জয়তী রায়
গভীর অরণ্য। পাতায় পাতায় শাখায় শাখায় জড়াজড়ি করে তৈরি করা আচ্ছাদন ভেদ করে সুয্যির আলো ঢুকবে এমন সাধ্য নাই। দিনের বেলাতেও ঘাস জমি ভেজা, নরম। ছায়া ছায়া আঁধার। ওই প্রাচীন বৃক্ষসকল যেন অরণ্য প্রহরী। শরীর জুড়ে পুরনো ইতিহাসের বাকল। হাজার বছরের পুরোনো অরণ্য সকলের আশ্রয়। মাতৃরূপী। সেখানে কিচির মিচির পাখির ডাক, ছুটে যাওয়া চিত্রিত হরিণ, চলন্ত পর্বত হেন হাতির পাল, ভাব গম্ভীর শার্দুল রাজকীয় ভঙ্গিতে বিশ্রামে আছে পর্বত গুহায়।
পশুর সঙ্গে গাছের সঙ্গে বসবাস করে মানুষ। বনগ্রাম বলা চলে। তির ধনুক কুঠার মুগুর নিয়ে শিকার করবে, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নাইতে যাবে, ভারি আনন্দে থাকে এই অরণ্য অধিবাসী। গাছে গাছে ফল, ফুলে ফুলে মধু, নদীভরা মাছ, পশু মাংস – অরণ্য কখনও কষ্ট দেয় না আশ্রিতকে। প্রতিদান না পেলেও প্রতিপালন করে।
এই জঙ্গল মহলের অধিপতি নিষাদরাজ, হিরণ্যধণু। হাজার ক্রোশের জঙ্গলে অবশ্য রাজা-প্রজার গোলমাল মোটেই নেই। এখানে সবাই রাজা সবাই প্রজা। মানুষ আর গাছ পাশাপাশি বসত করলে দুজনকে আর আলাদা করা যায় না। অনুচ্চারিত শৃঙ্খলা সকলেই রক্ষা করে। অকারণ হত্যা নয়, অকারণ হিংসা নয়, অকারণ চিৎকার নয়! ঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ো, ঠিক সময়ে জেগে ওঠো। তবু একজন গোষ্ঠীপতি থাকে। যিনি সকলের মধ্যে সেরা বুদ্ধিমান, যিনি বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন, যিনি শক্তিশালী বটে। হিরণ্যধণু তেমন একজন নেতা। এই অরণ্য তার মা। সেখানে পরিবার নিয়ে লোকজন ভারি সুখে থাকে। তবে, দুনিয়ার সেরা সুখ তাকে দেয় একমাত্র সন্তান একলব্য। চোদ্দবছর মোটে বয়স। পাথর কোঁদা শরীর। শিশু শালগাছ বেড়ে উঠছে যেন, তেমন সতেজ, তেমন সোজা। এখনই নিপুণ শর চালনায়। চোখে না দেখে, শুধু শব্দ শুনেই তীর দিয়ে গেঁথে দিতে পারে চলন্ত পশু থেকে উড়ন্তপক্ষী। ধন্য ধন্য করে বনচর জাত। তারা বলে, ‘এমন কখনও দেখি নাই বাপা। শুনেছি, হস্তিনাপুরের রাজকুমার অর্জুন, সে জানে এমন বিদ্যে!’
মাথা নেড়ে সমর্থন জানায় কেউ। বলে ‘অর্জুন রাজবংশের সন্তান। সেরার সেরা।’
হুঙ্কার দেন হিরণ্যধণু, ‘আমার একলব্য কম কিসে? বনগ্রামের রাজার ছেলে। রাজপুত্তুর বটে। একবার সামনাসামনি লড়াই হোক দেখি দুজনের। বুঝি হে, কে কম কে বা বেশি!’
‘আহাহা রাজা। চটে কেন যাও?’
রাজা গম্ভীর মুখে বলেন, ‘রাগের কথা কও কেন? নগর বলে খাতির? অরণ্য কম কিসে?’
‘না গো রাজা। খাতির করি না। খবর দিচ্ছি তোমায়। হস্তিনাপুরের রাজপুত্তুরের দল যাঁর কাছে বিদ্যে শেখে, তিনি হলেন এই ধরিত্তির সেরা গুরু, দ্রোণাচার্য।’
একলব্য ঘুরে তাকায়। নামটা কানে গেছে তার। দুইহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বলে ‘ওনার মত কেউ নাই।’
রাজা হিরণ্য চমকে বলেন ‘তুই জানিস তাঁর কথা?’
‘ওনাকে পুজো করি। আমার গুরু মানি।’
অবাক হন রাজা! ছেলে কেমন কথা বলে! না দেখেই গুরু মানে?
মাথা নাড়ে প্রবীণ মানুষ। তিনি বনচর জাতির বুদ্ধিদাতা। সম্পর্কে একলব্যর দাদামশাই। ঘরে বাইরে কত্ত খবর আছে তার ঝুলিতে। নিষাদ জাতির সেই আদিকালের পুরাণ ইতিহাস সব জানে ওই বুঢ়া। হাতে একখান লাঠি, কোমরখানি বেঁকা, বয়সের গাছ-পাথর নাই। টিমটিম সন্ধ্যায় মোটা ভুরুর নিচে বুজে যাওয়া চোখ নিয়ে গল্প বলতে বলতে জ্বলে ওঠে চোখ, ‘হুই বাপ, নিষাদ জাতি মহাদেবের অংশ। এই ধরিত্তিরের সবচেয়ে পুরাতন জাতি। সক্কলে মানে গোনে। বীর বটে মোরা।’
তাহলে তো ল্যাঠা চুকে গেল।
বুঢ়া মলিন মুখে মাথা নাড়ে, ‘সে হবার নয় গো। এমন আশা করো না। চাইলেই তো আর হবে না বাপা। এখন তুমি আকাশের চাঁদ চাও, পাবে? এমনি ধারা কিছু বস্তু থাকে, বাপু হে, তাদের আশা করতে নাই।’
প্রবীণ মানুষের কথা শুনে সব কটা মাথা নড়ে উঠে বলে ‘ঠিক ঠিক’।
বুঢ়া বলে, ‘আমরা সব্বাইরে আপন করি, নগর উল্টা। বুঝে শুনে কাজ করতে হয় গো।’
একলব্য তাকায় কঠিন চোখে। ঈশান কোনে মেঘ জমেছে। ঝড় আসছে। সে ঝড় এখন থম থম করছে তার মুখে। কে যেন বলে উঠল ‘সামাল সামাল। ঝড় আসছে। ঝড়।’
ধনুকে টঙ্কার তুলল একলব্য।
আসুক ঝড়। আসুক তুফান। হস্তিনাপুর সে যাবেই। ধনুর্বিদ্যা শিখবে আচার্য দ্রোণাচার্যের কাছে।
অরণ্যের দেবতা হলেন বঙ্গা। সবচেয়ে পুরনো বটগাছ, যার বয়স কম করে দুশো পঞ্চাশ, লক্ষ লক্ষ ঝুরি নামিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে, হুই মাঠের পারে। তার নিচে আছেন দেবতা। সাদা চোখে দেখলে মনে হবে একখান পাথর, সিঁদুর লেপা। কিন্তু, ভক্তি নিয়ে দেখলে? তবে জানবে, উনি হলেন সাক্ষাৎ জাগ্রত মহাদেব। কচ করে কেটে দাও মুরগির মাথা, দুখানি কচি নধর পাঁঠা এনে ভেট দাও ঠাকুরের থানে। তারপর? চাও। যা প্রাণে চায়। আশা ফলবেই ফলবে।
গতকাল সারারাত ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। মাটি চপচপ ভিজে। মেঘ কেটে সুয্যি উঠেছেন বটে, কিন্তু চাদ্দিক কেমন কাঁদুনে বাচ্চার মুখের মত। এক হাতে বনমোরগের ঝুঁটি চেপে ধরে দৌড়ে দৌড়ে থানের দিকে আসছে একলব্য। আজ যাবে হস্তিনাপুর। তাই এসেছে ঠাকুরের পায়ে মাথা ঠেকাতে।
এসে দেখে, ওমা! এই ভোরবেলা, চলে এসেছে সুংলি। পরিষ্কার করছে মাটিতে পড়ে থাকা পাতা আর অন্য আবর্জনা। কিশোরীর গলায় দুলছে বনফুলের মালা।
ভোরের অমলিন শোভা শরীরে মেখে দাঁড়িয়ে আছে তার বাল্যসঙ্গিনী। সে বলে, ‘তুই ভাগ। আমি পুজো দেব।’
নিরীহ মুখ করে সুংলি বলে, ‘দাও না। আমি কি বারণ করেছি?’
‘তোর সামনে দেব না। তুই যা।’
নাকের পাটা ফুলিয়ে, পায়ের মল ঝমঝমিয়ে, হাতের কচি আঙ্গুল উঁচিয়ে পাকামেয়ে বলে কি না-
‘নাই বা গেলে হস্তিনাপুর! এখানে তোমাকে সবাই কত্ত ভালোবাসে। কালে কালে আরও কত বড় বীর হবে। অরণ্যের অধিপতি হবে। নাই বা গেলে!’
রেগে ওঠে একলব্য। শুভ কাজে যাচ্ছে। তার এত বাধা? গোটা নিষাদগ্রাম এমন করে শিকল পরাতে চাইছে কেন পায়ে! গুরু দ্রোণ তার ভগবান। ভগবানের দেখা পাবে! কতদিনের আশা।
সুংলি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বলে, ‘তুমি আমাদের বড্ড গর্বের গো। আদরের। তোমার মান যেন বজায় থাকে!’
‘গুরুর কাছে যাচ্ছি রে সুংলি। ভয় কিসের? গুরু যদি কটু কথা বলেন, সেটাও আশীর্বাদ মানতে হয়, বুঝলি?’
সুংলি কিছু বলে না। অরণ্য কিছু বলে না। আজন্মের সঙ্গী সাথী পশু পাখি কেউ কিচ্ছু বলে না। স্বপ্নের ঘোর যাকে ঘর ছাড়া করে, তাকে কিছু বলা বৃথা। অবহেলা অপমান ভয় কোনও কিছুই পরোয়া করা যাবে না। দুনিয়ার সেরা তিরন্দাজ হবার স্বপ্ন কাঁধের ঝুলিতে নিয়ে রাজার ছেলে রাজপুত্তুর নৈষদ একলব্য যাত্রা শুরু করল হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে রইল শহরের খবর জানা সঙ্গী সুষেণ। চালাক ছেলে। রান্না-বান্না করবে, দেখভাল করবে। ছায়ার মত সঙ্গে থাকবে।
গঙ্গানদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত হস্তিনাপুর নগরী দেখলে চোখ ঝলসে যায়। কুরুবংশের রাজধানী। কী বা শান, কী বা ঝলক কী বা ধন সম্পদ! সিংহাসনে বসে আছেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। তিনি যদিও জন্মান্ধ, কিন্তু তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিদুর আর অভিভাবক ভীষ্ম থাকায় রাজ্য দিনে দিনে জগতের সেরা হয়ে উঠছে। ধনে সম্পদে ঐশ্বর্য গরিমায় হস্তিনাপুরী যেন স্বপ্নের জগত। শত্রুপক্ষের ক্ষমতা আছে এই রাজ্যের দিকে মুখ তুলে তাকানোর? কাঁহা কাঁহা বীর পুরুষের অস্ত্র ঝলকে উঠে গর্দান
নিয়ে নেবে মুহুর্তে। এর মধ্যে আবার নিযুক্ত হয়েছেন আচার্য দ্রোণ। তিনি এখন কুরু-পান্ডব রাজপুত্রদের শিখিয়ে পড়িয়ে ধুরন্ধর যোদ্ধা করে তুলছেন।
সে তো করতেই হবে। একদিন এরাই করবে রাজ্য শাসন। যুদ্ধক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াতে হবে। কুরুরাজ্যের অভিভাবক প্রাচীন মানুষ ভীষ্ম তাই দ্রোণকে পেয়ে নিশ্চিন্ত। এখন আর চিন্তা নেই। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, সে কী অদ্ভুত শিক্ষাপদ্ধতি। এমনটি কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে? কালে কালে এঁরা যে এক একজন মস্ত বীর হবে সে ব্যপারে সন্দেহের কোনও কারণ নেই। ভীষ্ম পরিতৃপ্ত। কোষাগারে আদেশ দিয়ে দ্রোণাচার্যের মাসিক বৃত্তি আরও বাড়িয়ে দিলেন। প্রাসাদ, দাস দাসী স্বর্ণরথ, কোনও কিছুর অভাব যেন না থাকে। আচার্যের একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামা, সেও যেন সমান আদর পায়। গুরু হলেন দ্বিতীয় পিতা। তাঁকে যত্নে রাখলে শিক্ষার মান উঁচু হবে। অচিরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল দ্রোণাচার্যের বিদ্যালয়ের সুখ্যাতি। বৃষ্ণি অন্ধক প্রভৃতি নানা রাজ্যের রাজপুত্রের দল অস্ত্র শিক্ষার জন্য।
দ্রোণ নিজেও কোনও ত্রুটি রাখলেন না। সমস্ত ছাত্রদের নিজ পুত্রসম দৃষ্টিতে দেখলেও, ছাত্র নিয়োগে বেশ খুঁতখুঁতে তিনি। রীতিমত পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথমিক ভিত কতটুকু আছে, শারীরিকভাবে কতখানি সক্ষম, এগুলি সমস্ত বিবেচ্য বিষয়। এমনিতে বিদ্যালয় সম্পূর্ণ অবৈতনিক। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যয়ভার গ্রহণ করে রাষ্ট্র। তবে, এক্ষেত্রে যেহেতু সকলে রাজপুত্র আর ধনী বংশের সন্তান, তাদের কাছে অর্থ কোনও সমস্যা নয়। বিলাসবহুল জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত
এঁদের প্রত্যেকের আছে নিজস্ব রথ, দাস-দাসী, প্রশিক্ষণ শেষে আরামদায়ক কক্ষ। আচার্য দ্রোণ নিজে ব্রাহ্মণ হলেও, স্বভাব-ধর্ম ক্ষত্রিয়ের মত। তাঁর বিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে অস্ত্র এবং শস্ত্র শিক্ষার স্থান। অস্ত্র হল যা নিক্ষেপ করে আঘাত করা হয় যেমন, বাণ বল্লম ভল্ল ইত্যাদি। শস্ত্র হল, যা হাতে ধরে আঘাত করতে হয়। অসি, গদা, খড়্গ ইত্যাদি। বিশাল বিরাট বিদ্যালয় জুড়ে ধনুকের কেরামতি, গদা নিয়ে চলছে তুমুল ঠোকাঠুকি, অসি ঝনঝন, ঝলসে ওঠা ভল্ল নিয়ে সে এক মহা তুলকালাম ব্যাপার। সে বিদ্যালয়ের যেমন শৃঙ্খলা, তেমনি উঁচুমাপের কলা-কৌশল। ওখানে যে শিখবে ভবিষ্যতে বড় যোদ্ধা হবেই হবে, এমন বিশ্বাস ছড়িয়ে ছিল চরাচর জুড়ে। এই সমস্ত কিছুর কৃতিত্ব একটা মানুষের। তিনি হলেন আচার্য দ্রোণ। অথচ, তাঁর মনে সুখ নেই।
সফল মানুষের অতীতে হেরে যাওয়ার গল্প থাকতেই হবে। না হলে জীবন বর্ণময় হবে কেন? সার্থক সফল ধনী গুরুদেবের ভিতরে এমন এক সর্বহারা অপমানিত মানুষ বসে আছে, যিনি রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে কাঁদেন! মনে পড়ে, মনে পড়ে… ভুলতে পারেন না, দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন একসময়। এখনকার শক্তিশালী ধনবতী রাজ্য পাঞ্চালের অধিপতি দ্রুপদ ছিল বাল্যবন্ধু। গুরু-আশ্রমে বিদ্যাশিক্ষা নিতে নিতে রাজার ছেলে দরিদ্র বন্ধুকে স্বপ্ন দেখাত আমি যখন রাজা হব, তোমায় দেব অর্ধেক রাজত্ব। তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে।
হায় দ্রোণ! কিশোর বয়েসের আবেগে কত কীই বলে মানুষ। পরিপক্ক বুদ্ধিতে সেগুলি মনে হয় হাস্যকর। দ্রুপদ তখন কিশোর রাজপুত্র। গুরু-আশ্রমে শিক্ষা গ্রহণকালে ধনী-দরিদ্র পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠত সহজে। সরোবরে স্নানের সময় ডুবন্ত দ্রুপদ প্রাণে বেঁচে গেল দ্রোণের সাহায্যে।
সেইসময় বলে ফেলা একটা কথার উপর নির্ভর করে রাজ্যসভায় এসে উপস্থিত হবে দ্রোণ, পরণে শতছিন্ন বস্ত্র, মলিন চেহারা, হাত ধরে আছে উপোসী কিশোর, ধূলি ধূসরিত চরণ, কতদিন ভালো করে স্নান পর্যন্ত করেনি কে জানে! এমন একজন মানুষ, রাজ সভাকক্ষে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে ‘ওহে দ্রুপদ, এই দেখো, আমি… আমি দ্রোণাচার্য, তোমার বন্ধু।’
‘কী বলছে এই অর্বাচীন ব্রাহ্মণ! কে অনুমতি দিল ওদের রাজসভায় প্রবেশের?’
ছুটে এলো ভীত দ্বাররক্ষী ‘দোষ নেই প্রভো। উনি নিজেকে আপনার পরিচিত বলেছিলেন।’
‘কেন হে নির্বোধ! রাজা সমান স্তরের লোক ছাড়া বন্ধু হয় না, জানো না! এইরকম একজন ব্যক্তি আমার বন্ধু, ভাবলে কী করে?’
এতক্ষণ পুত্র অশ্বত্থামার হাত ধরে চকমক ঝকমক রাজসভার মাঝে বুক টান করে দাঁড়িয়েছিলেন দ্রোণ, পুত্র দেখুক, তার পিতা কত উঁচুদরের লোক। অশ্বত্থামা দারিদ্র্য ছাড়া আর কিছু দেখেনি। জন্ম থেকে কিশোর বয়স অবধি ভালো করে খাওয়া জোটেনি তার। অসহায় পিতা আজ বাধ্য হয়ে এসেছেন বাল্যবন্ধুর কাছে। দ্রুপদ সেদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তাঁকে। অশ্বত্থামা করুণ গলায় বলেছিল ‘চলে আসুন পিতা। চলুন।’
উফফ! সে অপমান তিনি ভুলতে পারেন না। প্রতিশোধ নেবেন। চরম প্রতিশোধ। তৈরি করছেন শিষ্যদের। এঁরাই অস্ত্র তাঁর। বেশি ভরসা করেন অর্জুনের উপর। দ্রুপদরাজার অহঙ্কারী মাথা নিচু করতে পারবে একমাত্র অর্জুন।
সকলেই মনোযোগ দিয়ে শিখছে। আচার্যর নজর কড়া। একটু এদিক ওদিক হলেই তিনি সেই একই কৌশল দশবার বেশি করিয়ে ছাড়বেন। তবে, অর্জুনের কথা আলাদা। যে নিজের থেকেই বারবার কৌশল শিখতে চায়। কিছুতেই তৃপ্তি নেই তার। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করবে, পাঠ শেষ হলে।
সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করে, একমাত্র তৃতীয় পান্ডব অর্জুন, দূরে দাঁড়িয়ে একমনে তির ছুঁড়ে অভ্যাস করে। কখনও বসে কখনও এক পা উঁচুতে তুলে, কখনও গাছের উপর উঠে অভ্যাস করেই চলে। শেখার প্রবল ক্ষুধা। পুত্র অশ্বত্থামার মধ্যেও এমন নেই। প্রতিভার সঙ্গে চাই অভ্যাস আর অনলস পরিশ্রম। সেটা তাঁর নিজের পুত্রের নেই। তৃতীয়পান্ডব অর্জুনের মধ্যে হিংস্র এক ক্ষুধাবোধ লক্ষ্য করেন আচার্য। কেউ যেন অর্জুনকে ছাপিয়ে না যেতে পারে! ভবিষ্যতের সফল যোদ্ধার চরিত্রে এতখানি আগ্রাসী মনোভাব থাকতেই হবে কি? শিক্ষক মন যেন সায় দিতে পারে না।
বনগ্রাম থেকে হস্তিনাপুরের দূরত্ব বেশি নয়। যত কাছে আসছে, ততো অবাক হচ্ছে একলব্য। গাছ গাছালি এমন সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা যায়? পথঘাট এমন চকচক করছে মুখ দেখা যায়। ঘোড়ায় টানা রথ যাচ্ছে। হাতির উপর বসে আছে মানুষ। আহা! বনের স্বাধীন জীব! এমন করে মানুষের প্রভুত্ব মেনে নিয়ে কাজ করছে? রাস্তার দুইধারে বিপণী। আলো ঝলমল করছে। নারী-পুরুষের রঙ বেরঙের পোশাকের বাহার দেখে চোখে ঘোর লাগে। এরা কি সকলেই রাজপুত্র আর রাজকন্যা?
শুনে হেসে উঠে সুষেণ বলে ‘আরে না না। দেশের সাধারণ মানুষ সব। রাজপুত্তুর দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না।’
‘সে কী গো?’
‘আবার কী! তাদের গায়ের রঙ যেমন সোনারবরণ, পোশাক সোনার সুতো দিয়ে তৈরি। আর কত গয়না। পরিপাটি সাজ। কত গন্ধ মাখে জানো? অনেক দূরের দেশ থেকে শরীরে মাখার তেল আসে।’
‘বাপ রে! আমিও তো রাজপুত্তুর। মাটি মেখে নদীতে ডুব, ব্যাস হয়ে গেল।’
‘রাজার ছেলে মাটি মেখে নদীতে স্নান করছে… খিক খিক খিক। দূর, ও সব তোমার জঙ্গলেই মানায়।’
‘আমার কেমন ভয় করছে সুষেণদাদা। রাজপুত্তুরের দল আমার সঙ্গে কথা কইবে তো?’
‘তুমি হলে লড়াকু ছেলে। এখান থেকে শিখে নিষাদ জাতির মাথা উঁচু করবে। আরে, আমাদের দেশের কথা ভাবো। গাছগুলো কম লড়াই করে? একটা পুঁচকে দানা তার থেকে এত্ত বড় গাছ। তবে? তুমিও একদিন সকলের চেয়ে সেরা হবে। কে কী বলল তাতে তোমার কী আসে যায়? ছাতি টান করে দাঁড়াও দেখি।’
‘সুষেণদাদা, তুমি অর্জুনকে দেখেছ?’
‘তেমন করে দেখার সুযোগ তো হয়নি। যখন তখন বাইরে ওনাদের বেরুতে দেওয়া হয় না। বুঝলে কি না? তবে, যখন ধরো, মহাকালের মন্দিরে যাওয়া হয় তখন দু-একবার দেখেছি। সোনার বরণ নধর ছেলেগুলির মধ্যে ও-ই একটু কালোপানা।’
উৎসাহের সঙ্গে একলব্য বলে ‘এই আমার মতো?’
হো হো করে হেসে বলে সুষেণ, ‘আমাদের রঙের মত আমরা ছাড়া আছে কেবল অমাবস্যার রাত।
অর্জুন হল শিবঠাকুরে ফুলের মত। আহা, কী শান্ত মুখ। বড় বড় চক্ষু। মন জুড়ায় যায়।’
‘আর… আর… তির কেমন চালায়? নিশানা কেমন?’
‘ওতো কথা আমি কেমন করে জানব বলো দেখি? তবে, লোকজন এক জায়গায় জড়ো হলে কথা হয় বটে। কৌরব আর পান্ডবদের মধ্যে সদ্ভাব নেই, সে কথাও লোকে বলে। সেই সঙ্গে বলে অর্জুনের নাম। সে নাকি এখনই পৃথিবীর সেরা তিরন্দাজ। দ্রোণাচার্য নিজের ছেলের চাইতে বেশি ভালোবাসেন।’
রাত কত এখন? অর্জুন জানে না। প্রয়োজন নেই জানার। আজ নিশুতি আঁধার। চাঁদের আলো কেন মেঘছেঁড়া আলো পর্যন্ত নেই। আলো থাকলে উদ্দেশ্য সফল হত না।
এদিক ওদিক দেখে চিতাবাঘের মত হাল্কা পায়ে মহলের বাইরে এসে দ্রুত চলতে লাগল লোকালয়ের পিছন দিকে। এত অন্ধকার! তার উপরে প্রহরীর নজর! অবশেষে সে এসে দাঁড়াল একটা টিলার সামনে। ছোট মাঠ। ঝোপ ঝাড়, কিছুই দেখা না গেলেও জায়গাটা যে জঙ্গুলে সেটা বোঝা যাচ্ছে। মানুষজন নেই।
তিরতির জলাশয়। রাতজাগা পাখি আর কিছু ছোটখাটো জানোয়ার জল খেতে আসে। অন্ধকারে জ্বলে সবুজ চোখ। অর্জুন ছোট মত টিলার আড়ালে দাঁড়ায়। চোখের সামনে দুলছে কালো চাদরের মত অন্ধকার। কী মনে হতে ঝোলা থেকে কাপড় বার করে চোখে বেঁধে নিয়ে ধনুক তির হাতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চুপ চারিধার চুপ। সামনে আঁধার। শুনতে হবে। কোথায় কী আছে কান দিয়ে দেখতে হবে। এক অদ্ভুত জগত। মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত শ্রবণ ইন্দ্রিয়। টুল টুল। পা দিল জলে কেউ? টুপ টুপ পাতা ঝরে পড়ল? চকিতে তির ছুঁড়ল অর্জুন। চোখে দেখে নয়, শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করবে সে। এই বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন ইক্ষাকু বংশের রাজা দশরথ, রামচন্দ্র এবং লক্ষণ, সে বিদ্যা শিখতেই হবে। শন-শন-শন-শন। অন্ধকারের মধ্যে এক অতন্দ্র বালক একাকী নিরলস ভাবে বাণ ছুঁড়ে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে। অর্জুন মাথা ঝাঁকায়। আরও অভ্যাস চাই। আরও নিখুঁত হতে হবে। এই চরাচর এই হস্তিনাপুর এই পৃথিবী যেন একযোগে উচ্চারণ করে, অর্জুন অর্জুন অর্জুন।
কখন পিছনে এসে দাঁড়ায় গুরু দ্রোণ। টের পায় না মগ্ন কিশোর। গুরু মুগ্ধ। কে কাকে সৃষ্টি করে? এই শিষ্য নিজেই নিজেকে তৈরি করছে। তিনি নিমিত্ত মাত্র। কার কথা বলবে ইতিহাস? এমন যোগ্য শিষ্যের নামে পরিচিত হলে লজ্জার কী? নরম হাতের স্পর্শ দিলেন পরিশ্রান্ত শিষ্যের পিঠে। চমকে না ওঠে। বিঘ্ন না ঘটে। কোমল স্বরে বললেন, ‘অর্জুন, আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক। আমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করবে তোমার স্বপ্ন আমি।’
‘আপনার স্বপ্ন?’
‘তীব্র অপমানের দীর্ঘ ইতিহাস। পঞ্চাল রাজ দ্রুপদ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তোমার গুরুদেবের সম্মান। আজ বুঝেছি যদি কেউ পারে প্রতিশোধ নিতে তো সে হল একমাত্র তুমি!’
‘আপনি যা চাইবেন যেমন চাইবেন আমি করে দেব।’
‘আমিও পাশে থাকব তোমার। কেউ যেন ছিনিয়ে নিতে না পারে তোমার মাথার মুকুট। কথা দিলাম।’
গুরু-শিষ্যের মধ্যেকার অলিখিত গোপন চুক্তির সাক্ষী রইল অন্ধকার রাত।
মূল নগরী থেকে একটু দূরে একলব্য আর সুষেণ বাসস্থান ঠিক করে নিল। গাছপালা বেশ ঘন। ছায়াঘন নিবিড় ভাব। শহর থেকে দূরে জঙ্গুলে জায়গা। সুষেণ বলল ‘একটু আরাম করে নেওয়া যাক।’
‘আরাম কিসের? আমি এখুনি যেতে চাই শিক্ষাকেন্দ্রে।’
‘শোনো, এত উত্তেজিত হয়ো না। তুমিও তো একজন রাজপুত্তুর। পিতা হিরণ্যধনু কত উপহার দিয়েছেন, সেগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে যেতে হবে তো?’
একলব্য অস্থির। সে জেদি গলায় বলল ‘তুমি এমন কেন করছ গো সুষেণদা? তুমি যদি না যাও, আমি একলা চললাম।’
কিশোরের সরল অবোধ মুখ দেখে মন ভেঙে এলো সুষেনের। একজন নিষাদ বালক তির ধনুক হাতে যাতায়াত করছে দেখলে প্রহরী ধরে নিয়ে যেতে পারে। এখানে পথে ঘাটে স্বজাতীয় লোক
না দেখলে গুপ্তচর, গুপ্তঘাতক সন্দেহ করতেই পারে। হস্তিনাপুর এবং বিদেশের রাজপুত্রের দল অনুশীলন করছে। নিরাপত্তার খাতিরে এই পথ এবং আশেপাশের কিছু জায়গা প্রবল সুরক্ষিত। সতর্ক প্রহরী ঘিরে থাকে চতুর্দিক। আশ্রমের বিশাল ফটক দিয়ে মাছি গলার ক্ষমতা নেই। একমাত্র রাজকুমারদের খাস দাসদাসী থাকে তাদের সঙ্গে। বাইরে অপেক্ষা করে রথ আর সারথি। অনুশীলন শেষ হলে, একে একে রথ এসে দাঁড়ায় ফটকের সামনে। কলকল করতে করতে কুমারদের নিজ নিজ রথে উঠে পড়তে দেখা যায়। সাধ্য কী, এত বুহ্য পার হয়ে আশ্রম বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পৌঁছে যাওয়া? একলব্য ভাবছে, সে ও একজন রাজপুত্র! অরণ্যের রাজপুত্রের মধ্যে কোথায় আছে নাগরিক অহঙ্কার? উতলা বালকের দিকে তাকিয়ে সে আদর মাখানো স্বরে সুষেণ বলে, ‘চিন্তা কোরো না। ঠিক সময় পৌঁছে যাব।’
সুষেণ ঘুমিয়ে পড়েছে। আঁধার ঘরে একলা থম মেরে বসে একলব্য ভাবে, নগরী কত্ত সুন্দর। সে কি তবে এসে পড়ল রূপকথার রাজ্যে? সেই যে গল্প শুনত? রাজকন্যা রাজপুত্তুরের গল্প। সোনা হিরে জহরতের গল্প। স্বপ্ন বেচা-কেনার গল্প। তার অরণ্য এমন নয়। সেখানে রাতের বেলা আলো পোকা টুকটুক, ঝিলমিল পাতায় শিরশির বাতাস, চিকচিক নদী জল। সেখানে মানুষ মিশে থাকে অরণ্যের সঙ্গে। ভয় পায় বাইরে যেতে। নাহ! একলব্যর মনের আকাশে উড়ে বেড়ায় বিশ্বাস পাখি। কত সাধ মনে। শিখতে হবে। বাণ মারলেই ঝরে পড়বে বৃষ্টি। জ্বলে উঠবে আগুন। এক বাণ হতে বেরিয়ে আসবে হাজার হাজার বাণ। এ বড় কঠিন শিক্ষা! অরণ্যে পড়ে থাকলে কে শেখাবে তাকে? একদিন দেখবে সবাই, শহরের ছেলেদের মত ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে একলব্য। জয় জয় করবে সবাই। নৈষদ একলব্যের জয়, নৈষদ একলব্যের জয়!
উত্তেজিত একলব্য উঠে দাঁড়ায়। সাগর গর্জন আছড়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে। কাছে এসে এইভাবে চুপ করে থাকা? ইচ্ছে করছে, ধনুক দিয়ে ধাক্কা মারে একটা! ঘুমোবে যদি তবে অরণ্যের তেঁতুল গাছের মাথায় উঠে ঘুমোলে না কেন?
একলব্য বুঝে পায় না, এত ভয় কেন পায় সুষেন?
যাবে রাতের অন্ধকারে। অন্ধকারে দেখতে পায় বনের জীব। শুনতে পায় স্পষ্ট। অসুবিধা কিসের?
সুষেণ যেন শুনতে পেল একলব্যের মনের কথা। ঘুমের মধ্যেই জড়িয়ে জড়িয়ে বলল ‘মশাল জ্বলে। চাঁদের আলো আছে। সবাই দেখে নেবে।’
‘গাছের উপর দিয়ে যাব। আমাদের পা বিড়ালের মত। শব্দ নেই।’
‘তারপর? সারারাত ওখানে থাকবে?’
‘তাই থাকব।’ জেদী গলায় বলে একলব্য, ‘তুমি এমন কেন করছ বলো তো? যেন ইচ্ছেটাই নেই, আমি ওখানে যাই?’
‘এতদূর এসেছি বাপু, ইচ্ছে না থাকলে হতো? তবে নগরের কূট কচালি তুমি বুঝবে না, মনে যদি কষ্ট পাও, তাই এট্টু বুঝে শুনে পা ফেলছি আর কী!’
‘কষ্ট পাই আর যাই পাই, গুরু আমার উনিই হবেন। আচার্য দ্রোণ। এ আমার প্রতিজ্ঞা।’
‘ওরে বাবা। তাই হবে। দু’দিন পরে অমাবস্যা। সেদিন যাব। সারারাত থাকব। পরের দিন আচার্যের হাতে তোমায় সঁপে দিয়ে আমি ফিরে আসব। খুশি?’
‘এই দুদিন কী করব তবে?’
‘নগর দেখবে। ভালো মন্দ খাবে। আর কী করবে?’
একলব্য উত্তর দিল না। দুটি দিন! হে বোঙ্গাদেবতা! সব যেন ঠিক থাকে।
কিশোর ছেলের আকুল প্রার্থনা বাতাসে মিশে মিশে দীর্ঘশ্বাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কোথায় কোন অজানা শক্তির দিকে।
অর্জুন রাতে কম ঘুমোয়। কম বললে ভুল হবে জেগে থাকে বেশির ভাগ রাত। রাতের নির্জন অবসরে ধ্যান করে সে। মনের নিবিড় অনুশীলন যাকে বলে। নিজেই খুঁজে খুঁজে বার করে নিজের ত্রুটি। শান্ত হয়ে মনঃসংযোগ জোরালো করে প্রশ্ন করে নিজেকে। কেন কেন কেন? কেন তির আজ লক্ষ্যর বাইরে এলো? কেন? আবার, দশনম্বর তির সোজা গিয়ে ঠিক জায়গায় বিঁধে গেল, কেন? সে চেয়েছিল একটু বাইরে পড়ুক। যুদ্ধকালে, গুরুজন যোদ্ধাদের প্রণাম জানাতে হয়। সে বাণ এমন করে ছুঁড়তে হবে যেন প্রতিপক্ষের কান ঘেঁসে মাটিতে পায়ের কাছে পড়ে। উফফ। সেটা হল না! বাঘের মত জ্বলছে তার চোখ। দুইহাত পিছনে রেখে হেঁটে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবছে, ত্রুটি কেন হবে? ত্রুটির ফাঁক ধরে কেউ যদি নিখুঁত হয়ে ওঠে তার চাইতে? তেমন ঘটনা কিছুতেই ঘটতে দেবে না সে।
এই কিছুদিন আগেই কর্ণ এসেছিল, গুরুদেব পর্যন্ত স্বীকার করছিলেন প্রতিভা আছে বটে! অর্জুনের ভালো লাগেনি এই প্রশংসা। কোথাকার কে এক সারথির ছেলে! গুরুদেব যখন তখন যাকে ইচ্ছে মাথায় তুলবেন, এ কি সহ্য করা যায়? ভ্রুকুটি জেগে ওঠা ললাট গোপন করে নত মুখে চেয়ে ছিল বটে, তবে বিরক্তি প্রকট হয়েছিল শরীরের ভাষায়! দিন কয়েক পরেই শোনা গেল চলে গেছে কর্ণ। যেতে বাধ্য করা হয়েছে। করেছেন গুরুদেব নিজে। অর্জুন চুপ করে ছিল। কর্ণ আর তার মধ্যে কোনও বাক্যালাপ ছিল না। অর্জুন সাধারণত নির্জন স্থানে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন করে, চলন্ত রথের উপর থেকে তির চালায়, ঝড় উঠলে বৃষ্টি পড়লে, আরও বেশি করে কাজ করে। কিছুতেই যেন হাত সরে না যায়, কেঁপে না যায়। অদ্ভুত লাগে, যখন দেখে ছায়ার মত অনুসরণ করে ঠিক ওই কাজগুলোই করছে কর্ণ। বিরক্তি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চলে গেছে কর্ণ। নাহ! অনুশোচনা কাজ করে না। অনুতাপ হয় না। সে কী করবে? সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গুরুদেব।
আড়ালে কানাকানি হয়, গুরুপুত্র অশ্বত্থামার প্রতিভা কয়েক গুণ বেশি অর্জুনের চাইতে। কিন্তু, সে প্রতিভা বিকশিত হতে পারেনি। অশ্বত্থামা ইদানিং মানসিক চাপ নিতে পারে না, ধনুর্ধর হিসেবে তার গুরুত্ব অর্জুনের নামের অনেক পরে। সে জন্যে অনেকটা দায়ী অর্জুনের আগ্রাসী মনোভাব।
এমত কথার বিষ স্পর্শ করে না অর্জুন হৃদয়। সে একমনে নিজের কাজ করে যায়। শ্রেষ্ঠ হতে চাইলেই হতে পারা যায় না। শন-শন-শন… দিনে রাতে শুতে জাগতে… কানে চলন্ত তিরের শব্দ শুনতে পায় অর্জুন। উদ্যম উৎসাহ আত্মবিশ্বাস আর সেইসঙ্গে অনুমান ইন্দ্রিয় নিশানায় খুব প্রয়োজনীয়। হাজার প্রশিক্ষণ থাকুক, যদি অনুমান শক্তি নির্ভুল না হয় তবে পতন অথবা পরাজয় অনিবার্য।
আগামী পরশু তাদের বাৎসরিক পরীক্ষা। গুরুদেব বলেছেন যে, প্রত্যেক বিভাগের সকলকে নিয়ে একসঙ্গে একটা পরীক্ষা হবে। সেখান থেকে স্থির হবে কৌরব-পান্ডব মিলিয়ে কে শ্রেষ্ঠ? একজনকে দেওয়া হবে এই খেতাব। দেখা যাক! আগামী পরশু, আরও দুই দিন বাকি। দেখা যাক!
মুষ্টিবদ্ধ দুইহাত উপরে তুলে যেন নিজেকেই শোনায়, আমি শ্রেষ্ঠ। আমিই শ্রেষ্ঠ।
আশ্রম জুড়ে সাজো সাজো রব। চাপা অস্থিরতা। অবশেষে এসেছে সেই মহাক্ষণ। পরীক্ষা। দ্রোণাচার্য এমনিতেই গম্ভীর, আজ একেবারে ভীষণ রাশভারি ভাব ধারণ করে এদিক-ওদিক করছেন। পরীক্ষা ঠিক কী রকম হবে, আভাসটুকু পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। পান্ডব ভাইদের দেখলে মনে হচ্ছে কোনও চাপ নেই, প্রকৃতপক্ষে মনের মধ্যে উত্তাল ভয়। সম্মান থাকলে হয়! দুর্যোধনরা
একশত ভাইয়ের অবশ্য কোনও বিকার নেই। তারা বরং হইহই করে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৃতকার্য হোক বা না হোক তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। অর্জুন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে। একটু উদাসীন ভঙ্গি। যেন শরীর এখানে আছে মন অন্য কোথাও। কারো সঙ্গে কথা নেই একটাও। এমন একটা সময়ে তুরী ভেরি দামামা বেজে উঠল। পরীক্ষা শুরু।
দ্রোণাচার্য বললেন ‘তোমরা প্রস্তুত?’
‘অবশ্য গুরুদেব!’
‘আজকে পরীক্ষার কথা শোনো।’
‘ওই দেখো, ওই দূরে গাছের উপর এক কাঠের পাখি। ওই পাখির চোখ বিদ্ধ করতে হবে একবারে।’
শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই। এ তো একেবারে সো-জা। কোথায় পাখি? কোথায় পাখি? চলো চলো। ঝপাঝপ যাই আর টপাটপ মেরে আসি। কাঠের পাখি! যে না কি উড়বে না ছটফট করবে না, তার চোখ! দূর দূর। এ একটা পরীক্ষা হল? যুধিষ্ঠিরের মুখে হাসি, দুর্যোধন তো এমন ভাব করছে, যেন আজ প্রথম পুরস্কার ওর ভাগ্যে। হেলদোল নেই কেবল অর্জুনের। চুপচাপ তাকিয়ে
আছে পাখিটার দিকে।
দ্রোণাচার্য বললেন, ‘হে ধর্মপুত্র। এসো, তুমি প্রথম সুযোগ নাও। আচ্ছা বলো, কী দেখছ তুমি?’
যুধিষ্ঠির হাসি মুখে বললে, ‘আজ্ঞে আমি গাছপালা ভাইদের… এগুলি ছাড়াও আরো কত কীই দেখতে পাচ্ছি।’
‘বেশ করেছ। পরীক্ষা দিয়ে কাজ নেই। যাও, পিছনে গিয়ে বসো।’
এ তো মহা মুশকিল! গাছের উঁচু ডালে পাখি বসে আছে, খচ করে একটা তির ফুটিয়ে দিতে হবে। এর মধ্যে আবার দেখাদেখির হল কী?
ব্যাপার কিছু বোঝা গেল না। আচার্য এদিকে একজন একজন করে ডাকছেন আর ওই এক প্রশ্ন করছেন। কী দেখছ আর কী দেখছ? দুর্যোধন আবার জুড়েছিল পরিচারকদের নাম, এমন ধমক খেল যে সে রাগের চোটে কী করবে ভেবে পায় না। ভীম পুরো তুতলে গেল। যাই বলছে তাতেই যদি ধমক খেতে হয় তবে সঠিক উত্তর ঠিক কী? কী হবে সঠিক উত্তর?
সকলের শেষে এলো অর্জুন। চারিদিকে অকৃতকার্য ছাত্রদের অসন্তোষ গুঞ্জন, সূর্যদেব মাথার উপর। অর্জুন এসে দাঁড়াল। দ্রোণ বললেন ‘আকাশ বাতাস জল গাছ পাতা… কাকে কাকে দেখতে পাচ্ছ বলো তো?’
‘না গুরুদেব। আমি শুধু পাখিটা দেখছি।’
‘সে কী! এত বড় আশ্রম। আর কিছু দেখছ না?’
‘নাহ।’
‘তা, পুরো পাখিটা দেখছ তো?’
‘না গুরুদেব। শুধু মাথা। পাখির মাথা।
যতক্ষণ কথা চলছে, অর্জুনের ধনুক আর তির সোজা উপরের দিকে তাক করা। চোখের পলক পড়ছে না। মুখ উত্তর দিচ্ছে কেবল।
সে কী টানটান উত্তেজনা! দ্রোণ চিৎকার করে আদেশ দিলেন ‘শর ত্যাগ করো।’
মুহূর্তমধ্যে পাখির মাথা নিচে পড়ে থাকতে দেখা গেল। চারিদিক হতে ছুটে এলো সবাই। অর্জুন অর্জুন। দ্রোণ নিজেও আপ্লুত। এত নিখুঁত এত নিপুণ! এতটা তিনিও আশা করেননি। বেশ ভালো লাগছে অর্জুনের। সফলতার আলো ছড়িয়ে পড়ছে মুখে। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে অন্তর না থাকলে এমন আলো ফুটে ওঠে।
আলিঙ্গন উচ্ছ্বাস সবকিছুর মাঝখানে প্রহরীদের উত্তেজিত গলা শোনা গেল। তারা ধরে এনেছে একলব্য আর সুষেণকে। এলোঝেলো চুল, মলিন বসন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দুটি মূর্তিমান দেখে কৌতুক অনুভব করল রাজকুমারের দল। অবাক হবার মতই ঘটনা। কিশোর ছেলের হাতে আবার তির-ধনুক! এরা ঢুকল কোথা হতে? দ্রোণাচার্য বেশ অবাক। এরকম একটা অভিজাত জায়গায় এইভাবে দুজন বহিরাগত ঢুকে পড়ল? কোমরে হাত রেখে কড়া গলায় বললেন ‘কে হে তোমরা? এখানে কী মনে করে?’
সুষেণ জোড়হাত। নত মস্তক। একলব্যকে ঠেলা মেরে বলল ‘পেন্নাম কর।’
একলব্য অবাক হয়ে দেখছিল। এই তিনি! গুরুদেব! এমন সুন্দর? সাদা সাদা ফুল ফুটে থাকে অরণ্যে তাদের পাঁপড়ি যেন ছড়িয়ে আছে শরীরে। চোখ বুজে শ্বাস নিলে চন্দনের গন্ধ। চোখদুটো থেকে ঝরে পড়ছে দুধের মত স্নেহ। একলব্যের ভূতের মত দশা দেখে সুষেণ গড়গড় করে বলল, ‘গুরুদেব, এ হল একলব্য। বনগ্রামের রাজা নিষাদপতি হিরণ্যধনুর একটামাত্তর ছেলে। খুব ভালো তির ছোঁড়ে। আপনি এট্টু শেখাবেন? দয়া করবেন?’
‘আমার কাছে শিখবে?’
‘আপনি রাজপুত্তুরদের শেখান যেখানে, একলব্য নিজেও রাজপুত্তুর।’
জোর হররা উঠল হাসির। পরীক্ষার উদ্বেগ যেটুকু ছিল এখন কেটে গেছে এই নতুন আমোদে। রাজপুত্তুর দেখে হাসি আর থামে না। দ্রোণ ধমক দিলেন ‘এই চুপ করো সকলে।’
ধমক দিলেন বটে কিন্তু কোথাও যেন ছুঁয়ে রইল মৃদু কৌতুক। তিনি তাকালেন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের দিকে। হিরণ্যধনু পরিচিত নাম। তাঁর পুত্র? বিদ্যাদান করা গুরুর ধর্ম। সে ধর্ম পালন করা যেতেই পারে। যেতে পারে কিন্তু যাবে না। অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এই ছেলে চরম বেমানান। কেউ সহ্য করবে না! তিনি গুরু কিন্তু পরাধীন। পরাধীন মানুষ যা করে তিনিও তাই করতে বাধ্য হলেন। ফিরিয়ে দিলেন উৎসুক দুটি চোখের প্রার্থনা।
‘যোগ্য না অযোগ্য সে বিচার পরে। তুমি মাননসই হবে না এদের সঙ্গে।’
হাহাকার করে উঠল সুষেণ ‘এ কী কথা গুরুদেব? আমাদের ছেলেটারে পরখ করুন একবার।
বুক বাজিয়ে বলছি এখানে যত্তগুলান আছে, একলব্য সবার সেরা।’
‘চুপ করো মূর্খ। অরণ্যের রাজা! এটা একটা পরিচয় হল? আছে নিজের রথ? আছে প্রাসাদ? আছে কোনও রাষ্ট্রের কোনও উঁচু মন্ত্রী অথবা সেনাপতির পদ? চলন-বলনে আছে কোনো অভিজাত ছোঁয়া? চলে এসেছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হতে!’
সুষেণের চোখ ফেটে জল আসছিল। এটাই স্বাভাবিক। এটাই কথা ছিল, তবু কোথায় যেন একটু আশাও ছিল। এখন সে করে কী? কীভাবে ছেলেটাকে নিয়ে ফিরে যাবে অরণ্যে? সে বলল ‘চল রে বাবু, ফিরে যাই আমরা।’
‘দাঁড়াও দাদা। গুরুদেবের পায়ে একটা পেন্নাম করি।’
‘গুরুদেব? কে গুরুদেব?’
‘আচার্য দ্রোণ। উনি আমায় ফিরিয়ে দিলেন তো কী হল? শিষ্য হবার অধিকার কেড়ে নিতে পারবেন না।’
কুরু-পান্ডব রাজপুত্রের দল ঠিক করল একদিন শিকারে যাবে। দূরে নয়। কাছেই জঙ্গল আছে একটা। ভীষ্ম উদার অনুমতি দিলেন। যাক, ঘুরে আসুক। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। যোগ্য হয়ে উঠছে সব। ঘুরে ফিরে নিক। তারপর তো আবার দায়িত্ব নিতে হবে রাজ্যের।
পান্ডব-কৌরবদের দল জঙ্গলে পৌঁছে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সঙ্গে আছে শিক্ষিত সারমেয়। সে নিজের মত ছুটে বেড়াতে লাগল। বেশ একটা বনভোজনের মত ভাব।
হঠাৎ যুধিষ্ঠির বলল–আরে, আমাদের সারমেয় ডাকছে না! কী ব্যাপার?’
সত্যি তো। গেল কোথায়? এতক্ষণ ভৌ ভৌ করে অস্থির করে তুলছিল অনন্দে। পাখি থেকে শুরু করে যাই দেখে তেড়ে যাচ্ছিল। শিক্ষিত সারমেয়। শিস দিলেই চলে আসবে ভেবে দুর্যোধন শিস দিতে লাগল। অন্ধকার হয়ে আসছে। বাড়ি ফেরা দরকার। কিছুক্ষণ পরেই ছুটে ছুটে আসতে দেখা গেল বাঘের মত তেজিয়ান শিকারি কুকুরটিকে। ছুটেই আসছে অথচ মুখ বন্ধ! মুখ সেলাই হয়ে রয়েছে সরু সুতোর মত সাতটি তির দিয়ে! একে বলে শব্দহরণ বাণ। যে কোনও জীবের স্বরনির্গমনের দ্বারে এই সপ্ততির নিক্ষিপ্ত হলে, সেই প্রাণীর সপ্তস্বর সাময়িকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। অদ্ভুত এই তীরন্দাজী। শরশাস্ত্র সম্পর্কে বিদ্বান না হলে এমন সূক্ষ্ম কৌশল জানা সম্ভব নয়।
তির দিয়ে কুকুরের মুখ সেলাই!
কৌরব-পাণ্ডবের বিস্ফারিত চক্ষু। অর্জুন নিজেও ভযঙ্কর অবাক। এমন অনুন্নত জায়গা সেখানে এত উন্নত মানের শর-চালনা? কে করল কে? সারমেয়টি প্রাণপণে লেজ নাড়ছে। সে ফিরে যেতে চায় ওই জায়গায়। প্রভুদের দেখাতে চায়। ইশারা করা মাত্র সে ছুটতে লাগল নির্দিষ্ট দিকে, পিছনে রাজপুত্রের দল। কোথায় নিয়ে যাবে? কোন রহস্যের দিকে?
নির্জন বনের মধ্যে নিকষ কালো একটি ছেলে, সারা গায়ে ধুলো-মাটি, জট পাকানো চুল, পরনে এক টুকরো মৃগ চর্ম, হাতের ধনুক-বাণ না থাকলে মনে হত গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মানুষরূপী গাছ। সারমেয় এসে থেমে গেল সেখানে। অবাক রাজপুত্রের দল দেখল, কাদা মাটি দিয়ে তৈরি আচার্য দ্রোণের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটি বিরামহীন অস্ত্র অভ্যাস করে চলেছে। নিজেকে ধমক দিচ্ছে আবার ঠিক করছে। কোনও বাণ ঘুরে যাচ্ছে চক্রের মত, উড়ে যাচ্ছে আকাশে আবার ফিরে আসছে ছেলেটির হাতে। ভীমের মত সরলমতি বালক পর্যন্ত বলে বসল ‘এ কে? গুরু দ্রোণের শিষ্য না কি? অর্জুনের কৌশলও তো এত নিপুণ নয়। কী বলো?’
দুর্যোধন আনন্দে হাততালি দিয়ে বলে উঠল ‘আরে, এ তো সেই ছেলেটা! গুরুদেব যাকে তাড়িয়ে দিলেন। আবার গোপনে এসে শিখিয়ে যাচ্ছেন না কি? জিজ্ঞেস করো দেখি।’
এত হইচই হচ্ছে, ছেলেটা ফিরেও তাকাচ্ছে না। যুধিষ্ঠির যখন একান্ত কাছে গিয়ে প্রশ্ন করল, তখন সে এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করল অভ্যাস। কেমন আনমনে উত্তর দিল, ‘আমি নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য। আচার্য দ্রোণ আমার গুরু। আপনাদের কুকুরটি ভারি বিরক্ত করছিল তাই বন্ধ করে দিয়েছি মুখ। দাঁড়ান, খুলে দিচ্ছি।’
যেন কোনও নায়ক, যেন কোনও দৃপ্ত যোদ্ধা এমন ভঙ্গিতে ছেলেটি এগিয়ে এসে অবহেলা আর অনায়াস ভঙ্গিতে মুক্ত করে দিল সারমেয়র মুখ। তারপর ফিরে গেল আপন অভ্যাসে। অবাক হতবাক রাজপুত্রের দল। এমন তারা কখনও দেখেনি। দুর্যোধন আবার বলে উঠল ‘যাই বলো, অর্জুনের শিক্ষা এর কাছে তুচ্ছ।’
কেউ প্রতিবাদ করল না এই উক্তির। বনভূমি জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে না কি অর্জুনের মনের আকাশে ছেয়ে গেছে কালো অন্ধকার! আকাশ বাতাস চরাচর জুড়ে প্রতিধ্বনি বেজে উঠছে, তুচ্ছ অর্জুন তুচ্ছ! এই সামান্য নিষাদ বালক, অর্জুন তার কাছে তুচ্ছ!
মাথার মধ্যে দুমদুম শব্দ হচ্ছিল অর্জুনের। একশত ঘোড়া যেন দৌড়ে যাচ্ছে। এত অপমান এমন নিরাপত্তাহীনতা জীবনে বোধ করেনি অর্জুন। কোনওমতে বাড়ি ফিরে স্বভাববিরুদ্ধভাবে ফেটে পড়েছিল গুরুদেবের উপর। ‘কেন? কেন? কেন? কেন এমন প্রতারণা?’
‘কিসের প্রতারণা? অর্জুন, তুমি ছাড়া বিশেষ প্রশিক্ষণ কেউ কখনও পায়নি।’
‘গুরুদেব। এমন কৌশল কোনও সাধারণ অরণ্যে শেখানো হয় না। বিশেষ বিদ্যালয় বিশেষ শিক্ষক ছাড়া এমন অসম্ভব বিদ্যা অর্জন করা যাবে না।’
‘অর্জুন, তুমি অকারণ উত্তেজিত হয়ে উঠছ!’
‘অকারণ? দিন-রাত পরিশ্রম করেছি, এতটুকু বিশ্রাম করিনি, যা বলেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি নিংড়ে দিয়েছি নিজেকে। আর… গুরুদেব! ভুলে গেলেন সেই শর্ত?’
দ্রোণাচার্য বললেন ‘কিছু ভুলিনি।’
বিষ গলায় অর্জুন বলে ‘আপনি কথা রাখেননি। গোপনে শিক্ষা দিয়েছেন ওই নিষাদ বালক
একলব্যকে।’
‘না অর্জুন, না। এমন কাজ করিনি আমি। চলো তুমি সেখানে, আমি প্রমাণ করে দেব।’
‘ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন গুরুদেব। তবে, আমি শ্রেষ্ঠ হব এটাই শর্ত ছিল! শর্ত রক্ষা করতে আপনাকে হবেই।’
অপমান অথবা হুমকি নিঃশব্দে হজম করে আচার্য চললেন বনের গভীরে।
রাজপুত্রের দল এসে বিরক্ত করে গেল একটু, একলব্য আবার ফিরে এলো সাধনায়। লাগাতার তির ছুঁড়েই চলেছে। কঠিন থেকে কঠিন লক্ষ্য স্থির করছে। সামনে অনেক কাজ। শর চালনায় সফল হতেই হবে তাকে। সামনে গুরুর মূর্তি হাসি মুখে আশীর্বাদ করছেন। হাতজোড় করে চোখ বন্ধ করে প্রণাম করতেই শুনল কে যেন ডাকছে ‘বৎস একলব্য।’
এ কী! এ যে স্বয়ং গুরুদেব! এখন সে কী করে? কী করে আপ্যায়ণ করবে সে গুরুকে? সুষেণদাদা কাছে নেই! সে করজোড়ে বসে পড়ল পায়ের কাছে। চোখ ভিজে আসছে। গলা বুজে আসছে। যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ভেসে এলো আরাধ্য দেবতার গলা ‘তুমি এত কৌশল শিখলে কী করে?’
‘আমি কিছুই করিনি গুরুদেব। আপনার মূর্তি সামনে রেখে এক অভ্যাস করে গেছি। আর কৌশল? রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে আপনি নিজে এসে শেখাতেন! বিশ্বাস করুন, মিথ্যে বলতে আমি শিখিনি।’
আচার্য দ্রোণ স্তম্ভিত। অলৌকিক শক্তি এই কিশোরের! স্বপ্নের মধ্যে শিখে নিয়েছে বিদ্যা! একলব্য এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মুখের দিকে। ছেলেটা অনেকদিন ভালো করে স্নান-খাওয়া করেনি। তবে, উজ্জ্বল হীরকখন্ডের দ্যুতি যেমন ধুলোয় ঢাকা পড়ে না, এই ছেলের সমস্ত শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে প্রতিভার আলো। এই আলো পরিণত করতে হবে অন্ধকারে। শিক্ষক আজ হবে ঘাতক! উপায় নেই। উপায় নেই! তিনি পরাধীন। ধনী পরিবারের বেতনভুক দাস মাত্র। ঘাড়ের কাছে ক্রুদ্ধ ফোঁস ফোঁস অনুভব করছেন স্পষ্ট।
একলব্য বলে ‘পদ্মপাতায় কোনও দোষ নাই। আপনি আর অর্জুন দাদা এট্টু মধু খাবেন?’
কোমল গলায় দ্রোণ বললেন ‘মধু আর একদিন খাব। এখন কাজের কথা শোনো।’
একলব্য তাড়াতাড়ি গুছিয়ে বসে। চোখে মুখে আগ্রহ। এসে দেখুক সক্কলে। রাজপুত্তুরদের গুরু নাকি ফিরেও চাইবে না। বললেই হল আর কী!
সে হাসি মুখে বলে, ‘বলুন গুরুদেব। কী আদেশ?’
গলা পরিষ্কার করে দ্রোণ বলেন ‘একলব্য, তুমি শিখলে আমার কাছে কিন্তু গুরুদক্ষিণা তো কই দিলে না?’
‘গুরুদক্ষিণা!’
‘জানো না বুঝি? গুরুকে কিছু দিতে হয় বৎস। না হলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না।’
‘আপনি… আপনি… গুরু দক্ষিণা চাইছেন? তার মানে আপনি স্বীকার করলেন আমি আপনার শিষ্য!’
স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন দ্রোণ। জঙ্গলে বড্ড ধুলো। তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারলে হয়। একলব্য নেচে উঠেছে খুশিতে। বনের গাছপালা হরিণ শিশু শুনে যাও গো শুনে যাও, গুরু আমায় স্বীকার করেছেন। কিন্তু, কী দেব আমি, কী আছে আমার! এই জীবন এই প্রাণ এই শরীর… গুরুদেব, বলুন, কী দেব আপনাকে?’
‘তোমার ডানহাতের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়ে দাও।’
শন শন করে ওঠে গাছ পালা। ভীষণ জোরে ডেকে ওঠে মেঘ। কোথায় যেন একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে পাখি। ওরে ও একলব্য। পালিয়ে আয়। পালিয়ে আয়। ওরে ও একলব্য…!
প্রাণ নয়, শরীর নয়, ডান হাতের বুড়ো আঙুল! ষোলো বছরের ছেলের চোখে পড়ে না কোনও অস্ত্র। এদিক তাকায় ওদিক তাকায়। অর্জুন এগিয়ে দেয় ধারালো ছুরি। আচার্য দ্রোণের শ্বেতপদ্মের মত পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে খসখস কালো চামড়ায় মোড়া রক্তমাখা বুড়ো আঙুল।
কেটে গেছে দীর্ঘ ঋতুকাল। পান্ডব-কৌরব বিবাদ এখন সর্বজনবিদিত। ভযঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হতে চলেছে কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণে। দু-পক্ষেই চলছে সাজো সাজো রব। পান্ডব পক্ষের প্রধান সহায় বুদ্ধিদাতা শ্রীকৃষ্ণ আজ মন্ত্রণাগৃহে উপস্থিত। কিছু জরুরি কথা আলোচনার হবে আজ।
মৃদু হেসে বললেন বাসুদেব কৃষ্ণ, ‘মগধরাজ জরাসন্ধ এবং তাঁর অনুগামীদের যুদ্ধ শুরুর আগেই নিপাত করতে হবে। নতুবা, কৌরব পরাজয় অসম্ভব।’
‘কেন বলো তো বাসুদেব? তুমি আমাদের ক্ষমতায় সন্দেহ করছ?’
‘ভীম! এত লম্ফ ঝম্প করো না। তোমাদের চাইতে অনেক ক্ষমতাবান রাজা হলেন মগধরাজ জরাসন্ধ আর নৈষদরাজ একলব্য। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, জরাসন্ধ এবং তাঁর অনুগামীদের জন্য আমি নিজেও চিন্তিত।’
ভীম বলল ‘বৃথা চিন্তা করছেন কেশব। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর অর্জুন আমাদের সঙ্গে।’
বিচিত্র হাসলেন কৃষ্ণ। কত ধরণের অর্থ লুকিয়ে আছে পুরুষশ্রেষ্ঠর হাসির মধ্যে!
‘তোমরা ভুলে গেছ এই সেই একলব্য, কিশোর বয়সে যাঁর প্রতিভায় ঈর্ষান্বিত ছিল অর্জুন!’
‘কৃষ্ণ!’
‘নির্মমভাবে কেটে দেওয়া হয়েছিল বৃদ্ধাঙ্গুলি। কোনওদিন যেন আর তির চালাতে সমর্থ না হয়! একলব্য অতিক্রম করেছে তাঁর শারীরিক অক্ষমতা। দিনের পর দিন রাত ঝড় জল, ক্ষত বিক্ষত চারটি মাত্র আঙুল দিয়ে অভ্যাস করে করে নিজেকে তুলে নিয়েছে দক্ষতার শিখরে। আজ সে সমর্থ বীর!’
অর্জুন নিরুত্তর রইল। কখনও কখনও নিজেকে অসহায় মনে হয়।
আবারও বিচিত্র হাসলেন বাসুদেব।
‘একলব্য অপ্রতিরোধ্য। পান্ডব এবং আমি দুজনের উপর সাংঘাতিক রাগ তাঁর। যে ভাবেই হোক, দমন করতেই হবে। একলব্য আর অর্জুন মুখোমুখি না হলেই ভালো।’
ছিটকে ওঠে অর্জুন ‘কী বলছ! আমার সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এই মুহুর্তে কার আছে?’
বাসুদেব উত্তর দিলেন না। জ্ঞানীমানুষ অপরিণত অহংকারের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।
গভীর অরণ্যে পথ চলছে একলব্য। আহা। কত মায়া! সবুজ আশ্রয়। কে যেন ডাকে… সুংলি? সুষেণ দাদা? পিতা হিরণ্যধনু? এই তো আমি, তোমাদের কাছেই আসছি। কতদিন ঘুমাইনি ঠিক করে। একটু ঘুমাতে চাই। ছায়া নিবিড় মায়ের কোলে। ও কী! ও কী! ধেয়ে আসে কে? গুরুদেব গুরুদেব… আপনি ধাক্কা দেবেন না গুরুদেব… সামনে খাদ… আমি পড়ে যাব…! আর্তনাদ করে জেগে উঠলেন নৈষদরাজ একলব্য। আবার দুঃস্বপ্ন! রোজ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। আকণ্ঠ পিপাসা। শয্যার পাশে সযতনে রাখা স্বর্ণপাত্র ডান হাতের চারটি আঙুল দিয়ে অপার দক্ষতায় ধরে জল খেলেন। চার আঙুল নিয়েই আজ তিনি বিজয়ী বীর। সফল যোদ্ধা। নিষাদ জাতির মাথা উঁচু করে দিয়েছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছা থাকলে সাফল্য এসে চরণে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য। শুনেছেন, কৃষ্ণ-বলরাম একযোগে আক্রমণ করতে আসছে। কিন্তু, আর যেন ভালো লাগে না।
এই মেকি দুনিয়া এই মিথ্যা আর মেনে নিতে পারছেন না। নির্জন কোনও দ্বীপে নির্বাসনে চলে যেতে চান নৈষদরাজ একলব্য। বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন প্রকৃতির ছায়া নিবিড় আশ্রয়ে। যেখানে কখনও প্রতারিত হতে হবে না। যেখানে এখনও মিথ্যা সফলতার চেয়ে সততা অনেক বেশি গ্রহণীয়। সেখানে তাড়া করবে না প্রতারণা। মিথ্যা। ছলনা।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Valo hoyeche mam. opurbo
Ekta osadhaon golpo porlam