অনুষ্টুপ শেঠ
এই দোকানটা কাছে হয়। এদের স্টকটাও অনেক ভালো, সব মোটামুটি পাওয়া যায়। কিন্তু গাড়ি চলে একটু বেশি। তার চেয়েও বড় সমস্যা হল, মোড়ের এই পাশটায়, ঘোষালবাড়ির রকে ওবাড়ির ছেলেরা আর তাদের বন্ধুরা আড্ডা মারে। ছেলেগুলোর সামনে দিয়ে যেতে অস্বস্তি হয় বিন্নির। এই বড় হয়ে ওঠার বয়সটায় সবেতেই অস্বস্তি হয়, তেমন না। তার চেয়ে অনেক বেশি, বিচ্ছিরি কিছু। ছেলেগুলো কেমন করে যেন তাকায়, চটুল হিন্দি গান গেয়ে ওঠে। আজও ছিল, তবে শান্তামাসির দোকানে চা খেতে ব্যস্ত ছিল বলে ওকে খেয়াল করেনি। হনহন করে জায়গাটা পার হয়ে গেল বিন্নি। জগত্তারিণী মেডিক্যাল হলে ঢুকতেই পাশের কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো রানাদার ভ্রূ কুঁচকে গেল।
“একা এলি?”
বিন্নি ছোট্টো করে উত্তর দিল, “মায়ের জ্বর।”
“ফোন করে দিসনি কেন?”
রানাদার গলায় রাগ। বিন্নি অসহায়ের মতো বলে, “লাগছিল না তো! জ্বর বেড়ে যাচ্ছে ওদিকে…”
চার পুরুষের পুরোনো পাড়ায় বাস করার এই এক সুবিধে, বা অসুবিধে, যাই বলো। খুচখাচ ফ্ল্যাটবাড়ি গজালেও, পুরোনো বাড়িগুলো আজও বেশিরভাগই রয়েছে। একতলা বা দোতলা, কদাচিৎ তিনতলা ওঠা সেসব চৌকো, হলুদ বা মেটে লাল বা সাদা রং করা বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের পরস্পরকে চেনা জানা খবরদারি করাটাও রয়ে গেছে তাই।
এই দুপুরেও ভিড়ে ভিড়াক্কার। তবে বিন্নিকে বেশি দাঁড়াতে হয় না। তপনকাকু দেখতে পেয়েই ওর হাত থেকে কাগজ নিয়ে তাড়াতাড়ি করে দিয়ে দেয়। বিন্নি ওষুধ আর টাকা বুঝে নিয়ে ব্যাগে ভরতে ভরতে, কাউন্টারের টপ ঠেলে রানাদা বেরিয়ে আসে।
“চ।”
যায় ওরা। বিন্নি একা এলে, রানাদা হোক, বিশুকাকু হোক, কাউকে না কাউকে তপনকাকু সঙ্গে করে এগিয়ে দিতে বলেন।
মোড় পেরোনোর সময় রক থেকে সুর করে ভেসে এল,”ডিম পাউরুটি… ডিম পাউরুটি… ডিম পাউরুটি…”
রানার চোয়াল একটু শক্ত হল খালি।
সেই সঙ্গে করে বাড়ির দরজা অবধি দিয়ে গেল। গলির মধ্যে আর কী দরকার বলো তো, ওটুকু বিন্নি নিজেই পারে।
শুনলে তো! দরজায় দাঁড়িয়েও বকতে লাগল!
“গাঁ গাঁ করে বাইক চলে ও রাস্তায় তবু সেই একা যাবে। আপনারই বা কী আক্কেল বড়দি…”
দেবযানীর জ্বরটা খুব বেড়েছিল, আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিল সে। শুনতে পায়নি নির্ঘাৎ। নইলে ঠিক হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিত, ‘করতে শিখুক রে রানা। ওকে তো করতেই হবে…আমি যেতে না পারলে কে করবে বল…”
রানাদা, বা বিশুকাকু, বা যেই হোক যে বিন্নিকে পৌঁছোতে আসত, এর পর বলত, “না দিদি, কল না লাগলে একটূ অপেক্ষা করবেন, ওকে পাঠাবেন না…ঘোষালবাড়ির সামনে যত বেপাড়ার ছেলে এসে জড়ো হয় আজকাল…”
এ পাড়ার সবচেয়ে বড়ো বাড়িটা ঘোষালদের। দোতলা, অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো ছিটোনো, কোনায় গোল বারান্দা। ও বাড়ির কাউকে কাকু বা দাদা ডাকেনি কখনও বিন্নি, চেনেই না বেশির ভাগ। কারো সঙ্গেই তেমন মেশে না ওরা।
মা চুপ করে থাকত। উত্তর দিত না।
ওরাও চুপ করে থাকত এর পর। বলতে হয় তাই বলছে। নইলে, বড়দি যে ঘোষাল বাড়ির প্রসঙ্গ এলে আর মুখ খুলবে না, সেটা ওরাও এতদিনে বুঝে গেছে।
মিত্র বাড়ির বড় মেয়ে দেবযানীর সঙ্গে ঘোষালদের মেজো তরফের একমাত্র ছেলে নিরুপমের বিয়ের কথা হয়েছিল একদা। বয়সে এবং অবস্থায় বেশ একটু তফাৎ থাকলেও, দেবযানী নাকি ঘোষালবাড়ির জ্যোতিষীর মতে বেজায় সুলক্ষণা ছিল। দেনপাওনাও সেই লক্ষণের লোভে ছেড়ে দিয়েছিল ওরা প্রায় সব। বলা বাহুল্য, দেবযানীর বাবা-মা এই প্রস্তাবে হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন।
নিরুপমের নানান ঠেকের মধ্যে একটা ছিল এক কলেজপড়ুয়া-ভেকধারী হাফগেরস্থ মেয়ের ফ্ল্যাটে। সেইখানে, বিয়ের ঠিক দিন কুড়ি আগে সে মাতাল অবস্থায় কীসব হল্লা-হাঙ্গামা করে হাজতে ঢুকে বসল। বড়লোকের ছেলের সাধারণত এরকম বেহাল হয় না, কিন্তু কপালদোষে হাঙ্গামাটা যার সঙ্গে করেছিল সে আরও বেশি বড়লোক পরিবারের ছেলে ছিল শুধু তাই নয়, তার রাজনৈতিক যোগাযোগটাও ছিল ঢের বেশি।
বিয়ে পিছিয়ে দেবার কথা হয়েছিল। এইখানে, খুব আশ্চর্যভাবে, দেবযানী বেঁকে বসল। নরম, ভীতু, মুখচোরা মেয়ের বেঁকে বসা যে কী জিনিস, সে যে জানে সে জানে। অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে, মেয়ের দিক থেকে আরও বড় কোনো অঘটনের ভয়ে তার বাবা-মা শেষ অবধি বিয়েটা ক্যান্সেল করায় মত দিল। তবে একটা শর্তে।
দেবযানীর বিয়ে ওই তারিখেই হয়েছিল। পাড়ারই মাধববাবুর এক আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে। সামান্য ঘর, সাধারণ অপুষ্ট ক্ষীণ চেহারার বর। এটাই শর্ত ছিল – যা জুটবে তাই মেনে নিতে হবে। এই মেয়েকে আর বাবা-মা ঘরে রাখবেন না।
দেবযানী মেনেই নিয়েছিল। অতীনের সঙ্গে তার সাত বছরের জীবন, সুখে দুঃখে মন্দ কাটেনি। বিন্নি যখন পাঁচ, অতীনের চাকরি গেল। এক বছর জমা ভেঙে চলেছিল। তারপর এক শান্ত মাঘের সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরের ঘরে এসে দেবযানী দেখল দরজা হাট করে খোলা।
ওদের বাসা থেকে গঙ্গা অনেকদূর ছিল। ঐ ভোররাত্রে, অতীন নিশ্চয়ই পায়ে হেঁটেই গেছিল। দেবযানীর অনেকবার মনে হয়েছে, একটা মানুষ, সে নিশ্চয় প্রকৃতিস্থ ছিল না তখন, একা একা হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, যাচ্ছে, হাতে কিচ্ছু নেই, ঘাটে ডুব দিয়ে উঠে পালটাবে কোন জামাকাপড় নেই – কারও কি চোখে পড়ল না, কারও চোখে লাগল না? অত ভোরেও তো কলকাতায় কম লোক জেগে যায় না!
জলে ডুবে মরলে শরীর কেমন ফুলে ওঠে।
তারপর বিন্নিকে নিয়ে এ বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তদ্দিনে বাবা চলে গেছেন, বোন বিয়ে করে সুরাট চলে গেছে। সেখান থেকে সরকারী চাকুরের বৌ তার বোন জানিয়ে দিয়েছিল, তারা কোনো দায় নিতে পারবে না। মায়ের যেটুকু যা ছিল, আর দেবযানীর অস্থায়ী স্টাফের চাকরি হল একটা প্রাইভেট স্কুলে। চলল দেবযানীর সংসার, টালমাটাল। হাড়ভাঙা খাটুনিতে, খেয়ে-না খেয়ে, মায়ের ধিক্কার আর ঘৃণা বহন করে।
এখনো দেবযানীর মা ওর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন না। গত বছর পিছলে পড়ে পা ভেঙে অবধি তিনি অথর্ব, শয্যাগত, সব সেবাযত্ন দেবযানীই করে। তবু।
বিন্নি এখন সামনের দুধের দোকান, রেশন, এরকম রাস্তা পেরিয়ে ওষুধ আনা, ওদিকে রতন কলোনির বাজার থেকে শাক সবজি কিনে আনা, সব পারে। ক্লাস নাইন হল তো! আর কতই বা বাচ্চা বলে আগলে রাখবে দেবযানী। একা হাতে স্কুল, সংসার, রোগীর সেবা সব সেরে আর করবেই বা কত সে। এইসব পাড়ার লোকের ভরসাতেই মেয়েকে ছাড়ে সে। এখানেই তো বিন্নি বড় হল বলতে গেলে। ঘোষালবাড়ির কথা তারও কানে আসে। নেহাৎ নিরুপায় না হলে মেয়েকে ওদিকে যেতে বলে না সে।
বিন্নি মাকে ডেকে তুলে ওষুধ বুঝিয়ে দেয়। দিদার হরলিক্স করে দেয়, গায়ে চাদর চাপা দেয়, তক্তপোশের নিচে ধূপ জ্বালে। তারপর বইখাতা বার করে পড়তে বসে যায় নিজে নিজে।
সন্ধের মত মন খারাপ লাগা আর কোনও সময়ে হয় না।
পরের দিন রানাদা মায়ের খোঁজ নিতে এল। দেবযানী তখন স্কুলে। বিন্নি সবে ফিরেছে। এক আশ্চর্য গোলাপী রং তখন আকাশে, বিন্নি সাদা স্কুল ড্রেস সে আলোয় কেমন আরও পুরোনো-পুরোনো দেখাচ্ছিল।
“মায়ের জ্বর অল্প আছে গো রানাদা। সারেনি পুরো। বলল আর একদিন লাগবে।”
“স্কুল গেল?”
“হ্যাঁ, ছুটি নেই বেশি। ওষুধ নিয়ে গেছে।”
রানা জিভ দিয়ে চুক্ করে একটা আওয়াজ করে। আর কী বলবে ভেবে পায় না। চেয়ে চেয়ে দেখে, বিন্নি নিজে নিজে চুলে বিনুনি বেঁধেছে, সিঁথি সোজা হয়নি। ওর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, এই যে স্কুল থেকে এল মেয়েটা, কী খাবে সে এখন। জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না।
বিন্নির খিদে পাচ্ছিল বইকি। কিন্তু রানাদা না গেলে খাওয়া যাবে না, মুড়ি বেশি নেই। কিছুটা তাড়া দিতেই বিন্নি বলে ওঠে, “মায়ের আজ দেরি হবে বলছিল…”
রানা তাতে চলে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু যায় না। গলির মুখ অবধি বেরিয়ে এসে, দাঁড়িয়ে পড়ে আবার। বিন্নি দরজা দিতে পারে না, অপেক্ষা করে।
রানা ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু বিন্নি চোখে চোখ না রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, “আজ রাতের ট্রেন বুঝলি। যে কোম্পানিটার কথা বলছিলাম না? চেন্নাইতে জয়েনিং দিয়েছে। জগত্তারিণীতে এই সব হ্যান্ডওভার করে দিয়ে এলাম। বড়দিকে বলিস…”
বিন্নি পায়ে পায়ে মোড় অবধি এগিয়ে আসে, রানার দিকে তার না ধোওয়া ঘর্মাক্ত মুখটি তুলে ধরে বিভ্রান্ত গলায় বলে, “আজকেই?”
“হ্যাঁ, চিঠিটা আসতে অনেক দেরি হয়েছে রে আসলে… পোস্টে আসে তো…ভাবলাম বড়দিকে একবার বলে আসি…”
বিন্নির মনে একটাই কথা আসে শুধু। এরপর থেকে, মা অসুস্থ হলে এমন, ওকে একা একা ওই মোড় পেরিয়ে, ঘোষালদের রক পেরিয়ে জগত্তারিণী যেতে হবে।
রানা ওর মনের কথাটা বুঝতে পারে হয়তো।
“তুই বাজারের দিকের অমলের দোকান থেকে ওষুধ আনবি। হোক দূর। মনে থাকবে? একা এদিকে যাবি না।“
কথার শেষদিকে গলাটা তীক্ষ্ণ শোনায়।
বিন্নি আলগোছে মাথা নাড়ে। ওর অন্যমনস্ক চোখের দিকে তাকিয়ে রানা কেমন অসহায়ের মতো গলা খাঁকারি দেয়।
দুজনেই বোঝে, তাড়া থাকলে, বা ও দোকানে না পেলে বিন্নি এদিকের মোড়েই যাবে। একাই। যেতে ওকে হবেই। কলেজ পেরিয়ে প্রায় দু’বছর জুতোর সোল খইয়ে এই একটা চাকরির ডাক পেয়েছে রানা। যেতে তো ওকেও হবেই।
দূরে কোথাও শাঁখে ফুঁ পড়ল। সন্ধ্যার মরে আসা আলোয় এক সদ্য বেকারত্ব ঘোচা ছেলে আর এক কিশোরী স্কুলের মেয়ে মুখোমুখি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগলো, কঠিন বাস্তবের শেষেও কোমল কমনীয় বাস্তবের আভাস মন ছুঁয়ে গেল।
এই মহানগরের বাস্তবতাকে, কঠিন বাস্তবের মধ্যে বাস করেও আকাশের গোলাপী আলোয় দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে চাওয়া মধ্যবিত্ত মনকে বড় সুন্দর এঁকেছেন।
ভালো লাগল। এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনা ভীষণ জীবন্ত তাই পড়ে সহজেই ভালো লাগা তৈরি হয়।