short-story-buri-dihinger-pare

বুড়ি ডিহিঙের পার
অমর মিত্র


  পথটা ঠিক ওইখানেতে ঘুরেছে।
           যেইখানেতে হারিয়ে গেল সে
                   সেইখানেতে মুখ দেখাবে আবার।

মেয়েটি একাই থাকে। একা থাকে মানে একা একটি বাড়িতে থাকে যে তা নয়। সে আছে আর তার মা আছে। তার বাবা নেই। বাবা বছর দুই আগে আচমকা চলে গেছে। আগে বাড়িতে তিনজন ছিল, এখন দু’জন। দু’জন হওয়ার পর মেয়েটি একা হয়ে গিয়েছে। আগে তার কত কথা হত বাবার সঙ্গে। আগে তার মায়েরও কত কথা হত বাবার সঙ্গে। সেই লোকটা চলে যাওয়ার পর মেয়েটির মাও একা হয়ে গিয়েছে। মেয়েটি একা থাকে আর তার মা একা থাকে। এই বাড়িটিও একা থাকে।

বাড়িটা করেছিল সেই লোকটা খুব মন দিয়ে। লোকটা মানে মেয়েটার বাবা, তার মা নীলিমার স্বামী। মেয়েটার নাম ঐশী। তার বাবার নাম ছিল চন্দন। মেয়েটা একদিন আচমকা শুনে ফেলেছিল, তার মা তার বাবার কানে গুনগুন করছে, মেয়েটা আমার চন্দনের ফোঁটা। চন্দন হেসেছিল, কী যে বলো, মেয়েটা আমার নীলিমা থেকে নামিয়ে আনা নীলিমায় নীল। নীলিমা হলো ওই আকাশ। আকাশ থেকে তো নামে বজ্র। বজ্রপাত, মেঘ গুড়গুড় শব্দ। উফ, ওতে ঐশীর খুব ভয় করে। তাহলে তার বাবা বলেছিল কেন, বাবা বলেছিল, আকাশ থেকে বৃষ্টিও তো নামে।

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে। মেয়েটা জানে চন্দন সিনহা চলে যেতে তার আর কেউ নেই। মেয়েটার মায়ের কথা মেয়েটা জানে না। এই বাড়িটার কথাও মেয়েটা জানে না। কিন্তু সে নিজের কথা কিছুটা জানে। চুপ করে জানালার ধারে বসে থাকে যখন নির্জন পথের দিকে চেয়ে ঠিক দুপুরবেলা, কেমন যেন মনে হয়, চন্দন সিনহা ফিরবে ওই পথ দিয়ে।
অথচ চন্দনকে তো সাজিয়ে নিয়ে গেল অনেকে মিলে। সে স্তম্ভিত হয়ে বসেছিল। তার কাকার ছেলে দিব্য সব কাজ করেছিল। সে যায়নি শ্মশানের দিকে। এই শহরটা খুব ছোট। কিন্তু শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটা বড় শহর আছে। সে শহরের ধারে ব্রহ্মপুত্র নদ আছে। সে নদী কত বড়। এপার ওপার দেখা যায় না। ব্রহ্মপুত্রের ধারেই সেই শহরটা গড়ে উঠেছিল। বাবা সেই শহরে যেত সপ্তাহে পাঁচদিন। বাসে যেত বাসে ফিরত। বাবার ব্যবসা ছিল ওখানে। বইয়ের ব্যবসা। বাবা মাঝে-মধ্যেই বলত, ওখানেই সকলকে নিয়ে যাবে, ব্যবসাটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। রাত হয়ে যাচ্ছে দোকান বন্ধ করতে। একেক দিন তো বাবা থেকেই যেত ওখানে। দোকান সংলগ্ন একটি ঘর আছে। সেখানে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল যাতে যখন-তখন থেকে যেতে পারে। এই শহরের গায়ে একটা ছোট নদী আছে। সে নদীতে জল থাকে শুধু বর্ষার সময়। তারপর সারা বছর ধু ধু বালি, গরম বাতাস। নদী একেবারেই শুকনো। সেই নদী পেরিয়েই তার বাবা চন্দন সিনহা চলে গেছে কোথাও, দূরের কোনও পাহাড়ের দিকে।

মেয়েটার এমনি মনে হয়। সে এখন বাইশ। সে এখন বড় হয়ে গেছে। বাবা যখন চলে যায় সে ছিল কুড়ি। তখন সে বড় হয়নি। কী করে বড় হবে, বাবা থাকতে মেয়ে বড় হয় নাকি? সে ছিল সেই ছোট্ট পুতুল। পুতুল পুতুল করে বাবা বাড়ি মাথায় করত।

মা এল, বলল, সে খবর দিয়েছে?
কে মা?
আবার কে, সেই বিজয়।
না মা।
সে তাকিয়ে থাকল বাইরে। বিজয় বলে একটি যুবক তার প্রেমে পড়েছে। সে সুদর্শন, সুচাকুরে আর তার বাবা মা কেউ নেই। পিসির কাছে মানুষ। পিসির কোনও ছেলেপুলে নেই। অথচ পিসি অতি ধনাঢ্য এক বিধবা। পিসির সব পাবে সে। এই বিজয় ছিল তার কলেজে থার্ড ইয়ার, তখন সে ফার্স্ট ইয়ার। তারপর বিজয় এমএ-তে ভর্তি হয়। সে যখন এমএ পড়তে যায়, বিজয় তখন বেরিয়ে গেছে। এতদিন সে কিছুই বোঝেনি যে বিজয় তাকে ভালবেসেছে। কী আশ্চর্য তার তো কিছুই মনে হয়নি কোনওদিন। সে কোনওদিন ভালবাসার কথা ভাবেইনি। বিজয়কে তার আহামরি কিছু মনে হয়নি কোনওদিন। কিন্তু বিজয়কে নিয়ে তাদের বন্ধুদের ভিতর কত কৌতূহল! অথচ তার কোনও কৌতূহল ছিল বলে মনে পড়ে না। বিজয় সুদর্শন, বিজয় কফিশপে অনেক টাকা খরচ করতে পারে, বিজয় হ্যাঁ বললে কত মেয়ে ধন্য হয়ে যায়, অথচ তার কিছুই মনে হত না। সে কোনওদিন বিজয়কে স্বপ্নে পায়নি। আকাশ কুসুম ভাবেনি বিজয়কে নিয়ে। অথচ কতজনই না তা ভাবত। লুকিয়ে বিজয়ের প্রেমে পড়ে হাঁসফাঁস করত। ঘুমোতে পারত না। আহা মা বাবা কেউ নেই ওই বিজয়দার। মা বাবা কী তাই জানে না, পিসির কাছে মানুষ। পিসি কি কখনও মা হয়?

এক বন্ধু কাজরী নাকি বিজয়ের সঙ্গে ঘুরেছিল ক’দিন। সেই কাজরীই বলেছিল ব্রহ্মপুত্রের ধারের জুবিলি পার্কে বিজয় তাকে চুমু খেয়েছে। কত সময় ধরে তা হয়েছিল তা সে বলতে পারবে না। চব্বিশ ঘন্টা বাদেও বিজয়ের ঠোঁটের স্পর্শ লেগে আছে তার ঠোঁটে। সত্যি হলেও সেই কাজরীর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করতেও চায়নি। কিন্তু তার মনে হয়েছিল কাজরীর কথা সত্যি।

সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কোথায় তাকে মিট করলি কাজরী?
কাজরী বলেছিল, কেন পার্কের গেটের বাঁদিকের বুক স্টলে।
তোকে কি ওয়েট করতে হয়েছিল?
না, সে আগে এসে দাঁড়িয়েছিল।
তুই কি শাড়ি পরেছিলি?
না, হলুদ সালোয়ার কামিজটা।
ওটা খুব ঝলমলে।
কাজরী হেসেছিল, হ্যাঁ, হলুদ রঙ ওর খুব পছন্দ, ওই বলেছিল হলুদ হয়ে যেতে।
ও কী পরেছিল?
ব্লু জিনস আর ডিপ গ্রিন টিশার্ট, আমার পছন্দ।
তাদের বন্ধু শম্পা সব শুনে বলেছিল, কাজরী ঠিক বলেনি, সি ইজ আ লায়ার, বানিয়ে বলেছে, বিজয় হলুদ পছন্দ করে কে বলেছে?
তাহলে কী পছন্দ করে? জিজ্ঞেস করেছিল সে।
বিজয় হালকা নীল লাইক করে, ওর টিশার্ট আছে ওই রঙের।
না না, হলুদও আছে, আর কেউ কি এমনি বানাতে পারে, নিজের প্রেম নিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারে?
শম্পা বলেছিল, পারে।
না হয় না। ঐশী তর্ক জুড়েছিল।
শম্পা বলেছিল, ওকে সে চেনে সেই ছেলেবেলা থেকে, কাজরী গাঙ্গুলী বলত সৌরভ গাঙ্গুলী তাদের আত্মীয় হয়, তার বড় পিসিমনির ভাসুরের ছেলে সৌরভদাদা, তারা যতবার কলকাতা যায়, সৌরভদাদার সঙ্গে দেখা হয়। হতেও তো পারে কথাটা সত্যি।

পুরোটা ফলস, ওর বাবা আমার বাবার অফিসে চাকরি করে, আমার বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, তাতে তাঁর কি হাসি, বলেছিলেন, দুনিয়ার গাঙ্গুলী আমাদের আত্মীয়, সুনীল শ্যামল দুই গাঙ্গুলী লেখকও আমাদের আত্মীয়।

শম্পা নিজেও মিথ্যে বলত খুব। বলত সে বাংলায় লেটার পেয়েছিল। আসলে সেই বছর উচ্চ মাধ্যমিকে কেউ লেটার পায়নি বাংলায়, খবর এনেছিল কাজরী। সে কি বোর্ড থেকে পাকা খবর এনেছিল, নাকি নেট থেকে খুঁজে বের করেছিল লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীর নম্বর? কথাটা কাজরীর। কেউ কাউকে আড়ালে রেয়াত করত না। তার নিজের মনে হত কাজরীর কথা সত্য। আবার কাজরী যে অনেক সময় মিথ্যে বলে তাও সত্য। সে নিজে কাজরীকে জিজ্ঞেস করেছিল, সৌরভ গাঙ্গুলী কেউ হয় তোদের?

কাজরী বলেছিল, তখন সেই ছোট বেলায় সৌরভ ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন, কী গ্ল্যামার, টিভিতে তার খেলা, সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, মনে হত ইশ, সৌরভ যদি আমাদের কেউ হত, আমরা তো গাঙ্গুলী, এ তো হতেই পারে।

ইস্কুলে বলতিস?
হ্যাঁরে ঐশী, সে এক দারুণ মজা, কলকাতা গিয়েছিলাম সামার ভ্যাকেশনে। সৌরভদাদার বাড়িতে গেলাম, কত কাপ ঘরে সাজানো, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরল সেদিনই।
সত্যি?
না বানিয়েছিলাম, বানাতে আমার দারুণ লাগে রে।
এতটা মিথ্যে বললি? ঐশী জিজ্ঞেস করেছিল।
মিথ্যে কেন হবে ঐশী, কল্পনা।
মোটেই না, এটা মিথ্যে।
না রে, আমি তো হারানো সুর দেখে ভেবেছি অমনি কিছু আমার জীবনে ঘটুক, আমাকে ভুলে যাক বিজয়… কী দারুণ হয় তাই না!
হ্যাঁ বিজয় কি তাহলে কাজরীকে ভুলে গিয়ে তার কাছে আসছে? সে নিজের ভিতরে থাকতে ভালবাসে। বিজয়কে তার মনে ধরেনি কখনও, অথচ সেই বিজয় কিনা তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, সে তাকে ভালবাসে। তাহলে কি কাজরীর কথা সত্য হয়ে গেল। কাজরীকে ভুলে গিয়ে বিজয় এসেছে তার কাছে।

মেয়েটা বসে আছে জানালার ধারে। এই জানালা তার খুব প্রিয়। সে কোন ছোটবেলা থেকে বসে থেকেছে এখানে। বাবা আসবে। রাত হত চন্দন সিনহার। কিন্তু বাঁক ঘুরে বাবার অবয়ব চোখের সামনে এলেই সে হাততালি দিয়ে উঠত, বাবা বাবা বাবা।
এখনও সে বসে আছে। যদি আসে চন্দন। মানুষ যা ভাবে তা কখনও কখনও সত্যি হয়ে যায়। কল্পনার স্বাধীনতা সকলের আছে। কাজরী বলত, সে মনে মনে ভাবত, হয়তো একদিন সত্যিই সৌরভদাদার সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা বেরিয়ে আসবে। আহা সেদিন যে কী হবে? সে ‘মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি’ গাইবে হাত নেড়ে নেড়ে। তারপর যত বড় হতে লাগল, তার কল্পনা অন্য দিকে প্রবাহিত হতে লাগল। কিন্তু বিজয়ের কথা কল্পনা নয়, সত্য। বিজয় আর সে পরস্পরকে ভালবাসে। কিন্তু তার ভয় করে যদি বিজয় তাকে ভুলে যায়। পৃথিবীতে কত কিছু হয়, কত কিছু হয় না। যা হয় তার ভিতরে যদি বিজয়ের ভুলে যাওয়া থাকে।

কাজরী হেরে গিয়েছিল। শম্পা গিয়ে কাজরীর কথা বলে দিয়েছিল বিজয়কে। আর বিজয় একদিন সকলের সামনে… ইশশ। সেদিন সে কলেজে ছিল না। পরে শুনেছে সব। কাজরী নাকি মরতে গিয়েছিল। সে আর কোনওদিন কলেজে আসেনি।

মা এসে বসল তার পাশে। জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে, বলল, বিজয় ছেলেটি খুব ভাল, ও শিলচর কলেজে চাকরি পেয়েছে।
ঐশী বলল, মা একদিন ওই বুড়ি ডিহিং পার হয়ে ওদিকে যাবে?
কেন রে?
ওইদিকে যে পাহাড়, সেই পাহাড়ের ওপারে যাবে?
কী সব বলছিস তুই।
বাবা মনে হয় ওই দিকে কোথাও।
মা তার গায়ে হাত রাখে, বলল, অমন ভাবতে নেই, যে লোকটা গেছে সেই লোকটা কষ্ট পাবে।

মেয়েটা চুপ করে থাকে। সে একটি মেয়ে। তার নিজের কিছু কথা আছে। সে বিজয়ের কথা কোনওদিন ভাবেনি, অথচ তার বন্ধুরা সবাই ভাবত। কাজরী ভাবতে ভাবতে অনেক দূর গিয়েছিল। একটা কাহিনি সে বানিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এমনও হতে পারে, কাহিনি নয়। বিজয় আর তার ভিতরে সম্পর্ক হয়েছিল। বিজয়ের ছিল ভয়ঙ্কর আগ্রাসন। কাজরী বলেছিল, প্রথম দিনের সেই গোপন দেখাতেই বিজয় তাকে চুমু দিয়েছিল অনেকবার। তারপর তো সে নিজেকে নিবেদন করেছিল, বিজয়ের আগুনে নিজেকে পুড়িয়েছিল। বিজয়ের বোধ হয় ক্ষুধা মিটেছিল, কাজরীকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে। সুযোগটা শম্পা করে দিয়েছিল। যারা বিজয়ের জন্য নিজেদের প্রতিদিন সাজাতো তাদের সঙ্গে বিজয়ের সব সম্পর্কের ইতি হয়েছিল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হলে যে যার ঘরের জানালায় গিয়ে বসেছে।

মা নীলিমা বলল, তুই একে ফিরিয়ে দিস না।
মেয়েটা বলল, ওই যে বুড়ি ডিহিঙের ওপারে সেই অনেক দূরের পাহাড়, সেই পাহাড়ের ওপারে কি অন্য দেশ?
মা বলল, থাই রাজারা ওই পথে এসেছিল।
ড্রাগন নিয়ে?
ড্রাগন তো মিথ, ওদের পুরাণ।
আমার মনে হয় সত্যি।
মা বলল, তুই বড় হলি না।
মা, বাবা আমাকে বলত একদিন আমাকে নিয়ে যাবে ওই পাহাড়ের ওপারে।
নীলিমা রেগে যায়, উফ, সেই এক কথা, কবে বলেছিল রে কবে?
সেই ছোটবেলায়।
নীলিমা জিজ্ঞেস করে, বলেছিল, না তুই এখেনে বসে ভেবেছিস ?
ঐশী মৃদু গলায় বলল, হতে পারে মা। তাই-ই হয়েছে।
কিন্তু আমার কেন মনে হয় কথাটা বাবার ছিল, আমি আর বাবা ওই পাহাড়ের ওপারে হাত ধরাধরি করে চলে যাব, ওই পারেতে একটা দেশ আছে তার সব সুন্দর, আমি বলতাম সুন্দর দেশ।
এসব কথা রাখ, এসব কথা ছোটবেলার, ছোটবেলায় অমনি ভাবে ছোটরা, বড় হয়ে সব ভুলে যায়।
কিন্তু আমি তো ভুলিনি মা, আমার মনে হয় এই এখনই ভেবেছি বুঝি, আমি তো ভাবি মা,

‘একদিন হাঁটতে হাঁটতে বুড়ি ডিহিঙের ওপারে
বুড়ি ডিহিঙের ওপারে হাঁটতে হাঁটতে সেই পাহাড়ের কোলে।
একদিন হাঁটতে হাঁটতে সে পাহাড়টা পার হয়ে
সুন্দর, সুন্দরের কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা দুজন।
সে বলল, তুই একটুখানি দাঁড়া, এই যাই আর এই আসি। আচ্ছা এসো।
একদিন হাঁটতে হাঁটতে সে আমাকে সুন্দরের কাছে নিয়ে গিয়ে
ফিরব বলে ফেরেনি।
কই তুমি তো এলে না,
আমি দাঁড়িয়ে আছি একা।’

শুনতে শুনতে মায়ের চোখ ছল ছল করতে লাগল, তুই লিখেছিস?
লিখিনি তো মা।
এই যে বললি।
মনে হল তাই বললাম। ঐশী বলে।
আর একবার বল, লিখে রাখি, খুব ভাল হয়েছে ঐশী।
কী বলব আর একবার?
যা বললি।
আর তো বলতে পারব না মা, সব কথা কি দুবার বলা যায়?

চুপ করে গেল নীলিমা। মেয়ে যে গোপনে কবিতা লেখে তা সে জানত না। কিন্তু বিজয় কি কবিতা পছন্দ করে? এখন করবে হয় তো, পরে করবে না। সে নিজেও তো লিখতো। বিয়ের পর ধীরে ধীরে মরেই গেল ইচ্ছে। ঐ যে মেয়ের বাবা বলত, তোমার হয় না কবিতা, পন্ডশ্রম। আর কবিতা লেখার চেয়ে ভাল করে সংসার করা ভাল। মেয়েকে পড়াও, মেয়ের কথা বেশি করে ভাবো। একটু বাদে নীলিমা বলল, কবিতা লিখিস তা বিজয় জানে?

মেয়ে বলল, আমার কে সে যে জানবে ?
সে তোকে যে প্রস্তাব দিয়েছে।
আমি তো কিছু বলিনি মা, আমাকে কতজন প্রস্তাব দিয়েছে, আমি কি বলেছি তাদের কোনও কথা, তারা সাড়া না পেয়ে চুপ করে গেছে।
বিজয় খুব ভাল ছেলে।
আমি জানি মা।
তোর বাবা আমাদের এভাবে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল, বিজয় আমাদের সহায় হবে, ও ছোটবেলায় মা বাবা হারিয়েছে, পিসির কাছে মানুষ।
জানি মা জানি।
তাহলে তুই রাজি হয়ে যা।
সে বলল, না, হয় না মা।
কেন হয় না?

ঐশী চুপ করে থাকে। নীলিমা উঠে গেল। সে বসল অন্য একটি জানালায়। মেয়ের কোনও প্রেমিক আছে বলে সে জানে না। কিন্তু তার তো ছিল। বাবা বলেছিল, ঠিক আছে, অপেক্ষা করব আমরা?

মা বলেছিল, না, কবে সে চাকরি পাবে, কবে সে দাঁড়াবে, আর আমার মেয়ে অপেক্ষা করে করে বুড়ি হবে, দরকার নেই অপেক্ষার। তখন এই বিয়ে। চন্দন সিনহার পৈতৃক প্রকাশন সংস্থা। সে ভেবেছিল খুব উৎসাহ পাবে, তার বই হবে। হয়নি। অনেকদিন বাদে নীলিমার মন খারাপ হয়ে গেল খুব। সেই যে তার ভালবাসার জন, অতীন, কবিতা লিখতে লিখতে, লিখতে লিখতে হারিয়ে গেল। তার নাম সবাই ভুলে গেছে। অথচ সে তো লিখেছিল কিছু আশ্চর্য কবিতা। খুব নাম হয়েছিল তার। কলকাতার বিখ্যাত সব ম্যাগাজিনে ছাপা হত কবিতা। কিন্তু কোথায় যে চলে গেল সে ধীরে ধীরে! জীবন বহমান। স্রোতে ভেসে গেছে সে।

এই যে এই নিঃঝুম অপরাহ্ণ, এ আসে প্রতিদিন। আষাঢ় এসে গেছে কিন্তু বৃষ্টি নেই। ঘোলাটে এক মেঘের নিচে ভেপে যাচ্ছে পৃথিবী। মা মেয়ে দুই জানালায় বসে আছে দু’জন একা একা। এই যে এই বাড়ি, বাড়িটাও আর সব বাড়ির থেকে আলাদা হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছে এখানে। মা মেয়ে আর বাড়িটা পথের দিকে তাকিয়ে। মা ভাবে বিজয় বলে গিয়েছিল, ফোন করবে, করেনি। আসবে বলে গিয়েছিল, আসেনি। তবে এসে যেতে পারে। মেয়ে না পছন্দ করলেও বিজয়ের সঙ্গেই ওর বিয়ে হোক, মা চায় তা। বিজয় ওকে ভালবেসেছে, এর চেয়ে বড় কথা কী হতে পারে? কত মেয়ে বিজয়কে মনে মনে চায়, তার মেয়ে কেন চাইবে না? কত মেয়ে বিজয়কে নিয়ে কত রঙিন স্বপ্নের জাল বোনে, তার মেয়ে কেন তেমন স্বপ্ন দেখবে না? ভাল না বাসিলেও বাসিতে হইবে।

বাড়িটা প্রতিক্ষায় আছে কবে তার নতুন মালিক আসবে। যে লোকটা তাকে গড়ে তুলল সে গেছে নদী পেরিয়ে পাহাড় পেরিয়ে কোথায় কতদূরে! মেয়েটা তাই বলে। কিন্তু লোকটা তো গত পরশু গভীর রাতে এসে ডেকেছিল তাকে, এই আমার কুটির ঘুমোলি?

না তো, কে ডাকছে?
লোকটা বলল, আমি, আমি চন্দন সিনহা।
ফিরে এলে?
না ফিরিনি, বলছি তোর আসল মালিক আসছে শীগগির।
সে তো বউদিমনি আর ঐশী।
না, সে আর একজন, মেয়েমানুষ কি মালিক হতে পারে? যে হবে সে আসছে।
তিনজন তাকিয়ে আছে। পথের বাঁক ঘুরে কে আসে কখন তা দেখেই যাচ্ছে। মেয়ে বিড়বিড় করছে নিজের মনে,
‘পথটা ঠিক ওইখানেতে ঘুরেছে।
যেইখানেতে হারিয়ে গেল সে
সেইখানেতে মুখ দেখাবে আবার।
পথ ওইখানেতে শেষ
ওর পরেতে বুড়ি ডিহিং তার পরেতে ধু ধু
মাঠ-পাহাড় তারপরেতে সুন্দর।
মা বলল, হয় না তা, আমি বললাম হয়।
এই তো দ্যাখো বসে আছি
বসেই আছি
বসেই…’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-buri-dihinger-pare

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *