short-story-chor

চোর
সমীরণ দাস


রঙমাখা সাজগোজ করা মেয়েমানুষের মত শারদীয় কলকাতায় ভিড় — পুজো এসেছে, এখানে ওখানে ‘কলকাতা আমাদের’ বিজ্ঞাপন ‘কলকাতা আবার কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে’ অথবা ‘একটি শিশুর সোনার থালা/দুটিতেও আদর/অধিক মানে অবহেলা/কেবলই চড়চাপড়’-এর নীচে এক একটি প্রজন্ম বাড়তে থাকে অনাদরে। দশ বছরের ন্যাড়া —- কে তার বাপ, কেন সে প্রতিবছর নতুন নতুন বাপের আমদানি দেখে, জানে না। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে মানুষের চোখের মত চাঞ্চল্য আর মাথার মধ্যে জটিল চিন্তার ধাঁধা নিয়ে। ছেঁড়া একটা হাফ প্যান্ট জড়িয়ে থাকে টুটা ফাটা শরীরের ধুলোকাদায় মাখা মধ্যদেশ।

রঙিন বিজ্ঞাপনের নীচে পরিবারটি। দুটো খাঁড়া থাম্বা ছ-সাত ফুট উঁচু, মাথার উপর বিরাট হোর্ডিংয়ে ছড়া কেটে কেটে লেখা সোনার থালার বিজ্ঞাপনটি। পাশেই খাটাল, গরু-মোষ — অন্ধকার — পেচ্ছাপের গন্ধ আর পাশে সার সার প্লাইউডের ঘর। ঘরের মধ্যে ঘর। প্রতিটি ঘরে বেড়ে চলে ভবিষ্যৎ মানুষের বীজ। সামনের রেল লাইন থেকে ঘটাং ঘটাং আওয়াজ আসে যা কখনোই এখানকার ঘুমিয়ে থাকা মানুষদেরও অসহ্য মনে হয় না। ভোর-ভোর জেগে ওঠে বস্তি। বাল-বাচ্চা, জেনানা-মর্দানা। আজ পুজো, পঞ্চমী তিথির শেষ অন্ধকার ছেঁড়াখোড়া করে উড়ে আসে মাইকের হিন্দি গানের দুর্ধর্ষ শব্দ, বস্তির চিৎকার, খিস্তি আর ষষ্টির ভোর। আঠার মত ঘুম লেগে ছিল ন্যাড়ার চোখে, জেগে উঠেই সে চিৎকার শোনে। মা গাল পাড়ে, গলার শিরা ফুলে ওঠে চিৎকারে; গা দিয়ে ঘামও ঝরে। পাকানো দড়ির মত চেহারা এই মধ্য তিরিশেই যেন প্রৌঢ়া। সে ঘুঁটে দিয়েছিল সামনের দেওয়ালে, সকালে আঁচ ধরানোর জন্য আনতে গিয়ে দেখে দেওয়াল সাফ। আর তখন থেকেই মায়ের গলার শিরা ফুলে উঠছে, বস্তির হাওয়া কাঁপছে থর থর করে। কে চোর, মা দেখেনি।‌ তবুও তার ধারণা পরোক্ষ কথার গালাগালিতে স্পষ্ট হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অপরদিক থেকে সাড়া মেলে। সবকিছু ঠিক ঠাক বুঝতে পারেনা ন্যাড়া, তবুও বন্ধুদের কাছ থেকে যা ইঙ্গিত পেয়েছে তা তার নতুন বাবার সঙ্গে মা-কে জড়িয়ে। ন্যাড়া বুঝতে পেরেছে যা অন্যের চোখে অশোভন, তাই-ই প্রকাশ পাচ্ছে মায়ের গালাগালের উত্তরে —- এই মাগি আমাকে গাল দিস ক্যান? নিতে দেখিছিস তোর ঘুঁটে?

তুই না তো কে নিয়েছে? কাল তুই চাসনি আমার কাছে? বলিসনি এক দিনের জন্নি খান দশেক ঘুঁটে দে, ঘরে একটাও নেই কো, তা’লে এখন এত ঘুঁটে তোর ঘরে আসে কোত্থেকে শুনি?

বলব শালি কোত্থেকে আসে? তোর মত তো আমার গণ্ডা গণ্ডা ভাতার নেই যে দিয়ে যাবে, খেটে পয়সা রোজগার করে কিনতি হয়।

বাঘা, পাশ থেকে বস্তির অন্যান্য নেড়িদের সঙ্গে বেড়ে উঠছে যে, গলা মেলায় ঘেউ! ঘেউ! সাত সকালের মিষ্টি হাওয়া, শিশির এক নরকে পরিণত হয়।

অন্যদিকে থেকেও আওয়াজ ওঠে — কোন হারামির বাচ্চা আমার সর্বনাশ করল গো? কোন ভাতারখাগী — খানকি?

বেশ কিছুদিন পর বস্তির বাতাস আবার গরম হতে শুরু হয়েছে। চটকলের ঝাড়ুদার পরেশ লস্করের বৌ ছেলের অসুখের জন্য ডাক্তার খর্চা বাবদ একশো টাকা তার টিপতালা লাগানো ট্রাঙ্কে রেখেছিল, খুলে দেখে সব ফাঁকা। কাল রাত থেকে জ্বরে বেহুঁশ, ডাক্তার ডাকতে পারেনি এখনো। ধার কর্জ করে টাকাটা জুটিয়েছিল পরেশ। যখন বৌয়ের হাতে দেয়, বিন্দি পিসি দেখেছিল প্লাই উডের বেড়ার ফাঁক দিয়ে। মুখোমুখি ঘর। সাতদিন বিন্দি ভিক্ষেয় বের হয় না। পারে না। রস নেমেছে পায়ে, ফুলে গেছে দুই পা। সেই ফোলা পা নিয়ে বিন্দি — যার আপন বলতে দূর সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে পরেশ — শুয়ে থাকে বিছানায়। পেটে দানাটি পড়েনি। বুড়ো বয়সের মৃত্যুকালীন লোভ নিয়ে বিন্দি তাকিয়ে থাকে, গালাগাল দেয় বিড়বিড় করে আর কাৎরায় অসুখের যন্ত্রণায়। এমনিভাবে শুয়ে থাকতে থাকতেই বিন্দি দেখেছিল পরেশের বৌয়ের হাতে টাকাটা দিতে। একটু একটু করে বেলা বাড়ে, পরেশের বৌ অসুস্থ ছেলেকে ঘরে রেখে সামনের ডোবায় নাইতে বের হলে দুপুরের বস্তির নির্জনতায় মানুষের চোখ এড়িয়ে বিন্দি কেতরে কেতরে পরেশের ঘরে ঢোকে। ছেলে জ্বরে বেহুঁশ থাকায় কিছুই বুঝতে পারে না।

কিন্তু পরেশের বৌ বুঝতে পারে কে টাকা নিয়েছে। পরেশের টাকা দেওয়ার সময় বিন্দির লোভী চোখে তাকিয়ে থাকা সে দেখে ফেলেছিল। পরে যখনই দেখল ট্রাঙ্ক ফাঁকা, মুহূর্তে বুঝতে পারল কার কাজ। তখন থেকেই শুরু হয়েছে চিৎকার, খিস্তি। ন্যাড়া কিছুক্ষণ শুনল, বুড়িকে দেখল। বুড়ী শুয়ে শুয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। প্রতিবাদ করছে, কারণ ওর ধারণা প্রতিবাদ না করলে সবাই ভাববে বুড়ীই চোর। তবুও ন্যাড়া, দশ বছরের ন্যাড়া রাগে না বুড়ির উপর। কারণ ওর একমাত্র আপনজন পরেশ নিজেই বুড়িকে লাথি-ঝাঁটা মারে। দিনের পর দিন সেই সব দেখতে দেখতে একটা মূক সমর্থন তার তৈরি হয়েছে বুড়ির প্রতি।

প্রায় আটটা। একটা চৌখুপি স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরের মধ্যে ইটের উনুন জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে ন্যাড়া পেটের মধ্যে খিদে মালুম করে। উনুনের পাশে বসে আটা মাখছে মোতি, ন্যাড়ার বড় বোন, রাত জাগার ক্লান্তি ও ঘুমের কষ এখনো লেগে আছে দুচোখে। কাল কত রাতে ফিরেছে কে জানে! মাঝে মাঝে এমন ঘটে, রাতের বেলা বেরিয়ে যায় নাইলনের শাড়ি পরে এবং ফেরে —- কখন ফেরে ন্যাড়া জানে না। দূর থেকে মোতির ঘোলাটে চোখ দেখে ন্যাড়া।

নতুন বাপটা —- দিন দশেক আগে মা’র সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়েছিল, হদিশ ছিল না কোন চুলোয় গিয়ে কী করছে, সপ্তা খানেক খানেক আগে ঘোর সন্ধ্যায় ফিরেছিল হরিদাস কামারের সঙ্গে মালে চুর হয়ে। বেতের মতো পাকানো চেহারা, কালো — টলতে টলতে মায়ের কাছে এসে বলল, দুটো টাকা দে মাইরি, জলদি।

মা তাকাল তীব্র চোখে, পোড় খাওয়া শুকনো ভ্রূ কুঁচকে উঠল, বলল, হারামির পয়সা, না? তোর মাল টানার জন্য পয়সা আমি কেন দেব? কামাই করে খা!

বাপটা টলতে টলতে পায়চারি করছিল। থমকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল মায়ের কথায়। চোখ বড় করে তাকাল। লাল, ঘোলাটে চোখের নীচে এক রাশ শ্যাওলা জমা। দুহাত উপরে তুলে হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে সারা শরীর কাঁপিয়ে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল মায়ের মনে। চিৎকার করে জড়ানো গলায় বলল, মাল খাবো না কী খাবো? আয় তালে তোরেই খাই? বলেই হাত তুলতে চাইল মায়ের গায়ে। ভর সন্ধ্যায় দু পা এগিয়ে এসে ঝাঁপ দিতে গেল শরীর তুলে। মোতি তার ষোল বছরের সদ্য যৌবনা শরীর নিয়ে দেখছিল সব কিছু। হঠাৎ লোকটার নজর পড়ল ওর দিকে। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মায়ের বদলে মোতিকে ধরার জন্য দিক পরিবর্তন করে হাত বাড়াল। জান্তব গর্জন করে মোতির হাত ধরে টানল ঘরের দিকে। সদ্য ধার দেওয়া রামদা পাশেই পড়েছিল। ধাঁ করে সেটা মায়ের হাতে উঠে গেল। তার শুকনো শরীরে যেন হঠাৎ দুর্গার শক্তি এসে গেছে। মায়ের রামদা হাতে মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেল ন্যাড়া। মূর্তির মুখ থেকে তীক্ষ্ণ স্বর ফুটে বের হল, দায়ের ধারালো ফলা থেকে ঝিলিক দেওয়া আলোর বিচ্ছুরণের মত, শালা খানকির ছাওয়াল, তোরে আজ জানেই মেরে ফেলব।

বলতে বলতেই আঘাত এসে পড়ল কাঁধের উপর। এক পর্দা চামড়া কেটে ফ্যাটফেটে মাংস ঝুলে পড়ল। বিন্দু বিন্দু রক্ত চুইয়ে বের হতে লাগল। তখনই লোকটার মনে হল, যে কোনো মুহূর্তেই আরো একটা কোপ এসে পড়তে পারে। সে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল জখম কাঁধ নিয়ে। আর ফেরেনি। ন্যাড়ার হঠাৎ মনে পড়ল এইসব কথা।

হাতলখসা একটা এলুমিনিয়ামের কড়াই — আঘাত লেগে সারা গায়ে আলু আলু হয়ে গেছে — সেটার উপর কী যেন চাপিয়েছে মা। বুড় বুড় করে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাস ছড়াচ্ছে চারিদিকে। ন্যাড়া উঁকি মেরে দেখে। জ্বাল হচ্ছে না ভালো, আধ ভেজা ঘুঁটের আঁচে ভালো ধরেনি উনুন, এবং সেজন্যই ধোঁয়া হা হা করছে সারা ঘরে।

মায়ের দুচোখ লাল। শুকনো খড়খড়ে শেকড় বাকড়ের মত শিরা ওঠা হাতে কোঁচকানো কপাল ও শ্যাওলা পড়া পুরনো স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের মত শরীর থেকে ঘাম মোছে। ডান হাত দিয়ে উনুনের উপরে বসানো চচ্চড়িতে খুন্তি নাড়ে। অনেকটা দূর থেকেও ন্যাড়া খাবারের স্বাদু গন্ধ পেল। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল খিদেয়। এখনো কত দেরি, কে জানে?

যদিও দিদি, তবুও ন্যাড়া আদৌ গুরুত্ব দেয় না মোতিকে। সেজন্যই সে চেঁচিয়ে ডাকল, এই মোতি জলদি রুটি বেলা শেষ কর। কী খুচ খুচ কত্তিচিস?

মোতি ঘুমহীন লাল চোখে তাকায়, তারপর বলে, চুপ! একদম চুপ করে থাকবি! যখন হবে তখন পাবি, বেশি ক্যাচালি করলি আরো দেরি করে দেবো।

মোতির কথা তীব্র ভাবে আঘাত করল ন্যাড়াকে। ওর চোখ সরু হয়ে গেল। চৌখুপি আটো ঘরে ছ্যাঁচড়া গরম আর পুঁইডাটার চচ্চড়ির ঘ্রাণ ভিতর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। ওর খালি গা, ছেঁড়া হাফ প্যান্টটা কোমরে জড়ানো। কাঁধের পিছনের হাড় দুটো কূজের মত উঁচু হয়ে আছে। সে মনে মনে ভাবল, আমাকে কী ভাবে মোতি? আমি কি কিছুই বুঝি না? কী করে মোতি, কোথায় যায়, কেন যায়? এই মুহূর্তে সে ওর সমস্ত কথার জবাব দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু তাহলে খাওয়াটা আর হবে না। মোতি যা-ই বলুক না কেন, মা ওকেই সমর্থন করবে। ওর জন্যই তো সংসারটা চলছে। ন্যাড়ার দশ বছরের মাথা, বেশি কিছু বোঝার কথা নয়, তবুও সে অনেক কিছু বুঝতে পারে।

আবার উঁকি মারে সে। কয়েক খানা সেঁকা হয়ে গেছে, সেজন্যই সে সুর পালটে ভিখিরির মত ক্যাঁৎরাতে লাগল, এই মা, দে না?

মা কোনো কথা বলেনি এতক্ষণ।‌ হঠাৎ রেগে উঠল, যেন বুকের মধ্যে জমে থাকা বারুদে আগুনের ফুলকি পড়েছে। গরম খুন্তি উঁচিয়ে বলল, ভাগ! ভাগ! দূর হয়ে যা!

ন্যাড়া দুই হাত দিয়ে জীর্ণ, নোংরা প্যান্টটা কোমরের কাছে গিট পাকাতে পাকাতে নিঃশব্দে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। সামনে গঙ্গারামের মুদিখানা। মাস দুয়েক দোকান দিয়েছে গঙ্গারাম। আগে কাজ করত চটকলে, ক্যাজুয়াল লেবার — নো ওয়ার্ক নো পে। তিন বছর ওভাবে কাজ করে রেগুলার হয়েছিল। সেভাবে চলল আরো কিছুদিন, গঙ্গারাম বিয়ের কথা ভাবল। মেয়ে দেখতে শুরু করল। ছোট খাট কাজ করে, এমন মেয়ে পছন্দ ওর, যে দুচার পয়সা ঘরে এনে সাহায্য করতে পারবে। এই রকম অবস্থায় গঙ্গার বিয়ে যখন প্রায় ঠিক, ছাঁটাই হয়ে গেল সে। স্ট্রাইক আরম্ভ হল চটকলে।

ন্যাড়া এখন দোকানের কাছে। বোয়েমের মধ্যে বিস্কুট আর লজেন্স সাজানো থাকে লোভনীয় করে, দেখেই ওর পেটের খিদেটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। গঙ্গার নজর এড়িয়ে কিছু সরানো যায় কিনা, ভাবতে শুরু করল। কিন্তু তার আগেই গঙ্গার নজরে পড়ে গেল ন্যাড়া। গঙ্গা ডাকল, এই ন্যাড়া, শোন এদিকে আয়।

ন্যাড়া তার কোমরখসা প্যান্টটা এক হাতে ধরে এগিয়ে গেল। গঙ্গারাম চেঁচিয়ে বলল, কিরে? চোরের মত উঁকি মারছিস কেন? একটু দাঁড়া এখানে, আমি আসছি।

গঙ্গারাম বেরিয়ে গেল। ন্যাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে লাগল দোকানের সামনে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আবার খিদেটা চুলবুল করে উঠল। কী নেওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে চারদিকে তাকাল। কেউ নেই। তৎক্ষণাৎ সে বয়েম খুলে তুলে নিল কিছু বিস্কুট, কিছু লজেন্স। বোয়েমের ঢাকনি বন্ধ করে আবার তাকাল চারিদিকে। কেউ দেখেনি।

ন্যাড়ার বয়স যখন সাত, মা ওকে নিয়ে বের হত প্রতিদিন। বাবুদের বাড়ি ঠিকে ঝি-র কাজ করত মা, এবং কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা নামত।

একদিন সন্ধ্যা। কাজ শেষ। বাবু তখনো ফেরেনি অফিস থেকে। বৌদি বাথরুমে। মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে আসতে ন্যাড়া দেখে, বাবুদের ঘড়িটা টেবিলের উপর পড়ে আছে। ন্যাড়া দেখল, মা দ্রুত ঘরে ঢুকে এক ঝটকায় টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে নিয়ে শাড়ির মধ্যে পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসছে। দরজার বাইরে এসে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মন এবং শরীর স্বাভাবিক করে চেঁচিয়ে বলল, বৌদি, দরজাটা বন্ধ করে দিও গো! আমি চললাম।

ন্যাড়ার মনে আছে, তখন মাসের শেষ। ঘড়িটা বিক্রি করে যে পঞ্চাশ টাকা পেয়েছিল, তাই দিয়ে মাসের শেষ দুদিন চলেছিল ওদের। সেই থেকেই চুরি শিখেছে ন্যাড়া। আজ ও ও-বিদ্যায় ওস্তাদ।

গঙ্গারাম এলো একটু পরে। বলল, চুরি টুরি করিসনি তো? এই বিস্কুটটা নিয়ে ভাগ! বলতে বলতে গঙ্গা বয়েম খুলে একটা বিস্কুট এগিয়ে দিল ন্যাড়ার দিকে। ন্যাড়া হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে মনে মনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে।




চারদিকে চারটি লোহার থাম্বা, মাথার উপর হাজার পাখির বিষ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডের টিনের শেড। তলায় একটা থাম্বার দুদিকে ন্যাড়ার দুখানা হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। কোমরের দড়িতে আটকানো প্যান্টটা প্রায় খুলে গেছে। এলোমেলো চুল, মাথা নিচু করা বিধ্বস্ত শরীরটা কাত হয়ে ঝুলে আছে, যা একটু আগেও ছিল মানুষের চোখের মণির মত চঞ্চল, চটপটে। মুখের কষ দিয়ে চোয়াচ্ছে সাদা ফেনার সঙ্গে লাল রক্ত।

একটা জনতা —- ছেলে-বুড়ো, কিশোর-যুবক, মোটা-রোগা, ঢ্যাঙ্গা-বেটে, রঙচঙে-খসখসে —- খিকখিক করে হাসছে আর থেকে থেকে মন্তব্য করছে। একটা বিদ্ঘুটে শব্দের মিশ্রণ তৈরি হচ্ছে ক্রমাগত।

ক্যালা না শালাকে ধরে।

ইস! এইটুকু ছেলে চুরি করেছে!

কাকা, কেসটা কী?

আরে বাচ্চা ছেলে, ছেড়ে দিন!

খবরদার, ছাড়বেন না। আচ্ছা করে শিক্ষা দিয়ে দিন।

বড় গ্যাং থাকে ওদের!

এই শালা, চুরি করেছিস কেন বল?

নীচু হয়ে ঝুলে ছিল ন্যাড়ার মাথা। পিছন থেকে ঘাড়ের উপর একটা রদ্দা এসে পড়ল। ঘোঁত করে শব্দ বের হল গলা দিয়ে। চোখের সামনে কালো পর্দায় অসংখ্য তারা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মাথা ঝিম ঝিম করে উঠতে থাকল এবং একই সঙ্গে ঘোলাতে লাগল সারা শরীর। এক একটা আঘাতের সঙ্গে চোখে নিরীহ ভাব ফুটিয়ে কাতর আবেদন জানাতে থাকে, আমি চুরি করিনি বাবু! আমি চুরি করিনি!

কে যেন বলল, দাদা ব্যাপারটা কী বলুন তো? বাচ্চা ছেলেটাকে মারছেন কেন?

মাথা তুলে তাকাল ন্যাড়া। তাহলে এতক্ষণে কি একটা ব্যবস্থা হবে? আর মার খেতে হবে না? প্রশ্ন শুনে পাশে দাঁড়ানো একটা মাঝবয়সী লোক রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করল, আর বলবেন না! আমার ফুটপাতে দোকান, এখন পুজোর মরসুম — দেখছেন তো চারদিকে কেমন ভিড়। সব সময় সব দিকে নজর রাখা হয়ে ওঠে না। সেই দুপুর থেকে মালটাকে দেখছি দোকানের সামনে ঘোরাফেরা করতে। চোখ দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। খানিক আগে আমাকে বলল, খদ্দের এসেছে, ওদিকে মাল দেখাও। আমি অন্য দিকে ঘুরতেই ঝটপট দুখানা চটি হাওয়া! তখন ঠিক বুঝতে পারিনি, কিন্তু একটু পরেই মনে হল ডান দিকে ঝোলানো ছিল আড়াইশো টাকা দামের যে জোড়া, কোথায় গেল? খোঁজ, খোঁজ, কোথায়ও নেই। সেই থেকে এই শালারও পাত্তা নেই। বুঝলাম, ওরই কাজ। কিন্তু একটু পরে নিজেই এলো, যেন কিছুই হয়নি, মুখে সেই রকম ভাব করে। আর যায় কথায়? ঘেটিটা ধরলাম ঘপ করে।

কিন্তু এইটুকু ছেলে চুরি কেন করবে? বিভ্রান্তি মুখে ফুটিয়ে বলল প্রশ্নকর্তা।

ওইটুকু কি মশাই? বলতে বলতে দোকানদার এগোয় ন্যাড়ার দিকে, তল পেটে হাঁটু দিয়ে গোত্তা মারতে মারতে বলে, কী রে শালা বলবি না মাল কোথায় রেখেছিস?

ন্যাড়ার শরীর ঘোলাচ্ছিল, তলপেটে আঘাত পেতেই একরাশ হলুদ বস্তু নেমে এলো পেটের ভিতর থেকে। মাখামাখি হয়ে গেল বোতামহীন প্যান্টে। সঙ্গে সঙ্গে হাসির হররা উঠল চারদিক থেকে, কী মজার দৃশ্য!



রাত দশটা। একই রকমভাবে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ন্যাড়া। প্যান্টটা হলুদ নোংরায় মাখামাখি। আঠার মতো সেই নোংরা লেপ্টেও আছে শরীরের কোথায়ও কোথায়ও। সারাদিন কোনো খাওয়া জোটেনি। দশটায় দোকান বন্ধ করল লোকটা। অসীম করুণায় ন্যাড়ার হাত খুলে দিয়ে বলল, যা। পালা! ফের যদি কোনোদিন দেখি এই চত্তরে, একদম শেষ করে দেবো।

ন্যাড়া এখন হাত পা মুক্ত। ভাবছিল, আড়াইশো টাকার চটিজোড়া কতোয় বিক্রি করতে পারব? একশো টাকা তো পাবোই! জোরে শ্বাস নিয়ে এগোতে থাকে সামনের দিকে, তখন ফের সেই মাঝবয়সী দোকানদার ডাকে, এই শোন?

ন্যাড়া ফের ভয় পেলেও ঘুরে এগিয়ে যায় লোকটার দিকে। লোকটা তার রেক্সিনের ব্যাগের ভিতর থেকে একটা কাগজের ঠোঙ্গা বের করে ন্যাড়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, সারাদিনে তো খাওয়া হয়নি। এই ঠোঙায় চারটে রুটি আর আলুরদম আছে। নে! খা!

ন্যাড়া একবার অবিশ্বাসী চোখে তাকাল। তারপর কাঁপা হাতে ঠোঙ্গাটি ধরতে ধরতেই বুঝতে পারল, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে! এইটুকু ভালোবাসার ছোঁয়াও সে জীবনে পায়নি কখনো।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-chor

  1. সমাজের নিষ্ঠুর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, খুব ভালোলাগল।

  2. কলকাতার বস্তিগুলোতে এমনই সব ঘটনা ঘটে। বর্ণনার গুনে বিষয়টি একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শেষ দৃশ্যে মোচড় ও যথেষ্ট। তবে ওই দোকানদার লোকটি কিনা ওকে তলপেটে গোত্তা মেরেছিল। তা হোক, এক্ষেত্রে স্বভাবে নয়, অভাবেই চোর তৈরি হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *