মেহেদী উল্লাহ
ওই দেখা যায়, মরা বাড়ির উঠানে শীতল পাটি বিছিয়ে বসে থাকে নিজামের আম্মা। শুধু শীতল পাটি বললে ভুল হবে, পাটির নিচে খড় পাতা আছে। মেলা শীত! পাটির এক কোনে আগুন না জ্বাললে এতক্ষণে হু হু করে কাঁপতে হতো নিজামের আম্মাকে। মনে হয় অনেক রাত হয়ে গেছে, কিন্তু না, মাত্র নয়টা আট পঞ্চাশ। আগুন আর নিজামের আম্মার হাড়-হাড্ডি ছুঁয়ে ফিসফিসে উত্তরা বাতাস রওনা দিসে সুজনের আম্মার নতুন কবরটার দিকে। নিজামের আম্মার বয়স এখনো কেউ জানে না, কেউ বলে নব্বই, কেউ বলে একশ হই যাবে চোখ বন্ধ করি। তিনি সেরকমই একটা বয়সের ভারে উঠানে আগুন সেঁকতেছেন এখন। আজকে সুজনের আম্মার চারদিন্যা। এক হিসাবে শোকের কথা আছিল চারদিকে, কান্দন থাকবে থেমে থেমে যার যতটা তারে মনে পড়ে। কিন্তু শহর থেকে দুনিয়ার আত্মীয়-স্বজন আসছে, সবার মতি-গতি, বুঝ ত এক না, তাই না! সবার আড্ডায়, হাঁকডাকে এখন মনে হইতেছে মরা বাড়ি যেন উৎসবের কোলাহল! সুজনের আম্মা চারদিন আগে চলে গেলেন, শীতের মাঝামাঝিতে আর আশির বেশি বয়সে, কম করে ধরলেও। আরো একজনের কথাও এই ফাঁকে বলি ফেলি। শওকতের আম্মা, যিনি চলে গেলেন পৌষের শুরুতে। ছেলেরা শহর থেকে তার জন্য নয়া শীতবস্ত্র পাঠানোর এন্তেজাম করতেছিলেন, আর হঠাৎ তিনি চলে গেলেন! শওকতের আম্মার বয়স এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল, একশর উপরে। বিশ্বাস হয়! মাটিতে কুর্নিশ করে করে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতেন। দিনের আলোতে যখন তিনি উঠানে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতেন তার ছায়া ছিল পুঁটলির মতন! একটা পুঁটলি যে কোন একদিকে যাইতেছে ধীরে! সেইরকম! এখন হইচে যে, পরপর দুইজনের চলে যাওয়ায় মাথার মধ্যে যা যা ভাবনা আসতে পারে তা তা ভাবনা নিয়ে নিজামের আম্মা এখন আগুন পোহাইতেছে। আগুনের আরেক প্রান্তে দুইটা কুকুর, কাজু কাদামের মতো ভাঁজ মেরে আছে। আর কান কাড়া করার চেষ্টা করতেছে, যেন কান দিয়ে আগুনে খড় পোড়ার শব্দ শোনার চেষ্টা। কী বলব! নিজামের আম্মা এত বেশি বছর বয়সে এটাও ভাবতে পারতেছে না, বাড়ি ভর্তি মানুষেরা নিজেরাই নিজেরা দলবদ্ধ হয়ে গল্প-গুজব করতেছে। কেউ কেউ খাটে, বিশেষ করে সমবয়সী মহিলারা, কেউ কেউ সোফায়, বিশেষ করে সমবয়সী পুরুষেরা, কেউ কেউ বাড়ির বাইরের রাস্তায় বিশেষ করে সমবয়সী শিশুরা; শুধু নিজামের আম্মার মতন কেউ আর নাই, ফলে তিনি একলা! হুটহাট কেউ এসে কথার কথা জিজ্ঞেস করে যায়, কিছু লাইগবোনি গো আন্নের? তিনি ইশারায় বুঝিয়ে দেন, কিছু লাগবে না এখন। আসলে, এই বাড়িটায় শওকতের আম্মা, সুজনের আম্মা আর নিজামের আম্মাই থাকতেন স্থায়ীভাবে। তাদের তিনজনের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও একটা জায়গায় ছিল মিল, তিনজনই ছিলেন বিধবা। এটা তো ঠিক, বাবাদের হারিয়ে ছেলেরা সংসারের হাল ধরেছিল, শহরে গিয়ে ব্যবসা, চাকরি যে যেটা সুবিধা মতো পেয়েছে ধরেছে, সংসারও করছে শহরেই। নিজামের আম্মার ছেলে-মেয়েরা শহরেই থাকে, শওকতের আম্মারও তাই, শুধু সুজনের আম্মার এক ছেলে এই বাড়িতেই থাকে, তার নামই সুজন, মেয়েরাও শহরেই থাকে। তাই এই বাড়িতে এতদিন মানুষ বলতে ছিল শুধু তিন আম্মা, সুজন আর তিন আম্মার খেদমতের জন্য চার-পাঁচজন মহিলা, যাদের বাড়ি পাশেই। কেউ কেউ দিনে দিনে কাজ করে চলে যেত, কারো ইচ্ছে হলে রাতে থেকে যেত তিন আম্মার পাঁজরের কাছে কোথাও। যারা রাতে থাকত তাদেরই বেশি আপন ভাবত তিন আম্মা ও তাদের ছেলে-মেয়েরা, তাদের জন্য ছিল উচ্চ বেতন। সুজনের আম্মা এখন যেভাবে বসে আছে, ঠিক গেল বছরও এইরকমই শীতের রাতে এভাবে বসে আগুন পোহাত তিন আম্মা। এই কথার পরে! আহারে! জীবন! একে অপরকে পানের খিলি বানিয়ে দিত, ছেলে-মেয়েরা কে কত টাকা পাঠিয়েছে গেল মাসে সেই আলাপ তো আছেই। প্রায়ই শওকতের আম্মা মুরুব্বি হিসেবে বলতেন, আর পরবর্তী মুরুব্বি হিসেবে নিজামের আম্মা সায় দিতেন, ‘এখন সুজনেরও শহরে যাওন দরকার।’ সুজনের আম্মার খুব ইচ্ছা ছিল সুজনও তার চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাই-বোনদের মতন শহরে চলে যাবে, থাকবে, বছরে দুইবার বাড়ি আসবে, ঈদের সময় আর শীতের সময়। এক কি দুই রাতের জন্য এসে, আম্মা অনেক কাম-কাজ, আবার কিছুদিনের মধ্যে আইসব, এই বলে শহরে ফিরে যেত। তাদের আম্মারা খুব জানে, আসবে না, আবার ওই ঈদে-চান্দেই! সুজন কী আর যায়? সুজন বাড়িতে থাকলেও মূলত থাকত বাড়ি বাড়ি! তার ডিশের ব্যবসা এলাকায়। এটা মূলত পৈত্রিক ব্যবসা। সুজনের আব্বাই ভাইদের মধ্যে বেশি আয়ু পাইছিলেন। থাকতে থাকতে সময় কাটে না বিধায় যাওয়ার আগে ডিশের ব্যবসা চালু করে দিয়ে যান গ্রামে। এই গ্রামে সুজনের আব্বাই প্রথম ডিশের ব্যবসা শুরু করে, এখনো তারটাই। সুজনের শহরে না যাওয়ার এটাও একটা বড় কারণ। কে যায়? এত সোন্দর সাজানো ব্যবসা রেখে যেতে মন চায় না। ছেলে এলাকায় ভালো ব্যবসা বাণিজ্য করছে। তবুও শওকত আর নিজামের আম্মার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখলে সুজনের আম্মার খারাপ লাগত খুব। ভাবত, তার ছেলেও নিশ্চয়ই একদিন শহরেই যাবে। ডিশের ব্যবসা ধরে রাখার জন্য একটা ছেলে রাখলেই চলবে। ছেলে নিয়ে তাকে আর বেশি দিন ভাবতে হয় নাই, বাড়ন্ত ডিশের সংযোগের দিনগুলির মধ্যেই সে চলে গেল। সন্ধ্যার পর তিন আম্মার বেশিরভাগ সময় কাটত সিরিয়াল দেখে। আরো আরো বাড়িতেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রিয় ছিল সিরিয়াল। আগিলা যুগের মানুষদের উপযোগী করেই বোধ হয় বানানো সিরিয়ালগুলো। আজকে অমুক সিরিয়ালে অমুক আছে, এই সময় লাইন নাই, অভিযোগে ডাক পড়ত সুজনের। হোন্ডা চালিয়ে রওনা দিত সাথে সাথেই। তাই সুজনও বুঝতে পারে, এই গ্রামে তার ডিশের চেয়ে সিরিয়াল বেশি জনপ্রিয়। অন্যসময় ডিশ না থাকলেও তাদের কোনো ক্ষতি নাই। পোলাপান ঝামেলা করে ভারত-পাকিস্তান খেলার দিন। আর বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সময় ডিশ না থাকলে খবর আছে। অধিকাংশ সময় ফিল্ডিং কোনো বিষয় না। শুধু জিতা ম্যাচের ফিল্ডিংয়ের সময় না থাকলে খবর আছে! সুজনের এসব করেই দিন চলে যায়। ডিশের বিল তোলা তার কাছে আরেকটা আনন্দের কাজ। এটা তাদের বংশীয় রীতি। নেওয়ার চেয়ে দেওয়া তাদের পছন্দ। কেউ বিল দিতে না পারলে, কিংবা ঘুরালে, বার কয় আসতে যেতে যতই হোন্ডার তেল খরচ হোক, সুজন খুশিই হতো। সুজনের আব্বা ছিল পুরা উল্টা। জায়গায় দাঁড়ায়া থাকত বিলের জন্য। সে সাইকেল চালিয়ে বিল তুলত। সুজনের আব্বা মারা যাওয়ার পর সে একধাক্কায় হোন্ডা কিনে ফেলে। আর লোকে খালি তারে তার বাপের কাহিনি শোনাত। বলত, ‘তোমার আব্বা কত কষ্ট করি বিল নিতে আইত, ঝড়-বাদল, রোইদ বৃষ্টি ব্যাক সময় সাইকেল চালাই।’ এখন আর শোনায় না। এখন সুজনের কাহিনি সবখানে। সুজন উত্তর দিত, ‘হেতারা আছিল আগিলা যুগের মানুষ। এখন যুগ পাল্টাই গেছে। সাইকেলে অনেক সময় লাগি যা।’ পারলে ত সুজন ফ্রি ডিশ দ্যাখায়, বিল দিলেও ভালো, না দিলেও ভালো, সুজনের পাগল পুরা গ্রাম, কোন বাড়িতে সে বিয়ে করবে, এতে কোথায় তার কি লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি কাহিনি সুজনের। সুজনের আব্বার অবশ্য আরো একটা কাহিনি আছে। সেটা সুজনের সুনামের কাছে আপাতত ঢাকা পড়ে আছে। সুজন এবং সুজনের আম্মা কল্লা ফালাই দিবে, এই কাহিনি কেউ বললে। শুধু এই একটা কাহিনি যদি কারো মুখে, কোন ঘরে শোনা যায় কোনোদিন, সেদিনই ডিশ লাইন কাটা সেই ঘরে। সুজন এমন জিনিস। সব সহ্য করবে, কিন্তু এই কাহিনি না। কিন্তু সুজনের ছোট ফুফু, থাকে চিটাগাং, সেই এখন এই কাহিনিটা নতুন করে তোলার জন্য নিজামের আম্মার পাটিতে গিয়ে বসে। সে কাউকে ভয় পায় না। এবাড়ির কাউকেই না। সুজনকে ত প্রশ্নই আসে না। সুজনের আম্মা মারা গেল বলে বহুবছর পর এলো এ বাড়িতে! আর সে তো সুজনের ডিশের কাস্টমার না! উল্টা সবাই তাকে ভয় পায়। সুজনের আব্বা জীবিত থাকতে বহু সিদ্ধান্ত সুজনের ফুফু দিত। সুজনের আব্বা বিনা বাক্যে মেনেও নিত, সুজনের আম্মাও। ফলে এখন সুজনের আব্বার সেই কাহিনি নতুন করে তোলার অধিকার কেবল সুজনের ফুফুরই আছে। সুজনের ফুফু নিজামের আম্মার কাছে গিয়ে বসে, আরো কাছে, যতটা কাছে গেলে সে শুনতে পাবে। বলে,‘ভাবি, দুই দিনের দুনিয়া, হয়াৎ-মউত আল্লার হাতে। দেখলেন ত অল্প ক দিনের ব্যবধানে দুইজন নাই। আমি একটা জিনিস ভাইবছি। আন্নে আমার লগে থাকেন। কথা দেন থাইকবেন।’ নিজামের আম্মা উত্তর দেয়, ‘আগে ক তুই, কি কতা?’ ফুফু বলে,‘না, আন্নের কতা চিন্তা করেই আমার এই ডিশিসান। আর কতকাল ওই মহিলা বাইরে থাইকব। অনেক অইছে। যার কথা ভাবি বাইরে রাইখছিলেন এতদিন সেই ই তো নাই আইজকা!’ নিজামের আম্মা আগুনের ওপর হাত বদল করে। ডান হাত সরিয়ে নিয়ে বাম হাত দেয়। দিতে দিতে বলে,‘বুইজজি তুই কি কইছোস। সুজন কি মাইনব?’ এবার ক্ষেপে যায় সুজনের ফুফু,‘সুজন কে? আগের ডিসিশানও আমি দিছিলাম, এখনকার ডিসিশানও আমিই দিব। সুজন পাইরলে ঠেকাক। এখন আর কিয়া। সুজনের কী? মা-বাপ দুইজনেই ত চলি গেছে! আর কার জইন্য কার লগে রাগ! আগিলা সেই প্রয়োজনই ত নাই।’ এবার নিজামের আম্মা নতুন প্রশ্ন করে,‘হেতি এত বোচর হরে কি আইবো নি? অন আর কিল্লাই আইবো, হেতির এই বাড়িত কিয়া আর, বাঁচি থাইকতে আইতে দাও নাই তোমরা?’ ‘শুনেন ভাবি, হেইটা হেই সময় প্রয়োজন ছিল, ব্যাকের শান্তির জইন্য, এখন আর সেই প্রয়োজন নাই, আমরা বলি দেখি, আইলে আইব না আইলে নাই। অনেক সময় স্মৃতিও অনেক কিছু। শেষ নিশানা।’ যোগ করে ফুফু। এবার নিজামের আম্মা বলে,‘ব্যাকের লগে কতা বলি দেখ, অন্যরা কি বলে।’ ‘ব্যাকে কী কইব! ডিসিশান নিমু আমি আর আন্নে। বুইজজেন নি, ভাবি। আন্নে কইবেন, আন্নে রাজি আছেন, আর আন্নের কথা চিন্তা করি আমার এই চিন্তা। আন্নে অন একলা মানুষ। ব্যাকে ত চলি যাইবো আবার কাইল থেকে, আন্নে এত বড় বাড়িতে একলা থাইবেন কেন্নে?’ ‘আইওত’ বলে সায় দেয় নিজামের আম্মা। যার অর্থ, হ্যাঁ ঠিক বলেছ।
হায় আল্লা! নিজামের আম্মা আর ফুফুর এই আলাপ সুজনের কানে পৌঁছায়। সে উথামথাম শুরু করে দেয়! যে কাহিনি তার আড়ালেও এই গ্রামে কে তুলতে সাহস পায় না, সেই কাহিনি তুলল তার ফুফু। তাও তার আম্মা মরার চারদিনও হয় নাই। খাইচে অবস্থা! তেড়ে আসে ফুফুর দিকে, এসে আবার ভয়ে থেমে যায়। যাক, থামছে। ফুফু তাকে খোটা দিয়ে দুর্বল করে,‘তুই এখনো এই বাড়িতে কী? ব্যাকে বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য করে শহরে। তোরে কে কইছে বালের ডিশের ব্যবসা কইরতে, আবার মুরব্বিদের মুখে মুখে তর্ক কইরতে আইছোস। যা এয়ান তেন। যা কাইলকাই চলে যাবি, যাই হেগুনের লগে বড় ব্যবসা করবি। আমি টাকা দিমু। যা কইরতেছি তোর আম্মার আত্মার শাস্তির জইন্য করতেছি। আগে কাজটা ঠিক হয় নাই। মহিলারও হক ছিল। অধিকার সমান ছিল। আমরা দিই নাই। কাজটা এক্কেরে ঠিক হয় নাই।’ তারপর সুজনকে বুকে টেনে লয় ফুফু। তার মায়ের জন্য কিছুক্ষণ কাঁদে। এতে সুজনের বুক ভরে যায়। ঘরের সামনের গাঁদা ফুলগুলোর দিকে তাকায় সে, তার মা লাগাইছিল। সদ্য ফুটেছে ফুলগুলো। তার কলিজা ঠা-ঠা হয়। হঠাৎ যেন এইখানে কেউ চ্যানেলটা চেঞ্জ করে দিছে কেউ। কিন্তু আবার আগের চ্যানেলের হয়ে যায় ফুফু। সুজনকে বলে,‘তুই যা ঘরে যা, আমরা তোর আম্মার ভালোর লাই নতুন করি ডিসিশান নিয়ের।’ সুজন কথা না বাড়িয়ে বিদ্যুতের আলোয় হলুদিয়া গাঁদাগুলোকে দেখতে দেখতে চলে যায়।
সত্য কি আর চাপা থাকে বেশিদিন! কখনো না। সুজনের আব্বার কাহিনিটা আবার গ্রামময়! সুজন ঢাকা পড়ে গেল বোধ হয় কিছুদিনের জন্য। ফুফুর কথা আর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সেও শহরে চলে যায় বাণিজ্যের জন্য। ভাইদের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে কী ব্যবসা করা যায়। তার আগ পর্যন্ত ভাইদের বাসায় বাসায় থাকবে। শহরের সঙ্গে আগে মানিয়ে নিক সে। বহুদিন গ্রাম থাকতে থাকতে কিছুটা আগিলা যুগের মানুষের মতো হয়েছিল সে, যদিও সে আগিলা যুগেরই মানুষ তার আব্বার পুরা উল্টা। তবুও আগিলা যুগ নিজের মধ্যেই কিছু তফাৎ করে রেখেছিল!
এদিকে হইছে কী! নতুন কাহিনিটা নিয়ে একটু বলা দরকার। কাহিনি আর কিছুই না। সুজনের আব্বা গোপনে আরো একটা বিয়ে করেছিল। সুজনের বোন ও ফুফুরা এই বাড়িতে থাকতে সেই স্ত্রীকে এই বাড়িতে উঠতে দেয় নাই। বাধ্য হয়ে সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী বাপের বাড়িতেই ছিল, বাপের বাড়ি পাশের গ্রামে। সেই ঘরে একটা মেয়ে আছে, সেও শহরেই থাকে, পড়ালেখা করে। সুজনের আম্মা মারা যাওয়ার পর সবাই, বিশেষ করে সুজনের ফুফু অনুতপ্ত হয় তার আগিলা কৃতকর্মের জন্য। তাই দ্বিতীয় স্ত্রীকে সসম্মানে স্বামীর বাড়ি আনার প্রস্তাব রাখে। সবাই, বিশেষ করে সেই প্রস্তাবে যেন নিজামের আম্মা হ্যাঁ বলে সেভাবেই ফুফু তাকে রাজি করায়। দায়িত্বটা সুজনের ফুফুরই বেশি ছিল। বিয়েটা যখন জানি জানি হয়, জানাজানির পরে যখন ওই স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে আসে সাহস করে তখন সবার আগে সুজনের ফুফুই ঝাড় দিয়ে মেরে তাড়াতে সাহায্য করেছিল। মারতে মারতে অনেক কথা বলেছিল, যাতে সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রীর অপমান হয়, অভিমান হয়, কড়া রাগ হয়। আর এসবের চোটে সে বাপের বাড়ি চলে যায়। বাপের বাড়িতেই গিয়ে থাকে, আর কখনো এই বাড়ির নাম মুখে না নেয়। সেদিনের দুই সতীন আর কোন দিন মুখোমুখিই হওয়ার সুযোগ পেল না। দ্বিতীয় স্ত্রীর খোরাকি সময়মতো পৌঁছে যেত তার বাপের বাড়ি, শর্ত একটাই এই বাড়িতে কখনো আসতে পারবে না। তাই এবার সুজনের ফুফু সেই শর্ত তুলে নিল। খবর পেয়ে সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী আসতে রাজি হয় নাই। সুজনের আব্বা বেঁচে থাকলে না হয় একটা কথা ছিল। এখন আসবে কার ভরসায়! স্বামী জীবিত থাকতেই দাম দিল না কেউ! এখন এক্কেরে তাদের মায়া লাইগা উঠছে, এতবছর বাদে! জীবন-যৌবন শেষ করে দিল একটা পুরুষের পাল্লায় পড়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর একবার এসেছিল সে। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে চলে গিয়েছিল। তারও যে স্বামী মারা গেল, এই জিনিসটাই সেদিন এই বাড়ির কেউ উপলব্ধি করে নাই এবং তাকেও করায় নাই। এবার সবাই তাকে বুঝাল, দ্যাখো, আল্লা ভরসা। যা হয় ভালোর জন্য হয়। তুমি সুজনের আম্মারে ক্ষমা করে দিও, আমাদের ক্ষমা করে দিও। তখন একই বাড়িতে থাকলে দুই সতীনের মারামারি, দুঃখ, গঞ্জণা সহ্য করতে হতো, আলাদা ছিলা ভালোই ছিলা। আরো অনেক কিছু বুঝায়, যতক্ষণ না তার গোসা ভাঙে। অবশেষে এক বিকালে সে এসে উপস্থিত হয়। সুজন ঘরের চাবি দিয়ে গেছিল নিজামের আম্মার কাছে। এসেই নিজামের আম্মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে সে। যেন নিজামের আম্মাই সুজনের আব্বার পাঠানো প্রতিনিধি, তাকে বরণ করে নিচ্ছে নববধূর মতন। কষ্ট ও লাজ একসঙ্গে ফুটে উঠেছিল সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রীর চোখে-মুখে। তারপর চোখের পানি মুখে নিজামের আম্মাকে বলে,‘আমি ওনার কোনো কিছু ধইরতাননো। লেপ-তোশক সব নিয়ে আইসছি, ভাবি।’ নিজামের আম্মা কোনো কথা বলে না। ইশারায় বুঝায় সে যেভাবে থাকতে চাইবে পারবে। সে ছাড়া ঘরে আর কেউ নাই। সে চাইলে দুই একটা কাজের লোক রাখতে পারে। সুজনকে বললে টাকা পাঠিয়ে দিবে। আর না পাঠালেও চলবে, ডিশের ব্যবসা তো রেখেই গেছে সুজন, একটা ছেলেকেও দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তাতেই হয়ে যাবে। আর ডিশের ব্যবসা চাঙ্গে উঠলেও সমস্যা নাই, নিজাম তো আছে, আম্মার পাশাপাশি চাচির জন্যও নিশ্চই পাঠাবে। সুজন কি আমার সাথে রাগ করি চলি গেছে ভাবি? জানতে চায় সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী। নিজামের আম্মা জানায়, মোটেও না, তার ফুফু বড় ব্যবসা ধরাই দিবে শহরে, সে জন্য গেছে।
অবস্থা ভালো! মিলেমিশে চলে! এমনই ভালা। তাই না? ঘুমের সময় বাদে নিজামের আম্মার সাথেই থাকে সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী। এক বিছানায় গল্প-গুজব করে, একচুলার খায়। রাতে শুধু ঘরে গিয়ে ঘুমায়। সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী এখনো একটু শক্তপোক্ত, তাও বয়স ষাটের কাছেই হবে। নিজামের আম্মার অনেক কিছুই আন্তরিকতার সাথে করে দেয় সে। সুজনের ফুফু সওয়াবের কাজ করে দিয়ে গেছে। কাজের লোকেরা বলে দিলেও বুঝতে পারে না, যত সহজে কী করতে হবে টের পেয়ে যায় সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী। সুজনের আম্মা আর শওকতের আম্মার সেই অভাব কি আর পূরণ হবে? তবুও তার সাথে সময় খারাপ কাটে না নিজামের আম্মার। সব নতুন করে শুরু করতে হয়। দ্রুতই বুঝে যায় সে। নিজামের আম্মাও আর কয়দিন। কাজেই এবাড়ির সব কিছুই এক অর্থে সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রীরই দেখে রাখতে হবে। যে আগিলা যুগে সবকিছু থেকে বঞ্চিত ছিল, এখন তার আঁচলেও আর রাখার জায়গা থাকবে না। তবুও বুক খালি তো জগতের সব খালি যেন। টের পায় সে! কী টের পায়? বলতেছি, স্বামী ছাড়া বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু সে তো নতুন থাকতেছে না। তার আগেই তিন বিধবা থেকে আসতেছে, দুইজন চলেও গেল! কত শীত-বসন্ত পার করে দিল। কিন্তু তারা তো এই বাড়িতে বহু বসন্ত পার করেছে। সে তো এক বসন্তও পার করে নাই। তবুও আগিলা অনেক স্মৃতি শোনায় তাকে নিজামের আম্মা। এতেই শীতে বসন্তের ছোঁয়া পায়। তাকে তার স্বামীর স্মৃতিই শোনায় নিজামের আম্মা, বাড়তি বা ভিন্ন কিছু না। যেমন, বাড়িতে বিয়ে লাগলে লুঙ্গি পরে ডেন্স দিত সুজনের আব্বা, পার্টনার হিসেবে নিত নিজামের আম্মাকে। সবার সেকি হুলস্থুল তাদের নাচ দেখে! আরো আরো কত কাহিনি! ভোলা যায়! এখন আরো গোপন কথা সব বের হচ্ছে। সুজনের আব্বা নাকি গোপনে প্রতি মাসেই যেত তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাপের বাড়ি। শাড়ি-চুড়ি সবই দিয়ে আসত। রাতে থাকত না। দিনে গিয়ে দিনে আসত। নিজামের আম্মা বলে, ‘তাইলে এখনো তোর এত রাগ ক্যান?’ হাসে সে। স্বামীর সাথে রাতে এক বিছানায় ঘুমানো কী জিনিস জানে না সে। তাই হাসে! নিজেই লজ্জা পায়। এসব কি আর কাউকে বলা যায়! এটা ভেবে হাসির কি আছে? তার তো কাঁদার কথা। যদিও এখন সে কাঁদে, তবে রাতে, একা শুয়ে শুয়ে। বসার ঘরে সিঙ্গেল একটা খাট আছে, সেখানেই ঘুমায় রাতে একা। ডাবল খাটে সে শোয় না। আজে বাজে ভাবনা মনে পড়ে। তার স্বামী ও সুজনের আম্মাকে ঘিরে! জিদ চাপে তার। এই জিদের ভাত কতজন খায় না! আর সে আসছে মরার পর খেতে! তাই সিঙ্গেল খাটে শোয়। এই খাটে সুজন থাকতে ঘুমাত। এখানেই চোখের সামনে একটা টিভি আছে। এই চ্যানেল, সেই চ্যানেল দেখতে থাকে সে। কত কী ভাবে সুজনের আব্বাকে ঘিরে। গানের চ্যানেলে গিয়ে নিজেকে ও সুজনের আব্বাকে কল্পনা করে প্রায়ই নায়ক-নায়িকার জায়গায়। এই বয়সে কী সব ভাবছে, পরে নিজেই লজ্জা পায়। মানুষটা একটু নিরীহও আছে। তা না হলে স্বামী থাকতে ঠিকই এই বাড়ির একটা খাট দখল করে নিতে পারত। তা সে করতে চায়ই নাই। যা মন থেকে কেউ দিবে না, তা পেয়ে কী শান্তি! এখন যেমন একটা শান্তি আছে। সে স্বামীর বাড়ি ফিরেছে, ফিরতে পেরেছে, এই বিষয়ে তার স্বামী কী ভাবছে, সে কি দেখতে পারছে? সে কি খুশি না বেজার! টিভির পাশেই একটা ছবি টানানো। স্বামীর যৌবনের ছবি। পুরা বাড়িতে সুজনের আম্মার কোনো ছবি নাই। তোলাই হয়নি কোনদিন। তার সাথে সুজনের আব্বারও কোন ছবি নাই। বুদ্ধি করে স্টুডিওতে গিয়ে তুলে রাখার দরকার ছিল। কিন্তু আগিলা যুগে কি আর এত কিছু ছিল। কেউ বুঝতো! তখন তো ছবি আঁকার যুগ ছিল। সুজনের আব্বার এই ছবিটাও বোধ হয় আঁকানো কাউকে দিয়ে। সে এত কিছু বুঝে না। তবুও কেমন যেন ছবিটা। এই রূপে কখনো সুজনের আব্বাকে সে দেখেনি। এটা বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের ছবি মনে হয়। তার সাথে পরিচয় আরো পরে। বাতি না নিভিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে প্রায়। অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে এমনিতেই চোখে পানি আসে। এসব একাকী কান্নার কোনো মানে কী আছে কারো কাছে? কেউই কাউকে পরিপূর্ণ সময়ের জন্য কখনো পায় না। মৃত্যু এসে ব্যবধান গড়ে দেয়ই! যে সময়ের জন্য পাওয়া যায় সেই সময়ই পূর্ণতা, সময়ের পূর্ণতার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। হঠাৎ বাতিটা নিভিয়ে দিলে সাদাকালো ছবিটার গা থেকে তখনও আলো বেরোয়!
এমন হবে কেউ ভাবে নাই! কিন্তু হইল তাই! বাড়িতে সবাই ঘুমাচ্ছে! গভীর রাত, না হয়তো শেষ রাত। ঠিক বুঝতে পারছে না সুজনের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী। ঘরের দরজায় কড়া নড়ল। ভেতর থেকেই সে জানতে চাইল, কে? বলল, ‘আমি!’ তার সাহস হয় না দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করে আমি কে? এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে শব্দটা উচ্চারিত হয়েছে, যেন এবাড়িতেই দীর্ঘদিন কাটাতে থাকা মানুষ, দীর্ঘ রজনী এ ঘরেই পার করা কেউ। কিছুদিনের জন্য ছিল না মাঝে, এসেছে আজ! আবার কড়া নড়ল। বিধবা কী করবে বুঝতে পারল না। একটা ফুটো খুঁজে তাকিয়ে দেখে, যুবক। দেয়ালের ছবিটার যুবক। বিধবা দরজা খুলে দেয় জলদি! যুবক ভেতরে ঢোকে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরে বিধবা। চুমু খায়, বুকে মাথা রাখে। হাতড়িয়ে দেখে শরীরের চারধার। যুবক হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। বলতে চায়, দূর থেকে এসেছে, তার খুব ক্ষুধা, খেতে দিক তাকে কিছু একটা। বিধবার সেদিকে খেয়াল আছে? সে শুধু ছবিটার সাথে যুবককে মিলিয়ে দেখার একটা সুযোগ পেতে চেয়েছিল। মিল আছে! তাই আর দেরি করে নি! যুবককে জড়িয়ে ধরে তার যে ভেতরের আবির্ভাব একটা বসন্ত যেন! তার সঙ্গে শেষের দিকের শীতের শেষরাতে আসা এই যুবকের আবির্ভাব মিলবে কি! জীবিতের সাথে জীবন অনেককিছু মিলিয়ে চলে! কিন্তু মৃতের সাথে জীবনের এত কিসের হিসাব? যুবক তাকে কী সম্মোধন করবে বুঝতে পারছে না। কখনো এভাবে সাক্ষাৎ হয়নি তাদের, সম্মোধনের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আজ রাত থেকে একটা সম্বোধন তো লাগবেই। সেটাই ভাবছে যুবক। বিধবা বলে যাচ্ছে তখন বিড়বিড় করে, ‘কার জন্য আসছ তুমি? আমার জন্য, না সুজনের আম্মার জন্য?’ সুজন তাকে চেপে ধরে বসায়। আর কী বলব!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন