short-story-benche-thakar-golpo

বেঁচে থাকার গল্প
দীপু মাহমুদ



রাত কয়টা বাজে মানিক বুঝতে পারছে না। তার কাছে ঘড়ি নেই। মোবাইল ফোনে সময় দেখা যায়। বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরুনোর সময় সঙ্গে মোবাইল ফোন আনতে ভুলে গেছে। হাসপাতালের আইসিইউ’র সামনের দেয়ালে এক ওষুধ কোম্পানির ঘড়ি ঝুলছে। ঘড়ি কাত হয়ে গেছে। তাতে অনেকক্ষণ হলো ৮টা ৫৩ বেজে আছে। মিনিটের কাঁটা টিকটিক শব্দ করে লাফাচ্ছে কিন্তু এগুচ্ছে না।

মানিকের ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খাওয়া দরকার। বাসায় যেতে হবে। মোবাইল ফোন আনা জরুরি। টিটো চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। টিটো চাচা হচ্ছে মুস্তফা স্যারের ছেলে। আমেরিকায় থাকে। মানিক তাকে শেষ দেখেছে দুই বছর আগে। ইন্ডিয়াতে এসেছিল কাজে। একদিনের জন্য বাংলাদেশে এসে আব্বার সঙ্গে দেখা করে গেছে। তবে সে বাসায় আব্বার কাছে থাকেনি। উঠেছিল হোটেলে। ফাইভ স্টার হোটেল। রাতে হোটেলেই ছিল। মানিক তার জন্য সরষে দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করেছিল। সে কিছু খায়নি। বিদেশি পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে ঘুরত। অন্য কোনো পানি ছুঁত না। অন্য পানি দিয়ে চা বানানো হয়েছিল বলে চা খেতেও রাজি হয়নি।

টিটো চাচা আমেরিকায় কী করে মানিক জানে না। মুস্তফা স্যারও স্পষ্ট কিছু বলেননি। তবে শুনেছে সেখানে নাকি তার বিশাল হোটেল আছে। হোটেলের মালিক টিটো চাচা।

মুস্তফা স্যার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলেন। দুই পাতা ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। কড়া ডোজের ওষুধ। মানিক সকালে নাস্তার জোগাড় করে তাকে ডাকতে গেছে। গিয়ে দেখে তিনি বেডরুমের বিছানায় অসাড় হয়ে শুয়ে আছেন। চোখের মণি হয়ে আছে স্থির। হাসপাতালে আনার পর তাকে লাইফসাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন বাহাত্তর ঘণ্টা পার না হলে কিছু বলা যাবে না। তিনি বাঁচবেন কি বাঁচবেন না, তা এখন কেবল সৃষ্টিকর্তা বলতে পারেন।

টিটো চাচাকে খবর দিয়ে কোনো লাভ হবে না। বেশিরভাগ সময় তাকে ফোনে পাওয়া যায় না। ভয়েস ম্যাসেজ রেখে দিতে হয়। কখনো কলব্যাক করে না। ফোনে তাকে পাওয়া গেলেও তার কথা এত জড়ানো থাকে যে কিছু বুঝা যায় না। সে বুঝতে পারে কি না তাও অনুমান করা কষ্টকর হয়ে যায়। যারা তাকে চেনে তারা বলে টিটো চাচা নাকি মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে থাকে। তবু তাকে ফোনে জানাতে হবে তার পিতা লাইফসাপোর্টে। যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন।

এবার দিয়ে মুস্তফা স্যার তিনবার সুইসাইড করার চেষ্টা করলেন। প্রথমবার তার গলার ভেতর দিয়ে রবারের নল ঢুকিয়ে ওয়াশ করা হয়েছিল। সুস্থ হয়ে তিনি বললেন, ধ্যাত্তেরি, বেঁচে গেলাম। পরেরবার আর চান্স দেব না।

পরেরবার ঘটনা হলো জটিল। তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হয়েছিল। তবে মৃত্যুর পথ ছেড়ে ছেচল্লিশ ঘণ্টার মাথায় তিনি চোখ মেলে তাকালেন। তৃতীয় দিন সুস্থ হয়ে গেলেন। সেবার পাঁচদিন থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে। তাতে ডাক্তারের সঙ্গে যুক্ত হলেন একজন সাইকোলজিস্ট। তিনি ভিজিট যত নেন, কাজ তার চারভাগের একভাগও হয় না। সাইকোলজিস্টকে জানিয়ে মুস্তফা স্যার তৃতীয়বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

মানিক ছোটো বেলা থেকে মুস্তফা সাহেবের কাছে থাকে। এখন বয়স ছাব্বিশ বছর। মুস্তফা সাহেব তার বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধান করছেন। মানিক বলেছে, আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর বিয়ে করব।

মুস্তফা সাহেব বললেন, তাহলে আমার মৃত্যু ছাড়া তোর কপালে বিয়ে নেই। আমি আর কখনো সুস্থ হব না।

হেপাটোকার্সিনোমা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন মুস্তফা সাহেব। ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে যকৃতে। রেডিয়োথেরাপি পর্ব শেষ হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন এতে নিরাময় না হলে সার্জারিতে যাবেন। মুস্তফা সাহেবের বয়স আটষট্টি বছর। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিকভাবে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এখন অন্যদের দয়ায় তার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি আর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে চান না। তিনি মরতে চান।

একমাত্র সন্তান টিটো আমেরিকায় থাকে। আমেরিকায় যাওয়ার আগে বিয়ে করেছে। বউয়ের নাম নাঈমা। ভালো মেয়ে। মুস্তফা সাহেবের পছন্দ হয়েছিল। সেই মেয়েও এখন বদলে গেছে। ফোন করলে দায়সারা কথা বলে ফোন রেখে দেয়।

ছেলে আর ছেলের বউকে আমেরিকায় পাঠাতে মুস্তফা সাহেব তার গ্রামের ফসলি জমি বিক্রি করেছেন। থাকার ভেতর ছিল বাড়ির ভিটের অংশ। ক্যান্সার হওয়ার পর ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। টাকা নেওয়া বাবদ বাড়ির ভিটের অংশ ভাইকে লিখে দিতে হয়েছে। ইমপোর্ট এক্রপোর্টের ব্যবসা ছিল। পার্টনারশীপ বিজনেস। ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। মুস্তফা সাহেবের আয়রোজগার তেমন সুবিধাজনক ছিল না। অসুস্থ হওয়ার পর পার্টনার ব্যবসা নিজের নামে করে নিয়েছে।

সবাই মুস্তফা সাহেবকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু তাকে ছেড়ে যায়নি মানিক। স্ত্রী মারা গেছেন দশ বছর আগে। তারপর ছেলে বিয়ে করে বিদেশ চলে গেল। ছোট্ট ভাড়া বাসায় মুস্তফা সাহেব একদম একা হয়ে গেলেন। তখন মানিক ফিরে এলো।

মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, স্যার, চলে এলাম।

অবাক হয়ে মুস্তফা সাহেব বললেন, এতদিন ছিলি কোথায়?

মিয়ানমারে।

সেখানে কী?

কিছু না ভাবলাম দেশত্যাগী হব। ধারেকাছে দেশ বলতে ইন্ডিয়া আর মায়ানমার। ইন্ডিয়াতে সবাই যায়। আমি গেলাম মায়ানমারে।

কী কাজ করতিস?

গাড়ি চালাতাম। হেভি ভেহিকেল চালানোর লাইসেন্স আছে আমার। পাথর বোঝাই ট্রাক চালিয়েছি। দেশ সুন্দর হলেও মানুষ ভালো না। সেই দেশের মানুষের আন্তরিকতা কম।

মানিক যখন খুব ছোটো তখন তাদের খাওয়ার কষ্ট ছিল। মানিকের বাবা বেঁচে ছিল না। দিনমজুরি করত। মানিককে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন মুস্তফা সাহেব। নিজের কাছে রেখেছিলেন। ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। মানিক তাকে দাদা বলে ডাকত। টিটো একদিন ডেকে বলল, আব্বাকে দাদা ডাকবি না।

কী ডাকব?

স্যার ডাকবি। মনে থাকবে?

মানিক ডানপাশে ঘাড় কাত করল। তার মনে থাকবে।

তাকে দিয়ে টিটো ফুটফরমাশ খাটাত। মুস্তফা সাহেবের পছন্দ হতো না। তবে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেননি। টিটো ছিল ভীষণ জেদি আর একরোখা। কোনো অঘটন ঘটালে হতভম্ব হওয়ার কিছু ছিল না। মানিক একদিন কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।

এখন মুস্তফা সাহেবের দেখাশোনা মানিক করে। ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাজারসদাই করা, রান্না করা সব সে করে। আচমকা দুই-তিনদিন উধাও হয়ে যায়। জিগ্যেস করলে বলে, খ্যাপ মারতে গেছিলাম।

কিসের খ্যাপ?

রেন্ট-এ কারের।

মুস্তফা সাহেব কিছু বলেন না। নিজের জমানো কোনো টাকা নেই। মানিক তার সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কখনোসখনো টিটোর বউ নাঈমা টাকা পাঠায়। অতি সামান্য টাকা। ঘর ভাড়া আর বিদ্যুৎ বিল দিয়ে অতিরিক্ত যা থাকে তাই দিয়ে খাওয়ার খরচ চালাতে হয়। তাতে চলে না। থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করতে মানিককে মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেতে হয়।

ক্যান্সার হওয়ার পর মুস্তফা সাহেবের টাকার টানাটানি শুরু হলো প্রবল। তিনি বিজনেস পার্টনারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। দেখা পেলেন না। সে নাকি বেশি সময় দেশের বাইরে থাকে। ফোনেও তাকে পাওয়া গেল না।

ছেলেকে ফোন করলেন। তাকে ফোনে পাওয়া গেল। মুস্তফা সাহেব জিগ্যেস করলেন, টিটো, তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে? গলা বসা মনে হচ্ছে!

ঠান্ডা লাগেনি, গলা ঠিক আছে, বলেন।

তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? ঘুমে তোমার কথা জড়িয়ে গেছে মনে হচ্ছে। এখন তো আমেরিকায় সন্ধ্যা হওয়ার কথা। আমার অবশ্য সময়ের হিসাব ঠিক থাকে না। রাত কত হলো?

আব্বা এত বেশি কথা বলছেন কেন? কী বলার জন্য ফোন করেছেন তাই বলেন।

আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে, টিটো। যকৃতের ক্যান্সার। বিশাল ব্যয়বহুল চিকিৎসা।

দেশের ডাক্তারের ওপর ভরসা নেই। সব টাকা কামানোর ধান্দা। বিরাট ধাপ্পাবাজ তারা। তাদের কথা বিশ্বাস করবেন না। ফোঁড়া হলে বলে টিউমার। চুলকানি হলে বলে স্কিন ক্যান্সার। বিদেশে গিয়ে ডাক্তার দেখান। ইন্ডিয়ায় যান। ইন্ডিয়ায় ভালো ডাক্তার আছে।

সেখানে যাওয়ার টাকা আমার কাছে নেই তুমি জানো।

কথা এত ঘুরিয়ে বলেন কেন, আব্বা। সরাসরি বললেই হতো, টাকা লাগবে। তার জন্য ক্যান্সারের নাটক সাজানোর দরকার ছিল না। আপনাকে তো নিয়মিত টাকা পাঠানা হচ্ছে। নতুন নাটক কেন করছেন?

ফোনের লাইন কেটে গেছে। মুস্তফা সাহেব ফোনের লাইন কেটে দেননি। তিনি ফোন কানে নিয়ে বসে আছেন। কো কো আওয়াজ শুনছেন।

প্রথম যেবার মুস্তফা সাহেবকে লাইফসাপোর্টে নেওয়া হয় তখন মানিক ফোন করেছিল। ফোন রিসিভ করেছে নাঈমা। ঘটনা শুনে সে ফোন দিয়েছে টিটোকে। টিটো বলল, মানিক, টাকাপয়সা নিয়ে ভাবিস না। আব্বার চিকিৎসা করাবি দেশের সবচেয়ে বড়ো হাসপাতালে। প্রয়োজন মনে করলে ব্যাংককে নিয়ে যাবি। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যাবি। চিনিস তো মাউন্ট ই হাসপাতাল? তোর পাসপোর্ট আছে? চিন্তা করিস না। আমার পরিচিত লোক আছে। আমি বলে দেব, ভিসা করতে সময় লাগবে না। অবস্থা বেশি খারাপ হলে আব্বাকে এয়ার এম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে নিয়ে যাবি। ব্যাংককের হাসপাতালের নাম, বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল। এটা থাইল্যান্ডে। মনে থাকবে?

মানিক চুপ করে আছে। টিটোর গলার স্বর ফুরফুরে। বাবা আছেন লাইফসাপোর্টে। বাবার অবস্থা এখন কেমন, বাঁচার সম্ভাবনা কতখানি, সে ব্যাপারে তার ভেতর কোনো অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে না। সে আছে কোথায় চিকিৎসা করাবে তাই নিয়ে।

শান্ত গলায় মানিক বলল, স্যার কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে, তাকে আপনি বিদেশে কোথাও নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন।

টিটো বলল, আরে আমার এত সময় কোথায়? শোন, আব্বাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যা। আমি ব্যবস্থা করছি। টাকা নিয়ে চিন্তা করিস না। একজন লোক যাবে তোর কাছে। সে তোকে টাকা দিয়ে আসবে।

সেই লোক কবে আসবে, কোথায় আসবে, কত টাকা নিয়ে আসবে তার কিছ্ইু টিটো বলল না। কারণ টিটোর পাঠানো সেই কল্পিত লোক মানিকের কাছে আসেনি। হাসপাতালের বিল মিটিয়েছে মানিক। সে কীভাবে ওই টাকা জোগাড় করেছে তা জানা যায়নি।

মানিক আশা করছে এবারও মুস্তফা সাহেব সুস্থ হয়ে উঠবেন। সে জানে হাসপাতালের বিল তাকেই মেটাতে হবে। বাসায় গিয়ে ফোন আনা কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে ক্ষুধা কমানোর ভাবনা আপাতত চলে গেছে। এখন তাকে ভাবতে হচ্ছে হাসপাতালের বিল কীভাবে শোধ করবে। একসঙ্গে এত টাকা কোথায় পাবে!




মুস্তফা সাহেব হাসপাতালে অনকোলজি সেন্টারের বিছানায় শুয়ে আছেন। তাকে কেমো দেওয়া হচ্ছে। আজ সপ্তম কেমো। আর একটা দিলে তার কেমো দেওয়া শেষ হবে।

তৃতীয়বারের মতো আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন মুস্তফা সাহেব। লাইফসাপোর্ট থেকে ফিরে সুস্থ হয়ে বললেন, মানিক, মৃত্যু বড়ো কষ্টের। অন্ধকার নিতল কুয়োর ভেতর ডুবে যাওয়ার মতো।

মানিক বলল, তাহলে আর মরার চেষ্টা করার দরকার নেই।

ফস করে বুকের ভেতর আটকে থাকা দম ছেড়ে দিয়ে মুস্তফা সাহেব বললেন, না মরেই বা কী করব বল! কোনো কাজে লাগছি না। রোজগার নেই আমার। চিকিৎসায় কাড়িকাড়ি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা হয়েছে অমানুষ। তুই যে কোথা থেকে টাকা জোগাড় করছিস, তুই জানিস। বুঝতে পারছি ধারদেনায় ডুবে যাচ্ছিস। জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।

গম্ভীর গলায় মানিক বলল, মরতে আমাদের সবাইকে হবে। আপনি মরবেন, আমিও মরব। মরণ যেদিন আসবে, সেদিন মরবেন। নিজেকে নিজে মেরে ফেলা কোনো কাজের কাজ কিছু নয়। আপনি আপনাকে তৈরি করেননি, অতএব আপনি আপনাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন না।

দার্শনিকের মতো কথা বলতে পেরে মানিকের ভালো লাগছে। সে দার্শনিকের মতো কথা বলতে পছন্দ করে। মুস্তফা সাহেব স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আছেন। তিনি আবার কেমো নিতে হাসপাতালে এসেছেন।

পাশের বিছানায় শুয়ে আছেন সরফুদ্দিন মুজেরি। তাকেও কেমো দেওয়া হচ্ছে। বয়স পঁচাত্তর বৎসর। তার কোলন ক্যান্সার। হাসিখুশি মানুষ। গল্প করতে ভালোবাসেন।

কিছু মনে না করলে কি আপনার নাম জানতে পারি?

মুস্তফা সাহেব ঘাড় ঘুরালেন। তিনি বুঝলেন প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে। শুকনো মুখে নিজের নাম বললেন।

সরফুদ্দিন মুজেরি বললেন, আমার কোলন, আপনার?

যকৃত।

শুনুন ভাই, মুখ শুকিয়ে রাখবেন না। ডায়রিয়া, খোসপাঁচড়ায় মারা যাচ্ছি না আমরা। মারা গেলে ছেলেমেয়েরা গর্ব করে বলতে পারবে, বাবা ক্যান্সারে মারা গেছে। ঠিক কি না বলুন?

সরফুদ্দিন মুজেরির মুখে সকালের রোদ্দুরের মতো হাসি ছড়িয়ে আছে। মুস্তফা সাহেব ব্যাপারটা ভাবলেন। তবে ঘটনা তাকে ততটা উত্তেজিত করতে পারল না। তিনি আছেন টাকার চিন্তায়। মানিক বের হয়েছে টাকার সন্ধানে। তাকে কয়েকটা ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের ঠিকানা। কেন জানি কেউ টাকা দিতে চায় না। নানান অজুহাত দেখায়। দিলেও দুই হাজার টাকার বেশি দেয় না। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য মাত্র দুই হাজার টাকা দেয় কেমন করে! একজন ডাক্তারের ভিজিট ষোলোশ টাকা। চারশ টাকা লাগে হাসপাতালে আসতে। দুই হাজার টাকায় ডাক্তার দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার টাকা থাকে না।

জীবনের একমাত্র নিশ্চিত গন্তব্য মৃত্যু। তার জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমাদের সকল প্রস্তুতি গন্তব্যহীন কাজের জন্য।

কথাগুলো বলেছেন সরফুদ্দিন মুজেরি। তিনি মুস্তফা সাহেবের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। মুস্তফা সাহেবের কিছু ভালো লাগছে না। তার মাথায় আত্মহত্যার নতুন পরিকল্পনা এসেছে। ট্যাবলেট খেয়ে মরার চিন্তা বাদ দিয়েছেন। এবার এমন কিছু করবেন যাতে নিশ্চিত মৃত্যু হয়। একবার ভাবলেন তার মৃত্যুর জন্য ছেলেকে দায়ী করে যাবেন। ছেলের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হবে। ছেলে দেশে নেই। ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে ছেলেকে ধরতে। তাতে সুবিধা হবে। ছেলে কখনো দেশে আসতে পারবে না। টিটো তার মৃত্যু সংবাদ শুনে দেশে আসুক কিংবা পরে কবরের পাশে এসে দাঁড়াক তিনি চাইছেন না।

নিজে মরে ছেলেকে ফাঁসানোর ভাবনা স্থায়ী হলো না। সরফুদ্দিন মুজেরি একটানা কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি সেদিকে মনোযোগ দিলেন। সরফুদ্দিন মুজেরি বললেন, আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।

মুস্তফা সাহেব এবার কথা বললেন, মরার চেষ্টা করেছিলাম তিনবার। গরিবের ভাগ্যে মৃত্যুও নেই। মরা হলো না।

আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, কেন?

জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। অর্থহীন এ জীবন নির্ধারিত মৃত্যুর দিন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চাইছি না।

জীবনের অর্থ কোথায় খুঁজেছিলেন, কী করতে চেয়েছিলেন?

ইচ্ছে ছিল আশ্রম বানাব। অনাথ শিশুরা সেখানে থাকবে। বয়স্ক মানুষ, বাড়িতে যাদের সামান্যতম সম্মান নেই, তারাও থাকবে আশ্রমে। তারা শিশুদের দেখাশোনা করবে। সেখানে হাসপাতাল থাকবে, ইশকুল থাকবে।

সরফুদ্দিন মুজেরি আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করলেন, আশ্রম বানাতে পারলেন না?

মুস্তফা সাহেব ঝুলন্ত স্যালাইনের ভেতর ওষুধের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আশ্রমের জন্য রাখা জমি বিক্রি করে ছেলেকে আমেরিকায় পাঠালাম। ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকায় চলে গেল। সেখানে গিয়ে প্রথম সে তার জন্মদাতা পিতাকে ভুলে গেছে। তাতে হয়তো সুখে আছে তারা। ছেলের মা আমাকে ছেড়ে অনন্তলোকে চলে গেছে দশ বছর আগে। অন্যের দয়ায় এখন আমার চিকিৎসা চলছে।

একজন নার্স এসে দাঁড়িয়েছে তাদের দুজনের বেডের মাঝখানে। নার্সের নাম অধরা। অল্প বয়স। মুখে সবসময় হাসি থাকে। তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে। সে হেসে বলল, বাঃ, আপনাদের দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। কী চমৎকার গল্প করছেন। দেখবেন আপনারা শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবেন।

মুস্তফা সাহেব কিছু বললেন না। সরফুদ্দিন মুজেরি হাসলেন। হেসে বললেন, দোয়া কোরো, মা। পবিত্র মানুষের দোয়া কবুল হয়। তুমি একজন পবিত্র মানুষ।

অধরা দুজনের ওষুধ ঠিকঠাক মতো শরীরে যাচ্ছে দেখে চলে গেল।

সরফুদ্দিন মুজেরি বললেন, আমার ভরা সংসার। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনি সকলেই আছে। কন্যা জামাইকে নিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। তার দুই মেয়ে। স্ত্রী মেয়ের কাছে থাকে। মেয়ে আর জামাই দুজনই চাকরি করে। নাতনিদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার স্ত্রীর। ছেলে বউ আর ছেলেকে নিয়ে কানাডায় থাকে। বছরে-দু’বছরে একবার দেশে আসে। একসপ্তাহ থেকে হইহই করে ফিরে যায়। সবাই খুব ব্যস্ত। তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। প্রতিদিন ভিডিয়ো কলে কথা বলে। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে বলেছিল। রাজি হইনি। আমাদের দেশের চিকিৎসার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। তাছাড়া শহরে আছি বলে চিকিৎসার আধুনিক অনেক সুযোগ পাচ্ছি। যে মানুষ দূর গ্রামে থাকে, তার অসুখ হলে তো তাকে সেখানেই চিকিৎসা নিতে হয়।

মুস্তফা সাহেব আবার স্যালাইনের ড্রপের দিকে তাকালেন। টিপটিপ করে ড্রপ পড়ছে। চোখ নামিয়ে বললেন, গ্রামের সেই মানুষদের নিয়ে ভাবেন আপনি!

ভাবী, কারণ তারা আমাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কৃষকরা গ্রামে বাস করে। তারা দেশের ইঞ্জিন। বলতে পারেন হার্ট। যতক্ষণ সার্ভিস দেবে ততক্ষণ বাঁচব। অথচ সবচেয়ে অবহেলিত তারা। তাদের অবজ্ঞা করে আমরা খাবার আমদানি করছি বিদেশ থেকে। নিজ দেশের হার্টের কার্যক্ষমতা নিজেরাই কমিয়ে ফেলছি।

বুকের ভেতর গভীরভাবে বাতাস টেনে নিলেন মুস্তফা সাহেব। তিনি উদ্দীপ্ত বোধ করছেন। তার ভেতর প্রফুল্ল ভাব। স্বপ্নমাখা চোখে বললেন, আমার খুব ইচ্ছে ছিল গ্রামে আশ্রম হবে। শিশু আর বয়স্করা থাকবে। কৃষকদের জন্য হবে কৃষক ক্লাব। সেখানে যেমন তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে, তেমনি তারা ক্লাবে বসে সিদ্ধান্ত নেবে। কৃষি উপকরণ ভাগাভাগি করে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত। ফসলের ন্যায্যমূল্যের সিদ্ধান্ত। কৃষকদের যাতে মর্যাদা রক্ষা হয় এমন সব কাজের সিদ্ধান্ত।

ঝট করে বিছানায় উঠে বসেছেন সরফুদ্দিন মুজেরি। বসে থাকতে পারলেন না। মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠেছে। চোখে ঝাপসা দেখছেন। তিনি শুয়ে পড়লেন। স্যালাইনের ভেতরের ওষুধ শেষ হয়ে আসছে। ওষুধের মাত্রা কমে এলে মেশিন থেকে শব্দ হবে। নার্স এসে স্যালাইনের লাইন খুলে দেবে।

সরফুদ্দিন মুজেরি আলতো করে চোখ বন্ধ করলেন। মুস্তফা সাহেব বললেন, ঘুম পাচ্ছে?

চোখ খুলেছেন সরফুদ্দিন মুজেরি। তাকিয়ে আছেন মুস্তফা সাহেবের দিকে। তার চোখে অদ্ভুত গভীরতা। যেন তিনি বহুদূরের কিছু ভাবছেন। নরম গলায় বললেন, শিগগির সেরে উঠবেন আপনি। গ্রামে গিয়ে আশ্রম বানাবেন। তারপাশে বানাবেন আপনার স্বপ্নের কৃষক ক্লাব।

স্যালাইনের ভেতর দেওয়া হলুদ ওষুধের দিকে তাকিয়ে আছেন মুস্তফা সাহেব। ওষুধের ভেতর দিয়ে হাসপাতালের সাদা দেয়াল ঘোলাটে দেখাচ্ছে। তিনি আবার বুকের ভেতর থেকে লম্বা শ্বাস টেনে আনলেন। বাতাসে সেই শ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, এখন আর স্বপ্ন দেখি না। গ্রামে আমার কোনো জমি নেই। টাকা নেই।

টাকা আমার আছে, বলে উজ্জ্বল চোখে তাকালেন সরফুদ্দিন মুজেরি। তিনি বললেন, আমি বাঁচব না। ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকা আছে আমার। ছেলেমেয়ে চিকিৎসার জন্য নিয়মিত টাকা পাঠায়। তারা বোঝে না, টাকা আমার দরকার নেই। আমার ভীষণভাবে দরকার তাদের। তারা এসে শুধু আমার পাশে থাকুক।

সরফুদ্দিন মুজেরির শেষের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এলো। তার চোখের কোনা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুস্তফা সাহেবের মন অতি নরম হয়েছে। তিনি কথা বলছেন না। সরফুদ্দিন মুজেরি চোখের পানি মুছলেন না। নাকের ভেতর মৃদু বাতাস টেনে নিয়ে বললেন, চলুন, কোনো গ্রামে জমি কিনি। সেখানে আমরা দুজন মিলে আশ্রম বানাব। কৃষকদের জন্য ক্লাব বানাব।

মুস্তফা সাহেবের চোখে পানি চলে এসেছে। তিনি হাত দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। বুকের ভেতর চাপ ধরে আসছে। গলার নিচের দিকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে। তবু মুস্তফা সাহেব অনেক সুস্থ বোধ করছেন এখন। মনে হচ্ছে তার অসুখ পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে।

সরফুদ্দিন মুজেরি ভেজা গলায় বললেন, শুধু একটা অনুরোধ। মৃত্যুর পর আমার কবর দেবেন আশ্রমের উঠোনের পাশে। কবরের শিথানে বাতাবি লেবুর গাছ লাগাবেন। বসন্তে বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধে চারপাশ ভরে যাবে। সেই সুঘ্রাণে আমি থাকব।

ওষুধ শেষ হয়েছে। মেশিন থেকে একটানা কিনকিন আওয়াজ হচ্ছে। নার্সের আসার কথা। নার্স আসছে না। অন্যদিন এমন হলে সরফুদ্দিন মুজেরি অস্থির হতেন। আজ অস্থির হলেন না। তিনি তার আগের কথার রেশ ধরে বললেন, গাছভরতি বাতাবি লেবু নিয়ে ডালগুলো নুয়ে আসবে আমার কবরের কাছে। শুকনো গাছ কখানো নত হয় না, নত হয় কেবল ফল-ফসলভরা বৃক্ষ আর শস্য। তারা আসবে আমার কাছে, আমাকে দেখতে। আমার সাথে কথা বলবে।

হু হু করে কাঁদছেন সরফুদ্দিন মুজেরি। তার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি দমকে দমকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মরে গেলে মানুষ গন্ধ নিতে পারে না, তবু বুক ভরে বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

সরফুদ্দিন মুজেরি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।




সাত বছর পরের ঘটনা।

মুস্তফা সাহেব আশ্রমের উঠোনে বসে আছেন। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। অক্টোবর মাসের শেষ সকালের রোদ তেতে উঠতে শুরু করেছে। তিনি পূর্বদিকে পিঠ দিয়ে বসলেন। উঠোনের উত্তর-পশ্চিম কোনায় সরফুদ্দিন মুজেরির কবর। বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা। সরফুদ্দিন মুজেরি বলে গেছেন তার কবর যেন বাঁধানো না হয়। মুস্তফা সাহেব ইট-সিমেন্ট-টাইলস দিয়ে কবর বাঁধাননি। কেবল বাঁশের বাতা ঘেরা কবরের সামনে মার্বেল পাথরে খোদায় করা এপিটাফ লাগিয়েছেন। এপিটাফে লেখা আছে, আনন্দ গ্রামে শিশুদের উচ্ছলতার মাঝে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছেন সরফুদ্দিন মুজেরি। যেমন ঘুম তিনি চেয়েছিলেন। কবরের পাশে সতেজ বাতাবি লেবু গাছ। ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের সবুজ পাতা কাঁপছে।

চার বছর হলো সরফুদ্দিন মুজেরি মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তাকে যেন এই আশ্রমে সমাহিত করা হয় এমন নির্দেশনা সরফুদ্দিন মুজেরি লিখে গেছেন। নির্দেশনায় লেখা আছে মৃত্যুর পর তার দেহ স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজনের এখতিয়ারে যাবে না। তিনি সমাহিত হতে চান তার জীবনের শেষ সময়ের আবাস এই আশ্রমে।

আশ্রমের বয়স হয়েছে পাঁচ বছর। পাহাড় ঘেরা সমতল ভূমিতে ২৫ বিঘার উপর আশ্রম। সরফুদ্দিন মুজেরি আশ্রমের নাম দিয়েছেন, আনন্দ গ্রাম।

মানিক বাজারে গেছে। তার সঙ্গে আশ্রমের আরও কয়েকজন বয়স্ক মানুষ গেছেন। বাজার, রান্না সব দায়িত্ব তারা নিয়েছেন। উঠোন জুড়ে ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। তাদের ইইচই মিশে যাচ্ছে গাছে বসা পাখির ডাকের সঙ্গে। এক গাছ থেকে কাঠবিড়ালি নেমে এসে দৌড়ে উঠোন পার হয়ে আরেক গাছে উঠছে। মুস্তফা সাহেবের মনে হলো পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে ছেলেমেয়েদের উচ্ছ্বসিত আনন্দ।

ডানপাশে উঠোনের ওপর দুজন মানুষের ছায়া পড়েছে। মুস্তফা সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তিনি অবাক হয়েছেন। নাঈমা দাঁড়িয়ে আছে। নাঈমার শরীর আগের থেকে অনেক ভারী হয়েছে। চোখে বাদামি ফ্রেমের চশমা। কোমর ছাপানো লম্বা চুল এখন কাঁধ ছুঁয়ে আছে। চুলের রং লালচে। পারফিউমের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার পাশে ১১/১২ বছরের একহারা গড়নের একজন মেয়ে। পরনে ফেইড জিন্সের প্যান্ট, সঙ্গে ধবধবে সাদা টপস। পায়ে ছাই রঙের কেডস। মাথায় ছোটো করে রাখা ঘন কালো চুল। বাঁহাতে উল্কি আঁকানো। ডানহাতে কালো ব্রেসলেট। গলায় রূপার চিকন চেইনের সঙ্গে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা চিত্রকর্ম ভিত্রুভিয়ানো ম্যানের আদলে বানানো লকেট ঝুলছে।

মুস্তফা সাহেব ঘুরে বসলেন। নাঈমা বলল, বাবা, আপনার নাতনি।

বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন মুস্তফা সাহেব। অবিকল টিটোর মুখ। ছোটো বেলায় টিটো দেখতে ঠিক এরকম ছিল। তিনি দুহাত বাড়িয়ে নাতনিকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। তার দুহাত আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তিনি অবসন্ন বোধ করছেন। ঝপ করে পানি এসে মুস্তফা সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।

নাঈমা বলল, জুডিথ, সে হ্যালো টু দাদু!

জুডিথ স্পষ্ট আমেরিকান উচ্চারণে বলল, হাই ড্যাডু, লাভলি টু মিট ইউ।

গলার ভেতর ব্যথা করছে। বোধ হচ্ছে গলার ভেতর পুটলির মতো গোল কিছু দলা পাকিয়ে আটকে আছে। মুস্তফা সাহেব কথা বলতে পারছেন না।

জুডিথ ছুটে চলে গেছে সামনে। উঠোনে ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। তারা কোনো কথা বলছে না। উঠোনের পাশে রোদ্দুর আর গাছের ছায়ার মাঝামাঝি জায়গায় মা-ছাগল পেট পেতে শুয়ে আছে। ছাগলের তিনটা বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাগুলো উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে এসে মায়ের দুধ খেয়ে যাচ্ছে।

উঠোনে পড়ে থাকা গাছের সবুজ পাতা নিয়ে জুডিথ এগিয়ে গেল মা-ছাগলের কাছে। ছেলেমেয়েরা ঘুরে জুডিথকে দেখছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। জুডিথ ছাগলের মুখের কাছে গাছের পাতা ধরেছে। ছাগল মুখ বাড়িয়ে গাছের পাতা নিয়ে চিবুচ্ছে। জুডিথ ডানেবাঁয়ে তাকাচ্ছে। সে আরও পাতা খুঁজছে। একজন মেয়ে উঠোনের মাঝখান থেকে ছুটে গেল। কাঁঠালের একটা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে জুডিথকে দিয়েছে। জুডিথ বলল, থ্যাংক ইউ।

জুডিথের কথায় ছেলেমেয়েরা মজা পেয়েছে। অমনি দুজন ছেলে লাফ দিয়ে গাছে উঠে পড়ল। তারা কাঁঠাল গাছের পাতা পাড়ছে। অন্যরা ছোটাছুটি করে উঠোনের আশপাশ থেকে এ-গাছ সে-গাছের পাতা এনে জুডিথকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।

নাঈমা বসেছে মুস্তফা সাহেবের পাশে। মোলায়েম গলায় বলল, আপনার শরীর এখন কেমন?

মুস্তফা সাহেব সে কথার উত্তর দিলেন না। তিনি জিগ্যেস করলেন, টিটো আসেনি?

নাঈমা বলল, তার শরীর ভালো নেই, বাবা। গতবছর মাইল্ড স্ট্রোক করেছিল। শরীরের বাঁদিক খানিক অবশ হয়ে গেছে। রেগুলার থেরাপিতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছেন সেরে উঠতে সময় লাগবে।

মুস্তফা সাহেব উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার আবার চোখ ভরে পানি চলে এসেছে। ছাগলের বাচ্চার পেছনে উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে জুডিথ। অবিশ্বাস্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছেন মুস্তফা সাহেব। চোখের পলক ফেলেননি। তিনি চোখের পাতা ফেলে দুচোখ বন্ধ করলেন। দু’হাতের দু-আঙুল দিয়ে ডলে চোখ মুছলেন। অতি স্পষ্ট চোখে দেখলেন বহুবছর পর টিটো ফিরে এসেছে তার কাছে।

চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুস্তফা সাহেব আটকাতে পারলেন না। তিনি চোখ টানটান করে তাকিয়ে আছেন জুডিথের দিকে। মুস্তফা সাহেব কাঁদছেন। তিনি কাঁদছেন আনন্দে। তার গাল বেয়ে চোখের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *