short-story-ei-jeevan-ei-jolostar

এই জীবন এই জলস্তর
সৈকত মুখোপাধ্যায়


আজ থেকে প্রায় চারবছর আগে এক বিকেলে ঝিলিক আমাকে বলেছিল, “এস দীপ, আমরা একে অন্যকে হাসিমুখে বিদায় দিই। মনখারাপ কোরো না।”

মনে আছে, অনেকদিন বাদে সেদিন আবার আমরা দুজনে বৈদ্যবাটি খালের ধারের নির্জন রাস্তাটা ধরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ঝিলিকই আমাকে ফোন করে বলেছিল ওখানে আসতে।

ব্রেক-আপের কথাটা ও আমাকে ফোনেই বলতে পারত, কিন্তু বলেনি। ওই ক্যানালের পাশের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে-হাঁটতেই বলেছিল। বলবার সময় আড়চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

ফোনে বলেনি কেন?

মনে হয় ও স্বচক্ষে আমার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছিল। ও যদি দেখত আমি খুব বেশি ভেঙে পড়ছি, যদি আমি তখনই ওর হাত চেপে ধরে বলতাম, ‘প্লিজ ঝিলিক। আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সহ্য করতে পারব না’, তাহলে হয়তো ও কথা ফিরিয়ে নিত। রিলেশনশীপটাকে আরও অনেকদিন টেনে নিয়ে যেত।

এর মধ্যে দিয়ে আমি কিন্তু এ কথা বলতে চাইছি না যে, ঝিলিক একজন শঠ মেয়ে, ঝিলিকের মনে কপটতা আছে। আমি এখনও চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে নিয়ে চীৎকার করে বলতে পারি, ঝিলিকের মতন অকপট এবং সৎ মানুষ আমি আর দুটি দেখিনি। হ্যাঁ, মেয়েমানুষ নয়, মানুষ। আমি চারবছর ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। আমি জানি, যে কোনও রকমের ছলনাই ওর সাধ্যের অতীত।

আমরা দুজনে দুই শহরে থাকতাম। দুজনেরই চাকরি ছিল। অনেক সাংসারিক দায়-দায়িত্বও ছিল। ঝিলিকের প্যারা-টিচারের চাকরিটায় বেতন খুব সামান্য বলে ওকে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াতে হত। আর আমার বাড়িতে ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা। দিনের আয়ামাসি সন্ধেবেলায় ডিউটি শেষ করে চলে যাওয়ার পর থেকে বাবার দেখভালের দায়িত্ব পড়ত আমার কাঁধে। তাই আমাদের খুব বেশি দেখাসাক্ষাত হত না।

এমন অসাক্ষাতের মধ্যে দিয়ে পনেরো দিন, কুড়ি দিন, একমাস পেরিয়ে গেলে আমাদের দুজনেরই বুকের মধ্যে দেখা করার জন্য তীব্র বাসনা জেগে উঠত। একটু কথা বলা, এক পলকের জন্যে বুকের মধ্যে টেনে নেওয়া… কিংবা ওসব কিছুই নয়— দুজনে দুজনের চোখের মধ্যে চোখ ডুবিয়ে বসে থাকা— এইটুকুর জন্যেই আমরা আকুল হয়ে উঠতাম। নদীর চরে বালিতে গর্ত খুঁড়ে রাখলে যেমন সেটা আস্তে-আস্তে জলে ভরে ওঠে, ঠিক সেইভাবে আমাদের দুজনের বুকের মধ্যে দুটো শূন্য জায়গা পনেরো দিন, কুড়ি দিন, একমাস ধরে মিলন-পিপাসায় ভরে উঠত।

তখন অনেক হিসেব করে আমরা এমন একটা দিন খুঁজে বার করতাম, যেদিন দুজনেই সন্ধেবেলাটুকু ছুটি নিতে পারি; যেদিন ঝিলিক আগে থেকেই ট্যুইশনের বাচ্চাগুলোকে বলে রাখতে পারে, ‘কাল তোদের পড়াবো না’ কিম্বা আমি আয়ামাসিকে একটু বেশিক্ষণ থেকে যাওয়ার জন্যে রাজি করাতে পারি। কিন্তু তারপরেও এরকম অনেকবার হয়েছে, একদম শেষ মুহূর্তে ঝিলিক বলেছে, “স্যরি, আমি যেতে পারব না।” আমি স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে অবাক, তারপরে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছি। তেতো গলায় ওকে জিজ্ঞেস করেছি, “কেন? কেন পারবে না?”

ঝিলিক আমাকে অনায়াসেই মিথ্যে কথা বলতে পারত। বলতে পারত, হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছি। শরীর খারাপ নিয়ে তো আর কোনও তর্ক-বিতর্ক চলে না। কিন্তু প্রত্যেকবারই ঝিলিক আমাকে বলেছে হঠাৎ এসে পড়া কোনও অনিবার্য দায়িত্বের কথা।

আমি ফোনের মধ্যে চীৎকার করে বলেছি, “তোমার প্রায়োরিটি কী? ভালবাসা, না ডিউটি?”

ও কান্নাভেজা গলায় উত্তর দিয়েছে, “ভালবাসাকে আমি কোনও প্রায়োরিটি-লিস্টে রাখি না দীপ। সে একক। তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।”

“তাহলে? তাহলে আজ আসবে না কেন?”

ঝিলিক বলেছে, “কারণ, তুমি আমার অসহায়তাটা বুঝবে। কিন্তু আর তো কেউ বুঝবে না। আর কেউ তো আমাকে ক্ষমা করবে না দীপ।”

মাথা ঠান্ডা হয়ে এলে আমি সত্যিই বুঝেছি ওর অসহায়তা। ‘ক্ষমা’ অনেক বড় শব্দ। ঝিলিককে ক্ষমা করার যোগ্যতা আমার ছিল না। কিন্তু এইসব ঘটনার পর ওকে আরও বেশি করে ভালো বেসেছিলাম। কারণ, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর প্রেমে লাবণ্যের অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু ফাঁকি ছিল না।

আমার ধারণা, সেইজন্যেই ঝিলিক সম্পর্কটাকে শেষ করে দেওয়ার মুহূর্তেও আমার মুখ দেখতে চেয়েছিল। ভালবাসা ফুরিয়ে গেলেও মায়া থেকে যায়। ঝিলিক ভীষণ মায়াময় মেয়ে। রাস্তার কুকুর, বেলুন-বিক্রেতা শিশু, ফ্লাই-ওভারের সিঁড়ির নীচে বসে থাকা বৃদ্ধা ভিখারিনি, কাউকেই ও একটু আদর না করে পেরিয়ে যেতে পারত না। আমার জন্যে তো মায়া থাকবেই। সেদিনও আমার মুখে বিন্দুমাত্র কাতরতা ফুটে উঠতে দেখলে ও নিশ্চয় কথা ফিরিয়ে নিত।

কিন্তু সেরকম কিছু হল না। ওর কথা শুনে আমি কাতর কিম্বা পাথর কিছুই হইনি সেদিন।

আসলে ভালোবাসা এক আশ্চর্য আয়না। সে উল্টোদিক থেকে যেটুকু আলো পায়, সেটুকুই ফিরিয়ে দেয়। তাই ঝিলিক যেমন বুঝতে পারছিল আমাদের পারস্পরিক টানটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আমিও তেমনই সেই একই কথা বুঝতে পারছিলাম। কিছুদিন ধরেই আমারও মনে হচ্ছিল, প্রতিটি সম্পর্কের জন্মমুহূর্তেই তার আয়ু স্থির হয়ে যায়; তারপর নক্ষত্রের মতন ধীরে-ধীরে ফুরিয়ে যায় তার অন্তর্গত বিকিরণ। মৃত-নক্ষত্রের ভার বড় ভীষণ। সেই ভারের চোটে সে নিজেই নিজেকে চূর্ণ করে দেয়। আর আমরা তো সামান্য দুই মানব-মানবী।

তাই আমারও সেদিন মনে হয়েছিল, ভালোই করেছে ঝিলিক কথাটা বলে। একে অন্যের মুখের দিকে তাকালে যখন শিরায় রক্ত চলাচল আর দ্রুত হয়ে ওঠে না, তখন কী লাভ শুধু নিয়মরক্ষার জন্যে মাসে এক-দুবার দেখা করে? আমিও চেয়েছিলাম, মৃত নক্ষত্র চূর্ণ হয়ে যাক।

এখনও মনে পড়ে, ঝিলিক যখন বলেছিল, “এস দীপ, আমরা এবার একে অন্যকে হাসিমুখে বিদায় দিই”, তখন আমার মাথায় কোনও বজ্রাঘাত হয়নি। বরং একটা স্বস্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল আমার মনে। চার-বছর আগে ওই সময়টায় আমার ঘাড়ে এমন কিছু কাজ এসে পড়েছিল, যেগুলো পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। দিনান্তে একবার ঝিলিককে ফোন করাটাও তখন বিঘ্ন বলে মনে হচ্ছিল। সেই বিঘ্নের হাত থেকে সেদিন ঝিলিক নিজেই আমাকে মুক্তি দিয়েছিল।

তারিখটা এখনও মনে আছে। মনে থাকার কারণও আছে। ছুটির দিন ছিল সেটা— পনেরোই অগাস্ট, বৃহস্পতিবার। ছুটির দিন ছিল বলেই আমরা দেখা করতে পেরেছিলাম। বৈদ্যবাটি-খালটা সেদিন শেষ-বর্ষার জলে টইটম্বুর হয়ে ছিল। গঙ্গার ঘোলাজল অজস্র কচুরিপানার দাম বয়ে নিয়ে খালের মধ্যে দিয়ে তীরবেগে ছুটে যাচ্ছিল। এতটাই ছিল সেদিনের সেই জলস্ফীতি যে, দু’পাড়ের কদমবনের ঝুঁকে পড়া ডালগুলো অবধি জলের নীচে ডুবে গিয়েছিল। মনে পড়ে, ঝিলিক যখন ওই কথাটা বলল, তখনও আমি মন দিয়ে জলের বুকে ছোট-ছোট ঘূর্ণিগুলোকে দেখছিলাম। ভাবছিলাম, ঘূর্ণি কীভাবে তৈরি হয়। ঝিলিক কিছুক্ষণ আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে, আমার হাতে টান দিয়েছিল। বলেছিল, “কী গো? কিছু বলছ না যে! এদিকে তাকাও।”

তখন আমি জলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঝিলিকের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ও খুব খুঁটিয়ে আমার মুখটাকে দেখেছিল। ও কি ভেবেছিল, আমার মুখটা যন্ত্রণায় ভেঙেচুরে যেতে দেখবে? তার বদলে আমার মুখে চরম নির্লিপ্তি দেখে কি ঝিলিক আঘাত পেয়েছিল? মনে হয়, পেয়েছিল। কারণ, আমার স্পষ্ট মনে আছে, কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, ঝিলিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ও নির্ঘাৎ তখন মনে-মনে বলেছিল, তোমার ভেতর থেকেও ভালোবাসা এইভাবে নিঃশেষ হয়ে গেছে, দীপ? বুঝতে দাওনি তো কখনও!

আমি লজ্জিত হয়েছিলাম। বুঝেছিলাম, আর কিছু না হোক, আমাদের বিগত চারটে বছরের ভালোবাসাবাসির স্মৃতিতে ওর কথায় একটু মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমি তাই তাড়াহুড়ো করে ঝিলিককে বলেছিলাম, “হ্যাঁ, ঝিলিক। সেই ভালো। এরপর থেকে আমরা দুজনে শুধুই বন্ধু হয়ে থাকব। আমার বিপদে তুমি পাশে এসে দাঁড়াবে। তোমার প্রয়োজনে আমি ছুটে যাব, কেমন? তোমার ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক, তার নামকরণ করব আমি। ঠিক আছে?”

তারপরেই কী যেন সন্দেহ হতে আমি আলতো হাতে ঝিলিকের চিবুক ধরে ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, ওর গাল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে নেমে আসছে। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “একি ঝিলিক! তুমি কাঁদছ কেন? এরকম তো কথা ছিল না।”

ও ওড়নার খুঁট দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলেছিল, “নিজেদের জন্যে কাঁদছি না, দীপ। ভালবাসার জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কত যত্ন করে আমরা ভালবাসতাম বলো। কত সুন্দর করে ভালবাসাকে সাজাতাম। তাও কেন ভালবাসা রইল না?”

চার-বছর আগের সেই বিকেলে ঝিলিকের কথা শুনে আমারও মনটা ভার হয়ে গিয়েছিল।

সত্যিই আমরা বড় যত্ন নিয়ে ভালবাসতাম। যেরকম যত্ন নিয়ে গরিব বাবা-মা তাদের প্রথম সন্তানকে বড় করে— চোখে কাজল টেনে দেয়, চুলে রাবার-ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বাঁধে, টাকা জমিয়ে ট্রাই-সাইকেল কিনে আনে, পুজোয় ভেলভেটের ছোট্ট জ্যাকেট— ঠিক সেইভাবে আমরা কথা দিয়ে আমাদের ভালবাসাকে সাজাতাম। কত কথা। সব আজ আর মনেও পড়ে না। কথা বলতে বলতে কখন যেন এক-ঘন্টা, দু-ঘন্টা পেরিয়ে যেত।

প্রথম ভালোবাসা সত্যিই বড় বিস্মিত করেছিল আমাদের। কেমন করে এমন হয়? কেমন করে একজন অনাত্মীয়, রক্তের সম্পর্কহীন মানুষের জন্যে এতটা টান জন্মায়? কেমন করে তার মনের কথা এত সহজে বোঝা যায়?

ঝিলিক চিঠি পেতে বড় ভালোবাসত। যে কথা অনায়াসে মেসেঞ্জারে কিম্বা হোয়াটস-অ্যাপে লেখা যায়, সে কথাও ওকে কাগজের ওপরে লিখে জানাতে হত আমায়। ছেলেমানুষী নয়? এখন ভাবলে একটু হাসিই পায়। আবার মায়াও লাগে। শুধু ওকে চিঠি লিখব বলেই নিউ-মার্কেট থেকে অনেক কষ্টে জলছাপ দেওয়া চিঠি লেখার প্যাড খুঁজে এনেছিলাম। আরও অনেক কিছুই কিনে দিতাম আমরা একে অন্যকে। আমি ওর জন্যে কানের দুল। ও আমার জন্যে দামি লাইটার।

আমরা একে অন্যের প্রতিদিনের গতিবিধি জানতাম। একটু দূরে কোথাও গেলে দফায়-দফায় ওর ফোন পেতাম— “অমুক স্টেশনে নামলে?” “তমুক বাসটা ধরতে পেরেছ?” “সেই দাদা বাড়িতে ছিলেন তো?” “হোটেলে গিয়ে উঠতে হয়নি তো তোমাকে?”

এখন ভাবলে হাসি পায়। আবার একটু মায়াও লাগে… নিজের জন্যে। আর কেউ তো ওইভাবে আমার খোঁজ নেয় না।

আমরা ভালোবাসার জন্যে নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বার করতাম। আমাদের মফস্বল শহরগুলোয় ভালোবাসার জায়গার বড় অভাব। পার্ক নেই, পরিচ্ছন্ন একটা রেস্তোঁরা নেই। কিছুদিন গঙ্গার ঘাটে সিঁড়িতে বসেছিলাম, কিন্তু সেখানে কিছু লুম্পেন আর প্রগলভ বৃদ্ধেরা বড় উত্যক্ত করতেন। বাকি সমস্ত জায়গাতেই বড় চীৎকার। অটো আর টোটোর হর্ন, লটারির দোকানের মাইক, শব্দ করে গয়ের তোলা, খিস্তি-খেউড়— এতরকমের আওয়াজের মধ্যে ভালবাসার কথা বলা বড় কঠিন।

তবু আমরা হাল ছাড়িনি। ঠিকই শান্ত এবং নিরিবিলি জায়গা খুঁজে-খুঁজে বার করতাম। এসব ব্যাপারে ঝিলিকের একটা বিশেষ প্রতিভা ছিল। ও-ই খুঁজে বার করেছিল, হাসপাতালের পেছনের জমিতে কয়েকটা জারুল গাছের জটলার মধ্যে পড়ে থাকা একটা কংক্রিটের স্ল্যাব। ঠিক যেন একটা কুঞ্জবন। শুধু মাঝেমাঝে পশ্চিমদিক থেকে হাওয়া বইলে মর্গের পচা-গন্ধ ভেসে আসত। তাছাড়া জায়গাটা ছিল চমৎকার।

এরকম আরও অনেক ছিল।

খেয়াঘাটের পাশে, নদীর একেবারে ধারেই, দরমার দেয়াল আর টালির চালের একটা ছোট ঘর ছিল। ঝিলিক কীভাবে যেন দেখে ফেলেছিল, ওটা আসলে এক সাধুর আস্তানা। সাধুবাবা সারাদিন গাঁজা খেয়ে বোম হয়ে থাকতেন। আমরা ওই ঘরে ঢুকেই ওঁর হাতে প্রণামি বাবদ দশটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে, তারপর যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকতাম। কী অপূর্ব যে লাগত, বলবার কথা নয়। দরমার দেয়ালের ওপাশ থেকে অবিরাম ঢেউয়ের ছলাৎছল শব্দ ভেসে আসত। মনে হত, আমরা দুজনে যেন কোনো নৌকার ছইয়ের মধ্যে বসে আছি।

আর ছিল ঝিলিকদের শহরের পাবলিক লাইব্রেরি। পুরনো বাড়ির বিশাল দুটো ঘরে, মেঝে থেকে ছাদ অবধি ঠেসে সাজানো ছিল অজস্র বই। কোনও পাঠক ছিল না। কেউ একটা বইও খুলে দেখত না। এক বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান ছিলেন, যিনি প্রায় অন্ধ। আমরা গেলে ভারি খুশি হতেন তিনি। আমরা দুজনে একটা র‌্যাকের আড়ালে চেয়ার টেনে বসে গল্প করতাম। অনেকক্ষন বসে থাকলে পুরনো বইয়ের গন্ধে মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করত। ওইখানেই আমি জীবনে প্রথমবার ঝিলিককে চুমু খেয়েছিলাম।

আর শেষবার ওকে চুমু খেয়েছিলাম ওই বৈদ্যবাটি খালের পাশের রাস্তায়। ওটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় রঁদেভু… মিলনস্থল।

আমি নিশ্চিত, সেইজন্যেই সমাপ্তি-অনুষ্ঠানের জন্য ঝিলিক ওই রাস্তাটাকেই বেছে নিয়েছিল।

আমার চোখে এখনও গেঁথে আছে সেদিনের সেই অপরূপ বিকেল। হিসেব মতন মাসটা ছিল ভাদ্র। কিন্তু সেদিনই প্রথম বাদলমেঘ সরে গিয়ে শরতের নীল আকাশ মুখ দেখিয়েছিল। বৃষ্টিধোয়া গাছের পাতাগুলো জেড-পাথরের ভাস্কর্যের মতন ঝকমক করছিল। ঝোপেঝাড়ে অজস্র প্রজাপতি উড়ছিল। আর ফড়িং। কোথায় যেন পাতার আড়ালে লুকিয়ে দুটো টুনটুনিপাখি উচ্চৈঃস্বরে গলা সাধছিল।

আমাদের পায়ের নীচে মোরামের রাস্তাটাও জলে ভিজে আলতাপাতার মতন লাল টুকটুকে রঙ ধরেছিল। তারই মধ্যে এখানে ওখানে ছোট ছোট খানাখন্দে জমে থাকা জলের মধ্যে আকাশের নীল রঙ গুলে মিশে গিয়েছিল। ঝিলিক তার সালোয়ারের পাড়টা সামান্য তুলে হাঁটছিল। আমি বরাবরের মতনই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম ওর আইভরি-রঙের পায়ের পাতাদুটো। মনে মনে ভাবছিলাম, সত্যিই পারব তো ওকে ছেড়ে থাকতে?

পারলাম কিন্তু।

চার-বছর বড় দীর্ঘ সময়। ঝিলিকের সঙ্গে যোগাযোগ কমতে কমতে এখন একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। শেষবার ওর খবর পেয়েছিলাম প্রায় বছর দেড়েক আগে। ওর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনের কামরায় দেখা হয়েছিল। বলেছিল দিদি জামাইবাবু এখন জব্বলপুরে থাকে।

আমার কাছে ঝিলিকের যে মোবাইল নাম্বারটা ছিল, সেটা ওইসময় থেকেই আর কাজ করছে না। ভালোই হয়েছে। কীই বা বলতাম ওকে ফোন করে? কেনই বা ওকে ফোন করতাম?

এই চার বছরে আমি সাধারণের থেকেও আরও একটু সাধারণ হয়ে গেছি। খুবই সামান্য একটা চাকরি করি। বাবা মারা গিয়েছেন। আমাদের মা আর ছেলের সংসার ওই চাকরির মাইনেতেই মোটামুটি চলে যায়।

যতদিন আমার জীবনে ঝিলিক ছিল, আমি কিছু ভালো বই পড়তাম, কিছু ভালো গান শুনতাম। ঝিলিক নোংরা সহ্য করতে পারত না; তাই তখন আমার জামা প্যান্ট পরিষ্কার থাকত। এখন দিনের পর দিন আমার চলে যায় একটাও গান না শুনে, একটাও বই না পড়ে। মাঝে মাঝে আমাদের ভাড়াবাড়ির দালানের দড়িতে ঝোলানো শার্ট টেনে নিয়ে পরবার সময়, কলারে জমে থাকা ময়লা দেখে একটু থমকাই। তারপর আর বেশি কিছু না ভেবে, সেটাই গায়ে গলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। কী হবে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ভেবে? কেউ তো আর দেখছে না।

ঝিলিক নেই। ভালোবাসার স্মৃতি প্রায় মুছেই গেছে। খুবই এলেবেলে একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে আছি।

আশেপাশের মানুষজনও যেন কেমন করে ঠিক আমাকে এলেবেলে বলে চিনে নেয়। যে কোনও কিউতে দাঁড়ালে একের পর এক সুবেশ নারী-পুরুষ অক্লেশে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ি। যে কোনও কাউন্টারের সামনে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ভেতরের লোকটি প্রচন্ড ধমক দিয়ে ওঠে। বাস থেকে নামবার সময় কন্ডাকটর পেছন থেকে ঘাড়ে হাত দেয়— ‘টিকিট করেছ?’

কেউ জানে না, আমি, এই এলেবেলে মানুষটাই, গত চার বছরে বারবার একা গিয়ে বসেছি হাসপাতালের পিছনের জারুলকুঞ্জে, লাইব্রেরির নির্জন ঘরটায়, খেয়াঘাটের সাধুর কুটিরে আর বৈদ্যবাটি-খালের ধারের রাস্তায়।

আসলে ভালবাসা আমার কাছে ছিল এক অলীক পথপ্রদর্শক, যে হাত ধরে পৃথিবীর কিছু নির্জনতম, কিছু সুন্দরতম জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেই পথপ্রদর্শক চলে যাওয়ার পরেও তার দেখিয়ে যাওয়া জায়গাগুলোয় আমি বেড়াতে যেতাম।

ভালবাসা না থাকলে কি আমি কোনওদিন নদীর ঢেউয়ের ক্ষীণ মর্মরের দিকে কান পাততাম? আমি কি কোনওদিন পুরনো বইয়ের গন্ধে বুক ভরে নিতাম?

না। আমি জানি, নিতাম না।

ওইসব জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি এক অন্য দীপকে খুঁজে পেতাম, যার উচ্চতা আমার চেয়ে একটু বেশি ছিল। যার চোখগুলোও ছিল আরও একটু দীঘল। যার কন্ঠস্বরে ছিল স্তবপাঠের গমক।

যার একখানি নিজস্ব প্রতিমা ছিল।

আজকেও আমি বৈদ্যবাটি খালের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি। অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ এটা। আর ক’দিন বাদেই পুজো। আজও আকাশের রঙ সেদিনের মতই নীল, সেরকমই প্রজাপতি উড়ছে। শুধু খালে এখন জল নেই। অগাস্ট থেকে অক্টোবর, এই দু’মাসের মধ্যে জলস্তর একেবারেই নেমে গেছে। ঘূর্ণি নেই, কদমের ডাল কাঁপিয়ে যাওয়া স্রোত নেই। মরা খালের বুকে জায়গায় জায়গায় কচ্ছপের পিঠের মতন কাদাজমি জেগে উঠেছে।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, খালের বাঁধানো পাড়ে শুকনো কচুরিপানার দাগ লেগে আছে। তার মানে বর্ষাকালে ওই অবধিই ফুলে উঠেছিল জলস্তর। জল নেমে গেছে। কচুরিপানাগুলো এখনও ইটের গাঁথনির গায়ে আটকে রয়েছে।

একদিন আমারও ভিতরে জলস্তর ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। কিছুদিনের জন্যে আমিও কদমের ডালকে কাঁপিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম এদিক থেকে ওদিক। এখন আমার ভিতরে আর স্রোত নেই। শুকনো কিছু কচুরিপানা রয়েছে কি কোথাও, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারবে, একদিন কী ছিলাম?

আপনা থেকেই আমার বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনে মনে বলি, নাঃ। এই জীবনে সেদিনের জলস্তর কোনও চিহ্ন না রেখেই মিলিয়ে গিয়েছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

4 thoughts on “short-story-ei-jeevan-ei-jolostar

  1. কিছু কিছু লেখার পাশে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *