short-story-chayaghera-deuti

ছায়াঘেরা দেউটি
সুস্মিতা নাথ


খবরটা শুনে আমরা থ। যারপরনাই স্তম্ভিত। এতটাই যে, অন্তত মিনিট পাঁচেক আমাদের কারও মুখ দিয়ে কথা বেরোলো না। রাজেশ যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেটা অভাবনীয়। রীতিমতো অবিশ্বাস্য। যে রাজেশ সবার সঙ্গে এবং সব্বাইকে নিয়ে হইহই করে থাকতে ভালোবাসে, সে কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট চলে গেল বৃদ্ধাশ্রমে! তাও আবার প্রভাকে ছেড়ে! রাজেশ ও প্রভার দীর্ঘ বাহান্ন বছরের বিবাহিত জীবন। সুখী দাম্পত্য বলতে যা বোঝায়, ওরা দুজন আমাদের কাছে তারই পারফেক্ট এক্সাম্পল। প্রভা যে এক কালে বেশ সুন্দরী ছিল, সেটা এখনও বেশ বোঝা যায়। এই বয়সেও স্ত্রীকে চোখে হারাত রাজেশ। অথচ এত ভালোবাসাবাসি, এত মিলমিশ, এত সুখের সংসার ছেড়ে কেন এ ডিসিশন নিল রাজেশ? তাও এভাবে হুটহাট? নাকি কিছুই আকস্মিক ঘটেনি! এর প্রস্তুতি কি অনেক আগে থেকেই চলছিল ভেতরে ভেতরে? শুধু আমরাই আজ জানতে পারলাম। সত্যি বলতে কী, আমাদের মন ও মাথা কিচ্ছু কাজ করছে না। কালও তো রাজেশ আড্ডায় এসেছিল। কোনও অসামঞ্জস্য দেখিনি ওর ব্যবহারে। এরপর একটা রাতের মধ্যে কী এমন হয়ে গেল যে, এই সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল? আমরা প্রত্যেকে হতবিমূঢ়।

রাজেশ ছিল আমাদের আড্ডার মধ্যমণি। ছিল বলছি, কারণ খবরটা যদি সত্যি হয়, তা হলে আজ থেকেই রাজেশকে আর আড্ডায় পাচ্ছি না আমরা। সে আমাদের কোনও আগাম সংবাদ না দিয়েই চলে গেছে শহর ছেড়ে। দূরের কোনও বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে। কোন শহর, কোন বৃদ্ধাশ্রম, কিছুই জানায়নি। শুধু মিনিট কয়েক আগে আমাদের প্রত্যেকের ফোনে রাজেশের একটা মেসেজ আসে। মাত্র দুটি বাক্যে সে তার চলে যাওয়ার খবর জানিয়ে আমাদের জন্যে শুভেচ্ছা রেখে গেছে। সত্যি বলতে কী, আমরা কেউ প্রথমে বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম মজা করছে রাজেশ। ওর যা স্বভাব! আমি তো জবাবে লিখেই দিলাম, ‘মস্করা ছাড়, আজ হাঁটতে এলি না কেন বল?’

এর উত্তর এল না। বিশ্ব তখন প্রভাকে ফোন করে। কিন্তু ওপাশ থেকে যখন প্রভার হাউহাউ কান্নার আওয়াজ ভেসে এল, তখন আমরাও যেন শ্বাস ফেলতে ভুলে গেলাম। তখনই দলেবলে ছুটলাম রাজেশদের বাড়িতে। প্রভা কেঁদে ভাসাচ্ছে। কিছুই বলতে পারছে না। রাজেশরা নিঃসন্তান। ফলে রাজেশের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত এই বয়সে প্রভাকে একেবারে একা করে দিল। এ কী করল রাজেশ! আমরা হতবিহ্বল। রাজেশের ফোন সেই থেকে বন্ধ। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না কেউ।

আমার আটাত্তর পার করা জীবনে এত অবাক কখনও হয়নি। রাজেশের এই অদ্ভুত আচরণ এবং আকস্মিক অন্তর্ধান শুধু আমার কেন, রাজেশকে যারা চেনে তাঁদের কারও বোধগম্য হচ্ছে না। কত কী মনে পড়ে যাচ্ছে। রাজেশরা এ শহরে তুলনামূলক ভাবে নতুন। বছর পাঁচ-সাতেক আগে মিত্তিরদের পুরোনো বাড়িটা কিনে, সেটাকেই রেনোভেট করে সাজিয়ে গুছিয়ে ওরা আমাদের রঙ্গনপাড়ার বাসিন্দা হয়। আগে থাকত কোলকাতার টালিগঞ্জে, ফ্ল্যাট বাড়িতে।

এখানে এসে খুব খুশি ছিল রাজেশ ও প্রভা দু’জনেই। রাজেশ বলত, “ফ্ল্যাটবাড়ির আবদ্ধ জীবন থেকে নিজের বাড়িতে খোলামেলা থাকার যে কী সুখ, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আর এর জন্যে পুরো কৃতীত্ব আমি প্রভাকে দিই। সে উদ্যোগ না-নিলে, আর দিনের পর দিন আমাকে তাগাদা না-দিলে এ বাড়িটা কেনাই হত না। আর তোদেরকেও বন্ধু হিসেবে পাওয়া যেত না।”

মিত্তিরদের, অধুনা রাজেশদের ঠিক পেছনের বাড়িটাই আমাদের। আর ওটার তিনটে বাড়ি পরে সন্দীপের বাড়ি। তবে নতুন প্রতিবেশী হলেও পাড়াতে নয়, আমাদের প্রথম আলাপ লেকের ধারে, মর্নিং-ওয়াকে গিয়ে। আর আলাপটা রাজেশই আগবাড়িয়ে এসে করেছিল।

সবাইকে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে রাজেশের। নইলে এই বুড়ো বয়েসে তুই-তোকারির বন্ধুত্ব স্থাপন করা সম্ভব? রাজেশ সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিল। আমরা অর্থাৎ আমি, রঘু, সন্দীপ, অমল, বিশ্ব, তারক, সুজয় বহুদিন থেকেই লেকের পাশে হাঁটতে যেতাম। আমি ও সন্দীপ রঙ্গনপাড়ার হলেও বাকিরা সবাই অন্যান্য পাড়ার বাসিন্দা। রোজ দেখা হতে হতে আমাদের মধ্যে চেনাজানা হয়ে গিয়েছিল। দেখা হলে কুশল বিনিময়, কিংবা দু’-চার কথাও বলতাম। কিন্তু এভাবেই বছরের পর বছর কেটে গেলেও আমাদের মধ্যে এর বেশি হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি। নিজের নিজের হাঁটার কোটা সম্পন্ন হলে যখন বাড়ি ফিরে আসতাম, তখন আর লেকের ধারের কারও কথা মনেই থাকত না।

অবস্থাটা ক’বছর আগে সহসাই পালটে গেল। মিত্তিরবাড়ির নতুন মালিক রাজেশ এসে লেকের ধারের পরিবেশই যেন আমূল বদলে দিল। সবসময় হাসিখুশি ও আলাপি রাজেশ দিন কয়েকের মধ্যেই সেখানে হাঁটতে আসা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলল। দূর থেকে দেখা হলেই হাত তুলে এমন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে “গুড মর্ণিং” বলে উঠত, যেন কতকালের চেনা। এতদিন হাঁটাহাঁটি করলেও, এবং প্রতি সকালে পরস্পরকে দেখলেও যাদের সঙ্গে কখনও কথাও হয়নি, রাজেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল তাদেরও। সে বাচ্চা বুড়ো নারী পুরুষ যে-ই হোক না কেন।

এক রবিবারে সমস্ত প্রাতঃভ্রমণকারীদের মাঠে ডেকে নিল ও। তারপর ঘোষণা করল, “আমরা এখানে যারা রোজ আসছি, তারা এক পরিবারের সদস্য হয়ে গেছি। আমাদের পরিবারের নাম হোক, ‘লেকবন্ধু পরিবার।”

আর কী আশ্চর্য! দাম্ভিক অমিশুকে ভেবে আমরা যাঁদের এড়িয়ে এসেছি এতদিন, সেই লোকগুলো পর্যন্ত সবার সঙ্গে হাত তুলে ‘উত্তম প্রস্তাব’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। আর এরপরেই অদ্ভুত জাদুবলে লেকের ধারের জায়গাটা আমাদের চোখের সামনে স্বর্গে রূপান্তরিত করে ফেলল রাজেশ। প্রতি রবিবারে শরীরচর্চা শেষে সবাই আধধন্টার জন্যে একত্র হই। চা-বিস্কুট খাই। দেদার আড্ডা দিই। গল্পগাছা করি। কেউ গান, কেউ আবৃতিও শোনায়। নানা জায়গা থেকে আসা এতগুলো লোক আপনজন হয়ে ওঠে।

আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ উদযাপন করি। কারও জন্মদিন হলে তাকে ছোটখাটো উপহার দিই। আর এসবের জন্যে প্রতি সদস্যের থেকে মাসে মাসে সামান্য করে চাঁদা তোলা হয়। এবং সেটা সবাই খুব উৎসাহের সঙ্গেই দিয়ে থাকে। কেউ কেউ নির্দিষ্ট অঙ্কের অনেক বেশিও দেয়।

তবে রাজেশের সঙ্গে আমাদের সাতজনের সম্পর্কটা আরও গভীর হল। লেকের ধার ছাড়িয়ে বাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত হল। আমরা সবাই প্রায় সমবয়সী বলেই হয়ত রাজেশও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব খুঁজেছিল। মূলত ওরই জন্যে আমরা আটজন ভিন্নরুচির বুড়ো একত্র হয়ে যাই। আমাদের মাঝের দূরত্ব ও জড়তাগুলো ইরেজারের মতো মুছে দিতে রাজেশ প্রথমেই বলেছিল, “আমরা যেহেতু বন্ধু, সেজন্যে নিজেদের মধ্যে আপনি-তুমি চলবে না। সবাই সবাইকে ‘তুই’ বলব।”

শুধু তাই নয়, রাজেশের উদ্যোগে আমরা সপ্তাহে দু’দিন বিকেলেও আড্ডায় বসতে লাগলাম। আর সেই আড্ডা এক-এক দিন এক-এক জনের বাড়িতে। আট বন্ধুর বাড়িতে ঘুরেফিরে। এই দু’টি দিনের জন্যে আমরা সবাই মুখিয়ে থাকি। কোনও কাজ রাখি না তখন। একেবারে নির্ভেজাল আড্ডা আমাদের। সে যে কী আনন্দ ফূর্তি হয়, বলে বোঝানো যাবে না। আমরা আমাদের বয়সও যেন ভুলে যাই। সিং কেটে বাছুর হয়ে দাপিয়ে বেড়াই সে সময়। এই আড্ডা যে কী পরিমাণ অমূল্য প্রাণবায়ু জোগায়, অভিজ্ঞতা না হলে জানাই হত না। রাজেশ আমাদের আয়ুটাও যেন অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে সবার পরিবারের সঙ্গেও। বিশেষ করে গিন্নিদের সঙ্গে। বিকেলের আড্ডায় আমাদের গিন্নিরাও থাকেন। সন্দীপ বিপত্নিক। ওর ছেলে থাকে আমেরিকায়। ফলে এখানে একার সংসার ওর। ওর বাড়িতে যেদিন আড্ডা বসে, সেদিন আমাদের গিন্নিরাই ওর রান্নাঘরের দখল নিয়ে চা-টা বানিয়ে দেয়। আবার অমলের সঙ্গে ওর স্ত্রী বাণীর সম্পর্কটা ঠিক মধুর নয়। একই বাড়িতে আলাদা থাকে দু’জন। কিন্তু অমলের বন্ধু হয়েও রাজেশ বাণীর মন জয় করে নিয়েছে। অমলের বাড়িতে বসলে বাণী এখন নিজেই উপযাজক হয়ে আমাদের চা-কফি করে খাওয়ায়। সঙ্গে কেক বা সন্দেশও থাকে। আমার বিশ্বাস, এতে ধীরে ধীরে অমল আর বাণীর সম্পর্কের শৈত্যও অনেকটা কেটেছে। যদিও একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় বলে অমলকে কখনও জিজ্ঞেস করতে পারিনি। কেবল আগে যে ওর অভিব্যক্তিতে একটা বিমর্ষ ভাব লেগে থাকত সবসময়, সেটা ইদানীং অনুপস্থিত দেখে মনে হয়, ও আগের চেয়ে ভালো আছে।

আসলে রাজেশ নিজেও হয়তো জানে না যে, ও আমাদের জীবনের লুকোনো চোরা গলিগুলিতেও খোলা বাতাস বইয়ে দিয়েছে। নইলে আমারও কি কম সমস্যা জর্জরিত জীবন ছিল? ছেলে-বৌমার সঙ্গে নিত্য অশান্তিতে জেরবার হয়ে ছিলাম। এক বাড়িতে থেকেও প্রত্যেকে যেন ভিনগ্রহের বাসিন্দা হয়ে থাকতাম। কর্তা-গিন্নি আপ্রাণ চেষ্টা করেও দাম্ভিক বৌমাটিকে আপন করে নিতে পারিনি। ভুল-বোঝাবুঝি লেগেই ছিল। উপরন্তু একমাত্র ছেলেটিই যেন দিন দিন দূরের হয়ে যাচ্ছিল। আমার ও কান্তার দম বন্ধ হয়ে আসত। বেঁচে থাকার ইচ্ছেই চলে গিয়েছিল। এখন বন্ধুদের দলটা পেয়ে যেন নতুন করে বাঁচছি।

উপরন্তু রাজেশ এসে আমাদের বাড়ির গুমোট ভাবটাও অদ্ভুত ভাবে কাটিয়ে দিয়েছে। এর জন্যে ও আলাদা কিছুই করেনি। কেবল আমাদের বাড়িতে যেদিন আড্ডা বসে, রাজেশ এসেই গলা ছেড়ে হাঁক পাড়ে, “আমার রানিমা (বৌমাকে এই সম্বোধনেই ডাকে রাজেশ) কোথায় গেলে? তোমার বুড়ো ছেলেরা এসে গেছি।”

আর এতেই যেন ম্যাজিক ঘটে যায়। বৌমা উপর তলার থেকে নেমে আসে। সবাইকে হাসিমুখে সাদর সম্ভাষণ জানায়। যে মেয়ে শ্বশুরকেও একটিবার চা করে খাওয়ায় না, সে নিজের থেকেই তদারকি করে চা-টিফিন পাঠিয়ে দেয় আড্ডাস্থলে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে বৌমা অনেকটা সহজ হয়ে এল আমাদের সঙ্গেও।

রাজেশের কাছে আমরা তাই নানাভাবেই ঋণী। ও আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে। কিন্তু রাজেশ এটা কী করল?

দিনটা যে কীভাবে কাটল, বলে বোঝানো যাবে না। কতভাবে রাজেশের খোঁজ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফল হয়নি। মোড়ের মুদি দোকানের কানু ওকে শেষ দেখেছে। একটা নীল রঙের ট্রলি নিয়ে রাজেশকে নাকি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে দেখেছে সে। শুনেই বাসস্ট্যান্ডে ছুটে গিয়েছি সবাই। কিন্তু এর বহু আগেই পাখি উড়ে গেছে। আর কেউ কোনও খবরও দিতে পারেনি। প্রায় ছ’ফুটের সুঠাম মানুষটা যেন হাওয়ার মতো উবে গিয়েছে। রাজেশ যদিও স্ব-ইচ্ছেয় চলে গেছে, তবু থানাতেও বিষয়টা জানিয়ে রেখেছি। যে করেই হোক রাজেশকে ফিরিয়ে আনতেই হবে।

এখন রাত বাজে দশটা। কান্তাকে রাজেশের বাড়িতে দিয়ে এসেছি, প্রভার সঙ্গে রাতটা থাকার জন্যে। নইলে এত বড় বাড়িতে প্রভা বেচারি একা থাকবে কী করে? কী যে করল না রাজেশ!

বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না কিছুতেই। এমন সময় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। এত রাতে কার ফোন! ধরব না ধরব না করেও ধরি। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে রাজেশের গলা ভেসে আসে, “ঘুমিয়ে পড়েছিস অমিয়?”

“রাজেশ তুই!” বিস্মর, রাগ ও উচ্ছ্বাসের সম্মিলিত বিস্ফোরণ ঘটে আমার মধ্যে। – “ইউ রাস্কেল। এই বয়েসে এসব কী মস্করা করছিস? জানিস আমাদের কী অবস্থা করেছিস? কেঁদে কেঁদে প্রভার কী হাল হয়েছে খবর নিয়েছিস? …”

এক নিঃশ্বাসে সমস্ত উষ্মা ঢেলি দিই ফোনে। কিন্তু রাজেশ নীরব। আমার বলা শেষ হলে, ও শান্ত স্বরে বলল, “আমার একটা উপকার করবি তোরা? বড় ভরসা করে এই সাহায্যটা চাইছি। আর একমাত্র তোরাই সেটা পারবি।”

রাজেশের স্বরে এমন কিছু ছিল, যাতে আমি থমকে গেলাম। বললাম, “কী সমস্যা রাজেশ? আমরা সবাই তোর পাশে আছি। আমাকে খুলে বল।”

রাজেশ বলল, “কাল-পরশুর মধ্যেই প্রভার কাছে আমার ডিভোর্সের নোটিশ যাবে। তোরা শুধু সন্দীপের সঙ্গে প্রভার বিয়ে দিয়ে দিস।”

“মানে!” চেঁচিয়ে উঠি আমি। আমার কানে যেন কেউ গরম তেল ঢেলে দিয়েছে। এমন কথাও শুনতে হচ্ছে! ধমকে উঠি, “তুই কি পাগল হয়ে গেলি রাজেশ? নাকি মাতাল হয়ে আছিস?”

“কোনওটাই নয় রে অমিয়। যা বলছি সজ্ঞানেই বলছি। সন্দীপের সঙ্গে প্রভার সম্পর্কটা আমাদের বিয়ের থেকেও পুরোনো। ওরা এখনও পরস্পরকে ভালোবাসে। আমি না-বুঝেই ওদের মাঝখানে এতদিন কাঁটার মতো রয়ে গিয়েছিলাম।”

“কী বলছিস রাজেশ!” আমি স্তম্ভিত।

রাজেশ বলে চলল, “বিয়ের পরেই প্রভা আমাকে জানিয়েছিল, ও কাউকে ভালোবাসত। কিন্তু বাড়িতে সে সম্পর্ক কেউ মেনে নেয়নি। সেজন্যেই দেখাশোনা করে আমার সঙ্গে ওকে বিয়ে দেওয়া হয়। আমি তখন সত্যটা সহজেই নিয়েছিলাম। প্রভার অতীত নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। আমি স্ত্রী হিসেবে ওকে শুরু থেকেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম অতীত ভুলে প্রভাও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটা জীবনের বারোয়ানা কাটিয়ে দিয়েও বুঝতে পারিনি। ভাবতেও পারিনি আমার আড়ালে প্রভা ওর প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে।

টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটটা খুব যে খারাপ ছিল, তা নয়। আবাসনের সবার সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতাও গড়ে উঠেছিল। আমরা ওখানে ভালোই ছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর আগে প্রভা হঠাৎই মহানগরীর বাইরে খোলামেলা কোথাও বাড়ি কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করতে শুরু করল। আমি ওকে এতটাই ভালোবাসি যে, ওর ইচ্ছে আমারও পছন্দ হয়ে ওঠে। আমি বললাম, “শান্তিনিকেতন হলে কেমন হয়?”

কিন্তু প্রভা রাজী হল না। বলল, “ওখানেও এখন বড্ড ভিড়।”

এরপরই একদিন বাসু মিত্তিরের বাড়ির খবরটা প্রভাই আমাকে জানায়। ওর নাকি কোন বান্ধবী এ বাড়িটা বিক্রির খবর দিয়েছে। আমরা এখানে আসি বাড়ি দেখতে। পছন্দ হয়। কেনার সিদ্ধান্ত নিই।

টালিগঞ্জ থেকে আসার আগে বাড়ির জিনিসপত্র যখন প্যাকিং হচ্ছিল, তখন পুরোনো ওয়ার্ডরোবের ভেতরে একটা কাগজের প্যাকেট পাই আমি। প্রভা সে সময় আবাসনের মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল। আমি কৌতূহলে সে প্যাকেট খুলি। অবাক হয়ে দেখি ভেতরে অনেকগুলো চিঠি। কিন্তু আমার বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। চিঠিগুলো উল্টেপাল্টে দেখতেই বোঝা গেল, সবই প্রেমপত্র। প্রভাকে লেখা কোনও প্রেমিকের। আরও যেটা আশ্চর্যের, সব ক’টি চিঠিই আমাদের বিয়ের পরে লেখা। প্রেরকের নামের জায়গায় লেখা ‘দীপ’। আমি বিস্ময়ে পাথর হয়ে যাই। কেউ আমাকে জ্যান্ত কবর দিলেও হয়ত এত কষ্ট হত না। আমি প্যাকেটটা লুকিয়ে ফেলি।

এরপর রঙ্গনপাড়ায় আসি। তোদের সঙ্গে আলাপ করি। আমি তক্কে তক্কে থাকতাম। চিঠি কোত্থেকে আসে, এখনও আসে কিনা, গোপনে খোঁজ রাখছিলাম। একবার মনে সন্দেহ ঢুকে গেলে, এর থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। একদিন, প্রভা যখন স্নানে গেছে, তখনই ওর ফোনে একটা মেসেজ ঢোকে। আমি অনুমতি না-নিয়ে কারও ফোন ধরি না। এমনকি প্রভারও নয়। কিন্তু সেদিন হয়ত সন্দেহের বশেই ওর ফোনটা নিয়ে মেসেজটা দেখতে যাই। মেসেজ এসেছে সুরভির থেকে। সুরভি প্রভার ভাইঝির নাম। কিন্তু মেসেজটা দেখে আমি হতভম্ব। এমন প্রেমময় একটা মেসেজ সুরভি ওর পিসিকে পাঠাল! আমার কৌতূহল ও সন্দেহ দুটোই গাঢ় হল। এরপর পুরো মেসেজ খুলি। তখনই আমার চমক বাড়ে। অজস্র মেসেজ, মন দেয়া-নেয়া কথাবার্তায় ভরে আছে চ্যাটবক্স। প্রভার তরফ থেকেও সুরভিকে অজস্র অনুরূপ মেসেজ পাঠানো হয়েছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিত পাঠায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে নম্বরটা টুকে নিজের ফোনে সেভ করে নিতে যাই। আর তখনই দেখি, এটা অলরেডি সন্দীপের নামে সেভ হয়ে আছে আমার ফোনে। বুঝতে বাকি থাকে না, আমাকে ফাঁকি দিতেই সন্দীপের জায়গায় সুরভি নামে নম্বরটা সেভ করেছে প্রভা। সন্দীপই সেই প্রেমিক দীপ।”

“বলছিস কী রাজেশ! আমাদের সন্দীপ?” আমি বিস্ময়ে থ।

“হ্যাঁ, আমাদের সন্দীপ। সন্দীপই প্রভার সেই প্রাক্তন প্রেমিক। বিয়ের পরেও প্রভা ওর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও সম্পর্ক রেখে গিয়েছে। অর্থাৎ দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে প্রভা কখনই মন থেকে আমার হয়নি। বিশ্বাস কর অমিয়, এই ফাঁকি আমি আর নিতে পারলাম না। তাই সরে এলাম। কিন্তু প্রভা এখন একেবারে একা হয়ে গেছে। এই বয়সে একা থাকা অত্যন্ত কঠিন। ওর সুগার, প্রেসার সবই আছে। তাই তোরা সন্দীপ ও প্রভার চার হাত এক করে দে। বাকি জীবনটা অন্তত ওরা একসঙ্গে বাঁচুক।…”

রাজেশ আরও অনেক কথাই বলে চলেছে। কিন্তু আমার কানে আর কিছুই ঢুকছে না। রাজেশের জন্যে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কেবল। সবার জীবনে আলো জ্বেলে দেওয়া মানুষটার নিজের জীবনেই এত অন্ধকার রয়ে গেল! ঠিক যেমন চাঁদের দক্ষিণ প্রান্ত!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-chayaghera-deuti

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *