বিনিসুতোর মালা

বিনিসুতোর মালা
সুজয় দত্ত
(১) রঙ্গন


জানলাটা বন্ধ হয়না ভাল করে। শীতের পড়ন্ত বিকেলের হিমেল হাওয়া হুহু করে ঢুকছে তার ফাঁক দিয়ে। ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল রেখে। পরের স্টেশন আসতে এখনো খানিকটা দেরী। আমার মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল, “ঠান্ডা লেগে যাবে। সরে এস এদিকে।”
তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না ওর। একরাশ ফিনফিনে কোঁকড়া চুল হাওয়ায় উড়ছে এলোমেলো। মুখ আলতো ছোঁয়ানো জানলার কাচে। উষ্ণ নিঃশ্বাসে মাঝেমাঝেই ঝাপসা হয়ে উঠছে সে-কাচ। খানিক পরে মুখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “জ্বর এলে রাত জেগে জলপটি দিতে হবে, তাই তো?”
আমার মাথা নীচু, চোখ কামরার মেঝেতে। মনের ক্যালেন্ডারে ফুটে উঠছে একটা তারিখ। ১১ই মে। চার বছর আগের। শেষ যখন ওর শিয়রে বসে তপ্ত কপালে হাত ছুঁইয়েছিলাম – জলপটি দিতে। আগের দিন কালবৈশাখীর হঠাৎ হওয়া বৃষ্টিতে ছাতাহীন বাড়ী ফিরেছিল। বৃষ্টি হলেই কেমন যেন কিশোরীর চাঞ্চল্য পেয়ে বসত ওকে। জ্বর এল সে রাতেই। তারপর সারাদিন দেহের উত্তাপ উঠল নামল। ঠিক যেমন করে শরীরে উত্তাপের ওঠানামা চলেছিল আরো কিছু বছর আগে এক উৎসবমুখর ১১ই মে-র রাতে। সারারাত ধরে পরস্পরকে চিনেছিল দুটো শরীর। সেই প্রথমবার। বন্ধ সে ঘরের দেওয়ালে মেঝেতে টেবিলে খাটে সেদিন ছড়ানো ছিল সামাজিক স্বীকৃতির নানা সুদৃশ্য সুগন্ধী ছাড়পত্র। হায়, সময়ের নিষ্ঠুর জাদুদন্ডে কত মায়াকানন যে মরুভূমি হযে যায়। আজ এতবছর পর এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া, তার ওপরেও কি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল? দূরপাল্লার ট্রেনে মাঝপথে উঠে দেখি ফার্স্টক্লাস রিজার্ভড কামরায় জানলার ধারে আমার সামনের সীটে ও। ওর চাহনিতে প্রথমে ছিল চমক, তারপর অস্বস্তি, শেষে জোর করে মুখোশের মতো পরে থাকা একটা নির্লিপ্ততা। এইভাবেই কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা, যেন কয়েকটা যুগ।
মেঝে থেকে চোখ তুলতেই দেখি ও চোখাচোখি এড়াবার জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার মানে এতক্ষণ তাকিয়েছিল আমার দিকে? কী ভাবছিল? সেই মধুচন্দ্রিমায় শিমলা যাওয়ার ট্রেনজার্নির কথা? স্টেশনে থেমেছে গাড়ী, গরম পানীয়ের সন্ধানে আমি প্লাটফর্মে আর ওর উৎসুক, উদ্বিগ্ন চোখ জানলা দিয়ে খুঁজছে আমায়? নাকি সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যেগুলোর কথা যখন ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকা মাইগ্রেনের ব্যথায় আমি ঠিক এইরকমভাবে মাটির দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম আর ও আমার মাথায় প্রাণপণে হাত বুলিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করত আরাম দেবার? নাকি ক’বছর আগের আমার সেই প্রশ্নকঠিন মুখ – নির্মম কৈফিয়ত চাইছি কেন সে গোপন করেছে তার অতীত ভালবাসা আমার কাছে?
গাড়ীর গতি কমে আসছে। স্টেশন আসার সময় হয়ে গেল বোধহয়। ঈষৎ চাঞ্চল্য চারপাশের যাত্রীদের মধ্যে। গুছিয়েগাছিয়ে নামার প্রস্তুতি। ও-ও কি নামবে? কেন জানিনা ওকে আর জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি কোথায় যাচ্ছে। তেমন কোনো তৎপরতা অবশ্য দেখছিনা ওর মধ্যে, সেই একইভাবে জানলার বাইরে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে। এবার কারশেড দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে, ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ফাঁকা ওয়াগন আর অচল ইঞ্জিন, স্টেশন রোডের বাজারের ব্যস্ততা, সাইকেল রিক্সার হর্ন, লাইনম্যানের কেবিন। ধুসর প্ল্যাটফর্মটা মাটি থেকে হঠাৎ গজিয়ে উঠতেই উঠে দাঁড়াল ও। সীটের তলা থেকে চাকালাগানো পুলম্যানটা বার করে এক হাতে সামলে অন্য কাঁধে গলিয়ে নিল সঙ্গের ব্যাগটা। আমি নীরবে তাকিয়ে সেদিকে – কিছু বলবে কি ও? কিচ্ছু বলবে না? সহযাত্রীদের আগে বেরোতে দিয়ে তাদের পিছু পিছু কামরার দরজার দিকে এগোল ধীরপায়ে। একেবারে শেষ মুহূর্তে ফিরল আমার দিকে। অজানা প্রত্যাশায় স্তব্ধ আমার হৃদস্পন্দন। ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল ওর, “সেই রঙ্গন গাছটায় এখনো ফুল হয়?” কি বলব এর উত্তরে? সারারাত কথা বললেও কি যথেষ্ট উত্তর হবে? ক্ষণিক তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম মেঝেতে। বেজে উঠল ট্রেনের বাঁশী। জীবনে কত প্রশ্নই তো এমন জবাবহীন রয়ে যায়।



(২) ভোজ


“কই রে কমলা, বাইরের ঘরটা ঝাঁট দেওয়া হল? এবার বারান্দায় আয়।”
“এই হল বলে, বৌদি। খাটের তলায় ঝুল জমেছে অনেক, ঝ্যাঁটা দিয়ে পোস্কার করতিছি।”
“দূর বাবা, এই সকালবেলা অফিসটাইমে তোকে ঝুল ঝাড়তে হবেনা, রান্নাঘরে একগাদা বাসন পড়ে আছে…”
“আসতিছি গো আসতিছি। আগে তোমার তয়-তরকারীগুলো কেইটে দিই, তুমি রান্না বসাও, তারপর বাসনে হাত দেবোখন।”
আশির দশকের মাঝামাঝি কলকাতার একপ্রান্তে মধ্যবিত্ত আবাসনে দু’কামরার ছোট ফ্ল্যাট। রোজ সকালে ঘড়ি ধরে সোয়া ছ’টায় কাজে আসে কল্পনা। সেই শহীদ কলোনী বস্তি থেকে হাঁটতে হাঁটতে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা। যদি না শরীর খারাপ থাকে বা বৌদিদিমণির কাছে আগেভাগে ছুটি নেওয়া থাকে। বৌদি মাঝেমাঝেই ওকে ‘কমলা’ বলে ডেকে ফেলেন। আসলে আগে এ-বাড়ীতে কমলার মা কাজ করত তো, তাই।
“ও বাবা, এই অ্যাত্ত শিম? দাঁড়াও, কাটাপোনার আঁশটা আগে ছাইড়ে দিই, তুমি মাছটা ভেইজ্যে নাও। তারপর শিমে হাত দিতিছি। আজ কী করবে গো বৌদি? শিমবেগুন না শিম দিয়ে নিরিমিষ্যি ঝোল?”
“শিমবেগুন। তোর অত খবরে দরকার কী? কাটতে বসেছিল, কাট। আর হ্যাঁ, নলী বেগুনগুলো ডুমোডুমো করে কাটবি আজ, লম্বালম্বি নয়।”
“না গো বৌদি, শিমবেগুন কত্তিছ করো, কিন্তু এই কচি কচি শিম দিয়ে শিম-সর্ষে যা হয় না, এক্কেরে ফাস্টোকেলাস! পোস্তবাটা দিয়ে শিম দিয়ে বড়ির ঝালও খুব জমে, কিন্তুক শিম-সর্ষের মতো না।”
“আঃ, এখন সকালবেলা তাড়াহুড়োর সময় ওইসব রান্নার ফিরিস্তি দিসনা তো! কাট, কাট, হাত চালিয়ে কাট।”
“কাটতিছি তো। না গো, শিম-সর্ষে মোট্টে শক্ত নয়, শিমগুলো গোটাগোটাই থাকবে, শুধু চিরে বিচিগুলো বার করি নিতি হবে। সর্ষেটা ভাললো করে বাটতি হবে কিন্তু, বড়ির ঝালের পোস্তর মতো অত্ত মিহি করে নয়, কিন্তুক বেশ পিষে পিষে। আর এসব রান্নায় তোমাদের ওই রেপছি তেল, শাপলা তেল একদম দিওনি গো বৌদি, শুদ্ধ সর্ষের তেল…”
“ধ্যাৎ, শাপলা তেল আবার কী? স্যাফোলা, স্যাফোলা। নাঃ, তুই যা গল্প জুড়েছিস, দিলি আজ দাদাবাবুর অফিসের দেরী করিয়ে।”
“না না, কত্তিছি কত্তিছি। শিমে তো অত বেগুন লাগবেনি গো, চারখান সরিয়ে রেইক্যে দিই? বেগুনপোস্ত করবে।”
“উঃ, বেগুনপোস্ত করবে না ইয়ে করবে। ছটায় উনুন ধরিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসের ভাত রেডি করতে হয়, আবার বেগুনপোস্ত? বকিস না তো উল্টোপাল্টা!”
“ওই দেক, তোমায় একা হাতে কত্তে বলতিছি নাকি? আমি বেগুন কেইটে দেব, পোস্ত বেইটে দেব। আচ্চা, দাদাবাবুকে বলতে পারোনি রোজ রোজ নলিবেগুন না এনে বড় বড় ঠাসবেগুন আনতে? এই শীতের দিনে বেগুনপোড়া দিয়ে গরম গরম রুটি, সঙ্গে কুচো পিঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা..আঃ”
“এই তুই ওঠ তো ওখান থেকে! যা রান্নাঘরে বাসন মাজগে যা। বাকি তরকারী আমি কেটে নিচ্ছি।”
“যাচ্ছি গো যাচ্ছি। এই আলুর খোসাগুলো ছাইড়ে দিয়ে যাই। তোমার হাত কেইটেছিল না কাল? এই গোল গোল নতুন আলুর কাশ্মীরী আলুদ্দম নুচি দিয়ে একদিন খাওয়াতে পারো তো দাদাবাবুকে ছোড়দাবাবুকে… ছুটির দিন দেকে। আমি বেলে দেব’খন। পাতে একটু খেজুরগুড় কি নলেন গুড়..”
বৌদি জোরে বকুনি দেওয়ার আগেই তাঁর এগারো-ক্লাসে-পড়া ছেলে নিজের বেডরুম-কাম-স্টাডিরুম থেকে জামা পরতে পরতে বোঁ করে বেরিয়ে এসে বলল, “চা-টা একটু ঘরে দিয়ে আসতে পার না কেউ? প্রতি মঙ্গলবার ট্যুইশনে লেট্ করে যাওয়া আর স্যারের বকুনি খাওয়া… ভাল্লাগে, বল? ওয়ান আদার থিং, ফর হেভেন্স সেক্ রোজ সক্কালবেলা থেকে তোমাদের এই চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় রান্নার গল্প বন্ধ করবে? আই সিম্পলি কান্ট্ টলারেট ইট।”
“সেকি গো ছোড়দাবাবু, রান্নার গল্প ভাল লাগেনিকো তোমার? দুমুঠো খাওয়ার জন্যিই তো সব গো। দাঁড়াও, একদিন আমি তোমায় মশুর মামলেট করে খাওয়াব..”
“হোয়াট?”
“মশুর মামলেট গো, ওই যে পুরু করে ডিমের মামলেট করে তার ভাঁজে ভাঁজে মশুর কেটে কেটে দিতে হয়। ব্যাঙের ছাতা গো ব্যাঙের ছাতা। তারপরেতে সেই মামলেটের গায়ে এট্টু মাখন মাখিয়ে..”
“হোপলেস” বলে চা-ব্রেকফাস্ট হাতে নিয়ে বোঁ করে আবার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল সে। খেয়েদেয়ে জামাজুতো পরে প্রায় ছুটেই বাস ধরতে বেরিয়ে গেল। দেখতে পেল না যে, বাসন মাজা ঘর মোছা কাপড় কাচা শেষ করে বিদায় নেওয়ার আগে তার প্রতিদিনের বরাদ্দ বাসিরুটি-গুড়ের সঙ্গে একটা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগও পেয়েছিল আজ কল্পনা তার বৌদির কাছ থেকে। তাতে ছিল কালকের বাসিগন্ধঅলা ডালমাখানো ভাত আর টকটক আলুচচ্চড়ি। বয়স কম, তাই এটাও জানা বাকী ছেলেটার যে, এই পৃথিবীর সব কল্পনারই ওই শিমবেগুন-শিমসর্ষে-বড়ির ঝাল-বেগুনপোস্ত-বেগুনপোড়া-আলুদ্দম-লুচি-নলেনগুড় আর মশুর মামলেট আসলে থাকে তাদের প্রাত্যহিক বাসিরুটির ঠোঙায় আর বাসিভাতের ক্যারিব্যাগে। আর থাকে তাদের কল্পনায়। শুধুই কল্পনায়।

(৩) সেকেলে


“টুথপেস্ট কোনটা দেব দাদা? এটা দিই – সেনসোডাইন? নাকি এই নতুন একটা বেরিয়েছে অ্যাকোয়া বলে, ট্রিপল স্ট্রাইপ, ওটা নেবেন? নিয়ে দেখুন, ফাস ক্লাস।” খদ্দেরের ভীড়ের মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে জানতে চায় দোকানদার।
“নাঃ থাক, ওই নিমপেস্টটাই দাও। আর একটা মার্গো নিমসাবান। আর যেন কী… ও হ্যাঁ, ব্লেড আছে, দাড়ি কামাবার ব্লেড?”
“মার্গো হবেনা দাদা। ডাভ আছে তিনরকম — গোল্ড, ল্যাভেন্ডার আর কোকোবাটার, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী আছে, ফ্রেসকা আছে। আরে অ্যাই ফটকে, একটু হাতটা চালা না! সান্যালকাকুর বিস্কুটটা দিয়েছিস? এই দাদাকে একটা জিলেট পেড়ে দে তো.. ওই ওখানে টাঙানো আছে..”
“না না, জিলেট-ফিলেট না।”
“তবে কি পামোলিভ নেবেন? দু’টাকা কম পড়বে।”
“আরে আমি ইউজ-অ্যান্ড-থ্রো রেজার চাইনি। এমনি ব্লেড নেই তোমার?”
“দাঁড়ান তাহলে, একটু খুঁজতে হবে। অ্যাই বাচ্চা, মাস্টারমশাইয়ের মুসুর ডালটা চট করে দিয়ে পেছনের স্টোরেজে দ্যাখ তো বেলেড পাস কিনা। আপনি দাদা সক্কালবেলায় এমন মুশকিলে ফেলেন! ওসব বেলেড-ফেলেড আজকাল আর কেউ চায়না। আপনি সেই কোন যুগে পড়ে আছেন?”

