বিরিয়ানি

বিরিয়ানি
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
-“বিরিয়ানি খাবেন?”
আচমকা এরকম একটা প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রিশান।
-“আমাকে বলছেন?”
-“হ্যাঁ আপনাকেই।”

রিশান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। রিশান এই পাড়ায় নতুন এসেছে। পেইং গেস্ট। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বিরিয়ানি রিশানের সব থেকে পছন্দের খাবার। কিন্তু এইরকম অযাচিত আমন্ত্রণ। এর মানে কী?

-“আমার নাম জিনিয়া। আসলে একটা ছোট্ট খাবারের দোকান শুরু করেছি। এখনো রেস্টুরেন্ট বলা যায়না। আজকেই তার প্রথম দিন। একবার টেস্ট করে দেখবেন?”
রিশান পুতুলের মতো মাথা নাড়ে। জিনিয়ার বড় বড় চোখদুটো খুশিতে ঝলমল করে ওঠে।

একটা দোতলা বাড়ির নিচে এই খাবারের হোটেলটা। খুবই ছোট। চারটে চেয়ার টেবিল, দুটো বেঞ্চ সাজানো রয়েছে। রিশান ছাড়া আর কেউ বসে নেই। জিনিয়া নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করছে। খুব ফর্সা, বাদামী চুল, চোখ দুটোও বাদামী রঙের। হাতের পাতায়, গালে ঈষৎ লালচে আভা রয়েছে। সকাল থেকে বোধহয় নিজেই রান্না করেছে। সাদা চুড়িদারে এদিক ওদিকে হলুদ লেগে রয়েছে। বিরিয়ানি রায়তা আর তার সঙ্গে ফিরনি পরিবেশন করে জিনিয়া ।

রিশানের আসলে ভালো করে খাওয়া হয়নি। সয়াবিনের তরকারি দিয়ে দুটো ভাত নাকে মুখে গুঁজে বেরিয়েছিল তাড়াহুড়ো করে বাসটা ধরবে বলে। কিন্তু ভাগ্যে ছিল বিরিয়ানি। খেয়ে রিশান টাকা মেটাতে যেতেই জিনিয়া বারণ করে। বলে- “আজ প্রথম দিন ভালো লেগে থাকলে পরে আবার দেবেন।”
রিশান হাসিমুখে বলে –“খুব ভালো হয়েছে ওই কী একটা কথা আছে না, উমদা।”
জিনিয়া সবকটা দাঁত বের করে হাসে। হাসলে তার গালে টোল পড়ে।

এরপরে বিরিয়ানির কথা মাথায় এলেই রিশান ওই হোটেলের সামনে চলে যেত। জিনিয়া কে রাস্তায় কোথাও দেখলেই ওর একটা অদ্ভুত খিদে পেয়ে যেত। মুখে বিরিয়ানির স্বাদ চলে আসতো নিজের থেকেই। জিনিয়া আর বিরিয়ানি যেন সমার্থক। জিনিয়ার দোকানে এখন বেশ ভীড় হচ্ছে। হাতে হাতে সাহায্য করার জন্য একটা মেয়েকেও রেখেছে জিনিয়া।

সেদিন রিশানের বান্ধবী জুলি এসেছিলো রিশানের কাছে কিছু নোটস নিতে। জুলি দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। কার্লি হেয়ার। ওয়েস্টার্ন পোশাকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। জুলিকে বেশ ভালো লাগে রিশানের, ওর মধ্যে একটা ছেলেমানুষি আছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বিরিয়ানির দোকানটা দেখেই- “জন্মদিনের ট্রিট দিসনি, বিরিয়ানি খাওয়া” বলে রিশানের হাত ধরে ঝোলাঝুলি করতে থাকে জুলি। অগত্যা রিশান রাজি হয়। বিরিয়ানিটা খেয়ে জুলির মুখ চোখ লাল। কী অসম্ভব ঝাল।
অবাক হয় রিশান। ওর বিরিয়ানি তো ঝাল নয়। তাহলে কি জিনিয়া ইচ্ছে করেই? এই এক মাসে জিনিয়ার প্রতি একটা অদ্ভুত দুর্বলতা জন্মেছে রিশানের। তাহলে কি জিনিয়ারও ওর প্রতি, না ও একটু বেশিই কল্পনা করে ফেলছে।

কিন্তু এর উত্তর এরকম ভাবে পাবে ভাবতে পারেনি রিশান। সেই দিনটা ছিল আগস্টের ঝমঝমে এক বৃষ্টির দিন। কলেজ যাওয়া হয়নি। একটু জ্বর জ্বর মতো এসেছিলো। রিশান বিরিয়ানির দোকানে গিয়েছিলো। জিনিয়া দাঁড়িয়েছিল ওপরের বারান্দায়। তারপর রিশানকে দেখে নীচে নেমে এসেছিলো। বললো “আজ তো দোকান বন্ধ। মা গেছে মামার বাড়ি। ওই মেয়েটাও আসেনি আর এত বৃষ্টি দেখে।”

-“ও আমি জানতাম না। আসলে আজ আমাদের যে রান্না করে সেও আসেনি। তাই ভেবেছিলাম।”
চলে যাওয়ার উদ্যোগ করে রিশান।
জিনিয়া রিশানের হাত ধরে বলে “ভেতরে এস।”


জিনিয়ার গা থেকেও জাফরান আর গোলাপজলের মতো গন্ধ পেতো রিশান। জিনিয়ার পাতলা ঠোঁটে এলাচের, খোলা চুলে মেহেন্দির গন্ধ আচ্ছন্ন করে রাখতো রিশান কে। রিশান আর কিছু ভাবতেই পারতো না। জিনিয়া বেশি কথা বলতো না । শুধু হাসতো। সেই প্রথম দিনের মতো। মাঝে মাঝে বুকের ওপর শুয়ে থাকা রিশানের চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে জিনিয়া বলতো -“আমার জীবনের দুটো স্বপ্ন আছে, প্রথমটা হলো- আমি অনেক বড় একটা রেস্টুরেন্ট করবো। কতরকমের বিরিয়ানি আর পোলাও সেখানে পাওয়া যাবে, বুঝলে রিশান?”

জিনিয়ার গন্ধে ডুবে থাকা রিশান জড়ানো গলায় বলে, “কতরকম ?”
-“কলকাতা বিরিয়ানি তো থাকবেই এছাড়া লখ্নৌ বিরিয়ানি, বম্বে বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি, হায়দ্রাবাদ বিরিয়ানি।”
-“ব্যস ব্যস আর বলতে হবে না খুব খিদে পেয়ে যাচ্ছে এবারে।”
শব্দ করে হেসে ওঠে জিনিয়া।
“দ্বিতীয় স্বপ্নটা তো বললে না?”
-“তুমি। সারাজীবন বিরিয়ানি রেঁধে প্রথমবার তোমাকে টেস্ট করানো।”
এভাবে রিশানের নিত্য যাতায়াত হতে থাকে ওই পুরোনো দোতলা বাড়িটায়।
কখনো বিরিয়ানি, কখনো জিনিয়া, কখনো দুটোই।

কিন্তু একদিন একটা বড় গাড়ি এসে থামলো জিনিয়ার বাড়ির বাইরে। অনেক লোকজন। জিনিয়ার বিয়ে ঠিক করেছে ওর মামা। জিনিয়ার বাবা নেই, মামারবাড়ি থেকেই সব দেখাশোনা হয়েছে। এর পরে আর জিনিয়াকে ওই দোকানে বা বারান্দায় দেখা যায়নি। পরের দিন জিনিয়ার বাড়ি গিয়ে রিশান দেখে তালা বন্ধ। ওরা নাকি চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারেনি। দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
রিশানের বুকের ভেতরে বৃষ্টি ভেজা বাতাস বইতে থাকে যেন। বালিশে নিজের মুখটা চেপে ধরে রিশান। অনেকবার জিনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে রিশান। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এরপরে একটানা অনেকগুলো বৃষ্টির দিন কেটে গেছে, অনেকগুলো জুলাই, আগস্ট চলে গেছে।

রিশান এখন কর্মসূত্রে দশ বছর আমেরিকায় প্রবাসী। কলকাতায় এসেছিলো একটা কাজে। কলকাতায় পা দিতেই রিশানের কেন যেন আবার মনে পড়লো বিরিয়ানির কথা। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেলো ‘উমদা বিরিয়ানি’। পার্ক স্ট্রিটে নতুন হয়েছে রেস্টুরেন্টটা। এই দশ বছর বিরিয়ানি ছুঁয়ে দেখেনি রিশান।
রিশান ভেতরে ঢুকে বললো, “একবার ওনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
-“জিনিয়া ম্যাডাম তো আজ আসেননি “
-” ঠিকানা পাওয়া যাবে ওঁর ?” ঠোঁট চাটে রিশান।

সন্ধের দিকে ফ্ল্যাটের বেল বাজাতেই দরজা খোলে জিনিয়া। সেই জিনিয়া। রিশানের মনটা এতদিন বাদে এত খুশি হয়ে ওঠে যে মুখে কোনো কথা ফোটে না। জিনিয়ার ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। ছিমছাম সুন্দর সাজানো।

-“তোমার হাজব্যান্ড?”
-“আমি তো বিয়ে করিনি।“
রিশান অবাক হয়ে তাকায়।
-“আমার হাতের বিরিয়ানি ওদের পছন্দ হয়নি তাই” জিনিয়া মুচকি হাসে। “কিন্তু আমি জানতাম তুমি আমাকে ঠিক খুঁজে পাবে।”

“আচ্ছা এইটা তবে তোমাদের ‘উমদা বিরিয়ানি’ সৃষ্টির রহস্য।” ঋক বলে ওঠে।
-“হ্যাঁ, গল্পটা কেমন ? পাঠকদের তো আর নিজেদের নাম দিয়ে বলা যাবে না। তাই দুটো অন্য নাম ব্যবহার করেছি।”
-“ব্রিলিয়ান্ট দাদাই , খুব সুন্দর দিদুন আর তোমার এই প্রেমের গল্প।”
-“কিন্তু বোকা বনে গেছি সেটা অনেক পরে বুঝেছি। তোর দিদুন সাইকোলজির স্টুডেন্ট ছিল।“
-“মানে?”
-“আমার ওপরে প্যাভলভের থিয়োরি প্রয়োগ করেছিল। বিরিয়ানির প্রতি দুর্বলতা আর প্রেম ব্রেন দুটো জিনিসকে আলাদা করতে পারেনি।”
-“যাই হোক বোকারাই ভালোবাসে। আর ভালোবেসে বোকা হওয়াটাও কম সুখের নয়।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

9 thoughts on “বিরিয়ানি

  1. তোমার ছোটগল্প “বিরিয়ানি” মন দিয়ে পড়লাম। আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া :- নিখুঁত ছোটগল্প।
    এবার আসছি বিশদ আলোচনায়। প্লট অভিনব। থ্রিলারের মতো টানটান সাসপেন্স বজায় থেকেছে শেষ পর্যন্ত! শেষটা বুঝতে আমাকে দু’বার পড়তে হয়েছে, একথা স্বীকার করছি। তবে, নবীন প্রজন্ম… মনে হয়, একবার পড়েই বুঝবে। গল্পের নায়িকার দশ বছর নিশ্চিন্ত থাকার ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও লেখার ম্যাজিকের দৌলতে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে পাঠক। এমনই ভালো ভালো গল্প লিখে চলো দ্বৈতা। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

  2. পাবলভ যদি বিরিয়ানী বানাত তাহলে ওর বিরিয়ানী খেয়ে খাদকের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার নাম একটাই হতো ইশক ! ইশক! ইশক!। এই গল্পটি পড়ে যদি পাঠকের বেশক তাই হতে পারে।

  3. খুব ভাল লাগল। আপনার গল্পের বেশ একটা signature tone আছে। ধরে ফেলা যায় এটা আপনার গল্প। যদিও প্লটের বিভিন্নতার দিকে যে আপনার সজ্ঞান নজর রয়েছে সেও বোঝা যায় রকমারি স্বাদের গল্প এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিসমাপ্তির ধরন গুলি দেখে। একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যদিও। আচ্ছা না, সে কথা আজ না। আপনার গল্প আরও কিছু পড়ে নিই আগে, তারপর বলা যাবে…

  4. ভাল লাগল। আপনার গল্পের বেশ একটা নিজস্বতা আছে, কিছুটা পড়লেই বোঝা যায় বেশ। তবে প্লটের নতুনত্বের দিকেও আপনার সজাগ দৃষ্টি। তাই নিত্য নতুন প্লট এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিসমাপ্তি সহ গল্প পেয়ে যান আপনার পাঠকেরা। তবে যে কটি পড়লাম, সেই গল্পগুলোর মধ্যে কি যেন একটা মিলও আছে। আপনার আরও কিছু গল্প পড়ে নিই, তারপর বুঝব সেই মিলটা কি, বা সত্যিই আছে কি না।

  5. সুৃন্দর গল্প। মিষ্টি ও নিটোল প্রেমের একটি গল্প। প্যাভলভের থিওরিটা যে সত্যি কাজের তা রিশান আর জিনিয়ার প্রেমের ক্ষেত্রে আরও একবার প্রমাণিত। শেষের রহস্যটাও কম নয়।

Leave a Reply to Semanti Mukhopadhyay Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *