আফসানা বেগম
কেমিক্যাল চৌধুরীর কথা শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে। বয়সে অনেক বড় হলেও আমার বন্ধুর সঙ্গে তার বন্ধুর মতোই সম্পর্ক। কেমিক্যাল চৌধুরীর কাহিনির আগাগোড়া মনে আছে, তবে এত ঘটনার ঘনঘটায় ভদ্রলোকের আসল নামটাই আর মনে করতে পারি না। ছাত্রজীবনে এরকম দেখেছি যে কর্মগুণে অর্জিত নামের ভীড়ে কারো কারো জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নামটাই যায় হারিয়ে। তানভির রহমান হয়ে গেছে পোড়া মবিল, সাদিয়া আফরোজ হয়ে গেছে সূতাকৃমি, এসব আমার নিজের চোখে দেখা। এখন এদের আসল নাম মনে করতে বেশ অনেকক্ষণ ভাবতে হয়। কেমিক্যাল চৌধুরীর বেলায়ও তাই হচ্ছে। তবে হাজার চেষ্টাতেও তার নামের প্রথম শব্দটা কিছুতেই মনে পড়ছে না, ‘কেমিক্যাল’ সগৌরবে যাকে প্রতিস্থাপন করেছে। যা হোক, তার অধীনস্ত কেমিক্যালগুলোর কথা অবশ্য স্পষ্ট মনে পড়ছে। কবে যেন একদিন আমার বন্ধু এসে বলল, ‘কেমিক্যাল চৌধুরী তো এবার মহা বিপদে পড়েছেন!’
‘কী হলো আবার?’ আমি আঁতকে উঠে বললাম।
‘মাত্র তিন মাস পরে তিনি রিটায়ারমেন্টে যাবেন।’
‘এ তো খুব আনন্দের খবর! পারিবারিক সূত্রে ঢাকায় বাড়ি আছে, টাকাটুকাও শুনেছিলাম ভালোই আছে, ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, আর ভাবনা কী? এখন শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম। আহা, আমি কবে থেকে ওরকম একটা সময়ের জন্য হাঁ করে…’
‘আরে, তোমার কথা আলাদা। তুমি একা মানুষ, কারো ধার ধারতে হবে নাকি তোমাকে? ওনার অবস্থা বড়ো খারাপ। মানে, কেমিক্যাল চৌধুরী প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন যে মাত্র তিন মাস পর থেকে প্রতিটা দিন বউয়ের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হবে। এটা কি ওনার পক্ষে সম্ভব? বেচারা এখন তো অন্তত পাঁচদিন সকাল থেকে বিকেল অব্দি ছুটি পাচ্ছে।’
‘আহা রে, ভারি দজ্জাল বুঝি?’
‘তা অবশ্য বলা মুশকিল, তবে কেমিক্যাল চৌধুরীর নিজের সমস্যাও কি কম? যা হোক, তোমাকে বলেছিলাম কয়েকবার তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। তারপর নানান পরিস্থিতিতে আবার নিজেই বাড়ি ফিরে গেছেন।’
‘তা তিনি বারবার নিজের বাড়ি ছেড়ে নিজেই চলে যান কেন?’
‘সে আছে এক জটিল সমস্যা, যা হোক, এখন নানান ঝামেলা সামলাচ্ছেন।’
আমি ছোট্ট করে ‘ও’ বলে চুপ করে থাকলাম। বন্ধু চলে গেলে কেমিক্যাল চৌধুরীর কথা ভাবছিলাম। তিনি না থাকলে শরীরে কেমিক্যালের নানান প্রভাবের কথা আমার জানাই হতো না। মনে পড়ল, কেমিক্যাল চৌধুরি এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সকালে বউকে বলেছিলেন যে চার্লস ডারউইন আসলে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ নয়, আবিষ্কার করেছিল, ‘সারভাইভাল অব দ্য ইমোশনালি ফিটেস্ট’ থিওরি। বলেছিলেন যে, মানুষ ভালুককে ভয় পায় বলে দৌড়ে পালায়। কিন্তু কী হতো যদি ভয় না পেয়ে হাবাগোবার মতো একখানেই দাঁড়িয়ে থাকত? ভালুক এসে আক্রমণ করত আর মানুষ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। মোট কথা, ভয়ই হলো সেদিনের মানুষ থেকে আজকের মানুষের টিকে থাকার প্রধান কারণ। এসব আসলে হয়েছিল শরীরে এন্ডরফিন হরমোন নিঃসরণের ফলে। কেমিক্যাল চৌধুরীর নিজের শরীরে এই হরমোন তৈরি হয় বলেই নাকি তিনি পরিস্থিতি বুঝে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচেন। নাহলে অনেক আগেই এই পৃথিবীকে তার বিদায় জানাতে হতো। এন্ডরফিনের কার্যকলাপের একটা প্রমাণও তিনি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সেই যুগে এক দ্বীপে ছিল ডোডো নামের একরকমের পাখি। তাদের শিকার করার মতো কেউই সেখানে থাকত না, তাই পাখিগুলো জীবনে ভয় পেতে শেখেনি। সোজা কথায়, তাদের শরীরে এন্ডরফিন তৈরি হবার মতো কোনো পরিস্থিতিই আসেনি। তারপর একদিন যখন কেউ তাদের আক্রমণ করল, তারা উৎসাহী হয়ে মজা দেখার জন্য এগিয়ে গেল। ব্যস, আর যায় কোথায়, ডোডো পাখির বংশ চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য আক্রমণে ভয় পাওয়া খুব জরুরি। কেমিক্যাল চৌধুরী এই বলে কথা শেষ করেছিলেন যে, ‘ভয় না পেলে অনেক আগেই তুমি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে, তাই না? থ্রি চিয়ার্স ফর এন্ডরফিন!’ বউও খেঁকিয়ে উঠেছিলেন, ‘শোনো, আমাকে সারাজীবন এত কষ্ট দেবার পরেও তুমি মনে করো তোমার পিছনে আমি সোনার একটা দামী গুলি নষ্ট করব? তুমি তো ওই গুলি খাবারও যোগ্য নেই আর!’
‘আচ্ছা, এই সারাজীবন কষ্ট দেয়ার কথা তুমি আর কতদিন মনে রাখবে আর বলতেই থাকবে?’
‘বলো কী, মনে রাখব না মানে? তুমি জানো, আলঝেইমারের রোগী নিজের পরিচয় ভুলে গেলেও অতীতের ইমোশনাল আঘাতের কথা ভোলে না, তাহলে আমি কেন ভুলব! এর জন্য তোমাকেও বাকি জীবন কষ্ট পেতে হবে।’
এরপর ঘণ্টাখানেক তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেলে কেমিক্যাল চৌধুরী বারান্দায় মন খারাপ করে বসে ছিলেন। ঘুরঘুর করার ছলে আড়চোখে বউ কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ করেন। শেষে গিয়ে বলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমার দেখি আজ এন্ডরফিন ঠিকঠাকমতো তৈরি হচ্ছে না? এখনো পালিয়ে যাওনি?’
‘কেন যাব নিজের বাড়ি ছেড়ে?’ কেমিক্যাল চৌধুরী সাহস করে বলেন। বউকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলেন, ‘শোনো, তুমি কী মনে করেছ, এন্ডরফিন শুধু ভয় পাওয়ার? এই যে হাজার বিপত্তির পরেও মানুষ টিকে থাকে তার মূলেও তো ওই এন্ডরফিন!’
‘আচ্ছা!’
‘নিশ্চয়। সেই পাথর যুগের কথাই ধরো, মানুষ যখন একের পর এক বিপদ মোকাবেলা করত, খাবারের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করত, তখন তাদের মানসিক বা শারীরিক অবস্থাটা কী হয়েছিল একবার ভেবে দেখ দেখি। এই এন্ডরফিনই তো তাদের ওই সমস্ত ক্লান্তি আর কষ্টের মধ্যেও কেবল দৌড়াতে শিখিয়েছিল। শিখিয়েছিল, শুধু লড়ো আর লড়ো। মানে, এখন আমি যা করছি আর কী।’
‘এখন তুমি তাই করে টিকে আছ?’ বউয়ের বিস্ময় চরমে পৌঁছে।
‘না, মানে, আমি বলছিলাম, আমার অবস্থা প্রাচীন যুগের ওই অভাগাদের মতোই, মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ,’ বলে কেমিক্যাল চৌধুরী লম্বা হাই তুলে শরীরে আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় এলিয়ে পড়েন। ঘুমে চোখ বুজে আসতে থাকলে বিড়বিড় করে বলে নেন, ‘আহা, এন্ডরফিন, আহা! তোমার জন্যই আজ আমি না খেয়ে না দেয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের বিছানায় শান্তিতে ঘুমাতে পারি, আবার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের কথাও ভাবতে পারি। তুমি না থাকলে…’
বউ তার মুখের কাছে ঝুঁকে জানতে চান, ‘কী বললে? কে না থাকলে…? কার নাম নিয়ে বিড়বিড় করছ তুমি? তাই তো বলি, আমার যে কপাল পুড়েছে সে আমি আগেই জানতাম!’
কেমিক্যাল চৌধুরী বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘কী? কী জানতে তুমি?’
‘তুমিই বলো। তলে তলে এত কিছু, তাহলে এখন আমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছ কেন?’
‘মানে? তুমি বললে তুমি জানতে, তাহলে তুমিই বলবে না? শুরু করো। বলো দেখি, আমিও শুনি।’
‘থাক, আর ঢং কোরো না। অনেক হয়েছে। আমি কিছু বুঝি না মনে করো?’ বউয়ের কর্কশ গলা হঠাৎ কেন যেন নরম মনে হয় কেমিক্যাল চৌধুরীর কাছে। মনে হয় বউ কেঁদেই ফেলবে নাকি! তাই তিনি নিজেকে খানিকটা সামলে নেন, ‘আমি বলছিলাম এন্ডরফিনের কথা। এই ধরো, আজ যেখানে আমাদের জীবনে কোনো উটকো ঝামেলা নেই, মানে প্রাচীন কালের মানুষদের মতো পদে পদে নানান অনিশ্চয়তা বা হুমকি তো লেগে নেই, তাই না?’
‘তো? তাতে হয়েছেটা কী?’
‘তাতে হয়েছে কী, এন্ডরফিন আমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে।’
‘ধোঁকা দিচ্ছে! এন্ডরফিন?’
‘হুম। এই মনে করো, আশেপাশে কোনো হুমকি নেই কিন্তু মাথার মধ্যে সবসময় একটা হুমকি হুমকি ভাব জাগিয়ে রাখছে, যেন আমরা আবার বেশি আরামে নষ্ট হয়ে না যাই। যেন ভেবে না নিই যে আমাদের খুব শান্তি। ধরো, তোমার সঙ্গে আমার খুব শান্তি, এটা ভেবে নিয়ে তোমার দিক থেকে হুমকি যে আসতে পারে সেই সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে না দিই।’
‘বুঝেছি। তা, আমার সঙ্গে শান্তি নেই, আছেটা কার সঙ্গে সেটাই সাফ করে বলে ফেল না! কদিন পরেই রিটায়ারমেন্ট, তার সঙ্গে গিয়ে থাকো দেখি কত বড়ো সাহস!’
কেমিক্যাল চৌধুরী বিছানা থেকে লাফিয়ে মেঝেতে নামেন। প্রকাশ না করলেও বউ চমকে ওঠেন তার আচরণ দেখে। মানুষটা সত্যি সত্যি অন্য কারো কাছে চলেই যাবে নাকি! গতিবিধি ভালো ঠেকে না। স্যান্ডেল পরে নিয়ে ঘরে আড়াআড়ি ছয়বার পায়চারি করেন কেমিক্যাল চৌধুরী। হাঁটার গতি কিছু বাড়িয়ে দেন শেষের বারে। বউ পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে থাকেন। অবহেলার সুরে বলেন, ‘তা এখন বাড়ি থেকে বেরোবে মনে হচ্ছে? তার কাছে যাবে?’
‘আরে বাবা, কে? কার কাছে যাব? আমি তো শরীরটাকে একটু দ্রুত নাড়াতে চাচ্ছি কেবল, তাই হাঁটছি।’
‘আশ্চর্য, দিনে-দুপুরে এখনই তুমি ঘুমঘুম ভাব ধরে শুয়ে পড়লে আর এখনই উঠে গিয়ে জোরে জোরে হেঁটে দেখাচ্ছ! বিষয় কী?’ ভাবনায় বউয়ের ভুরু কুঁচকে V অক্ষরের মতো হয়ে যায়।
‘বিষয় খুব সহজ। দ্রুত নড়াচড়া আর শারীরিক কসরত করলে এন্ডরফিন নিঃসরণ হয়, বুঝেছ? ওটা আমার দরকার এখন খুব। তোমার হাত থেকে বাঁচার জন্য দরকার।’
‘জানি তো, ওটাই তোমার লক্ষ্য। আমার হাত থেকে বাঁচা। তা যাবে কার কাছে শুনি? যাও, যাও দেখি কত সুখে থাক।’
বউ মনে হয় কেঁদেই ফেলেছিলেন তখন। কেমিক্যাল চৌধুরী তাই হাঁটা বাদ দিয়ে তার পাশে এসে বসেছিলেন। এমনিতেও ছুটির দিনে সকালে নাস্তার পরে ঘুমঘুম ভাবটাকেই প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করছিল তার। হাঁটতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। তা ছাড়া, বুঝেছিলেন যে হেঁটে লাভ হচ্ছে না। এন্ডরফিন তো তৈরি হচ্ছেই না, বরং এন্ডরফিনের অভাবে যে সমস্যাগুলো হয়, সেসব দেখা দিতে শুরু করেছে। পরিষ্কার টের পাচ্ছিলেন যে তার আর রেগে থাকতে ভালো লাগছে না। বউটাকেও চোখের সামনে বেশ অসহায় দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আদর করে দু’চার কথা বলেন। বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই অবশ্য। নিজের উপরে তাই খানিক বিরক্ত লাগে কেমিক্যাল চৌধুরীর, সব দোষ ওই এন্ডরফিনের, যার অভাবে মুহূর্তে এরকম উলটো চিন্তা তার মাথায় আনাগোনা করছে, যাকে বলে মুড স্যুইং। তিনি বউয়ের ঘাড়ে আলতো করে হাত রেখে বলেন, ‘আচ্ছা, তোমার কি এখন আর অক্সিটোসিন কেমিক্যালটা নিঃসরণ হয় না?’
‘মানে?’ বউয়ের চোখ কপালে উঠে যায়। বউ ব্যস্ত হয়ে ছিলেন যে লোকটা তাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে যখন চলেই যাবে, যাবার আগে মোক্ষম কী কী বলে তার মনোবল ভেঙে দেয়া যায়, সেই ভাবনায়। হঠাৎ ওরকম প্রশ্নে তাই সরু চোখে কেমিক্যাল চৌধুরীর দিকে তাকান।
‘মানে হলো গিয়ে, তুমি তো জানো, অক্সিটোসিনকে তুমি লাভ হরমোনও বলতে পার। ভাবছিলাম, তোমার ঠিক কবে থেকে অক্সিটোসিন নিঃসরণটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।’
বউ অবিশ্বাসের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর তিরিক্ষি মেজাজে চিৎকার করে বলেন, ‘ওসব হরমোন-টরমোন থাকলেও তোমার জন্য আমার কিছু নেই, না-থাকলেও নেই, বুঝেছ? তোমার দোষে তুমি ভালোবাসা পাও না। আর এখন দোষ হরমোনের, না? আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে যে ওটা নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেছে আমার। নাহলে তোমার মতো একটা অপদার্থকে এখনো ভালোবেসে যেতে হতো। শুধু অপদার্থ না, ধোাঁকাবাজও।’
‘মানে? আমি কী ধোঁকাবাজি করেছি বলো তো?’
কেমিক্যাল চৌধুরী অবাক হয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বউ এমন ভাব দেখান যে এটা জানতে চাওয়াও বিরাট অন্যায় হয়েছে। যে ধোঁকা দেয়, এ তো তারই ভালোমতো জানার কথা! রাগে কাঁপতে থাকেন বউ। কেমিক্যাল চৌধুরীও কী করবেন ভেবে পান না। অসহায় লাগে। ওদিকে এত নড়াচড়ার পরেও এন্ডরফিন হরমোনটা নিশ্চয় এখনো তার শরীরে তৈরি হচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত, কারণ, তার কেন যেন প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে আজ না-হয় থাক; আজ ঝগড়া-টগড়া না-করে বরং নিজেরা নিজেরা কিছু কথা বলা যাক। কিছু সুখ-দুঃখের আলাপ কি হতে পারে না? গুনে গুনে প্রত্যেকটা শুক্র-শনি কি একইরকমের খারাপ যায় কারো? অথচ কেমিক্যাল চৌধুরীর যায়। প্রতি মুহূর্তেই ভয় থাকে, এই বুঝি মুখ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার কথা বেরিয়ে পড়ে! আর একবার বলে ফেললে আবার না-বেরিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকাও যায় না। সেটা নিতান্ত অপমানজনক।
এন্ডরফিনের অভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক, কেমিক্যাল চৌধুরীর কিছুতেই রাগ করতে ইচ্ছে করে না। তার বদলে তিনি বউয়ের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। একভাবে তাকিয়ে থাকেন। চোখে মায়ার ভাব আনতে চেষ্টা করেন। মনে মনে ভাবেন, এই এক চোখ, এক চোখ দিয়েই মানুষ কত কত ভাব প্রকাশ করতে পারে! এমনকি ভাষারও দরকার পড়ে না। কত ভাষাভাষী আছে পৃথিবীতে অথচ তাদের চোখের ভাষা একরকম। কারণ চোখ এমন এক অদ্ভুত জিনিস যে মনে মনে মানুষ যা ভাববে, চোখে সঙ্গে সঙ্গে তারই ছবি দেখা যাবে। এটা মাঝেমধ্যে বেশ ঝামেলার। এই যেমন এখন, চোখে ভালোবাসার ভাব আনতে আনতে কেমিক্যাল চৌধুরীর করুণ অবস্থা। তবে একটা সুবিধা হলো মানুষ ভালোবাসার ভাব খুব সহজে অভিনয়ের সাহায্যে এনে ফেলতে পারে। কিন্তু মনের মধ্যে সত্যি সত্যি না ঘটলে, রাগ আর বিব্রত ভাব আনা সবচেয়ে কঠিন। বউয়ের রাগটা শতভাগ খাঁটি তা তিনি ভালোমতই জানেন। তাই ভয়ে ভয়ে বউয়ের চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে থাকেন। বউ খানিকটা পিছনে সরে যান, কেমিক্যাল চৌধুরী আগান। বউ একসময় অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘কী করতে চাচ্ছ বলো তো?’
‘প্রেম ভাব জাগাচ্ছি,’ কেমিক্যাল চৌধুরী তাকিয়েই থাকেন।
‘প্রেম ভাব জাগাচ্ছ মানে? ফাজলামো পেয়েছ?’
‘ফাজলামো হবে কেন? তোমার শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হচ্ছে নাকি বন্ধ হয়ে গেছে, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।’
বউ লাফিয়ে আরেকদিকে সরে যান, ‘সেটা কী করে পরীক্ষা করবে?’
‘এই যে তোমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছি। আমার শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হচ্ছে; তোমার শরীরেও হবার কথা। মানে, যদি তোমার আদৌ হয় আর কী। মানুষ যখন চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে তখন তার শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হয়। আবার ধরো, মানুষ যখন একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে…,’ বলেই কেমিক্যাল চৌধুরী বউয়ের দুই ঘাড়ে হাত রাখেন। বউ পিছনের দিকে ধীরে হাঁটতে থাকেন। কেমিক্যাল চৌধুরী আগান। মাঝারি আকৃতির ঘর কয়েক পদক্ষেপেই ফুরিয়ে যায়। পিঠে দেয়ালের স্পর্শ পেতেই বউয়ের শরীরে ঝাঁকুনি লাগে। কেমিক্যাল চৌধুরী আবেগময় গলায় বলেন, ‘মানুষ যখন একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে তখন অক্সিটোসিন তৈরির হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। দেখ, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখলে তুমি বুঝতে পারবে যে…’
আবেগের ভারে কেমিক্যাল চৌধুরীর হাত বউয়ের ঘাড় থেকে গলার দিকে পিছলে যেতে থাকে। বউ গলার দুদিকে তার হাতের স্পর্শ পেতেই নিজের হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে কেমিক্যাল চৌধুরীর দুই হাত সরিয়ে দেন। তারপর তাকে সামান্য ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে ঘরের আরেক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান। সেখান থেকে চিৎকার করে বলেন, ‘তুমি আমাকে গলা টিপে মারতে চাও? আমি… আমি আজই থানায় ডায়রি করব। আর তুমি মনে করেছ আমি তোমাকে মারতে পারি না? তোমার ওই যে পিস্তলটা আছে, ওটার সোনার গুলিগুলো আমার কাছে। আমি কিন্তু ওটা ঠিকই চালাতে পারব। লাইসেন্স তো তোমার নামে, এক্কেবারে নির্ভুলভাবে আত্মহত্যা সাজিয়ে রাখব, বুঝলে? কারো বাপের সাধ্য হবে না আসল ব্যাপারটা ধরার। আমাকে তুমি এতদিনেও চেননি!’
বউয়ের কথা শুনে কেমিক্যাল চৌধুরীর আত্মা কেঁপে ওঠে। এই বাড়ি ছেড়ে ভেগে না গিয়ে উপায়? এখানে তো শান্তিমতো ঘুমানোও যাবে না। ঘুমিয়ে পড়লে সেটাই হবে শেষ ঘুম। পরের দিন খবরের কাগজে একটা শিরোনাম ঝুলবে, ‘অবসরের পরে একাকিত্বের ভারে শিক্ষকের আত্মহত্যা।’ কেমিক্যাল চৌধুরী নিজেকে সামলে নেন। অবশ্য রেগে না গিয়ে এটা তিনি কেন করছেন সেও তার কাছে এক রহস্য; ওই এন্ডরফিনের অভাব, হাঁ, ওটাই। কেমিক্যাল চৌধুরী ভয়ে ভয়ে সামান্য আগান, ‘শোনো, সৃষ্টির শুরু থেকে, মানুষ একসঙ্গে থাকে কেন? থাকে, কারণ তারা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। এই যেমন আমি তোমাকে, তুমি আমাকে… ভেবে দেখো, মানুষ বরাবর গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকে কেন? সে হলো ওই অক্সিটোসিনের প্রভাব, সেই হিসেবে তুমি অক্সিটোসিনকে একটা ইভোল্যুশনারি কেমিক্যাল বলতে পার। মানে, ওই অক্সিটোসিনই আমাদেরকে বলে যে…’
বউ কয়েক পা লাফিয়ে কিছুটা পিছনে চলে যান। ‘কী বলতে চাও তুমি, তাই বলে সারাজীবন তোমার সঙ্গে আমাকে আটকে থাকতে হবে? ওই অক্সিটোসিনকে পেলে আমি…’
বউ ঘুরে গিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। কেমিক্যাল চৌধুরী হতাশ হয়ে বিছানায় এসে বসেন। তার ধারণা ছিল বউয়ের চোখ ধীরে ধীরে নরম হয়ে যাবে। তিনি যেমন করে জবরদস্তি চোখাচোখি বজায় রাখতে চাচ্ছিলেন তাতে করে অক্সিটোসিন তৈরি না হয়ে তো কোনো উপায় নেই! তার নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কানেই সম্মোহনের মতো শোনাচ্ছিল, যেন কোনো মানসিক চিকিৎসক বলে চলেছেন, নদীর ধারে শীতল বাতাসের মধ্যে গাছের ছায়ায় আপনি শুয়ে পড়েছেন, বাতাস আপনার গায়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে, ক্লান্তি আর আরামে আপনার চোখ বুজে আসছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন, ঘুমিয়ে পড়ছেন, ঘুমিয়ে… কিন্তু নাহ্, বউয়ের উপরে চোখে চোখ রাখা থেকে শুরু করে সম্মোহন, কোনোটাই কোনো ফল দেয়নি। কেমিক্যাল চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করেন। ছুটির দিনের সকাল গেছে, দুপুরটা অন্তত তার মনমতো হোক। পিস্তলের গুলির ভয়টা উড়িয়ে দেয়া না গেলেও ঘুমিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে কেমিক্যাল চৌধুরী ভাবতে থাকেন, অক্সিটোসিনের ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? এত চেষ্টাতেও বউয়ের শরীরে তা তৈরি হচ্ছে না কেন? রোববার ইউনিভার্সিটিতে গিয়েই প্রথমে ওই ব্যাটা ইমতিয়াজকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সে আজকাল অনেককিছুই ভুলভাল বকছে মনে হয়। মনে মনে কেমিক্যাল চৌধুরী হাসেন, ইমতিয়াজও তার মতোই বুড়ো হয়ে গেছে আসলে। বছরতিনেক পরে সেও অবসরে যাবে। তখন ব্যাটা বুঝবে সারাদিন একজনের, মাত্র একজনের সঙ্গে থাকতে কেমন লাগে! কিন্তু তার আগে রোববার তার সঙ্গে এই অক্সিটোসিনের সমাধানটা করে নিতে হবে, ভুল তথ্য সে দিল কেন? কেমিক্যাল চৌধুরীর গল্প শুনতে শুনতে আমি আমার বন্ধুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, কেমিক্যাল চৌধুরী কি কেমিস্ট্রির টিচার?’ সে হেসে বলল, ‘আরে না। উনি তো প্রায় ছত্রিশ বছর ধরে ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ান।’
‘তবে?’
‘তবে কী?’
‘মানে, তাহলে সারাক্ষণ রিঅ্যাকশন, কেমিক্যাল, এসব নিয়ে থাকেন কেন?’
‘বুঝলে না, সায়েন্স পড়তে গিয়ে কিছু কেমিস্ট্রি তো পড়তে হয়েছিলই। তখন ওটা মনে ধরে গেছে। পরে বেশি পড়েছেন ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির ভাণ্ডার রয়ে গেছে অজানা। এখন কথা হলো কেমিস্ট্রির ঘোরে ডোবা একটা মানুষ বিষয়টাতে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কী করবে আর? মানে, তুমি তো জানোই, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী।’
‘হুম।’
‘আসলে ওনার ব্যাপারটা হলো, তিনি মনে করেন মানুষ নিজের ইচ্ছায় বা পরিস্থিতিতে কিছুই করে না। মানুষ যেখানে যা করে তা ওইসমস্ত কেমিক্যালের প্রভাব। তিনি বিশ্বাস করেন, বিচিত্র কেমিক্যালের উপস্থিতি আর পরিমাণের তারতম্যের পারমুটেশন-কম্বিনেশন মানুষের একেকটা ব্যবহারের জন্য দায়ী। পারমুটেশন-কম্বিনেশনের যেমন সীমা নেই তেমনি মানুষের কাজকর্ম আর প্রতিক্রিয়াও নিত্যনতুন।’
‘ব্যাপারটা আসলে কিন্তু অনেকটা তাই। এই যে আমি যা বলছি তা কি আসলে আমি বলছি নাকি বলছে আমার শরীরের কেমিক্যালস,’ আমি হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
‘সে কী, তুমিও!’
‘না না, আমি কেবল তার কথাটা ভাবছিলাম আর কী। যা হোক, তার কি রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল নাকি?’
‘হুম। তাই আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম একদিন। ভাবলাম দেখি কেমন চলছে।’
‘তো কী দেখলে?’
‘ভালোই তো। গিয়ে দেখি বাড়িতে বউ নেই। চৌধুরীর ঘরে জোরে জোরে গান বাজছে, শুনতে শুনতে তিনি ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি করে চকোলেট খাচ্ছেন।’
‘এই বয়সে চকোলেট খাচ্ছেন!’
‘তাই তো দেখলাম। বললেন চকোলেট খেলে শরীর থেকে নাকি সেরোটোনিন রিলিজ হবে, যা তাকে ফুর্তি ফুর্তি ভাব দেবে। তারপর একই গান বারবার বাজিয়ে শোনালেন আমাকে। শেষে দু’হাত সোজা করে ধরে দেখালেন যে গানটা শুনে তার লোম খাড়া হয়ে উঠছে।’
‘সেটা কেন হচ্ছিল?’
‘সেটা হলো গিয়ে ডোপামাইনের কাজ। বললেন গান এমন জিনিস যা উপভোগ করতে হলে আমাদের পুরো মগজটাকে একযোগে কাজ করতে হয়। আর একই প্রিয় গান বারবার শুনলে নাকি ব্রেইন ডোপামাইন রিলিজ করে, যে কারণে লোম কাটা দিয়ে ওঠে। তো, তিনি এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আছেন আর কী। বললেন, চাকরি নেই, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটির বাইরেও এইসমস্ত করার জন্য প্রচুর সময় পাচ্ছেন।’
‘তা ভালো। তবে তুমি কিন্তু তাকে বলবে যে এভাবে মিষ্টি খেলে শুধু সেরোটোনিন না, রক্তে সুগারও বাড়বে। বাই দ্য ওয়ে, তিনি কোন গানটা বারবার শুনছিলেন বলো তো?’
‘ওই যে আছে না, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা, শচীন দেব বর্মনের। ওই যে গানটা হলো গিয়ে, তুমি শুধু তুমি।’
‘তাই? ওটা আমারো খুব প্রিয়!’
বন্ধু চলে গেলে আমি ইউটিউবে শচীনের গানটা বাজিয়ে দিলাম। একবার, দুবার, তিনবার, অসংখ্যবার… আর তাকিয়ে থাকলাম আমার দুই হাতের লোমের দিকে। লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। যখন অন্য কোনো চিন্তায় গানের কলি কানে ঠিক পৌঁছাচ্ছে না, লোমগুলো শুয়ে পড়ছে। তারপর আবার, মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি শুনলেই লোমগুলো সামান্য নড়ে উঠছে। আশ্চর্য, এ তো ভারি মজার ব্যাপার! খাওয়া বা যৌনতার মতো বিষয়ের সঙ্গে ডোপামাইন জড়িত তা জানতাম, তবে ড্রাগ না নিয়ে কফি না খেয়েও শরীরের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে অদ্ভুত ভালো লাগা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কেমিক্যাল চৌধুরীকে আমি মনে মনে ধন্যবাদ জানাতে লাগলাম।
কেমিক্যাল চৌধুরী ঠিক বলেছেন, গানটা শোনার জন্য শুধু কান না, মাথাটাও ভীষণভাবে দরকার পড়ছে। শুনেছি কোকেইনের ক্ষমতা এদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি, একইসঙ্গে ব্রেইনের বারোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। গান কি তাহলে কোকেইনের মতো কাজ করছে আমার মাথায়? এসব ভাবতে ভাবতে নেশা নেশা লাগতে শুরু করল আমার। হঠাৎ গান বাদ দিয়ে টিভি ছাড়লাম। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের দৃশ্য ভেসে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ল, সেনাবাহিনীতে প্রত্যেককে নেয়া হয় তার শারীরিক উচ্চতা, গঠন, শক্তি, এসবের ভিত্তিতে। কিছু জ্ঞানের পরীক্ষাও হয় বটে, কিন্তু কী হবে যদি এমন কেউ ঢুকে পড়ে যার শরীরে এন্ডরফিন বা ডোপামাইন ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে না? সে যদি ভয় পায়? তার মনোবল যদি কম থাকে? কিংবা সে যদি উত্তেজনার পরিবর্তে নির্লিপ্ততায় ভোগে?
চিন্তাগুলোকে পাশ কাটাতে চাইলাম। কিন্তু কী করব, কিমিক্যাল চৌধুরী কেন যেন আমাকে ঘায়েল করে ফেলছেন!
ক’দিন বাদে এমন হলো যে নিজেই কেমিক্যাল চৌধুরির খবর নেয়ার জন্য বন্ধুর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি সে এমনভাবে কাজ করছে যে মনে হচ্ছে ঝিমাচ্ছে। জানতে চাইলাম, ‘রাতে ঘুমাওনি?’
‘আরে আর বোলো না, কেমিক্যাল চৌধুরী আর ওর বউয়ের যন্ত্রণায় কালকের রাতটা মাটি হলো। মোটেও ঘুমাইনি। এদিকে অফিসে ছিল জরুরি কাজ তাই আসতেও হলো।’
‘ও আচ্ছা। তুমি ব্যস্ত, আমি তাহলে আর আজ বসি না বরং…,’ কৌতূহল চেপে বলতে বাধ্য হলাম।
‘না না, একটু বোসো। আমার কাজ শেষ প্রায়, একটু অপেক্ষা করো, কেমিক্যাল চৌধুরীর কাহিনি বলব তোমাকে,’ বন্ধু বলতেই খুশি হলাম। আমি তো কেমিক্যাল চৌধুরীর গল্পই শুনতে এসেছি, সেটা গোপন করে চুপচাপ বসে থাকলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, এই কপট ব্যবহারটা করছি কোন কেমিক্যালের প্রভাবে? কেমিক্যাল চৌধুরীকে পেলে জিজ্ঞাসা করা যেত। অবশ্য আমার বন্ধুর তথ্য অনুযায়ী, কেমিক্যাল চৌধুরীর সমস্ত জিজ্ঞাসার জবাব দেন আরেক অধ্যাপক, ইমতিয়াজ। জিজ্ঞাসা করার জন্য ইমতিয়াজ সাহেবকে পেলে অবশ্য আরো ভালো হতো। তবে কেমিক্যাল চৌধুরী যতই কাজে লাগাক ইমতিয়াজকে, এমনিতে তাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। কারণ ইমতিয়াজ সাহেব হরমোন আর কেমিক্যাল নিয়ে যত তথ্য দেন তার অনেক কিছুই কেমিক্যাল চৌধুরী কাজেকর্মে প্রমাণ করতে পারেন না। ইমতিয়াজ বেচারা সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও দেন আবার পরদিন আচ্ছামতো বকাঝকাও সহ্য করেন।
‘শুনবে কাল রাতে কী হয়েছে?’ কাজ শেষ করে বন্ধু বলল।
রাতে কেমিক্যাল চৌধুরী আধশোয়া হয়ে গান শুনছিলেন। বউ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আচড়াতে বলেন, ‘আমার মুখটা বলিরেখায় ভরে গেল!’
‘এই বয়সে মুখে বলিরেখা সবারই হয়,’ কেমিক্যাল চৌধুরী হয়ত তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলেন। বউ বলেন, ‘কিন্তু সবাই তো আর তা নিয়ে বসে থাকে না। মানুষ বলিরেখা থেকে বাঁচার জন্য কতকিছু করে, সাধারণ ডাক্তারের কাছে যাওয়া তো আছেই, কেউ কেউ বোটক্স ট্রিটমেন্টও করে। চামড়া একেবারে টান টান হয়ে যায়।’
‘খবরদার তুমি ভাববে না ওসব। চামড়া ওরকম টেনে সোজা করলে চেহারা থেকে আবেগ হারিয়ে যায়,’ বলে নিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরী মনে মনে ভাবেন, আবেগ-টাবেগ অবশ্য এমনিতেই তার বউয়ের মুখে আসে না। তবে এটা বললে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে ভেবে তিনি চেপে যান।
‘আমার দরকার টান টান চেহারা। ওসব ইমোশন-টিমোশন দিয়ে কী করব?’ বউ বলেন।
‘বলো কী তুমি, ইমোশন তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ! মানুষের মুখে অন্তত দশ হাজার রকমের ইমোশন দেখা যায়, বুঝেছ? তা ছাড়া, শুধু ইমোশন বর্ণনা করার জন্যই ইংরেজি ভাষায় অন্তত চারশ’ শব্দ আছে। এটাকে তুমি যা তা একটা বিষয় মনে করো?’
‘এত জানো কিন্তু আমার মুখের ইমোশন তো তোমার নজরে আসে না জীবনেও!’
‘তোমার মুখের আবার ইমোশন!’ বলে কেমিক্যাল চৌধুরী হো হো করে হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতে চোখ বুজে যায়। আর ওই হাসিই তার কাল হয়। চোখ খুলে দেখেন মুখের ঠিক সামনে ভয়ঙ্কর মূর্তি। মূর্তির মুখে যা ছিল তা এক ধরনের ইমোশনই বটে। কেমিক্যাল চৌধুরী শুধু কোনোরকমে বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি ভস্ম হয়ে যাব, চোখ সরাও।’ শেষে বলিরেখার জন্য চর্ম বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত বলে-টলে তিনি পার পান। যা হোক, বউয়ের মন ঠিক হলে কেমিক্যাল চৌধুরী ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আলমারিতে যেখানে তোমার গয়নার বাক্সটা থাকত সেখানে দেখছি না যে?’ ব্যস আর যায় কোথায়, বউ হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘আমার গয়নার বাক্সয় নজর পড়েছে কেন তোমার, হুম? কাকে দেবে শুনি?’ তাই শুনে কেমিক্যাল চৌধুরী কাঁচুমাচু হয়ে যান। তিনি আসলে মনে মনে বাক্সটা খুঁজছিলেন এই ভেবে যে পিস্তলের সোনার গুলিগুলো থাকলে ওটার মধ্যেই থাকতে পারে। এত দামী গুলি কি আর বউ যেখানে সেখানে ফেলে রাখবে! ওগুলো হাতিয়ে নেয়া ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। কিন্তু বউয়ের জেরার মুখে গলায় খানিক হতাশার সুর এনে বলতে বাধ্য হন, ‘দেখতাম ছেলের বউ আর মেয়েদেরকে দেয়ার পরে তোমার নিজের বলতে আর কী থাকল, এই আর কী।’ এই কথা শুনে বউয়ের মন নরম হয়। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কী আর থাকবে ওদেরকে দেবার পরে? আছে পড়ে দু’একটা।’
‘সেই আর কী,’ কেমিক্যাল চৌধুরীও একটা সাজানো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে সক্ষম হন। সেই সুযোগে বউ মিষ্টি করে বলেন, ‘তুমি এবারে আমাকে একটা হীরার কানের দুল কিনে দাও না! তাহলে যা গেছে তার দুঃখ ভুলে যাব।’
‘কী বললে, হীরা? দাম জানো? লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে আমি স্রেফ কার্বন কিনব?’
‘কার্বন মানে?’
‘কার্বন মানে কার্বন। হীরা শতভাগ কার্বনে তৈরি। কয়লা যা, হীরাও তা। ওটার পিছনে এত টাকা খরচের মানে হয়? তা ছাড়া…’
‘তা ছাড়া কী?’
‘মানে, হীরা দেখতে ভালো লাগে ফরসা মুখে। মানে, আমি বলতে চাচ্ছি…’
‘বলতে চাচ্ছ আমি কালো? আশ্চর্য, ফরসারাও তো আমাকে কালো বলে না! তোমার কি কোনো বেশি ফরসা মেয়ের সঙ্গে…’ বউ ভাবনায় পড়ে যান। ভাবতে ভাবতে একসময় আর্কিমিডিসের সূত্র খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনা নিয়ে বলেন, ‘তাই তো বলি, এই অসহ্য গরমের মধ্যে চা হাতে নিয়ে পেপার পড়ার ঢং করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় বসে থাক কেন! পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসা সাদাটে মহিলাটা ওই সময়ে অফিসে যায়, তাই না?’
ব্যস, এই শেষ। এর পরে কেমিক্যাল চৌধুরীর পক্ষে আর বেশিক্ষণ চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। তার খানিক পরে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি আমার বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছান। তখন ইতোমধ্যেই বেশ রাত। বন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেমিক্যাল চৌধুরীকেও ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিল। কিন্তু কেমিক্যাল চৌধুরী তো আর সহসা বাড়ি ফিরবেন না, অন্যের বাড়িতে হুট করে গিয়ে লম্বা সময় থাকতে নাকি বাধে তার। তাই সেখান থেকে একটা লুঙ্গি ধার নিয়ে তিনি গিয়ে ওঠেন তার বাড়ির কাছের এক হোটেলে। তাকে হোটেলে রেখে আমার বন্ধু বাড়ি গিয়ে আবারো শুয়ে পড়ে। ওদিকে কেমিক্যাল চৌধুরী হোটেলের ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘরে পায়চারি করতে থাকেন। নাহ্, কোনোভাবেই শরীরে এন্ডরফিন তৈরি হয় না! কী দুঃখজনক! বউয়ের হয় না সেরোটোনিন আর তার হয় না এন্ডরফিন। তার এখন খুশি হওয়া দরকার, ফুর্তি ফুর্তি ভাব আনা দরকার। একটা গান বাজিয়ে দেখলে হয়, সেটাই শেষ চেষ্টা। কেমিক্যাল চৌধুরী গান শুনতে শুরু করেন। আনন্দের গান তার কানে কান্নার মতো লাগে। নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকে ব্যাপারটা। এ কোন হরমোন নিঃসরণ হচ্ছে তার শরীরে? এ তো তার অজানা! ইমতিয়াজ হারামজাদা কি কোনো একটা হরমোনের কথা আমূল চেপে গেছে? এত একা লাগছে কেন? কেনইবা কিছু ভালো লাগছে না! এই ভালো না লাগার হরমোনের নাম কী হতে পারে? কীসে তার নিঃসরণ হয় কে জানে। সঙ্গে কিছু চকোলেট থাকলে ভালো হতো। আর প্যাঁ প্যাঁ করতে থাকা গানটা বন্ধ করা দরকার।
ঘণ্টাখানেক পরে কেমিক্যাল চৌধুরী আমার বন্ধুকে ফোন করে এসব বললে সে তাকে বলে, ‘আপনি বরং সামনের মোড় থেকে কিছু চকোলেট এনে খান। তাতে যদি আপনার সেরোটোনিন রিলিজ হওয়া শুরু হয় আর কী, ওই যে আপনার সুখী হবার কেমিক্যালটা।’
‘তা ঠিক। কিন্তু এত রাতে কি দোকান খোলা থাকবে?’
‘দেখেন, অন্তত ওষুধের দোকান তো খোলা থাকার কথা।’
‘ওষুধের দোকানে চকোলেট পাব?’
‘ভাই, আজকাল ওষুধের কিছু দোকানে শুধু চকোলেট কেন, মুড়ি বা কাপড় কাচার সাবানও পাওয়া যায়।’
‘তাই নাকি!’
কেমিক্যাল চৌধুরী লুঙ্গি হাতে নিয়ে ভাবছিলেন প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরে নেবেন। ঘরে প্যান্ট পরে থাকা তার অপছন্দ। কিন্তু এখন ওষুধের দোকানে যেতে হবে বলে লুঙ্গি রেখে রওনা দেন। রাত একটায়ও ওষুধের দোকান খোলা, শাটার সামান্য নামানো। কথা সত্য, দোকানের দুই তৃতীয়াংশ দেখতে মুদির দোকানের মতো, কী নেই সেখানে! যা হোক, পছন্দ করে কিছু চকোলেট নিয়ে দাম মেটাতে গিয়ে কাউন্টারের পাশের শেলফে তার চোখ পড়ে ঘুমের ওষুধের দিকে। মনে হয় এত বিরক্তি নিয়ে এমনি এমনি ঘুমানো অসম্ভব। ওদিকে সারা রাত বউয়ের একেকটা ডায়ালগ ভেবে ভেবে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকারও মানে হয় না। কেমিক্যাল চৌধুরী তাই অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ কিনে ফেলেন, কে জানে হোটেলে কতদিন থাকতে হয়। গাদাখানেক চকোলেট আর ঘুমের ওষুধ নিয়ে তিনি হোটেলের ঘরে ফিরে আসেন। এসেই আগে লুঙ্গি পরে নেন, তারপর চকোলেট আর পানির বোতল নিয়ে আয়েশ করে বসেন। চকোলেট মুখে দিতে যাবেন ভাবতেই তার সুখি সুখি ভাব জাগতে শুরু করে। ইতিবাচক ব্যাপার, কেমিক্যাল নিঃসরণ শুরু হয়েছে! কিন্তু হাতটা মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ফোন বেজে ওঠে। ‘তুমি কী ভেবেছ, আমি জানি না তুমি কোথায়? ওখানে গিয়ে ঘাড় ধরে তোমাকে টেনে আনতে পারব না?’ বাজখাঁই গলার আওয়াজে কেমিক্যাল চৌধুরীর কেমিক্যাল নিঃসরণটা সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায়। কেমিক্যাল চৌধুরী কোনো কথা না বললেও ওপাশ থেকে আবারো শোনা যায়, ‘কী, কথা বলছ না কেন? তোমার সঙ্গে ওখানে কে আছে বলো তো? কার জন্য কথা বলতে পারছ না, হুম?’ কণ্ঠস্বর খানিক থেমে আবারো বলে, ‘বলবে নাকি আমি নিজেই এসে…’
কেমিক্যাল চৌধুরি ফোন বন্ধ করে ফেলেন। ওটা চালু থাকলে পজিটিভ কোনো কেমিক্যাল নিঃসরণের সামান্য সম্ভাবনাও নেই। কেবল ভালো না লাগার কেমিক্যালে শরীরটা টইটুম্বর হয়ে যাচ্ছে। চকোলেট হাতে নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন, এই হোটেলে যদি সত্যি সত্যি বউ চলে আসে? যদি সত্যিই সমস্ত বোর্ডার আর স্টাফদের সামনে ঘাড় ধরে তাকে করিডোর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়? পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল অব্দি কেঁপে ওঠে তার। তাই ফোন আবার অন করে আমার বন্ধুকে ফোন করে এসব বলেন। রাত দুটোয় বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, ‘আরে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান তো। ঢাকা শহরে কত হোটেল আছে জানেন? সেসব হোটেলে কত রুম আছে, খবর রাখেন? এতকিছুর মধ্যে ওই হোটেলে গিয়ে ঠিক ওই রুমের দরজায় টোকা দিয়ে ভাবি আপনাকে খুঁজে বের করবে মনে করেন?’ এ কথায় কেমিক্যাল চৌধুরীর মন শান্ত হয়। হোটেলের ঘরের চারদিকে তাকান তিনি। বেশ সুন্দর রুমটা, বহুদিন লুকিয়ে থাকার জন্য চমৎকার। ভাবতে না ভাবতেই ফোন আবারো বাজতে থাকে। পাশে পড়ে থাকা ফোনের দিকে চোখ যেতেই ভেসে ওঠে বউয়ের নাম। কেমিক্যাল চৌধুরী ফোন ধরেন না। বেশ কয়েকবার বাজতে বাজতে তারপর একসময় মেসেজ ভেসে ওঠে, ‘দাঁড়াও, আমি আসছি।’
কেমিক্যাল চৌধুরীর সারা শরীরে তখন যেন কী এক কারেন্ট লেগে যায়। নিজেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে খেতে করিডোর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে ওঠেন তিনি। দ্রুত হাতে পানির বোতল খুলে নিয়ে ঘুমের ওষুধগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মন বলে, ওরকমভাবে অপমানিত হবার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। তবু সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মিনিট সময় লাগে। যা হোক, বিদায় পৃথিবী। কেমিক্যাল চৌধুরী একে একে ওষুধের পাতা ছিঁড়ে বের করতে থাকেন। প্রথমে সবগুলো ছিঁড়ে সামনে সাজিয়ে নেন। একেক স্তূপে দুটো করে রাখেন। ছোটো ছোটো ওষুধ, একসঙ্গে দুটো করে গিলে খাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। ঘটনাটা তাড়াতাড়িও ঘটবে তাতে। বেশি সময় নেয়া ঠিক না। কিছু চকোলেট খাওয়া হয়ে গেছে। যদি হুট করে সেরোটোনিন নিঃসরণ শুরু হয়ে যায় তবে আর ঘুমের ওষুধের দিকে হাত যাবে না। পৃথিবী সুন্দর লাগতে শুরু করবে। খামোখাই ফুর্তি ফুর্তি ভাব জেগে উঠবে। আর তখন বউ এসে ঘাড় ধরে করিডোরে সবার সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেও সেটাকে আদর বলে মনে হবে। তাই সেরোটোনিনের সঙ্গে দৌড়ে জেতার জন্য কেমিক্যাল চৌধুরী দ্রুত প্রথম দুটো ট্যাবলেট হাতে নেন। এক এক ঢোকে দুটো করে গেলেন আর থেমে নিয়ে শরীরে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না বুঝতে চেষ্টা করেন। নাহ্, কিছুই বোঝা যায় না। তার শরীরেও কি বউয়ের মতো হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেল নাকি? না এন্ডরফিন, না সেরোটোনিন… কী দুর্ভাগ্য!
তিন নম্বর স্তূপ গেলার পরে চার নম্বরের দিকে হাত বাড়াতেই দরজায় জোরে জোরে কিল ঘুসি পড়তে থাকে। হোটেলের লোকেরা নিশ্চয় কোনো বোর্ডারের ঘরের দরজায় মধ্যরাতে এরকম আঘাত করবে না! কেমিক্যাল চৌধুরীর হাত থেকে পানির বোতল ধীরে ধীরে টেবিলে নামে। পরমুহূর্তে বউয়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘কী হলো, আমি জানি তুমি ঘুমাওনি। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম হয় তোমার? খোলো বলছি এখনই।’ কেমিক্যাল চৌধুরী পাথর হয়ে যান। তার শরীরে এ কোনো পাথর বানানোর হরমোন হবে হয়ত। অজানা হরমোন। ইমতিয়াজ হারামজাদা বলেনি। কিন্তু বউ এখানে এসে পৌঁছল কীভাবে? সে এক রহস্য। হঠাৎ মনে পড়ে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে তার… কী কুক্ষণে যে একদিন রাগের মাথায় কেমিক্যাল চৌধুরী তার বউকে ভয় দেখাবার জন্য বলেছিলেন, ‘শোনো, দিনভর এরকম খ্যাচখ্যাচ করলে আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। ওই হোটেলে গিয়ে উঠব। মরলে ওখানেই মরব।’ আঙুল দিয়ে তাক করে এই হোটেলটা কেমিক্যাল চৌধুরি দেখিয়েও দিয়েছিলেন বউকে। বউ সেদিন রাগ করে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার দৌড় জানা আছে। হোটেলে গেলেও বাড়ির কাছেরটাতেই যেতে হবে! যাও না, পারলে দূরে গিয়ে মরো।’ ভাবতে ভাবতে কেমিক্যাল চৌধুরী চমকে ওঠেন, বউ এলই যখন এই হোটেলে, তিনি যে এখানে আর এই ঘরেই আছেন তা জানতে পারল কীভাবে? তিনি তো নিজের নামে হোটেল বুক করেননি, করেছেন ওই হারামজাদা ইমতিয়াজের নামে। হোটেলে এসে রাত কাটানোর দুর্নাম যা হবার ওই ইমতিয়াজের হোক। যত্তসব ভুলভাল হরমোন জাগানোর পদ্ধতি বলার ফাজলামো বের হোক হারামজাদার।
কিন্তু বউ কী করে এই ঘরের হদিস পেয়ে গেল আর… এইসমস্ত রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে লক ভেঙে দরজাটা এলোমেলোভাবে দুলে দেয়ালে জোরে বাড়ি খায়। বিকট শব্দের পরপরই প্রথমে বউ হাট করে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে আসেন। পিছনে হোটেলের লোকজন। বউ তাকে দেখেও যেন দেখেন না। না দেখার মতো এক ঝলক তাকিয়ে নিয়েই আলমারির কপাট খোলেন, খাটের চাদর উঠিয়ে তলাটা দেখে নেন, তারপর ঢোকেন বাথরুমে। বাথরুম দেখা হলে ফিরে এসে উপর থেকে মেঝে অব্দি গড়াগড়ি করা ভারী পরদাগুলো সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকেন। মুখে বলতে থাকেন, ‘কাকে নিয়ে হোটেলে উঠেছ, হুম? কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? বউয়ের প্রশ্ন জোরে বেজে ওঠে কেমিক্যাল চৌধুরীর কানে। কিন্তু তার পাথরভাব কাটে না। নীরবতার রহস্য ধরার জন্য বউ তখন একবার হয়ত সামান্য ভালোমতো তাকান তার দিকে। তাকিয়েই চমকে ওঠেন, ‘এ কী! এ কার লুঙ্গি পরে বসে আছ তুমি? এ তো দেখি ব্যবহার করা লুঙ্গি। তোমার তো না, নাকি?’ কেমিক্যাল চৌধুরী আমতা আমতা করে লুঙ্গির মালিক, আমার বন্ধুর নাম বলেন, হোটেলে আসার আগে তার বাড়িতে যাবার কথা বলেন। দেখে মনে হয় বউয়ের কানে তা পৌঁছায় না, বউ বলেন, ‘আচ্ছা, লুঙ্গি কি এখানেই কোথাও ছিল? তুমি কি প্রায়ই এই হোটেলের রুমে… ছি ছি ছি আমি আর ভাবতে পারছি না।’ হোটেলের মানুষদের মধ্যে একজন বলে, ‘উনি তো মনে হয় আত্মহত্যা করতেছিলেন, দেখেন কেমন দুনিয়ার ওষুধ বিছাইয়া বসছেন!’ আরেকজন বলে, ‘ভাগ্যিস সময়মতো দরজা ভাঙা হইছিল, নাইলে তো কালকের পেপারে হোটেলের দুর্নাম হইয়া যাইত!’ একজন এগিয়ে গিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরীর সামনে স্তূপ করে রাখা ওষুধগুলো নাড়াচাড়া করে পরীক্ষা করে। ওষুধের ছেঁড়া ছেঁড়া খোসার টুকরো মিলিয়ে নামটা বের করার চেষ্টা করে। নাম পাওয়া মাত্রই ভয়ে ভয়ে জানতে চায়, ‘ভাই, এত্তগুলা যে বিছায়ে রাখছেন, খাইছেন কয়টা?’ কেমিক্যাল চৌধুরী কোনোরকমে উত্তর দেয়, ‘ছয়টা।’
‘সর্বনাশ। মাথা ঘুরতেছে?’
‘না।’
কেমিক্যাল চৌধুরীর মাথা ঘুরছিল না। এতগুলো ওষুধ খাওয়ার পরে হয়ত ঘোরার কথা। নাহলে লোকটা ওরকম উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইত না। কিন্তু ঘুরছে না কেন! ভাবতেই কেমিক্যাল চৌধুরীর খুব হতাশ লাগে, ওষুধও কি তার শরীরে কোনো কেমিক্যালের আধিক্য তৈরি করছে না? তার শরীরের হলোটা কী?
হঠাৎ বউয়ের গলা শোনা যায়, ‘হোটেল বুক করেছ ইমতিয়াজ সাহেবের নামে, সেটা আমি বোর্ডারের লিস্ট দেখেই ধরে ফেলেছি। এখন লুঙ্গির যে গল্পটা বলছ সেটা বিশ্বাস করতে গেলে… ওঠো তুমি, ওঠো তো। চলো, কার বাসা থেকে লুঙ্গি এনেছ সেটা দেখাও আমাকে। চলো।’ রাত তিনটা নাগাদ বউয়ের অদ্ভুত আবদার শুনে অবাক হন কেমিক্যাল চৌধুরী। কিন্তু কোনো উপায় থাকে না। বউয়ের কথা অনুযায়ী আমার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন তারা। সেখানে গিয়ে হয় আরেক বিপত্তি। লুঙ্গি যে আমার বন্ধুরই তার সাক্ষী কে দেবে? কেমিক্যাল চৌধুরীর বউ বিরক্ত হয়ে আমার বন্ধুকে বলেন, ‘একা মানুষ আপনি, ক্রস চেক করার জন্য কার কাছে এই লুঙ্গির ব্যাপারটা জানতে চাই বলেন তো? মুশকিল।’
‘হ্যাঁ, মুশকিল বটে। কিছু করার নেই। আমার কথাই আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। হোটেলে ওঠার আগে উনি আমার এখানে এসেছিলেন। তবে এখন উনি টলছেন, হঠাৎ পড়ে যেতে পারেন। ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে,’ আমার বন্ধু জবাব দেয়। বাড়িটার আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি ফিরিয়ে বউ তখন কেমিক্যাল চৌধুরীর দিকে তাকান। ‘ও আচ্ছা,’ বলে তাকে নিয়ে যখন আমার বন্ধুর বাসা থেকে রওনা দেন তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে।
সারা রাতের কাহিনি শুনে আমি থম মেরে বসে থাকলাম। হায় রে কেমিক্যাল চৌধুরী, আবারো বাড়ি ফিরে যেতে হলো তাকে! চিন্তিত হয়ে বন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম, ‘কিন্তু ভদ্রলোক এখন আছেন কেমন?’
‘কেমন আর, শুনলাম মরার মতো ঘুমাচ্ছেন। এই বয়সে হুট করে এতগুলো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ঠেলা আছে।’
তিন দিন পরে বন্ধু ফোন করে বলল কেমিক্যাল চৌধুরী ঘুম থেকে উঠেছেন। এর মধ্যে নাকি তাকে পাশ ফিরতেও দেখা যায়নি। বউ মাঝেমধ্যে এসে নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখেছেন নিশ্বাস চলছে নাকি। বাতাসের উপস্থিতি পেলে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। তবে তিন দিন পরে কেমিক্যাল চৌধুরী ঘুম থেকে উঠলে কথা যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু হয়। বউ শুরু করেন, বলেন, ‘বুঝলাম লুঙ্গি ওনার কাছ থেকে এনেছ, কিন্তু অতগুলো চকোলেট আর ঘুমের ওষুধ কেন কিনে নিয়ে গেলে? আর কিনলেই যখন ওরকম বাজে কোম্পানির ওষুধ কিনলে কেন? আত্মহত্যার ঢং, না?’
বউয়ের শেষ কথায় কেমিক্যাল চৌধুরীর ঘুম ঘুম ভাবটা শেষ পর্যন্ত কেটেই যায়। তবে এত দুর্বল লাগে যে কোনো উত্তর দেয়া সম্ভব হয় না। তবে মনে মনে ভাবেন যে বউ কথা ঠিকই বলেছে, ভালো জাতের ঘুমের ওষুধ হলে কি ছয়-ছয়টা ওষুধ খেয়েও তিনি বেঁচে থাকতেন? এর একটা বিহিত করা দরকার। শরীরও কেমিক্যাল তৈরি করছে না আর ওদিকে কেনা কেমিক্যালেও ভেজাল। এ তো ভয়ানক অন্যায়। বিছানা থেকে উঠে কোনোরকমে একটু খেয়ে নিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরী ওষুধ কোম্পানির ফোন নম্বর জোগাড় করেন। ওপাশে কোম্পানির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের কোনো তরুণের মার্জিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। কেমিক্যাল চৌধুরী বিরক্তি চেপে যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে আলাপ শুরু করেন, ‘মার্কেটিং না, আমি প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওষুধে ভেজাল প্রসঙ্গে।’
‘জি আপনি আমার সঙ্গেই বলতে পারেন। কোন ওষুধে ভেজাল বলুন তো?’
‘এই যে আপনাদের ঘুমের ওষুধে মেলাটোনিন হরমোনের কথা লেখা আছে, কিন্তু তা ঠিকঠাকমতো কাজ তো করল না। আমি ছয় ছয়টা ওষুধ একসঙ্গে গিলে ফেলেছি কিন্তু… এত বড়ো কোম্পানির নামে আপনারা বাজারে সমানে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করে যাচ্ছেন কেন? আপনাদের বিরুদ্ধে তো…’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি ওই ওষুধ এক সঙ্গে ছয়টা খেয়ে ফেলেছেন? পাঁচ মিলিগ্রামেরটা নাকি দশ?’
‘পাঁচ।’
‘আচ্ছা। তো, আপনার ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?’
‘তা হয়েছে।’
‘কয়দিন ঘুমালেন?’
‘প্রায় তিন দিন।’
‘খুব ভালো। ওষুধটা ঘুমেরই। মেলাটোনিন হরমোন শরীরকে শিথিল করে ঘুম এনে দেবে। আর ধরেন, বেশি খেলে ঘুম একটু বেশি হবে বা সাইড অ্যাফেক্ট হিসেবে একটু ঝাপসা দেখতে পারেন, মাথা ঘোরা ঘোরা বা মুখটা শুকিয়ে যাওয়ার মতো ভাবও হতে পারে। তা আপনার কি হচ্ছে এসব?’
‘মাথাটা সামান্য ঘুরছে।’
‘তিন দিন হয়ে গেছে তো, আজই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু আমার কথা হলো এতগুলো ওষুধ খেয়েও আমি মরলাম না কেন?’
‘কী আশ্চর্য, মরবেন কেন! আমরা তো ওষুধটা পেশেন্টকে মারার জন্য বানাইনি, ঘুম পাড়ানোর জন্য বানিয়েছি। ওষুধে কোনো ভেজাল নেই, আপনার ঘুম ভালো হয়েছে না?’
‘হয়েছে।’
‘ব্যস, তাহলে তো হলোই। তবে এর পরে খেলে একটা করে খাবেন প্লিজ। একটানা তিন দিন না ঘুমিয়ে, একদিন একদিন করে ঘুমালে ভালো না?’
প্রসঙ্গ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে কেমিক্যাল চৌধুরীর আর কথা বলতে ভালো লাগেনি। বরং হঠাৎ করে কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ডোপামাইনের সমস্যা হতে পারে। কেমিক্যাল চৌধুরী নিশ্চিত, কেউ ভালোবাসে না এমন একটা অনুভূতি ডোপামাইনের অভাবেই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এক কাপ চা চেয়ে নিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরী বারান্দায় গিয়ে বসেন। সামনে তিন দিনের খবরের কাগজ। তিনি যেন পৃথিবী থেকে তিন দিন পিছিয়ে গেছেন। হাতে মেলে রাখা পেপারের পিছনে কাকে যেন হেঁটে যেতে দেখা যায়। অতিরিক্ত সাদাটে এক মহিলা, বউ হয়ত এর কথাই বলেছিল, পাশের অ্যাপার্টমেন্টে নতুন উঠেছেন। মহিলা বাড়ির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে রাস্তার একদিকে তাকিয়ে থাকেন, হয়ত কারো অপেক্ষায়। নিঃশব্দ দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরীর কেন যেন হঠাৎ ভালো লাগতে শুরু করে। তিনি চোখ ফেরাতে পারেন না। তার শরীরে কি ডোপামাইন তৈরি শুরু হয়ে গেল? নরম আলোর মধ্যে হুট করে সূর্যের রাগের মতো কটকটে রোদটাকে কেন যেন হঠাৎ করেই আনন্দময় মনে হতে থাকে। সবকিছুই যৌক্তিক লাগে, এমনকি টানা তিন দিন ঘুমিয়ে থাকাকেও। এটুকু বিশ্রাম যেন তার প্রয়োজন ছিল। হঠাৎ মনে পড়ে, ইমতিয়াজ বলেছিল, ‘ডোপামাইন নিজে আপনাকে আনন্দিত করবে না, ডোপামাইন নিঃসরণ হলে আপনি যা করছেন তাতেই আপনার আনন্দ হবে। সবকিছুতেই আনন্দ, বুঝলেন?’
গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সাদাটে মহিলা তাতে উঠে বসেন। এই পুরো দৃশ্যটা অপলক গিলতে থাকেন কেমিক্যাল চৌধুরী। মনে মনে ভাবেন, ইমতিয়াজ নেহায়েত ভুল বলে না।
‘কী হলো আবার?’ আমি আঁতকে উঠে বললাম।
‘মাত্র তিন মাস পরে তিনি রিটায়ারমেন্টে যাবেন।’
‘এ তো খুব আনন্দের খবর! পারিবারিক সূত্রে ঢাকায় বাড়ি আছে, টাকাটুকাও শুনেছিলাম ভালোই আছে, ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, আর ভাবনা কী? এখন শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম। আহা, আমি কবে থেকে ওরকম একটা সময়ের জন্য হাঁ করে…’
‘আরে, তোমার কথা আলাদা। তুমি একা মানুষ, কারো ধার ধারতে হবে নাকি তোমাকে? ওনার অবস্থা বড়ো খারাপ। মানে, কেমিক্যাল চৌধুরী প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন যে মাত্র তিন মাস পর থেকে প্রতিটা দিন বউয়ের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হবে। এটা কি ওনার পক্ষে সম্ভব? বেচারা এখন তো অন্তত পাঁচদিন সকাল থেকে বিকেল অব্দি ছুটি পাচ্ছে।’
‘আহা রে, ভারি দজ্জাল বুঝি?’
‘তা অবশ্য বলা মুশকিল, তবে কেমিক্যাল চৌধুরীর নিজের সমস্যাও কি কম? যা হোক, তোমাকে বলেছিলাম কয়েকবার তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। তারপর নানান পরিস্থিতিতে আবার নিজেই বাড়ি ফিরে গেছেন।’
‘তা তিনি বারবার নিজের বাড়ি ছেড়ে নিজেই চলে যান কেন?’
‘সে আছে এক জটিল সমস্যা, যা হোক, এখন নানান ঝামেলা সামলাচ্ছেন।’
আমি ছোট্ট করে ‘ও’ বলে চুপ করে থাকলাম। বন্ধু চলে গেলে কেমিক্যাল চৌধুরীর কথা ভাবছিলাম। তিনি না থাকলে শরীরে কেমিক্যালের নানান প্রভাবের কথা আমার জানাই হতো না। মনে পড়ল, কেমিক্যাল চৌধুরি এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সকালে বউকে বলেছিলেন যে চার্লস ডারউইন আসলে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ নয়, আবিষ্কার করেছিল, ‘সারভাইভাল অব দ্য ইমোশনালি ফিটেস্ট’ থিওরি। বলেছিলেন যে, মানুষ ভালুককে ভয় পায় বলে দৌড়ে পালায়। কিন্তু কী হতো যদি ভয় না পেয়ে হাবাগোবার মতো একখানেই দাঁড়িয়ে থাকত? ভালুক এসে আক্রমণ করত আর মানুষ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। মোট কথা, ভয়ই হলো সেদিনের মানুষ থেকে আজকের মানুষের টিকে থাকার প্রধান কারণ। এসব আসলে হয়েছিল শরীরে এন্ডরফিন হরমোন নিঃসরণের ফলে। কেমিক্যাল চৌধুরীর নিজের শরীরে এই হরমোন তৈরি হয় বলেই নাকি তিনি পরিস্থিতি বুঝে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচেন। নাহলে অনেক আগেই এই পৃথিবীকে তার বিদায় জানাতে হতো। এন্ডরফিনের কার্যকলাপের একটা প্রমাণও তিনি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সেই যুগে এক দ্বীপে ছিল ডোডো নামের একরকমের পাখি। তাদের শিকার করার মতো কেউই সেখানে থাকত না, তাই পাখিগুলো জীবনে ভয় পেতে শেখেনি। সোজা কথায়, তাদের শরীরে এন্ডরফিন তৈরি হবার মতো কোনো পরিস্থিতিই আসেনি। তারপর একদিন যখন কেউ তাদের আক্রমণ করল, তারা উৎসাহী হয়ে মজা দেখার জন্য এগিয়ে গেল। ব্যস, আর যায় কোথায়, ডোডো পাখির বংশ চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য আক্রমণে ভয় পাওয়া খুব জরুরি। কেমিক্যাল চৌধুরী এই বলে কথা শেষ করেছিলেন যে, ‘ভয় না পেলে অনেক আগেই তুমি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে, তাই না? থ্রি চিয়ার্স ফর এন্ডরফিন!’ বউও খেঁকিয়ে উঠেছিলেন, ‘শোনো, আমাকে সারাজীবন এত কষ্ট দেবার পরেও তুমি মনে করো তোমার পিছনে আমি সোনার একটা দামী গুলি নষ্ট করব? তুমি তো ওই গুলি খাবারও যোগ্য নেই আর!’
‘আচ্ছা, এই সারাজীবন কষ্ট দেয়ার কথা তুমি আর কতদিন মনে রাখবে আর বলতেই থাকবে?’
‘বলো কী, মনে রাখব না মানে? তুমি জানো, আলঝেইমারের রোগী নিজের পরিচয় ভুলে গেলেও অতীতের ইমোশনাল আঘাতের কথা ভোলে না, তাহলে আমি কেন ভুলব! এর জন্য তোমাকেও বাকি জীবন কষ্ট পেতে হবে।’
এরপর ঘণ্টাখানেক তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেলে কেমিক্যাল চৌধুরী বারান্দায় মন খারাপ করে বসে ছিলেন। ঘুরঘুর করার ছলে আড়চোখে বউ কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ করেন। শেষে গিয়ে বলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমার দেখি আজ এন্ডরফিন ঠিকঠাকমতো তৈরি হচ্ছে না? এখনো পালিয়ে যাওনি?’
‘কেন যাব নিজের বাড়ি ছেড়ে?’ কেমিক্যাল চৌধুরী সাহস করে বলেন। বউকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলেন, ‘শোনো, তুমি কী মনে করেছ, এন্ডরফিন শুধু ভয় পাওয়ার? এই যে হাজার বিপত্তির পরেও মানুষ টিকে থাকে তার মূলেও তো ওই এন্ডরফিন!’
‘আচ্ছা!’
‘নিশ্চয়। সেই পাথর যুগের কথাই ধরো, মানুষ যখন একের পর এক বিপদ মোকাবেলা করত, খাবারের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করত, তখন তাদের মানসিক বা শারীরিক অবস্থাটা কী হয়েছিল একবার ভেবে দেখ দেখি। এই এন্ডরফিনই তো তাদের ওই সমস্ত ক্লান্তি আর কষ্টের মধ্যেও কেবল দৌড়াতে শিখিয়েছিল। শিখিয়েছিল, শুধু লড়ো আর লড়ো। মানে, এখন আমি যা করছি আর কী।’
‘এখন তুমি তাই করে টিকে আছ?’ বউয়ের বিস্ময় চরমে পৌঁছে।
‘না, মানে, আমি বলছিলাম, আমার অবস্থা প্রাচীন যুগের ওই অভাগাদের মতোই, মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ,’ বলে কেমিক্যাল চৌধুরী লম্বা হাই তুলে শরীরে আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় এলিয়ে পড়েন। ঘুমে চোখ বুজে আসতে থাকলে বিড়বিড় করে বলে নেন, ‘আহা, এন্ডরফিন, আহা! তোমার জন্যই আজ আমি না খেয়ে না দেয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের বিছানায় শান্তিতে ঘুমাতে পারি, আবার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের কথাও ভাবতে পারি। তুমি না থাকলে…’
বউ তার মুখের কাছে ঝুঁকে জানতে চান, ‘কী বললে? কে না থাকলে…? কার নাম নিয়ে বিড়বিড় করছ তুমি? তাই তো বলি, আমার যে কপাল পুড়েছে সে আমি আগেই জানতাম!’
কেমিক্যাল চৌধুরী বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘কী? কী জানতে তুমি?’
‘তুমিই বলো। তলে তলে এত কিছু, তাহলে এখন আমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছ কেন?’
‘মানে? তুমি বললে তুমি জানতে, তাহলে তুমিই বলবে না? শুরু করো। বলো দেখি, আমিও শুনি।’
‘থাক, আর ঢং কোরো না। অনেক হয়েছে। আমি কিছু বুঝি না মনে করো?’ বউয়ের কর্কশ গলা হঠাৎ কেন যেন নরম মনে হয় কেমিক্যাল চৌধুরীর কাছে। মনে হয় বউ কেঁদেই ফেলবে নাকি! তাই তিনি নিজেকে খানিকটা সামলে নেন, ‘আমি বলছিলাম এন্ডরফিনের কথা। এই ধরো, আজ যেখানে আমাদের জীবনে কোনো উটকো ঝামেলা নেই, মানে প্রাচীন কালের মানুষদের মতো পদে পদে নানান অনিশ্চয়তা বা হুমকি তো লেগে নেই, তাই না?’
‘তো? তাতে হয়েছেটা কী?’
‘তাতে হয়েছে কী, এন্ডরফিন আমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে।’
‘ধোঁকা দিচ্ছে! এন্ডরফিন?’
‘হুম। এই মনে করো, আশেপাশে কোনো হুমকি নেই কিন্তু মাথার মধ্যে সবসময় একটা হুমকি হুমকি ভাব জাগিয়ে রাখছে, যেন আমরা আবার বেশি আরামে নষ্ট হয়ে না যাই। যেন ভেবে না নিই যে আমাদের খুব শান্তি। ধরো, তোমার সঙ্গে আমার খুব শান্তি, এটা ভেবে নিয়ে তোমার দিক থেকে হুমকি যে আসতে পারে সেই সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে না দিই।’
‘বুঝেছি। তা, আমার সঙ্গে শান্তি নেই, আছেটা কার সঙ্গে সেটাই সাফ করে বলে ফেল না! কদিন পরেই রিটায়ারমেন্ট, তার সঙ্গে গিয়ে থাকো দেখি কত বড়ো সাহস!’
কেমিক্যাল চৌধুরী বিছানা থেকে লাফিয়ে মেঝেতে নামেন। প্রকাশ না করলেও বউ চমকে ওঠেন তার আচরণ দেখে। মানুষটা সত্যি সত্যি অন্য কারো কাছে চলেই যাবে নাকি! গতিবিধি ভালো ঠেকে না। স্যান্ডেল পরে নিয়ে ঘরে আড়াআড়ি ছয়বার পায়চারি করেন কেমিক্যাল চৌধুরী। হাঁটার গতি কিছু বাড়িয়ে দেন শেষের বারে। বউ পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে থাকেন। অবহেলার সুরে বলেন, ‘তা এখন বাড়ি থেকে বেরোবে মনে হচ্ছে? তার কাছে যাবে?’
‘আরে বাবা, কে? কার কাছে যাব? আমি তো শরীরটাকে একটু দ্রুত নাড়াতে চাচ্ছি কেবল, তাই হাঁটছি।’
‘আশ্চর্য, দিনে-দুপুরে এখনই তুমি ঘুমঘুম ভাব ধরে শুয়ে পড়লে আর এখনই উঠে গিয়ে জোরে জোরে হেঁটে দেখাচ্ছ! বিষয় কী?’ ভাবনায় বউয়ের ভুরু কুঁচকে V অক্ষরের মতো হয়ে যায়।
‘বিষয় খুব সহজ। দ্রুত নড়াচড়া আর শারীরিক কসরত করলে এন্ডরফিন নিঃসরণ হয়, বুঝেছ? ওটা আমার দরকার এখন খুব। তোমার হাত থেকে বাঁচার জন্য দরকার।’
‘জানি তো, ওটাই তোমার লক্ষ্য। আমার হাত থেকে বাঁচা। তা যাবে কার কাছে শুনি? যাও, যাও দেখি কত সুখে থাক।’
বউ মনে হয় কেঁদেই ফেলেছিলেন তখন। কেমিক্যাল চৌধুরী তাই হাঁটা বাদ দিয়ে তার পাশে এসে বসেছিলেন। এমনিতেও ছুটির দিনে সকালে নাস্তার পরে ঘুমঘুম ভাবটাকেই প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করছিল তার। হাঁটতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। তা ছাড়া, বুঝেছিলেন যে হেঁটে লাভ হচ্ছে না। এন্ডরফিন তো তৈরি হচ্ছেই না, বরং এন্ডরফিনের অভাবে যে সমস্যাগুলো হয়, সেসব দেখা দিতে শুরু করেছে। পরিষ্কার টের পাচ্ছিলেন যে তার আর রেগে থাকতে ভালো লাগছে না। বউটাকেও চোখের সামনে বেশ অসহায় দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আদর করে দু’চার কথা বলেন। বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই অবশ্য। নিজের উপরে তাই খানিক বিরক্ত লাগে কেমিক্যাল চৌধুরীর, সব দোষ ওই এন্ডরফিনের, যার অভাবে মুহূর্তে এরকম উলটো চিন্তা তার মাথায় আনাগোনা করছে, যাকে বলে মুড স্যুইং। তিনি বউয়ের ঘাড়ে আলতো করে হাত রেখে বলেন, ‘আচ্ছা, তোমার কি এখন আর অক্সিটোসিন কেমিক্যালটা নিঃসরণ হয় না?’
‘মানে?’ বউয়ের চোখ কপালে উঠে যায়। বউ ব্যস্ত হয়ে ছিলেন যে লোকটা তাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে যখন চলেই যাবে, যাবার আগে মোক্ষম কী কী বলে তার মনোবল ভেঙে দেয়া যায়, সেই ভাবনায়। হঠাৎ ওরকম প্রশ্নে তাই সরু চোখে কেমিক্যাল চৌধুরীর দিকে তাকান।
‘মানে হলো গিয়ে, তুমি তো জানো, অক্সিটোসিনকে তুমি লাভ হরমোনও বলতে পার। ভাবছিলাম, তোমার ঠিক কবে থেকে অক্সিটোসিন নিঃসরণটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।’
বউ অবিশ্বাসের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর তিরিক্ষি মেজাজে চিৎকার করে বলেন, ‘ওসব হরমোন-টরমোন থাকলেও তোমার জন্য আমার কিছু নেই, না-থাকলেও নেই, বুঝেছ? তোমার দোষে তুমি ভালোবাসা পাও না। আর এখন দোষ হরমোনের, না? আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে যে ওটা নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেছে আমার। নাহলে তোমার মতো একটা অপদার্থকে এখনো ভালোবেসে যেতে হতো। শুধু অপদার্থ না, ধোাঁকাবাজও।’
‘মানে? আমি কী ধোঁকাবাজি করেছি বলো তো?’
কেমিক্যাল চৌধুরী অবাক হয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বউ এমন ভাব দেখান যে এটা জানতে চাওয়াও বিরাট অন্যায় হয়েছে। যে ধোঁকা দেয়, এ তো তারই ভালোমতো জানার কথা! রাগে কাঁপতে থাকেন বউ। কেমিক্যাল চৌধুরীও কী করবেন ভেবে পান না। অসহায় লাগে। ওদিকে এত নড়াচড়ার পরেও এন্ডরফিন হরমোনটা নিশ্চয় এখনো তার শরীরে তৈরি হচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত, কারণ, তার কেন যেন প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে আজ না-হয় থাক; আজ ঝগড়া-টগড়া না-করে বরং নিজেরা নিজেরা কিছু কথা বলা যাক। কিছু সুখ-দুঃখের আলাপ কি হতে পারে না? গুনে গুনে প্রত্যেকটা শুক্র-শনি কি একইরকমের খারাপ যায় কারো? অথচ কেমিক্যাল চৌধুরীর যায়। প্রতি মুহূর্তেই ভয় থাকে, এই বুঝি মুখ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার কথা বেরিয়ে পড়ে! আর একবার বলে ফেললে আবার না-বেরিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকাও যায় না। সেটা নিতান্ত অপমানজনক।
এন্ডরফিনের অভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক, কেমিক্যাল চৌধুরীর কিছুতেই রাগ করতে ইচ্ছে করে না। তার বদলে তিনি বউয়ের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। একভাবে তাকিয়ে থাকেন। চোখে মায়ার ভাব আনতে চেষ্টা করেন। মনে মনে ভাবেন, এই এক চোখ, এক চোখ দিয়েই মানুষ কত কত ভাব প্রকাশ করতে পারে! এমনকি ভাষারও দরকার পড়ে না। কত ভাষাভাষী আছে পৃথিবীতে অথচ তাদের চোখের ভাষা একরকম। কারণ চোখ এমন এক অদ্ভুত জিনিস যে মনে মনে মানুষ যা ভাববে, চোখে সঙ্গে সঙ্গে তারই ছবি দেখা যাবে। এটা মাঝেমধ্যে বেশ ঝামেলার। এই যেমন এখন, চোখে ভালোবাসার ভাব আনতে আনতে কেমিক্যাল চৌধুরীর করুণ অবস্থা। তবে একটা সুবিধা হলো মানুষ ভালোবাসার ভাব খুব সহজে অভিনয়ের সাহায্যে এনে ফেলতে পারে। কিন্তু মনের মধ্যে সত্যি সত্যি না ঘটলে, রাগ আর বিব্রত ভাব আনা সবচেয়ে কঠিন। বউয়ের রাগটা শতভাগ খাঁটি তা তিনি ভালোমতই জানেন। তাই ভয়ে ভয়ে বউয়ের চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে থাকেন। বউ খানিকটা পিছনে সরে যান, কেমিক্যাল চৌধুরী আগান। বউ একসময় অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘কী করতে চাচ্ছ বলো তো?’
‘প্রেম ভাব জাগাচ্ছি,’ কেমিক্যাল চৌধুরী তাকিয়েই থাকেন।
‘প্রেম ভাব জাগাচ্ছ মানে? ফাজলামো পেয়েছ?’
‘ফাজলামো হবে কেন? তোমার শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হচ্ছে নাকি বন্ধ হয়ে গেছে, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।’
বউ লাফিয়ে আরেকদিকে সরে যান, ‘সেটা কী করে পরীক্ষা করবে?’
‘এই যে তোমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছি। আমার শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হচ্ছে; তোমার শরীরেও হবার কথা। মানে, যদি তোমার আদৌ হয় আর কী। মানুষ যখন চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে তখন তার শরীরে অক্সিটোসিন তৈরি হয়। আবার ধরো, মানুষ যখন একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে…,’ বলেই কেমিক্যাল চৌধুরী বউয়ের দুই ঘাড়ে হাত রাখেন। বউ পিছনের দিকে ধীরে হাঁটতে থাকেন। কেমিক্যাল চৌধুরী আগান। মাঝারি আকৃতির ঘর কয়েক পদক্ষেপেই ফুরিয়ে যায়। পিঠে দেয়ালের স্পর্শ পেতেই বউয়ের শরীরে ঝাঁকুনি লাগে। কেমিক্যাল চৌধুরী আবেগময় গলায় বলেন, ‘মানুষ যখন একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে তখন অক্সিটোসিন তৈরির হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। দেখ, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখলে তুমি বুঝতে পারবে যে…’
আবেগের ভারে কেমিক্যাল চৌধুরীর হাত বউয়ের ঘাড় থেকে গলার দিকে পিছলে যেতে থাকে। বউ গলার দুদিকে তার হাতের স্পর্শ পেতেই নিজের হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে কেমিক্যাল চৌধুরীর দুই হাত সরিয়ে দেন। তারপর তাকে সামান্য ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে ঘরের আরেক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান। সেখান থেকে চিৎকার করে বলেন, ‘তুমি আমাকে গলা টিপে মারতে চাও? আমি… আমি আজই থানায় ডায়রি করব। আর তুমি মনে করেছ আমি তোমাকে মারতে পারি না? তোমার ওই যে পিস্তলটা আছে, ওটার সোনার গুলিগুলো আমার কাছে। আমি কিন্তু ওটা ঠিকই চালাতে পারব। লাইসেন্স তো তোমার নামে, এক্কেবারে নির্ভুলভাবে আত্মহত্যা সাজিয়ে রাখব, বুঝলে? কারো বাপের সাধ্য হবে না আসল ব্যাপারটা ধরার। আমাকে তুমি এতদিনেও চেননি!’
বউয়ের কথা শুনে কেমিক্যাল চৌধুরীর আত্মা কেঁপে ওঠে। এই বাড়ি ছেড়ে ভেগে না গিয়ে উপায়? এখানে তো শান্তিমতো ঘুমানোও যাবে না। ঘুমিয়ে পড়লে সেটাই হবে শেষ ঘুম। পরের দিন খবরের কাগজে একটা শিরোনাম ঝুলবে, ‘অবসরের পরে একাকিত্বের ভারে শিক্ষকের আত্মহত্যা।’ কেমিক্যাল চৌধুরী নিজেকে সামলে নেন। অবশ্য রেগে না গিয়ে এটা তিনি কেন করছেন সেও তার কাছে এক রহস্য; ওই এন্ডরফিনের অভাব, হাঁ, ওটাই। কেমিক্যাল চৌধুরী ভয়ে ভয়ে সামান্য আগান, ‘শোনো, সৃষ্টির শুরু থেকে, মানুষ একসঙ্গে থাকে কেন? থাকে, কারণ তারা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। এই যেমন আমি তোমাকে, তুমি আমাকে… ভেবে দেখো, মানুষ বরাবর গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকে কেন? সে হলো ওই অক্সিটোসিনের প্রভাব, সেই হিসেবে তুমি অক্সিটোসিনকে একটা ইভোল্যুশনারি কেমিক্যাল বলতে পার। মানে, ওই অক্সিটোসিনই আমাদেরকে বলে যে…’
বউ কয়েক পা লাফিয়ে কিছুটা পিছনে চলে যান। ‘কী বলতে চাও তুমি, তাই বলে সারাজীবন তোমার সঙ্গে আমাকে আটকে থাকতে হবে? ওই অক্সিটোসিনকে পেলে আমি…’
বউ ঘুরে গিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। কেমিক্যাল চৌধুরী হতাশ হয়ে বিছানায় এসে বসেন। তার ধারণা ছিল বউয়ের চোখ ধীরে ধীরে নরম হয়ে যাবে। তিনি যেমন করে জবরদস্তি চোখাচোখি বজায় রাখতে চাচ্ছিলেন তাতে করে অক্সিটোসিন তৈরি না হয়ে তো কোনো উপায় নেই! তার নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কানেই সম্মোহনের মতো শোনাচ্ছিল, যেন কোনো মানসিক চিকিৎসক বলে চলেছেন, নদীর ধারে শীতল বাতাসের মধ্যে গাছের ছায়ায় আপনি শুয়ে পড়েছেন, বাতাস আপনার গায়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে, ক্লান্তি আর আরামে আপনার চোখ বুজে আসছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন, ঘুমিয়ে পড়ছেন, ঘুমিয়ে… কিন্তু নাহ্, বউয়ের উপরে চোখে চোখ রাখা থেকে শুরু করে সম্মোহন, কোনোটাই কোনো ফল দেয়নি। কেমিক্যাল চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করেন। ছুটির দিনের সকাল গেছে, দুপুরটা অন্তত তার মনমতো হোক। পিস্তলের গুলির ভয়টা উড়িয়ে দেয়া না গেলেও ঘুমিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে কেমিক্যাল চৌধুরী ভাবতে থাকেন, অক্সিটোসিনের ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? এত চেষ্টাতেও বউয়ের শরীরে তা তৈরি হচ্ছে না কেন? রোববার ইউনিভার্সিটিতে গিয়েই প্রথমে ওই ব্যাটা ইমতিয়াজকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সে আজকাল অনেককিছুই ভুলভাল বকছে মনে হয়। মনে মনে কেমিক্যাল চৌধুরী হাসেন, ইমতিয়াজও তার মতোই বুড়ো হয়ে গেছে আসলে। বছরতিনেক পরে সেও অবসরে যাবে। তখন ব্যাটা বুঝবে সারাদিন একজনের, মাত্র একজনের সঙ্গে থাকতে কেমন লাগে! কিন্তু তার আগে রোববার তার সঙ্গে এই অক্সিটোসিনের সমাধানটা করে নিতে হবে, ভুল তথ্য সে দিল কেন? কেমিক্যাল চৌধুরীর গল্প শুনতে শুনতে আমি আমার বন্ধুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, কেমিক্যাল চৌধুরী কি কেমিস্ট্রির টিচার?’ সে হেসে বলল, ‘আরে না। উনি তো প্রায় ছত্রিশ বছর ধরে ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ান।’
‘তবে?’
‘তবে কী?’
‘মানে, তাহলে সারাক্ষণ রিঅ্যাকশন, কেমিক্যাল, এসব নিয়ে থাকেন কেন?’
‘বুঝলে না, সায়েন্স পড়তে গিয়ে কিছু কেমিস্ট্রি তো পড়তে হয়েছিলই। তখন ওটা মনে ধরে গেছে। পরে বেশি পড়েছেন ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির ভাণ্ডার রয়ে গেছে অজানা। এখন কথা হলো কেমিস্ট্রির ঘোরে ডোবা একটা মানুষ বিষয়টাতে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কী করবে আর? মানে, তুমি তো জানোই, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী।’
‘হুম।’
‘আসলে ওনার ব্যাপারটা হলো, তিনি মনে করেন মানুষ নিজের ইচ্ছায় বা পরিস্থিতিতে কিছুই করে না। মানুষ যেখানে যা করে তা ওইসমস্ত কেমিক্যালের প্রভাব। তিনি বিশ্বাস করেন, বিচিত্র কেমিক্যালের উপস্থিতি আর পরিমাণের তারতম্যের পারমুটেশন-কম্বিনেশন মানুষের একেকটা ব্যবহারের জন্য দায়ী। পারমুটেশন-কম্বিনেশনের যেমন সীমা নেই তেমনি মানুষের কাজকর্ম আর প্রতিক্রিয়াও নিত্যনতুন।’
‘ব্যাপারটা আসলে কিন্তু অনেকটা তাই। এই যে আমি যা বলছি তা কি আসলে আমি বলছি নাকি বলছে আমার শরীরের কেমিক্যালস,’ আমি হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
‘সে কী, তুমিও!’
‘না না, আমি কেবল তার কথাটা ভাবছিলাম আর কী। যা হোক, তার কি রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল নাকি?’
‘হুম। তাই আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম একদিন। ভাবলাম দেখি কেমন চলছে।’
‘তো কী দেখলে?’
‘ভালোই তো। গিয়ে দেখি বাড়িতে বউ নেই। চৌধুরীর ঘরে জোরে জোরে গান বাজছে, শুনতে শুনতে তিনি ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি করে চকোলেট খাচ্ছেন।’
‘এই বয়সে চকোলেট খাচ্ছেন!’
‘তাই তো দেখলাম। বললেন চকোলেট খেলে শরীর থেকে নাকি সেরোটোনিন রিলিজ হবে, যা তাকে ফুর্তি ফুর্তি ভাব দেবে। তারপর একই গান বারবার বাজিয়ে শোনালেন আমাকে। শেষে দু’হাত সোজা করে ধরে দেখালেন যে গানটা শুনে তার লোম খাড়া হয়ে উঠছে।’
‘সেটা কেন হচ্ছিল?’
‘সেটা হলো গিয়ে ডোপামাইনের কাজ। বললেন গান এমন জিনিস যা উপভোগ করতে হলে আমাদের পুরো মগজটাকে একযোগে কাজ করতে হয়। আর একই প্রিয় গান বারবার শুনলে নাকি ব্রেইন ডোপামাইন রিলিজ করে, যে কারণে লোম কাটা দিয়ে ওঠে। তো, তিনি এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আছেন আর কী। বললেন, চাকরি নেই, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটির বাইরেও এইসমস্ত করার জন্য প্রচুর সময় পাচ্ছেন।’
‘তা ভালো। তবে তুমি কিন্তু তাকে বলবে যে এভাবে মিষ্টি খেলে শুধু সেরোটোনিন না, রক্তে সুগারও বাড়বে। বাই দ্য ওয়ে, তিনি কোন গানটা বারবার শুনছিলেন বলো তো?’
‘ওই যে আছে না, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা, শচীন দেব বর্মনের। ওই যে গানটা হলো গিয়ে, তুমি শুধু তুমি।’
‘তাই? ওটা আমারো খুব প্রিয়!’
বন্ধু চলে গেলে আমি ইউটিউবে শচীনের গানটা বাজিয়ে দিলাম। একবার, দুবার, তিনবার, অসংখ্যবার… আর তাকিয়ে থাকলাম আমার দুই হাতের লোমের দিকে। লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। যখন অন্য কোনো চিন্তায় গানের কলি কানে ঠিক পৌঁছাচ্ছে না, লোমগুলো শুয়ে পড়ছে। তারপর আবার, মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি শুনলেই লোমগুলো সামান্য নড়ে উঠছে। আশ্চর্য, এ তো ভারি মজার ব্যাপার! খাওয়া বা যৌনতার মতো বিষয়ের সঙ্গে ডোপামাইন জড়িত তা জানতাম, তবে ড্রাগ না নিয়ে কফি না খেয়েও শরীরের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে অদ্ভুত ভালো লাগা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কেমিক্যাল চৌধুরীকে আমি মনে মনে ধন্যবাদ জানাতে লাগলাম।
কেমিক্যাল চৌধুরী ঠিক বলেছেন, গানটা শোনার জন্য শুধু কান না, মাথাটাও ভীষণভাবে দরকার পড়ছে। শুনেছি কোকেইনের ক্ষমতা এদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি, একইসঙ্গে ব্রেইনের বারোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। গান কি তাহলে কোকেইনের মতো কাজ করছে আমার মাথায়? এসব ভাবতে ভাবতে নেশা নেশা লাগতে শুরু করল আমার। হঠাৎ গান বাদ দিয়ে টিভি ছাড়লাম। সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের দৃশ্য ভেসে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে মনে পড়ল, সেনাবাহিনীতে প্রত্যেককে নেয়া হয় তার শারীরিক উচ্চতা, গঠন, শক্তি, এসবের ভিত্তিতে। কিছু জ্ঞানের পরীক্ষাও হয় বটে, কিন্তু কী হবে যদি এমন কেউ ঢুকে পড়ে যার শরীরে এন্ডরফিন বা ডোপামাইন ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে না? সে যদি ভয় পায়? তার মনোবল যদি কম থাকে? কিংবা সে যদি উত্তেজনার পরিবর্তে নির্লিপ্ততায় ভোগে?
চিন্তাগুলোকে পাশ কাটাতে চাইলাম। কিন্তু কী করব, কিমিক্যাল চৌধুরী কেন যেন আমাকে ঘায়েল করে ফেলছেন!
ক’দিন বাদে এমন হলো যে নিজেই কেমিক্যাল চৌধুরির খবর নেয়ার জন্য বন্ধুর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি সে এমনভাবে কাজ করছে যে মনে হচ্ছে ঝিমাচ্ছে। জানতে চাইলাম, ‘রাতে ঘুমাওনি?’
‘আরে আর বোলো না, কেমিক্যাল চৌধুরী আর ওর বউয়ের যন্ত্রণায় কালকের রাতটা মাটি হলো। মোটেও ঘুমাইনি। এদিকে অফিসে ছিল জরুরি কাজ তাই আসতেও হলো।’
‘ও আচ্ছা। তুমি ব্যস্ত, আমি তাহলে আর আজ বসি না বরং…,’ কৌতূহল চেপে বলতে বাধ্য হলাম।
‘না না, একটু বোসো। আমার কাজ শেষ প্রায়, একটু অপেক্ষা করো, কেমিক্যাল চৌধুরীর কাহিনি বলব তোমাকে,’ বন্ধু বলতেই খুশি হলাম। আমি তো কেমিক্যাল চৌধুরীর গল্পই শুনতে এসেছি, সেটা গোপন করে চুপচাপ বসে থাকলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, এই কপট ব্যবহারটা করছি কোন কেমিক্যালের প্রভাবে? কেমিক্যাল চৌধুরীকে পেলে জিজ্ঞাসা করা যেত। অবশ্য আমার বন্ধুর তথ্য অনুযায়ী, কেমিক্যাল চৌধুরীর সমস্ত জিজ্ঞাসার জবাব দেন আরেক অধ্যাপক, ইমতিয়াজ। জিজ্ঞাসা করার জন্য ইমতিয়াজ সাহেবকে পেলে অবশ্য আরো ভালো হতো। তবে কেমিক্যাল চৌধুরী যতই কাজে লাগাক ইমতিয়াজকে, এমনিতে তাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। কারণ ইমতিয়াজ সাহেব হরমোন আর কেমিক্যাল নিয়ে যত তথ্য দেন তার অনেক কিছুই কেমিক্যাল চৌধুরী কাজেকর্মে প্রমাণ করতে পারেন না। ইমতিয়াজ বেচারা সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও দেন আবার পরদিন আচ্ছামতো বকাঝকাও সহ্য করেন।
‘শুনবে কাল রাতে কী হয়েছে?’ কাজ শেষ করে বন্ধু বলল।
রাতে কেমিক্যাল চৌধুরী আধশোয়া হয়ে গান শুনছিলেন। বউ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আচড়াতে বলেন, ‘আমার মুখটা বলিরেখায় ভরে গেল!’
‘এই বয়সে মুখে বলিরেখা সবারই হয়,’ কেমিক্যাল চৌধুরী হয়ত তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলেন। বউ বলেন, ‘কিন্তু সবাই তো আর তা নিয়ে বসে থাকে না। মানুষ বলিরেখা থেকে বাঁচার জন্য কতকিছু করে, সাধারণ ডাক্তারের কাছে যাওয়া তো আছেই, কেউ কেউ বোটক্স ট্রিটমেন্টও করে। চামড়া একেবারে টান টান হয়ে যায়।’
‘খবরদার তুমি ভাববে না ওসব। চামড়া ওরকম টেনে সোজা করলে চেহারা থেকে আবেগ হারিয়ে যায়,’ বলে নিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরী মনে মনে ভাবেন, আবেগ-টাবেগ অবশ্য এমনিতেই তার বউয়ের মুখে আসে না। তবে এটা বললে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে ভেবে তিনি চেপে যান।
‘আমার দরকার টান টান চেহারা। ওসব ইমোশন-টিমোশন দিয়ে কী করব?’ বউ বলেন।
‘বলো কী তুমি, ইমোশন তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ! মানুষের মুখে অন্তত দশ হাজার রকমের ইমোশন দেখা যায়, বুঝেছ? তা ছাড়া, শুধু ইমোশন বর্ণনা করার জন্যই ইংরেজি ভাষায় অন্তত চারশ’ শব্দ আছে। এটাকে তুমি যা তা একটা বিষয় মনে করো?’
‘এত জানো কিন্তু আমার মুখের ইমোশন তো তোমার নজরে আসে না জীবনেও!’
‘তোমার মুখের আবার ইমোশন!’ বলে কেমিক্যাল চৌধুরী হো হো করে হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতে চোখ বুজে যায়। আর ওই হাসিই তার কাল হয়। চোখ খুলে দেখেন মুখের ঠিক সামনে ভয়ঙ্কর মূর্তি। মূর্তির মুখে যা ছিল তা এক ধরনের ইমোশনই বটে। কেমিক্যাল চৌধুরী শুধু কোনোরকমে বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি ভস্ম হয়ে যাব, চোখ সরাও।’ শেষে বলিরেখার জন্য চর্ম বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত বলে-টলে তিনি পার পান। যা হোক, বউয়ের মন ঠিক হলে কেমিক্যাল চৌধুরী ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আলমারিতে যেখানে তোমার গয়নার বাক্সটা থাকত সেখানে দেখছি না যে?’ ব্যস আর যায় কোথায়, বউ হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘আমার গয়নার বাক্সয় নজর পড়েছে কেন তোমার, হুম? কাকে দেবে শুনি?’ তাই শুনে কেমিক্যাল চৌধুরী কাঁচুমাচু হয়ে যান। তিনি আসলে মনে মনে বাক্সটা খুঁজছিলেন এই ভেবে যে পিস্তলের সোনার গুলিগুলো থাকলে ওটার মধ্যেই থাকতে পারে। এত দামী গুলি কি আর বউ যেখানে সেখানে ফেলে রাখবে! ওগুলো হাতিয়ে নেয়া ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। কিন্তু বউয়ের জেরার মুখে গলায় খানিক হতাশার সুর এনে বলতে বাধ্য হন, ‘দেখতাম ছেলের বউ আর মেয়েদেরকে দেয়ার পরে তোমার নিজের বলতে আর কী থাকল, এই আর কী।’ এই কথা শুনে বউয়ের মন নরম হয়। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কী আর থাকবে ওদেরকে দেবার পরে? আছে পড়ে দু’একটা।’
‘সেই আর কী,’ কেমিক্যাল চৌধুরীও একটা সাজানো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে সক্ষম হন। সেই সুযোগে বউ মিষ্টি করে বলেন, ‘তুমি এবারে আমাকে একটা হীরার কানের দুল কিনে দাও না! তাহলে যা গেছে তার দুঃখ ভুলে যাব।’
‘কী বললে, হীরা? দাম জানো? লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে আমি স্রেফ কার্বন কিনব?’
‘কার্বন মানে?’
‘কার্বন মানে কার্বন। হীরা শতভাগ কার্বনে তৈরি। কয়লা যা, হীরাও তা। ওটার পিছনে এত টাকা খরচের মানে হয়? তা ছাড়া…’
‘তা ছাড়া কী?’
‘মানে, হীরা দেখতে ভালো লাগে ফরসা মুখে। মানে, আমি বলতে চাচ্ছি…’
‘বলতে চাচ্ছ আমি কালো? আশ্চর্য, ফরসারাও তো আমাকে কালো বলে না! তোমার কি কোনো বেশি ফরসা মেয়ের সঙ্গে…’ বউ ভাবনায় পড়ে যান। ভাবতে ভাবতে একসময় আর্কিমিডিসের সূত্র খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনা নিয়ে বলেন, ‘তাই তো বলি, এই অসহ্য গরমের মধ্যে চা হাতে নিয়ে পেপার পড়ার ঢং করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় বসে থাক কেন! পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসা সাদাটে মহিলাটা ওই সময়ে অফিসে যায়, তাই না?’
ব্যস, এই শেষ। এর পরে কেমিক্যাল চৌধুরীর পক্ষে আর বেশিক্ষণ চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। তার খানিক পরে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি আমার বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছান। তখন ইতোমধ্যেই বেশ রাত। বন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেমিক্যাল চৌধুরীকেও ঘুমিয়ে পড়তে বলেছিল। কিন্তু কেমিক্যাল চৌধুরী তো আর সহসা বাড়ি ফিরবেন না, অন্যের বাড়িতে হুট করে গিয়ে লম্বা সময় থাকতে নাকি বাধে তার। তাই সেখান থেকে একটা লুঙ্গি ধার নিয়ে তিনি গিয়ে ওঠেন তার বাড়ির কাছের এক হোটেলে। তাকে হোটেলে রেখে আমার বন্ধু বাড়ি গিয়ে আবারো শুয়ে পড়ে। ওদিকে কেমিক্যাল চৌধুরী হোটেলের ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘরে পায়চারি করতে থাকেন। নাহ্, কোনোভাবেই শরীরে এন্ডরফিন তৈরি হয় না! কী দুঃখজনক! বউয়ের হয় না সেরোটোনিন আর তার হয় না এন্ডরফিন। তার এখন খুশি হওয়া দরকার, ফুর্তি ফুর্তি ভাব আনা দরকার। একটা গান বাজিয়ে দেখলে হয়, সেটাই শেষ চেষ্টা। কেমিক্যাল চৌধুরী গান শুনতে শুরু করেন। আনন্দের গান তার কানে কান্নার মতো লাগে। নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকে ব্যাপারটা। এ কোন হরমোন নিঃসরণ হচ্ছে তার শরীরে? এ তো তার অজানা! ইমতিয়াজ হারামজাদা কি কোনো একটা হরমোনের কথা আমূল চেপে গেছে? এত একা লাগছে কেন? কেনইবা কিছু ভালো লাগছে না! এই ভালো না লাগার হরমোনের নাম কী হতে পারে? কীসে তার নিঃসরণ হয় কে জানে। সঙ্গে কিছু চকোলেট থাকলে ভালো হতো। আর প্যাঁ প্যাঁ করতে থাকা গানটা বন্ধ করা দরকার।
ঘণ্টাখানেক পরে কেমিক্যাল চৌধুরী আমার বন্ধুকে ফোন করে এসব বললে সে তাকে বলে, ‘আপনি বরং সামনের মোড় থেকে কিছু চকোলেট এনে খান। তাতে যদি আপনার সেরোটোনিন রিলিজ হওয়া শুরু হয় আর কী, ওই যে আপনার সুখী হবার কেমিক্যালটা।’
‘তা ঠিক। কিন্তু এত রাতে কি দোকান খোলা থাকবে?’
‘দেখেন, অন্তত ওষুধের দোকান তো খোলা থাকার কথা।’
‘ওষুধের দোকানে চকোলেট পাব?’
‘ভাই, আজকাল ওষুধের কিছু দোকানে শুধু চকোলেট কেন, মুড়ি বা কাপড় কাচার সাবানও পাওয়া যায়।’
‘তাই নাকি!’
কেমিক্যাল চৌধুরী লুঙ্গি হাতে নিয়ে ভাবছিলেন প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরে নেবেন। ঘরে প্যান্ট পরে থাকা তার অপছন্দ। কিন্তু এখন ওষুধের দোকানে যেতে হবে বলে লুঙ্গি রেখে রওনা দেন। রাত একটায়ও ওষুধের দোকান খোলা, শাটার সামান্য নামানো। কথা সত্য, দোকানের দুই তৃতীয়াংশ দেখতে মুদির দোকানের মতো, কী নেই সেখানে! যা হোক, পছন্দ করে কিছু চকোলেট নিয়ে দাম মেটাতে গিয়ে কাউন্টারের পাশের শেলফে তার চোখ পড়ে ঘুমের ওষুধের দিকে। মনে হয় এত বিরক্তি নিয়ে এমনি এমনি ঘুমানো অসম্ভব। ওদিকে সারা রাত বউয়ের একেকটা ডায়ালগ ভেবে ভেবে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকারও মানে হয় না। কেমিক্যাল চৌধুরী তাই অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ কিনে ফেলেন, কে জানে হোটেলে কতদিন থাকতে হয়। গাদাখানেক চকোলেট আর ঘুমের ওষুধ নিয়ে তিনি হোটেলের ঘরে ফিরে আসেন। এসেই আগে লুঙ্গি পরে নেন, তারপর চকোলেট আর পানির বোতল নিয়ে আয়েশ করে বসেন। চকোলেট মুখে দিতে যাবেন ভাবতেই তার সুখি সুখি ভাব জাগতে শুরু করে। ইতিবাচক ব্যাপার, কেমিক্যাল নিঃসরণ শুরু হয়েছে! কিন্তু হাতটা মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ফোন বেজে ওঠে। ‘তুমি কী ভেবেছ, আমি জানি না তুমি কোথায়? ওখানে গিয়ে ঘাড় ধরে তোমাকে টেনে আনতে পারব না?’ বাজখাঁই গলার আওয়াজে কেমিক্যাল চৌধুরীর কেমিক্যাল নিঃসরণটা সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায়। কেমিক্যাল চৌধুরী কোনো কথা না বললেও ওপাশ থেকে আবারো শোনা যায়, ‘কী, কথা বলছ না কেন? তোমার সঙ্গে ওখানে কে আছে বলো তো? কার জন্য কথা বলতে পারছ না, হুম?’ কণ্ঠস্বর খানিক থেমে আবারো বলে, ‘বলবে নাকি আমি নিজেই এসে…’
কেমিক্যাল চৌধুরি ফোন বন্ধ করে ফেলেন। ওটা চালু থাকলে পজিটিভ কোনো কেমিক্যাল নিঃসরণের সামান্য সম্ভাবনাও নেই। কেবল ভালো না লাগার কেমিক্যালে শরীরটা টইটুম্বর হয়ে যাচ্ছে। চকোলেট হাতে নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন, এই হোটেলে যদি সত্যি সত্যি বউ চলে আসে? যদি সত্যিই সমস্ত বোর্ডার আর স্টাফদের সামনে ঘাড় ধরে তাকে করিডোর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়? পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল অব্দি কেঁপে ওঠে তার। তাই ফোন আবার অন করে আমার বন্ধুকে ফোন করে এসব বলেন। রাত দুটোয় বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, ‘আরে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান তো। ঢাকা শহরে কত হোটেল আছে জানেন? সেসব হোটেলে কত রুম আছে, খবর রাখেন? এতকিছুর মধ্যে ওই হোটেলে গিয়ে ঠিক ওই রুমের দরজায় টোকা দিয়ে ভাবি আপনাকে খুঁজে বের করবে মনে করেন?’ এ কথায় কেমিক্যাল চৌধুরীর মন শান্ত হয়। হোটেলের ঘরের চারদিকে তাকান তিনি। বেশ সুন্দর রুমটা, বহুদিন লুকিয়ে থাকার জন্য চমৎকার। ভাবতে না ভাবতেই ফোন আবারো বাজতে থাকে। পাশে পড়ে থাকা ফোনের দিকে চোখ যেতেই ভেসে ওঠে বউয়ের নাম। কেমিক্যাল চৌধুরী ফোন ধরেন না। বেশ কয়েকবার বাজতে বাজতে তারপর একসময় মেসেজ ভেসে ওঠে, ‘দাঁড়াও, আমি আসছি।’
কেমিক্যাল চৌধুরীর সারা শরীরে তখন যেন কী এক কারেন্ট লেগে যায়। নিজেকে ঘাড় ধাক্কা খেতে খেতে করিডোর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে ওঠেন তিনি। দ্রুত হাতে পানির বোতল খুলে নিয়ে ঘুমের ওষুধগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মন বলে, ওরকমভাবে অপমানিত হবার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। তবু সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক মিনিট সময় লাগে। যা হোক, বিদায় পৃথিবী। কেমিক্যাল চৌধুরী একে একে ওষুধের পাতা ছিঁড়ে বের করতে থাকেন। প্রথমে সবগুলো ছিঁড়ে সামনে সাজিয়ে নেন। একেক স্তূপে দুটো করে রাখেন। ছোটো ছোটো ওষুধ, একসঙ্গে দুটো করে গিলে খাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। ঘটনাটা তাড়াতাড়িও ঘটবে তাতে। বেশি সময় নেয়া ঠিক না। কিছু চকোলেট খাওয়া হয়ে গেছে। যদি হুট করে সেরোটোনিন নিঃসরণ শুরু হয়ে যায় তবে আর ঘুমের ওষুধের দিকে হাত যাবে না। পৃথিবী সুন্দর লাগতে শুরু করবে। খামোখাই ফুর্তি ফুর্তি ভাব জেগে উঠবে। আর তখন বউ এসে ঘাড় ধরে করিডোরে সবার সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গেলেও সেটাকে আদর বলে মনে হবে। তাই সেরোটোনিনের সঙ্গে দৌড়ে জেতার জন্য কেমিক্যাল চৌধুরী দ্রুত প্রথম দুটো ট্যাবলেট হাতে নেন। এক এক ঢোকে দুটো করে গেলেন আর থেমে নিয়ে শরীরে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না বুঝতে চেষ্টা করেন। নাহ্, কিছুই বোঝা যায় না। তার শরীরেও কি বউয়ের মতো হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে গেল নাকি? না এন্ডরফিন, না সেরোটোনিন… কী দুর্ভাগ্য!
তিন নম্বর স্তূপ গেলার পরে চার নম্বরের দিকে হাত বাড়াতেই দরজায় জোরে জোরে কিল ঘুসি পড়তে থাকে। হোটেলের লোকেরা নিশ্চয় কোনো বোর্ডারের ঘরের দরজায় মধ্যরাতে এরকম আঘাত করবে না! কেমিক্যাল চৌধুরীর হাত থেকে পানির বোতল ধীরে ধীরে টেবিলে নামে। পরমুহূর্তে বউয়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘কী হলো, আমি জানি তুমি ঘুমাওনি। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম হয় তোমার? খোলো বলছি এখনই।’ কেমিক্যাল চৌধুরী পাথর হয়ে যান। তার শরীরে এ কোনো পাথর বানানোর হরমোন হবে হয়ত। অজানা হরমোন। ইমতিয়াজ হারামজাদা বলেনি। কিন্তু বউ এখানে এসে পৌঁছল কীভাবে? সে এক রহস্য। হঠাৎ মনে পড়ে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে তার… কী কুক্ষণে যে একদিন রাগের মাথায় কেমিক্যাল চৌধুরী তার বউকে ভয় দেখাবার জন্য বলেছিলেন, ‘শোনো, দিনভর এরকম খ্যাচখ্যাচ করলে আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। ওই হোটেলে গিয়ে উঠব। মরলে ওখানেই মরব।’ আঙুল দিয়ে তাক করে এই হোটেলটা কেমিক্যাল চৌধুরি দেখিয়েও দিয়েছিলেন বউকে। বউ সেদিন রাগ করে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার দৌড় জানা আছে। হোটেলে গেলেও বাড়ির কাছেরটাতেই যেতে হবে! যাও না, পারলে দূরে গিয়ে মরো।’ ভাবতে ভাবতে কেমিক্যাল চৌধুরী চমকে ওঠেন, বউ এলই যখন এই হোটেলে, তিনি যে এখানে আর এই ঘরেই আছেন তা জানতে পারল কীভাবে? তিনি তো নিজের নামে হোটেল বুক করেননি, করেছেন ওই হারামজাদা ইমতিয়াজের নামে। হোটেলে এসে রাত কাটানোর দুর্নাম যা হবার ওই ইমতিয়াজের হোক। যত্তসব ভুলভাল হরমোন জাগানোর পদ্ধতি বলার ফাজলামো বের হোক হারামজাদার।
কিন্তু বউ কী করে এই ঘরের হদিস পেয়ে গেল আর… এইসমস্ত রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে লক ভেঙে দরজাটা এলোমেলোভাবে দুলে দেয়ালে জোরে বাড়ি খায়। বিকট শব্দের পরপরই প্রথমে বউ হাট করে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে আসেন। পিছনে হোটেলের লোকজন। বউ তাকে দেখেও যেন দেখেন না। না দেখার মতো এক ঝলক তাকিয়ে নিয়েই আলমারির কপাট খোলেন, খাটের চাদর উঠিয়ে তলাটা দেখে নেন, তারপর ঢোকেন বাথরুমে। বাথরুম দেখা হলে ফিরে এসে উপর থেকে মেঝে অব্দি গড়াগড়ি করা ভারী পরদাগুলো সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকেন। মুখে বলতে থাকেন, ‘কাকে নিয়ে হোটেলে উঠেছ, হুম? কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? বউয়ের প্রশ্ন জোরে বেজে ওঠে কেমিক্যাল চৌধুরীর কানে। কিন্তু তার পাথরভাব কাটে না। নীরবতার রহস্য ধরার জন্য বউ তখন একবার হয়ত সামান্য ভালোমতো তাকান তার দিকে। তাকিয়েই চমকে ওঠেন, ‘এ কী! এ কার লুঙ্গি পরে বসে আছ তুমি? এ তো দেখি ব্যবহার করা লুঙ্গি। তোমার তো না, নাকি?’ কেমিক্যাল চৌধুরী আমতা আমতা করে লুঙ্গির মালিক, আমার বন্ধুর নাম বলেন, হোটেলে আসার আগে তার বাড়িতে যাবার কথা বলেন। দেখে মনে হয় বউয়ের কানে তা পৌঁছায় না, বউ বলেন, ‘আচ্ছা, লুঙ্গি কি এখানেই কোথাও ছিল? তুমি কি প্রায়ই এই হোটেলের রুমে… ছি ছি ছি আমি আর ভাবতে পারছি না।’ হোটেলের মানুষদের মধ্যে একজন বলে, ‘উনি তো মনে হয় আত্মহত্যা করতেছিলেন, দেখেন কেমন দুনিয়ার ওষুধ বিছাইয়া বসছেন!’ আরেকজন বলে, ‘ভাগ্যিস সময়মতো দরজা ভাঙা হইছিল, নাইলে তো কালকের পেপারে হোটেলের দুর্নাম হইয়া যাইত!’ একজন এগিয়ে গিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরীর সামনে স্তূপ করে রাখা ওষুধগুলো নাড়াচাড়া করে পরীক্ষা করে। ওষুধের ছেঁড়া ছেঁড়া খোসার টুকরো মিলিয়ে নামটা বের করার চেষ্টা করে। নাম পাওয়া মাত্রই ভয়ে ভয়ে জানতে চায়, ‘ভাই, এত্তগুলা যে বিছায়ে রাখছেন, খাইছেন কয়টা?’ কেমিক্যাল চৌধুরী কোনোরকমে উত্তর দেয়, ‘ছয়টা।’
‘সর্বনাশ। মাথা ঘুরতেছে?’
‘না।’
কেমিক্যাল চৌধুরীর মাথা ঘুরছিল না। এতগুলো ওষুধ খাওয়ার পরে হয়ত ঘোরার কথা। নাহলে লোকটা ওরকম উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইত না। কিন্তু ঘুরছে না কেন! ভাবতেই কেমিক্যাল চৌধুরীর খুব হতাশ লাগে, ওষুধও কি তার শরীরে কোনো কেমিক্যালের আধিক্য তৈরি করছে না? তার শরীরের হলোটা কী?
হঠাৎ বউয়ের গলা শোনা যায়, ‘হোটেল বুক করেছ ইমতিয়াজ সাহেবের নামে, সেটা আমি বোর্ডারের লিস্ট দেখেই ধরে ফেলেছি। এখন লুঙ্গির যে গল্পটা বলছ সেটা বিশ্বাস করতে গেলে… ওঠো তুমি, ওঠো তো। চলো, কার বাসা থেকে লুঙ্গি এনেছ সেটা দেখাও আমাকে। চলো।’ রাত তিনটা নাগাদ বউয়ের অদ্ভুত আবদার শুনে অবাক হন কেমিক্যাল চৌধুরী। কিন্তু কোনো উপায় থাকে না। বউয়ের কথা অনুযায়ী আমার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন তারা। সেখানে গিয়ে হয় আরেক বিপত্তি। লুঙ্গি যে আমার বন্ধুরই তার সাক্ষী কে দেবে? কেমিক্যাল চৌধুরীর বউ বিরক্ত হয়ে আমার বন্ধুকে বলেন, ‘একা মানুষ আপনি, ক্রস চেক করার জন্য কার কাছে এই লুঙ্গির ব্যাপারটা জানতে চাই বলেন তো? মুশকিল।’
‘হ্যাঁ, মুশকিল বটে। কিছু করার নেই। আমার কথাই আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। হোটেলে ওঠার আগে উনি আমার এখানে এসেছিলেন। তবে এখন উনি টলছেন, হঠাৎ পড়ে যেতে পারেন। ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে,’ আমার বন্ধু জবাব দেয়। বাড়িটার আনাচে কানাচে ঘুরতে থাকা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি ফিরিয়ে বউ তখন কেমিক্যাল চৌধুরীর দিকে তাকান। ‘ও আচ্ছা,’ বলে তাকে নিয়ে যখন আমার বন্ধুর বাসা থেকে রওনা দেন তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে।
সারা রাতের কাহিনি শুনে আমি থম মেরে বসে থাকলাম। হায় রে কেমিক্যাল চৌধুরী, আবারো বাড়ি ফিরে যেতে হলো তাকে! চিন্তিত হয়ে বন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম, ‘কিন্তু ভদ্রলোক এখন আছেন কেমন?’
‘কেমন আর, শুনলাম মরার মতো ঘুমাচ্ছেন। এই বয়সে হুট করে এতগুলো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ঠেলা আছে।’
তিন দিন পরে বন্ধু ফোন করে বলল কেমিক্যাল চৌধুরী ঘুম থেকে উঠেছেন। এর মধ্যে নাকি তাকে পাশ ফিরতেও দেখা যায়নি। বউ মাঝেমধ্যে এসে নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখেছেন নিশ্বাস চলছে নাকি। বাতাসের উপস্থিতি পেলে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। তবে তিন দিন পরে কেমিক্যাল চৌধুরী ঘুম থেকে উঠলে কথা যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু হয়। বউ শুরু করেন, বলেন, ‘বুঝলাম লুঙ্গি ওনার কাছ থেকে এনেছ, কিন্তু অতগুলো চকোলেট আর ঘুমের ওষুধ কেন কিনে নিয়ে গেলে? আর কিনলেই যখন ওরকম বাজে কোম্পানির ওষুধ কিনলে কেন? আত্মহত্যার ঢং, না?’
বউয়ের শেষ কথায় কেমিক্যাল চৌধুরীর ঘুম ঘুম ভাবটা শেষ পর্যন্ত কেটেই যায়। তবে এত দুর্বল লাগে যে কোনো উত্তর দেয়া সম্ভব হয় না। তবে মনে মনে ভাবেন যে বউ কথা ঠিকই বলেছে, ভালো জাতের ঘুমের ওষুধ হলে কি ছয়-ছয়টা ওষুধ খেয়েও তিনি বেঁচে থাকতেন? এর একটা বিহিত করা দরকার। শরীরও কেমিক্যাল তৈরি করছে না আর ওদিকে কেনা কেমিক্যালেও ভেজাল। এ তো ভয়ানক অন্যায়। বিছানা থেকে উঠে কোনোরকমে একটু খেয়ে নিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরী ওষুধ কোম্পানির ফোন নম্বর জোগাড় করেন। ওপাশে কোম্পানির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের কোনো তরুণের মার্জিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। কেমিক্যাল চৌধুরী বিরক্তি চেপে যথেষ্ট ধৈর্য নিয়ে আলাপ শুরু করেন, ‘মার্কেটিং না, আমি প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টের কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওষুধে ভেজাল প্রসঙ্গে।’
‘জি আপনি আমার সঙ্গেই বলতে পারেন। কোন ওষুধে ভেজাল বলুন তো?’
‘এই যে আপনাদের ঘুমের ওষুধে মেলাটোনিন হরমোনের কথা লেখা আছে, কিন্তু তা ঠিকঠাকমতো কাজ তো করল না। আমি ছয় ছয়টা ওষুধ একসঙ্গে গিলে ফেলেছি কিন্তু… এত বড়ো কোম্পানির নামে আপনারা বাজারে সমানে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করে যাচ্ছেন কেন? আপনাদের বিরুদ্ধে তো…’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি ওই ওষুধ এক সঙ্গে ছয়টা খেয়ে ফেলেছেন? পাঁচ মিলিগ্রামেরটা নাকি দশ?’
‘পাঁচ।’
‘আচ্ছা। তো, আপনার ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?’
‘তা হয়েছে।’
‘কয়দিন ঘুমালেন?’
‘প্রায় তিন দিন।’
‘খুব ভালো। ওষুধটা ঘুমেরই। মেলাটোনিন হরমোন শরীরকে শিথিল করে ঘুম এনে দেবে। আর ধরেন, বেশি খেলে ঘুম একটু বেশি হবে বা সাইড অ্যাফেক্ট হিসেবে একটু ঝাপসা দেখতে পারেন, মাথা ঘোরা ঘোরা বা মুখটা শুকিয়ে যাওয়ার মতো ভাবও হতে পারে। তা আপনার কি হচ্ছে এসব?’
‘মাথাটা সামান্য ঘুরছে।’
‘তিন দিন হয়ে গেছে তো, আজই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু আমার কথা হলো এতগুলো ওষুধ খেয়েও আমি মরলাম না কেন?’
‘কী আশ্চর্য, মরবেন কেন! আমরা তো ওষুধটা পেশেন্টকে মারার জন্য বানাইনি, ঘুম পাড়ানোর জন্য বানিয়েছি। ওষুধে কোনো ভেজাল নেই, আপনার ঘুম ভালো হয়েছে না?’
‘হয়েছে।’
‘ব্যস, তাহলে তো হলোই। তবে এর পরে খেলে একটা করে খাবেন প্লিজ। একটানা তিন দিন না ঘুমিয়ে, একদিন একদিন করে ঘুমালে ভালো না?’
প্রসঙ্গ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে কেমিক্যাল চৌধুরীর আর কথা বলতে ভালো লাগেনি। বরং হঠাৎ করে কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ডোপামাইনের সমস্যা হতে পারে। কেমিক্যাল চৌধুরী নিশ্চিত, কেউ ভালোবাসে না এমন একটা অনুভূতি ডোপামাইনের অভাবেই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এক কাপ চা চেয়ে নিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরী বারান্দায় গিয়ে বসেন। সামনে তিন দিনের খবরের কাগজ। তিনি যেন পৃথিবী থেকে তিন দিন পিছিয়ে গেছেন। হাতে মেলে রাখা পেপারের পিছনে কাকে যেন হেঁটে যেতে দেখা যায়। অতিরিক্ত সাদাটে এক মহিলা, বউ হয়ত এর কথাই বলেছিল, পাশের অ্যাপার্টমেন্টে নতুন উঠেছেন। মহিলা বাড়ির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে রাস্তার একদিকে তাকিয়ে থাকেন, হয়ত কারো অপেক্ষায়। নিঃশব্দ দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে কেমিক্যাল চৌধুরীর কেন যেন হঠাৎ ভালো লাগতে শুরু করে। তিনি চোখ ফেরাতে পারেন না। তার শরীরে কি ডোপামাইন তৈরি শুরু হয়ে গেল? নরম আলোর মধ্যে হুট করে সূর্যের রাগের মতো কটকটে রোদটাকে কেন যেন হঠাৎ করেই আনন্দময় মনে হতে থাকে। সবকিছুই যৌক্তিক লাগে, এমনকি টানা তিন দিন ঘুমিয়ে থাকাকেও। এটুকু বিশ্রাম যেন তার প্রয়োজন ছিল। হঠাৎ মনে পড়ে, ইমতিয়াজ বলেছিল, ‘ডোপামাইন নিজে আপনাকে আনন্দিত করবে না, ডোপামাইন নিঃসরণ হলে আপনি যা করছেন তাতেই আপনার আনন্দ হবে। সবকিছুতেই আনন্দ, বুঝলেন?’
গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সাদাটে মহিলা তাতে উঠে বসেন। এই পুরো দৃশ্যটা অপলক গিলতে থাকেন কেমিক্যাল চৌধুরী। মনে মনে ভাবেন, ইমতিয়াজ নেহায়েত ভুল বলে না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন