মুহাম্মদ মহিউদ্দিন
পুরোনো খাটের মড়মড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। গভীর রাত। ঠিক সময় কত জানতে ঘড়ি দেখতে হবে। মাথার নিচের বালিশ উল্টে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে থামি। বোজা চোখ বাঁ হাতে কচলে খানিক আলো দেখতে গিয়ে চমকে উঠি। দেয়ালের পাশের বিছানায় জামিল সাহেব খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। মশারি টাঙানো। বিছানার সিথানে জানালার খোলা কপাটের মাঝখানে দাঁড়ানো বাতি নেভানো হলেও জামিল সাহেবকে দেখা যাচ্ছে। বোশেখের রাত। দিনের তীব্র তাপদাহের রেশ এখনও কেটে যায়নি। মাথার উপর ঝোলানো পাখা ঘুরছে। বাইরে বাতাসের গতি নেই। বাতাসের বেগ বেশি হলে পাখা বন্ধ রাখা যায়।
জামিল সাহেবকে দেখছি। তিনি কি মাঝরাতে শৌচাগারে যাওয়ার জন্যই উঠলেন! ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তিনি দাঁড়ালেন। বিছানার পাশে জানালার সাথেই পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিল বলা হলেও খাবার কর্মটি এই টেবিলেই সারেন জামিল সাহেব। টেবিলের ডানপশে বইস্তুপের পাশে চক-ডাস্টার। অনেক সময় পাঠদান শেষে চক-ডাস্টার নিজের টেবিলে এনে রাখেন জামিল সাহেব। এ ঘরটির একমাত্র শৌচাগারটিতে আমার বিছানার পাশ দিয়ে যেতে হয়। তিনি এদিকে না এসে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। হাতে চক-ডাস্টার তুলে নিলেন। বিছানার উপরে পাখাটি ঘুরছে। তারপর হেঁটে ঘরটির একমাত্র বেরুনোর দরজাটির দিকে গেলেন। ছিটকিনি খুললেন।
ভয় ও বিস্ময়ে উঠে বসলাম। বিছানা থেকে নেমে খাটের নিচে রাখা জুতো জোড়া নিয়ে জামিল সাহেবের পিছু নিলাম। তিনি চক-ডাস্টার হাতে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
কিশোরগঞ্জ বাজিতপুর কলেজের তিনতলা প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ঘরে জামিল সাহেব ও আমি থাকি। জামিল সাহেব যুক্তিবিদ্যার সহকারি অধ্যাপক। আর আমি পড়াই ইংরেজি। ইংরেজিতে আমার দৌড় বেশিদূর নয়। এই ধরে নেয়া যায় সিম্পল, কমপ্লেক্স, কম্পাউন্ড পর্যন্ত। ডিগ্রি কলেজে সাহিত্যের গভীর পাঠদান তেমন একটা হয় না।
জামিল সাহেব এই কলেজে যোগদান করেছেন এক সপ্তাহ পেরুল। কাল শুক্রবার। কলেজ বন্ধ। প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায় মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত খেয়ে ফিরতে দেরি হয়েছিল আমার। জামিল সাহেব দাওয়াতে যাননি। আমি ফেরার আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
বাক্স-পেটরা নিয়ে জামিল সাহেব এক সপ্তাহ আগে যেদিন আমার এ ঘরে এসে উঠলেন সেদিন তার সাথে ছিটেফোঁটা কথা বলেই তার সম্পর্কে আমার কৌতুহল জেগেছিল। কম কথা বলেন। হাসেন তার চেয়েও কম। চলাফেরা অনেকটা রোবটের মত যান্ত্রিক। সেদিন রাতেই নিজের কিছু বই খাতা বের করে টেবিল সাজালেন। বাংলাদেশের মানচিত্র ঝোলানোর মতো ফ্রেম করা একটি ফেস্টুন তিনি টেবিলের উপর দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। ফেস্টুনের উপর দিকে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা- ‘My Daily Duty’ ডেইলি ডিউটি অনুসারে জামিল সাহেবকে রাত সাড়ে দশটার মধ্যে বাতি নিভিয়ে বিছানায় যেতে হয়। সংগত কারণেই তিনি প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ের জন্মদিনে অংশ নিতে পারেননি।
জামিল সাহেবের ডেইলি ডিউটির বিস্তারিত আমরা জানব। তার আগে অন্ধকার গভীর রাতে চক-ডাস্টার হাতে নিয়ে তিনি কোথায় চললেন সেটা দেখা যাক।
জামিল সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। আমি পেছনে। কিছুটা দূরে। আলতো পায়ে। যেন তিনি টের না পান। তিনি নিচতলায় নামলেন। গেটের কাছে দুটি কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। জামিল সাহেব এগিয়ে গিয়ে হাতের ডানপাশের একশত এক নম্বর শ্রেণি কক্ষের দরজা টান দিয়ে খুললেন। ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি দরজার আড়ালে লুকালাম। মনের মধ্যে বিরাট ভয় কাজ করছে। শিক্ষক চক-ডাস্টার নিয়ে পাঠদান করতে শ্রেণি কক্ষে এসে হাজির। গেটের কাছে ছোট্ট ঘরে নাইটগার্ড পরিমল থাকার কথা। ও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে। টের পেলে এতক্ষণে ছুটে আসত। কুণ্ডলী পাকানো ঘুমন্ত কুকুরগুলো দূরে কোথাও কুকুরের ডাক শুনে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
শ্রেণি কক্ষের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বকবক করছেন জামিল সাহেব। কত সময় হবে। চার থেকে পাঁচ মিনিট। পুনরায় বেরিয়ে আসছেন। আমি দরজার কাছ থেকে দৌড়ে গিয়ে দেয়ালের আড়াল হলাম। জামিল সাহেব বেরিয়ে দরজা ভিজিয়ে দিলেন। চক-ডাস্টার ডান হাতে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি জামিল সাহেবের আগেই খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। জামিল সাহেব আগে এসে দরজার ছিটকিনি আটকে দিলে আমার ঢোকা হবে না। বিছানায় গিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লাম।
জামিল সাহেব ফিরলেন। ভেতরে এসে দরজার ছিটকিনি লাগালেন। পড়ার টেবিলে চক-ডাস্টার রাখলেন। পাশেই একটি জল ভরা বোতল। নিয়ে ঢক ঢক জল গিললেন দাঁড়িয়ে। তারপর মশারিরর পাড় উল্টে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন।
এ আমি কী দেখলাম! ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। নাকি স্বপ্ন দেখলাম। একহাত দিয়ে অন্য হাতে চিমটি কাটলাম। না ঠিকই তো আছি। তাহলে? আমি কি জামিল সাহেবকে জাগাব? জানতে চাইব তিনি এমনটি কেন করলেন?
থাক। কাল সকালে জানা যাবে।
বিছানায় বালিশের পাশে রাখা হাত ঘড়িটি দেখলাম। রাত চারটা বেজে কুড়ি মিনিট। ভোর হতে এখনও ঘন্টা দেড়েক বাকি। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার প্রস্রাবের চাপ বেড়ে যায়। এখনও তাই হলো। এতক্ষণ আমিও ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তাই টের পাইনি।
হাত-মুখ ধুয়ে ফিরলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা। একবার ঘুম ভেঙে গেলে পুনরায় ঘুমের রানীকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। জানালা দিয়ে শিরশির বাতাস দেহ জুড়িয়ে দিলেও মনে ভয় কাজ করছে। জানালার বাইরে দীর্ঘ ইউক্যালিপটাস গাছের ডালপালা দুলছে। উঁকি-ঝুকি মেরে জামিল সাহেবকে দেখছি। তিনি চিৎ হয়ে শোয়া। মনে হয় গভীর ঘুম। মৃদু নাক ডাকছেন। হঠাৎ পাখাটি থেমে আছে। তিনি পাখাটি কখন সুইচ অফ করলেন? তাহলে কি তিনি জেগে আছেন? জেগেই নাক ডাকছেন?
“জামিল সাহেব… জামিল সাহেব!”
ডাকলাম দু’বার। কোনও সাড়া-শব্দ নেই। নিশ্চিত তিনি ঘুমোচ্ছেন।
পাখা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকুক তা পছন্দ করেন না জামিল সাহেব। তিনি মনে করেন পাখারও প্রাণ আছে। কিছুটা সময় ঘোরার পর তারও বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। তাই অনেক সময় রাত দুপুরে জেগে পাখা বন্ধ করে দেন। গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে ঘেমে নেয়ে বিছানার চাদর-বালিশ ভিজে গেলেও তিনি পাখাকে বিশ্রাম দিতে পছন্দ করেন।
আর সময়ের ব্যাপারে অতি সচেতন বলেই তিনি পরনের শার্টের বোতামগুলো না খুলে শুধু উপরের দুটি ছাড়িয়ে মাথা গলিয়ে পরে নেন। জামা পাল্টানোর সময়ও একই পদ্ধতিতে খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখেন। এতে নাকি সময় অপচয় কম হয়।
প্রচন্ড ভোলামনের মানুষ জামিল সাহেব। ইন্টারমিডিয়েটের ক্লাস নেবেন, ঢুকে পড়লেন ডিগ্রি ক্লাসে। একটি অধ্যায় অথবা বিষয় পড়ানোর কথা শুরু করে দিলেন অন্য অধ্যায়। সবগুলোই যেন তার হড়হড়ে মুখস্থ। এক নাগাড়ে বলে যেতে পারেন। সেদিন মজার একটি কান্ড ঘটল। মাই ডেইলি ডিউটির লিখিত সময় মত জামিল সাহেব রাত সাড়ে দশটায় বিছানায় গেলেন। আমার ঘুমোতে যেতে যেতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়।
রাতের খাবার শেষে বিছানায় শুয়ে এডগার এলান পোর ছোটগল্প পড়ছিলাম। রাত কত হবে। বারোটা পেরিয়েছে। জামিল সাহেব হঠাৎ মশারির ভেতর থেকে ডাক দিয়ে বললেন- “আশিক সাহেব।”
“জি?” বললাম আমি।
“আচ্ছা আমি কি রাতের খাবার খেয়ে শুয়েছি?”
বিছানায় শোয়া অবস্থায় পাশ ফিরে বললেন জামিল সাহেব।
এডগার এলান পোর গল্পের সাসপেন্স থেকে বেরিয়ে জামিল সাহেবের প্রশ্নে নিজেকে স্থাপন করতে মস্তিষ্ক কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। পেটের ভেতর থেকে দম ফাটানো একটি বিকট হাসি গলা অবধি এসে আটকে গেল। মুখ ফুটে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। হাসিটি পুনরায় ভেতর দিকে পাঠিয়ে দিয়ে বললাম “জি না। আপনি খাবার খেয়ে শুতে যাননি।”
ইচ্ছে করে মিথ্যা বললাম।
“ও। তাই। দেখুন তো কি কান্ড! আমার বাবা রাতে না খেয়ে শোয়াটা মোটেই পছন্দ করতেন না। স্কুল বেলায় রাতে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লেও বাবা আদর করে জাগাতেন। অনেক সময় খাইয়ে দিতেন। চোখে ঘুম নিয়ে বাবার হাতে রাতের খাবার গিলতাম”, শোয়া থেকে উঠে বসে মশারির ভেতর থেকে এক নাগাড়ে কথাগুলো বললেন জামিল সাহেব।
বাজিতপুর কলেজে জয়েন করার সপ্তাহখানেক পর থেকে আমাকে খাবার সাপ্লাই দেয় দারোয়ান পরিমল। কলেজের কাছেই পরিমলের বসতবাড়ি। স্ত্রী সুলেখার রান্নার হাত ভালো। সকালে রুটি ভাজি অথবা খিচুড়ি আর দুবেলা ভাত। মাসকাবারি টাকা দিই। মাঝে মাঝে ভালো বাজার-সদাই চোখে পড়লেও কিনে দিই। সুলেখা খুব খুশি হয়। জামিল সাহেবের খাবারও পরিমল আলাদা বাটিতে দিয়ে যায়।
মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন জামিল সাহেব। টেবিলের কাছে ফিরে গেলেন। চেয়ার টেনে বসলেন। ধুয়ে রাখা প্লেট রাখলেন সামনে। পাশে রাখা জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খেলেন। তারপর খাবার বাটি খুললেন। রাতে তিনি খেয়ে রাখা বাকি খাবারগুলোই আছে।
“আজ পরিমলের স্ত্রী সুলেখা খাবার কম দিয়েছে।” পাতে ভাত-তরকারি তুলতে তুলতে বললেন জামিল সাহেব।
আমার আবারও দম ফাটানো হাসি এলো। আচ্ছা হাসি আর কতক্ষণ আটকে রাখা যায়। হেসে নিলাম।
জামিল সাহেব ফিরে তাকালেন। বললেন “হাসলেন যে?”
বললাম “এলান পোর গল্পে একটি চমৎকার হাসির ঘটনা পড়লাম। তাই।”
“ও। অবশ্য আমার খিদেও তেমন নেই। এই খাবারেই হয়ে যাবে।” বললেন জামিল সাহেব।
জামিল সাহেব দ্বিতীয়বারের মতো রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমি পড়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন বসছে না। একজন মানুষ খাবার খেয়ে ভুলে যেতে পারেন। তাই তো দেখছি। নিশ্চয় এটা কোনও রোগ। জামিল সাহেব খাওয়া শেষ করে শৌচাগারে গেলেন। প্লেট নিজেই ধুয়ে রাখেন। খাবার বাটি পরিমল সকালে নাশতা নিয়ে আসার পর নিয়ে যায়।
জামিল সাহেবের পড়া ও খাবার টেবিলের উপর দেয়ালে টাঙানো মাই ডেইলি ডিউটিতে লেখা আছে- শৌচাগার সাত মিনিট। মানে তিনি শৌচাগারের যাবতীয় কর্ম নির্ধারিত সাত মিনিটের মধ্যে শেষ করবেন। সাত মিনিটের পাশে কোনাকুনি দাগ দিয়ে লেখা পাঁচ মিনিট। মানে বড় কাজ সাত মিনিট আর ছোট কাজ পাঁচ মিনিট। বালিশের নিচে রাখা হাত ঘড়িটি দেখছি। তিন মিনিট হলো। সাত মিনিটের মাথায় তিনি বেরুবেন। একদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে জামিল সাহেবের ডায়রিয়া হয়ে গেল। তিনি এই আসেন-এই যান। মাই ডেইলি ডিউটি বিকল হয়ে পড়ে। শৌচাগারের পেছনে কত সময় অপচয় হলো তা তিনি নোট রাখেন। কম ঘুমিয়ে অপচয় হওয়া সময়টুকু পুষিয়ে দেন।
কলেজ বিল্ডিংয়ের একই কক্ষে বাস করার কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে জামিল সাহেবকে আবিষ্কার করি। তার যে অভ্যাসটি আমাকে খুব বিস্মিত করেছে তা আমরা সাধারণ জীবনে সহজে কল্পনাও করতে পারি না। আর যদি কেউ এ বিষয়টি শুনে থাকেন তাহলে হঠাৎ করে তার পক্ষে বিশ্বাস করাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
জামিল সাহেব পরিমলকে বলে রেখেছেন সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই যেন টেবিলে নাশতা পৌঁছে যায়। পরিমল ঠিক তাই করে। কদাচিৎ দু-এক মিনিট এদিক-ওদিক হয়। যখন আমি একা ছিলাম তখন পরিমলের জন্য সময় বাধ্যবাধকতা না থাকলেও যেন তেমন বিলম্ব ঘটাতো না।
সকাল সাড়ে সাতটায় নাশতা এলে দু’জনে একসাথে নাশতা করি। তারপর আমি দাঁত ব্রাশ করে শুয়ে বই পড়ি। আর জামিল সাহেব পুনরায় শৌচাগারে ঢোকেন। ঠিক ত্রিশ মিনিট পর তিনি বেরিয়ে আসেন। শৌচাগারের জন্য নির্ধারিত সাত মিনিট থাকলেও সকালের নাশতা সারার পর আধঘন্টা কী করেন তা জানা যায়নি। তবে মাই ডেইলি ডিউটিতে ঐ সময়টায় লেখা আছে- বায়ুস্নান। কয়েকবার পড়েও আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। কারণ এ বিষয়ে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। একদিন হঠাৎ জামিল সাহেবের ‘বায়ুস্নান’ শব্দটির কার্যকারিতা আবিস্কার করলাম।
সকালের নাশতা শেষে জামিল সাহেব শৌচাগারে গেলেন। প্রায় পনেরো মিনিট কোনও সাড়া শব্দ নেই। তিনি শৌচাগারে আছেন তাও আমার মনে নেই। তাড়াহুড়ো করে শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে আমি দরজায় গিয়ে হালকা ধাক্কা দিলাম। ছিটকিনি খোলা। জামিল সাহেব সম্পূর্ণ দিগম্বর হয়ে শৌচাগারের জানালার পাশে রাখা ছোট্ট ফোল্ডিং চেয়ার পেতে বসে আছেন। ফোল্ডিং চেয়ারটি তিনি এ ঘরে আনার পর শৌচাগারে নিয়ে রেখেছিলেন।
জামিল সাহেবকে শৌচাগারে জানালার পাশে দিগম্বর হয়ে বসে থাকতে দেখে খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। ফিরে এসে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলাম। বাইরে বেরুনোর আগে ইউরিনাল প্রেসারটা কমিয়ে যাওয়া দরকার। তাই জামিল সাহেব বেরুনোর অপেক্ষা করছি।
ঠিক ত্রিশ মিনিট পূর্ণ হওয়ার পর জামিল সাহেব জামা পরে বেরিয়ে এলেন, তার মুখে ন্যূনতম সংকোচ কিংবা বিব্রত হওয়ার কোনও চিহ্ন নেই। তিনি হেসেই বললেন ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন।
“না জেনে দরজা ধাক্কা দেয়ার জন্য দুঃখিত”, বললাম আমি।
“আরে দুঃখিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষের ভুল হতেই পারে।” বললেন জামিল সাহেব।
শৌচাগারে গিয়ে সংক্ষিপ্ত কাজ সেরে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। জামিল সাহেব থামালেন।
“খুব তাড়া আছে?”
“জি না। বলুন।”
“আমি যে দিগম্বর হয়ে শৌচাগারে জানালার পাশে চেয়ারে বসেছিলাম তাকে বলে ‘বায়ুস্নান’। আমি প্রতিদিন দিগম্বর হয়ে আধ ঘন্টা বায়ুস্নান করে থাকি। মানুষের দেহ প্রকৃতির তৈরি। বায়ু প্রকৃতির অন্যতম একটি উপাদান। যা না থাকলে প্রকৃতিই থাকবে না। প্রতিদিন আধঘন্টা বায়ুস্নানে দেহ সতেজ, পুষ্ট এবং অধিকতর কর্মক্ষম হয়।”
এটুকু বলে থামলেন জামিল সাহেব।
“বেশ তো। বায়ুস্নান সম্পর্কে তো আমার কোনও ধারণাই ছিল না। জামিল সাহেব…”
“জি।”
“এই বায়ুস্নানের আইডিয়াটা কোথায় পেলেন?”
“ও। বলছি। শুনুন। আপনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের নাম তো শুনেছেন?”
“জি। শুনেছি।”
“তিনি প্রতিদিন অফিস ও নৈমিত্তিক কাজ শুরু করার আগে এক ঘণ্টা বায়ুস্নান করতেন। তিনি বলতেন শরীরকে সতেজ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য বায়ুস্নানের কোনও বিকল্প নেই। তাছাড়া বায়ুস্নানে আপনি আপনার দেহের প্রতিটি অঙ্গ নিখুঁতভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারবেন। চামড়াবৃত দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য আপনার হৃদয়ে অন্যরকম ভালোবাসা তৈরি হবে। জন্মের পর থেকে আমরা সভ্যজাতি হিসেবে জামাকাপড় পরেই থাকি। স্রষ্টার দেয়া দেহটি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয় কদাচিৎ। শৌচাগারে স্নান করার সময় এক পলক দেখা হয়। অনুভব হয় না। তাই বায়ুস্নান দেহের জন্য খুবই উপকারি।”
নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামলেন জামিল সাহেব। পুনরায় শুরু করলেন “আশিক সাহেব।”
“জি।”
“আপনিও নিয়মিত বায়ুস্নানের অভ্যেস করতে পারেন।”
“কি!”
“হুম। আপনার কল্যাণের জন্যই বলছি।”
জিভে কামড় খেয়ে চুপ করে রইলাম। জামিল সাহেবের নিশ্চয় মানসিক সমস্যা রয়েছে। না হয় তিনি আমাকে দিগম্বর হয়ে শৌচাগারের জানালার পাশে বসে থাকতে বলতেন না।
“কী ব্যাপার চুপ হয়ে গেলেন?” বললেন জামিল সাহেব।
“ভাবছি।”
“অত ভাবাভাবির কিছু নেই। কাল থেকে শুরু করে দিন।”
“আচ্ছা জামিল সাহেব শৌচাগারের ছোট্ট পরিসরে তো আপনার বায়ুস্নান ঠিকমত হয় না। বায়ুস্নানের জন্য প্রয়োজন খোলামেলা জায়গা” বললাম আমি।
“একদম ঠিক বলেছেন। বাড়িতে আমার ব্যক্তিগত ঘর রয়েছে। ওই ঘরেই আমি জানালার পাশে বায়ুস্নান সেরে নিই।”
“জানালার আশপাশে কোনও বাড়ি নেই?”
“নেই।”
“তাই রক্ষা। জামিল সাহেব এখানে উন্মুক্ত বায়ুস্নানের জন্য আপনাকে একটি বুদ্ধি দিতে পারি।”
“বলুন।”
“কাল থেকে আপনি এ বিল্ডিংয়ের ছাদে খোলা আকাশের নিচে দিগম্বর হয়ে বায়ুস্নান করবেন।”
“কী বলছেন! আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন? নাকি আমাকে হাসির পাত্র ভাবছেন?”
“মোটেই না জামিল সাহেব। আমি সিরিয়াসলি বলছি। ছাদে বায়ুস্নানে আপনাকে আমি সহযোগিতা করব।”
“কীভাবে?”
“পরিমলের কাছ থেকে ছাদের চাবিটি আমি নিয়ে নেব। ছাদে একটি স্টোর রুম আছে। আপনি ওই ঘরে গিয়ে দিগম্বর হয়ে বায়ুস্নান সারবেন, ভেতর থেকে আধঘণ্টার জন্য ছিটকিনি আটকে রাখবেন। ব্যস হয়ে গেল। আপনি হাঁটাহাঁটি করে বায়ুস্নান সারতে পারবেন।”
“গুড আইডিয়া।” বললেন জামিল সাহেব।
সেদিন রাতে পরিমল রাতের খাবার নিয়ে এলে জামিল সাহেব ছাদের চাবি নিয়ে রাখলেন। পরদিন থেকে ছাদে ঈদ আনন্দে নিয়মিত বায়ুস্নান করতে লাগলেন।
ভোর পেরিয়ে সকাল হলো। জামিল সাহেব তার মাই ডেইলি ডিউটি অনুযায়ী সব কাজ করছেন। কাল রাতে ঘুমের মধ্যে চক-ডাস্টার হাতে বেরিয়ে নিচতলায় গিয়ে ক্লাস নেয়ার কথা বলা হয়নি। ইতোমধ্যে দুপুরে ক্লাসের ফাঁকে আমার পরিচিত একজন ডাক্তারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আমি আলাপ করেছি। ঘুমের মধ্যে রাতে হাঁটাহাঁটি করাকে বললেন- ‘সমনামবুলিজম’। স্লিপ ওয়াকিং। এটিও একটি রোগ। এ রোগে মানুষ দিনে যা যা করে তা রাতেও করতে চায়। রাতে ঘুমের ঘোরে করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। দেয়াল বা দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে মাথাও ফেটে যেতে পারে। বারান্দা থেকে নিচে পড়ে মৃত্যুও হতে পারে। ডাক্তার বললেন স্লিপ ওয়াকিংয়ের রোগী থাকলে রাতে ঘরের দরজাটি তালা দিয়ে রাখাই উত্তম এবং রোগীকে বিষয়টি জানিয়েও রাখা উচিত।
বিকেলে কলেজে তেমন কোনও ক্লাস থাকে না। দুপুরে খেয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেন জামিল সাহেব। আমারও বিছানায় গড়াগড়ি দেয়া হয়ে যায়। তারপর দুজন হাঁটতে হাঁটতে বাজিতপুর বাজারের দিকে অথবা প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ফরেস্ট বাংলোর দিকে যাওয়া হয়। জামিল সাহেব সন্ধের আগেই ঘরে ফেরার পক্ষে। তাই আমার আর দেরি করে ফরেস্টের ভেতর সন্ধ্যা দেখা হয় না।
আজও জামিল সাহেবের সাথে ফরেস্ট বাংলোর দিকে যাচ্ছি। পথে ডাক্তার সাহেবের পরামর্শ মতো গতরাতের স্লিপ ওয়াকিংয়ের বিষয়টি জানালাম। জামিল সাহেব পুরোপুরি অস্বীকার করলেন। ভাবটা এমন যেন তিনি গতরাতে ঘুমের স্বপ্নপুরিতেই ছিলেন। বরং উল্টা আমাকে দুষলেন হয়তো আমি ভুল দেখেছি।
সেদিন থেকে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ঘরের ভেতর ছিটকিনিতে তালা দিয়ে রাখছি। আমার ভেতর ভয়ের আনাগোনা দেখা দিয়েছে। জামিল সাহেবের উপর কোনো জিন ভর করেছে কি না কে জানে? কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের সাথেও বিষয়টি আলাপ করলাম। তিনি আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন। বললেন প্রথম যে দিন জামিল সাহেব কলেজে এলেন, পরিচয়পত্র দিলেন সেদিনই তার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল।
তিন-চার দিন খাবার দেয়ার পর পরিমল একদিন ভয়ে ভয়ে বলল “স্যার, জামিল স্যারের মাথায় কি ডিস্টার্ব আছে?”
বললাম “কেন?”
“তিনি দেখি আকাশের দিকে তাকাইয়া, গাছের দিকে চোখ বন্ধ কইরা বিড়বিড় করেন। কথা বলেন।”
“তাই নাকি?” বললাম আমি।
“জে স্যার।”
আমার ভয় বাড়ছে। এ ধরনের একজন অস্বাভাবিক চরিত্রের মানুষের সাথে এক ঘরে থাকাও বিপদ। ঘুমের ঘোরে যে কোনও সময় আমাকেও গলা টিপে মেরে দিতে পারেন। অথবা জবাই করে দিয়ে ভাববেন ছাগল জবাই দিচ্ছেন। সকালে জেগে দেখবেন আমার গলাকাটা লাশ। রাতে জামিল সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলাম। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এল না। অজানা ভয় মনে বিড়বিড় করছে। জানালা খোলা। আকাশে মেঘের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো নেই। দীর্ঘদেহী ইউক্যালিপটাস গাছেল সরু ডাল-পালা দুলছে। চামচিকার ওড়াওড়ি। রাত পাখিদের ডাক। অন্ধকারের দেহ ভেদ করে চাঁদের উঁকি।
জামিল সাহেব পাশ ফিরে শুলেন। আমার মনোযোগ অন্ধকার রাতের প্রকৃতি থেকে জামিল সাহেবের বিছানায় ফিরে গেল। আকাশে মেঘের ছুটোছুটি দেখে জ্যোৎস্নার আলো তেমন নেই। আবছা আলো। থেকে থেকে গভীর অন্ধকার। জামিল সাহেবকে আমার বিছানা থেকে কালো ছায়ার মতো দেখাচ্ছে। মানুষের একটি অবয়ব বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। কিছুক্ষণ। দাঁড়ালো। একটি ছায়ামূর্তি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। কিছু একটা হাতে নিল। আলো একেবারেই ক্ষিণ দেখে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। একটি হাত উপরে উঠিয়ে মুখের কাছে নিলেন। জল পান করলেন। তারপর দরজার দিকে হেঁটে গেলেন। ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করলেন। তালা দেয়া দেখে খুলতে পারলেন না। ফিরে এলেন। ঘরের ভেতর পায়চারি করছেন। অন্ধকারে জামিল সাহেবের দেহটি ভৌতিক অবয়ব মনে হচ্ছে। কয়েকবার পায়চারি করে পুনরায় দরজার কাছে ফিরে গেলেন। ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করলেন। এবার জামিল সাহেবের মুখ থেকে গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছি। জামিল সাহেবের ছায়ামূর্তির দিকে নজর রাখছি। পায়চারি থামিয়ে তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন। পা টানলেন। তারপর টানটান হয়ে শোয়া। জামিল সাহেব বিছানা রেখে মেঝেতে শুলেন কেন? মনের ভয়টা তেড়ে উঠছে। এই বুঝি জামিল সাহেব কিছু একটা করে বসবেন!
না। তিনি কিছু করলেন না। মৃদু স্বরে নাক ডাকছেন। জামিল সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি জেগে আছি। হঠাৎ কিছু ঘটে যাওয়ার অপেক্ষায়। বাইরে শীতল বাতাস বইছে। বৃষ্টি হতে পারে। মেঝেতে শুয়ে থাকা জামিল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছি। রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। জেগে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। বাইরে থেকে দরজায় খটখটানির শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল।
জেগে ওঠার সাথে সাথে খুঁজলাম জামিল সাহেবকে। তিনি ঘরে নেই। দেখা যাচ্ছে না। বালিশের নিচে থেকে হাতঘড়ি টেনে নিলাম। সকাল সাড়ে সাতটা। বাইরে দরজা খটখটানির শব্দ। উঠে গিয়ে তালা খুললাম। পরিমল সকালের নাশতা নিয়ে এসেছে। পরিমলের হাত থেকে নাশতার বক্স নিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। জামিল সাহেব শৌচাগার থেকে বেরুলেন। এবার আমার শৌচাগারে যাওয়ার পালা। জামিল সাহেব নাশতা সারবেন। তারপর ছাদে যাবেন। বায়ুস্নানে।
জামিল সাহেব নাশতার টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। বক্স খুলতে যাবেন এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
“কে? কে?” বলতে বলতে আমি এগিয়ে গেলাম। ছিটকিনি খুলেই দেখলাম একজন মহিলা, গায়ে বাসন্তি রঙের শাড়ি জড়ানো, দাঁড়িয়ে আছে। দুধে আলতা ফর্সা চেহারায় বেশ সুন্দরী। আনুমানিক ত্রিশ পেরিয়েছে। দু’চোখে তীব্র সম্মোহনের মমতা। মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আগে কখনও দেখিনি তা নিশ্চিত।
“জামিল সাহেব আছেন?” বললেন মহিলা।
মহিলার কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। একই সাথে নিজের শৌচাগারে যাওয়ার কথা ভুলে গেলাম।
“জি। জামিল সাহেব আছেন।”
মহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন। জামিল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মহিলাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন জামিল সাহেব। মহিলা জামিল সাহেবের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন। একটাই চেয়ার আগলে দাঁড়িয়ে আছেন জামিল সাহেব। মহিলাকে বসতে বলবেন কি বলবেন না দ্বিধা করছেন। ঠোঁট কাঁপছে। শরীরেও ভূত দেখার মতো কম্পনের ঢেউ অনুভব হচ্ছে।
আমার টেবিলের সাথে সাটানো চেয়ারটি এনে মহিলাকে দিলাম। বসতে বললাম।
তিনি বসলেন। জামিল সাহেব দাঁড়িয়েই আছেন।
“বস।” মহিলা জামিল সাহেবকে বললেন।
“এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছ যেন একান্ত বাধ্যগত ছাত্র। বাধ্যগত স্বামী হলে তো আজ আমাকে এখান অবধি আসতে হতো না।” পুনারায় মহিলা বললেন।
সাজ সকালে কী হতে যাচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। জামিল সাহেব চেয়ার ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলেন। মুখে ভীষণ জড়তা নিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললেন “তুমি!”
“কেন? খুব অবাক হলে তাই না?”
“হুম। না… মানে..” জামিল সাহেব কর্তব্যবিমূঢ়।
“অবাক তো হওয়ারই কথা। আমি এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছাব তুমি তা কল্পনাও করোনি। পাতালের গহিনে গেলেও তোমাকে আমি তুলে আনব।” বললেন মহিলা।
সুন্দরী মেয়েরা যখন রেগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কথা বলেন তখন তাদের পৃথিবীর একমাত্র কদাকার মহিলা বলে মনে হয়। এই মহিলা যখন রেগে কথা বলছেন তখন তাকে খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে। চোখের সম্মোহনী ক্ষমতা যেন ডাইনিতে রূপ নিয়েছে, আচ্ছা এই মহিলা কি জামিল সাহেবের স্ত্রী? কথার ঢংয়ে তো তাই মনে হচ্ছে।
মহিলা পুনরায় বিশ্রী রূঢ় স্বরে কথা বলা শুরু করলেন।
“সংসার করার ইচ্ছে যদি নাই থাকত, তাহলে বিয়ে করার প্রয়োজনটা কী ছিল? বিয়ে কি ছেলের হাতের মোয়া! ইচ্ছে হলো করলাম আর ভালো লাগল না ফেলে দিলাম! আর রোগ-ব্যাধি মানুষের থাকতেই পারে তার চিকিৎসাও আছে। তুমি রাতে ঘুমের মধ্যে ভূতের মতো হেঁটে বেড়াও। গাছপালা আর শূন্যের সাথে বিড়বিড় করে কথা বল- এসব তো রোগ। এর চিকিৎসা করাও। সুস্থ হওয়ার চেষ্টা কর। সংসার করো। আমারও তো একটা জীবন আছে।”
জামিল সাহেব অনড় বিছানায় বসে আছেন। স্ত্রী ইচ্ছেমতো মনের খেদ মেটাচ্ছেন। আমার শৌচাগারে যাওয়ার চাপ বাড়ছে। না গিয়ে বিছানায় বসে আছি। জামিল সাহেব বিবাহিত তা জানা ছিল না। ঘর-সংসার থাকলেও তিনি যে ছন্নছাড়া জীবনযাপন করছেন তা এই মহিলা মানে জামিল সাহেবের স্ত্রী হঠাৎ করে এসে না পড়লে হয়তো জানাই হতো না।
জামিল সাহেব ও তার স্ত্রী মুখোমুখি বসা। মহিলাটিকে জামিল সাহেবের স্ত্রী বলে তার কথায় আমি ধরে নিয়েছি। আসলে জামিল সাহেবের স্ত্রী কি না তা মহিলাটি চলে গেলে জানা যাবে। পেছন থেকে মহিলার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। জামিল সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছেন।
“তারপর তোমার সেই বদ অভ্যাস। সকালে নাশতার পর ঘরের দরজা বন্ধ করে জানালার পাশে ন্যাংটা হয়ে বসে থাকা। বলে কি না বায়ুস্নান। আরে বাবা এই জনমে তোমার কাছে এসে প্রথম জানলাম বায়ুস্নান নামে একটি পাগলামি বিষয় আছে। কাপড়-চোপড় খুইল্ল্যা ন্যাংটা হইয়া জানালার পাশে বইসা থাকা। এইটা কোনও কথা! আমি স্ত্রী হলেও স্ত্রীর সামনে কি স্বামী ন্যাংটো হইয়া ঘরে বইসা থাকে!” এক নাগাড়ে বলে থামে মহিলা।
উত্তেজনায় মহিলার কথা বলার ভাষায় পরিবর্তন হচ্ছে টের পাওয়া গেল। হঠাৎ মুখ ফসকে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল- জামিল সাহেব এখানেও বায়ুস্নান করে থাকেন। খোলা আকাশের নিচে। ছাদে। বললাম না। মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথা আটকে দিলাম।
মহিলা পুনরায় মুখ খুলল “আমার বাপে কলেজের প্রফেসর পাত্র দেইখ্যা গলায় ঝুলাইয়া দিল। শুধু পাত্রের আয়-রোজগার ভালো, সামাজিক পরিচিতি ভালো দেইখ্যা মাইয়া গছাইয়া দিলে হইব? দেখতে হইব না- মাথায় সমস্যা আছে কি না, চরিত্র কেমন? ন্যাংটা হইয়া ঘরে বইসা থাকে কি না?”
দম নেয় মহিলা।
“বাপরেও আর কি দোষা দিমু, বেচারা অকালে চইলা গেল। যাওয়ার আগে মেয়েটার একটা বিহিত কইরা গেল। এমন জায়গায় বিহিত করলো…”
“শিউলি তুমি কেন এসেছ?”
দীর্ঘসময় আতঙ্কে বুঁদ হয়ে থাকার পর জামিল সাহেবের মুখ ফুটে কথা বেরুল।
মহিলাটির নাম জানা গেল। শিউলি।
“কেন এসেছি মানে? তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার জীবনটা তুমি ছারখার করে দিয়েছ। হয় তুমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, না হয়…” থামে শিউলি।
শিউলির মুখে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে ভয় ও আতঙ্কের ছাপ ভেসে ওঠে জামিল সাহেবের মুখে। জামিল সাহেব মাথা তুলে তাকাতে আমার চোখাচোখি হয়। পরিমলের রেখে যাওয়া নাশতার বক্স টেবিলে খোলা পড়ে আছে। নাশতা সেরে জামিল সাহেবের ছাদে বায়ুস্নানে যাওয়ার শিডিউল। শিউলি এসে জামিল সাহেবের মাই ডেইলি ডিউটি এলোমেলো করে দিল।
যাই। শৌচাগার থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি। আমারও ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে যাবে। শিউলি এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। জামিল সাহেব হ্যাঁ-হুঁ করছেন।
স্নান সেরে বেরিয়ে দেখি চেয়ার শূন্য। শিউলি নেই। জামিল সাহেব বিছানায় বসে আছেন। এক ধ্যানে পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
“নাশতা তো ঠান্ডা হয়ে গেল…” পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম।
“ও, হ্যাঁ।” বলেই নাশতার টেবিলে ফিরে গেলেন জামিল সাহেব।
“ভাবি ফিরে গেছেন?” জানতে চাইলাম।
“জি।”
জামিল সাহেব চুপচাপ। আটার রুটি দিয়ে আলু ভাজি খাওয়া শুরু করেছেন।
“ভাবি আছেন তো জানতাম না। কোথায় থাকেন ভাবী?”
“জানি না।”
“মানে? জামিল ভাই, আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?”
“জি না। শিউলি এক সময় আমার স্ত্রী ছিল। এখন নেই।”
“মানে? ডিভোর্স হয়েছে?”
“না।”
“তো?”
“শিউলি দুই মাস তেরো দিন আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে।”
“কী বলছেন জামিল সাহেব?”
“ঠিকই বলছি।”
“তাহলে এতক্ষণ বসে যে আপনার সাথে কথা বলে গেলেন! আপনি তাকে শিউলি বলেও ডাকলেন।”
“সবই ঠিক আছে।”
“তাহলে?”
“আমার সাথে শিউলির বিয়ে হয় তিন মাস আগে। বিয়ের প্রথম দুই সপ্তাহ ও রাতে খুব ভয় পেত। বাসর রাতের পর আমাদের এক বিছানায় আর থাকা হয়নি। এক রাতে ও ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করে। হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে ওদের বাসায় ফিরে যায়। তারপর এক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যায়। আমি শুনেছিলাম মারা গেছে। এ ঘটনার পর ওদের বাড়িতে আমার যাওয়া হয়নি। তবে আমি নিশ্চিত সে মারা গেছে।”
“মারা যদি গিয়ে থাকে তাহলে এখন এল কী করে?” বললাম আমি।
“সেটা তো আমারও প্রশ্ন।”
“আচ্ছা জামিল সাহেব ভাবি কী ভয় পেতেন? জ্বিন, ভূত?”
“না। আমাকে।”
“মানে?”
“আমি নাকি রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটি, কথা বলি, গোঙাই।”
“কথাগুলো সঠিক। আমিও তো বললাম। তাহলে আপনার কারণেই শিউলি ভাবি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।”
“হয়তো।”
“এখন যিনি এলেন?”
“শিউলি ওর আত্মার উপর ভর করে এসেছে। কারণ আমি জানি ও মারা গেছে।”
“কেন এলো?”
“বলল তো আমাকে নিতে।”
“জামিল সাহেব আমার মনে হয় কোথাও একটা গন্ডগোল হচ্ছে। এমনও হতে পারে শিউলি ভাবি মারা যায়নি। আপনি শিউলি ভাবির বাড়িতে একবার খোঁজ নিয়ে দেখুন।”
“হুম। তাই করা উচিত।”
মাঝরাতে ইউক্যালিপটাস গাছে চামচিকার পাখা ঝাপটানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। ডানহাতের আঙুলে চোখ কচলে দেখি। ঘরে আবছা আলো। হঠাৎ বুকের ভেতর ধক্ করে ওঠে। জামিল সাহেবের বিছানা শূন্য, মশারি টাঙানো। ভয়ে দেহের মধ্যে রক্তের হিমশীতল প্রবাহ বয়ে যায়। তাপদাহের এই সময়েও লোম খাড়া হয়ে যায়। বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখি ছিটকিনি খোলা। রাতে ভুলে তালা দেওয়া হয়নি। জামিল সাহেব নিশ্চয়ই স্লিপ ওয়াকিংয়ে বেরিয়ে গেছে। খুঁজতে যাব কি না ভাবছি। তার মৃত স্ত্রী শিউলি বেগমের আত্মা দেহে ভর করে ফিরে আমার মনে ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
থাক। জামিল সাহেব স্লিপ ওয়াকিং শেষে নিশ্চয় সেদিনের মতো ফিরে আসবেন।
দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। ঘুম এলো না। অনেকক্ষণ। জামিল সাহেবের স্ত্রী শিউলি বেগমের মৃত্যু, ফিরে আসা, জামিল সাহেবের স্লিপ ওয়াকিং, বায়ুস্নান সব মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে।
ভোরের দিকে চোখ জড়িয়ে আসে। পরিমলের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ছুটে যায়। জেগেই জামিল সাহেবের বিছানায় চোখ যায়। বিছানা শূন্য। তিনি ফেরেননি।
পরিমল ঘরে এসে নাশতার বক্স রাখল। পরিমলকে বসিয়ে রেখে শৌচাগারে খুঁজলাম। নেই। ভয়টা গলার কাছে এসে গেল।
“পরিমল!”
“জে স্যার।”
“নিচে জামিল সাহেবকে দেখেছ?”
“জি না স্যার।”
“এক কাজ কর। একবার ছাদে দেখে এসো তো।”
“পরিমল ছাদের দিকে গেল। আমি করিডোরে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখছি।”
ছাদ থেকে পরিমলের চিৎকার শোনা গেল।
“স্যার…!”
দৌড়ে ছাদে গেলাম। পরিমলের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। জামিল সাহেবের দিগম্বর মৃতদেহ ছাদের কার্নিশের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মনে শঙ্কাটা বেজে উঠলো।
শিউলি বেগম কি তাহলে জামিল সাহেবকে নিতে এসেছিল?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন