short-story-ekti-mombati

একটি মোমবাতি ও এক পাহাড়ি ঝোরা
শাশ্বতী নন্দী




বিয়াসের সঙ্গে দেখা করেছিলাম একটা ছিমছাম রেস্তোরায়। ও এসেছিল একটা সাদা সালোয়ার কামিজে, লম্বা বিনুনি, বুকের ওপর ফেলা। ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক। একটা শিশির ফোঁটার মতো ছোট্ট স্টোন টিপ দুই ভ্রুর মাঝখানে।

খুব যে অপ্সরা সুন্দরী, তা মোটেও নয় বিয়াস। কিন্তু এক দেখাতে ওকেই পছন্দ করলাম। নদীর নামে নাম মেয়েটির। শুনেই মনে কেমন শান্ত অথচ তিরতিরে স্রোত বইতে লাগল।

ওর দু চোখ ভর্তি মায়া দেখেছিলাম। আর ওই মায়াই আমায় বেঁধে ফেলল। যেই না আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘আমার খুব ইচ্ছে করে, কোনও এক অমাবস্যার রাতে একটা মোমবাতি জ্বেলে একটা পাহাড়ি ঝোরার পাশে বসে থাকব’, ব্যস, আমি ক্লিন বোল্ড। মনে হল, বিয়ে করলে ওকেই করব।

রেস্তোরার ভেতরটা আধো অন্ধকার, হাল্কা মিউজিক চলছে। বিয়াস টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে বার বার। মুখে কী একটা বলি বলি ভাব। তারপর বলেই ফেলল, -আচ্ছা, বাথরুমটা কোন দিকে?

-ওই তো ওই দিকে।

বিয়াস মুচকি হেসে চলে গেল। আমি মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছি। হঠাৎ দেখি ও ফিরে আসছে।

-কী হল, খুঁজে পেলেন না?

বিয়াস হি হি হাসছে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, না পাওয়ার কী আছে। আচ্ছা, তুমি কি এই রেস্টুরেন্টে মাঝে মাঝেই আসো? বেশ সুন্দর ভেতরটা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে’।

একটু অবাক হলাম। হঠাত যেন ওর মুখে কথার তুবড়ি! আর কী সহজেই আপনি থেকে তুমিতে চলে এলো। অবশ্য সুবিধেই হল। আপনি, আজ্ঞেতে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না।

-এই রে, দাঁড়াও, দাঁড়াও, ওয়াশরুমে রুমালটা ফেলে এসেছি। হি হি হি। – বিয়াস আবার হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল ।

কিন্তু ও চলে যেতেই লক্ষ করি, ওই তো রুমাল, টেবিলের কোণায় পড়ে আছে। কিন্তু আমি পেছন থেকে যে ডাকব, তার আগেই মেয়ে ভ্যানিস। কী হড়বড়ে রে বাবা!

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। ওয়েটর খাবারের অর্ডার নিতে এসেছে। বুঝতে পারছি না বিয়াসের কী পছন্দ। কিন্তু এতক্ষণ লাগছে কেন? পেট ফেট বিগড়ালো নাকি? তাই রুমাল আনার ছুতো করে …

ওই তো আসছে এতক্ষণে। সামনে এসে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। ভিতু ভিতু মুখ, ঘামে কপাল চকচকে। হেসে বললাম, ‘কী হল?’

-দরজায় লক লেগে গিয়েছিল জানেন। সে কী গেড়ো। এদিকে মোবাইলও ফেলে গিয়েছি, আপনাকে যে বলব আমার দেরির কারণ – টেবিল থেকে রুমালটা তুলে মুখ মুছল ও। একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে, ‘না পেরে দরাম দরাম ধাক্কা দিলাম দরজায়, সেই শুনেই একজন স্টাফ নানা কসরত করে বাইরে থেকে কীভাবে যেন লক খুলল। এত খারাপ লাগছিল, একা একা বসে আছেন আপনি!’

আবার আপনি! মেয়েটার রঙ ঢঙ দেখছি মুহুর্মুহু পালটায়! মুখের কাছে জলের গ্লাস তুলে আলতো ভাবে বলি, ‘আপনার রুমাল তো টেবিলেই পড়ে ছিল, তড়িঘড়ি ছুটলেন কেন ওটা খুঁজতে?’

-রুমাল খুঁজতে, আমি? না তো। – বিয়াসের কপাল জুড়ে রেখার আঁকিবুঁকি। এমন করে আমার দিকে চেয়ে আছে, এক রাশ সন্দেহ যেন চোখে। আমি চোখ নামিয়ে নিই।

ও ঢকঢক করে জল খেল পুরো এক গ্লাস, একটু যেন অন্যমনস্ক। তারপর বড় করে একটা শ্বাস টেনে আমায় অবাক করে বলে, ‘একটা হাসনুহানা ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন?’

-অ্যাঁ! – আমি চমকে তাকাই। – হাসনুহানা ফুল! তার গন্ধ কেমন আমি জানি না।

-কোনও মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছেন না? – বিয়াসের মধ্যে কেমন অস্থির অস্থির ভাব। – আমি কিন্তু পাচ্ছি।

মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ওয়েটর আবার সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘আপনাদের অর্ডারটা?’

-বলুন কী খাবেন। আরে ছাড়ুন তো, কেউ হয়তো ওই হাসনুহানা ফুলের কোনও পারফিউম লাগিয়ে এসেছে। – মেনু কার্ডটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে।

বিয়াস তখনও অন্যমনস্ক, ‘আচ্ছা, ওই মেয়েটি যে এখানে এসেছিল বললেন, দেখতে কি ঠিক আমার মতো? চুলটা ছোট না এরকমই বিনুনি বাঁধা?

কী জানি। এত আলো কম এখানে, আমি অত লক্ষ করি নি। অর্ডারটা দিয়ে দিন।

বিয়াস হাত থেকে কার্ডটা নেয়, সহজ হবার চেষ্টা করে একটু হাসল, ‘জানেন, আমার মতো দেখতে নাকি আর একটি মেয়েও আছে, হুবহু এক। কে জানে হয়তো সেই এসেছিল, টেবিল ভুল করে এখানে চলে এসেছে। যাই হোক, আমি চাইনিজ ভালবাসি, তবে গ্রেভিওলা নয়, হাক্কা। খেয়েই কিন্তু বাড়ি ছুটব। অনেক বেজে গেছে’।

– ডোন্ট ওরি, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে আমি যাব। এবার কি আমরা একটু ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করতে পারি?

– হ্যাঁ, বলুন না।

কথাবার্তা শুরু হতেই বুঝলাম, মেয়েটা সরল। তবে সব সময় যেন কল্পনার ফানুসে ভেসে বেড়ায়।




কথা ছিল বিয়াসকে বাড়িতে নামিয়েই ফিরে আসব। আটকালেন ওর বাবা। ‘ছিঃ, বাড়ির দোরগোড়ায় এসে, এক কাপ চা অন্তত …

অগত্যা …

ভেতরে ঢুকেই দেখি বেশ ছিমছাম ঘর বাড়ি। দেয়ালে টাঙানো সুন্দর সুন্দর ছবি। আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি। ইতিমধ্যেই চা, সঙ্গে টুকটাক খাবারও এল। বিয়াস মা মরা মেয়ে। সংসারে এক পিসিই মায়ের মতো আগলান। উনিই বললেন কথাটা, ‘জানো, ছবিগুলো সব আমাদের মেয়ের আঁকা। একসময় কত প্রাইজ পেয়েছে’।

-ও বাবা, তাই! কই, এত কথা হল, আঁকার কথা তো ও বলল না।

সবাই চুপ। বিয়াসের বাবার মুখে কষ্ট, ‘কী বলবে? মাথায় পাগলামি, কার ওপরে অভিমান করে যে আঁকা ছাড়ল। দেখো আলমারিতে রঙ, তুলি, কাগজ, সব গুছিয়ে তুলে রেখেছে। বিয়াস, মা, তোর ওই ছবিটা দেখা না? রাজ্যপালের হাত থেকে পুরস্কার পেয়েছিলি যার জন্য?’

বিয়াসের মুখে অনিচ্ছা। তবু বাবার কথা ফেলতে পারল না। উঠে ছবিটা আলমারি থেকে বার করে। সত্যিই দৃষ্টি ফেরানো যায় না। অসাধারণ!

-তোমার পছন্দ? নিয়ে যাও না।

-এমা তা হয় নাকি?

-তুমি নাও, এমন আঁকা ওর আরও আছে। – বিয়াসের বাবা এমন জোর করলেন, না নিয়ে পারলাম না একটা ছবি।

কিন্তু বিয়াসের ব্যাজার মুখ, অনেকখানি অনিচ্ছায় যেন দিল।

যাই হোক, একটা পলি প্যাকে ছবিটা গুছিয়ে গাড়িতে বসলাম। শীতের রাত, ফাঁকা রাস্তা, গাড়ি চালাচ্ছি উড়িয়ে। রাস্তার আলোগুলোর চারপাশে যেন জমাট হলুদ কুয়াশা। হঠাৎ, একী! আমার গাড়ি থেকে কয়েক হাত দূরে একটি মেয়ে! আলুথালু শাড়ি, খোলা চুল। হাত দেখিয়ে গাড়ি থামতে বলছে।

কী ব্যাপার? আমি ধন্দে পড়লাম। গাড়ি থামালে কোনও বিপদে পড়ব না তো? হর্ণ বাজাই, তবু ও সরে না। বরং আরও কাছে চলে আসছে। প্রাণপণে ব্রেক চাপি। ও হাত বাড়িয়ে কী যেন বলতে বলতে ডান দিকে চলে এল। জানলার কাঁচ আগেই তোলা ছিল। মেয়েটি কাঁচের ওপর টোকা দিতে থাকে, হাত বাড়িয়ে কী যেন চাইছে।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েকটা টাকার নোট, জানলা অল্প ফাঁক করে বাড়িয়ে দিলাম। হঠাৎ খিলখিল একটা হাসি। সে হাসছে আর বলছে, ‘টাকা না, টাকা না, ছবি দে’।

আমি ঘামতে শুরু করলাম। কোন ছবি? বিয়াসের আঁকাটা? অসম্ভব! আমি দাঁতে দাঁত চিপে গাড়িতে স্টার্ট দিই। ও একটু টাল খেয়ে পেছনে সরে যায়। আমি উর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি ছোটাই। অত রাতে সিগনালের বালাই নেই, তবু মনে হল কে যেন উন্ডস্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে আছে, ‘ছবিটা দে, দে বলছি’।




পরদিন ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। বিয়াসই ভাঙাল, মোবাইলে ওর কল। ‘এখনও ঘুমোচ্ছেন?’

– ব্যাচেলার লাইফের এই তো মজা। আজ দেরিতে বেরোব। বলুন কী মনে করে?

– ছবিটা ঠিকঠাক রেখেছেন তো? আসলে ওটা আমার প্রিয় ছবি। কখনও কাছ ছাড়া করি নি’।

– ছবিটা ফেরত চাই, এই তো? পেয়ে যাবেন।

– এখনই বেরোবার পথে দিয়ে গেলে ভাল হয়।

বিয়াসদের বাড়ি ঢোকার মুখেই যে বড় রাস্তা, ওখানে এসে ও অপেক্ষা করছিল। ছবিটা হাতে পেয়ে মুখে অনাবিল হাসি। আমিও ভারমুক্ত, যার জিনিস, তার জিম্মাতেই থাক বাবা।

দিনে দিনে দুজনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। বাবা, মা মুম্বাই থেকে এসে মেয়ে দেখে গেলেন। মাস দুয়েকের মধ্যে বিয়ে সারা।

হানিমুনে এলাম উত্তর বঙ্গের এক পাহাড়ি গ্রামে। নতুন বৌ, তার পছন্দেই আমার পছন্দ। যদিও মন চাইছিল বিদেশে হানিমুনে গেলে বেশ হত। তবে নিরিবিলি এ জায়গাটা যেন এক টুকরো স্বর্গ। বিয়াস আবার রঙ, তুলি টেনে নিয়েছে। ও যখন আঁকে, আমি বাইরেটা ঘুরে ঘুরে দেখি। বাংলোয় আমরা দুজন ছাড়াও কেয়ারটেকার রামভকত আর ওর বউ লাইকা আছে, তবে সন্ধ্যের পর ওরা ফিরে যায় নিজেদের ডেরায়।

লাইকা মেয়েটা বেশ। বাঁশ পাতার মতো ফিগার, চূড়ো করা বাঁধা চুল। ওর শরীর থেকে একটা ফুলের গন্ধ ওড়ে।

বিয়াসই একদিন বলল, ও নাকি চুলে হাসনাহানার ফুল গুঁজে রাখে। তা রাখে তো রাখে, আমার কিন্তু বেশ লাগে গন্ধটা।

কিন্তু বিয়াস ওকে পছন্দ করে না। লাইকা কাছে আসলেই বিয়াসের মুখে বিরক্তি। বলে, ‘মেয়েটা ভালো নয় দুষ্টু চরিত্রের’।

কী দেখে বোঝে কে জানে। তবে এটা ঠিক, মেয়ে বড় ডাকাবুকো। একদিন দেখি গলায় একটা সাপ জড়িয়ে দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছে। রামভকত বলে, ‘পোষা সাপ, কিচ্ছু বলে না। লাইকা ওর বন্ধু’।

একদিন পাহাড় ঘুরে যখন বাংলোয় ফিরলাম, বেশ বেলা হয়েছে। খিদেতে পেটে চুই চুই। লাইকা আমার সঙ্গেই ছিল, নিজে থেকেই এসেছে। জায়গা চেনাতে চেনাতে যাচ্ছিল। ঘরে ঢুকে দেখি বিয়াস যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

-কী হল? শরীর খারাপ নাকি? – বলতে বলতে কপালে হাত দিই। জ্বরে গা পুড়ছে। সর্বনাশ!’

বিয়াস চোখ খুলে তাকায়, ঘোলাটে দৃষ্টি, তাতে কেমন অভিমান। এতক্ষণ ছিলাম না হয়তো তাই, বা লাইকা সঙ্গে ছিল বলে …

ওকে জোরাজুরি করেও খাওয়াতে পারলাম না। আমি দু গ্রাস মুখে দিয়েই আবার ঘরে ছুটে আসি। জ্বরটা আরও বাড়ছে। নার্ভাস লাগল।

হঠাত দেখি, লাইকা পর্দা সরিয়ে ঘরে উঁকি দিচ্ছে, ‘তুই সর বাবু, আমি দেখছি’। – ও বিছানার কোণা ঘেঁষে বসে বিয়াসকে মাথা টিপতে শুরু করে। আমি বারান্দায় পায়চারী করছি।

হঠাৎ শুনি জোরে জোরে আমার নাম ধরে ডাকছে বিয়াস। ছুটে ঘরে ঢুকতেই লাইকা তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। বিয়াস হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচাচ্ছে, ‘ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছ কেন? ও ছবি চুরি করতে এসেছিল। আমি হাতে নাতে ধরে ফেললাম ভাগ্যিস’।

আমি হতবাক। বিয়াস কি জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে? তাড়াতাড়ি একটা ওষুধ খাইয়ে বলি, ‘এখানে কোনও ভাল ডাক্তার বদ্যি নেই। চল, কালই কলকাতায় ফিরি’।

-অসম্ভব। – বিয়াস হাত চেপে ধরে। – পরশু অবধি থাকতেই হবে। অমাবস্যা ওইদিন। আমি একটা পাহাড়ি ঝোড়ার পাশে বসে ছবি আঁকব। কতবার তো বলেছি। পাহাড়ি জায়গায় আসার এটাই আমার মিশন। মোমবাতি জ্বলবে পাশে’।

কথা বাড়ালাম না, যা বলে বলুক। একটু পরেই দেখি ও ঝিমিয়ে আসছে, ওষুধের এফেক্ট বুঝলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল টেবিলে, বিয়াসের আঁকা ছবিগুলো এমন এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কেন?

একটা ছবির ওপর প্যালেট উল্টে অনেকখানি রঙ চুইয়ে পড়েছে। এগুলো কি লাইকার কাজ? কিন্তু লাইকা কেন এমন করবে? কে জানে, হয়তো কৌতূহলে দেখতে গিয়েছিল, হাত লেগে প্যালেট উল্টে গেছে।

এর মধ্যেই শুনি বিয়াসের জড়ানো গলা, ‘ঝিলাম, ঝিলাম’।

কে ঝিলাম? কাছ ঘেঁষে আর একটু শোনার চেষ্টা করলাম। বিয়াস খালি বিছানায় হাত বোলাচ্ছে। ‘কাছে আয়। আমি জানি তুই কাছাকাছিই আছিস। তোর ওই প্রিয় গন্ধটা পাচ্ছি, হাসনুহানার গন্ধ। তোকে তো ক্ষমা করে দিয়েছি। তবু আসবি না? আমায় কষ্ট দিয়ে কী সুখ পাস?’

মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না। অসুখটা বাড়াবাড়ির জায়গায় চলে যাওয়ার আগে শ্বশুরমশাইকে জানানো দরকার।

মোবাইলে তাঁকে পেতেই সংক্ষিপ্ত ভাবে যা বলার বললাম, ঝিলামের কথাও। উনি প্রথমে চুপ। পরে বলেন, ‘একটা অধ্যয় তোমায় গোপন করে গিয়েছিলাম। কারণ আমি ভুলতে চাই সেটা। বিয়াস আর ঝিলাম আমার দুই যমজ মেয়ে। জন্মের পরই ওদের মা মারা যায়। একটু বড় হতেই দেখলাম দু মেয়ে দু প্রকৃতির। বিয়াস শান্ত, ওকে সবাই ভালবাসে। ঝিলাম ততটাই অপ্রিয় সবার কাছে। প্রচন্ড হিংসুক, সুযোগ পেলেই দিদির ছবিতে কালি ঢেলে দেয়, নষ্ট করে’।

বলতে বলতে উনি এবার ইতস্তত করতে থাকলেন, ‘এবার যা বলব, শুনে প্লিজ ভুল বুঝো না। আমার বিয়াসের একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল। ভারি ভাল ছেলে, যেমন শান্ত, ভদ্র, তেমনি পরিবারটিও চমৎকার। বিয়ে প্রায় ঠিক। হঠাত ছেলের মা মারা গেল। ওরা এক বছর সময় চাইল অশৌচ কাটাতে।

ছেলেটির আসা যাওয়া ছিল আমাদের ঘরে। হঠাত ঝিলাম তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে। তারপর একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। পরে শুনেছি বিয়ে থা করে ওরা অন্য জায়গায় সেটল হয়েছে। এরপর আমি আসামের সমস্ত ঘর বাড়ি বেচে কলকাতায় উঠে আসি। অত বড় ব্যবসা, এককথায় ছেড়েছি। বলতে পারো সব ভুলতে’।

বিয়াসের বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।





আজ অমাবস্যা। বিয়াসের জ্বর এখনও একশোয় আটকে। তবু মেয়ে জেদ ধরেছে, রাতে পাহাড়ি ঝোড়ার পাশে গিয়ে বসবে। এদিকে সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় ঘুরছিলাম। ঘরে ফিরে দেখি বিয়াস নেই। কী হল? গায়ে জ্বর নিয়ে গেল কোথায়? একটু পরেই লাইকা হাঁপাতে হাঁপাতে এল। ‘বাবু, দিদিমনিটর মাথা পুরা খারাপ। একা একা এই শরীলে ঝরণার কাছে চলি গেল। ডাকলাম সাড়া দিল না’।

চমকে উঠি। সর্বনাশ!

-তুই আমার সঙ্গে চল বাবু। ওকে নিয়ে আসবি।

ছুটলাম লাইকার সঙ্গে। সত্যিই একটা পাহাড়ি ঝোড়া আছে আমাদের বাংলোর খুব কাছেই। রাত দিন ঝর ঝর ঝর ঝর জল ঝরা শব্দ আসে। ওখানেই কি একা একা চলে গেল বিয়াস?

লাইকা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছিল। হঠাৎ থমকে গেল। বলে, ‘ও রাস্তায় যাব না। সাপের ভয় আছে। অন্ধকার নেমেছে না! রেল লাইন পেরিয়ে চল’।

তাই চললাম। হাঁটছি, হেঁটেই চলেছি। – আর কত দূর? – পথ যেন শেষ হচ্ছে না।

আর একটু। কেন হাঁটতে ভাল লাগছে না? – লাইকার চোখের চাহনী ভাল লাগল না।

হঠাত আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। বলি, ‘এ রাস্তা দিয়ে যাব না’।

ও শক্ত হাতে আমার বাজু চেপে ধরল, ‘কেন? এই পথটাই ভাল’।

আমি এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়াতে চাইলাম, এ কী পারছি না কেন! একজন ফিনফিনে বাঁশ পাতার মতো মেয়ের শরীরে এতো শক্তি।

হঠাৎ দেখি উল্টো দিক থেকে ক্ষীপ্র গতিতে ধেয়ে আসছে একটা ট্রেন। ‘লাইকা ছাড়ো আমায়, ট্রেন আসছে’। আমি চিৎকার করে চলেছি, ও তবু ছাড়ে না।

মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি খুব সামনে থেকে। কী করব এখন? লাইকা এমন করছে কেন?

ঠিক তখনই এক ঝটকায় কেউ যেন আমায় ছুঁড়ে দিল রেল লাইনের ওপারে, পাশের ঝোপে। লাইকা তখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। এবার ক্ষিপ্র গতিতে হেডলাইট ফেলতে ফেলতে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল চোখের নিমেষে।

আমার মাথা শূন্য। হঠাৎ দেখি লাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিয়াস। কেমন ভূতগ্রস্তের মতো বিড়বিড় করছে আপন মনে, ‘একের পর এক আমার ভালবাসাকে খুন করেছিস তুই। আর না। এবার তোকে চরম শাস্তিটা দিলাম’। ও হাসছে, হাসতে হাসতে কাঁদছে। এমন করছে কেন ও? লাইকাকে কি ভুল করছে ঝিলাম বলে?

কিন্তু লাইকার কী হল? ও কি সরে আসতে পেরেছে নাকি রেল লাইনের ওপরেই … তাহলে তো ওর শরীর এতক্ষণে ছিন্ন ভিন্ন! শক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়াই, বিয়াসকে হ্যাঁচকা টানতেই ও ফ্যালফ্যাল করে খানিক তাকাল, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে।

আমি বুঝলাম, যা অঘটন ঘটার ঘটে গেছে। আর এখানে নয়। পালাতে হবে, এখুনি, এই জায়গা ছেড়ে।

লাট খাওয়া ঘুরির মতো পাক খেতে খেতে চলতে লাগলাম। বিয়াস হাঁটু মুড়ে বসে পড়তে চাইছে। আমি কোনরকমে ওকে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে আসতে থাকি।

কোনরকমে বাংলোয় ফিরলাম দুজনে। রামভকতকে কী জবাব দেব? কিন্তু ঘরে ফিরে দেখি দরজা খোলা। তাহলে কি রামভকত খবর পেয়ে গেছে? ঘরে এসেই বিয়াসের শরীরটা নুয়ে পড়ল। জ্বরে ওর শরীর থেকে হল্কা বেরোচ্ছে।

হঠাৎ দরজায় বেল। আমার পা অসাড়। দরজা খুলতেই সামনে রামভকত। চোখ লাল, আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে। নিজেকে কোথায় লুকোব? হঠাৎ ও আমার হাত ধরে কঁকিয়ে উঠল, ‘লাইকা চলে গেল বাবু। আমি শ্বশানে চললাম, কাল আর আসতে পারব না’।

মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘সে কী! কীভাবে হল?’

– যে পোষা সাপ নিয়ে ও ঘুরে বেরাত, ও-ই ওকে আজ কেটেছে। এখান থেকে কাজ করে যাওয়ার পর কেমন গুমসুম হয়ে ঘরে বসেছিল। হঠাৎ সেই সাপ, এক ছোবলেই – হাউ হাউ করে কেঁদে চলে রামভকত।

আমি হতবাক। বুঝতে পারছি না, কোনটা সত্যি, রামভকতের কথা নাকি একটু আগে ট্রেন লাইনে যা ঘটে গেল, তা?




ভোর রাত থেকেই বিয়াসের জ্বর নেই। অন্য সকালের মতো আজও পাখি ডাকছে। খুব ইচ্ছে করছে কালকের রাতটাকে ভুলে যাই। সেটা কি আদৌ সম্ভব?

হঠাৎ ফোন, ওপাশে বিয়াসের বাবা। ‘মেয়ে কেমন আছে? কাল রাতে কী যে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম। আসলে সবাই তো চলে গেল, আছে ওই বিয়াসই, প্রদীপের শেষ সলতে’।

‘ঝিলামকে এবার ডেকে নিন না, অনেক তো অভিমান করেছেন’। – সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলি।

ওপাশে একটা হাসির শব্দ। কিন্তু সে হাসিতে কান্নার সুর। – ঝিলাম এখন অনেক দূরে চলে গেছে বাবা, ওকে ডেকেও ফেরানো যাবে না’।

– মানে? – বুকটা কেঁপে উঠল।

– গত বছর ও সুইসাইড করেছে। বিয়াসকে জানাই নি, শকটা নিতে পারবে না। ও এখনও বিশ্বাস করে বোন ওর পাশেপাশেই আছে। তাই যন্ত্রণাটা একা একাই বয়ে বেরাই।

ঠিক শুনলাম কি?

তখনই পিঠে একটা ঠান্ডা ছোঁয়া। চমকে ঘাড় ফেরাতেই দেখি, বিয়াস হাসছে, ‘গুড মর্নিং। কখন উঠলে?’

চোখ মুখ দারুণ ফ্রেস আজ ওর। – এই তো, একটু আগে।

– তোমার বাবা আছেন লাইনে। কথা বলবে?

– পরে বলব। আগে চল, ওই পাহাড়ি ঝোড়াটার কাছে যাই। একটা ছবি এখনও অসমাপ্ত, ওখানে বসে এঁকে নি।

আমি অবাক হয়ে তাকালাম, তাকিয়েই রইলাম। কেন যেন মনে হল গত রাতের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে গেছে বিয়াস। আর অমাবস্যার রাতে ঝোড়ার কাছে যেতে চাওয়ার বায়নাও ও আর করবে না।

ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস ফিফটি ফিফটি। কিন্তু আজ সেই ঈশ্বরকেই মনে প্রাণে প্রার্থনা করলাম, বিয়াসের জীবন থেকে অমাবস্যার রাত্রিগুলোর এবার ছুটি দাও। ওর আকাশে জেগে থাক শুধু পূর্ণিমার চাঁদ।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *