short-story-bedanar-maa

বেদনার মা
দীলতাজ রহমান


মানসুরাহ’র বিয়ে হয়েছে বছর দশেক। এই দশ বছরে তার ছেলেমেয়ে হয়নি, এর জন্য তার মা-বাবার তেমন কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন থেকে সাধারণ মানুষ পরিবারের খোঁজ-খবর করতে গিয়ে যখন শোনে গফুর খন্দকার ও তার স্ত্রী জোহরা খন্দকারের ছয় নম্বর সন্তান মানসুরাহর এখনো ছেলেমেয়ে হচ্ছে না, তখনি তারা সবাই যারযার পছন্দের ডক্তার থেকে কবিরাজের কাছে মানসুরাহ’কে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এমন কি তাদের কেউ কেউ পারলে মানসুরাহকে তখনি সাথে করে নেয়!

কেউ কেউ যখন জানতে চায়, দোষটা আসলে কার, গফুর- জোহরা কেউই তা বলতে পারেন না। আর এরকম সময় আগন্তুকদের কেউ কেউ বলে ফেলে, কেমন দায়িত্বহীন মা-বাবা আপনারা, যে মেয়ে-জামাই দুজনের কার দোষে সন্তান হচ্ছে না, তাও আপনারা জানেন না।

গফুর সাহেব অতি চাপা স্বভাবের মানুষ। তিনি তার মতো করে উত্তর দেন, বলেন, এটা একটা দম্পতির অতি ব্যক্তিগত বিষয়। তারা না বলতে চাইলে জোর করে জানতে চাওয়া কি ঠিক?

কিন্তু জোহরা খন্দকার মাঝে মাঝে পরিমিতি বোধ রক্ষা করতে না পেওে অধৈর্য হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘ঠিকই তো, মানুষ তো ঠিক কথাই বলে। মায়ের অন্তত জানার অধিকার আছে দোষটা কার! কারণ মানসুরাহর শ্বশুর-শাশুড়ি ভাববাচ্যে আমাকে শোনাতে ছাড়েন না, যে দোষটা আমার মেয়ের! আসলে যে মেয়ে মা হয়নি সে নিজের মায়ের দুঃখও বোঝে না। তাদের মাতৃত্বের বোধটি অন্ধই থেকে যায়। বোধ খোলে না!

মায়ের এমন কথা বহুদিন রকমফেরে মানসুরাহ’র কানে পৌঁছে গেছে। সন্তান সম্পর্কে স্বয়ং মায়ের এমন কথায় সে নিজে কষ্ট পেলেও মাকে প্রবোধ দিতে বলেছে, আচ্ছা মা, আপনাদেও তো আটটি ছেলেমেয়ে। তারা সবাই বিয়েসাদী করে বংশ বৃদ্ধি কওে আপনার বাড়ি সরগরম করে রেখেছে। আপনাদের একটা মেয়ের শুধু ছেলেমেয়ে হচ্ছে না, তাতে আপনার এত দুঃখ কেন?

তারপর মানসুরাহ গফুর খন্দকারের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা, আমাকে নিয়ে আপনারও কি আমার মায়ের মতো দুঃখ?

গফুর দম্পতি প্রায় একসাথে উত্তর দেন, আমাদের দুঃখ তোমার জন্য, তোমার সন্তানের জন্য নয়! নিজের সন্তান থাকলে সাধারণত যে কোনো অবস্থায় মা-বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। পোষ্য নিলে বা ভাগ্নে-ভাগ্নি পুষলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নানান বিড়ম্বনা দেখা যায়। তাই আমরা প্রার্থনা করি তোমার কোলজুড়ে অন্তত একটি সন্তান আসুক! যৌবনকালে কাউকেই না হলে চলে, কিন্তু বয়স বাড়লে অনিবার্যভাবে অবলম্বন লাগে মা!

মা-বাবার এত ভারিক্কি কথার পরেও মানসুরাহ’র কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। সে সেখান থেকে সরে পড়ে। হয়ত সে মা-বাবার ফ্ল্যাট ছেড়ে দু’ফ্লোর ওপরে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যায়।

জোহরা খন্দকার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুধু শুধুই কি বলি, যার সন্তান হয় না, সন্তান বিষয়ে তার ফিলিং থাকে না! যদি পেটে একটা জন্মাতো তাহলে আমাদের দুঃখ বুঝত! বুঝত, সন্তান পিতামাতার কতখানি, আর আমরা কি নিজের দুঃখে না কি তার দুঃখে হা-পিত্যেস করি!’ এটুকু বলেই যেন লাফিয়ে জোহরা আরেক প্রসঙ্গে গেলেন। স্বামীর দিকে চোখ আরো সুঁচালো করে বললেন, আচ্ছা, তুমি খোঁজ-খবর করো তো, যে কোনোভাবে একটি মেয়ে তুমি জোগাড় করো। আমরাই প্রতিপালন করব। এরপরে যদি মানসুরাহ’র বাচ্চা হয়, সেটা আরো ভাল। তারা দুজন হবে!

: কিন্তু মেয়ে কেন? ছেলে নয় কেন?

: শোনো, মেয়ে বড় হয় আর ঘরে ঢোকে। ছেলে বড় হয় আর ক্রমে বহির্মুখি হয়!

: এখন মেয়েও আর ঘরে থাকে না গিন্নী, তোমার হিসেব এখনকার সময়ে এসে গড়বড় বেঁধে গেছে। তবে কথা এটা সত্য, নিজের ছেলেমেয়েও কি মা-বাবার প্রয়োজনে কাছে থাকে? তবু জন্মদান ও প্রতিপালনের আনন্দ যাপন করা! যে যাকে পোষে, তার নিজের আনন্দেই পোষে।

উপরোক্ত কথাগুলো সন্তানহীন মেয়েকে শোনাতে স্বামী-স্ত্রী দুজন উত্থাপণ করলেও প্রস্তাবটি লুফে নেয় বাড়ির বাবুর্চি নবাব আলী। সেই পরামর্শ দিল, বলল, ‘বৈধবাবে মেলা জায়গা থিকা পুষ্যি নিয়া যায়। কিন্তু তা আবার থানায় জানাতি অয়। থানাঅলারা আবার রেগুলার সে পুষ্যির খুঁজখবর নেয়। অন্যের নজরদারিতে অমন পুষ্যি পুইষে আরাম পাবিনানে! তারচেয়ে এমনি অভাবে পইড়ে যারা বেচে, তাগে কাছতে নেন! কোনো প্রমাণ থাকপিন্যানে!’

গফুর খন্দকার: সারাজীবন মানুষের বাড়ি রান্নাবাড়ার কাজ করেও তুমি এতকিছু জানো নবাব আলী?

নবাব আলী: বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করছি বুইলাই তো অন্য মানুষির অবিজ্ঞতা নিজির মাথায় জুমা অইছে সাহেব! তয় কতা আরো আছে, বৈধ জায়গারতে বাচ্চা আনতি গেলি স্বামী-স্ত্রী একসাতে যাওয়া নাগে। আমার তো মনে অয় না মানসুরাহ আম্মার স্বামী যাবেনে! দেহেন না আম্মা নিজিও যায় কি না! না অলি এমন এট্টা গুরুত্বুপূন্ন কথা থুইয়া তিনি সইরে পড়লেন!

নবাব আলীর কথায় জোহরা খন্দকার লোভাতুর হয়ে ওঠেন। তিনি বাড়ির বুড়ো বাবুর্চির প্রতি কাতরস্বরে বললেন, পারবে সেভাবে কারো একটা বাচ্চা আনতে? ওদের কারো যেতে হবে না আমরা দুজন দায়িত্ব নিয়ে পুষব! আমাদেরকে তো আল্লাহ কম কিছু দেন নাই। এই যে সব ছেলেমেয়েরে একটা করে ফø্যাট তো আমরাই দিলাম! আর কাউকে দায়িত্ব নিয়ে আনলে তাকেও কিছু দিব! মানসুরাহ যে চাকরি করে, সে বাচ্চা পুষবেই কী করে? তার হলেও তো আমাকেই পালতে হত! কাছে থাকা সবার সব কটাকে তো আমিই পেলেপুষে স্কুল ধরিয়ে দিলাম!

দিন চারেক পর জানা গেল, ঢাকা থেকে বহুদূরের জেলা সুনামগঞ্জের রাস্তার পাশের এক বস্তিতে একটি বাচ্চা পাওয়া গেছে। নবাব আলীই তার কারো মারফত খবরটা পেয়েছে। একজনের দুটি মেয়ে হয়েছে। একটি সুস্থ আরেকটির হার্টের বাল্ব ত্রুটিপূর্ণ। ডাক্তার তাদেরকে বলেছেন, এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যয়বহুল। তাও বাচেঁ কি না, গ্যারান্টি নেই। যাদের বাচ্চা তারা এতই দরিদ্র যে এই রোগের নামও তারা শোনেনি। থাক তো চিকিৎসা! তাই ভালো বাচ্চাটা বিক্রি করে অসুস্থটার চিকিৎসা করাবে।

গফুর খন্দকারের থেকে জোহরার খন্দকারের আগ্রহই বেশি। তিনি স্বামীকে নিয়ে সুনামগঞ্জের সেই বস্তিতে গিয়ে বাচ্চা দেখে এসেছেন। তাদেরকে কিছু টাকাও এমনিতে দিয়ে এসেছেন। মায়ের দুধ খাইয়ে আরেকটু ঝরঝরে হলেই আগামী সপ্তাহে আবার যাবেন দুজনে সুস্থ বাচ্চাটি আনতে। মূল্য একলাখ টাকা!

বিষয়টা তিনজনের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকলেও কী করে যেন মানসুরাহর কানে পৌঁছে গেল। হয়ত মা-বাবা আর বাবুর্চির টুকরো-টাকরা কথা জোড়াতালি দিয়ে সে উদ্দেশটি বুঝে নিয়েছে। মা-বাবার নির্দিষ্ট দিনে মানসুরাহ নিজেই তৈরি হয়ে মা-বাবাকে বলল, আপনাদের যেতে হবে না। আমিই নবাব আলী চাচাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি!

গফুর খন্দকার আর জোহরা খন্দকার ভয়ে ভয়ে একসাথে বলে উঠলেন, কোথায় যাবে?

: ওই যে বাচ্চা আনতে!

স্বামী-স্ত্রী দুজনের মুখেই আনন্দের রেশ ঝিলিক দিয়ে উঠল। জোহরা খন্দকার বললেন, জামাই যাবে?

: তাকে বলিনি!

: যদি পরে আপত্তি করে?

: মা, আমিও কিন্তু চাকরি করি! চাকরি করা মানে শুধু বেতন পাওয়া নয়। স্বাধীন মনোভাবও পোষণ করা!

: শেষ র্পযন্ত না পরের একটা বাচ্চা এনে পালতে দুজনের কলহ শুরু হয়। এমনিতে তো ভালই আছ দুজনে। আমরা ভেবেছি, তোমার নামে আমরা এনে প্রতিপালন করি, যাতে তোমাদের কোনোভাবে বেগ পেতে না হয়, কিন্তু সে জানবে জানবে তোমরাই তার মা-বাবা!

: মা, মা-বাবা হয়ে উঠতে হয়। খালি চিনলেই তা হয় না! যাই, দূরের পথ। সকাল সকাল রওনা দিই! আমি অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়েছি!

মেঘ না চাইতেই এমন অমল জলের বর্ষণ দেখে গফুর খন্দকার মেয়েকে বললেন, তুমি জানলে কী করে, আমি তো তাই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি!

: বাবা, ওই যে প্রবাদ আছে না, ‘যা জানে না গাঁয়, তা জানে মায়!’ না বাবা, কদিন ধরে আপনার আর মা’য়ের আনন্দ দেখে একটু ওঁৎ পেতে ছিলাম। তারপর পুরোটাই জানা হল। ভাবলাম, যাক, আপনাদের এ বয়সে এসে একটা বাড়তি কাজের ব্যবস্থা যদি আমাকে উপলক্ষ করে হয়!

: আমরা তোমার সাথে যেতে চাই!’ জোহরা খন্দকার বললেন।

: না মা, আমি একাই যাব বলে ভেবে রেখেছি, বলে মানসুরাহ নবাব আলীকে তাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল!

আজ ঢাকা থেকে যে বৃদ্ধ দম্পতিটির আসার কথা টাকা নিয়ে, দিনভর তাই জমজ শিশু দুটির মা-বাবার জীর্ণ কুটিরে মানুষের আনাগোনা চলছে। মানসুরাহ গিয়ে দেখল, সুস্থ শিশুটিকে অন্যান্যরা লেপটে কাজল দিয়ে, দলা দলা পাউডার মেখে সাজিয়ে রেখেছে। আর অসুস্থ শিশুটি কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদছে তাদের কিশোরী বয়সী মা! এই প্রথম তার মা হওয়া। দীর্ঘদিন পুষে রাখা আনন্দের ভেতর এমন বিড়ম্বনা হামলে থাকবে, এ সে কিশোরী কেন, তাদের কেউই ভাবতে পারেনি!

মানসুরাহকে বসার জন্য ঘরের সামনে একটি টুল দেয়া হল। কিন্তু কাদামাটি আর খোলা পায়খার গন্ধে তার দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মানসুরাহ’র উসখুশ ভাব দেখে নবাব আলী দ্রুত তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলল তার বয়সী ওখানকার আরেক বৃদ্ধকে।

বৃদ্ধ ও নবাব আলীর যোগসাজশ দেখে মানসুরাহ বুঝল, ওই বৃদ্ধই এই নাটের গুরু। নবাব আলীকে এ শিশুর ব্যবস্থা সেই করে দিয়েছে। মনে মনে সে ধন্যি মানল বৃদ্ধ নবাব আলীর, যে এতদূর তার যোগাযোগ! তার এই মেধা কাজে লাগালে সে আরো যে কী কী করতে পারত! দিন দশেকের সুস্থ শিশুটিকে কোলে নিয়ে সুঠাম শরীরের প্রায় ছফুট লম্বা বৃদ্ধ গুঁজো হয়ে খুপরি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শিশুটিকে এক বাহুতে শক্ত করে চেপে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে দিল মানসুরাহ’র দিকে। বলল, আগে টাকাটা দেন!

মাথার সব চুল পাকা হলেও তেলতেলে ঋজু শরীরের অধিকারী বৃদ্ধকে মৃদু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নবাব আলী মানসুরার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, দেও দিকিনি মা একলাখ টাকা! আমি গুণে এগে বুজোই দিই যাই! তারপর মাইয়েডা কোলে নিই গাড়িতি উটি। মেলা ফত তো যেতি অবে ! আর অন্য মানষির কান্দাকাটি দেখলি আমারও কান্দন আসে!

মানসুরাহ দৃঢ়কণ্ঠে বলল, চাচা, বাচ্চার মা’কে ডাকেন!

: কতা তো ইর সাতে অইছে আমার। ই অলো একসুময়কার সিলেট রেল ইষ্টিশনের কুলিগে সরদার..।’ নবাব আলী কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বলল। ‘ইর কতাই শ্যাষ কতা! কাউরি মধ্যস্ততায় না রাখলি শ্যাষে একদিন ইরাই আমাগি খুঁইজে বাইর কইরে জামেলা পাকাবি। শ্যাষে মধ্যস্ততা করতি কেওরে পাবা না!’

নবাব আলীর সাথে এইটুকু কথপোকথনে অন্যরা কী বুঝে পনের-ষোল বছরের কম বয়সী আলেয়াকে ধরে নিয়ে এলো মানসুরাহ’র কাছে। মানসুরাহ তার হাতে একটি সুদৃশ্য পার্স দিয়ে বলল, তোমাদের যা দাবি ছিল, এতে তার চেয়ে বেশি আছে। আর তোমার সুস্থ মেয়েটিকে তুমি রাখো। আমি তোমার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে যাই, তাও যদি তোমরা দাও! দাও যদি, তারপর ওকে আমি চিকিৎসা করাব। তাতে যদি ও ভাল হয়, বেঁচে যায় তারপরই সে আমার হবে!

মানসুরার কথায় সবার কেমন ঘোর লেগে যায়। ভিড়ের ভেতর থেকে মৌমাছির গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু সবার থেকে বেশি ঘোরে ছিল মানসুরাহ নিজেই। ঢাকা থেকে কিনে নেয়া বেশ কিছু কাপড়চোপড় ও খাদ্য ও শিশুখাদ্য ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে বলে, হাতের কাছে রাখা খুব বেছে কিনে আনা বড় মোলায়েম তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে অসুস্থ মেয়েটিকে নিজের কোলে রাখল মানসুরা। মেয়েটির কষ্ট দেখে তখনি তার নিজের দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

গাড়ি ঢাকার ইস্কাটন বাসায় ঢুকতেই নবাব আলী হনহন কনে নেমে গিয়ে পুরো ঘটনা তার গফুর খন্দকার ও তার স্ত্রীকে বলে বুঝিয়ে দিল, এই গাফিলতিতে তার কোনো দায় ছিল না। সে আরও বলল, এতবড় গচ্ছা তার দ্বারা আর একটিও ঘটেনি। বলল, মানসুরাহ মামনি যে এই বাচ্চা আনল, এমনিতে টাকা সে বেশিই দেছে। তারওপর এর চিকিচ্ছে করতি দেহেন কত যায়! তাও যদি বাঁচে!

নবাব আলীর এই কথায় মানসুরাহ ক্ষুব্ধকন্ঠে বলল, বাবুর্চি চাচা, এখন এটা আমার মেয়ে। তাই ওকে নিয়ে হিসেব করে কথা বলতে হবে, কেমন?

নবাব আলীর প্রতি মেয়ের এমন নির্দেশে নিজেরাও ভেতরে ভেতরে সতর্ক হলেন গফুর দম্পতি। যদিও তারা রাগে দুজনই দাঁত কিড়মিড় করছিলেন, কারণ তারা সব সময় নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পছন্দ করে এসেছেন !

যেখানে জোহরা খন্দকার ভেবেছিলেন, মেয়ের জন্য বাচ্চা সংগ্রহ করে তিনি নিজে প্রতিপালন করবেন। সেখানে অসুস্থ বাচ্চাটির সেবাযত্নে মানসুরাহ মায়ের কোনো সাহায্যই নিচ্ছে না। বিয়ের পরে মানসুরাহ মা-বাবার বাড়িতেই আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। তাই তাদের নজর এড়ায় না জামাইয়ের মনোভাবও। বাচ্চাটির প্রতি জামাইয়ের উৎসাহ দূরে থাক, সে ফিরেও দেখছে না। কিন্তু তাদের মেয়ে মানসুরাহ তা তোয়াক্কা করছে না! সে বাচ্চাটি নিয়ে মগ্ন। এদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ভারতের ভেলরে নেয়ার ব্যবস্থা করতে একাই বাচ্চাটির পাসপোর্ট-অন্যান্য কাগজপত্র তৈরিসহ চিকিৎসা-সেবা একাই করে যাচ্ছে!

কিন্তু প্রায় মাসখানেক পরে ভেলর থেকে মানসুরাহ ফিরে এল শূন্য কোলে। শিশুটির যে অবনতি হচ্ছিল, এমন কি সে যে মারা গেছে তাও বাড়ির কাউকে জানায়নি। এক দুপুরে আচমকা বাড়িতে ঢুকে মাকে জড়িয়ে সে হু হু করে কাঁদতে থাকলে, হতভম্ব জোহরা খন্দকার বিষয়টি বুঝতে পেরে বলতে লাগলেন, কেন তুমি খামখেয়ালিপণা করে এতগুলো টাকা খরচ করে এই বেদনা কিনতে গেলে?

: আম্মা, আমি অনেকদিন আপনাকে বলতে শুনেছি, মানসুরাহ মা হতে পারেনি তাই তার অনেকগুলো বোধ অন্ধ রয়ে গেছে। তার বিবেক-মন গভীর হতে পারেনি! দুনিয়ার অন্য সব বিষয় ভাল বুঝলেও সন্তানের সাথে মায়ের যে সম্পর্ক, এমন কি আমার সাথে তার নিজের যে সম্পর্ক, এটাও সে ভাসা ভাসা বোঝে! দুটি পাথরের পাশাপাশি থাকার মতো!’ আপনার কোনো দুঃখই নাকি আমি বুঝি না! এমন কথায় আমার খুব রাগ হত আপনার ওপর। মনে হত আপনি আপনার একপেশে মনোভাব আমার ওপর চাপাচ্ছেন। তখন ঈশ্বরকে খুব নির্দয় মনে হত আমার। তাই খামখেয়ালিপণা নয়, আমি বুঝেশুনেই এই টাকাটা খরচ করেছি আম্মা, মেয়েটিকে বাঁচাতে। ভেবেছিলাম, জন্ম দিয়ে তো মা হতে পারব না, তাই কষ্টার্জিত টাকায় মূল্য দিয়ে যদি পারি! মূল্য দিয়ে বুঝেছি আম্মা, আপনার কথাই ঠিক! এখন যা আমি বুঝতে পারছি, আগে তা ধারণ করার মতো ক্ষমতা আমার হৃদয়ের ছিল না! এখন আর আমার মনে হচ্ছে না আমি সন্তানহীন!

: সময় চলে যায়নি। তোমরা চেষ্টা করো। নিজেদেরই সন্তান হবে!

: না আম্মা, কোনোদিনই হবে না! কারণ নোমান সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। তারপরও সে আমার মেয়েটির দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। আমাকে একটা ফোন করেও খবর নেয়নি, ভেলরে আমি একা ওকে নিয়ে কী যুদ্ধ করছি! এই যুদ্ধে ও শরিক না হয়ে বাবা হওয়ার সুযোগটা ও হারাল।

মেয়ের আহাজারি দেখে ধরা গলায় জানতে চাইলেন গফুর খন্দকার-কাগজপত্র তৈরি করতে-চিকিৎসা করাতে একটা নাম তো প্রয়োজন হয়েছিল। তাই কী নাম রেখেছিলে ওর?

: নাম? ওর নাম রেখেছিলাম বেদনা! যেন আপনারা আমাকে বেদনার মা বলে ডাকতে পারেন! এই ডাকের জন্য, অনুভূত পরম এই বেদনার জন্য মূল্যটা খুব বেশি নয় আব্বা। আমার এই মধ্যবর্তী চাকুরিজীবনের যা সঞ্চয় ছিল, আমি শুধু সেটুকুই নৈবেদ্য’র মতো করে ওর চিকিৎসায় সবটুকু ঢেলে দিয়েছি!

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *