short-story-corporate

কর্পোরেট
রেহান কৌশিক


তড়বড় করে কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল। অনুপম হাইওয়ে দিয়ে বাইক চালাতে চালাতে আকাশের দিকে তাকাল। ঈশানকোণে শ্লেট রংয়ের চাপচাপ মেঘ। শালা, আর দশটা মিনিট দে, ডানহাতে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে অদৃশ্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিজের স্টাইলে দাবি জানাল অনুপম। সত্যিই তো, আর দশ মিনিট পেলে সে সুন্দরগড় পৌঁছে যাবে। ঝকঝকে রাস্তা। সাত কিলোমিটার বাকি। বাড়ি পৌঁছনোর পর যত ঢালবি ঢাল, কুছ পরোয়া নেই।

করোনা গিয়েও যায়নি। এ সময় ভিজে সামান্য সর্দিজ্বর হলেও ডাক্তাররা তাদের চেম্বারে অ্যালাও করবে না। জ্বর নিয়ে এইসময় বারো-চোদ্দোদিন বসে গেলে সেলসটার্গেট খারাপ-ফ্রিজে রাখা আইসক্রিমের মতো ছেতরে যাবে। অথচ করোনাকালে সব ব্যবসা লালবাতি জ্বালার যোগাড় হলেও মেডিকেল সেক্টর ফুলেফেঁপে ঢোল। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল সেলসের এরিয়া-ম্যানেজার সমাদ্দারের মুখ। একন্বরের চুথিয়া। ব্যাটা পাক্কা শকুন। মুখে বসন্তের দাগ। চোখ দুটো গোল। আধবোজা। জীবনে ঠোঁটের কোণে হাসির দেখা মেলেনি। সে একটাই কাজ পারে, প্রতি টার্মে লাগামছাড়া টার্গেট ফিক্স করতে। আর টার্গেট ফুলফিল না-হলেই প্রথমে নোটিশ, তারপরের স্টেপেই ইমেলে টারমিনেশন লেটার। মাঝে মাঝে অনুপমের মনে হয় কোম্পানি যেন তাদের হাড় ফুটো করে স্ট্র লাগিয়ে সব মজ্জা শুষে নিতে চাইছে। চাকরি বাঁচানোর দড়ি টানাটানির মধ্যেও অনুপমের মতো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটেটিভরা আড়ালে হাসাহাসি করে, গান্ডুটা এই উদ্ভট মুখ নিয়ে বউকে চুমু খায় কীভাবে?

স্পিডোমিটারের কাঁটা একশো ছুঁইছুঁই। নাহ, তবুও এ বৃষ্টির হাত থেকে নিস্তার নেই। ফোঁটা ক্রমশ বাড়ছে। রাস্তার দুপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির জঙ্গল। বনসৃজন প্রকল্পে পঞ্চায়েত লাগিয়েছে। জায়গাটার নাম সুবর্ণপুর। সামনে আর একটু এগোলেই চায়ের দোকান। প্রতিদিনই চোখে পড়ে। কিন্তু কখনও দাঁড়িয়ে চা খায়নি। অনুপম ভাবল বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আজ ওখানেই দাঁড়াবে। বাইকে আরও স্পিড তুলল। কাছাকাছি পৌঁছে রাস্তা থেকেই দেখল চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। দোকানের সামনে ত্রিপল খোলা। দাঁড়াবার উপায় নেই। হা-রা-মি – দাঁতে দাঁত ঘষে বন্ধ চায়ের দোকানটাকেই খিস্তি দিল অনুপম। পরক্ষণেই হাসি পেল। ভাবল খিস্তি হচ্ছে এমন এক মহার্ঘ ও কার্যকরী মেডিসিন যা রাগের মুহূর্তে বাঙালির উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে মনের ক্ষোভ প্রশমিত করে। ফলে শরীরে স্বস্তি আসে, হার্ট-অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

অর্ধেক ভিজে গেছে। হেলমেট চুইয়ে জল নামছে কাঁধে, ঘাড়ে। ক্রমশ জামার ভিতর জলের স্পর্শ টের পাচ্ছে অনুপম। এখন ভাবনা আর নিজেকে নিয়ে নয়। পিছনে বেঁধে রাখা লেদারের ব্যাগটা নিয়ে। বাদামি রংয়ের ব্যাগের ভিতর স্যাম্পেলগুলোতে জল লাগলে কেলেঙ্কারির এক শেষ। আরও কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ বামদিকে চোখে পড়ল বেশ কিছু বুনো ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ভাঙাচোরা ইটের গেটের আদল। অল্প স্পিড কমাল বাইকের। চলন্ত বাইক থেকেই ভালো করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করল। বুঝল গেটের ওপারে ছাদওয়ালা ঘর আছে। অনুপম আর সাতপাঁচ ভাবল না। বাইকের মুখ ঘুরিয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ধরল।

বাইরে থেকে বোঝা যায়নি। ধ্বসে-পড়া গেটের ভিতর বিরাট চত্বর। প্রচুর জংলা গাছপালা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব পুরোনো কোনও জমিদারের সাতমহলা বাড়ি। বাড়ি তো নয়, যেন ছোটোখাটো প্রাসাদ! এতদিন এই পথ ধরে যাতায়াত করছে অথচ এই বাড়িটার কথা কখনও শোনেনি! নিজের কাছেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে অনুপমের। বাইকটাকে একেবারে সামনের ইটের দাঁত ওঠা চত্বর পার করে ছাদওয়ালা একটা ঘরের মেঝেয় দাঁড় করাল অনুপম। প্রথমেই তড়িঘড়ি করে পিছনে বেঁধে রাখা ব্যাগটা খুলল। দেখল ব্যাগের ভিতর জল ঢোকেনি। যাক, শান্তি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে। আকাশের গায়ে আলোর নকশা ফুটে উঠে মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশ যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে আশ্রয় পাচ্ছিল না বলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারছিল না। অনুপম নিজের মনে একচোট হেসে প্যান্টের পকেট হাতড়ে দোমড়ানো সিগারেটের প্যাকেটটা বার করল। প্যাকেটের গায়ে জলের ছোঁয়া লাগলেও সিগারেটে জল লাগেনি। একটা মাত্র সিগারেট পড়ে আছে। সিগারেট জ্বালিয়ে আয়েশ করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল। খালি প্যাকেটটা ছুড়ে দিল মাটিতে। বেশ আরাম লাগছে।

ঘরের কোথাও কয়েকটা চামচিকা ঘাপটি মেরে বসে ছিল। হঠাৎ একপাক ঘুরেই ভিতরের ভাঙাচোরা দালানের দিকে উড়ে গেল। অনুপম সেদিকে তাকাল। দেখল মস্ত বড়ো বাড়িটার নানা জায়গায় মহলগুলো ভেঙে প্রায় মাটিতে মিশে গেছে। কিছু কিছু খাড়া থাকলেও, তাদের চেহারাও সুবিধের নয়। কোথাও দেয়ালের ফাটলে গাছ জন্মেছে, কোথাও ছাদ ফেটে কড়িবরগা ঝুলছে। ভয়ঙ্কর অবস্থা! কেমন যেন গুমোট-ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগল। জরাজীর্ণ বাড়ির গন্ধ কি এমন হয়? কে জানে! অনুপম পাত্তা দিল না। বাইরের দিকে তাকাল। আকাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করল বৃষ্টি আর কতক্ষণ চলতে পারে। পকেট থেকে ফোন বার করল। ভাবল টুনটুনিকে ফোন করে জানিয়ে দিই, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি। হল না। নেটওয়ার্ক নেই। মেজাজ খিঁচড়ে গেল। খচ্চরগুলো দিনদিন রিচার্জ-প্যাকেজের রেট বাড়াচ্ছে, কিন্তু নেটওয়ার্কের আতাকেলানো অবস্থা। পাবলিকগুলোও তেমনি, মনে চাপা-রাগ অথচ মুখে ট্যাঁফোঁ নেই। কোনো প্রতিবাদ নেই। আমআদমি আজ মানুষ না এলিয়েন? মনে মনে গজরাচ্ছে অনুপম।

‘যে-রাষ্ট্রে মিছিলের আওয়াজ কমে যায়, প্ল্যাকার্ডের সংখ্যা কমে আসে, সে-রাষ্ট্রে মুনাফাখোররা জাঁকিয়ে বসে। গোপনে তারাই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। পলিসিমেকার হয়ে ওঠে। ফলে রাস্তাঘাটে আমজনতাকে সচল দেখবে, কিন্তু তারা আসলে একশ্রেণির মৃত-জন্তুর দল। অদৃশ্য শক্তির হুকুমে হাঁটাচলা করছে।’

ঠিক পিছন থেকে কথাগুলো বললেন এক ভদ্রলোক। চমকে পিছনে তাকাল অনুপম। লোকটির হাতে নকশা আঁকা সুদৃশ্য কালো কাঠের ছড়ি। গায়ে দামি সিল্কের লাল-পাঞ্জাবি। তাতে বাহারি জরির কাজ। মানানসই কালো রংয়ের ধুতি। ছড়ির ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে অল্প ঝুঁকে দাঁড়িয়ে মৃদু-মৃদু হাসছেন। যে-হাতে লাঠি মুঠো করে রেখেছেন, সেই হাতের চারটি আঙুলে চারটি আংটি। প্রত্যেকটি আংটিতে উজ্জ্বল রংয়ের পাথর। লাল, সাদা, নীল ও সবুজ। ঝকমক করছে। তুমুল ঝড়বাদলের দিনে এমন এক জরাজীর্ণ বাড়িতে এরকম একজন প্রৌঢ়ের মুখোমুখি হয়ে অনুপমের মুখে কথা হারিয়ে গেছে। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভদ্রলোক বললেন, ‘হাঁ করে অত ভাবার কী আছে? কথাগুলো কি মিথ্যে?’
অনুপম আমতা-আমতা করে বলল, ‘আপনাকে তো ঠিক…’
‘চেনো না, তাই তো? চিনবে কী করে? আগে তো কখনো দেখোইনি। আমি কিন্তু তোমাকে চিনি।’
‘আমাকে চেনেন?’
‘বিলকুল।’ হা হা করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। তারপর বললেন, ‘অনুপম দস্তিদার, রাইট?’
অচেনা ভদ্রলোকের মুখে নিজের নাম শুনে আরও চমকে গেল অনুপম। কোনওরকমে বলল, ‘রাইট।’
ভদ্রলোক এবার কিছুটা গম্ভীর। বললেন, ‘বাবার নাম অরুণ দস্তিদার। পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। রোড-অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তখন তুমি হাইস্কুলে পড়ছ। টুনটুনি, আই মিন তোমার বোন তখন প্রাইমারিতে।’
‘হ্যাঁ।’ কাঁপাস্বরে সায় দিল অনুপম।
ভদ্রলোক থামলেন না, ‘তোমার বাবার মৃত্যুর পর তোমাদের সংসার অথই জলে পড়ে। তোমার মা দরজির কাজ করে তোমাদের বড় করেছেন। তুমি মেধাবী ছাত্র ছিলে। তবু গ্রাজুয়েশনের পর আর এগোতে পারনি। সংসার চলছিল না। কারণ ততদিনে মায়ের ক্যানসার ধরা পড়েছে। তোমার চাকরির দরকার ছিল। শেষ অবধি, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টটেটিভের কাজ জুটল। তাও দেশি কোম্পানি। মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির জন্য যেখানে অ্যাপ্লাই করেছ, সেখানে তোমার হবে না।’
‘কেন?’
এবার মুচকি হাসলেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘কাঠি। যেটা বাঙালি সবচেয়ে ভালো পারে।’
অনুপম রেগে গেল। জিগ্যেস করল, ‘লোকটা কে?’
‘তা জানি। কিন্তু বলা যাবে না।’
‘গড়গড় করে সবই তো বলে যাচ্ছেন, সবই যখন জানেন, তাহলে নামটা বলবেন না কেন?’ উত্তেজিত অনুপম।

ভদ্রলোক নিরুদ্বিগ্ন। শান্তস্বরে কেটে-কেটে বললেন, ‘সবই জানি, কিন্তু কখন কোথায় কাকে কতটা বলব, সে একদম আমার ব্যাপার। যে-কাঠি করে তোমাকে আটকে দিয়েছে, সে করেছে তার ভাইয়ের জন্য। তার ভাইও তোমার মতো দেশি কোম্পানিতে ছিল। পাঁচবছর দেশি কম্পানিতে ঘষটাচ্ছিল। তাই সুযোগ যখন পেয়েছে, নিজের ভাইকে পুশ করে দিয়েছে।’
‘আপনি বলছেন যে-পেয়েছে তার এক্সপিরিয়েন্স ফাইভ ইয়ারস। বাট কোম্পানি এক্সপিরিয়েন্স চেয়েছিল দশ বছরের। আমার পনেরো আছে। তাহলে কী করে হল? যোগ্যতা তো আমার বেশি। এটা তো অন্যায়।’
‘যোগ্যতা, মাইফুট! যোগ্যতা বলে কোনো শব্দ কি সত্যিই এইসময়ে এগজিস্ট করে?’
‘করে না?’ অনুপমের গলায় তর্কের সুর।
‘যে-লোকটা ক’জন সাঙ্গোপাঙ্গো জুটিয়ে দু’দিন আগে তোলাবাজি করত, সেই লোকটাই এমএলএ হয়ে পুজো-প্যান্ডেলের ফিতে কাটছে, কালচারাল মিনিস্টার হয়ে মঞ্চের ওপর বসে ঘোড়ার হাসি হাসছে। এরকম অজস্র উদাহরণ দিতে পারি। কিন্তু ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। আসল হল, ডারউইন সাহেবের সেই কথাটা, স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্স। শুধু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এই স্ট্রাগল শব্দটার প্যাটার্ন বদলে গেছে। আর কিছু নয়। ফলে এই যোগ্যতা-ফোগ্যতা নিয়ে সেন্টুমার্কা কথা বলে লাভ নেই।’

অনুপম চুপ করে গেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। অবিরাম জল পড়ছে। আগের চেয়ে বরং বেড়েছে। আকাশ কি ফুটো হয়ে গেল? মুখে একটা যুতসই খিস্তি বেরোতে গিয়েও বেরলো না। গলার কাছে আটকে গেল। আফটার অল সামনে বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপর সদ্য চাকরি না-হওয়ার খবরটা তাকে ভিতরে-ভিতরে দুমড়ে দিয়েছে। একবার ভাবল লোকটা যে সত্যি বলছে, তার প্রমাণ কী? পরক্ষণেই মনে হল সবই যখন নির্ভুল বলছে, এ খবরটাই বা মিথ্যে বলবে কেন?
ভদ্রলোক বললেন, ‘জীবনের অভিজ্ঞতা যেমন বিশ্বাস করতে শেখায়, তেমনই কখনও-কখনও অবিশ্বাস করতেও বলে। শুধু নিজেকে যাচাই করে নিতে হয় কাকে বিশ্বাস করব, আর কাকে করব না, বুঝলে? নাহলে যাকে বিশ্বাস করা উচিত ছিল, তাকে অবিশ্বাস, আর যাকে অবিশ্বাস করার কথা তাকে বিশ্বাস করলে নিজেকেই ঠকতে হয়।’

হকচকিয়ে গেল অনুপম। লোকটা তার মনের কথা জানল কী করে? বুঝল লোকটা আলফাল কেউ নয়। বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী এক ঘোড়েল জিনিস। ভদ্রলোক অনুপমের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘আরে ধুর আমি একদমই ঘোড়েল-মাল নই। যা করি সবই ফেয়াল ডিল।’
ভদ্রলোকের কথায় ভুরু কুঁচকে গেল অনুপমের। বলল, ‘আপনি তো দিব্যি আমার মনের কথা টের পেয়ে যাচ্ছেন! ফান্ডাটা কী?’
আবার হা হা করে হেসে উঠলেন প্রৌঢ়। বললেন, ‘আয়াম আ গুড থট-রিডার।’
‘ওফ! আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই!’ বলল অনুপম। পরমুহূর্তে প্রসঙ্গ পালটে জিগ্যেস করল, ‘আমি তো এখানে ঢুকতে-ঢুকতেই ভিজে গেলাম, আপনার গায়ে একফোঁটাও জল পড়েনি, বৃষ্টির নামার আগে চলে এসেছিলেন?’
‘আমি এখানে আসতে যাব কেন? এটা তো আমারই বাগানবাড়ি। এখানে যা দেখছ, সবই আমার। আমার মানে আমার পূর্বপুরুষের। উত্তরধিকার সূত্রে এখন আমি ভোগ করছি।’ ভদ্রলোকের কথার ভিতর কোনো অহং নেই, ভনিতা নেই। সাধারণ গলায় জানালেন।
অনুপম ভয়ানক চমকে গেল। বলল, ‘এই পোড়ো, জরাজীর্ণ বাগানবাড়িতে আপনি থাকেন? ইয়ার্কি করছেন?’ ‘আমাকে দেখে তোমার ইয়ার্কি করার লোক বলে মনে হয়?’ ভদ্রলোকের গলায় উষ্মা।
থমকে যায় অনুপম। বলে, ‘না, তা ঠিক মনে হয় না, কিন্তু…’
ভদ্রলোক অনুপমকে কথা শেষ করতে না-দিয়ে বললেন, ‘তুমি রতনলাল শেঠের নাম শুনেছ?’
‘না।’
‘ওফ! ইতিহাসে বড্ড কাঁচা।’
‘রতনলাল শেঠ কে?’
‘আমার পূর্বপুরুষ। লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে দোস্তি ছিল। ইনফ্যাক্ট, দোস্তি ঠিক নয়, বিজনেস টার্মস বলতে পার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে টাকা ধার দিত। ফলে কোম্পানির সুনজরে ছিল। ঋণের বদলে সুদ তো নিতই, পাশাপাশি কোম্পানির কাছ থেকে ব্যবসায়িক সুবিধে আদায় করত। এভাবেই রতনলাল একসময় একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ নিয়ে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছিল। জগৎ শেঠ, উঁমিচাঁদদের সঙ্গে রতনলাল শেঠের নামও ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে।’
অনুপম সুযোগ পেয়ে ফোড়ন কাটল, ‘বাহ! আপনার পূর্বপুরুষ তো বেশ গুণধর। ইংরেজদের গোলাম।’ মুচকি হেসে ভদ্রলোক বললেন, ‘জগৎ জুড়ে গোলামিই চলছে হে, ছোকরা। তুমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দাও তো কে গোলাম নয়? সবাই জন্ম থেকে ঠিক জায়গায় গোলামি করার জন্য হাত ধুয়ে বসে থাকে। কেউ সুযোগ পায়, কেউ পায় না। রতনলাল সেই সময়ের কর্পোরেট ফিগার। আর, কর্পোরেটদের লক্ষ্য একটাই, মুনাফা। অ্যাবসোলিউট মুনাফা।’
‘তা, আপনার নাম?’
‘সুকান্ত।’
‘ইন্টারেস্টিং, রতনলালের উত্তরপুরুষ সুকান্ত! সুকান্ত ভট্টাচার্য নয় তো?’
‘এই মুহূর্তে তুমি নামের মাহাত্ম্য বুঝবে না, বাছা। বুঝবে, যদি আমার ডিলে এগ্রি করো।’ সুকান্ত রসিক মানুষ। মুচকি হেসে অনুপমের কথার শ্লেষে পালটা শ্লেষ ফিরিয়ে দিলেন।
অনুপমের গলায় বিস্ময়, ‘মানে! আপনি কি আমাকে কোনো ডিল অফার করতে চান?’
‘অফকোর্স। তুমি তো একটু আগে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরির জন্য হেদিয়ে মরছিলে, আমি যদি তার চেয়েও বেটার কিছু অফার করি, তুমি কি রাজি হবে?’
‘কী রকম?’
‘প্রাণ খুলে ফূর্তি করবে। জাগতিক সব সুখ ভোগ করবে। স্পনসর করব আমি।’
‘বুঝলাম না।’
‘বেশ, বুঝিয়ে বলছি, এসো।’

সুকান্তবাবুর কথা রহস্যময় লাগছে অনুপমের। সুকান্তবাবু ঘরের পিছনের দরজার দিকে হাঁটতে লাগলেন। নামেই দরজা, পাল্লার চিহ্নমাত্র নেই। শুধু বোঝা যাচ্ছে কোনো এককালে এখানে হয়তো দরজা ছিল ভিতরের দিকে যাওয়ার জন্য। চতুর্পাশে ছড়ানো ভাঙা ইটের জঞ্জাল, খসে পড়া পলেস্তরার স্তূপ পেরিয়ে সুকান্তবাবু দিব্যি হাঁটছেন। পিছনে অনুপম। কিছুদূর যাওয়ার পর বামদিকে ঘুরে গেলেন প্রৌঢ়। প্রৌঢ়ের পিছনে অনুপম বামদিকে ঘুরেই হতবাক। সামনে সুদৃশ্য দরজা। দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরটা স্পষ্ট। মেঝেয় রঙিন কার্পেট। রুমের প্রতিটি জিনিস ঝাঁ-চকচকে। কোথাও বিন্দুমাত্র ধুলো নেই। আসবাব থেকে দেয়ালঘড়ি, জলের কুঁজো থেকে পিয়ানো, সবই অ্যান্টিক। এইসব দেখে রীতিমতো মাথা ঘুরছে অনুপমের। সুকান্তবাবু ঘরে ঢুকে অনুপমকে আসতে বললেন। ভিতরে ঢুকে এলে কার্পেটের একপাশে পেতে রাখা ফরাসের ওপর নিজে বসে অনুপমকে বললেন, ‘বসো।’
অনুপম মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসল। যেদিকেই তাকায় বৈভবের জৌলুস যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। তার দুচোখে শুধু অপার বিস্ময়। পাশে রাখা লাঠির ওপর হাত বোলাতে বোলাতে সুকান্তবাবু বললেন, ‘এগুলো কিছুই নয়। আমার কাছে যা সম্পদ আছে, একজন মানুষ দশজন্মে ফুরোতে পারবে না।’
সুকান্তবাবু গড়গড়ার নলটা হাতে নিয়ে এগিয়ে দিলেন অনুপমের দিকে। অনুপম অবাক হয়ে বলল, ‘কখনো খাইনি।’
‘তোমার সিগারেটের চেয়ে হাজার গুণ ভালো। স্বাদু। একবার টেনে দেখো।’
নলের মুখটি সোনালি। তার গায়ে লতাপাতার সুদৃশ্য নকশা। অনুপম টান দিল। সুগন্ধি তামাকের গন্ধে ভরে গেল চারদিক। সে নলের মুখটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল। সুকান্তবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘খাঁটি সোনার।’

সুকান্তবাবুর কথায় অনুপম কিছুটা প্রকৃতিস্থ হল। সাময়িকভাবে ঘোর কাটল। তাকাল সুকান্তবাবুর দিকে। সুকান্তবাবু বললেন, ‘সমস্ত সম্পদ আমি তোমাকে ভোগ করার আধিকার দিতে পারি।’
‘আমি নিয়ে কী করব?’
‘ওই যে বললাম, ফূর্তি করবে। ওড়াবে।’
‘তাতে আপনার লাভ?’
‘দ্যাটস দ্য পয়েন্ট। দেখো, রাখঢাক আমি পছন্দ করি না। যা স্পষ্ট, তা বলতেই ভালোবাসি। আমার গায়ে কর্পোরেট জেনারেশনের রক্ত। সুতরাং মুনাফা ছাড়া আমি কিছুই করি না। এক্ষেত্রেও তাই। তার আগে একটা কথা বল তো, নিজের চোখে প্রায় বিনা-চিকিৎসায় তোমার মাকে মারা যেতে দেখেছ, একটার বেশি কেমোর টাকা যোগাড় করতে পারনি। ঠিক?’
‘হ্যাঁ।’
‘কত মানুষ আছে যারা ফুটপাতে জন্মায়, ফুটপাতেই মরে যায়, তোমার মায়ের মতো বিনা-চিকিৎসায়, কিংবা ওই ফুটপাতে মরে যাওয়া লোকগুলোর মতো করে তুমি বেঁচে থাকতে চাও, নাকি অর্থে-বৈভবে জীবনের বেঁচে-থাকাকে চূড়ান্ত ভোগ করতে চাও?’
‘সম্পদ থাকলে কে আর হাঘরের মতো খিদে নিয়ে বাঁচতে চায়?’
‘কিন্তু তাতে যদি দশবছরের জায়গায় পাঁচবছর বাঁচার সুযোগ মেলে, তাহলে?’
এবার থমকে গেল অনুপম। অনুপমের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুকান্তবাবু। তারপর বললেন, ‘ভাব। ভেবে উত্তর দাও।’
অনুপম চুপ করে থাকে। সুকান্তবাবু কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, ‘তোমার বয়স এখন ছত্রিশ, রাইট?’
‘হুম।’
‘তোমার আয়ু উনআশি।’
‘এ আপনি কী বলছেন?’ চমকে ওঠে অনুপম।
‘চমকানোর কিছু নেই। যা সত্যি, তাই বলছি।’
‘আপনি নিজেকে কী ভাবেন? সবজান্তা? গনৎকার? ম্যাজিশিয়ান?’
‘নাথিং। কিন্তু যা বলছি, তা ফ্যাক্ট। এর নড়চড় হবে না। তোমার বাবা মারা গিয়েছিলেন চুয়াল্লিশ বছর সাত মাস একুশ দিন বয়সে। তুমি তো তোমার বাবার ডেট অফ বার্থ জানো, হিসাব করে নাও, ঠিক বলছি কিনা।’
‘বোকা বানানো কথাবার্তা ছাড়ুন। আপনার সব ঢপবাজি। আমার বাবা সম্পর্কে খবর যোগাড় করলেই এটা বলা যায়। এটা অতীতের ঘটনা। আর আমার ক্ষেত্রে আপনি ভবিষ্যতের কথা বলছেন। আশমানজমিন ফারাক।’
‘বেশ। ওয়েট। অই জানালার দিকে তাকাও।’
অনুপম ডানদিকে জানালার দিকে তাকাল। সুকান্তবাবু বললেন, ‘দূরে একটা তালগাছ দেখতে পাচ্ছ?’
‘পাচ্ছি।’
‘পাচ্ছ তো? দেখছ, কেমন বৃষ্টিতে ভিজছে? হাওয়ায় অল্প-অল্প মাথা দুলছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাও। ক’টা বাজে?’
‘তিনটে পঁয়তাল্লিশ।’
‘ঠিক তিন মিনিট উনিশ সেকেন্ড পরে গাছটার ওপর বাজ পড়বে।’
‘সুকান্তবাবু, ঢপবাজির একটা লিমিট থাকে।’
সুকান্তবাবু গম্ভীর চোখে অনুপমের দিকে তাকালেন। মুখে কিছু বললেন না। সুকান্তবাবুর এমন স্তব্ধতায় অনুপমের বুকের ভিতর ক্রমশ আশ্চর্য এক ভয় দানা বাঁধতে লাগল। অনুপম একবার গাছটার দিকে, একবার দেয়ালঘড়িটার দিকে দেখতে থাকল। সুকান্তবাবু স্থির হয়ে বসে আছেন। ঘড়ির কাঁটা যত এগোয়, অনুপম বুঝতে পারে, তার শরীর যেন ক্রমশ শীতল হয়ে আসছে। আতঙ্কে। কে এই রহস্যময় লোক?

আকাশ যেন দুভাগ হয়ে গেল। শব্দে ও আগুনে ঝলসে গেল চারপাশ। কানে হাত চাপা দিল অনুপম। সুকান্তবাবু কিন্তু তিলমাত্র বিচলিত হলেন না। ঘড়ি ধরে ঠিক তিন মিনিট উনিশ সেকেন্ড পর বাজ পড়ল তালগাছটার ওপর। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তালগাছের মাথা। কয়েক মিনিটের মধ্যে জ্বলন্ত মাথা ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল। দেখা গেল অর্ধেক গাছ কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুপমের চোখ বিস্ফারিত।
সুকান্তবাবু বললেন, ‘আঠাত্তর নয়, আশিও নয়। উনআশি বছর তোমার আয়ু। এখন তোমার বয়স ছত্রিশ হলে বাকি থাকল কত? তেতাল্লিশ বছর। আমি এই তেতাল্লিশ বছরের অর্ধেক, অর্থাৎ সাড়ে একুশ বছর আয়ু তোমার কাছে কিনতে চাই।’
ভয়ে কাঁপতে থাকল অনুপম। কাঁপাস্বরে বলল, ‘সত্যি করে বলুন তো, আপনি কে? কী আপনার পরিচয়?’ ‘আমি এক ভোগবিলাসী দুঃখী মানুষ। সম্পদের পাহাড়চুড়োয় বসে আছি, কিন্তু নিজে থেকে ভোগ করার ক্ষমতা নেই।’
‘কেন?’
‘তোমাদের ভাষায় আমি মৃত, কিন্তু বিশ্বাস করো পুরোপুরি মৃত নই। দেখতেই তো পাচ্ছ, আমি কেমন তোমার সঙ্গে দিব্যি কথা বলছি।’
চোখ কপালে উঠে গেল অনুপমের, কার পাল্লায় পড়েছে সে! কী করে পালাবে এখান থেকে? বলল, ‘আপনি কি ভূত?’
‘এই তোমাদের খুব বাজে অভ্যাস, মুখে যা আসে তাই বলে দাও। অশরীরী এবং শরীরী অবস্থানের মধ্যে আমি ঘোরাফেরা করি। আমার পূর্বপুরুষ এক ফকিরের কাছ থেকে এই গুপ্তবিদ্যা রপ্ত করেছিল।’
অনুপম বলল, ‘যাক গে, এসব কথা থাক। আমাকে ছাড়ুন, বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘কী মুশকিল, তোমাকে আটকে রাখলাম কোথায়? কিন্তু এত বৃষ্টি হচ্ছে, যাবে কী করে? তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমার কথা তো শেষ হয়নি।’
‘আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে না।’
‘ভালো লাগবে। শেষ পর্যন্ত শুনে তো দেখো।’
অনুপম উঠে দাঁড়াল। লাঠিতে ভর দিয়ে উঠলেন সুকান্তবাবুও। দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অনুপম, একবার এসো।’

সুকান্তবাবু পিয়ানোর পাশ দিয়ে এগোলেন ঘরের পিছনে। সঙ্গে গেল অনুপমও। সুকান্তবাবুর কথার মধ্যে কী যেন জাদু আছে, চাইলেও চট করে অগ্রাহ্য করা যায় না। ঘরের শেষপ্রান্তে দেয়ালের কয়েকটি জায়গায় বামহাত দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় সাতবার টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের একটি অংশ নিঃশব্দে সরে গেল। খুলে গেল একটা সুড়ঙ্গের মুখ। সুকান্তবাবু পিছন ফিরে অনুপমকে বললেন, ‘এসো।’
সুড়ঙ্গ দিয়ে কয়েক ধাপ নামতেই ডানদিকে একটা লোহার দরজা। সেখানেও আগের মতো বিশেষ কায়দায় টোকা দিলেন। মুহূর্তে খুলে গেল দরজা। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভিতর থেকে রুদ্ধ থাকা সাতরংয়ের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল সুকান্তবাবু ও অনুপমের ওপর।
সুকান্তবাবুর সঙ্গে বিহ্বল অনুপম প্রবেশ করল মস্ত হলঘরে। থরে-থরে সাজানো মণিমানিক্য, রত্ন ও সোনার মোহরে ভর্তি ঘড়া। সুকান্তবাবু বললেন, ‘ভালো করে দেখো। আমার প্রস্তাবে রাজি হলে সমস্ত ভোগ করার আধিকার জন্মাবে তোমার। সব, সব, সব।’
অনুপম টের পাচ্ছে তার মন এই বৈভবের কাছে ক্রমশ যেন আত্মসমর্পণ করছে। মুখের ওপর না-বলার সাহসটা যেন ধীরে-ধীরে খুইয়ে ফেলছে। সুকান্তবাবু বললেন, ‘রাজি হলে আজই তুমি তোমার ইচ্ছেমতো রত্ন ও মোহর সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পার। অ্যাডভান্স।’
অনুপম মরিয়া হয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন, সুকান্তবাবু। লোভ মানুষকে নষ্ট করে দেয়।’ ‘ধুর। কে বলেছে? পাখির মতো আকাশে ওড়ার লোভ হয়েছিল বলেই মানুষ উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছিল।’ ‘আচ্ছা, আপনি আমার অর্ধেক আয়ু নিয়ে কী করবেন?’
‘তোমার সঙ্গে বাঁচব। তোমার ভিতর মিশে থাকব। তুমি যা ভোগ করবে, একইসঙ্গে আমারও তা ভোগ করা হবে।’
‘এও কি সম্ভব?’
‘সম্ভব না-হলে তোমাকে আমি এমন ডিল অফার করব কেন? আফটার অল কর্পোরেট ট্র্যাডিশন ইনহেরিট করছি, প্রফিটেবল আউটপুট না দেখে আমি ইনভেস্টে করব? আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়?’
অনুপম চুপ করে থাকে। সুকান্তবাবু বলেন, ‘একমাত্র আমার প্রস্তাবে রাজি হলেই তোমার আগামী জীবনের শিডিউল বদলে যাবে। পালটে যাবে ঘটনাগুলোও।’
‘যেমন?’
‘শোনো, আগামী চারমাসের মধ্যে তুমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবে। সেলস-টার্গেট অ্যাচিভ করতে না-পারার কারণে। নতুন কোনো চাকরি আর পাবে না। তোমার বোন টুনটুনির পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। গৌতম নামের যে ছেলেটাকে ভালোবাসে, সেই ছেলেটা জাস্ট একটা স্ট্রিট লাফাঙ্গা। কোনো ফিউচার নেই। টুনটুনি ওকে বিয়ে করবে। কিন্তু একবছরও সংসার করতে পারবে না। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তোমার কাছে ফিরে আসবে। তোমার তখন বাড়িটাই সম্বল, নিজের খাওয়ার সংস্থান নেই। ভাইবোনের মধ্যে আসবে আনিবার্য সংঘাত। একদিন অভিমানী টুনটুনির বডি পাওয়া যাবে রেললাইনে। তোমাকে ঘর বেচে পালাতে হবে। টাকা ফুরোবে। শেষ জীবনে ফুটপাতে মরে পড়ে থাকবে উনআশি বছর বয়সে। আর, আমার প্রস্তাবে যদি রাজি হও, তাহলে এখান থেকে পর্যাপ্ত সম্পদ নিয়ে তোমার বোনকে দাও। গৌতমকেই বিয়ে করুক, অসুবিধে হবে না। বড় করে ব্যবসা করুক। জীবনে দাঁড়িয়ে যাবে। আর, তুমি ছমাসের মধ্যে এইসব কাজ করে এখানে ফিরে আসবে। তারপর…’ সুকান্তবাবুর মুখে যেন লজ্জার আভা খেলা করল। অনুপম জিগ্যেস করল, ‘তারপর?’
সুকান্তবাবু জানালা দিয়ে দক্ষিণদিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওখানে নাচমহলটা ভেঙে পড়ে আছে। তুমি নাচমহলটা সাজাবে। তোমার তো আর টাকার ভাবনা থাকবে না, নাচমহল সাজিয়ে নাচের বন্দোবস্ত করবে। গানের বন্দোবস্ত করবে। বাছাবাছা নাচনেওয়ালী, গানেওয়ালীদের নিয়ে রঙিন মাহফিল বসাবে। ইরানি আতর সুগন্ধ ছড়াবে। হুইস্কির ফোয়ারা ছুটবে। ওফ! কতদিন এমন মেহফিলে নিশিযাপন করিনি!’
অনুপম দেখল সুকান্তবাবুর চোখ খুশিতে চকচক করছে। অনুপম বলল, ‘আর?’
‘এত নির্বোধের মতো প্রশ্ন করছ কেন? কিছুই বুঝতে পারছ না? জীবনের চূড়ান্ত ভোগ বলতে যা বোঝায়, তারই আয়োজন করতে হবে।’
অনুপম বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘আমি রাজি।’
হা হা করে হেসে উঠলেন সুকান্তবাবু। তারপর বললেন, ‘বেশ, তাহলে চলো, এগ্রিমেন্ট করার পর তুমি সম্পদ ব্যবহারের ছাড়পত্র পাবে।’
সুকান্তবাবু দেয়ালের কাছে গিয়ে কুলুঙ্গিতে থাকা একটি মস্ত বড়ো রত্নপাথর তুলে অনুপমের হাতে দিয়ে বললেন, ‘শপথ করো। আমার সঙ্গে বলো আপনি যা বলবেন, আমি জীবিত থাকাকালীন আপনার সমস্ত কথা পালন করতে বাধ্য থাকব।’
অনুপম সুকান্তবাবুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করল। আর কী আশ্চর্য, সঙ্গে-সঙ্গে পাথরের ভিতর থেকে একটি নীলরংয়ের জ্যোতি দপ করে জ্বলে উঠে সুকান্তবাবুকে ছুঁয়ে অনুপমের দেহে মিলিয়ে গেল। ক্ষণিকের জন্য অনুপম সে আলোর সম্মুখে যেন সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ খুলে দেখল সুকান্তবাবু নেই। সে একা সেই রত্নঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভীষণ ভয় পেল অনুপম। হাত-পা কাঁপতে লাগল। জিগ্যেস করল, ‘আপনি কোথায়, সুকান্তবাবু?’
সুকান্তবাবুকে দেখা গেল না। শুধু কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এই তো আমি তোমার কাছেই, অনুপম। ভয় পেয়ো না। তোমার সঙ্গে যা কথা হয়েছে, সেইমতো কাজ করো।’

অনুপম কথা রেখেছে। বোনের বিয়ে দিয়ে ছ’মাসের মধ্যে ফিরে এসেছে। ধীরে-ধীরে নাচমহল সেজে উঠেছে। সবসময় যে তার ফূর্তি করার মেজাজ থাকে এমন নয়। কিন্তু ইচ্ছে না-হলেও উপায় নেই। সুকান্তবাবু হুংকার দেন। বিরক্ত হন। তার ভোগের তৃষ্ণা অনন্ত।
একদিন বলে ফেলেছিল, ‘এবার আমাকে মুক্তি দিন। আর ভালো লাগছে না।’
ব্যস, আর যায় কোথায়! দেয়ালের গায়ে আটকানো চাবুকটা শূন্যে উড়ে এসে শপাং-শপাং করে আছড়ে পড়ল অনুপমের পিঠে। একসময় থামল, যখন সুকান্তবাবুর গোঙানির আওয়াজ শুরু হল। মার যে শুধু অনুপম খেলো, তা তো নয়, সুকান্তবাবুও খেলেন এমনই তার গোঁয়ারের মতো জেদ। পরে পরে সব বুঝেছে অনুপম। তাই সুকান্তবাবুকে ঘাঁটানোর মতো সাহস হয় না।

সময় যত দীর্ঘই হোক, ফুরোনোই তার নিয়তি। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এল অনুপমের। কয়েকদিন ধরেই শরীরে যুৎ নেই। মাথা ঘুরছে। বসন্তকালের সকালে অনুপম কোনওরকমে উঠে ডুমুরগাছের তলায় বসল। দূরে একটি গাছের আড়ালে কোকিল ডাকছে। নাচঘরের উস্তাদের গানের চেয়ে এই ডাক বড়ো মিঠা লাগছে তার। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেল। কত শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত পার হয়ে গেল। দেশবিদেশ ঘুরে কত ভোগের সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে। রাজকীয় কায়দায় ভোগ করেছে। কিন্তু সে কি সত্যিকারে নিজে কোনোকিছু ভোগ করেছে? অন্তর থেকে উপভোগ করতে পেরেছে? সে-কেবল অন্যের জন্য ভোগ করেছে। অন্যের ইচ্ছাধীন হয়ে তার শরীর, তার মন গোলামি করে গেছে। এ-যেন বেঁচে-থাকার এক চূড়ান্ত অপব্যয়। চুক্তির পরে এসবই বুঝতে পেরেছে, কিন্তু তখন কমিটমেন্ট ব্রেক করে মুক্তির সমস্ত দরজাই তার কাছে বন্ধ হয়ে গেছে। অনুপমের চোখে গাঢ় ঘুম নামছে। ক্রমশ চেতনা যেন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। এমনসময় শরীর তীব্রভাবে কেঁপে উঠল একবার। আচ্ছন্ন অবস্থায় দেখতে পেল সেই নীল আলোর ঝলকানি। অনুপমের শরীর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দাঁড়িয়ে পড়লেন সুকান্তবাবু। সুকান্তবাবুর মুখের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ বন্ধ হয়ে গেল অনুপমের। কয়েকমুহূর্ত পর অনুপম দাঁড়াল সুকান্তবাবুর মুখোমুখি। সুকান্তবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন। অনুপম দেখল তার মৃতদেহ নিঃসাড়ে পড়ে আছে ডুমুরগাছের নীচে। অনুপম জিগ্যেস করল, ‘এটা কী হল? আমার মৃত্যু হল, আর আপনি দিব্যি বেঁচে রইলেন?’
‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে? আমি কিছু বছরের জন্য তোমার শরীর ভাড়া নিয়েছিলাম আমার সম্পদ ব্যবহার করতে দেওয়ার বিনিময়ে। তার অর্থ তো এটা নয় যে তুমি আর আমি সমান-সমান বা তোমার যা পরিণতি হবে, আমারও তাই হবে।’
‘আপনি এতদিন ধরে আমাকে ঠকিয়েছেন?’
‘এখানে ঠকানোর কথা আসছে কেন? আমি তোমার সার্ভিস নিয়েছি, বিনিময়ে তোমাকে সম্পদ ব্যবহারের ফেসিলিটি দিয়েছি। গিভ অ্যান্ড টেক, সিম্পল।’
স্তম্ভিত হয়ে গেল অনুপম। অনুপম দেখল সুকান্তবাবু তার মৃতদেহের পায়ে একটা দড়ি বেঁধে টানতে টানতে পশ্চিমের একটি ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর বামহাতের টোকায় দরজা খুলে মৃতদেহটি ভিতরে ছুঁড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে একটা কোলাহল শোনা গেল কারা যেন বলল, ‘ওই আবার একটা এল।’
সুকান্তবাবু সে চিৎকারে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। অনুপম নাছোড়বান্দা। এমন বেইমানি সে মেনে নিতে পারছে না। বলল, ‘আপনি যাই বলুন, এভাবে আমার আয়ু কেড়ে নিয়ে আপনি বেইমানি করেছেন?’
‘কর্পোরেট সংস্থায় যতদিন তুমি চাকরি করবে, ততদিন তার সুযোগসুবিধে তুমি ভোগ করার অধিকারী। রিটায়ার করার পরও কি কর্মচারীর বলার অধিকার থাকে, এতদিন আপনার কোম্পানির জন্য আমি আয়ুক্ষয় করেছি, আপনার বিছানায় আমাকে শুতে দিন? কিংবা, যেহেতু আমার শ্রমের বিনিময়ে আপনার সম্পদ গড়ে উঠেছে, ওই সম্পদের সমান অধিকার আমারও? আর আয়ুর কথা বলছ? তোমার বাবার মৃত্যুটা কি সত্যিই রোড-অ্যাক্সিডেন্ট ছিল, অনুপম? বন্ধুদের সাহায্যে নিজের বাবাকে খুন করেছিলে কেন? পোস্ট অফিসে টাকা তছরুপের জন্য তোমার বাবা তো দায়ী ছিল না, তাকে ফাঁসানো হয়েছিল। স্কুলের কয়েকজন চোরের ছেলে বলে তোমাকে ক্ষেপাত। সেই রাগে নিজের বাবাকেই খুন করে বসলে? তখন তোমার কত বয়স? মাত্র ষোলো বছর। লজ্জা করে না, নিজের বাবাকে খুন করে এখন আয়ু নিয়ে আমাকে নীতিকথা শোনাতে এসেছ? তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রথমদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে তোমাকে কাঠি করে কে তোমার চাকরি খেয়েছিল? সেদিন আমি কী বলেছিলাম মনে পড়ে? বলেছিলাম না, সবই জানি, কিন্তু কখন কোথায় কাকে কতটা বলব, সে একদম আমার ব্যাপার? তোমার বাবার খুনের ব্যাপারটাও বলতাম না, তুমি বাধ্য করলে বলে বললাম।’

অনুপম একদম স্তব্ধ হয়ে গেল। হাওয়ায় হাওয়ায় এদিক ওদিক পাক খায়, ওড়ে, কিন্তু কোনও কথা বলে না। প্রায় শেষ-বসন্তের এক দুপুরে একটা ছেলে বাইক নিয়ে ভাঙা জমিদার বাড়িতে ঢুকল। বাইক দাঁড় করাল সেই জায়গায়, যেখানে একদিন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে অনুপম তার বাইক দাঁড় করিয়েছিল। ছেলেটার গলায় ক্যামেরা। অনুপম দেখতে পেয়েই তার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এই ছেলে, পালাও। পালাও। তোমার খুব বিপদ। এখানে আয়ুখেকো আছে। সে ভুল বুঝিয়ে তোমার আয়ু খেয়ে নেবে।’
সুকান্তবাবু সেই আগের মতো ছেলেটির পিছনে এসে দাঁড়ালেন। অনুপমের দিকে চোখ পাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘অকারণ চিৎকার করো না। তোমার কথা ও শুনতে পাবে না। তোমাকে দেখতেও পাচ্ছে না।’ তারপর সুকান্তবাবু পূর্বের মতোই ছেলেটির সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলেন। ছেলেটি জিগ্যেস করল, ‘কী নাম, আপনার?’
সুকান্তবাবু অম্লানবদনে বললেন, ‘অনুপম দস্তিদার।’
ছেলেটি হাসল, ‘আমি পুষ্পেন সরকার।’
দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর পুষ্পেনকে নিয়ে ভিতরের ঘরের দিকে এগোলেন সুকান্তবাবু। পাশেপাশে ভেসে চলেছে অনুপম। এরই ফাঁকে সুকান্তবাবু ফিসফিসিয়ে অনুপমকে বললেন, ‘এবার নাম-মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছ? রতনলাল শেঠ থেকে কীভাবে কতজনের শরীর ও আয়ু ভাড়া নিয়ে আমি সুকান্ত হয়েছিলাম? আসলে কী জানো, এ জগৎ হল খোলা বাজার। এখানে অঢেল হিউম্যান রিসোর্স আছে। দারিদ্র আছে, সুতরাং সস্তায় শ্রম আছে। আর, আমাদের হাতে আছে অগাধ অর্থ। আমরা সেই হিউম্যান রিসোর্সকে কাজে লাগিয়ে, তাদের শ্রমকে পারচেজ করে পণ্য বানাই। ভোগের পণ্য। এবং তা থেকে মুনাফা করি। মুনাফা, মুনাফা আর মুনাফা! আমাদের দ্বিতীয় কোনও লক্ষ্য নেই। জেনে রেখো তোমাদের মতো গোলামরা যতদিন থাকবে, রতনলালের মতো কর্পোরেট জিনিয়াসরা কখনো মরবে না। রক্তবীজের ঝাড়ের মতো থেকে যাবে। দশক পেরোবে, শতক পেরোবে কিন্তু রতনলালরা থাকবে। থাকবেই।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-corporate

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *