!

-ওমা! তাই নাকি? কুহেলির গলার সুরে প্রচ্ছন্ন মজা খেয়াল করে থেমে গিয়েছিল তন্ময়। মনে মনে বিব্রত হয়েছিল! কুহেলি কি জমি কেনাটা পছন্দ করেনি? ও তন্ময়কে ঠাট্টা করছে!

সেদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ফুটপাথে বিছিয়ে বিক্রি করা চটি বইয়ের মধ্যে খনার বচন বইটা পেয়ে গিয়েছিল। শুনেছিল কারও কাছে, বা কোথাও হয়তো পড়েছে যে, খনার বচন বেশির ভাগই কৃষিভিত্তিক বচন। কেনার ইচ্ছেটা সেই জন্যই আরও বেশি ছিল। কুহেলির কথা মাথা থেকে উড়ে গেল চটি বইটা বের করে পড়তে বসে। এখন সুযোগ পেলেই খনার বচন নিয়ে বসে তন্ময়। এক জায়গায় এসে থমকে গেল। মানে কী এই বচনের? পূর্ণিমা অমাবস্যায় যে ধরে হাল/তার দুঃখ চিরকাল! কেন? কলেজের রায়বর্মণের প্রচুর জমি আছে। ও খানিক আন্দাজ দিয়েছে। কথাটা মনে ধরেছে তন্ময়ের। ঠিক। গাই বলদের শরীরে জোয়ার ভাঁটার টান পড়ে বলে ওরা রুগ্ন হয়ে যায়। কুহেলি বকুনি দিয়েছে – কী যে বল! তাহলে সারাবছর সবাই পূর্ণিমা-অমাবস্যায় ঘরে বসে থাকতো !

তন্ময়ের মোটেই ভাল লাগেনি কুহেলির কথা বলার ভঙ্গী। এ কী? খনা কি মিথ্যে বলবে? তর্ক করতে গিয়ে থেমে গেল কুহেলির চোখ দুটো দেখে! শ্বাস ফেলে তন্ময়। গোপনে। এই চোখ দুটোই কুহেলির সম্পদ! তন্ময়কে বধ করার বাণ! এমনভাবে বিস্ময় আর দুষ্টুবুদ্ধি নিয়ে তাকায় যে, তন্ময় নিজের নামের প্রতি অবিচার করে ফেলে। সব তন্ময়তা ভেঙে চুরে যাকে বলে চাকনাচুর! দুজনের মধ্যে প্রেম-মেঘ জমে উঠে জমাট রূপ নিচ্ছিল। বৃষ্টি হয়ে আছড়ে পড়ার মুহূর্তে বাইরে থেকে কেউ আটকে দিল – তন্ময়দা, আছেন?

ঘোর কেটে গেল। কুহেলি ভ্রু তুলে প্রশ্ন এঁকে তন্ময়কে ইশারা করল দেখতে। কে আর আসবে এখন! সোহেল এসেছে! বাইরের বারান্দায় গিয়ে সোহেলকে স্বাগত জানাতে জানাতে তন্ময়ের মনে পড়ল কুহেলি তন্ময়কে ইশারা করার সময় ভ্রু তুলেছিল। বিরক্তি বোঝাতে! তাহলে আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখে নিচ্ছিল কেন? বুকের ওপরে শাড়িটা মেলে দিচ্ছিল কেন? সোহেল এ সময় প্রায়দিন আসে। ওর স্বর অচেনা নয় কুহেলির কাছে। তাহলে প্রশ্ন চিহ্ন আঁকল কেন? তন্ময়কে লুকোচ্ছে কিছু কি?

-কি বৃষ্টি দেখেছেন? তিনদিন ধরে পড়ছে তো পড়ছে। মহাশূণ্য থেকে নেমে আসার সময় ডান বাঁ ভাবেনি! সোহেল রেইন কোট খুলে রাখল হুকে। বারান্দা জলে ভিজে চুব্বুস হয়ে আছে। পা পিছলে না যায়! সাবধানে পা টিপে হাঁটে তন্ময়। রুম স্লিপারের গ্রিপ একেবারে মসৃন হয়ে গেছে। একজোড়া রুম স্লিপার এনে রাখতে হবে।

-যা বলেছ! বাজে! আর ভাল লাগছে না!

-আর একটা ব্যাপার কি খেয়াল করেছেন? দিনে বেশ গরম পড়ছে। আজ বত্রিশ ডিগ্রি ছিল। সন্ধের দিকে বৃষ্টি নামছে গা ছেড়ে আহ্লাদী মেয়ের মত! সোহেল কথা বলতে বলতে ঘরের ভেতরে উঁকি দিল।

তন্ময় থমকে গেল। এটা কিন্তু ঠিক বলেছে সোহেল। খনা বলেছে – দিনে রোদ, রাতে জল/দিনে দিনে বাড়ে ধানের বল। মানে এখন বৃষ্টি হওয়া ভাল, এবং এভাবেই হওয়া ভাল! আচ্ছা!

-সত্যি, কি বিশ্রি লাগে এই বৃষ্টি! কুহেলির গজদন্ত চিকমিক করে।

তন্ময় আর্তনাদ করে ওঠে – কী অজ্ঞের মত কথা বল? এসব বোলো না! বৃষ্টি হোক। হোক।

চমকে উঠল ওরা দুজনে। একই সঙ্গে চমকাল বিদ্যুতের মত। সোহেল অবাক চোখে তন্ময়ের দিক থেকে কুহেলির দিকে তাকাল। ঘরের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল।

-মানে? সোহেল দাঁড়িয়ে পড়েছে।

-মানে…এখন বৃষ্টি চাই বুঝলে সোহেল। মানে বলছি দিনে রোদ, রাতে জল …হা হা হা!

-বুঝলেন না? আপনার তন্ময়দা ওর ধানের ক্ষেতের কথা ভাবছে। খনা আওড়াচ্ছে বুঝলেন? কুহেলি হাসলেও ছিটকে ওঠা বিরক্তি আটকাল না – আসুন, ভেতরে, পা মুছে নেবেন? তোয়ালে দেবো? ওদের চলে যাওয়া, কথার টুকরো টুকরো চিকমিক দেখল তন্ময়। ওরা ভেতরে ঢুকে যেতেই ভেজা বারান্দায় খুব একা হয়ে গেল তন্ময়। তোড়ে নেমেছে বৃষ্টি। ধোঁয়াটে হয়ে উঠছে চারপাশ। গা ভিজে যাচ্ছে তন্ময়ের। ধানের গাছগুলো এই বৃষ্টিতে কেমন মজা করে ভিজছে ভাবতেই এক মাঠ সবুজ গাছের নেচে ওঠা দেখতে পেল তন্ময়। শরীর উন্মুক্ত করে মেঘ ভাঙা জলে ভিজছে ধান গাছ। তন্ময়ের গাছ।

-এইই, ভেতরে এস। চা হয়ে গেছে। কুহেলির রিনরিনে গলা জলের ভেতর দিয়ে সাঁতার কেটে কেটে আসছে বারান্দায়। তন্ময়ের কাছে। তন্ময় ভিজে শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকে সোহেলকে দেখল। সোফায় শরীর ছেড়ে বসে আছে। তন্ময় একটু হাসল – ঘুরে আসছি ওয়াশরুম থেকে। ভিজে গেছি। ভিজে পা চেপে চেপে হাঁটছিল তন্ময়। একবার স্লিপ করলে বড়দিদার মত দশা হবে। দশমাস কোমর ভেঙে ‘বিছানায় শয্যাশায়ী’। বড়দিদা এই রকমই বলতো। বাসন্তী মাসিমা বলতো ‘বিছানায় শয্যা’। আর কে যেন বলতো ‘আত্মা খাঁচা’। আত্মারাম খাঁচাছাড়া বোঝাতে এমনভাবেই বলতো …! কি জানি, মনে পড়ছে না!

-এইই, কী হল? চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছেএএ। কুহেলির মেজাজ খুশ আছে মনে হচ্ছে। তন্ময় তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসে। চায়ের সৌরভ ঘরের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মকাইবাড়ি। কুহেলির মামা নর্থবেঙ্গলে থাকেন। মাঝে মাঝে চা আসে বাড়িতে সৌরভ নিয়ে।

পাপোষে পা মুছতে মুছতে তন্ময় বৃষ্টির গন্ধ নিল নাক ভরে। এখন বৃষ্টি হয়ে ভালই হল। ধানের দয়ে পোকা বৃষ্টিতে আক্রমণ করে উঠতে পারবেনা। নাহলে পাতার রস খেয়ে হলুদ করে দিত। একটু একটু পোকা আছে গাছে, দেখেছে তন্ময়। তেমন কিছু গাছ তুলে ফেলেছে গজেনের উপদেশে। গজেন ধানি-চাষি। নিজের জমি ছিল। কখন যে হাতছাড়া হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি বেচারা। এখন অন্যের জমিতে বাগাল খাটে।

-কি গো? ওয়াশরুমে কি খনার বচন পড়ছ? কুহেলি স্বাভাবিক সুরে কথা ছুঁড়ে দিল। সোহেল কিছু জানতে চাইছে কুহেলির কাছে। কী আর জানতে চাইবে! তন্ময়ের খনা নিয়ে আগ্রহ, কুহেলি মিষ্টি করে সুর করে সেগুলো বলবে ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ…ধন্য রাজা পুণ্য দেশ।’

তন্ময় ঢুকতেই সোহেল আগ্রহ নিয়ে তাকাল – তন্ময়দার ধানের খবর কী? এখন বৃষ্টি হলে তো ভাল হয় বলে শুনেছি আমার ঠাকুমা বলতো খনার বচন। দাঁড়ান, মনে করছি – উমম, ষোল চাষে মুলা/তার অর্ধেক তুলা/তার অর্ধেক…স্যরি ভুলে গেছি …! সোহেল অপ্রস্তুত।

-তার অর্ধেক ধান/বিনা চাষে পান। তন্ময়ের মন ভাল হয়ে গেছে। অন্তত কেউ তো তন্ময়ের মন ভিজে যাওয়ার মর্মটা বুঝল। আজকের বৃষ্টির মর্মটা বুঝল! ধান গাছের আনন্দটা বুঝল! কুহেলি কখনই জানতে চায়না তন্ময়ের ধান নিয়ে। খনাকে নিয়ে।

-সে কি? তুমিও জান? আমিও শিখব! আদুরে গলা কুহেলির। সোহেলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফোলাল কিশোরীর মত।

তন্ময় কুহেলির মুখটা দেখছিল চা খেতে খেতে। কেমন তাজা, চকচকে মুখ। দেখে বোঝাই যায়না দয়ে পোকা লেগেছে কিনা। মাজরা পোকা লেগেছে কিনা! কেবল আগাছা আর আগাছার ছায়া দুলছে।

-হেল্প কর একটু, আমি তো যাকে বলে নবিস! তাছাড়া…

-তাছাড়া খনা কি অন্যের হেল্প নিতে বলেছে কোথাও?

সরল মুখ কুহেলির।

-বলেছে তো! বাপ বেটাই চাই/তার অভাবে ছোটভাই।

হা হা হেসে ওঠে সোহেল। কুহেলি হাসতে গিয়ে থেমে সোহেলকে দেখছে। তীব্র পুরুষালি দমক আছে সোহেলের মধ্যে। কুহেলি মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে চোখ নামিয়ে নিল।

-বৃষ্টি কি থেমেছে? হাসি থামিয়ে বাইরের দিকে ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করছে সোহেল। তন্ময় উঁকি দিল। একটু কমে এসেছে তোড়। সোহেল দেরি করল না। রেইনকোটের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। কুহেলি মন খারাপ করা গলায় বলল – কাল এসো! তখনই তন্ময় কুহেলির মন জুড়ে বৃষ্টি-পতনের আওয়াজ পেল। খুব বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে কুহেলি। কে জানে সোহেলও ভিজছে কিনা!

খনা ঠিক বলেছে। জন্ম মৃত্যু বিবাহ/তিন না জানে বরাহ! তন্ময় শ্বাস ফেলে। কে জানে গজেনের মত ও-ও অন্যের জমিতে বাগাল খাটছে কি না!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *