রাজা ভট্টাচার্য
জায়গাটা খুঁজে বের করতে পেরে রঞ্জন বেশ খুশিই হয়েছিল।
গ্রামের লোক যখন শহরে ফ্ল্যাট নেয়, গোড়ার দিকে তার মাথা ঘুরে যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। ধরে নেয়, এবার সেও নাগরিক হবে; অর্থাৎ ‘শহরের লোক’ নামের কোনও এক আশ্চর্য প্রজাতির প্রাণীরা যেমন ভাবে থাকে, যা যা করে, সেও করবে। অফিস থেকে ফেরার পথে অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখবে, রাতের শো-য়ে বউ নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে আইনক্সে, মাঝেসাঝে বারে গিয়ে দু’পাত্তর হুইস্কি খাবে— ইত্যাদি।
কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য টের পাওয়া যায়, ওসব আকাশকুসুম। কলকাতা একশো ঊনত্রিশ আসলে কলকাতা নয়। এও মফস্বল, তবে মহানগরের একটু কাছের মফস্বল— এই যা। ট্রেনে কম সময় কাটে, বাড়িতে একটু বেশি সময় দেওয়া যায়। আর কিচ্ছু না। বরং বিকেলের ঝোঁকে কয়েকটা ফাঁকা ট্রেন পাওয়া যায়, কাজেই ছুটোছুটি করে সেই ট্রেন ধরার তাড়া বেড়ে ওঠে উলটে। অ্যাকাডেমিতে যাওয়াটা বাস্তবে হয়ে ওঠে না।
রঞ্জনের এসব তত্ত্ব বুঝতে লাগল তিনটি মাস। তারপর তার মধ্যে সেই বিচিত্র অনুভূতিটা আস্তে আস্তে গেড়ে বসতে শুরু করল, যাকে বলা যায় ‘নাগরিক ক্লান্তি।’ ক্রমাগত ফ্ল্যাট আর রাস্তা আর গাড়ি আর দোকান আর মানুষ দেখতে দেখতে যে ক্লান্তিটা প্রায় সবার মধ্যেই জন্মায়, আর প্রায় কেউ টের পায় না।
দুর্ভাগ্যবশত, রঞ্জন টের পেল। সত্যিই এটাকে নিছক দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না; কারণ যে নব্য নাগরিকেরা এটা টের পান না, তাঁরা সত্যিই ভালো থাকার চাবিকাঠি খুঁজে পান। রঞ্জন খুঁজে পেল না। ওর ঘুমের মধ্যে, ধানক্ষেত আর শিউলির ঘ্রাণের স্বপ্নের মধ্যে ক্লান্তি জমতে শুরু করল।
এই সময়ই ও খুঁজে পেয়েছিল এই জায়গাটা। পেয়ে বেঁচে গিয়েছিল।
ফ্ল্যাট থেকে গাড়ি-রাস্তা বড়জোর দু’মিনিট। সেটাকে পেরিয়ে গিয়েই ডানহাতে পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে একটা গলি ঢুকেছে। আপাতদৃষ্টিতে একই রকম গলি। দু’পাশে সার সার বাড়ি, ফ্ল্যাট নেই— এই যা।
একদিন কী মনে হল, এই রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছিল রঞ্জন। স্কুল থেকে ফিরছিল। বিকেল। পড়ন্ত রোদ্দুর। খুব, মানে খুবই টায়ার্ড লাগছিল সেদিন অকারণে। কলকাতার মরখুটে একটা স্কুলে পড়ায় ও। ছাত্র নেই, ক্লাস দিনে বড়জোর তিনটে। ক্লান্ত লাগার কথা নয়। তবু ক্লান্ত লাগে। ভাল লাগে না আজকাল আর স্কুলে যেতে, এমনকি পড়াতেও; যে কাজটা ও একসময় বেজায় ভালবেসে করত। সেই ক্লান্তি দূর করার কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে ও ঢুকে পড়ত অজানা সব গলি-গলতায়। বাড়ি দেখতে দেখতে হাঁটত পা টেনে টেনে।
সেদিনও তেমন করেই ঢুকে পড়েছিল এই গলিটায়। তারপর অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
অবাক হওয়ার মতো কিছু ছিল না অবশ্য। আসলে রাস্তাটা একটা কানা গলি। একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটা বাঁক নিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। ডানপাশে পরপর ছোট ছোট জমির উপরে তৈরি চোখ-ধাঁধানো সব দোতলা তিনতলা বাড়ি। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরকমই চোখ-ধাঁধানো সব গাড়ি। অনেক দাম গাড়িগুলোর, দেখলেই বোঝা যায়।
আর বাঁদিকে একটা বেশ বড় খালি জমি। ছোট ছোট প্লটে ভাগ করা, পাঁচিলে ঘেরা। বোঝাই যায়— জমিগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বর্তমান মালিকেরা এখনও বাড়ি করে উঠতে পারেনি। এইটুকু এক ফালি পোড়ো জমিতে তাই গজিয়ে উঠেছে ঝোপঝাড়, বুনোতুলসীর ঝোপ, দু’চারটে কলাগাছ, নিমগাছ।
আর এই সবকিছুর উপর একটা নীলচে ছায়া ফেলেছে মস্ত একখানা বিকেলের আকাশ।
জমিটার পিছনে যে আবার এক সারি বাড়ি রয়েছে, সেটা যেন রঞ্জন দেখতেই পেল না। ও হাঁ করে চোখ দিয়ে চেটে খেতে লাগল এক ফালি সবুজ, আর এক ফালি নীল রঙের আকাশ। কয়েক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, যেন কতদিন ও সবুজ দেখেনি, যেন কতদিন নীল রং ওর চোখে পড়েনি।
আর ঠিক তখনই ওর কানের কাছেই কে যেন বলে উঠেছিল,“বেজিটারে দ্যাখসেন?”
প্রথমে রীতিমতো চমকে উঠেছিল রঞ্জন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ওর থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক।
সত্যি বলতে কী, লোকটার চেহারা মোটেই ভদ্রলোকের মতো নয়। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, দুটোই ভয়ানক নোংরা, শতচ্ছিন্ন। গালে অন্তত দশদিনের না-কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি। গলায় কণ্ঠি। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। একটু দূরে দাঁড় করানো আছে একটা তিনচাকার ভ্যান। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে একটু বাঁদিক ঘেঁষে।
লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে রঞ্জন দেখতে পেল, জমিটাকে ঘিরে রাখা পাঁচিলটার উপরে সত্যিই উঠে এসেছে একটা ক্ষুদে বেজি।
“অহনতরি বাচ্চা আছে। অর পুরা ফ্যামিলি কিন্তু এহেনেই আছে।”
অনাবশ্যক বোধে কথাটার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না রঞ্জন। চুপ করে রইল। লোকটা অবশ্য ওর নীরবতাটাকে পাত্তা দিল না। নিজের মনেই বলল,“রেললাইনের পাশ দিয়া পরপর বেজির বাসা আছিল, বোঝলেন। একদিন ছোড মাইয়াডা বায়না করল— বেজি পোষবে। অর মায় বকা দিয়া কইল, নিজের খাওন জোডে না, আবার পুষ্যি আনে! শোনল না৷ বৈকালেই বেজির গর্তে হাত ঢুকাইতে গিয়া সাপের ছোবল খাইয়া…”
ধড়ফড়িয়ে উঠে ফিরে দাঁড়াল রঞ্জন,“কী বলছেন!” এবার লোকটা উত্তর দিল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,“দত্তপুকুর আর বিড়ার মাইঝখানে লাইনের পাশে ঘর আছিল আমার। হাসপাতালে লইতে লইতে শ্যাষ।”
বিস্ময়ের তীব্রতার একটা মাত্রা আছে, যে পর্যন্ত মানুষ আঁতকে ওঠে। সেই মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মানুষ অসাড় হয়ে যায়। রঞ্জন আজ এটা বুঝতে পারল। এইভাবে কেউ নিজের ছোটমেয়ের মৃত্যসংবাদ দেয় নাকি কোনও অচেনা লোককে!
“কিন্তু আপনে কন, এর লাইগ্যা কোনও বেজিরে দোষ দেওন যায়? যায় না। আমার বউডা অহনতরি বেজি দ্যাখলে অজ্ঞান হইয়া যায়।”
একটা ঢোক গিলে রঞ্জন বলল,“কত বছর আগের ঘটনা এটা?” লোকটা আবার উত্তর দিল না। তার বদলে বলল,“আমার কিন্তু এইখানে আইলে মন ভালা হইয়া যায়।”
“ক্যান?” নিজের অজান্তেই দ্যাশের ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে রঞ্জন।
“এহানে এত বড় একখান আকাশ দ্যাখসেন কোথাও?”
মোক্ষম জবাব। রঞ্জনের চোখ উঠে গেল উপরের দিকে। মস্ত একটা নীল আকাশে লাল দাগ পড়তে শুরু করেছে এবার। মেঘগুলো রঙ বদলাচ্ছে। বিকেল ঢলে পড়ছে সন্ধের গায়ে।
“বাড়ির পিছনেই ধানের জমি আছিল। আমার না, চাষা-গো। আমি সারাদিন ভ্যান টাইন্যা সেইখানে গিয়া বসতাম বৈকালে৷ দ্যাখবেন, পেত্থমে পুবদিকের ম্যাঘগুলা লাল হইয়া যায়, তারপর পশ্চিমের।” এতক্ষণের মধ্যে লোকটা একবারও তাকায়নি রঞ্জনের দিকে।
কিন্তু ঠিক বলেছে লোকটা। সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারলে রঞ্জন গিয়ে বসত ছাতে৷ ঠিক এইভাবেই প্রথমে লাল হত পূর্বদিকের মেঘ। বাড়ির সামনের সবুজ মাঠে লালচে ছায়া পড়ত।
“আপনি কি এখন এদিকেই থাকেন?”
“হ। বউ রাজি হইল না ওইখানে থাকতে। কবে বড় মাইয়াডাও বেজির গর্তে…”
শিউরে উঠে রঞ্জন বলল,“সেটাই তো স্বাভাবিক!”
“অহন স্টেশনের কাছেই একখান ঘর নিসি। নোয়াই খালের কাছেই। মুশকিল হইল, বেশিক্ষণ আকাশ না দ্যাখলে… বোঝলেন কিনা… সেইজইন্য এই বৈকালের দিকটা এইখানে আইসা বসি। অন্ধকার হইলে ভ্যান টানতে যাই গিয়া।”
বেশিক্ষণ আকাশ না দেখলে যে রঞ্জনের শ্বাসকষ্ট হয়, সেটা অবশ্য ও বলল না৷ এই ধরনের কথা এইরকম ভাঙাচোরা দেখতে একটা লোকের মুখ থেকে মোটেই আশা করেনি ও।
“আপনে কি বরাবরই এইহানেই…?”
“নাঃ। রিসেন্টলি এসেছি। বাড়িতে বড্ড অশান্তি হচ্ছিল। মা চাইছিল না আমিও ওখানেই থাকি। ভাইকে লিখে দিল সব। বাধ্য হয়ে…”
এই পর্যন্ত বলে আচমকা চুপ করে গেল রঞ্জন। ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? চেনা নেই জানা নেই, কোনও ভ্যানওয়ালাকে এসব ঘরের কথা বলে যাচ্ছে কেন ও?
“আপনেও উদ্বাস্তু?” ফিকে হাসল লোকটা।
রঞ্জন বুঝতে পারছিল, ওর সম্ভবত রেগে যাওয়া উচিত। একজন শিক্ষক আর এক ভ্যানওয়ালার মধ্যে এরকম কথাবার্তা হওয়ার কথা নয়। ঘটনাচক্রে আজ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে না থাকলে ও হয়তো সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে লোকটার ভ্যানে উঠত; একটিও শব্দ বিনিময় হত না ওদের মধ্যে, এবং স্টেশনে নেমে ও নিঃশব্দে একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ছুট দিত প্ল্যাটফর্মের দিকে। যেভাবে ওকে নিজের নিজের দলে টেনে নিল লোকটা, তাতে ওর রেগে যাওয়ারই কথা।
মুশকিল হল, ওর রাগ হচ্ছে না। কথাটা যে ওর আঁতে লেগেছে, তার কারণ— কথাটা সত্যি। এখানে চলে আসার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না ওর। দিব্যি ছিল নিজের বাড়িতে। একেবারে বাধ্য হয়েই…
জোর করে মনটাকে আবার ছোট্ট বেজিটার দিকে ঘুরিয়ে দিল রঞ্জন। এখন এসব ভেবে নিজেকে আরও একটু রক্তাক্ত করার ইচ্ছে ওর আদৌ নেই। অন্তত তিন বছর ধরে এই একটি বিষয় নিয়ে অসীম তিক্ততা বুকে পুষে রাত জেগেছে ও। একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। আর নয়।
বেজিটা এখন আর একা নয়। সত্যিই পাঁচিলের উপর উঠে এসেছে আরও চারটে বেজি। দুটো বড়, দুটো আগেরটার মতোই ছোট। বোঝাই যাচ্ছে, বাবা, মা আর তিন সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার। এরকম ঠাসবুনোট শহরে কোন্ মন্ত্রবলে যে এরা রক্ষা পেয়ে গেছে, আন্দাজ করা অসম্ভব। আদিগন্ত মরুভূমির মধ্যে একফালি সবুজের মতো, যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদে বেঁচে গেছে পাঁচখানা প্রাণ— রঞ্জনের মনে হল।
“সকালে, আর এই সন্ধ্যার দিকে— দুইবার অরা বাইরে আসেই। রোজই আসে। আমিও আইসা পড়ি। মাঝেমাঝে মনে লয়, আকাশ না, বেজি দ্যাখতে আসি আমি।” পান খাওয়া লাল লাল দাঁত বের করে হাসল লোকটা৷
খুব একটা হাস্যকর নয় কথাটা— রঞ্জন ভাবল। সত্যিই এই পাঁচটা ছোট্ট রোমশ প্রাণীর মধ্যে যেন খানিকটা গ্রাম বেঁচে গেছে কোনোভাবে৷ লোকটাকে বুঝতে ওর অসুবিধা হচ্ছে না। ও নিজেও ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত ওদের মফস্বল শহরটার বাইরে, সেই পূবের মাঠে; সূর্যাস্ত দেখতে, দিগন্ত দেখতে, ডাহুক আর বাঁশপাতি দেখতে— আর ছেলেকে দেখাতে।
ওদের মফস্বল শহরটা যেখানে গিয়ে গ্রামে মিশে যায়, পিচরাস্তার সঙ্গে কাঁচারাস্তার দেখা হয়, সেখানে নিমাইদাদুর বাড়ি। চাষা মনিষ্যি। দ্যাশের বাড়ি ছিল নোয়াখালি। রঞ্জনরা ঢাকা। নোয়াখালির ভাষা এত বছরের চেষ্টাতেও আয়ত্ত করতে পারেনি রঞ্জন। কিন্তু নিমাইদাদুর উঠোনের বাদামগাছের ছায়ায় বসে কত দুপুর যে কাটিয়েছে ও নিছক বাড়ির পিছনের খেতখামারের দিকে তাকিয়ে থেকে, আর দেশভাগের গল্প শুনে! মাটির গন্ধ তাই রঞ্জনের সর্বাঙ্গে লেগে আছে।
তিনতলার ফ্ল্যাটে কি আর সে গন্ধ পৌঁছয়?
মেঘের লালচে রঙ ফিকে হয়ে আসছে। বিকেলটা গড়িয়ে পড়ছে সন্ধের গায়ে।
লোকটা বিড়ি ধরাল। একটা টান দিয়ে বলল,“ঠিকোই কইসেন। একবার শিকড় কাইট্যা গ্যালে ফের কোথাও গিয়া বসা মুশকিল।”
এই কথাটা রঞ্জন বলল নাকি? কখন? হবেও বা, বলেছে হয়তো! কথাটা তো মিথ্যে নয়!
ভ্যান ঘুরিয়ে চলে গেল লোকটা। ঠোঁটের কোণে ঝুলছে জ্বলন্ত বিড়ি। এইবার ভাড়া টানবে বোধহয়।
পায়ে পায়ে ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটতে লাগল রঞ্জনও। বেজির গর্তে হাত ঢুকিয়ে যার মেয়ে মারা গেছে, তার কাছে বেজি নামের প্রাণীটা মৃত্যুর প্রতীক না হয়ে গ্রামের প্রতীক হয়ে উঠল কী করে, কে জানে? রঞ্জনের শিক্ষিত মস্তিষ্ক যেভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত, সেটা দিয়ে এই অদ্ভুত লোকটার চিন্তাতরঙ্গের নাগাল পাওয়া সম্ভব না। তবু ওর সন্ধেটা খেয়ে নিল এক ভ্যানওয়ালা, যার নামটা পর্যন্ত ও জানে না। অভ্যেস মতো বউ-ছেলের সঙ্গে গল্পগুজব করল না, বই পড়ল না, টিভিতে সময়-মাপা মেকি রাজনৈতিক ঝগড়া দেখল না। গুম মেরে বসে রইল আড়াই ফুট চওড়া ব্যালকনিতে। বাড়ির কথা বড্ড মনে পড়ছে আজ। লোকটা ওই ‘আপনেও উদ্বাস্তু’ কথাটুকু বলে যেন বুকের তালা দেওয়া ঘরের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়ে গেছে।
পরের দিন সকালে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে রঞ্জনের দুটো কথা একই সঙ্গে মনে পড়ল। প্রথমত, আজ রবিবার। ছোটাছুটি করার দরকার নেই। আর দুই, লোকটা বলেছিল, সকালে নাকি বেজিগুলো পাঁচিলে উঠে বসে থাকে।
হাতে যখন সময় আছে, একবার দেখে এলে হয়! অবশ্য এই তুচ্ছ কথাটা সত্যি বলে প্রমাণিত হলে যে ঠিক কী লাভ হবে ওর— সেটা মাথায় এল না চট করে। তবু রঞ্জন বাজারের রাস্তাটা পেরিয়ে পোস্টাপিসের পাশ দিয়ে সেই গলিটায় ঢুকেই পড়ল।
কয়েক পা এগিয়েই অবশ্য কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রঞ্জন; যেন কেউ ওর বুকের উপর খুব জোরে একটা ঘুষি মেরেছে।
গোটা জমিটায় একটা গাছও অক্ষত নেই। ঝোপঝাড় পুড়ে ছাই। এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে সবকিছু। ধোঁয়া উঠছে। সমস্ত জায়গাটায় ছড়িয়ে আছে জোরালো পোড়া গন্ধ, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
বুঝতে অসুবিধা নেই, কাল রাতেই আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে জমির গাছপালায়, ঝোপঝাড়ে। বাড়ির কাজ শুরু হবে বোধহয়। একটা একটা করে গাছ কাটার চেয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়াটা সম্ভবত দ্রুততর এবং সহজতর উপায়। একবারে পরিস্কার হয়ে যাবে গোটা জমিটা।
আর পুড়ে যাওয়া জমির পাশের ঝলসে যাওয়া কালচে ইটের পাঁচিলের দূরতম প্রান্ত থেকে এই মুহূর্তে দেখা দিচ্ছে ছোট্ট একটা সোনালি রোমশ মুখ, পুতির মতো দুটো ভীরু চোখ।
খুব সাবধানে, সন্তর্পণে পা ফেলে জ্বলন্ত ঝোপের ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়াচ্ছে একটা বেজির ছানা৷ রঞ্জনের প্রথমেই মনে হল, এটা কালকের সেই ছানাটাই। পরক্ষণেই মনে হল, এরকম ভাবার কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। হয়তো সেটাই, হয়তো অন্যটা।
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল রঞ্জন। এক্ষুনি নিশ্চয়ই দেখা দেবে বাকিগুলো। বাবা, মা, ভাই বা বোন!
কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে আসছে বেজিটা। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওর চোখ। চারপাশে ধোঁয়া উঠছে। ও পা ফেলেই আবার তুলে নিচ্ছে। ডেকে উঠছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে টালুমালু চোখে।
হঠাৎ সত্যটা যেন আর একটা নির্লিপ্ত আগুনের শিখার মতো দপ করে জ্বলে উঠল রঞ্জনের চোখের সামনে।
মরে গেছে বাকি বেজিগুলো। এই একটা কোনভাবে বেঁচে গেছে, আর এখন বাকিদের খুঁজতে বেরিয়েছে।
“ঠিকোই ধরসেন। বাকিগুলান মইরা গ্যাসে। এই একখান…”
সেই লোকটা। সক্কালবেলায় চলে এসেছে রোজকার মতোই। এসে ব্যোমকে গেছে রঞ্জনের মতো। চোখে ধোঁয়া লেগেছে বোধহয়। লাল টকটকে। ছলছল করছে।
“একা হইয়া গেল। বাসাখানও গেল। আরও এক উদ্বাস্তু, বোঝলেন কিনা!”
রঞ্জন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল ধোঁয়া-ওঠা মাঠটার দিকে। এক পা এক পা করে এগোচ্ছে ক্ষুদে বেজিটা৷ তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক।
“ঘুমাইয়া পড়সিলাম। মাঝরাতে ভাইঙ্গা গেল। গরম লাগে ক্যান? তাকাইয়া দেহি— বেবাকডি জ্বলতেয়াসে। ঘরের বেড়া, চাউল, উঠানের বেলগাছখান…”
দূরের ধু ধু মাঠের দিকে আনমনা চোখে তাকিয়ে বলে যাচ্ছে নিমাইদাদু।
“বাইরে দেহি দাও লইয়া শাবল লইয়া সব খাড়াইয়া রইসে। বাইরালেই কোপাইব। চিল্লামু যে, গলা শুকাইয়া কাঠ। চুপচাপ পিছনের কলাবাগানের মইধ্য দিয়া বাইরাইয়া পাটের ক্ষেতে গিয়া শুইয়া পড়লাম।”
“তারপর?” জিজ্ঞেস করছে রঞ্জন। ওর চোখ দুটো টকটকে লাল।
“পরদিন ভয়ে ভয়ে, কাঁপতে কাঁপতে আইলাম আবার বাড়ির দিকে। আর যামু কই? লোকগুলারে তো খোঁজোন লাগব, নাকি? বাবা, মা, তিন দাদা, দুই দিদি, পিসিরা, রাঙাকাকা…”
“পেলে তাদের?”
“উঠান জানি রক্তে ভাইস্যা যাইতেআসে! বাড়িডা ভাইঙ্গা পড়সে। তখনও ধোঁয়া ওঠতেআসে…”
একদৃষ্টে পোড়া মাটির বুকের একা বেজিটার দিকে তাকিয়ে রইল রঞ্জন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
আজ ৮ই অগাস্ট, ২০২৪, সকাল ৬টা… আকাশ মেঘলা, কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত। আমার সামান্য মন, জানলার ফ্রেমে ঝুলতে থাকা আকাশের মতোই মনমরা হয়ে আছে। একটা সামান্য গল্প, ছায়াপাত করে গেছে, একটা সামান্য রঞ্জন, একটা সামান্য ভ্যানচালক আর একজন সামান্য বেজি…
বেজির মতো মানুষও শেষ হয়ে যায় জিঘাংসার আগুনে। খুব সুন্দর যাতনাময় লেখা 🌹 ধন্যবাদ ✍️ অশেষ।
জাত লেখক পৃথিবীর নাড়ির স্পন্দন নাকি সাধারণ মানুষের আগেই টের পান – এমন একটা বলা হয়ে থাকে। এই গল্পটি পড়ে মনে হল যেন গতকাল লেখা হয়েছে। লেখককে কুর্নিশ।
কান্না এল না। শুধু গলার কাছে ভীষণ ব্যথা করে উঠল। আমার বাড়ির কাছে এমন একটা বনবেড়াল একলা হয়ে গিয়েছিল। অনেক বড় এলাকার জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছিল তাই। সে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকত কোথাও। গভীর রাত হলে বেরোত। আমি একটা কাগজে অনেকটা মাংস ভাত বা মাছ ভাত মেখে এমন একটা জায়গাতে রাতে রেখে আসতাম যেটা ও আর আমি জানতাম। বেশ কিছুদিন পর তাকে আর দেখিনি। হয়ত অন্য কোথাও পালাতে সক্ষম হয়েছে।যতটা খবর পেয়েছিলাম তাতে ওকে এলাকার কেউ কোন ক্ষতি করেনি। এটা ওর আর আমার ছমাসের বন্ধুত্বের গল্প। এখন বেজিরাও এসে খায়। বেড়াল কুকুররা খেয়ে যাওয়ার পর ওরা আসে। তারপর আসে বড় ইঁদুররা।একই প্লেট থেকে পরপর খেয়ে যায়। অনেক সকালে আসে পাখিরা।ওদের সকলের সঙ্গেই আমার গল্প আছে। অসাধারণ লেখাটি শুধু এই বললাম।
অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। লেখককে অনেক ধন্যবাদ এমন একটা লেখা পড়ানোর জন্য।
সময় উপযোগী লেখা। ভবিষ্যত দেখতে পান বুঝি !
গল্প টা পড়ে বুকের বাঁ দিকে চিন চিন করে উঠলো । কষ্ট টা যেন আরো একটু বেশি বোধ হতে লাগলো ওই পাড়ে র মানুষ গুলোর জন্য।
ভালো থাকবেন, ধন্যবাদ ❤️
মর্মস্পর্শী!
দম বন্ধ করে পড়লাম। কুর্নিশ।
দারুণ চমৎকার একটা লেখা, লেখককে অভিনন্দন 🙏
বড্ড ভালো লেখা… অন্যরকম লেখা !!