বৈদিক পাখি ও মোবাইলের গান
(সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম)
আপনজনের অন্যায়ে বিচার করা দুরহ। মনা খালা নিরীহ মহিলা। আমাদের দেখভাল ছাড়া জগত সংসার নিয়ে তাঁর বিশেষ উদ্বেগ আছে বলে মনে হয়না। সেই গোবেচারা মাঝবয়েসীকে মা কেন টেনে নিয়ে ঘরের দরজা আটকালেন বুঝলাম না। ভাব দেখেই মনে হচ্ছে রিমান্ড চলছে। বাবা-মা’য়ের ঘরে কান পাতার ইচ্ছে-সাহস কোনকালে ছিল না আর ছোট চাচি আসার পর থেকে এসব কাজ তো অসম্ভব। টের পেলে নির্ঘাত দুইশবার নিজের নাম লিখতে দেবে আর পঞ্চাশটা বাজে ট্রান্সলেশন ধরিয়ে দেবে। এই আরেক যন্ত্রণা, পাকু বা আমি যেই অন্যায় করি শাস্তি দু’জনের। তবে এ মুহূর্তে সুযোগ নেয়া যায় কারণ মাঝরাতে পরপর দুটো ঘটনা আমাদের উৎসুক করে তুলেছে। আর ছোটচাচি নিজেই তার সেগুন কাঠের প্রেম পালঙ্কে বসে দাঁড়ি-কোলন-সেমিকোলন ছাড়া হাউমাউ করছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে রাখার শক্তি আছে বলে মনে হয় না। খানিক আগে উঠোনে তড়পাচ্ছিল এখন সেটা খাটে বসে। আমরা গোপনে নাম দিয়েছি ‘প্রেম-পালঙ্ক’। সদ্য বানানো, এখনো তারপিন আর রঙের কাঁচা ঘ্রাণ আছে। ঘরে ঢুকলেই নাকে আসে। বেচারী কত হাঙ্গামা করে বানালেন, ভালো গদি বসালেন। যেই সেই গদি নয় একেবারে উঠোনে বসে ধুনচী তুলো ধুনে নারকেলের ছোবা মিশিয়েছে। খোপ খোপ নীল কাপড় দিয়ে ইয়া বড় বড় সুইয়ের সেলাই। বিনিময়ে মোটা মজুরি নিয়ে ধুনচী বিদায় হবার পর ফলাফল শূন্য। পালঙ্কের মালকিন ঘুমাতে না পেরে সারারাত বসে থাকেন আর দিনের বেলায় ঝিমান। তার এই অকাল অসুস্থতায় আমরা দুই ভাইবোন একটা কৃত্রিম মায়া দেখাতে চেষ্টা করি। তবে মনের খুশির ঝিলিকটা ঠিকই বেড়িয়ে আসে। ইদানিং পড়তে বসানোর যন্ত্রণাটা কমেছে। কিন্তু আজ আমরা ছোট চাচীর জন্য কষ্ট পাচ্ছি।
প্রতিদিনের মতো মনা খালার দুপাশে দু’জনে শুয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক সে সময় উঠোন থেকে শব্দ শুরু হলো। জেগে উঠে জানলা খুলে দেখি, ছোট চাচি উঠোনে পা দাপিয়ে নাচছেন। মেঘের মত চুল খুলে একদিকে হেলে চাঁমকাঠাল গাছটার পাশে লাফাচ্ছেন। মনা খালার কুটুকুট হাসির শব্দে বুঝলাম, ঘটনা স্বপ্ন না। তবে মনা খালা কিন্তু খাট থেকে উঠেনি। আমরা আরও কিছুক্ষন জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। অন্ধকারের ভেতর চাচীকে একটা বড়সড় সারসের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, লাফাতে লাফাতে এক্ষুনি উড়াল দিবে। মা তাকে সামলে ভেতরে এনেই ঢুকলেন আমাদের ঘরে। আজ দিনটাই যেন কেমন গেল। নেহালদা আসার খবরে আমার যেন কী একটা হয়। বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে। পাকুও লাফালাফি শুরু করে। ওর কারণটা অবশ্য ভিন্ন। ছোট চাচীর বড়ভাইয়ের ছেলে নেহালদা থাকে ঢাকায়। এবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। মাঝে মাঝে যশোর আসে। বাড়ি এলেই আমাদের মনিরামপুরেও আসে একবার করে। নেহালদা দারুণ দারুণ সব ঘটনা ঘটাতে পারে বলে পাকু ওকে খুব পছন্দ করে। একবার একটা ঘড়ি নিয়ে এল পাকুর জন্য। সেই ঘড়ি অন্ধকারে জ্বলে। কি নাকি রেডিয়াম বসানো। ক্লাস থ্রির পাকু সেই ঘড়ি হাতে দিয়ে ঘুমালো আর মাঝরাতে উঠে দু’বার করে সময় দেখলো। আমিও ঘড়িটা কয়েকবার ছুঁয়ে দেখেছি সেটা অবশ্য ঘড়ির বাড়তি সৌন্দর্যের জন্য নয়। আজ সকালে ছোট চাচি যখন বললো, নেহালদা আসবে, তখন থেকেই আমি গোপনে আর পাকু প্রকাশ্যে উৎফুল্ল। মা একটু দুশ্চিন্তায় পড়লো, ভালো রান্নার আয়োজন করা নেই। মনা খালাকে দিয়ে দ্রুত তিনি মশলাপাতির ব্যবস্থা করিয়ে নিলেন। বিকেলের আগেই নেহালদা এলো। সাথে ইউনিভার্সিটির আরও দুই বন্ধু। আমাদের বাড়ি দেখাতে এনেছে।
বাড়িটা অবশ্য দেখাবার মতো। মূল বাড়ির চারপাশ ঘিরে গাছগাছালি। ঢোকার মুখে একপাশে মাঝারি গোল পুকুর কাটানো। দাদি জীবনকালে দুহাতে বৃক্ষরোপণ করেছিলেন। রান্নাঘরের পেছনে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ঘন ঝোপ-ঝাড়। ওই ঝোপটায় পাকু আর আমার আগ্রহ। এদিকটায় ফল আর কাঠের গাছ বেশি। বেণা ঝোপের ভেতরে একটা ছোট ডোবা। পানি যতটা জমে তার চেয়ে বেশি কচুরিপানা। যদিও ওদিকটায় যাওয়া কারও বিশেষ পছন্দ নয় তবুও বড়দের আঠার মত চোখটা একটু আলগা হলেই যেতাম। যেন কিছু হারিয়েছিল, খুঁজতে এসেছি বা আকস্মিক কোন নতুন পাখির ডাক শুনেছি। নতুন পাখি বিশেষ আসত না তবে যারা ছিল তাদের চিনতেই তো কতকাল প্রয়োজন। আরও ছোট থাকতে দু একবার গুলতি দিয়ে কাকের বাসা ভাঙার চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি। ওসব নিছক ভয় দেখানো। কাঠের দুই কোনা ডালটা ভালো করে কেটে ঘষে নিয়ে দুটোর মাথা চামড়ার একটা ফিতে বসিয়ে টান দিলেই হলো। তবে তখন আমরা ভেন্না গাছের বিচি যেগুলো দেখতে গোলগোল মটর দানার মতো ওই দিয়ে গুলি বানাই। তাতে বড়জোর কাকের বাসা কেঁপে ওঠে, ভাঙে না। ভয় পেয়ে ওরা ডাকাডাকি করে। একটা ফল ছিল তখন ওই ঝোপে, দাদি বলতো ‘মাকলি’। দেখতে সুন্দর বলে হয়ত সুন্দর একটা নাম দিয়েছিল, আসলে ‘মাকাল’। পেকে গেলে একেবারে ক্ষুদে টমেটোর মতো। এত ছোট আর সুন্দর মসৃণ যে মনে হয় সব খেয়ে ফেলি অথচ বলে দেওয়া হয়েছিল ভুলেও যেন মুখে না যায়। মনা খালা বলে, এই ফল খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। তিনকোণা আল বের করা পাতা অনেকটা করল্লা পাতার মতো। বাইরেটা যেমন সুন্দর ভেতরটা তেমনি বাজে মাকালের। যেন বিড়ালের বিষ্ঠার। ছোটবেলায় আমাদের রান্না-বান্না খেলার সময় ওই ফলটা বাজারে থাকা চাই। গাছটা ছিল ঝোপের ভেতরে হাত দশেক যাবার পর দুটো বড় আমগাছ পেঁচিয়ে।
এরপরই জলডোবাটা। যেন আমের গাছ দুটো আর মাকালের ঝাড় ওই ডোবার সদর দরজা। অব্যবহারে ওটা এঁদো ডোবা হয়েছে। চারপাশে বড় বড় ঘাস ছনের আশ মাথা উঁচু করা। এখানে পায়ের তলার মাটিতে সবসময় ভেজা ভেজা ভাব। জায়গাটাও আঁধার আঁধার। সুযোগ পেলে এসে দাঁড়াই, অদ্ভুত এক আলো দেখা যায়। বিকেল মরে যাওয়ার সময় মসৃণ আলোটা গুটাতে গুটাতে গাছের ভেতর দিয়ে ডোবার পানার সাথে মিশে। এই জংলাতেই ছিল ওদের বাসা। একজোড়া, গলা থেকে পুরো পেট বরাবর সাদা রঙের টানা দেওয়া। ঠোঁটের কাছটায় এক ছিটে লাল রঙ। পা দুটো বকের মতো একবারে ঠ্যাঙ ঠেংয়ে। বেশ নরম প্রকৃতির আর লাজুক ধরণের পাখি। শুধু ডাকতো যখন মাথা ধরিয়ে দিত। আমাদের না ধরলেও ছোট চাচি সেরকমই বলত। ডাক বাড়ত সন্ধ্যার দিকে। প্রথমে ধীর লয়ে তারপর দ্রুত ‘কোয়াক কোয়া…আক’ করে। সেদিন দিনের বেলাতেও দেখেছি পাখি দুটো ডোবা ছেড়ে বাড়ির কাছে ঘুর ঘুর করছে। ঝোপের শুরুতেই যে বরুণ গাছ ওতে সাদা ফুল ধরে। অনেকটা ভাঁট ফুলের মত তবে খয়েরি শুঁড় আছে। বরুণ গাছের গোড়ায় একরকমের পোকা যে জন্মায়, ওই ডাহুকের পাখি আবার সেসব পোকা বেশ আরাম করে খুঁটে খুঁটে খায়। পোকা খুঁটতেই এসেছে মনে হয়। এসেই কোয়াক কোয়াক করছে। অমন ডাকলেই কার কথা যেন মনে পড়ে আমার। সে অনেক দূরে থাকে। সে কথাটা আমি কাউকে বলতে পারি না কিন্তু পাকু ঠিকই ওর মনের কথা অকপটে বলে। পাকুর নাকি পাখি দুটোকে ডিম সমেত ঘরে তুলে আনতে ইচ্ছে করছে। বিড়ালের বাচ্চার মত করে পালতে ইচ্ছে করে। পাকুর কথা শুনে মা বিরক্ত হলেও মনা খালা হাসে। হাসতে হাসতে সে যেন আরও একটু উসকে দেয়
-ডুবার পাখি বুঝি ঘরে পোষ মানে বাবা ? ডাহুকরে দে তুমি ঘরের ভিতর ডিমি তা দিতি পারবান নে।
পাকু যে কী বোঝে বোকার মতো। মাছের কাঁটা রেখে আসে রান্না ঘরের পেছনে পাখির জন্য। ডাহুক কী ওসব খায় নাকি ! সেদিন পাখিরা ক্রমাগত ডাকছে শুনে পাকুর মনে হলো খিদে পেয়েছে। মনা খালা বললো
-বোকা ওটা ডিম ফুটাবার জন্যি ডাকতিছে। আর ক’দিন বাদে দেখপা আরও কডা পাখি হইয়েছে। ডাহুকে একশ একটা ডাক দিলিপর তার গলা দেরক্ত উইঠে আইসে, সেই রক্ত ডিমের ওপর ফেললি পর বাচ্চা ফোটে।
পাকুর চোখে বিস্ময়। সে জানতে চাইল, যদি ডিম ফোটাবার আগেই মারা যায়? মনা খালা বিজ্ঞের মত জানালো – তালিপর ডিমতে আর ছানা হবিনা।
মনা খালা হচ্ছে আমাদের প্রকৃতির অভিধান। কোন গাছের ছাল বেটে লাগালে ব্যথা কমে, কোন পাতা ছেঁচে খেলে কাশি থাকে না আর কোন পাখির ডাকে কী হয় সব জানে সে। মনা খালা কোনদিন আমাদের বকেনি। এই বাড়ির সবকিছুই তার। বাবা ছাড়া সবাইকে সে তুমি ডাকে। ছোট চাচিকে ছোট বউ সম্বোধন করলেও মা’কে কোন এক অজ্ঞাত কারণে সে বুবু বলে। নিরীহ এই মহিলাকে কদিন আগে জীবনে প্রথম চোখ রাঙ্গাতে দেখলাম। তাও একেবারে ছোট চাচীর ওপর। সেও ওই সেগুন গাছ কাটার কথা না হলে নিশ্চয়ই অমন করত না।
গত আষাঢ়ের মাঝখানে কাকার বিয়ে হল। বৌ খুলনা শহর থেকে মফস্বলে আমাদের সাথে থাকতে এসেছে। দুএকদিন যেতেই টের পেলাম, চাচীকে ভালোলাগার চেয়ে ভয়ের ওজনটা বেশি। মা’ও পায়। চাচির সামনে সুরুত সুরুত শব্দে পাতের শেষ ডালটুকু টেনে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।আকস্মিক অভ্যাসের শব্দ উঠলে অপ্রস্তুত হয় মা। চাচি কাঁচের প্লেটে পেটের তলায় পড়ে থাকার মতো সামান্য একটু ভাত নেয়। আমরা তখন দাদির আমলের মাজা কাঁসার প্লেটে ঝোল ঝোল তরকারির ভেতরে হাত ডুবিয়ে দিয়েছি। সেই মানুষকে চোখ রাঙানো কম কথা না। মনা খালা এই বাড়ির আশ্রিত হলেও পরিবারের সদস্য। শুধু চাচীর আচরণে কোথায় যেন তাচ্ছিল্য। বাবা হয়ত নিজে চালের আড়তদার হওয়ায় একটু অস্বস্তিতে যথাসম্ভব নিজেকে সিঁটিয়ে রাখেন চাচির সামনে। মা সারাদিন রান্না নিয়ে চিন্তিত। চাচীও বুঝে গেছেন, এদের মধ্যে সে সবচেয়ে শিক্ষিত। কাকা বিয়ে করেই চলে গেলেন ঢাকার চাকরিতে। গুছিয়ে উঠে মাস ছয় বাদে বউ নিবেন। চাচি এ সময়টা আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব হাতে নিয়ে ফেলেছেন। রাতের পড়া দেখিয়ে দেন, ইংলিশ ট্রান্সলেশন করান। পল্লী বিদ্যুতের টিম টিমে আলোয় পেছনের গাছে বসা পাখির ডাক শুনতে শুনতে এসএসসি’র প্রস্তুতি নিচ্ছি। খাতায় লিখি, আওল হ্যাভ ব্রাউন ফেদার, আওল হান্ট মোস্টলি স্মল ম্যামেল। ওই ঘরে তখন বাংলা নাটকের জিঙ্গেল শোনা যাচ্ছে। আমাদের তখন ঘন ঘন বাথরুম পায় আর পানি খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ছোট চাচির সামনে বই রেখে উঠে যাওয়ার চেয়ে গরম পেয়াজু মুখে দিয়ে গিলে ফেলা সহজ। অমন মেজাজী মানুষ হঠাৎ কেন এমন আচরণ করছেন সে এক রহস্য। এর আগেও একদিন অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়েছিলেন। সেটা তার ওই সেগুন কাঠ দিয়ে প্রেম পালঙ্ক বানানোর আগে। গাছটা কাটা হয়েছিল পাখি তাড়াতে। রাতে ওখানে পেঁচা এসে বসত। রাত বাড়লে ডাকও বাড়ত। একেবারের চাচির ঘর ঘেষা গাছ। ওই শব্দে সে ঘুমাতে পারেনা। একবার তার এক মামী এলেন দু’দিনের জন্য ভাগ্নির নতুন শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে। এসেই রাতে শব্দ শুনে বললেন
-ইসব পাখি ডাকা ভালো না। আমাগের দিক কয় কন্ঠী নিমপ্যাঁচা। কী যে খারাপ দেখতি। ডাক শুইনে বুকের ভিতর হিম ধইরে আসে। ঘুলা ঘুলা চোখ আর কান কেমন উচোঁয় রাহে।শুনো শুনো, কান পাইতে শুইনে দ্যাহো, হোও হোও কইরে বিড়ালের বাচ্চার মতো ডাইকে উঠে। দ্যাহো ঝিঁ ঝিঁ গুলোও ডাক থামোয় রাখিছে। এই পাখি ডাইকে ডাইকেই দুঃসংবাদ আইনে ছাড়ে কতিছি আমি।
আসলেই ডাকটা যেন কেমন। একবার মনে হয় গলার ভেতর ঘরঘর শব্দ তুলে ডাকছে আবার মনে হয়, শক্ত দরজার কপাট খোলার শব্দ হচ্ছে। মাঝরাতে আকস্মিক ডাক শুনলেই মনে হয় কী যেন সে জানে, অন্ধকারে কী যেন সে দেখেছে যা আমরা দেখছি না। সেই ডাকেই চাচির ভয়ে ঘুম ভাঙ্গে। শিক্ষিত নারীর জেদ মারাত্মক। কয়েক রাত পাখির সেই শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় তিনি ঘোষণা দিলেন গাছ কাটতে হবে। একদিন সকালে শুনলাম বাবা বলছেন,
-ওই গাছেই আইসে বসে তুমি জানো?
-জ্বি ভাইজান। ওই গাছেই। সারারাত ঘুমুতি পারিনে। আমার কিরম লাগতি থাকে।
-গাছ না কাইটে পাখি তাড়াবার ব্যবস্থা কইরে দেখি দাড়াও।
-তাড়াবেন কিরাম কইরে?
-সন্ধ্যার দিক নারকেলের ছুবা আর ধুপ মিশোয় জ্বালালি সেই গাছে রাত্তিরে পাখি বসপেনে না। অতদিনের বয়সী গাছটা কাইটে ফেলতি মায়া হতিছে ছোট বউ।
-চেষ্টা কইরে দ্যাখতি পারেন কিন্তু কাজ না হলি গাছ কাটতি হবি। আমার ঘুমডা কম জরুরি না।
চাচির আল্টিমেটামে আমরা সবাই দাদির লাগানো গাছটা বাঁচাতে প্রাণাতিপাত করে ফেললাম। প্রথমে ঢিল ছুঁড়ে তারপর ছন দিয়ে আগুনের ধোঁয়া বানিয়ে। গাছতলায় ধোঁয়া দিলে সেই গাছে পাখি বসে না। এই খবরও অবশ্য মনা খালার দেওয়া। মনা খালার সাথে মিলে আমরা নানাভাবে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু চলে গেলেও রাতে আবার পাখি ফিরে আসে। মাঝরাতের দিকে ঠিকই ডাক শুরু হয়। আমার মা মন দিয়ে শুনে বললেন,
-ছোট বউ এ খুঁড়-লে প্যাঁচা। ওর ডাক শুইনে তুমি ভয় পাতিছ। ইডারে লক্ষ্মী প্যাঁচাও কয়। দ্যাহোনি দিনের বেলায় জোড়া ধইরে একবার আসে। চিকক চিকক কইরে ডাকে, অতো ভয় পাতিছ কেন? লক্ষ্মী প্যাঁচা ডাকলি তো ভালো হয়।
চাচি কতটা বিশ্বাস করলেন জানি না, তাঁর রাতের ঘুম প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। পাকুর আরবী হুজুরের কানেও খবর পৌছাতে দেরি হল না। তিনি একটা সূরা শিখিয়ে অনেক কায়দা কানুন জানালেন। আমরা প্রতি রাতে পড়তে বসে এজাযা, নাসিরুল্লাহে তালা… পড়ে একটা লোহার শিক আগুনে পোড়াতাম। সেই শিক গরম থাকতে থাকতেই ঘরের দরজায় গেঁথে দিতে দিতে পাখিটাকে গালাগাল দিতে হবে। পাকু আর আমার নতুন খেলা শুরু হল এটা। শিক গরম করতে করতে দরজা প্রায় পোড়া নকশার চিত্রকর্ম করে ফেলেছি। কিছুতেই কিছু হলনা। অগত্যা এক সকালে বাবাকে চাচির আল্টিমেটাম দেওয়ার পর চোখ গরম করে মনা খালা বলে বসলেন,
-থাকতি পারতিছেনা, বাপের বাড়ি যাইয়ে থাকুক কডাদিন। তাই বইলে গাছ কাটার বাহানা উঠতিছে কিসির জন্যি, আমরা বুঝতি পারতিছিনা না?
সেগুন গাছটা কাটার কথায় আমার মা’এর মনটাও খারাপ হয়েছে তবুও তাঁর ধমকে চুপ করলেন মনা খালা। পরদিন সকালে বিরস বদনে আমার বাবা গাছ কাটার লোক নিয়ে এলে মা আমতা আমতা করে বললেন
-কচ্ছিলাম কী আজ বৃহস্পতিবার। হিন্দুরা লক্ষ্মী পুজো দেয়। এ দিনই লক্ষ্মী প্যাঁচার অজুহাতে গাছটা না কাটলি ভালো হত।
বাবার মনে হয় জেদ ধরে গেছে ভাইয়ের বউয়ের অভিযোগে। তিনি গাছ কাটালেন। রান্না ঘরের পাশটা আকস্মিক কেমন ন্যাড়া হয়ে গেল। এখন আর সেই বাতাসটা ওখান দিয়ে আসেনা। আমাদের সব চেষ্টাও ব্যর্থ হল, শুধু দরজার পোড়া শিকের দাগগুলো থাকলো চোখের সামনে। তবুও একটু নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, অভিযোগ বন্ধ হবে। দু’রাত শান্তিতে ঘুমালেন ছোট চাচি। তৃতীয় রাতেই হঠাৎ আমাদের ঘরে হাজির।
-পাকু-তিতির তোমরা শুনতিছ ডাক ?
-কই কী ডাকতিছে ?
-পাখি আবার ফেরত আসিছে, ডাকতিছে হোওও-হেহাওও-হোওও। শুনতিছ না ?
আমরা কিছু শুনছি না বলে তাকে নিশ্চিত করায় বুঝলেন, মনের ভুল। আরও দুএক রাতে তিনি অভিযোগ করলেও কেউই সে ডাক শুনলনা। চাচি আস্তে আস্তে ভুলে গেলেন পাখির ডাক শোনা। কিন্তু আজ রাতে তার আবার আকস্মিক কী ঘটলো যে সে উঠোনের মাঝখানে নাচতে শুরু করলেন। একপাশে কাত হয়ে কান থেকে পানি বের করার মত লাফাচ্ছিলেন। সন্ধ্যায়ও ভালো মানুষ। নেহালদারা আসার পর থেকে বেশ খোশ মেজাজে ছিলেন। আমরাও তাই ছিলাম সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত। সন্ধ্যার মুখে মুখে ঠিক যখন ডাহুকটা ডাকতে শুরু করল, ছোট চাচি উৎসাহ নিয়ে তার ভাস্তেকে জানালেন। এই পাখি জোড়া প্রায়ই ‘কোয়াক কোয়াক’ শব্দ করতে করতে রান্না ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। নেহালদা তার মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট থেকে কী যেন একটা নামালেন। আমার খুব ইচ্ছে হলেও দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম না। যদি হ্যাংলা ভাবে। ও ঘরের কথাবার্তা কানে আসছে ভেঙে ভেঙে। পাকুর কাছে দড়ি আর পেরেক চাইছে নেহালদা। পাকু এ ঘর এসে তার ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া সুতো বের করল ট্রাংক থেকে। ছোট চাচি আসার পর থেকে ভয়ে বড়শি, মাঞ্জা গুলতি সব ট্রাংকে উঠিয়েছিল। নেহালদার মত মানুষ তার কাছে কিছু চাইছে সে নিজেকে খুব একজন কেউকেটা ভেবে জানিয়ে গেল,
-আপা, ভারি এট্টা মজার ঘটনা ঘটতি যাতিছে। নেহালদা সুতো নিয়ে জিনেরির সাথে কী সুন্দর কইরে পেচাচ্ছে খোপ খোপ তুইলে। আর মোবাইল ফোনে এট্টা শব্দ নামাইছে জানিস ?
-কিসের শব্দ নামাইছে ?
-অবিকল পাখির ডাকের মতো শুনতি। ধর তোরে এই বসায় রাইখে বারান্দার থে যদি ওই শব্দ বাজাতি থাকে তুই ভাববি, পাখি ডাকতিছে। ঘরের ভিতর পাখি আপা।
-কিন্তু ওই সুতো দে কী হবে?
-তা জানিনে, নেহালদা কতিছে ভারি এট্টা মজা হবে।
নেহালদা তার দুই বন্ধু আর পাকুকে নিয়ে জংলাটায় যাবার পর পাকুর উচ্ছ্বাসই কিছুক্ষণের ভেতর কান্না হয়ে গেল। খাটের ওপর এসে উপুর হয়ে পরে ফুঁপাতে লাগল। মনা খালা ওকে টেনে তুলে সোহাগ করে জিজ্ঞেস করতেই পাকু এবার রীতিমত শব্দ করে কাঁদতে শুরু করেছে। পাকুর এই নামটাও মনা খালার দেয়া। ওর আসল নাম পুলক। আদর করে পাকু ডাকতে ডাকতে সবার মুখে ওই নামই হয়ে গেল। ভাগ্যিস মনা খালার মুখে আমার তিতির নামটা তিতি হয়ে যাওয়ার পরও কেউ ওভাবে ডাকে না। টেনে তুলে আদর করে পাকুকে বসাবার পর জানা গেল। নেহালদা সুতো দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল বনে। ঝোপের আড়ালে বসে মোবাইলে কী একটা ডাক ছাড়ল অবিকল পাখির মত। সেই শব্দ শুনে মা ডাহুকটা যেই ঝোপের দিকে আগালো অমনি তার পা আটকেছে ফাঁদে। পাকু তখনও ভেবেছে নিছক মজা হচ্ছে। এখনই ছেড়ে দেবে। নেহালদার বন্ধুরা ওটাকে রান্না ঘরের পেছনে জবাই করেছে। মনা খালা আর মা এতক্ষণ মেহমানদের রাতের খাবারের আয়োজন করছিল বলে বিশেষ খেয়াল করেনি। পাকুর চোখে সিনেমার নায়কের মতো নেহালদাকে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। এখন ঘরে ঢুকে কাঁদছে। আমি রান্না ঘরের দরজার কাছে ছোট চাচির স্পষ্ট কন্ঠ শুনলাম। মা’কে বলছে,
-ভাবি ছেলেমানুষ শখ কইরে পাখি ধরিছে। ওত আর আমাগেরে পুষানা। উরাই রান্না কইরে খাইয়ে পিকনিক করতি চাতিছে, বাটা মশলা আছে না ?
বাড়ির সবার মুখ থমথমে হয়ে গেল। এই বাড়ির কোন পশুপাখি না মারার প্রচলন আমার দাদির সময় থেকে। মা চোখ-মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ যোগাড়পাতি করে রান্না ঘর থেকে এসে শুয়ে পড়েছেন ঘরে। মনা খালার চোখটা শুধু একবার ধক করে জ্বলে উঠতে দেখেছি। ছোট চাচি শক্ত মানুষ, সবকিছু টের পেলেও তোয়াক্কা করলেন না। সামান্য একটা পাখি মারা নিয়ে নিজের ভাইয়ের ছেলের সামনে তিনি ছোট হবেন না। ওদের সাথে ডাহুক চুলোয় বসাতে সাহায্য করলেন। উঠোনে বসে নেহালদারা খাওয়ার সময় পাকুকে ডেকে বের করতে পারলনা। মা যেয়ে বলল,
-বাবা তুমরা খাও। আমার ছেলেটা এখনও ছোট, পাখিটার জন্যি মায়া ছিল ওর কষ্ট হতিছে। আর ডাইকনা।
পাকুকে না পেয়ে নেহালদাদের পিকনিকের আনন্দ অবশ্য খামতি হয়নি। ছোট চাচিও বুঝেছেন, ডেকে লাভ নেই। তিনি থালা-বাসন ধুয়ে টুয়ে পরিষ্কার করলেন। আর তারপর সবাই চলে যেতেই বললেন, তাঁর মাথা ব্যাথা করছে। সবসময় চাচিকে এড়িয়ে যাওয়া মনা খালা কেন অমন মায়া দেখালেন বুঝলাম না। তিনি নারকেল তেলের শিশিটা নিয়ে বললেন,
-ছোট বউ, আহা আগুনের কাছেত যাওয়া পড়ে না। এই জন্যি শরীল খারাপ লাগতিছে। এহানে বসে এট্টু জিরোও দেহি, মাথায় ভালো কইরে তেল দিতিছি। সাইরে যাবেনে।
এসব ব্যাপারে মনা খালার হাত ভালো। একবার পাকুর পা মচকেছিল। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার আগে মনা খালা বললো, দেহি বাপরে এট্টু আমার ধারে ছাইড়ে দেনদি ভাই। সরষে তেল আর হলুদ গরম করে সারা রাত ধরে ডলে ডলে সেই পা ঠিক করে ফেললেন তিনি। মনা খালার আরও একটা গুণ আছে, তাঁর নাকি হাত চলে। মা’র সোনার চেনটা যখন হারিয়ে গেল, মনা খালা কাঁসার বাটি চালান দিলেন। বাটি যেদিকে যাবে, সাথে সাথে আলগা করে হাত রেখে অনুসরণ করো। মনা খালা আমাদের চোখের সামনে খুঁজে বের করলেন, চেনটা ঘাটের কাছে পড়েছিল। মা বলে,
-ইসব মাইনষে চালি পর যেমন মাইনষের ভালো হয় আবার কারো ওপর কষ্ট পালি তাগের ক্ষতিও হতি পারে। তোগের মনা খালা মনে হয় কার্ত্তিক মাসে হইছে। ওই মাসের কডা দিন আছে, ওই সুসময় জন্মালি তাগেরে কিছু কিছু ক্ষমতা হয়। খবরদার কুনদিন তাঁরে আঘাত দেবানা। তোমাগের জান দে আগলায় থয়। কুনদিন যেন ছোট কইরে কথা কয়োনা।
মনা খালাকে কোনদিন ছোট করার কথা আমাদের মাথায়ও আসেনি। আর সেও এমন মায়াময় মানুষ, বাড়ির গাছপাতা থেকে শুরু করে মা’এর শাড়িটা রোদে দিতে হবে, বাজার থেকে বাবার পান আনাতে হবে কিনা সব তাঁর নজরেই থাকে। সবকিছু যে ভালোবাসে সে সবকিছুরই অংশ হয়ে ওঠে। আলাদা করে মনা খালাকে ভালোবাসা দেখাবারও যেমন প্রয়োজন পড়েনি তেমনি কিসে যে সে আঘাত পাবে সচেতন হয়ে ভাবতেও হয়নি কোনদিন। চাচিকে প্রেম পালঙ্কে বসিয়ে মনা খালা ভালো করে তার মাথায় তেল মালিশ করে এসে শুয়ে পড়ল। মা কয়েকবার রাতে খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করেও তুলতে পারেনি।
-আমার ভালো লাগতিছেনা কিছু।
-বাচ্চা ছাওয়ালপাল ঝোঁকের মাথায় ভুল কইরে পাখিডারে ধইরেছে। বুঝতি পারিছি তোমার কেমন লাগতিছে। পাকুওতো কতক্ষণ ধইরে ফুঁপাল তাই বইলে তুমি ভাত খাবানা ?
-এক রাত না খালি মানুষ মরে না বুবু। দু’দিন আগেও পাখিডা কেমুন ডাইকেছে শুইনে বুঝনি, ডিম ফুটোনোর সময় হইয়েছে ? শখ কইরে যদিও ধইরেছে তাই বলি ওই পাখিডাই খাতি হবি, ছাইড়ে দিলি কী হত ? হারামির বাচ্চারা বাপের কালে কিছুর মুক দ্যাহেনি ? আর ছোট বউ কী মানুষ, মাগী এট্টা ঘরে আইনে তুলিছ। দেখপা আরও সামনে।
মনা খালার মুখে এমন ভাষা আমরাত আমরা মা’ও মনে হয় প্রথম শুনলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বুঝল, সাধাসাধিতে লাভ নেই আজ। তাকে উঠানো যাবে না। পাকুকেও রাতে খাওয়ানো গেল না। বাবা এসে পাকুর ভালো নাম ধরে ডাকলো। তার মানে বাবা এখন বেশ সিরিয়াস কিন্তু তাতেও পাকু উঠলো না। মনা খালার গা ঘেঁষে শুয়েই রইলো। আমি শুধু বুঝলাম না, যার জন্য ভেতরটা এমন হু হু করে সেই মানুষটা আসলে কেমন ? একটা পাখি ধরায় সত্যি কী এমন আনন্দ ? আজ সন্ধ্যার পর থেকে আর অন্য পাখিটাও ডাকছে না। সঙ্গী হারিয়ে ভয় পেয়েছে। মনটা যেন কেমন হয়ে আছে আমার। কোনমতে মুখ গুঁজে খেয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। আর ছোট চাচি অস্থির হলো বাড়ির সব বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পরই। সে মা’এর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়েছে।
-ভাবি আমার কানের ভিতরদে এট্টা শব্দ হতিছে। ঘুমুতে পারতিছি না।
-কতেছিলা মাথা ব্যাথা। ওইতে মনে হয়, দিনে ঠিক হইয়ে যাবেনে। ঘুমাতি চেষ্টা করো।
-ঘুম আলিত আর আপনেরে ডাকতি আসতাম না। খুব কষ্ট হতিছে।
-তালিপর চলো তুমার খাটে শুতিছি আমি। মাথায় হাত বুলোয় দিতিছি।
ছোট চাচি তাঁর প্রেম পালঙ্কে মা’কে নিয়ে শুয়েও পড়েছিলেন। একটু ঘুম ঘুম ভাব আসতেই হঠাৎ চিৎকার করে লাফিয়ে উঠেছে।
-ভাবি আমার কানের ভিতর বইসে পাখি ডাকতিছে। অবিকল ওই পাখিডার মতো কইরে ডাকতিছে।
-কুন পাখিডার মতো বউ ? ধুর তুমি ওরে কাইটে রানছ তাই খারাপ লাগতিছে বইলে ওরম মনে হতিছে। কিচ্ছু হয় নাই, শোও শোও।
মা’এর সান্ত্বনা প্রলাপ শুনতে শুনতেই সেই ডাক বেড়েছে। আমরা কেউ শুনতে পাচ্ছি না কিন্তু চাচি ক্রমাগত অস্থির হয়ে গেছেন। তাঁর ডানকানের ভেতর বসে ডাহুক পাখি অবিকল ‘কোয়াক কো… আক’ করছে। সেই শব্দ মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। সহ্য করতে না পেরে তিনি বেতাল হয়ে উঠোনে এসে কান কাত করে অমন লাফাচ্ছেন। পানি ঢুকলে সাধারণত মানুষ এভাবে শরীর বাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কান থেকে বের করে। চাচি ঠিক অমন করে কান থেকে ‘কোয়াক কোয়াক’ শব্দ ঝেড়ে বের করতে চাইছেন। মনা খালা রিমান্ডে যাবার আগেও খাটে শুয়ে কুটকুট করে হেসেছে, অন্ধকারেও আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি।
সতর্কতামূলক দূরত্ব রেখে মা’এর ঘরের দরজার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে মা চাপা গর্জনে কিছু বলছেন কিন্তু তারপরপরই মনা খালার খিলখিল হাসির শব্দ।
-বুবু তুমার সত্যি দেখতি ইচ্ছে করতিছে না ? সত্যি কও, অমন গাছটা তারপর মা পাখিটা… বুবু দ্যাখপানা কানের ভিতর সবসুময় কুয়াক কুয়াক কইরে ডাকলি মাইনষের কী হয় ? মনা খালা আরও একবার কু…আক কুয়াক শব্দ উচ্চারণ করলেন অবিকল ডাহুকের স্বর নকল করে। আবারও হাসছেন মনা খালা।
আপনজন অন্যায় করলেও সত্যি তাকে মাপা কঠিন।