তন্ময় সরকার
জীবনের একটি নির্ঝঞ্ঝাট দিন কাটিয়ে সদ্য পরের দিনটি শুরু করেছেন শৈবাল মজুমদার, পার্টির নেতা সুবীর দত্ত হাঁকতে-হাঁকতে জংধরা গেট খুলে ঢুকল। পিছনে সাড়ে তিনখানা মানুষের মতো দেখতে জঞ্জাল।
‘শৈবালদা, একটু বেরোবেন, দরকার ছিল।’
সকাল-সকাল এ কী উৎপাত! নেতাগোতা দেখলে এমনিতেই শৈবালের গা ঘিনঘিন করে। আর সুবীর দত্তকে দেখলে তার দশগুণ। কারণ বাজারে এই নেতাটির কোনও স্ক্যান্ডেল নেই। তার মানে এর চিটিংবাজি আর চুরি-ছ্যাঁচড়ামির বুদ্ধি এতটাই সূক্ষ্ম যে, কেউ তা ধরতে পারে না!
‘কী হয়েছে, বলো,’ বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন শৈবাল।
‘জানেনই তো চারিদিকের কী অবস্থা। এরা মুন্সীপাড়ার বিলে থাকত। ঘরবাড়ি এখন আর কিছু নেই। গলে-ধুয়ে গ্যাছে সব। ক’টা দিন আপনার এখানে থাকবে। জল নামলেই চলে যাবে।’
ক্ষমতার দম্ভে একটি কথার নির্দেশনামা রেখে চলে গেল সুবীর দত্ত। আর সেই নির্দেশনামার বলে দু’টি বিরাট বোঁচকা নিয়ে সাড়ে তিনজন মানুষ বন্যার জলের মতো উঠে এল শৈবাল মজুমদারের পৈতৃক ভিটের বারান্দায়।
কুলকুল করে জল উঠছে। রাস্তা ভাসিয়ে, ব্রিজ ধসিয়ে আর ঘরবসত ডুবিয়ে। বিষময় টনটনে ফোঁড়া থেকে যে-রকম গলগলিয়ে পুঁজরক্ত উদ্গিরিত হয়, সে-রকম বুড়বুড়িয়ে পচা, ঘোলা আর দুর্গন্ধময় জল ঠেলে উঠছে চতুর্দিকে। প্রতিবছরই কাগজে, টিভিতে আর রেডিয়োয় এখানে-সেখানে বন্যার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু এ-বারের মতো বন্যার অভিজ্ঞতা এ-এলাকার মানুষের স্মরণকালে হয়নি।
দশদিক জলমগ্ন। শুধু দ্বীপের মতো জেগে আছে জহরথুবা শহরতলি। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে পোকামাকড়, সাপ-খোপ, কুকুর-বিড়াল, গোরু-ছাগলের সঙ্গে কিলবিল করে উঠে আসছে মানুষ। ভরে ফেলছে কলেজ, স্কুল, ক্লাবঘর, রেল স্টেশন। এইসব সামাজিক অবাঞ্ছিত ও তাদের পরিত্যক্ত বর্জ্যে গেঁজে উঠছে জহরথুবার আকাশ-বাতাস।
এবং, এই জনপ্লাবিত জহরথুবা টাউনের একটি পুরোনো বাড়িতে একাকী দ্বীপের মতো বেঁচে থাকেন একটিমাত্র মানুষ। শৈবাল মজুমদার। পঁয়ষট্টি বছরের শৈবাল মজুমদারের ত্রিভূবনে কেউ নেই। না আত্মীয়স্বজন, না বন্ধুবান্ধব। কারণ তিনি সে-সব কিছু রাখেননি।
দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে এই জহরথুবায় আস্তানা গেড়েছিলেন শৈবালের বাবা শৈলেশ্বর মজুমদার। যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ তাঁর ছিল। এই বাড়িটি তিনি বানিয়েছিলেন। তার পর শৈবাল যখন পঁচিশ, মা মারা গেলেন হঠাৎ, অজানা এক জ্বরে। তার পাঁচ বছর পরে বাবা। হার্টফেল।
শৈবাল জানতেন তাঁর দুই পিসি আর এক মামা সন্তানসন্তুতি সহযোগে মধ্যমগ্রাম আর কলকাতার ভবানীপুরে থাকেন। কিন্তু সেই ‘জানা’ কোনওভাবে ‘চেনাজানা’য় পরিণত হোক, তা তিনি চাননি। অপরদিক থেকে কয়েকবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শৈবালের নিস্পৃহতা আর নিষ্ক্রিয়তা সে উদ্যোগে জল ঢেলে দিয়েছে।
শৈবাল কখনও চাকরির চেষ্টা করেননি। কারণ তিনি মনে করেন, সমাজে যারা চাকরি-বাকরি করে, তারা নিজ-যোগ্যতায় তা পায় না। বরং এমপ্লয়ি এবং এমপ্লয়ার— উভয়ের অসৎ লেনদেনে যত চাকরি দেওয়া-নেওয়া চলে। এই আইন বহির্ভূত আপোষ-রফায় অংশগ্রহণ করে বাবার রেখে যাওয়া অর্থের অপব্যয় করা তাঁর অধিকার বহির্ভূত কাজ বলেই মনে হয়েছিল।
এবং, শুনতে বাড়াবাড়ি মনে হলেও, আরও একটি তথ্য না-দিলেই নয়। তা হল, শৈবাল বিয়ে করেননি। বাইরের অজানা-অচেনা একটি মেয়েকে বিশ্বাস করে এই পৈতৃক বাড়িতে এনে তোলা তাঁর সমীচীন মনে হয়নি। এর ফল যে ভালো হয় না, তার বহু দৃষ্টান্ত তাঁর চোখের সামনেই আছে।
সুতরাং, অকৃতদার শৈবাল এই অবিশ্বাসী পৃথিবীর আগ্রাসন ও লোভ থেকে বাবার রেখে যাওয়া বাড়ি এবং অর্থ যোগ্য উত্তরসূরির মতো আগলে রক্ষা করেছেন এযাবৎকাল। ব্যাঙ্কের গচ্ছিত টাকার সুদে একটিমাত্র হাড়ি ও সমসংখ্যক কড়াইতে যা পারেন ঘুটেঘেঁটে খেয়ে রাতে শুয়ে পড়েন। এক-একটা দিন দিব্যি কেটে যায়।
এ বাড়িতে দু’টি বড় ঘর, একটি কামরা, রান্নাঘর আর বেশ প্রশস্ত একটি বারান্দা। উঠোনের এক প্রান্তে পায়খানা-বাথরুম। মাঝখানে উত্তর দিকের পাঁচিল ঘেঁষে টিউবওয়েল। দক্ষিণ আর পুব পাশে দু’কাঠা জায়গা জুড়ে উঠোন। কিন্তু সেটাকে এখন আর উঠোন বলা চলে না, জায়গাটা জুড়ে আগাছার জঙ্গল।
একটা ঘরে শৈবাল থাকেন। আর উদরপূর্তির তাগিদে রান্নাঘরে ঢোকেন। বাকি ঘর-কামরা অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
কোনওপ্রকার অনুমতির অপেক্ষা না করে ত্রিশ-বত্রিশের যুবাটি ওর বউ আর বছর-চারেকের ছেলেকে নিয়ে পাশের বড় ঘরটাতে ঢুকে পড়ল। মিনিট দশেকের মধ্যে ওদের সঙ্গে আসা বিধবা মহিলাটির জন্যে কামরাটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ফেলল বউটি।
এই দখলকামী পৃথিবীর হাত থেকে এতদিন পিতৃদত্ত বাড়িটিকে আগলে রাখতে পেরেছিলেন শৈবাল। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন কই! শেষমেশ সুবীর দত্ত সেই পৈতৃক ভিটেতে ঘুঘু চড়িয়ে দিয়ে গেল। পরের বাড়ি, পরের ঘর। অথচ কী সাবলীলভাবে তা বাগিয়ে নিচ্ছে নেতার প্রশ্রয়ধন্য এই পঙ্গপালের দল!
‘কোথায় যাস সুখী?’ বউটাকে জিজ্ঞেস করল মধ্যবয়সী বিধবা।
‘দেখছ না সামনে কেমন জঙ্গল হয়ে আছে? সাপ-খোপের আড্ডা হবে,’ কোথা থেকে কাস্তে আর ঝাঁটা নিয়ে হাসি-হাসি মুখে উঠোনে নেমে পড়ল সুখী নামের বউটি।
শৈবালের বাড়ি, তাঁর বাড়ির উঠোন। তিনি জঙ্গল করে রাখবেন নাকি পুষ্পোদ্যান, সেটা তাঁর ব্যাপার। এরা কোথাকার কে তা পরিষ্কার করার! এমনভাবে কাস্তে চালাচ্ছে সুখী যেন এটা ওরই বাড়ির উঠোন, এতদিন অপরিচ্ছন্ন রেখে শৈবাল বড় অন্যায় কাজ করেছেন। শৈবাল ভাবলেন, অন্যের সম্পত্তি দখল করার কৌশলে এরা কী সাংঘাতিক দক্ষ!
একটু পরে পাশের ঘর থেকে যুবকটি বেরোল। লম্বা ডাণ্ডার মাথায় চৌকোনা বোর্ড বাঁধা। তার সর্বাঙ্গে হুক দিয়ে আটকানো ইঁদুরমারা বিষ।
‘কখন আসবি, নন্দ?’ ছেলেকে জিজ্ঞেস করল বিধবা।
নন্দ বলল, ‘সন্ধে হবে,’ তার পর সে শৈবালের দিকে তাকাল, ‘বেরোচ্ছি কাকা।’
কাকা! শৈবাল কোন চোদ্দগুষ্টির কাকা এই নন্দ নামের ছোটলোকের ছেলের? কিন্তু ও এমনভাবে কাকা ডাকল যেন কতই-না আপন, যেন নিজের কাকাকেই সে ডাকছে!
ঘেমে উঠলেন শৈবাল। তাঁর নীরোগ শরীর এতদিনে বুঝি উচ্চ রক্তচাপে উদ্বেগব্যাকুল হয়ে উঠেছে। শরীরটা সত্যিই খারাপ লাগছে। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। দুশ্চিন্তায় মস্তিষ্ক কেমন অসাড় হয়ে আসছিল। কতক্ষণ তন্দ্রাঘোরে ছিলেন তিনি জানেন না। চটকা ভাঙল একটি অশ্রুত আহ্বানে, ‘চা-টা খেয়ে নিন।’
বিধবা কড়ির কাপ-প্লেটে চা এনে পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ রান্নাঘরটিও দখল হয়ে গিয়েছে। কড়ির এই কাপ-প্লেট শৈবালের মায়ের। রান্নাঘরের শেলফে সাজানো থাকে।
উঠে বসলেন শৈবাল, ‘এখন চা খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই। আপনি শুধু-শুধু চা কেন এনেছেন?’
বেশ কঠোর শোনাল শৈবালের কণ্ঠস্বর। কিন্তু সে-কঠোরতা মহিলাকে স্পর্শ করল না বোধহয়। মহিলা তার মুখে একটি প্রসন্নতার হাসি ভাসিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে শরীরটা ভালো নেই। একটু লিকার চা খেলে ভালো লাগবে। আর আমি আপনার থেকে বয়সে ছোটই হব। আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। ‘তুমি’ করেই বলবেন। আমার নাম লক্ষ্মী। নাম ধরেই ডাকবেন।’
কথাগুলো বলে বিছানার উপর চা রেখে লক্ষ্মী চলে গেল। তার রেখে যাওয়া কাপ-প্লেট শৈবালের দিকে তাকিয়ে যেন তিরস্কার করতে লাগল। যেন রুষ্ট চোখে তাকিয়ে আছেন স্বয়ং শৈবালের মা। বলছেন, ‘আমার সাধের এই সামান্য জিনিসটুকুও তুই রক্ষে করতে পারলিনে খোকা? কোথাকার কোন লক্ষ্মী, স্বামীহারা বেধবা, কোন আস্পর্ধায় সে এই মজুমদার বাড়ির বাসনকোশন স্পর্শ করে! শেষ পর্যন্ত এইসব চতুর বুদ্ধির মেয়েছেলের খপ্পরে পড়লি তুই! ছিঃ ছিঃ!’
টলটল করছে খয়েরি রঙের লিকার চা। নন্দ নামের ছেলেটির ইঁদুরমারা বিষের গুঁড়ো খানিক এর মধ্যে আছে কিনা কে বলতে পারে!
দুপুরে সুখী ভাত বেড়ে দিয়েছে। কচুশাক, ডাল আর ধনেপাতার বড়া। খেতে পারেননি শৈবাল। গিলেছেন। স্বাদ বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু শৈবালের মনে হচ্ছিল, তিনি নিজেই নিজের পিণ্ড গিলছেন। সুস্বাদু স্ব-পিণ্ড!
তার পরেই পান হাতে ঘরে এল লক্ষ্মী, ‘জর্দা নেই। শুধু চুন-সুপারি। মিঠে পাতা। খান, ভালো লাগবে।’
লক্ষ্মী নিশ্চয়ই বুঝেছে পান খাওয়ার অভ্যেস শৈবালের নেই। কারণ এ-বাড়িতে সে-রকম কোনও আয়োজনের লক্ষণ অনুপস্থিত।
শৈবাল হাত বাড়িয়ে পানটা নিলেন। তার পর বোঁটার মাথায় করে খুব সামান্য চুন এগিয়ে দিল লক্ষ্মী, ‘আর চুন লাগবে?’
নিয়মিত পান খাওয়ার অভ্যেস না-থাকলেও, শৈবাল পান খেতে জানেন। পানটা মুখে গুঁজে বললেন, ‘আর-একটু তো লাগবে। এটুকুন চুনে পান খাওয়া যায়?’
লক্ষ্মী তার চুনের ডিব্বাটা এগিয়ে ধরে। বোঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে প্রয়োজনমতো চুন তুলে নেন শৈবাল। লক্ষ্মী চলে যায় তার কামরায়। এবং শৈবালের আবার সংবিৎ ফেরে— এ তিনি কী করছেন! এই ধান্দার মানুষগুলো এক বেলার মধ্যে তার সারাজীবন ধরে আগলে রাখা বাপ-মায়ের ভিটেতে জাবড়ে বসেছে। তাঁকে কবজা করে শেষ পর্যন্ত এই বাড়িটাকেই ওরা দখল করে নিতে চায়। তাহলে কেন সব বুঝেশুনে ওদের এই নকল আর শয়তানির আপ্যায়ন তিনি গ্রহণ করছেন! আত্মবিস্মরণ হয়েছে তাঁর! দেওয়ালে বড় করে টাঙানো বাবা-মায়ের ফোটো যেন সে-কথাই তাঁকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বিকেলে রোদ পড়ে গেলে পাড়ার মধ্যে পায়চারি করা শৈবালের অভ্যেস। প্যান্ট-শার্ট পরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। অভ্যেসমতো হাতের মুঠিতে বাড়ির চাবি। বারান্দার প্রান্তে এসে ভাবছেন কী করবেন। এই বদ মতলবের মানুষগুলোর হাতে এ-বাড়ির প্রাণটা ছেড়ে দিয়ে তিনি কিছুতেই নিশ্চিন্তমনে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে পারবেন না।
তখনই পাশের ঘর থেকে বাচ্চা ছেলেটিকে নিয়ে বেরোল সুখী। তাকে অতি মলিন অথচ পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরানো হয়েছে। কপালে কাজলের টিপ। হাত ধরে শিশুটিকে শৈবালের কাছে নিয়ে আসছে সুখী। সে-ও আনন্দে আটখানা। হেঁটে-হেঁটে নয়, লাফিয়ে-লাফিয়ে শিশুটি শৈবালের কাছে এল।
‘বিল্টু, যাও দাদার সঙ্গে একটু ঘুরুঘুরু করে এসো,’ বলে শিশুটিকে শৈবালের দিকে এগিয়ে দিল সুখী।
বিল্টু শৈবালের হাত ধরে আবারও লাফাতে লাগল, ‘কী মজা কী মজা! আমি দাদার সঙ্গে ঘুরু কত্তে যাব! ঠাম্মি, ও ঠাম্মি,’ বিল্টুর আহ্বানে কামরা থেকে বেরিয়ে এল লক্ষ্মী, ‘আমি দাদার সঙ্গে ঘুরু কত্তে যাচ্ছি! টাটা!’
লক্ষ্মী তার অমলিন হাসিটি হাসল। বিল্টু শৈবালের হাত ধরে এবার হেঁচকা টান দিল, ‘চলো দাদা…’
শৈবাল চাবির গোছা পকেটে ঢুকিয়ে বিল্টুর কচি হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন।
পাড়ার মধ্যে বিল্টুর হাত ধরে হাঁটছেন শৈবাল। আর ভাবছেন, কতখানি বেপরোয়া এই মানুষগুলোর দুরভিসন্ধি! একটা নিষ্পাপ শিশুকেও ওদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে নিযুক্ত করে দিয়েছে। তিন-রাস্তার মুখে চিন্তার সুতো কেটে দিল সুখেনের বউ সুজাতা, ‘ও শৈবালকাকু, কাকে নিয়ে বেরিয়েছেন? নাতি নাকি?’
মিটিমিটি হাসছে সুজাতা। শৈবাল বুঝলেন, ওর এই হাসি টিপ্পনীর হাসি। মুখে কিছু বললেন না শৈবাল। শুধু ‘হ্যাঁ’ সূচক ঘাড় নাড়ালেন। তার পর বিল্টুর ছোট্ট হাতে সামান্য চাপ দিয়ে বললেন, ‘ও-দিকে চলো দাদু।’
রাস্তায় ছেলেরা খেলা করছে। বিকেল পাঁচটার নিয়মে পাড়ার বউরা মিউনিসিপালিটির কলে জল নিতে এসেছে আর নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। দু’-চারজন বয়স্ক মানুষ দল বেঁধে হাটছেন এবং দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা-জারিত উপলব্ধির বিনিময় করছেন।
কিন্তু শৈবাল কারোর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন না। তুচ্ছ দুটো কথা বলে নিরর্থক সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার মতো বোকামি তিনি কখনও করেননি। কিন্তু শিশুর নিঃসংশয় সরল মন কথা বলে ওঠে, ‘এই দাদা সাইকেল চালাচ্ছিস?’
শৈবাল খেয়াল করলেন বিল্টু বীরেন মুখুজ্জের নাতির সঙ্গে কথা বলছে। সে বিল্টুর থেকে বছর-কয়েকের বড় হবে আন্দাজ করা যায়। একটা ছোটদের সাইকেলে বেশ জোরসে প্যাডেল করে সে এগিয়ে গেল। বিল্টুর কথার জবাব দিল না। বিল্টু এবার শৈবালের দিকে মুখ তুলে বলল, ‘দাদা, আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে তো!’
এইটুকু ছেলের কী খারাপ শিক্ষা হয়েছে! ভাবলেন শৈবাল। পরমুহূর্তেই তাঁর ভাবনার ভুল ভেঙে গেল। ধান্দাবাজ মা-বাবা আর ঠাকুমার থেকে যথাযথ শিক্ষাটাই ও পেয়েছে। যারা নেতার প্ররোচনায় পরের বাসস্থান নির্দ্বিধায় দখল করতে পারে, তাদের সন্তান তো অন্যের মন গলিয়ে আর চেয়েচিন্তে চাহিদার জিনিস আদায় করবেই। এ তো খুব স্বাভাবিক।
জল নেমে গিয়েছে। কিন্তু সাড়ে তিনজন মানুষরূপী ঘুঘু শৈবালের ভিটে থেকে নেমে যায়নি। শৈবালের আশঙ্কা একদম সঠিক ছিল। এরা আর যাবে না। তাঁর বাবার কষ্টার্জিত সঞ্চয় দিয়ে গড়া বাড়িটা দখল হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার সুবীর দত্তকে বলেছেন শৈবাল, ‘জল তো নেমে গ্যাছে। এবার ওদের চলে যেতে বলো।’
কাজ হয়নি। কাজ হবে না, তিনি জানতেন। কারণ দখলদার পরিবারটি সুবীর দত্তের ভোট। এদেরকে সে ঘাঁটবে না। তার চেয়ে বড় কথা, সুবীর দত্ত জানে, শৈবাল তার ভোট নয়।
শৈবাল উপলব্ধি করতে পারেন তিনি একটি চতুর ষড়যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছেন। এই কূট চক্রান্তের বিরুদ্ধে যে লড়বেন, এই বয়সে সেই শক্তিও আর ভেতর থেকে খুঁজে পান না। ফলত অসহায়ের মতো তিনি সকালের বিছানায় চা এবং খাওয়া পরে পানের বদভ্যাস করে ফেলেছেন। আর নিয়ম করে ফেলেছেন রাতে বিল্টুকে কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর পর নিজে ঘুমোবেন। দাদাকে ছাড়া রাতে বিল্টু কিছুতেই চোখ বুজতে চায় না।
এর মধ্যে একদিন শরীরটা খারাপ হয়ে পড়েছিল। পাড়ার কেষ্ট ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল নন্দ। কেষ্ট ডাক্তার ইসিজি করে আর দেখে-টেখে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই৷ তবে সাবধানে থাকতে হবে। বয়স হচ্ছে তো। হার্টের সমস্যা আসতে পারে। এই ওষুধগুলো এক হপ্তা খাবেন।’
সেদিন সারারাত পালা করে বুকে গরম তেল মালিশ করে দিয়েছিল লক্ষ্মী আর সুখী। চুলে বিলি কেটে দিয়েছিল, যাতে শৈবাল একটু ঘুমোতে পারেন। আর প্রতিবার ওষুধ খাওয়ার সময় বিল্টু তার কচি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ‘আমি দাদাকে ওসুদ খাইয়ে দেব… আমিইইই…’
হাল ছেড়ে দিয়েছেন শৈবাল। ছেলেবেলায় গ্রামের বাড়ির গোরুটা যেমন এঁটুলির মতো রক্তচোষার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে দিতে বাধ্য হত, শৈবালের তেমন হয়েছে। আর অদ্ভুত মানুষের মনের গতি। এই কুচক্রীদের সঙ্গে ছ’মাস বসবাস করার পর এখন এদেরই ভালোমন্দ নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় তাঁর।
বেশ কয়েকদিন ধরে নন্দ ঠিকমতো বাড়ি ফেরে না। কোথায় কী করছে কে জানে! একবার ভেবেছিলেন লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু করতে পারেননি৷ মেকি আন্তরিকতায় ওরা তাঁকে ভোলাতে চেষ্টা করে। উপযাচক হয়ে খবর নেওয়া মানে সেই ঘৃণ্য ফন্দিকেই আরও উৎসাহিত করা।
আজ সন্ধে থেকে বুকের বাঁ-দিকটাতে চিনচিন করে ব্যথা। রাতে খাওয়ার পরে সেটা বেড়ে গেল। নন্দকে পাঠিয়ে একবার কেষ্ট ডাক্তারকে ডেকে পাঠাবেন কিনা ভাবলেন। তার পরেই ভাবলেন— না। বারবার ওদের সাহায্য নিতে রুচিতে বাধে।
ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। শৈবাল কি এবার মারা যাবেন? আজ রাতেই কি এই পৃথিবীর শেষ স্বাদ নেওয়া?
বিল্টু ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠে পড়লেন শৈবাল। লাইট জ্বাললেন। দেওয়ালের বড় ফ্রেম থেকে তাকিয়ে আছেন বাবা-মা। শৈবাল তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে এল।
‘ক্ষমা করে দিও আমায়। আমি তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বেহাত হওয়া থেকে আটকাতে পারলাম না। এই পরস্বলোভীদের হাতে সব কিছু ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমার…’
এই ক্ষমাপ্রার্থনাটুকু যেন শান্তি দিল শৈবালকে। যেন একটা দম বন্ধ করা কর্তব্যের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত পরাজয় জেনে হাল ছেড়ে দেওয়া সৈনিক শত্রুর গুলি খেয়ে মরার আগে যেমন স্বস্তির শ্বাস নেয়, তেমন দীর্ঘ শ্বাস টেনে বিছানায় শুয়ে পড়লেন শৈবাল।
বুকের ব্যথাটা একটু কমেছে। মনে হচ্ছে এ-যাত্রা বেঁচে যাবেন। একবার বিল্টুর দিকে তাকালেন। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে শিশুটি। তার গায়ের চাদর ঠিক করে শৈবাল চোখ বুজে পড়ে থাকলেন অনেকক্ষণ।
কিন্তু ঘুম এল না। এলোমেলো চিন্তাগুলোর একটা হেস্তনেস্ত না-করলে বুঝি আসবেও না। এই ফন্দিফিকিরের মানুষগুলোই তাঁর উত্তরাধিকারী। তাঁর সম্পত্তি শেষ পর্যন্ত বরাদ্দ হবে বিল্টুর জন্যে। এই যদি ভবিতব্য হয়, তাহলে বুকের ব্যথাটা খারাপের দিকে যাওয়ার আগে দ্রুত নন্দর নামেই এ-বাড়ির দলিলটা করে দিতে হবে। কাল সকালেই বিল্টুকে সঙ্গে নিয়ে শ্যামসুন্দর সাইকেল স্টোর থেকে খুব মজবুত দেখে একটা ছোটদের সাইকেল কিনে আনতে হবে। আর একটি চিন্তা আসতেই কোনও অজানা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তাঁর মন। খুব সঙ্গোপনে ভাবলেন, লক্ষ্মীর শাড়িগুলো খুব পুরোনো আর ফেঁসে যাওয়া। ওর জন্যে একটা নতুন ঘিয়ে রঙের শাড়ি…
সকালে ঘুম ভাঙল দেরিতে। সুখী কখন বিল্টুকে তুলে নিয়ে গিয়েছে শৈবাল টের পাননি। চা নিয়ে এল লক্ষ্মী। খুব ভোরে স্নান হয়ে যায় তার। এখন বেশ সুন্দর লাগছে লক্ষ্মীকে। স্নিগ্ধ আর কোমল। তার মুখে ফাগুন ভোরের প্রশান্তি। চা দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। বিল্টু ডাকল, ‘দাদা…’
তাড়াতাড়ি চা শেষ করে শৈবাল বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। কিন্ত এসব কী! দুটো বড়-বড় বোঁচকা হাতে নিয়ে নন্দ দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে লক্ষ্মী আর সুখী। সাজুগুজু করে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিল্টু।
‘কী ব্যাপার?’ বিস্মিত শৈবাল জিজ্ঞেস করলেন।
সুখী বলল, ‘মুন্সীপাড়ার বিলের জল তো এতদিন নামেনি কাকা। এই এক হপ্তা হল নেমেছে। আমরা…’
‘জল নামলেই হল? থাকার মতো একটা কিছু…’ স্বর ভেঙে গেল শৈবালের। কথা শেষ করতে পারলেন না।
‘আপনার ভাইপো,’ নন্দর দিকে ইশারা করে বলল সুখী, ‘দরমার বেড়া দিয়ে দু’খানা ঘর তুলেছে। অসুবিধে হবে না।’
এবার বিল্টু মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে এল শৈবালের কাছে, ‘ও দাদা, মা বলল না জল নেমে গেছে! আমরা যাচ্ছি, তুমিও চলো…’ বিল্টু শৈবালের হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল, ‘দাদা, চলোওওও… আমার সঙ্গেএএএ…’
কচি হাতের মুঠির টান এত শক্তিশালী শৈবালের জানা ছিল না।
সুখী বিল্টুকে কোলে তুলে নিল। নন্দ বলল, ‘সাবধানে থাকবেন কাকা।’
লক্ষ্মী তার মুখে অকলুষ হাসিটি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আসি।’
চলে গেল ওরা। জহরথুবা শহরের ঠিক মাঝখানে পৈতৃক ভিটের বারান্দায় দ্বীপের মতো একা দাঁড়িয়ে রইলেন শৈবাল মজুমদার।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগলো। পরবর্তী গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
Bhalo laglo pore
Chaliye jao…
তোমার গল্পটার মধ্যে মাদকতা আছে । ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
গল্পে উপমাগুলো দারুনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর, কিছু বানান যেমন,”দরমার বেড়া”……এটা না হয়ে “দর্মার বেড়া” বা “দর্ মার বেড়া” …..এইরকম কিছু printing mistake আছে।অনেকদিন পর ছোটগল্প পড়লাম…..শেষ হয়েও হইল না শেষ…….
সার্থক গল্প একটি! সরল রেখায় ধরা রয়েছে একান্ত মানবিক সুক্ষ্ম আবেগ, শূন্যতাবোধ, মায়া …
খুবই ভালো লাগল ।
খুব ভাল লিখেছ তন্ময়, অন্য স্বাদের।
অসাধারণ গল্প কারণ গল্প টির শেষে যেরকম ভাবা হয়েছিল, ঠিক তার বিপরীত পরিণতি ঘটে গেল,এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাষা খুব সাবলীল,সংযত ও ঝরঝরে।
তন্ময় বাবু লেখা চালিয়ে যান।