short-story-chirkute-prem

চিরকুটের প্রেম
নন্দিনী নাগ

 

প্রায় পনেরটা বছর বিদেশে কাটিয়ে নিজের ছোট্ট শহরে ফিরে এসে সবকিছুই অন্যরকম লাগছে পূষণের কাছে। ওর মনের মধ্যে শহরের যে ম্যাপ আঁকা ছিল তার সঙ্গে কিছুই মিলছে না, এমনকি ওদের বসতবাড়িটাও বদলে গেছে আমূল। বাড়ি যে প্রোমোটারের ম্যাজিকে ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত হয়েছে সেটা জানা ছিল, ভিডিও কলে বাবা দেখিয়েওছিল, তাই ফ্ল্যাট বাড়িটাতে পা দিয়ে তেমন চমকে যায়নি পূষণ। কিন্তু পুরনো শহরটাকে খুঁজে  দেখতে বেরিয়ে ও জোরালো ধাক্কা খেল। দোকানপাট, বাড়িঘর এসব এমনভাবে বদলে গেছে যে পুরনো গলিগুলোর চিহ্নমাত্র নেই। প্রতি পদক্ষেপে ওর মনে হচ্ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় বেড়াতে এসেছে। তবে সবচেয়ে বড় চমকটা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ওর নিজের স্কুলবাড়িতে।

 পূষণদের আধা সরকারি স্কুলে সেই সময়ে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ানো হত। ক্লাস ফোর পর্যন্ত ছেলে আর মেয়েরা একই সঙ্গে পড়ত, তারপর মেয়েরা চলে যেত লাগোয়া গার্লস স্কুলে।

এখন গরমের ছুটি চলছে, সদর দরজায় ভেতর থেকে তালা দেওয়া। গেটের পাশে দারোয়ানের ঘর, সেখানেই উঁকি দিল পূষণ।

“দরজাটা একটু খোলা যাবে?”

“কেন? কি দরকার?”

“আমি এই স্কুলের পুরনো ছাত্র। অনেক বছর বাদে শহরে ফিরেছি। স্কুলটা একটু ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করছে, দিন না একটু খুলে।”

দারোয়ানের মন গলল। খুলে গেল ভারী লোহার দরজা। এই দরজাটা ছিল না আগে, তখন রাস্তা থেকেই স্কুলের ভেতরটা দিব্যি দেখা যেত। 

  ভেতরে ঢুকেই মনটা খারাপ হয়ে গেল পূষণের। জীবনের সেরা দশটা বছর কেটেছে যেখানে, সেই স্কুলটাও আর আগের চেহারায় নেই! বিল্ডিংএর সামনে যে মাঠটা ছিল সেটা একদম ভ্যানিশ! সেই মাঠের জমিতে দাঁড়িয়ে আছে একটা নতুন ভবন, তার গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা, অমুক দিন অমুকের হাতে এই বিজ্ঞানভবনের দ্বারোদ্ঘাটন হল। ‘বিজ্ঞান ভবন’, মানে স্কুলে এখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো হয়! আর তাই ঘরের অভাব হওয়ায় খেলার মাঠে হাত পড়েছে। অবশ্য এখন তো আর ছোটরা মাঠে নেমে খেলে না, স্ক্রীনেই তাদের সব খেলাধূলা, কাজেই মাঠ গেছে বলে সম্ভবত কারোরই তেমন আফশোস নেই। 

  স্কুল বাড়ির পেছনদিকে একটা আমগাছ ছিল, অনেক পুরনো। তার মোটা গুঁড়ি উঁচু করে বাঁধানো ছিল। সেই বেদীটা প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চাদের খুবই প্রিয় একটা খেলার জায়গা ছিল। এতবছর পরে পূষণের স্মৃতিতে ফিরে এল সেই গাছ। গাছটাকে খুঁজতে পূষণ পা বাড়ালো স্কুলের পেছন দিকে।

  এবার আর তাকে হতাশ হতে হল না। আমগাছটা একই জায়গায় রয়ে গেছে, থেকে গেছে তার বেদীটাও। কিছুটা সময় ছোটবেলায় কাটাবে বলে পূষণ বেদীতে পা ঝুলিয়ে বসল।

আর কি আশ্চর্য! তখনই ওর মনে পড়ে গেল প্রিয়াকে, পূষণ বেদীতে উঠে বসলেই যে পা ধরে টেনে নামানোর চেষ্টা করত। 

  ক্লাস ওয়ানে প্রিয়া বেশ ছোটোখাটো চেহারার ছিল, আর বেদীটা ছিল তুলনায় বেশ উঁচু। প্রিয়া বেদীতে চড়তে পারত না সহজে, ওপরে উঠতে হলে ওকে বেশ কসরৎ করতে হত। পূষণের তুলনায়ও বেদীটা উঁচু ছিল কিন্তু ও হাতে চাপ দিয়ে একটা লাফ দিলেই উঠে পড়তে পারত ওটার ওপরে। তারপর যেই না পূষণ বেদীতে পা ঝুলিয়ে বসত, প্রিয়া নিচ থেকে ওর পা ধরে টানত। কথাটা মনে পড়তেই পায়ে সুড়সুড়ি লাগল পূষণের, ও ফিক করে হেসে ফেলল। 

ক্লাস ফোরের পর প্রিয়া মেয়েদের স্কুল চলে গেল, তারপর থেকে বন্ধুত্বের সুতোটাই ছিঁড়ে গেল যোগাযোগের অভাবে। মাধ্যমিক পর্যন্ত তবু মাঝেমাঝে রাস্তাঘাটে দেখা হয়েছে, কিন্তু তারপর থেকে প্রিয়ার আর কোনো খোঁজখবর রাখেনি পূষণ। অথচ আজ এই আমগাছটাকে খুঁজতে এসে সবার আগে প্রিয়ার কথাই ওর মনে পড়ল।

“আমাকে ভুলে যাবি না তো? আমি কিন্তু জীবনে কোনোদিন তোকে ভুলব না!”

প্রাইমারী স্কুলের শেষদিন এই আমগাছতলাতে দাঁড়িয়ে চুলের ঝুঁটি দুলিয়ে বলেছিল প্রিয়া। ওর ফরসা টোপা কুলের মতো গালদুটো লাল হয়ে ছিল, সম্ভবত ঠান্ডায় ফেটে গিয়ে। লাল হয়ে ছিল ওর নাকটাও, আর ও ঘন ঘন নাক টানছিল কান্না গিলে ফেলার জন্য, কিন্তু পারছিল না। স্কুল ছেড়ে চলে যাবার দুঃখ ওর দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা হয়ে গড়িয়ে নামছিল।

পঁচিশ বছর আগেকার ঘটনা, অথচ পূষণ আজ পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে সেই দিনটাকে, ওদের ক্লাস ফোরের অ্যানুয়াল রেজাল্টের দিন, ক্লাস ফোরের মেয়েদের এই স্কুলে শেষদিন। ওই তো ক্লাস ফোরের পূষণ ক্যাবলার মতো মাথা নাড়িয়ে প্রিয়াকে ভুলে না যাবার আশ্বাস দিচ্ছে।

প্রিয়া এবার ওর ব্যাগের চেন খুলে একটা ছোট্ট কাগজ বার করে এনে পূষণের হাতে গুঁজে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। পূষণ কাগজটা খুলে দেখল, ওতে লেখা আছে, ‘আই লাভ ইউ’।

ছেলেটা ঘাবড়ে গেল, ভয়ও পেয়ে গেল। কারণ ও জানে, এটা বড়দের কথা, এবং ছোটদের জন্য এসব বেশ খারাপ কথা। ছেলেটার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।

পঁচিশ বছর আগের কথা, কিন্তু পূষণ এখন ওই ছোট্ট ছেলেটার বুকের ঢিপঢিপানি শুনতে পেল। ভয় পেলেও কাগজটা ফেলে দিতে বা নষ্ট করতে পারেনি ক্লাস ফোরের সেই ছেলেটা, বাড়ির বড়দের চোখের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। 

এতবছর পরে স্কুলের আমগাছতলা ফিরিয়ে দিল অনেক পুরনো স্মৃতি। 

  তিনটে মাত্র শব্দ, ছেলেমানুষী আবেগ। কিন্তু ওই তিনটে শব্দকে আবার নেড়েচেড়ে দেখার ভুত পেয়ে বসল পূষণকে। বাড়ি ফিরে গুপ্তধন খুঁজে বার করার উত্তেজনায় ও খুলল পুরনো বইয়ের আলমারী। বাড়ি বদলানোর সময় এই আলমারীর জিনিসপত্রে হাত পড়েছে ঠিকই, কিন্তু পূষণ আশা করছে ওর সংগ্রহের জিনিসপত্র মা নিশ্চয়ই আবার সব ঠিকঠাক জায়গায় রেখে দিয়েছে! 

জীবনে প্রথম কলমে লেখা শুরু হয়েছিল ক্লাস থ্রীতে। সেই কলমটা স্মৃতি হিসাবে রেখে দিয়েছিল পূষণ। লাল রঙের প্লাস্টিক বডির সেই কলমটাকে পাওয়া গেল পেনের বাক্সে আরও কয়েকটা যত্ন করে তুলে রাখা কলমের সঙ্গে, যেমনটা সে রেখে দিয়েছিল। কলমটাকে খুলে ফেলল পূষণ। কলমের ভেতরে যেখানে কালি ভরা হয় কাগজটাকে গুটিয়ে সেখানেই ভরে রেখেছিল ও, যাতে কারো চোখে না পড়ে। তারপর এত বছরে সেই কথা ভুলেও গেছিল। 

কলমটা দ্রুত হাতে খুলে ফেলল পূষণ, এবং পেয়েও গেল কাগজটা। দুরুদুরু বুকে কাগজের ভাঁজ খুলে ও দেখল, পেন্সিলের লেখা বলে শব্দ তিনটে এখনও রয়ে গেছে। কাগজটা হাতে নিয়ে পূষণ আবার ফিরে গেল ছোটবেলায়, এই বালিকার একটা খবর নিতে ওর ভীষণ রকম ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল, প্রিয়ার দেখা পেলে কাগজটা দেখিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করবে, ওর মনে আছে কিনা এসব ছেলেমানুষীর কথা!  

কাগজটার উল্টো পিঠে প্রিয়া নিজের ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। বেশী কিছু নয়, কেবল বাবার নাম আর পাড়ার নাম। ছেলেমানুষী বুদ্ধিতে যতটা পেরেছিল, ততটুকুই লিখেছিল। তখন ঠিকানাটা দেখে পূষণের কিছু মনে হয়নি, কিন্তু আজ হল। কেন ঠিকানা লিখেছিল প্রিয়া? তার মানে ও কি চেয়েছিল এই ঠিকানায় পূষণ কোনোদিন পৌঁছে যাক? 

নাহ্! পূষণ কিন্তু বোঝেনি এই ইশারা। ওর বাড়িতে যাওয়া তো দূরের কথা পূষণ তো প্রাইমারী স্কুল ছাড়ার পর যোগাযোগই রাখেনি প্রিয়ার সঙ্গে, এবং তারপর ওকে ভুলেই গিয়েছিল।

বেশ খারাপ লাগছিল পূষণের। ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে মানুষের কত যন্ত্রণা হয় এখন তো বোঝে সে! যতই ছেলেমানুষী হোক, ভালোবাসা তো! প্রিয়ার বালিকা হৃদয় পূষণের জন্য পুড়েছিল একসময়, কিন্তু পূষণ তার মূল্য দেয়নি।

পূষণ ঠিক করল, প্রিয়ার লেখা শব্দদুটো ‘ভবনাথ ঘোষ, কুমোর পাড়া’কে আশ্রয় করেই খুঁজবে প্রিয়াকে। হয়তো ও আর ওই বাড়িতে থাকে না, বিয়ের পর ঠিকানা বদল হয়েছে, তবে যদি ওই ঠিকানায় গিয়ে প্রিয়ার বাবা-মায়ের খোঁজ পায় তাহলে চেয়ে নেবে ওর নতুন ঠিকানা। তারপর অবশ্যই একবার দেখা করবে প্রিয়ার সঙ্গে, বলবে, “এই দেখ! আমি কিন্তু ভুলিনি তোকে।”

 



নদীর লাগোয়া পাড়াটাই কুমোর পাড়া। প্রত্যাশা মতো সেখানে গিয়ে পূষণ দেখল বাড়ি ঘর কিছুই আর নেই আগের মতো, সবটাই নতুন। পুরনো মানুষ, মুদির দোকান, সেলুন, এসব কিছুই আর নেই যারা দিতে পারত পুরনো বাসিন্দাদের সন্ধান।

  লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে করে খুঁজতে গিয়ে অনেকটা সময় চলে গেছিল, সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। বিফল পূষণ ফিরে আসছিল কুমোর পাড়া ছেড়ে। ফিরতি পথে দুটো নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির ফাঁক দিয়ে এক চিলতে একটা গলিতে নজর গেল ওর। গলির শেষ মাথায় একটা পুরনো বাড়ি এখনও টিকে আছে, হলুদ টিমটিমে বাল্বের আলো ঘরের জানলা গলে বাইরে এসে পড়েছে। পূষণ বুক ঠুকে এগিয়ে গেল ওই বাড়িটার দিকে, ওর মনে হল এবাড়ির বাসিন্দারা হয়তো কোনো সন্ধান দিতে পারবেন।

কলিংবেল ছিল না, দরজায় কড়া নাড়ার ব্যবস্থাটাকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে এ বাড়ির বাসিন্দারা।

  বেশ কয়েকবার কড়া নাড়ানোর পর ভেতর থেকে বয়স্ক মানুষের কফ জড়ানো গলা ভেসে এল, “কে?”

“একটু বাইরে আসবেন? একটা কথা জানার ছিল।” গলার স্বর অনেকটা উঁচুতে তুলে বলল পূষণ।

লুঙ্গি, হাফহাতা গেঞ্জি পরা এক প্রৌঢ় এসে দরজা খুললেন। দরজার দুই পাল্লায় হাত রেখে প্রবেশ পথ আগলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কি চাই?”

পূষণ লক্ষ্য করল গেঞ্জির দুই বগলের নিচই ছেঁড়া। অভাবই মানুষটার স্বভাব রুক্ষ করে দিয়েছে, বুঝল পূষণ। মুখের ওপর দরজা আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে ভেবে চট করে কাজের কথায় চলে এল ও।

“আমি একজনের বাড়ি খুঁজছি। অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই, তাই খুঁজে পাচ্ছি না। দূর থেকে আপনার বাড়িটা দেখে মনে হল, আপনি হয়তো জানতে পারেন। তাই একটু বিরক্ত করতে চলে এসেছি।”

পূষণের দামি পোশাক, শরীর থেকে ঠিকরে বেরনো বিদেশি পারফিউমের গন্ধ ওর কৌলিন্য প্রকাশ করছিল, তাই হয়তো ওকে অবজ্ঞা করতে পারলেন না ভদ্রলোক।

“কার বাড়ি? নাম কি?”

“ভবনাথ ঘোষ। কুমোরপাড়াতেই থাকতেন, এখনও থাকেন কি না জানি না।”

“তাকে আপনার কিসের প্রয়োজন?”

“তাকে ঠিক প্রয়োজন নয়, আসলে ভবনাথবাবুর মেয়ে নিচু ক্লাসে আমার সঙ্গে পড়ত। ওকেই খুঁজছি।”

“সে মরে গেছে।”

দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন ভদ্রলোক। পূষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজাটার দিকে।

  রাতে বিছানায় শুয়ে পূষণ ধাঁধাটা বুঝতে চেষ্টা করছিল। ওর যুক্তিবোধ বলছিল, ওইটাই ভবনাথ ঘোষের বাড়ি এবং ওই প্রৌঢ় ভদ্রলোকই ভবনাথ ঘোষ। শুধু অভাব নয় মেয়ের অকালমৃত্যুও ভদ্রলোকের এমন রুক্ষ স্বভাবের জন্য দায়ী। এমনও হতে পারে মেয়ের মৃত্যু শোকে লোকটার মাথাতেও গন্ডগোল হয়ে গেছে, নইলে অমন ভাবে কেউ কথা বলে! 

যে মেয়েটির কথা এতবছরে একবারও মনে পড়েনি সেই প্রিয়ার জন্য মনটা ভারী হয়ে ছিল পূষণের। ও ঠিক করল, পরদিন সকালে আবার যাবে ওই বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে সন্তানহারা দম্পতির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আসবে, কিভাবে মৃত্যু হল প্রিয়ার জেনে আসবে তাও।

 পরদিন সকাল দশটা নাগাদ পূষণ আবার গেল ওই বাড়িতে। আজ ও খালি হাতে আসেনি, ফল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পূষণ এক ঝলক দেখতে পেল ছাদে একজন মহিলা জামাকাপড় শুকাতে দিচ্ছে। রোদের জন্য তার মাথা মুখ কাপড় দিয়ে আড়াল করা ছিল বলে মুখটা দেখতে পেল না পূষণ, তবে দেখল কয়েকটা বাচ্চাদের জামাও ছাদে মেলে দেওয়া আছে। 

“তাহলে শুধু বুড়োবুড়ি নয়, বাচ্চাও থাকে এ বাড়িতে! কিন্তু কার বাচ্চা?” ভাবতে ভাবতে দরজার কড়া নাড়ল পূষণ।

  আজ দরজা খুলল এক প্রৌঢ়া। ইনিও যাতে গতকালের মতো দরজা থেকে বিদেয় করে দিতে না পারেন তাই পূষণ মহিলাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি ফল মিষ্টির প্যাকেটটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

“মাসীমা আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না বোধহয়, আমি প্রিয়ার সঙ্গে প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। বিদেশে ছিলাম, অনেকবছর পরে বাড়িতে ফিরে ওর কথা খুব মনে পড়ছিল খুব, তাই দেখা করতে এসেছিলাম।”

পূষণ লক্ষ্য করল, কথাটা শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “সে নেই।”

মহিলার হাবভাব দেখে পূষণের একটু খটকা লাগছিল, মনে হচ্ছিল ব্যাপারটার মধ্যে একটা অসঙ্গতি আছে কোথাও। কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ও বলল, “এ বাড়িতে যে বাচ্চাটা আছে সেটা কার?”

পূষণের মনে হয়েছিল, প্রিয়ার অবর্তমানে ওর বাচ্চা দাদু-দিদার কাছে বড় হচ্ছে। কিন্তু ওর অনুমান যে ভুল ছিল, তা বোঝা গেল ভদ্রমহিলার পরের কথায়।

“বাচ্চা! কোন বাচ্চা? এখানে তো কোনো বাচ্চা থাকেনা। শুধু আমরা দুই বুড়োবুড়ি থাকি।”

“ও! আসলে ছাদে বাচ্চাদের জামা দেখলাম মনে হল, তাই-”

“ওগুলো পাশের বাড়ির ওদের।”

কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না পূষণের। ছাদে যাকে জামাকাপড় মেলতে দেখেছে ও সে তবে পাশের বাড়িতে থাকে? কিন্তু সে এবাড়ির ছাদে সে এলো কোথা দিয়ে আর গেলই বা কোথায়? যতই সন্দেহ হোক এ নিয়ে তো আর তর্ক করা চলে না, তাই পূষণ এবার সেই প্রশ্নটাই করল যেটা ও জানতে এসেছিল।

“প্রিয়ার কি হয়েছিল মাসীমা?”

“শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল!”

এরপর আর কথা বলা যায় না। পূষণ চুপ করে রইল, সেইসঙ্গে প্রিয়ার মা-ও।

দেওয়ালে একটা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি লাগানো ছিল। ছবিটা যে প্রিয়ারই বুঝতে অসুবিধা হল না পূষণের। ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা প্রচন্ড কষ্টবোধ পূষণের ভেতর থেকে ঠেলে উঠছিল। ওর মনে হচ্ছিল, যদি সে প্রিয়াকে ভুলে না যেত, প্রিয়ার ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিত, তাহলে মেয়েটাকে এমন কষ্ট পেয়ে অসময়ে চলে যেতে হত না। গলাটা শুকিয়ে আসছিল পূষণের, ও জল চাইল।

  প্রিয়ার মা জল আনতে ভেতরে চলে গেলেন। এই ঘরে ঢোকার পর থেকে পূষণের একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, এখন একলা ঘরে বসে সেটা আরো বেড়ে গেল। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল কেউ যেন ওকে দেখছে, লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে ওর দিকে, কিন্তু চারদিকে তাকিয়েও কোথাও কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না পূষণ। এদিকে মাসীমা জল আনতে গেছেন মিনিট দশেক পার হয়ে গেছে, ফেরার নাম নেই। পূষণের মনে হল, যা জানার ছিল জানা হয়ে গেছে যখন, তখন এই অস্বাভাবিক পরিবেশে আর বসে না থেকে বেরিয়েই যাওয়া ভালো। পূষণ উঠতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে একটা ছোট্ট খেলনা গাড়ি ওর পায়ের কাছে এসে গেল। চমকে উঠে আবার বসে পড়ল পূষণ। কে পাঠালো গাড়িটা? কেউ কি ওকে কিছু বলতে চাইছে? কিন্তু আশেপাশে কারোর উপস্থিতিই তো নজরে আসছে না! মুখ তুলে তাকাতে আবার প্রিয়ার ছবিটাতে চোখ গেল পূষণের, মনে হল প্রিয়া যেন ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে।

অসহ্য লাগছিল পূষণের, পরিবেশটা ভারী হয়ে চেপে বসেছিল ওর বুকের ওপর, দম বন্ধ লাগছিল। মাসীমাকে না বলেই বেরিয়ে আসবে ভেবে ও উঠে পড়ল, আর তখনই জলের গ্লাস হাতে ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। গ্লাসটা পূষণের হাতে দিয়ে বললেন,

“উনি বাজারে গেছেন, এখনই এসে পড়বেন। তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছি দেখলে আমার ওপর রাগারাগি করবেন। তুমি এবারে যাও বাবা।”

  বাইরে বেরিয়ে পূষণ হাফ ছাড়ল। পুরো বাড়িটাতে এমন একটা দমচাপা ভাব যে ওর নিজেরও দম আটকে আসছিল। কিন্তু বাইরে এসেও ওর মনে হচ্ছিল কেউ ওকে এখনও দেখছে। ও পেছন ফিরে তাকালো, মনে হল ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির জানলার পাশ থেকে কেউ যেন সরে গেল। আর তখনই ওর পায়ের কাছে কিছু একটা এসে পড়ল। পূষণ তাকিয়ে দেখল একটা খেলনা গাড়ি। 

আবারও খেলনা গাড়ি! ভয়ে ভয়ে গাড়িটা কুড়িয়ে নিল পূষণ, দেখল গাড়ির সঙ্গে একটা কাগজ রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো আছে। কাগজটা দেখেই ওর একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল, প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চোখ চলে গেল ওই জানলায়, যেখান থেকে এক্ষুণি কাউকে সরে যেতে দেখেছিল। এবার তাকানোর পর ও জানলায় দুটো চোখ দেখতে পেল। পূষণ তাকাতেই চোখের মালিক এক ঝলক দেখা দিয়ে হাত নেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কাগজ সমেত খেলনা গাড়িটা পকেটে ঢুকিয়ে পূষণ তাড়াতাড়ি গলি ছেড়ে বেরিয়ে এল। 

 কোনোমতে উৎকন্ঠা চেপে রেখে কুমোরপাড়া ছেড়ে বেরিয়ে কাগজটা বার করল পূষণ। এবার আর তিনটে শব্দ নয়,  বেশ কয়েকটা লাইন লেখা আছে। কাঁপা কাঁপা হাতের লেখা জানাচ্ছে, ‘কলেজ জীবনে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম। নিষিদ্ধ সংগঠন, বাড়ি ছেড়ে, রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাই। পুলিশি এনকাউন্টারে গুলি লেগেছিল, কোনোরকমে লুকিয়ে বাড়িতে ফিরে আসতে পেরেছি। একটা চোখ নষ্ট আর একটা হাত অকেজো। পুলিশের খাতায় আমি কিন্তু মৃত, বাড়ি বয়ে এসে পুলিশ মৃত্যুর খবরটা দিয়ে গেছিল। আমি যে বেঁচে আছি, এই খবরটা কোনোভাবে লিক করলে আবার পুলিশি অত্যাচার হবে বাড়িতে, তাই আমার মরে যাওয়ার এই গল্পটাই সবাইকে জানানো হয়েছে, যেটা তুইও শুনে এসেছিস।  আর হ্যাঁ, বাচ্চাটা আমারই, আমার মেয়ে, একবছরের। আমাদের গোপন আস্তানায় যখন পুলিশ আসে তখন ও পেটে ছিল। তবে ওকে আর বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যাবে না, তাই আমাদেরও এখানকার পাততাড়ি গোটাতে হবে শিগগির-ই। খুব ভালো লাগল যে শেষ পর্যন্ত তুই এলি, দেখতে পেলাম তোকে। আর কয়েকমাস বাদে যদি আসতিস, তাহলে এ জীবনে আর কখনো দেখা-ই হত না। আমি কিন্তু অনেকবছর তোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, তুই আসিসনি। আর সেই যে তোকে কথা দিয়েছিলাম, ওটা কিন্তু এখনও সত্যি। আমি কিন্তু তোকে ভুলিনি আজও, যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি কোনোদিনও ভুলব না।”

  প্রিয়ার চিরকুটটা পাওয়ার পর দুটো দিন কেটে গেল সিদ্ধান্ত নিতে। নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করল পূষণ, শেষ পর্যন্ত জয় হল ওর শুভবুদ্ধির। পূষন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেভাবেই হোক প্রিয়ার বাবাকে রাজি করিয়ে ওকে বড় শহরে নিয়ে যাবে। সবে একটা বছর পার হয়েছে, এখনও চিকিৎসা করালে হয়তো বা ওর নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখ, হাত কিছুটা হলেও ঠিক হতে পারে। এভাবে বিনা চিকিৎসায়, মৃত পরিচয়ে প্রিয়ার পড়ে থাকাটা মেনে নিতে পারছিল না পূষণ। তাছাড়া ওর সন্তানেরও সামাজিক পরিচয় দরকার! দূরে কোথাও চলে গেলে নতুন পরিচয়ে জীবন শুরু করতে পারবে প্রিয়া। এইসব করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেটা প্রিয়ার বাবার নেই, বুঝে গেছে ও, আর তাই প্রিয়ার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চাইছে।

মনস্থির করে তৃতীয় দিন সকালে ভবনাথ ঘোষের বাড়িতে আবার গেল পূষণ। দরজা জানলা বন্ধ ছিল আগের মতোই। আজ আর কড়া নাড়তে হল না, হাত দিতেই দরজা খুলে গেল। পূষণ কারো অনুমতি না নিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ডাকাডাকি করার পর কাউকে বেরিয়ে আসতে না দেখে ও পায়ে পায়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ল। খাট বিছানা, কাপড়চোপড়, রান্নার বাসনপত্র সবই পড়েছিল যেখানে যা থাকার, কেবল মানুষগুলোকে কেউ যেন জাদুবলে ভ্যানিশ করে দিয়েছিল। পূষণ বুঝতে পারল, শেষ পর্যন্ত চলেই গেছে ওরা, যেখানে যাবার ছিল! 

  বেরিয়ে আসার আগে প্রিয়ার ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পূষণ। ওর মনে হল, প্রিয়ার হাসিমাখা চোখদুটো যেন বলছে, “সেই তো এলি! কিন্তু বড় দেরি করে ফেললি।”

প্রিয়ার চোখ থেকে চোখ সরানোর পর ছবির ফ্রেমে গুঁজে রাখা একটা কাগজ পূষণের নজরে এল। ওর মনে হল কাগজটা সদ্য রাখা হয়েছে, আগেরদিন ছিল না। কৌতুহলী হয়ে কাগজটা নিল পূষণ।

প্রিয়ার হাতের লেখায় মাত্র দুটো লাইন, আরেকটা ছোট্ট চিঠি।

“আমি জানতাম তুই আবার আসবি। আর খুঁজিস না আমাকে।”

চিরকুটটা সঙ্গে নিয়ে প্রিয়াদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল পূষণ, আর পিছন ফিরে তাকালো না। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *