short-story-chaturtha-raghob

চতুর্থ রাঘব
রাজা ভট্টাচার্য


ভরতের দুই চক্ষু যে মুহূর্তে বাষ্পাকুল হয়ে উঠেছে, তা বুঝতে হনুমানের বিলম্ব হল না৷ তিনি বললেন,“আর্য! ব্যাকুল হবেন না। আর মাত্র কয়েক দণ্ড পরেই প্রভু রামের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটবে।” এই বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভরতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকিয়ে থাকারই কথা, কারণ রাম তাঁকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন— তাঁর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পেয়ে ভরতের মুখভাব কী হয়— তা যেন হনুমান প্রখর চোখে লক্ষ করেন।

ভরত অবশ্য এই ব্যাপারটি স্বভাবতই ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না৷ চৌদ্দ বৎসর রামকে দেখেননি তিনি। চৌদ্দ বৎসর! কোনোক্রমে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাজোচিত শিষ্টাচার রক্ষা করলেন তিনি। অযোধ্যাপতির অপরের সম্মুখে এমন বিহ্বল হয়ে পড়া শোভন নয়।

সবলে উচ্ছ্বসিত আবেগ সংবরণ করলেন ভরত৷ তারপর পাশে দাঁড়ানো সন্ন্যাসীবেশধারী কমকান্তি যুবকটিকে বললেন,“ভ্রাতা! শুনলে? অগ্রজ বনবাস সাঙ্গ করে প্রত্যাগমন করেছেন! জানকী, লক্ষ্মণ— সকলেই সুস্থ আছেন, সবল আছেন! আজ আমাদের চতুর্দশ বর্ষের তপস্যা পূর্ণ হল!”

এতক্ষণে ভরতের পার্শ্বে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন হনুমান। লক্ষই করেননি এঁকে তিনি। এই যুবকের দেহের গঠন ভরতের মতো নয়। ইনি আরও গৌরবর্ণ, দীর্ঘচ্ছন্দ, এঁর ললাট উন্নত। মুহূর্তকাল অবলোকন করেই হনুমান সহসা অনুভব করলেন, প্রায় এই একই রূপধারী অপর কাউকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বহুবার। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে; তিনি এই সৌসাদৃশ্যের তাৎপর্য উন্মোচন করতে পারছেন না৷

সেই যুবকও এতক্ষণ মোহাবিষ্টের ন্যায় হনুমানের কথা শ্রবণ করছিলেন। ভরতের কথায় যেন চেতনা ফিরে পেলেন তিনি৷ কোনোক্রমে, রুদ্ধস্বরে বললেন,“হ্যাঁ, অগ্রজ, আমাদের অতিদীর্ঘ প্রতীক্ষা অবশেষে সফলকাম হল। কুমার রাম ও অন্যান্যরা নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করেছেন— স্বর্গস্থ দেবতারা প্রসন্ন হয়েছেন।”

এইবার হনুমান সহসা বুঝতে পারলেন, প্রায় পূর্ণত একই রূপধারী অপর ব্যক্তিকে তিনি কোথায় দেখেছেন! এই যুবক সন্ন্যাসীর সঙ্গে কুমার লক্ষ্মণের আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। এমন অবিকল প্রতিকৃতির ন্যায় রূপের একটিই অর্থ হতে পারে৷

বিনীত স্বরে হনুমান বললেন,“প্রণাম, কুমার শত্রুঘ্ন!”

শত্রুঘ্ন অকস্মাৎ ঈষৎ চমকিত হলেন, যেন এই অনাড়ম্বর রাজসভায় তিনি প্রথমবার নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনলেন। তারপর আত্মসংবরণ করে তিনি দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করে বললেন,“স্বস্তি, হে পবননন্দন! আপনি দাশরথি শত্রুঘ্নকে আজ ক্রয় করে নিলেন এই সুসংবাদ প্রদান করে।”

স্মিত বিস্ময়ের সঙ্গে ভ্রাতার দিকে তাকালেন ভরত৷ কোনো অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে শত্রুঘ্ন কদাচিত এত কথা বলেন। রামের প্রত্যাবর্তন শত্রুঘ্নকে সত্যই আনন্দিত করেছে, মুখর করে তুলেছে।

শত্রুঘ্ন অবশ্য আর বিলম্ব করলেন না। দ্রুত পদে ভরতের কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। রাম আসছেন! বহু…বহু ব্যবস্থা করতে হবে এইবার। এবং সময় অতিশয় সংক্ষিপ্ত। কাল প্রভাতেই আসবেন রাম। এই কুটির তাঁর অভ্যর্থনার উপযুক্ত স্থান হতে পারে না।

শীঘ্রই শত্রুঘ্নের আহ্বান শুনে ছুটে এসে তাঁকে বেষ্টন করল ভৃত্যরা, সেবকরা। তাদের সুচারুভাবে বিভিন্ন দলে বিন্যস্ত করে শত্রুঘ্ন দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন দ্রুত,“বেশ…কুকুদ— তুমি এই একশত জন কর্মীকে নিয়ে এখনই যাত্রা কর…সমস্ত রাত্রি কাজ করতে হবে…কাল সূর্যোদয়ের পূর্বে এই নন্দিগ্রাম থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত এক ক্রোশ পথ যেন সম্পূর্ণ সমতল হয়ে যায়। উচ্চাবচ না-থাকে যেন— বুঝেছ? আর্য রামের রথ যাবে এই পথ দিয়ে— তোমাদের কর্মের গুরুত্ব বুঝতে পারছ তোমরা? বীতশোক— তুমি অযোধ্যায় যাও। এই দণ্ডেই। সেখানকার মহামাত্যকে সংবাদ দেবে, কালই রাম নগরে প্রবেশ করবেন। সমস্ত রাজপথ যেন সুগন্ধী জল ও ধূপাদি গন্ধদ্রব্য দিয়ে সুরভিত করা হয়। ধৃষ্টি, তুমিও বীতশোকের সঙ্গে যাও। অগ্রজের প্রাসাদে যাবে তুমি। কঞ্চুকিকে আমার নাম করে বলবে…”

দ্রুত যথাযোগ্য ব্যক্তিকে যথাযথ দায়িত্বভার অর্পণ করে চললেন তিনি। কর্ম অনন্ত। সময় নেই। দ্রুততাই বর্তমানে একমাত্র অবলম্বন।

নিজের দ্রুত আদেশদানের ফাঁকে ফাঁকে শত্রুঘ্ন শুনতে পাচ্ছিলেন, হনুমান কুটিরের অভ্যন্তরে বসে ভরতের কাছে সবিস্তারে বলে চলেছেন রাম এবং লক্ষ্মণের আশ্চর্য বিজয়কাহিনী। বনবাস। সীতাহরণ। সুগ্রীব। রাবণ। লঙ্কা। যুদ্ধ। ইন্দ্রজিৎ। রক্তক্ষয়…জয়! শত্রুঘ্ন বুঝতে পারছিলেন— রাম-লক্ষ্মণের এই বিজয়গাথা জম্বুদ্বীপে অমর হয়ে থাকবে।

পলকের জন্য পশ্চাতের কুটিরটির দিকে ফিরে তাকালেন শত্রুঘ্ন। নন্দিগ্রামের উপকণ্ঠে অবস্থিত এই দীনদর্শন পর্ণশালাটি৷ কী আশ্চর্য! ভরত এবং তিনি— কোশলাধিপ, অযোধ্যা-নরেশ দশরথের দুই পুত্র— চৌদ্দ বৎসর অতিবাহিত করে গেলেন এই মৃত্তিকানির্মিত কুটিরে! কোথায় অযোধ্যার সেই তুঙ্গশীর্ষ প্রাসাদ, কোথায় নন্দিগ্রামের এই…

চতুর্দশ বর্ষ কেটে গেল! চৌদ্দ বৎসর!!

বেশ বড়ো হয়ে শত্রুঘ্ন জানতে পেরেছিলেন, লক্ষ্মণ আর তিনি শুধু একে অপরের হুবহু প্রতিরূপ নন! তাঁরা জমজ ভাই! যখন এ কথা মাতা সুমিত্রা তাঁকে বলেন, ততদিনে তিনি ভরতের ছায়াসঙ্গী হয়ে পড়েছেন। অবশ্য তার জন্য কোনো অনুতাপের প্রশ্ন ওঠেনি, কারণ ততদিনে লক্ষ্মণ পরিণত হয়েছেন রামের ছায়াসঙ্গীতে।

রামের মধ্যেই যেন চুম্বক ছিল এক। অবিশ্বাস্য এক আকর্ষণ ছিল তাঁর। শত্রুঘ্ন যে সেই আকর্ষণের বাইরে ছিলেন— এমন নয়। বস্তুত লক্ষ্মণের জন্যই তিনি রামের খুব সন্নিকটে কখনো পৌঁছতে পারেননি। রাম-লক্ষ্মণের চরিত্রেই কিছু অদ্ভুত সাম্য ছিল— দুইজনের মৃগয়াপ্রীতি, শস্ত্রের প্রতি আকর্ষণ, রাজ্যশাসনের স্বাভাবিক ক্ষমতা।

শত্রুঘ্ন এসব থেকে দূরে থাকতে চাইতেন শৈশব থেকেই। নির্জনতা তাঁর নিয়তি ছিল, আর ভরত তাঁর অন্তরের বান্ধব। রাজসভার কোলাহল, রাজ্যশাসনের বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি শত্রুঘ্নকে আকৃষ্ট করেনি কখনো। অযোধ্যা থেকে বহুদূরে, ভরতের মাতুলগৃহ কেকয় রাজ্যে থাকতেই অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন তিনি বরাবর। এখানে তিনি রাজপুত্র হিসাবেই জীবনযাপন করতে পারেন, কিন্তু রাজপুত্রের জটিল কর্তব্য পালন করতে হয় না৷

তখনও তিনি কেকয় রাজ্যেই ছিলেন ভরতের সঙ্গে, যেদিন তাঁকে অতি প্রত্যুষে জাগরিত করা হয়েছিল গভীর নিদ্রা থেকে। অনভ্যস্ত সময়ে নিদ্রোত্থিত হওয়ায় কিছুক্ষণের জন্য যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট মনে হচ্ছিল নিজেকে। সেই নিরতিশয় দুর্বল সময়েই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এক বিচিত্র সংবাদ। অযোধ্যা থেকে দূতেরা এসে পৌঁছেছে সেই ঊষাকালে। ভরতের কাছে তাঁরা নিবেদন করেছে রাজপুরোহিত বশিষ্ঠের অদ্ভুত বার্তা—‘এমন কোনো কর্ম সহসা উপস্থিত— বিলম্বে যা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে৷ যত দ্রুত সম্ভব অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করো— রাজপুত্রদ্বয়!’

এই বার্তার তাৎপর্য পূর্ণত অনুধাবন করতে পারেননি সেদিন কেউই। তীক্ষ্ণবুদ্ধি ভরতও শত্রুঘ্নের মতোই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন; বারংবার কুশল জিজ্ঞাসা করেছিলেন পিতার। শত্রুঘ্ন তাঁর এই অনর্থক ব্যাকুলতার কারণ বুঝতে পারছিলেন না৷ তাঁর প্রশ্নের উত্তরে ভরত প্রিয় ভ্রাতাকে জানিয়েছিলেন— আগের রাত্রেই তিনি এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছেন পিতা দশরথকে নিয়ে৷ তারপরেই এই বিচিত্র বার্তা পাওয়ায় স্বভাবতই উদ্ভ্রান্ত বোধ করছেন তিনি।

চার দিন চার রাতের প্রায়-অবিরাম যাত্রায় তাঁরা ফিরে এসেছিলেন অযোধ্যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের মস্তকে ভেঙে পড়েছিল দুঃসংবাদের পর্বত!

কৈকেয়ীর ভয়ানক প্রার্থনায় দশরথ বাধ্য হয়েছেন রামকে বনবাসে পাঠাতে!

রামের বিচ্ছেদশোক বহন করতে পারেননি পিতা। পরের দিনই মৃত্যু হয়েছে তাঁর৷

কৈকেয়ীর প্রার্থিত দ্বিতীয় বর অনুযায়ী এই রাজ্যের রাজা হবেন ভরত!

কিছুক্ষণের জন্য যেন হতজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন দুই ভ্রাতা। রাম যে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হতে চলেছেন— এই সংবাদটুকুও জ্ঞাত ছিলেন না তাঁরা! আর সেখানে ভরতের রাজ্যপ্রাপ্তি…পিতার মৃত্যুসংবাদ…

প্রাথমিক ক্ষোভে উন্মাদের মতো মন্থরা আর কৈকেয়ীর উপর ফেটে পড়েছিলেন শত্রুঘ্ন। তিনি রাজোচিত স্থৈর্য অভ্যাস করেননি কখনো, ক্ষমাধর্মও তাঁর সেই মুহূর্তে আয়ত্তে ছিল না। ভরতই বরং প্রকৃত অগ্রজের মতো তাঁকে শান্ত করেছেন। তবু…শত্রুঘ্ন জানেন— নারী এবং বয়োবৃদ্ধ না-হলে মন্থরা সম্ভবত সেইদিনই তাঁর হস্তে নিহত হতেন।

তারপর সেই অনুসরণ, অনুসন্ধান। রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার ব্রত নিয়েছিলেন তাঁরা দুইজন। দুজনেই অন্তরে জানতেন— একবার কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হলে রাম বা লক্ষ্মণের মত-পরিবর্তনের সম্ভাবনা প্রায় নেই৷ তবু অসহায় শোকে উদ্ভ্রান্তের মতো তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন বনে৷ ভরদ্বাজের আশ্রমে অসীম অপমান সহ্য করেছিলেন ভরত। প্রত্যাঘাত করেননি প্রবীণ ঋষিকে। সেখান থেকে চিত্রকূট।

প্রত্যাশা মতোই রাম কর্ণপাত করেননি ভরতের আকুল আবেদনে। দুই ভ্রাতা আকুল হয়ে ক্রন্দন করেছেন, রাম পিতার শোকে মূর্ছিত হয়ে গেছেন…কিন্তু অযোধ্যায় ফিরে আসতে সম্মত হননি। ভরতকেই দায়িত্ব দিয়েছেন রাজ্যপালনের৷ বহু উপদেশ দিয়েছেন, সুশাসনের পথ প্রদর্শন করে দিয়েছেন— কিন্তু পিতৃসত্য থেকে চ্যুত হওয়ার কথা বিবেচনা করতেও সম্মত হননি। ব্যর্থকাম হয়ে ফিরে এসেছেন ভরত ও শত্রুঘ্ন।

আর সেইদিনই প্রথম, অরণ্যের শীতল ছায়ায় নির্মিত রামের কুটিরের প্রাঙ্গণে বসে শত্রুঘ্নর একটি অদ্ভুত কথা মনে হয়েছিল।

তাঁকে কেউ লক্ষ করে না কেন? কেন তাঁর চারপাশের মানুষদের আচরণ দেখলে মনে হয়— তাঁর যেন কোনো অস্তিত্ব নেই? যেন তিনি কোনো বায়বীয় পদার্থ? তাঁকে ভেদ করে পশ্চাতের বৃক্ষরাজি, দূরের পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়— কিন্তু তাঁকে কারো চোখে পড়ে না? রাম ভরতের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে ক্রন্দন করলেন, তাঁকে তো আলিঙ্গন করলেন না? কেবল মস্তকে হস্তস্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন, স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করলেন শুধু! আর শত্রুঘ্নের সহোদর, সহোদর কেন— জমজ ভ্রাতা লক্ষ্মণ? একটি বাক্যও বিনিময় হল না দুই ভ্রাতার মধ্যে! কেন এমন হয়? তিনি কি আদৌ আছেন? নাকি প্রকৃতপক্ষে নেই?

সেইদিনই শত্রুঘ্নর জীবনে এক মহাপরিবর্তন এসেছিল। এবং অন্য সবকিছুর মতোই— সেই পরিবর্তনও লক্ষ করেনি কেউ! লক্ষই করেনি— তিনি আর কথা বলছেন না। প্রায় নীরব হয়ে গিয়েছেন তিনি সহসাই। পূর্বেও যে প্রচুর মুখরস্বভাব ছিলেন তিনি, এমন নয়। স্বভাবতই তিনি নীরব ধরনের। কিন্তু এক আকস্মিক গভীর অভিমানে তিনি সেইদিন থেকেই আরও মিতবাক হয়ে পড়লেন। কী বলবেন তিনি? কাকে বলবেন? কেন? কেউ তো তাঁর কথা শোনার অপেক্ষায় নেই! কোনো শ্রোতা তো উৎকর্ণ হয়ে নেই তাঁর মনোভাব বুঝে নেওয়ার জন্য!

আর কী আশ্চর্য, তাঁর ক্বচিৎ সরবতার মতোই তাঁর নীরবতাও ব্যর্থ হল! এমনকি ভরতও লক্ষ করলেন না, তাঁর প্রিয় ভ্রাতাটি নিতান্ত বাধ্য না-হলে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন না সম্প্রতি।

নীরবেই অরণ্য থেকে লোকালয়ে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা—এক বৃহৎ সেনাদল, দশরথের তিন প্রধানা মহিষী, ভরত…এবং শত্রুঘ্ন। মাঝে মাঝে শত্রুঘ্নর সন্দেহ হয়— তিনিও যে এই শোকাতুর দলটির একজন সদস্য— সেটুকুও কেউ লক্ষ করেছে কি?

কেউ তাঁকে আদেশ করেনি, অনুরোধ করেনি। তবু শত্রুঘ্ন স্বেচ্ছাবৃত হয়ে থেকে গিয়েছিলেন ভরতের সঙ্গে। অন্যান্যদের সঙ্গে অযোধ্যায় ফিরে গেলেন না তিনি। থেকে গেলেন নন্দিগ্রামেই। তাও সম্ভবত ভরত ব্যাতিত কেউ লক্ষ করলেন না৷ মাতা সুমিত্রা…শত্রুঘ্নর মাতা…একটিও বাক্যব্যয় করলেন না এই বিষয়ে, যেন ভরতের সঙ্গে শত্রুঘ্ন যে থেকে যাবেন এই পল্লিতে, ত্যাগ করবেন রাজধানী অযোধ্যার সকল নাগরিক সুখ— তাও নিছক পূর্বনির্ধারিত এক স্বাভাবিক ঘটনা। এমনই তো হওয়ার কথা! যেন শত্রুঘ্নর কোনো পৃথক অভিপ্রায় থাকতেই পারে না! থাকতেই পারে না পৃথক কোনো মনোভাব!

এমনকি— এ কোনো ত্যাগও নয়! এই কর্মের কোনো মাহাত্ম্যও নেই! রাজসুখ ত্যাগের জন্য বিন্দুমাত্র প্রশংসা, ঈষন্মাত্র মাহাত্ম্যও প্রাপ্য হয় না শত্রুঘ্নের! ত্যাগী পুরুষ তো ভরত! রাজা হয়েও রাজ্যলক্ষ্মীর প্রসাদ ভোগ করছেন না তিনি! প্রত্যাখ্যান করেছেন অসামান্য চারিত্র্যবল প্রদর্শন করে!

না! তেমন কোনো প্রত্যাশাও অবশ্য ছিল না শত্রুঘ্নর। কবেই বা কোনো কর্মের জন্য প্রশংসা পেয়েছেন তিনি? শাস্ত্রশিক্ষা হোক, শস্ত্রশিক্ষা হোক— কে কবে তাঁর প্রশংসা করেছে? না, আজ আর স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকেন না তিনি। যা করেছেন— সঠিক মনে হয়েছে, উচিত মনে হয়েছে বলেই করেছেন— এইমাত্র।

তারপর কেটে গেছে চতুর্দশ বর্ষ। জীবনের, যৌবনের শ্রেষ্ট বয়সটি তিনি অতিবাহিত করেছেন এই ক্ষুদ্র পল্লিতে— নন্দিগ্রামে৷ ভরতের মতো তিনিও ধারণ করেছেন সন্ন্যাসীবেশ। জটা নির্মাণ করেছেন বটক্ষীর দিয়ে, পরিধান করেছেন চীর৷ ভক্ষণ করেছেন ফলমূল, শয়ন করেছেন ভূমিতে, তৃণশয্যা রচনা করেছেন স্বহস্তে। আর এই ত্যাগ লক্ষ করেনি একজন মানুষও। ধন্য ধন্য করেছেন সকলেই ভরতকে নিয়ে। শত্রুঘ্নও যে স্বেচ্ছায় একই ভবিতব্যকে বরণ করে নিয়েছেন— তা কিন্তু কেউ…যাক। সকল মহৎ কর্ম কি প্রশংসার্হ হয়?

ভুল হল বোধহয়।

সকলের মহৎ কর্মই কি প্রশংসার্হ হয়? না! একই কর্মের জন্য কেউ মহান হয়ে ওঠেন, কেউ থেকে যান চক্ষুর অন্তরালে…উপেক্ষার আড়ালে৷

আজ, চতুর্দশ বর্ষের পরে, যেন নতুন করে পশ্চাতের কুটিরটির দিকে আবার নতুন করে চোখ ফেরালেন শত্রুঘ্ন। এক নিঃসীম কর্মব্যস্ততায় অতিবাহিত হয়ে গেছে বিগত চৌদ্দ বৎসর। রাম নেই, লক্ষ্মণ তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন বনবাসের পথে৷ উত্তর কোশলের নিরাপত্তা তাই এতদিন নিবিড় সংশয়ের মধ্যে ছিল। এই দুই রাজপুত্রই যে এই রাজ্যের সামরিক শক্তির মূল— তা পররাজ্যের গুপ্তচরেরা উত্তমরূপে অবগত আছে৷ তাঁদের অবর্তমানে তাই আকস্মিক আক্রমণের আশঙ্কা ছিল প্রবল। সৌভাগ্যক্রমে সেই আক্রমণ আসেনি বটে; কিন্তু ভরত এবং শত্রুঘ্ন প্রতিদিন অতিবাহিত করেছেন সতর্কতার সঙ্গে। সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি যেন শিথিল না-হয়— এই মনোভাব এতদিন তাঁদের নিশ্চিন্ত হতে দেয়নি৷ তৃণশয্যা অভ্যাস হয়ে যায়, অভ্যাস হয়ে যায় ফলমূলের পরিমিত আহার। কিন্তু কুশাসনের আশঙ্কা কখনো নিশ্চিন্ত হতে দেয়নি তাঁদের। রামকে যেন ফিরে এসে প্রজাদের অভিযোগ শুনতে না হয়— এই ব্রত একসময় গুরুভার হয়ে উঠেছিল। এই কুটির শত্রুঘ্নর সেই অনন্ত নিদ্রাহীন রাত্রির সাক্ষী বটে!

কাল তিনি ফিরে যাবেন অযোধ্যায়৷ অবশেষে শেষ হল সেই দুর্ভার ব্রত! কাল তিনি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনিও। ভরতের মতোই।

প্রসন্ন প্রভাতে এক আশ্চর্য বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে নন্দিগ্রামের উদ্দেশ্যে। এমন দৃশ্য শত্রুঘ্ন কেন— সমগ্র আর্যাবর্তে কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ৷ কুটিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সেই বিচিত্র শোভাযাত্রার দিকে বিষ্ফারিত চক্ষুতে চেয়ে রইলেন শত্রুঘ্ন।

সর্বাগ্রে আসছে একটি অতিকায় বিচিত্রদর্শন রথ। এমন রথ শত্রুঘ্ন কস্মিনকালেও দেখেননি। এর গঠন পৃথক, এর চলন অদৃষ্টপূর্ব। দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সেই রথের আসনে বসে আছেন এক দিব্যগঠন সন্ন্যাসী যুবা। তাঁর শ্যামবর্ণ উজ্জ্বল দেহ থেকে যেন জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

রাম! রাম আসছেন রাজার মতোই!

শত্রুঘ্ন সহসা অনুভব করলেন, তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে বাষ্পে৷ অগ্রজকে তিনি যে এমন অন্তর থেকে ভালোবাসেন— তা তিনি স্বয়ং জানতেন না এতদিন।

গোপনে দ্রুত চক্ষু মার্জনা করে নিলেন শত্রুঘ্ন। প্রকাশ্যে আবেগ প্রদর্শন করার অভ্যাস নেই তাঁর।

রথটি অগ্রসর হচ্ছে এই কুটির লক্ষ্য করেই। এইবার বোঝা যাচ্ছে, সালংকারা সীতা ব্রীড়াবনতা ভঙ্গিতে বসে আছেন স্বামীর পার্শ্বে৷ লক্ষ্মণ ঈষৎ পশ্চাতে দাঁড়িয়ে আছেন রথের উপরেই, তাঁর স্কন্ধে শরাসন ও খড়্গ, কিন্তু হস্তে ছত্র।

আর রথের পাশে পাশে পদব্রজে অগ্রসর হচ্ছে এক বিচিত্র জনমর্দ৷ তাদের সর্বাগ্রে দুই যুবক— পরনের বহুমূল্য বস্ত্র দেখেই বোঝা যায়— তাঁরা উভয়েই নৃপতি। তাঁদের মধ্যে একজন কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘকায়; ইনি নিশ্চিতভাবেই অনার্য৷ অপরজনের গাত্রবর্ণ তাম্রাভ, এঁর বস্ত্রের পশ্চাদ্ভাগে লগ্ন হয়ে আছে একটি বস্ত্রনির্মিত পুচ্ছ।

এঁদের পশ্চাতে এক বিপুল সৈন্যবাহিনী। বিচিত্র তাদের পরিচ্ছদ, বিচিত্র সজ্জা৷ কেউ বানরের ন্যায় নকল পুচ্ছ ধারণ করেছেন, কারোর মুখে ঋক্ষের মুখোশ৷

এই তাহলে রামের সেই লঙ্কাধ্বংসকারী বানরসেনা! সম্মুখবর্তী কৃষ্ণকায় যুবাপুরুষটি নিশ্চিত বিভীষণ, অপরজন সুগ্রীব! গতকাল সন্ধ্যায় এঁদের কথাই বলছিলেন হনুমান! রাক্ষসরাজ ও বানররাজ পদব্রজে আসছেন অযোধ্যা-নরেশ রামের স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনের গৌরবময় মুহূর্তের সাক্ষী হতে!

বিপুল বিস্ময়ে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শত্রুঘ্ন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিকটে এসে পড়ল এই অদ্ভুত শোভাযাত্রা৷ সর্বাগ্রে লক্ষ্মণ নেমে এলেন রথ থেকে। তারপর রাম। এক উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনরোলের মধ্যে ভরত এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে৷ দুই ভ্রাতার অশ্রু মিশে গেল নিবিড় আলিঙ্গনে, প্রণামে আর আশীর্বাদে।

কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন শত্রুঘ্ন। ইতিকর্তব্য স্থির করতে পারলেন না তিনি। রামকে বেষ্টন করেছে অযোধ্যার ঋষিরা। বশিষ্ঠ, জবালা— দশরথের মন্ত্রীরা সকলেই এখন অতিবৃদ্ধ হয়েছেন। তবু এতদিন এঁরাই অযোধ্যার শাসনতন্ত্রকে স্থির রেখেছিলেন। আজ রামের আগমনসংবাদ পেয়ে তাঁরা ছুটে এসেছেন নন্দিগ্রামে৷ এঁদের দাবি সর্বাগ্রে। তারপরে আছেন অন্যান্য মুনিরা এবং শত শত সাধারণ নাগরিক। রামের দীর্ঘ বিচ্ছেদে এঁরা সকলেই মর্মান্তিক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। আজ সেই প্রিয় রাজপুত্রটির প্রত্যাগমনে তাঁরা সকলেই উদ্বেলিত৷ শত্রুঘ্ন সেই জনসংঘের মধ্যে প্রবেশের পথ পেলেন না।

প্রাথমিক আবেগ সংযত হওয়ার পর রামই সহসা লক্ষ করলেন শত্রুঘ্নর অনুপস্থিতি। উচ্চস্বরে তিনি ডেকে উঠলেন,“ভ্রাতা শত্রুঘ্ন! কোথায় তুমি!”

সহসা দেহের মধ্যে এক শিহরণ অনুভব করলেন শত্রুঘ্ন। রামের মনে পড়েছে তাঁর কথা! অবশেষে!

এইবার জনতা বিভক্ত হয়ে পথ করে দিল শত্রুঘ্নকে। আড়ষ্ট পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে রামের নিকটে গিয়ে, ভূমিতে নতজানু হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন তিনি।

কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্কন্ধে হস্তার্পণ করে প্রসন্ন হাস্যে রাম বললেন,“তুমি এমন দূরে দাঁড়িয়ে আছ কেন, শত্রুঘ্ন?”

এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর থাকে না। শত্রুঘ্ন মুখ ফিরিয়ে প্রাণপণে উদ্গত অশ্রু দমন করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

রাম বললেন,“শত্রুঘ্ন! দীর্ঘ চৌদ্দ বৎসর আমরা সকলেই সন্ন্যাসীব্রত পালন করেছি। আজ তার অন্ত হল। চলো, এই বেশ এইবার বিসর্জন দেওয়া যাক!”

সমবেত প্রজামণ্ডলীর মধ্যে এক উল্লসিত মর্মরধ্বনি বয়ে গেল।

একে একে চার ভ্রাতাই বিসর্জন দিলেন কাষায়বর্ণ চীর, বটক্ষীরের সাহায্যে তৈরি করা সুদীর্ঘলালিত জটাজাল৷ রাজবেশ পরিধান করলেন সকলেই৷ আরও একবার বয়ে গেল সেই মর্মরধ্বনি, এবার অবশ্য বিস্ময় প্রকাশ করল তা৷ লক্ষ্মণ আর শত্রুঘ্নর রূপ যে প্রায় নিখুঁতভাবে একইরকম— তা চিরকাল অযোধ্যার প্রজাদের একপ্রকার বিস্মিত আনন্দ দান করে এসেছে৷ আজ একই বর্ণের বস্ত্র সেই আনন্দকে বহুদিন পর আবার তাদের সম্মুখে ফিরিয়ে দিয়েছে।

বিপুল সমারোহের সঙ্গে এবার শোভাযাত্রা অগ্রসর হল অযোধ্যার পথে৷ পথ এখন মসৃণ; গতরাত্রে তার সমস্ত উচ্চাবচে সাম্যবিধান করা হয়েছে, সেচন করা হয়েছে চন্দনবাসিত বারি। প্রকাণ্ড রথটির নাম যে পুষ্পকরথ, এবং তা প্রকৃতপক্ষে কুবেরের সম্পদ— তা জেনে শত্রুঘ্ন মহাবিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলেন। এখন সেই রথে তিনজনের পরিবর্তে আসীন হয়েছেন পাঁচজন। লক্ষ্মণ বীজন করছেন, শত্রুঘ্ন এবার রামের মস্তকে ছত্র ধরেছেন, ভরত স্বয়ং আসীন হয়েছেন সারথির আসনে৷

অযোধ্যার নিকটে আসতেই শত্রুঘ্ন দেখতে পেলেন, সমস্ত রাজধানী যেন একত্রিত হয়েছে তোরণদ্বারের বাইরে৷ নারী-পুরুষ-বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকল প্রজাই আজ বোধকরি নেমে এসেছে পথে। চৌদ্দ বৎসর পর রাম ফিরে আসছেন, এর চেয়ে বৃহৎ কোনো সুসংবাদ এই প্রাসাদখচিত নগরী কখনো পায়নি। আজ শুধু উৎসব। আজ শুধু আনন্দাশ্রু৷

দশরথের প্রাচীন প্রাসাদটিতে নিয়ে যাওয়া হল রাম-সহ সকল ভ্রাতাকে৷ পুণ্য সলিলে অভিষিক্ত হলেন রাম; কম্পিত হস্তে তাঁকে আশীর্বাদ করলেন বৃদ্ধ বশিষ্ঠ, আর স্বহস্তে তাঁর মস্তকে রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন ভরত ও সুগ্রীব।

সমারোহের শেষ হতে রাম এবার যাত্রা করলেন অন্তঃপুরের দিকে। বহু, বহুকাল পর আজ তিনি পুনরায় আপন শয্যায় শয়ন করবেন। অপরাপর ভ্রাতারাও স্ব স্ব প্রাসাদের দিকে যাত্রা করলেন। রাজসভা শূন্য হয়ে গেল।

সহসা যেন চেতনা ফিরে পেলেন শত্রুঘ্ন। দেখলেন, শূন্য রাজসভায় তিনি একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছেন সিংহাসনের পার্শ্বে।

সদ্য-নিদ্রোত্থিত ব্যক্তির ন্যায় তিনি একবার চাইলেন চারিপাশে। ফিরে এসেছেন তিনিও! কত যুগ পরে তিনিও ফিরলেন স্বগৃহে!

ধীর পায়ে নিজের প্রাসাদের দিকে হেঁটে যেতে যেতে সহসা তাঁর মনে হল— তাঁর জন্য কেউ…একজনও অপেক্ষায় ছিল না! তাহলে তিনি ফিরে এলেন কেন? আবাল্য অধিকাংশ সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন সুদূর কেকয়রাজ্যে। ফিরে এলেও ফেরা হয়নি তাঁর, চলে গিয়েছেন নন্দিগ্রামে৷ তাই কি কেউ লক্ষই করেনি— তিনি…শত্রুঘ্ন…দাশরথি শত্রুঘ্ন…যুবরাজ শত্রুঘ্নও আজ প্রত্যাবর্তন করেছেন!

নির্জন হয়ে গিয়েছে প্রাসাদ-সংলগ্ন পথ। বেলা দ্বিপ্রহর। ক্লান্ত পদক্ষেপে আপন প্রাসাদে প্রবেশ করলেন শত্রুঘ্ন। মাতা সুমিত্রা গিয়েছেন মাতা কৌশল্যার প্রাসাদে৷ সেখানে আজ বোধকরি সমস্ত দিন চলবে উৎসব।

এই প্রাসাদটি শূন্য। দাসদাসীরা এগিয়ে এসে শত্রুঘ্নকে অভ্যর্থনা জানাল, জানাল— স্নানাগারে শীতল সলিল তাঁর জন্য অপেক্ষায় আছে।

পুনরায় স্নান সেরে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন তিনি।

আর তখনই প্রথমবারের জন্য তাঁর দৃষ্টিগোচর হল— নিভৃত বিশাল কক্ষটির কেন্দ্রস্থলে রক্ষিত আছে একটি স্বর্ণপাত্র। তাতে একটি সযত্নরচিত মাল্য, একটি চন্দনের ক্ষুদ্র পাত্র।

এর অর্থ সম্যকরূপে বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই তিনি দেখলেন, দক্ষিণপার্শ্বের একটি দ্বার উন্মোচিত হল নিঃশব্দে। সেই পথে কক্ষে প্রবেশ করলেন এক প্রগাঢ়যৌবনা, অপরূপ সুন্দরী নারী।

শ্রুতকীর্তি! তাঁর পত্নী!

শীর্ণা হয়েছে সে সামান্য। চৌদ্দ বছরের অদর্শনের জন্যই এমন মনে হচ্ছে কি— ভাবলেন শত্রুঘ্ন। পরক্ষণেই তাঁর মনে হল— এই নারী, তাঁর পত্নীটিও চতুর্দশ বর্ষের বিরহ সহ্য করেছে নীরবে! সেও তো রাজকন্যা— জনক সীরধ্বজের ভ্রাতা কুশধজের তনয়া— সাংকাশ্যার রাজদুহিতা!

ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে তাঁর কণ্ঠে মাল্য পরিয়ে দিলেন শ্রুতকীর্তি, ললাটে পরিয়ে দিলেন চন্দন। তারপর অতি মৃদু, অশ্রুতপ্রায় স্বরে বললেন,“আপন অন্তঃপুরে আপনাকেই স্বাগত, আর্য!”

অকস্মাৎ তীব্র এক শিহরণে কম্পিত হল শত্রুঘ্নের সর্বাঙ্গ, রোমহর্ষ হল তাঁর।

ভুল ভেবেছিলেন তিনি। কে বলে— তাঁর জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই? আছে! এক উপেক্ষিতা, বিস্মৃত নারী আপন প্রেমের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রেখে নিঃশব্দে প্রতীক্ষায় ছিল নিতান্ত সাধারণ এক মনুষ্যের৷ শত্রুঘ্নের! মহাবীর বলে নয়, প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন রাজপুরুষ বলে নয়!

শুধু স্বামী বলে! অনির্বাণ প্রদীপশিখার তুল্য এক পরম ভালোবাসা জাগ্রত আছে বলে!

কী আশ্চর্য! শ্রুতকীর্তিকে তিনি বিস্মৃত হলেন কী করে! আর তার চেয়েও আশ্চর্য— সেই বিস্মরণ শ্রুতকীর্তিকে স্পর্শমাত্র করল না কোন্ উপায়ে!

বিহ্বলের ন্যায় পত্নীর দিকে দুই বাহু প্রসারিত করে দিলেন শত্রুঘ্ন। উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে ভেঙে পড়তে পড়তে দ্রুত পদে ছুটে এসে স্বামীকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করলেন শ্রুতকীর্তি— এক বিরহিণী নারী!

পরম তৃপ্তির সঙ্গে চোখ বন্ধ করলেন শত্রুঘ্ন। জীবন কাউকে একেবারে শূন্য হস্তে ফিরিয়ে দেয় না৷ প্রেম পৃথিবীর বৃহত্তম রাজ্যখণ্ড! সেই অধিকার যাঁর আছে, সে আর যাই হোক— দরিদ্র নয়!

সেই মহত্তম ঐশ্বর্যের সবটুকু আপন বক্ষে ধারণ করে শত্রুঘ্নর মনে হল— এতক্ষণে তাঁর প্রত্যাবর্তন সম্পূর্ণ হল যেন।

এতক্ষণে অযোধ্যায় ফিরে এলেন চতুর্থ রাঘব!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-chaturtha-raghob

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *