তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
দুপুরে–চণ্ডী গাছটার কাছে জল দিতে এসে এক মুহূর্ত থামলেন রণবীর, শীত প্রায় আগুয়ান, অথচ গাছটায় ফুল ধরব–ধরব করেও এখনও ধরছে না৷ ঘন মেরুন রঙের অজস্র ছোটো ছেটো ফুল হয় গাছটায়৷ মাছির আকারের ছোটো–ছোটো গোলাপ৷ যখন গাছটা ভরে যায় ফুলে, মনে হয় মেরুন রঙের একটা লেডিজ ছাতাই যেন বা৷ তার গোড়ায় জল দিতে গিয়ে খেয়াল করলেন, কাল বিকেলে জল দিয়েছিলেন অথচ এখনও গাছটার গোড়া ভিজে৷
আসলে এ–গাছে বেশি জল দিতে নেই, হয়তো কাল বিকেলে জল দেওয়া বেশি হয়ে গিয়েছিল, তাই এমনটা৷ আজ একটু কম জল দিতে হবে মাছি–গোলাপটায়৷
মাছি–গোলাপ পেরিয়ে রণবীর দাঁড়ালেন অ্যালামন্ডা গাছটার গোড়ায়৷ টবের গাছ, অথচ টব ছাড়িয়ে ডাঁটালো গাছটা এখন মস্ত হয়ে লতিয়ে লতিয়ে উঠে পড়েছে সিঁড়ির ছাদে৷ গাঢ় হলুদ রঙের বড়ো বড়ো ফুলে ভরে থাকে সারাক্ষণ৷ তার গোড়ায় একটু বেশি সময় ধরে জল দিলেন আজ৷ এত বড়ো গাছ, সেই তুলনায় টবটা মাঝারি৷ কিন্তু গাছটার তাতে হেলদোল নেই৷ বড়ো হচ্ছে তো হচ্ছেই৷
অ্যালামন্ডা পেরিয়ে এবার পৌঁছোলেন ছোটো সাইকাসটার কাছে৷ দুটো সাইকাস করেছে বিশাখা, তার মধ্যে যেটি বড়ো সেটি রেখেছে একেবারে কোণের দিকে৷ সবার থেকে আলাদা করে৷ তার গরিমাই আলাদা৷
রণবীর শুনেছেন সাইকাসের নাকি খুব দাম৷ বিশাখার অনুমানমতো বড়ো সাইকাসটার দাম এখন হাজার দশেক, ছোটোটার দাম ছয়–সাত হাজার৷ সেই ছোটোটার গোড়ায় শুরু করলেন জল দেওয়া৷
বিশাখা অনেকগুলো বনসাই তৈরি করে ফেলেছে নানা কসরত করে৷ কেউ বলেছে, ‘বনসাই কোরো না, গাছেদের কষ্ট হয়৷’ কথাগুলো বিশাখা না–ভাবে তা নয়৷ রণবীরকে বলেওছে, ‘দ্যাখো, কী সুন্দর দেখতে হয়েছে বনসাইগুলো৷ কিন্তু এদের কি সত্যিই কষ্ট হয়’৷ রণবীর খুঁটিয়ে দেখেছেন টবগুলো৷ একটা টবে অশত্থ গাছের বনসাই৷ ছোট্ট গাছ, তার কাণ্ড থেকে অসংখ্য ঝুরি বেয়ে নেমে এসেছে নীচে৷ তাতে গাছটার চেহারায় এক অপরূপ সৌন্দর্য৷ তেমনই আর একটা বনসাই করেছে সেটি দেখতে অনেকটা শিমুল গাছের মতো, তারও কাণ্ড থেকে অসংখ্য ঝুরি৷ সেই গাছগুলোকে বিশাখা বড়ো করেছে কত কষ্ট করে, নিয়মিত গোড়ায় জল দিয়েছে, নিড়েন দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলে দিয়েছে তাদের গোড়ায় জন্মানো ঘাস৷ বনের গাছকে কি কেউ এত যত্ন করে বাঁচানোর চেষ্টা করে
বনসাইয়ের সারি পেরিয়ে অনেকগুলো টবে শুধু ক্যাকটাস, তাদের এক–একজনের এক–এক রূপ৷ একটা ক্যাকটাসের সবুজ কাণ্ডের ভিতর থেকে একটা সরু ডাঁটি, তার ডগায় কী সুন্দর দেখতে লাল টকটকে ফুল৷ ক্যাকটাসগুলো অহংকারই অন্য রকম৷ তাদের পাশে কতরকম পাতাবাহারের সমাহার তার বৃক্ষসংসারে তাদের পাতায় কত না কারুকাজ কত রকমের রং৷ কোনও কোনওটা গাছের দাম নাকি এখন অনেক৷ দাম নিয়ে অবশ্য বিশাখার তেমন মাথাব্যথা নেই৷ কিন্তু গাছগুলো বেশ দামি ভাবলে তার বেশ অহংকার হয়৷ ছোট্ট একটা চারাগাছ জল দিয়ে সার দিয়ে সে বাঁচিয়ে রেখেছে, এমন দামি করে তুলেছে তিলতিল করে৷ রণবীরের হাতে এই মুহূর্তে একটি লম্বা রবারের নল, তার একপ্রান্ত লাগানো ছাদের জলাধারের ট্যাপে, সেই ট্যাপ অন করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা নল বেয়ে জল চলে আসে নলের এ–প্রান্তে৷ সেই প্রান্তটি ধরা রয়েছে রণবীরের হাতে, নলের মুখ দিয়ে জলের ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে ছাদভর্তি টব৷
বিশাখা নয়–নয় করেও পঞ্চান্ন–ষাটটি টব করেছে ছাদে৷ প্রায় চোদ্দো–পনেরো বছর ধরে সে–ই বালতি করে করে জল দিয়েছে প্রতিটি টবে, তাতে এই বয়সে যা হয় ঠিক সেইটেই হয়েছে বিশাখার৷ কোমরের ব্যথা নিয়ে এখন জেরবার৷ রণবীর বহুদিন ধরে বলেছিলেন এভাবে বারবার উঁচু–নিচু হয়ে জল না দিতে, কিন্তু বিশাখা একটু একগুঁয়ে স্বভাবের, কথা না–শোনায়––
অতঃপর রণবীর কিনে এনেছেন এই রবারের নলটি, সেই নল দিয়ে টবগুলিতে জল দেওয়ার দায়িত্ব এখন তাঁরই৷
রণবীরের এতদিন তেমন বৃক্ষপ্রীতি ছিল না, ছিল বিশাখার৷ এখান থেকে ওখান থেকে মাঝেমধ্যে কিনে আনে টবগুলো, তারপর চলে তাদের নিত্য পরিচর্যা৷ একে–একে এনেছে অনেকগুলো ক্যাকটাস, নানা জাতের পাতাবাহার৷ ভোরে উঠে প্রতিদিন তাদের গোড়ায় জল ঢালা, ঘাস হলে তুলে ফেলা, কখনও নিড়েন দিয়ে গোড়া খুঁচিয়ে সার দেওযা––সারাদিনে গাছগুলোর সঙ্গে বিশাখার ছিল এমন অনেক অন্তরঙ্গতা৷
এতদিন রণবীরের ছিল পাহাড়প্রীতি, এখন সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারও ভিতরে এখন যথেষ্ট বৃক্ষপ্রেম৷
ছোটো সাইকাসে জল দেওয়া শেষ করে রণবীর এবার ঝুঁকে পড়লেন ছাতা– ঝাউগাছটার গোড়ায়. এই ঝাউটার পাতাগুলো যেন সবুজ ভেলভেটের মতো৷ ঠিক সবুজ নয়, বটল–গ্রিন রঙের পাতা৷ একটা লেডিজ ছাতার আকারে ছড়িয়ে থাকে চারপাশে৷ দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই তার রং৷
ছোটো সাইকাসটার পাশেই পর পর পাঁচটা টগর৷ নানা জাতের টগর, ফুলও হয় নানা আকারের৷ যখন একসঙ্গে ফোটে, মনে হয় সাদা বরফ দিয়ে ঢ়েকে ফেলেছে গাছের পাতাগুলো৷ টগরগুলো বিশাখার পুজোর চাহিদা মেটায়৷ তার ঠাকুরঘরে তেত্রিশ কোটির মধ্যে অন্তত তেত্রিশটা ঠাকুরের বসবাস৷ তাদের প্রত্যেকের কাছে একাধিক করে ফুল দিতে হয় রোজ৷ সেই কারণেই বিশাখার সংসারে টগর, জবা আর রঙ্গনের আধিক্য৷ তা ছাড়া বর্ষায় দোপাটি, শীতে গাঁদা৷
এ বছরও শীত আগুয়ান হতে গাঁদার সঙ্গে সিজন ফ্লাওয়ারের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, কিন্তু চারা পোতা হবে হিমালয় থেকে ফেরার পর৷ গাঁদা পুজোর জন্য, সিজন ফ্লাওয়ার বাগানের শোভাবর্ধনের কারণে৷ এখন হিমালয় ভ্রমণের প্রস্তুতির কারণে সবই স্থগিত রেখেছেন তাঁরা৷ কাল বাদে পরশু কুমায়ুন ভ্রমণে বেরোবেন, প্রায় দু–সপ্তাহ ধরে ঘুরবেন নৈনিতাল, আলমোড়া, রানিখেত, কৌশানি––আরও অনেকগুলো ছোটো বড়ো পাহাড়ি স্পটে ৷
কিন্তু এত বড়ো শূন্য উদ্যান, তার কারণে বছর–বছর তাঁদের বেড়াতে যাওয়ার সময়টায় হয় মুশকিল৷ কলকাতায় তাদের কত পিছুটান৷ এত বড়ো বাড়ি, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে যেতে হয় কোনও নিরাপত্তা সংস্থাকে৷ দিনে একজন, রাতে একজন দেখভাল করে বাড়ির চারপাশ৷
প্রতিবার বাইরে যাওয়ার আগে বিশাখার নিজের ঘরকন্নার সংসার নিয়ে যত না চিন্তা, তার চেয়েও ঢ়ের দুশ্চিন্তা তার বৃক্ষসংসার নিয়ে৷ বাড়ির প্রধান গেটগুলোয় তালা দিয়ে দুজন সিকিউরিটি গার্ডের হাতে বাড়ির নিরাপত্তা সঁপে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাতে বাড়ির সুরক্ষা বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে, কিন্তু সে তো থাকবে তাদের বারান্দায়৷ ছাদের সংসার রক্ষা করতে হলে নিতে হয় অন্য ব্যবস্থা৷
তার বৃক্ষসংসার নিয়ে প্রতিবারই ভারী চিন্তায় পড়ে বিশাখা৷ আগের কয়েকবার তার এক আত্মীয়–যুবকের হাতে চাবি দিয়ে গিয়েছিল, সে প্রতিদিন সময় করে এসে জল দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল তার সন্তানসন্ততিকে৷ এবার সে কলকাতায় নেই বলেই এত সব ঝামেলা
এবার ঠিক করেছে সমস্ত টব মুনিশ লাগিয়ে ছাদ থেকে নীচে নামিয়ে রেখে যাবে বাড়ির পিছনের একচিলতে জায়গাটায়৷ বাড়ির কাজের মেয়ে বন্দনাকে এক্সড্রা টাকা দিয়ে যাবে যাতে প্রতিদিন নিয়ম করে জল দেয় গাছগুলোকে৷ তাকে পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে, টবের গাছ কিন্তু খুব অভিমানী৷ কাডকে জল কম দিলে সে পাতাগুলো কুঁকড়ে রেখে দুঃখ–দুঃখ মুখ করে থাকবে৷
পরশু রওনা হওয়া, তাই রণবীর আজ সব ক–টা টবে একটু বেশি–বেশ জল দিয়ে রাখছেন যাতে গাছগুলোর শরীর দু–তিনদিন তাজা থাকে৷ কালও দেবেন এরকমটাই৷ বিশাখা সেরকমই বলেছে আজ৷ হয়তো এটা বিশাখার মনের সান্ত্বনা, তবু বেড়াতে যাওয়ার সময় গাছগুলোর জন্য বিশাখার খুব ভাবনা হয় প্রতি বছর৷
টগরগুলো শেষ করে রণবীর দাঁড়ালেন পাশাপাশি রাখা দুটো বোগনভেলিয়া গাছের কাছে৷ একটায় ফুল হয় ধবধবে সাদা, অন্যটায় ঘন মেরুন৷ বর্ষার পর থেকে দুটো গাছই দিব্যি পাতা ছেড়ে দিয়েছে চারদিকে৷ বোগোনভেলিয়ার পর রণবীর চলে এলেন সারি দিয়ে অপেক্ষমান জবাগাছগুলোর কাছে৷ কত রকম জবা যে করেছে বিশাখা চারটে লাল জবা, লালেরও আবার রকমফের আছে৷ গাঢ় লাল, মেরুন লাল, হালকা লাল৷ তাদের পাশে দুটো সাদা৷ তাদের পরে একটা ফিকে–কমলা আর একটা গাঢ় কমলা৷ সবশেষে একটা গোলাপি৷ এরাই তো সারা বছর ফুটে থাকে বাগান আলো করে৷ প্রতিদিন ভোরে ডঠেই তাদের বেশ কয়েকটা তুলে নেবে বিশাখা, তার একটু পরেই তাদের স্থান হয় মায়ের পায়ে৷
জবাগাছগুলো কত মেহনতে বিশাখা সংগ্রহ করেছে এখান ওখান থেকে৷ কারও বাড়ি গিয়ে নতুন কোনও জবা দেখলেই স্থান–কাল–পাত্র ভুলে বলে ফেলে, পাওয়া যায় এর ডাল?
সেই ডাল এখন সব ডাঁটো চেহারার গাছ৷
জল দেওয়া শেষ হতে অন্তত মিনিট চল্লিশ৷ তারপর রণবীর কিছুক্ষণ গাছগুলোর চারপাশে ঘুরে দেখেন তাদের ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলেন কি না না কি কেউ অভিমান করে বলছে, ‘কীরকম জল দিলে আমার তেষ্টা তো মেটেনি’
রণবীরের এই নতুন ভূমিকায় সাব্যস্ত হওয়ার পর তাঁরও কী এক অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছে গাছগুলোর উপর৷ প্রতিটি গাছের প্রতিটি পাতাই যেন চেনা হয়ে গেছে একটু একটু করে৷ একদিন ছাদে এসে জল দিতে দেরি হলেই মনে হয় গাছগুলো অবুঝ চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে৷ বলছে, ‘কী হল, সূর্যদেব তো কখন অস্ত গেছেন, এতক্ষণে তোমার সময় হল আমাদের কাছে আসার’ রণবীরের সত্যিই তখন দংশন হতে থাকে বিবেকের কোনও কোণে৷ তিনি দ্রুত রবারের নলটি লাগাতে লাগাতে বলছেন, ভেরি ভেরি ভেরি স্যরি, মাই ফ্রেন্ডস৷
তারপর দ্রুত হাতে দিতে শুরু করেন জল৷
আজ কিন্তু জল দিতে দিতে বললেন, বন্ধুরা, আমরা কিন্তু ক–দিন থাকব না৷ তোমরা সব ভালো হয়ে থাকবে৷ দুষ্টুমি করবে না তোমাদের বন্দনামাসি রোজ আসবে জল দিতে৷
পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া প্রধানত রণবীরের জন্যই৷ কোথাও বেড়াতে যাওয়ার গল্প শুরু হলেই রণবীর প্রথমেই বলবেন, হিমালয়ের এখনও অনেকটাই বাকি৷
দৈর্ঘ্যে–প্রস্থে হিমালয় এতটাই বিশাল যে, সারা জীবন ঘুরলেও হিমালয় দেখা ফুরোবে না কখনও৷ ফলে কোনও বছর হিমাচল হল তো পরের বছর নেপাল, তার পরের বছর গাড়োয়াল তো তার পরের বছর ভুটান৷ কখনও মনে পড়ে, ‘যাহ্, গাড়োয়লের চার ধামের দু ধাম হল, কিন্তু আরও দু ধাম কবে হবে৷
বিপাশার ভুরুতে কোঁচ, বলে, এখন যা বয়স, আর ভুজবাসা যাওয়ার স্ট্যামিনা নেই
রণবীর হেসে বলেন, ধ্যুৎ, আশি বছরের লোকও ঘুরে আসছে, আর তুমি যেতে পারবে না লোকে যায় মনের জোরে৷ ঠিক আছে এ–বছর কুমায়ুন যাই৷ ওটাও তো এখনও বাকি আছে৷
রণবীরের উৎসাহে প্রতি বছর হিমালয় ঘুরতে গিয়ে ভারতের সমতলের সৌন্দর্য আর আবিষ্কার করা হয়ে ওঠে না ওদের৷ এ বছর বিশাখা বলেছিল সাউথ ইন্ডিয়া যেতে৷ রণবীরের ইচ্ছে ছিল গঙ্গোত্রী–যমুনোত্রী৷ বলেছিলেন, ‘দরকার হলে তোমাকে ডান্ডি করে নিয়ে যাব’৷ তখনই বন্যাটন্যা হয়ে গাড়োয়ল জলমগ্ণ হওয়ায় রণবীর গম্ভীরকণ্ঠে রায় দেন, তা হলে কুমায়ুন৷
কুমায়ুন যাওয়া অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমের৷ বৈচিত্র্যও যথেষ্ট৷ বাড়ির মেয়েরা সারা বছর সংসার নিয়ে ব্যস্ত, বেড়াতে পারলে তাদের আনন্দ ধরে না৷ আনন্দে থইথই করে নাচছিল বিশাখাও৷
দেখতে দেখতে এসে গেল সেই দিন৷ রাত আটটায় ট্রেন৷ সন্ধে–সন্ধে বেরোতে হবে ট্যাক্সি ধরে৷ তার আগে টবগুলো নামানো এক বড়ো কাজ৷ সকালে ডঠেই রণবীর এদিকে ওদিকে খোঁজ করে পেয়ে গেলেন দুজন৷ কিন্তু সকালে তারা ব্যস্ত থাকে, বলল, আসবে দুপুরের পর৷ দুপুর থেকেই বিশাখা তাড়া দিতে থাকে, কই, তারা তো এখনও এল না তুমি শিগগির দ্যাখো৷ টব না নামালে তো যাওয়াই হবে না
রণবীর আবার তাদের তাগাদা দিতে তাদের আসতে আসতে বিকেল৷ বিশাখার টেনসন শুরু হয়ে গেল বলল, আমরা রওনা দেওয়ার আগে নামাতে পারবে তো সব?
তারা অবশ্য ঝপঝপ করে নামাতে শুরু করে৷ একটা একটা করে টব নামাতে ঘন্টা দুই পার৷ সব ক–টা টব ছাদ থেকে নীচে নামিয়ে আনার পর বিশাখা বন্দনাকে ডেকে আবার বলে গেলেন, ঠিকমতো জল দিও কিন্তু৷
টানা বারো দিন ধরে তাঁরা ঘুরলেন কুমায়ুনের নানা প্রান্তে৷ পার হয়ে গেলেন কত যে পাহাড়, কত পাহাড়ি লোকালয়৷ অজস্র ছোটো–বড়ো গাড়ি পাওয়া যায় ট্যুরিস্টদের ভ্রমণসাধ মেটাতে৷ কত পাহাড়ি দৃশ্যপটের ভিতর হই হই করে ঘুরে এলেন ওরা৷ কিন্তু যেখানেই যায়, যত দূরেই যায়, বিশাখার মনের ভিতর হাপিসটিপিস৷ একবার মনে পড়ে রকমারকম জবাগাছগুলোর কথা৷ একবার ক্যাকটাসগুলোর কথা৷ একবার বনসাইদের কথা. একবার সাইকাসদের কথা৷
রণবীরেরও আজকাল ভাবনা হয় গাছগুলো নিয়ে৷ টবে জল দেওয়ার চাকরিটা পাওয়ার পর এখন উপলব্ধি করতে পারেন তার এমন বড়ো করে তোলা গাছসাম্রাজ্য ফেলে রেখে বেড়াতে যাওয়া কী যে টেনসনের বিশাখার কাছে৷
তবু রণবীর হেসে বলেন, গাছগুলোর কথা ভাববে ঠিকই, কিন্তু আগে দৃশ্যগুলো তো দেখবে
নতুন নতুন পাহাড়ি দৃশ্য দেখে বিশাখা যেমন আনন্দে উদ্বেল হচ্ছে, একই সঙ্গে মগজে চলকে ডঠছে তার ফেলে আসা গাছগুলোর কথা৷ সিকিউরিটির ছেলেটা ঠিকঠাক পাহারা দিচ্ছে তো বন্দনা নিয়ম করে জল দিচ্ছে তো? সব গাছ ঠিকঠিক জল পাচ্ছে তো? না কি বিশাখারা ঘরে নেই বলে ফাঁকি দিচ্ছে এন্তার একবার মনে হল গার্ড–ছেলেটির কাছে কি মোবাইল আছে, থাকলে মোবাইলের নম্বরটা নিয়ে এলে হত৷ এক পাহাড়ি শহর থেকে আর এক পাহাড়ি শহরে পাড়ি দেয়, আর শঙ্কিত হয়ে বারবার ভাবে গাছগুলো বেঁচে থাকলে হয় তার এত সাধের গাছ৷
রণবীর তাকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে, সব ঠিকই আছে, তোমার এত চিন্তা করতে হবে না তা হলে ভ্রমণের আনন্দ নিরানন্দ হয়ে যাবে৷
বারোটা দিন যে বিশাখার কী করে কেটেছে তা সে–ই জানে ট্যুর সেরে বাড়ি ফেরার পথে বিশাখা ভাবল সে যত না ভ্রমণের বৈচিত্র্য নিয়ে ভেবেছে, তার চেয়েও বেশি চিন্তিত থেকেছে তার গাছগুলোর বেঁচে থাকা নিয়ে৷ রণবীর তাকে কখনও খোঁচা দেয়, ইস, নিজের শরীর সম্পর্কে এরকম সচেতন হলে সেটা আরও ভালো হত৷
হাওড়া থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে বিশাখার মনে হচ্ছিল তাদের বাড়িটা স্টেশন থেকে অনেক দূর৷ কতক্ষণে তার গাছগুলো দেখবে সেই চিন্তায় ছটফট করছিল ট্যাক্সিতে বসে৷ একসময় ট্যাক্সিওয়ালা ব্রেক কষল বাড়ির গেটের সামনে৷ বিশাখা হুড়মুড় করে নেমে সিকিউরিটির ছেলেটাকে দেখে একটু নিশ্চিন্ত, জিজ্ঞাসা করে, কি, সব ঠিক আছে তো?
––হ্যাঁ, ম্যাডাম৷ গার্ড ছেলেটি স্মার্ট হওয়ার ভঙ্গি করে৷
গেটের ভিতর ঢুকেই বিশাখা প্রথমেই নজর ফেলল গাছগুলোর উপর, একে–একে সবার চারপাশে ঘুরেঘেরে দেখে তার ভিতর প্রবল উল্লাস, রণবীরকে বলল, বুঝলে, সব গাছ ঠিকঠাক আছে৷
রণবীরও দেখছিলেন গাছগুলোর চেহারা, নিজেও হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন, যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল বললেন, ডফ্, এদের একজন কেউ মারা গেলে তুমি বোধহয় কাঁদতে বসতে৷ এখন দ্যাখো, তোমার ঘরবাড়ি সব ঠিকঠাক আছে কি না
গাছগুলোর স্বাস্থ্যের খবর ও. কে. করে বিশাখার এতক্ষণে টনক নড়ে, বাড়ির জিনিসপত্র সব ঠিক আছে তো কিন্তু না, সব ঠিকই আছে৷
পরদিন আবার মুনিশ ধরে অনলেন রণবীর৷ টবগুলো আবার যথাস্থানে রাখতে রণবীর ছাদে গেলেন মুনিশদের বুঝিয়ে দিতে৷ পিছনে পিছনে বিশাখাও৷ কিন্তু ছাদে গিয়েই হঠাৎ বিশাখার বুকের ভিতর বোমা–বিস্ফোরণ৷ চিৎকার করে রণবীরকে বলল, এ কি!
রণবীর মুনিশদের বোঝাচ্ছিল কোনটা কোথায় রাখতে হবে৷ বিশাখরা চিৎকার শুনে ছুটে এলেন, কী হয়েছে?
––ওই দ্যাখো, বলে বিশাখা টাল হারিয়ে বসে পড়ল ছাদের ডপর৷
সেদিকে তাকিয়ে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল রণবীরের৷ তার চোখদুটোও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না দৃশ্যটা৷
বিস্ফারিত চোখে দেখছিলেন, বেড়াতে যাওয়ার দিন সব টবই নামানো হয়েছিল, কিন্তু ছাদের এক কোণে রাখা দামি সাইকাসটিই নামনো হয়নি একেবারে কোণের দিকে আলাদা করে রাখা থাকে তো৷
বিশাখার দু–চোখে তখন জল, বলল, তুমি একবার দেখে নাওনি সব গাছ নামানো হয়েছে কি না৷
রণবীর স্তব্ধ হয়ে আছেন সেই দৃশ্যে৷ তখন গোছগাছ করার তাড়া থাকায় মুনিশগুলোকে বারাবর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সব গাছ নামিয়েছো তো?’ তারা হ্যাঁ বলতে আর উপরে যাননি রণবীর৷ তখন সময়ও ছিল না তাদের৷
আর সেই দায়িত্বহীনতার কারণে ছাদের এককোণে শুকনো কাঠ হয়ে রয়েছে অত বড়ো সাইকাসটা৷ কাঠ নয়, তার শরীর ভরে একরাশ অভিমান৷
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
গাছদের নিয়ে গল্প পড়তে খুব ভালো লাগে, এই গল্পটি আমাকে অনেককিছুই মনে পড়িয়ে দিল।যাঁরা গাছ ভালোবাসেন তাঁরা ঠিক এভাবেই ভাবেন, বড় বাস্তব।