ঠিক কোন যুগে যে ও পড়ে আছে, এই প্রশ্নটা শুধু আজ মুদির দোকানেই নয়, দৈনন্দিন জীবনের অনেক ক্ষেত্রে অনেকবার ধেয়ে এসেছে অরিঞ্জয়ের দিকে। এইতো সেদিন পাড়ার রায়জ্যেঠুর ছেলে বাপীদা বাসের লাইনে বলছিল “এই ঝাঁঝাঁ রোদে চোখ কুঁচকে মুখে হাতের আড়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস রোজ, একটা সানগ্লাস কিনতে পারিস না? কোন যুগে বাস করিস?” কিংবা গতমাসে জ্যাঠতুতো দাদার বিয়েতে ওর সদ্য-কলেজে-ঢোকা পিসতুতো বোন যেমন ফস করে বলল, “অরিদা কি এখনো সেই হারু দরজির কাটপিসের প্যান্ট চালিয়ে যাচ্ছিস? কোল্ড ওয়ার শেষ হয়ে গেছে, বার্লিন ওয়াল ভেঙে গেছে, নতুন মিলেনিয়াম শুরু হয়েছে… এসব জানিস তো? হি হি হি। বলা যায়না, কোনদিন দেখব খাদি আর গান্ধীটুপি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস রাস্তায়। এবার একটু জিন্স-টিন্স পর!”

বাস্তবিকই, অঙ্ক-ইংরেজী-ভূগোল বা ক্রিকেট-ফুটবল-টেনিসের মতো ফ্যাশন জিনিসটাও যে শিখতে হয়, ওটা যে হরিণছানার পেট থেকে পড়েই হাঁটতে পারার বা কুমীরছানার ডিম্ ফুটে বেরিয়েই সাঁতার কাটতে পারার মতো স্বয়ংক্রিয় নয়.. সেটা এখনো ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারল না ও। যেসব চাকায় ভর করে সময় এগিয়ে যায়, যুগ বদলে যায়, তার একটার নাম ফ্যাশন। অন্যগুলো হল প্রযুক্তির উন্নতি, মূল্যবোধের বস্তুবাদী বিবর্তন, ভোগবাদের বিস্ফোরণ, ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটাতেই ঠিকঠাক সওয়ার হতে না পারলে অফিসটাইমের থামতে-না-চাওয়া বাসের মতো বা পাড়াগাঁয়ের মেঠো স্টেশন এড়িয়ে হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া গ্যালপিং ট্রেনের মতো জগৎ আর জীবন যে তাকে নির্মমভাবে পিছনে ফেলে রেখে ছুটে যাবে আপন গতিতে, এটা বুঝে ওঠার আগেই দেখল অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে সে। সত্যি, ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া আদর্শ জীবনের সংজ্ঞাটা অরিঞ্জয়ের চোখের সামনেই মাত্র কয়েক দশকে কত দ্রুত পাল্টে গেল। শপিং মলের শেলফে সাজিয়ে রাখা পণ্যসামগ্রীর মধ্যে প্রথমেই নজর কাড়ে ঝকঝকে মোড়কওয়ালারা। এখন তো গোটা পৃথিবীটাই একটা বাজার, তাই আজকের যুগে ওপরে ওঠার বা সকলকে ছাড়িয়ে চোখে পড়ার একনম্বর শর্ত দেখনদারী আর চটকদারি। ঠিক যে জিনিসগুলো অরিঞ্জয়ের নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, শহরতলীতে মানুষ হয়েছে, ভাইবোনদের মধ্যে ওই বড়। সারাজীবন মুখে রক্ত তুলে খেটেও উচ্চমধ্যবিত্তের তকমাটাকে ছুঁতে ব্যর্থ বাবা যখন ওদের তিন ভাইবোনকে রেখে একদিন আচমকা হার্ট অ্যাটাকে ‘নেই’ হয়ে গেলেন, চারটে প্রাণীর সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ল ওর কাঁধে। বিএসসির ফাইনাল ইয়ার সেটা। এ পোড়া বাংলার সাধারণ শিক্ষিত যুবকদের কাছে চাকরি আর কবে সুলভ ছিল? তাৎক্ষণিক রোজগারের রাস্তা একটাই, টিউশন। একটা-দুটো দিয়ে শুরু। তারপর অঙ্ক-সায়েন্সটা বেশ ভালোই পড়ায়, এই নাম ছড়িয়ে পড়তেই আরো অনেক। এখন তো প্রায় প্রতিদিনই সেই সক্কালবেলা পড়াতে শুরু করে, শেষ হতে হতে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। বেশীরভাগই গিয়ে গিয়ে পড়ানো, অল্প কয়েকটা ওর ছোট্ট ভাড়াবাড়ীতে। সারা সপ্তাহ শুধু এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে ঘোরাঘুরি। অবসর খুবই কম। কলেজ জীবনে ওর পুরু চশমাঅলা সিরিয়াস মুখ আর পড়ুয়া-পড়ুয়া ভাব দেখেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, ওর গায়ে কোনো রঙীন প্রজাপতি-টজাপতি বসে নি। অতএব বান্ধবীর খাতাও শূন্য। ফ্যাশন বা আধুনিকতার আর দোষ কী! এমন একটা জীবনে তারা ঢুকবে কোথা দিয়ে?

আজও এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ষষ্ঠীতলার কাছে পুরোনোপল্লীতে ওর শেষ ব্যাচটা পড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ী ফিরছিল অরিঞ্জয়। নারকেলডাঙা মেন্ রোডের ওপর খালপোলটার কিছু আগে একটা গলিঘুঁজি জায়গা। রাস্তায় আলোটালো তেমন নেই, তাই দেখেশুনে খানাখন্দ বাঁচিয়ে চলতে হয়। রাত সাড়ে নটাতেই এলাকাটা বেশ শুনশান, দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ, সরু সরু গলিগুলোর দুপাশের বাড়ীতে বাসিন্দারা নির্ঘাত টিভির সামনে। অল্প অল্প আওয়াজ ভেসে আসছে প্রোগ্রামের। আরো কিছুদূর হেঁটে মেন্ রোডে একবার পড়তে পারলে সেখানে গাড়ীঘোড়া আছে, আলোও আছে। যদিও রাজাবাজারমুখী বাস এই সময় কমে যায়। ওর বাড়ী রাজাবাজার মোড়ের খুব কাছে, তাই এখানে সন্ধ্যেবেলা পড়াতে এলে হেঁটেই বাড়ী ফেরে। মিনিট পঁচিশেকের হাঁটা।
কিন্তু আজ একটা গলি থেকে বেরিয়ে পরের অন্ধকার গলিটায় ঢোকার আগে ডানদিকে যে ঝোপঝাড়অলা মাঝারি সাইজের মাঠটা আছে, যেখানে ইঁট বালি সিমেন্ট ঢিবি করে রাখা, তার ওপ্রান্ত থেকে চাপা গলায় কথাবার্তা কানে এল ওর। গ্রাহ্য না করে সোজা এগিয়ে যেতে গিয়ে এবার শুনল একটা চাপা গলার অস্ফুট চীৎকার। সঙ্গে ওটা কি ধস্তাধস্তি, ঝটাপটির শব্দ? দেখা যাচ্ছে না কিছুই। একে অন্ধকার, তার ওপর বালি আর সিমেন্টের দুটো বিশাল পাহাড়ের ওদিকে হচ্ছে ব্যাপারটা। কৌতূহলবশত নির্জন মাঠটায় নেমে ঝোপঝাড় ঠেলে শব্দের উৎসের দিকে এগোতে থাকে ও। চীৎকার, ধস্তাধস্তির বদলে এখন কানে আসছে চাপা গোঙানি। বালি-সিমেন্টের দ্বিতীয় ঢিবিটা পেরোতেই অন্ধকারে কিসে একটা জোরে ধাক্কা খেল ও। ওর ঠেলায় ভারসাম্য হারিয়ে সশব্দে মাটিতে উল্টে পড়ল একটা বাইক। অন্ধকারে কয়েকটা ছায়ামূর্তি চমকে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল, আরেকটা ছায়ামূর্তি তাদের নাগাল ছিঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলোহীন প্রায়ান্ধকার রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে হয় বলে পকেটে একটা পেন্সিল টর্চ রাখে অরিঞ্জয়। সেটা বের করে জ্বালার আগেই টের পেল মাটি থেকে কোনোরকমে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে সেই ছায়ামূর্তিটা ছুটে এসে জাপ্টে ধরল তাকে, সঙ্গে নারীকণ্ঠে আর্তনাদ “বাঁচান আমায়, বাঁচান, প্লীজ, প্লীজ ওই দেখুন, ওই দেখুন, ওরা আসছে, ছাড়বে না শয়তানগুলো…”। অন্ধকারে তিনটে ছায়ামূর্তি ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। বুঝতে পেরেই প্রাথমিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ঢিবির পাশ দিয়ে দৌড়োতে শুরু করে ও। পিছনে পিছনে ওই লোকগুলো। খানিকটা দৌড়ে দ্বিতীয় ঢিবিটার কাছে পৌঁছতেই ওদের মধ্যে একজন ডাইভ দিয়ে পা টেনে ধরল অরিঞ্জয়ের। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়তে পড়তে ও দেখল মেয়েটা ওর হাত ছাড়িয়ে ঢিবির বাঁদিক দিয়ে ছুটছে আর একটা লোক তাকে ধাওয়া করছে। পা টেনে ধরে থাকা লোকটাকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি কষায় ও, নিজেকে মুক্ত করে প্রাণপণে ছুটতে থাকে মেয়েটা যেদিকে গেছে সেদিকে। পিছনে একটু তফাতে দুজোড়া পায়ের শব্দ। মাঠ শেষ হয়ে যেখানে গলিরাস্তা দেখা যাচ্ছে, তার ঠিক পাশেই ইঁটের পাঁজার গায়ে মেয়েটাকে ঠুসে ধরে আছে একটা ষন্ডামার্কা চেহারা, শক্ত হাত দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে তার শিকারের। সব কিছু ভুলে সেই লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অরিঞ্জয়, তাকে নিয়ে গড়াগড়ি খেল ঘাসজমিতে। মেয়েটা এই ফাঁকে তীরবেগে অন্ধকার গলিতে ঢুকে কোথায় হারিয়ে গেল, আর তিন মূর্তিমান শয়তানের সব আক্রোশ গিয়ে পড়ল অরিঞ্জয়ের ওপর। ওর মুখ চেপে ধরে পাঁজরে-পেটে-পিঠে কয়েকটা সুতীব্র লাথি কষাবার পর ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল মাঠের পিছনদিকে ওদের বাইকের কাছে। সেখানে একটা পাথরের ওপর ওর মাথাটা রেখে থান ইঁট দিয়ে থেঁতলে দিতে লাগল বারবার। তারপর তিনজনে বাইকের সীটে বসে ওর রক্তাক্ত দেহটার শুধু হাতদুটো শক্ত করে ধরে চালিয়ে দিল বাইক মাঠের পিছনদিকের অন্ধকার গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে। এবড়োখেবড়ো খোয়াওঠা রাস্তায় অসহায়ভাবে ঘষটে ঘষটে চলল অরিঞ্জয়ের দেহ। বড়রাস্তার ঠিক মুখে একটা নির্জন জায়গায় দেহটাকে ফেলে রেখে জোরে বাইক চালিয়ে দূরে মিলিয়ে গেল লোকগুলো।

আর তারপর সারারাত ওই ফাঁকাফাঁকা বড়রাস্তায় গাড়ীর চাকারা অ্যাসফল্টে শব্দ তুলে সেই নিস্পন্দ দেহটাকে বিদ্রূপ করতে লাগল, “ইশশ, একটা অজানা অচেনা মেয়ের জন্য এভাবে কেউ প্রাণটা খোওয়ায়? এমন আহাম্মক আর কে আছে? কোন যুগে বাস করিস?”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *