short-story-ek-lekhoker-mrityu

এক লেখকের মৃত্যু
নন্দিনী নাগ


নিশান বেশ বুঝতে পারেন তিনি ফুরিয়ে গেছেন। সাদা কাগজের ওপর দামী কলমটা উপুড় করে দীর্ঘসময় রেখে দিলেও আজকাল একটা শব্দও ঝরে পড়ে না।

ছোটবেলায় শরতের সকালে যেমন টুপটাপ শিউলি ঝরতে দেখতেন, সাজি ভরে ফুল কুড়িয়ে নেবার অল্প সময় বাদেই আবার যেমন গাছতলাটা ফুলে ফুলে ভরে যেত, তেমনই শব্দরাজি উপচে পড়ত নিশানের কলম বেয়ে, কয়েকবছর আগেও। এখন শিউলি ঝরা শরতের মতোই শব্দেরাও ছুটি নিয়েছে, নিশানের দামী লেখার কাগজ দিনের পর দিন পড়ে আছে বন্ধ্যা জমির মতো, নিস্ফলা।

তবু প্রতিদিনই নিয়ম করে লেখার টেবিলে বসতেই হয় নিশানকে, কিছু না কিছু লিখতে তাঁকে হয়ই, নতুন কিছু সৃষ্টি না হলেও।

কলমের ধার অনেকদিনই চলে গেছে তাঁর, কিন্তু ভার কমেনি। নিশান সান্যালের নামে এখনও সাময়িকী, মাসিক পত্রিকাগুলো বিক্রি হয়, পূজাবার্ষিকীগুলোর বিজ্ঞাপনে সকলের আগে তাঁরই নাম ছাপা হয়। এই প্রত্যাশার চাপ প্রবল, সেই চাপেই প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসেন নিশান, কুড়িটা বছর ধরে যেমন বসে আসছেন।

নিশানের স্ত্রী মিলি মাঝেমাঝেই বলেন, “একজন মানুষ কি সারাজীবন লিখতে পারে! লেখা দিতে পারবে না সেটা বলে দিলেই তো পারো!”

পারেন না নিশান, নামী প্রতিষ্ঠান থেকে লেখার আমন্ত্রণ তিনি ফেরাতে পারেন না। কেন যে পারেন না তার সঠিক কারণটাও খুঁজে পাননি তিনি। টাকার ব্যাপারটা ছাড়াও আছে যশলোভ। এতগুলো বছর পরিশ্রম করে নিজের যে জায়গাটা তৈরি করেছেন, সেই জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে সরে আসতে মন চায় না তাঁর।

যে পত্রিকায় লেখার সুযোগ পাওয়া একসময় তাঁর স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নের মাশুল দিতে কত রাত যে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে লেখক জীবনের প্রথমদিকে, সেই পত্রিকায় লেখার আমন্ত্রণকে ফিরিয়ে দেবার মতো মানসিক দৃঢ়তা এখনো তাঁর হয়নি। দোনোমোনো করতে করতে এবারেও তাই উপন্যাস লিখতে সম্মত হয়েছেন।

পূজাবার্ষিকীতে এবছর এই একটাই উপন্যাস লিখবেন, কিন্তু ছোটো গল্প দিতে হবে গোটা পাঁচেক। অথচ কোনোটাই লেখা হয়ে ওঠেনি এখনো পর্যন্ত। খানিকটা লেখা হয়ে যাবার পর পড়ে দেখতে গেলে কখনো বা নিজের ভালো লাগছে না, কখনো বা মতামতের জন্য মিলিকে পড়ে শোনালে সে নাক কোঁচকাচ্ছে।

“তোমার এখনকার লেখাগুলো বড্ড একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। যা বলতে চাইছ সবই আগে কোনো না কোনো লেখাতে বলে ফেলেছ। এখন যে গল্পটা শোনালে একদম এরকম একটা গল্প তোমার পাঁচবছর আগে বার হওয়া একটা গল্প সংকলনে আছে।”

“এত লিখেছি এ যাবৎ, কিছু তো মিল থাকবেই। একেবারে আনকোরা প্লট কোথায় পাব!”

নিশানের স্বগতোক্তি মিলির কান এড়ালো না।

“নতুন প্লট না থাকলে লিখবে না! লিখতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে তোমাকে!”

মিলির মন্তব্যে অত্যন্ত মুষড়ে পড়লেন নিশান। সত্যিই তো, যদি বিষয়বস্তু, গল্প বলার ঢং, কিংবা জীবনদর্শনে নতুন কিছু না থাকে,তবে পাঠক সেটা নেবেই বা কেন! কেবল নামের জোরে পাঠককে বেশিদিন টেনে রাখা যায় না।

বিষণ্ণ নিশান লেখার টেবিলে বসে মা সরস্বতীর কৃপা প্রার্থনা করতে থাকেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁর কলমে ধরা দেয় না সেই জাদু বর্ণমালা, যা দিয়ে শুরু হতে পারে একেবারে আনকোরা নতুন একটা গল্প।

ক্লাস নাইনে ওঠার পর অনেকেরই কবিতা পায়, কিংবা বলা যেতে পারে কবিতা অনেককে খায়। বইয়ের মলাটে, স্কুলের খাতার পেছনে, প্রেমপত্রে, কিছুদিন কাব্যপ্রতিভা নিজেকে মেলে ধরে, তারপর সেই রোগ নিজে থেকেই সেরে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যে অল্প দুই একজনের ক্ষেত্রে এঁটুলির মতো ইচ্ছেটা মনের মধ্যে আটকে থাকে, সবুজ সেরকমই একজন।

পুরো নাম সবুজবরণ বিশ্বাস। কলেজে পড়ে আর স্বপ্ন দেখে, একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হবার। তবে শুধু দিবাস্বপ্ন দেখা নয়, সেই ইচ্ছেপূরণের জন্য সবুজ যথেষ্ট পরিশ্রমও করে।

কবিতাগুলোকে খাতার পেছনের পাতায় আটকে না রেখে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকের ঠিকানাতে পাঠানো শুরু করেছে দু-তিন বছর হল, বেশ কয়েকটা ছাপাও হয়েছে। কবিতায় সাফল্যের মুখ দেখার পর সবুজ এখন হাত দিয়েছে গদ্যে, বেশ কয়েকটা গল্প লিখেও ফেলেছে।

স্কুলবেলায় সবুজ প্রায়শই বলতো, “বড় হয়ে আমি লেখক হব”।

নাইন-টেন এ পড়া ছেলেরা নিজেদের সাবালকই ভাবে, তাই বন্ধুরা নিরীহ সবুজের কথা শুনে গম্ভীর মুখে ঠাট্টা করে বলতো, “তুই আর কবে বড় হবি ভাই?”

সবুজ ততোধিক সিরিয়াস মুখে জবাব দিত, “যেদিন লেখক হব।”

সেইসব বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো ওর সহপাঠী, তারা এখন বলে, “সবুজবরণ তো, তাই কাঁচা লেখক। যেদিন তুই হলুদবরণ হবি, সেদিন একেবারে পাকা লেখক হয়ে উঠবি।”

বন্ধুদের এসব ঠাট্টা গায়ে মাখে না সবুজ। ও জানে, যেদিন সত্যি সত্যি লেখক হিসেবে নামডাক হবে সেদিন এসব বন্ধুরাই অন্য সুরে গাইবে।

তাই সবুজ কেবল লিখেই যায় আর গল্পগুলো পাঠাতে থাকে খ্যাত-অখ্যাত সমস্ত রকম পত্রিকার দপ্তরে। বলা তো যায় না কখন কোথায় শিকে ছেঁড়ে!


দুই


প্রতিদিন গুচ্ছের লেখা আসে পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে। ডাকে, ক্যুরিয়ারে,হাতে হাতে এবং মেলে। খ্যাতনামা লেখকদের লেখা প্রকাশ করতে হয় নিয়মিত আর তার ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দিতে হয় অখ্যাত অনামীদের লেখা। এতে ভারসাম্য থাকে, পত্রিকার গুণগত মান বজায় থাকে আবার ব্যবসার দিকটাও রক্ষা হয়।

সম্পাদকের এত সময় কোথায় যে এত লেখা পড়বেন! দপ্তরে বসে যদি প্রতিদিন কুড়িটা করে গল্প পড়তে হয়, তবে অন্য কাজ কখন করবেন! এই গল্প বাছাই করার কাজটা করে সোমক, জমা পড়া লেখাগুলোর মধ্যে থেকে ঝাড়াই বাছাই করে পাঁচটাকে পাশ নম্বর দিয়ে সম্পাদকের টেবিলে ফ্যালে সে, তিনি তারমধ্যে থেকে দুটোকে বেছে নিয়ে ফাইলে রাখেন, বাকিগুলোর জায়গা হয় বাতিল কাগজের গাদায় কিংবা ‘বিন’ এ।

কখনো কখনো এই কাজটাও করেন না সম্পাদক, সোমককেই করে নিতে বলেন। সোমকের চুড়ান্ত করা লেখাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই তিনি ছাড়পত্র দিয়ে দেন।

অবশ্য সোমকের ওপর ভরসা না করার কোনো কারণ নেই। পাকা রাঁধুনি যেমন একটা ভাত টিপেই বুঝতে পারে, ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে নামানোর সময় হয়েছে কি না, সোমকও তেমন একটা অনুচ্ছেদ পড়লেই বুঝতে পেরে যায়, গল্পটা আদৌ উৎরাবে, নাকি ঘেঁটে যাবে। কোনো কোনো সময় তারও দরকার হয় না, চোখ বোলাতে গিয়ে যদি কোনো বেয়াড়া বেখাপ্পা লাইন চোখে পড়ে যায় তবে সেখানেই ঘ্যাচাং করে দেয়। প্রয়োজনের চাইতে যোগান বেশি থাকলে এমনটাই করা বিধেয়, বাছাই না করে ছাঁটাই।

গত পাঁচবছর ধরে এভাবেই কাজ করছে সে, কখনো কোনো প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়নি। কিন্তু আজ হল।

আজ লাঞ্চের পর নিজের চেয়ারে বসতেই সম্পাদকের ঘরে ডাক পড়ল সোমকের।

“এই মাসে যে দুটো গল্প যাবে, বাছাই হয়ে গেছে?”

“পরশুদিনই তো তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে গেলাম দাদা!”

“দেখিয়েছিলে, না? আমার মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছে।”

“আবার পাঠাব? ইলাস্ট্রেশনে পাঠিয়ে দিয়েছি, অবশ্য তুমি যদি বল-”

“না ঠিক আছে। তুমি বরং যেগুলো রিজেক্ট করেছ, তার থেকে গোটা দশ-পনেরো স্টোরি আমাকে দিয়ে যাও তো”

“দশ না পনেরো?”

“দশ। না,পনেরোই পাঠাও”

সম্পাদকের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সোমক মাথাভর্তি দুশ্চিন্তার কিলবিলে পোকা নিয়ে। বাতিল গল্পগুলো কেন চাইলেন উনি? কেউ কি চুকলি কেটেছে যে সোমক ভালো করে না পড়েই সব ট্র্যাশে ফেলে দেয়? কে হতে পারে? পাশের টেবিলের জয়শ্রী? নাকি এমন কারো লেখা বাতিল হয়ে গেছে, যেটা হওয়া উচিত ছিল না?

‘যা থাকে কপালে’ ভেবে নিয়ে, বেছে বেছে পনেরোটা বাতিল গল্প সম্পাদকের টেবিলে রেখে এল সোমক, যেগুলোর লেখকদের নাম, ধাম আগে কখনোই চোখে পড়েনি ওর। আর তারপর আবার ও ঘর থেকে ডাক আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

“রাতের শেষ আপ ট্রেনটা হর্ণ বাজিয়ে দেবার পর শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকল রাকেশ। দৌড়ে ট্রেনের কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতেই ছেড়ে দিল ট্রেনটা। শেষ কামরাটার দরজার দিকে ছুটতে ছুটতে জানালার পাশে বসে থাকা লোকটাকে রাকেশ জিজ্ঞেস করল, দাদা এই গাড়ি কোথায় যাচ্ছে?

-নরক

এত রাতে এমন বেখাপ্পা রসিকতায় ঘাবড়ে গেল রাকেশ। ওর ছুটন্ত পা দুটো নিজে থেকেই থমকে গেল। হতভম্ব রাকেশের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল রাতের শেষ ট্রেন।

কোথায় যাচ্ছিল সেই ট্রেনটা? লোকটি কে ছিল? এরপর রাকেশের কি হল? এইসব প্রশ্নের জবাব জানার জন্য চোখ রাখুন শারদীয়া খুশির হাওয়ায়”

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল সবুজ। তিনবার, চারবার, পাঁচবার পড়ল লাইনগুলো। এ তো ওরই লেখা! ‘নরকসংকেত’ গল্পের লাইন এগুলো, যে গল্পটা ‘খুশির হাওয়া’তে পাঠিয়েছে কয়েকমাস আগে! তাহলে এতদিনে সবুজের কপাল খুলেছে, যে সে পত্রিকা নয়, একেবারে ‘খুশির হাওয়া’তে ছাপা হচ্ছে ওর গল্প।

কাগজটা নিয়ে কলেজে গেল সবুজ। ক্যান্টিনে, বন্ধুরা যেখানে আড্ডা মারছিল সেখানে গিয়ে ওদের মাঝখানে ফেলল বিজ্ঞাপনের পাতাটা।

“দ্যাখ্! দ্যাখ! এতদিন তো হ্যাটা করতিস আমাকে, এবার দ্যাখ!”

“ভাই করেছিস কি! এটা কি তুই নাকি!”

বন্ধুরা খুশিতে জাপটে ধরল সবুজকে।

“খাওয়া ভাই! তোর তো লটারি লেগে গেল! কত টাকা পাবি এই গল্পটার জন্য?”

“গুলি মার টাকায়! একেবারে খুশির হাওয়াতে লেখা বার হচ্ছে! কত প্রেস্টিজ বলতো! তোর তো লাইফ বনে গেল! আর কলেজে পড়ে কি করবি! মন দিয়ে লেখালিখি কর!”

বন্ধুরা অকৃত্রিম আনন্দে কথাগুলো বলছিল। সবুজও স্বপ্নের গ্যাসবেলুনে চড়ে ভেসে যাচ্ছিল উঁচুতে,আরো উঁচুতে।


তিন


মাসখানেক বাদে আজ আবার অনেক রাতে বিছানায় গেলেন নিশান। অফিস থেকে ফিরে একটু জলখাবার খেয়ে সেই যে পড়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন, আর রাতে খেতেও বার হননি।

নিশানের এই আচরণের সাথে মিলি পরিচিত বহুবছর ধরে, তাই নিঃশব্দে রাতের খাবার পৌঁছে দিয়েছেন লেখার টেবিলে। এরকম দিনগুলোতে নিশান লিখতে লিখতেই চামচ দিয়ে খেয়ে নেন, টেবিল ছেড়ে উঠে এলে ওঁর মনঃসংযোগ নষ্ট হয়ে যায়।

একটানা পাঁচঘন্টা লিখে যখন বিছানায় এলেন নিশান তখন তিনি তৃপ্ত, মুখ থুবড়ে পড়া কলমটা আবার জোর পেয়েছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

“কালকে বেলা করে বেরব। সকালে ডেকো না”

অনেকদিন পর নিশানকে লেখায় ফিরতে দেখে মিলিও খুশি। জিজ্ঞেস করলেন, “শেষ হল গল্পটা?”

“গল্প না, উপন্যাস ধরেছি। এটা শেষ করে গল্পগুলো এক এক করে ধরব। প্লট রেডি, ঠিক সময়ে নেমে যাবে।”

শারদীয়া ‘খুশির হাওয়া’ হাতে পাওয়ার জন্য তর সইছিল না সবুজের। কতক্ষণে যে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটা দেখে চোখদুটোকে সার্থক করবে তার জন্য বিজ্ঞাপন বার হবার পর থেকে দুটো মাস অপেক্ষা করে আছে। অবশ্য মাঝে একবার পত্রিকার অফিসে ফোন করে জানতে চেয়েছিল গল্পটা শারদ সংখ্যার জন্য মনোনীত হয়েছে কি না।

“মনোনীত হলে আমরাই আপনাকে যথাসময়ে জানিয়ে দেব।”

টেলিফোনের ওপারে থাকা সুমিষ্টভাষিণীর কথা অনুযায়ী ‘যথাসময়’ এর জন্য অপেক্ষা করতে করতে শেষপর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে যাবার বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে, সুতরাং নিজেকেই নিজে সারপ্রাইজ দেবার জন্য সবুজ বিজ্ঞাপন দেখামাত্র সাইকেল নিয়ে ছুটল স্টেশনে, যত পত্রপত্রিকা ট্রেন পথেই ওদের আধা শহরে এসে পৌঁছয় কি না।

পত্রিকা হাতে নিয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে সূচীপত্রে নিজের নাম খুঁজছিল সবুজ, হকারের ধমকে চৈতন্য হল।

“দাদা এভাবে বই ঘাঁটবেন না। পড়তে হলে কিনে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে পড়ুন।”

কিনতেই তো এসেছে সে, শুধু উত্তেজনা দমন করতে না পেরে একটু সূচীপত্রটা দেখছিল, তাতে অন্যায়টা কি হয়েছে বুঝতে পারল না সবুজ। অন্যসময় হলে এমন খেঁকুড়ে লোকের কাছ থেকে কিছুতেই বইটা কিনত না ও, কিন্তু আজ ওসব গায়ে মাখল না। তাড়াতাড়ি টাকা মিটিয়ে, প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চেই বইটা নিয়ে বসে গেল নিজের গল্পটা খুঁজে বার করার জন্য।

আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সূচীপত্রে কোথাও ‘নরকসংকেত’ খুঁজে পেলনা সবুজ।

“তাহলে কি ওরা নামটা বদলে দিয়েছে! হতে পারে, সম্পাদকের এটুকু অধিকার আছে!”

এবারে নিজের নাম খুঁজতে শুরু করল সবুজ।

গল্পের তালিকায় প্রতিটি লাইনে আঙুল দিয়ে দিয়ে পড়েও যখন ‘সবুজ বরণ বিশ্বাস’ পাওয়া গেল না, তখন সবুজ মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত।

“এত ভুল দেখলাম আমি! নিজের লেখা লাইনগুলোকে চিনতে এতটা ভুল হল!”

ভাবতে ভাবতে অবসন্ন, ক্লান্ত সবুজ কোনোমতে সাইকেলটাকে টেনে নিয়ে ফিরে এল বাড়িতে।

ওকে বইটা হাতে ঢুকতে দেখে দুবছরের ছোটোবোনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ছোঁ মেরে বইটা নিয়ে নিল ও।

“এটাতেই তো নিশান সান্যালের নতুন উপন্যাস আছে। এবছর মাত্র এই একটা পূজোসংখ্যাতেই উনি উপন্যাস লিখেছেন।”

নিশান সান্যালের অন্ধ ভক্ত পিংকি তখনই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ‘শেষ ট্রেনের যাত্রী’র ওপর।

বোনের হাতের ফাঁক দিয়ে সবুজের চোখে পড়ে গেল উপন্যাসের শুরুতে বড় বড় হরফে লেখা লাইনগুলোর ওপর, চমকে উঠল ও।

বোনের হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে সবুজ দেখল, হুবহু সেই লাইনগুলোই, যেগুলো বিজ্ঞাপনে দেখেছিল।

বইটা ফিরিয়ে দেবার জন্য বোনের ঘ্যানঘ্যানানিতে কান না দিয়ে সবুজ বই সমেত নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল, যাতে কেউ না বিরক্ত করতে পারে।

দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিশান সান্যালের ‘শেষ ট্রেনের যাত্রী’ পড়ে ফেলল সবুজ। এ তো তারই লেখা ‘নরকসংকেত’! পার্থক্য শুধু কলেবরে আর লেখনীতে। কাঁচা হাতের ছোটগল্প বদলে গেছে পাকা হাতে লেখা উপন্যাসে!

হতভম্ব হয়ে বসে রইল সবুজ। কি করবে সে এখন! ওর কথা যেখানে বাড়ির লোকেরাই বিশ্বাস করবে না, সেখানে বাইরের কাউকে বলতে গেলে বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া আর কিছু ভাববে না।

পত্রিকার দপ্তরে নালিশ করেও কোনো লাভ নেই, বিচার পাওয়ার কোনো আশাই নেই। কারণ নিশান সান্যাল ওখানকারই চাকুরে, ‘খুশির হাওয়া’ মাসিক পত্রিকাটির সম্পাদক। অত বড় একজন লেখকের গায়ে কালি ছেটানোর চেষ্টা করলে সেই কালি যে শেষ পর্যন্ত নিজের মুখেই মেখে নিতে হবে, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি সবুজের আছে।

সবুজের ভীষণ অসহায় লাগছিল। কিভাবে এবার বন্ধুদের সামনে যাবে সে বুঝতে পারছিল না। যে বন্ধুরা এতদিন ওর জন্য গর্ব করছিল, তারা এখন টিটকিরি দেবে। নিশান সান্যালের লেখাকে নিজের নামে চালানোর অপবাদে ছিছিক্কার করবে। কলেজে যারা এতদিন কিছুই জানত না, তারাও জেনে যাবে বাংলা অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সবুজবরণ বিশ্বাস একজন মিথ্যেবাদী, জোচ্চর। স্যর-ম্যাডামদের কানেও পৌঁছে যাবে কথাটা, তাঁরা ডেকে পাঠিয়ে অপমান করবেন। সবটাই মাথা নিচু করে হজম করতে হবে সবুজকে, কলেজের বাদবাকি দিনগুলোও ওকে কাটাতে হবে মাথা নিচু করে।

আর ভাবতে পারছিল না সবুজ। ওর শরীর মন সব অবশ হয়ে আসছিল। শ্যাওলা ধরা একটা স্যাঁতস্যাঁতে পানাপুকুরের শীতলতা শুষে নিচ্ছিল ওর লেখক হবার বাসনা, বেঁচে থাকার ইচ্ছে।

প্রিন্সেপঘাটে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে মিলির তখন মনে হচ্ছিল, অনেক অনেক বছর আগে, এখানে, এই গঙ্গার ধারে বসে নিশান তাকে শোনাতো একের পর এক নতুন ভাবনার কথা, নতুন কাহিনীর নকশা। এখনো হয়ত এই জলের তলায় রয়ে গেছে সেসব কাহিনী আর নিশান, সেই কাহিনীকার, সে নিজে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে আছে পাহাড়ছোঁয়া খ্যাতির নিচে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

9 thoughts on “short-story-ek-lekhoker-mrityu

  1. অসাধারণ সার্থক ছোটগল্প৷ বার্তাবহ৷ কতজনের স্বপ্নভঙ্গ হয় এভাবে৷নাম একটা বড় বস্তু ৷নামে টিআরপি বাড়ে৷

  2. স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার নির্মম কাহিনী। অনবদ্য শব্দ বুনোট। এক নিশ্বাসে পড়েছি।

  3. সমস্ত পাঠকবন্ধুকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। এভাবেই পাঠে থাকবেন,পাশে থাকবেন।

  4. অসাধারণ লাগলো…ধরতে গেলে প্রবীণ ও নবীন দুই লেখকের মৃত্যু হলো…

Leave a Reply to Arunima Bhuimali Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *