short-story-epar-opar

এপার-ওপার
আলমগীর রেজা চৌধুরী


জগদীশ কাকা খুন হওয়ার পর কৃষ্ণনগর থেকে চন্দ বাড়িতে ফিরে এলো দিলীপ চন্দ। দিলীপ চন্দ কৃষ্ণনগর থাকে। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছর না যেতেই তপতোষ জেঠা দিলীপকে নিয়ে কৃষ্ণনগর চলে যায়। দিলীপ চন্দের বয়স তখন আট। এই দীর্ঘ সময়ে পাকাপোক্ত ইন্ডিয়ার নাগরিক। দিলীপ চন্দ সিপিএম’র প্রভাবশালী নেতা। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সঙ্গে চন্দ বাবুর দহরম-মহরম আছে। বাংলাদেশে তার কাকা খুন হয়েছে, বিষয়টি যেনতেন ব্যাপার নয়।
প্রথম কথা হলো, জগদীশ কাকাকে খুন করবে কে? কী স্বার্থ সত্তরোর্ধ মানুষটিকে খুন করে! তের শতাংশ জমির ওপর তার বসতবাড়ি। দুটো দুধেল গাভী আছে। সারা বছর গাভীর দুধ বিক্রি করে। তাছাড়া কাঁঠাল-আম-জাম-নারকেল বিক্রি করে তার একার দিন চলে যায়। তাছাড়া দিলীপের বাল্যসঙ্গীরা জগদীশ কাকার বড় আশ্রয়। তারাই তার আপনজন। তপতোষ জেঠা ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার পর কতবার যে তাগিদ দিয়েছে জগদীশ কাকাকে! কাকা এসব পাত্তাই দেয়নি। কেন যাবে? ওখানে আমার কে আছে? একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেঝ কাকাকে হত্যা করে। তারপর থেকে তপতোষ জেঠা আর এদেশে নিজকে নিরাপদ মনে করেনি। বসতভিটা জলদামে বিক্রি করে পিশোতো ভাই খগেনকে সঙ্গে করে ভারত গমন। একাত্তরে ডিবরুগড় শরণার্থী শিবিরে পরিচয় হয়েছিল কৃষ্ণনগরের লাল বাবু ওরফে মতিন্দ্র সরকারের। সে শিবিরের টোকেন কর্মকর্তা। তপতোষ জেঠাকে পিতৃতুল্য গণ্য করে বলেছিল, ‘কাকা চলে আসুন। আমি আপনাকে সাহাষ্য করব।’
দেশ স্বাধীন-পরবর্তীতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বইচ্ছায় দেশান্তর নেয় তপতোষ জেঠা। কাকিমা আর দিলীপ সঙ্গী। সময়ের ব্যবধানে দু’একবার কাকিমা আর দিলীপ এসেছে চন্দ বাড়িতে। তপতোষ জেঠা কেন দেশান্তরী হয়- তা গ্রামের মানুষের কাছে বিস্ময়। তপতোষ জেঠা নামকরা শিক্ষক। স্থানীয় হাইস্কুলের সবচেয়ে ব্যক্তিত্ববান এবং জনপ্রিয় শিক্ষক। সেই মানুষটি বলা নেই কওয়া নেই রাতের অন্ধকারে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। তার প্রাণপ্রিয় ছাত্ররাও তপতোষ জেটাকে নিয়ে প্রশ্নের মধ্যে থেকে যায়। তপতোষ স্যারের মতো এমন মানুষের দেশপ্রেম নিয়ে কথা চলাচালি দীর্ঘদিন এ এলাকায় চলতে থাকে। বর্তমানে এক প্রজন্ম তাকে চেনেই না। আরেক প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গেছে।
আর জগদীশ কাকা কাকিমার সঙ্গে বহুদিন সংসার করে উত্তরাধিকার না রেখেই খুন হলো। কাকিমা মারা গেছে তাও পনের বছর হয়। তারপর থেকে মাতামাতি চলছে। পুলিশ থেকে নিকটতম প্রতিবেশী জানে না কি জন্য তাকে খুন করা হয়। তাকে খুন করতে পরিকল্পনা লাগে না। বাড়িতে একা থাকে। কাজের বাইরে পূজো-প্রার্থনায় নত থাকে। তারপর হতে পারে তের শতাংশ বসতবাড়ির লোভের শিকার। খুনি দখলের দায় নেবে কেন? বরঞ্চ কাকাকে সেবা করলে তিনি এমনি দান করতে পারতেন।
জগদীশ কাকা খুন হওয়ার আটাশ দিন পর ভ্রাতুষ্পুত্র দিলীপ চন্দ অভিযোগকারী হিসেবে পূর্বপুরুষের ভিটায় ফিরে আসে। জগদীশ কাকাকে দাহ করার পর প্রাচীন এই চন্দ বাড়িতে কেউ থাকেনি। দিনের বেলায় ওপাড়ার মাজম শেখের বড় ছেলে পল্টু শেখ ও তার বউ প্রায় প্রতিদিন নজর রাখে। কাকার বাল্যবন্ধু মাজম শেখ। হরি হরি আত্মা। আজ দু’জনই গত। অরক্ষিত বসতভিটার এখন কোনো মালিকানা নেই। দখলদার নেই। মালিক খুন হয়েছে, ভয়ে কেউ আসে না। নানান গল্প। ‘জগদীশ কাকা বাড়ি বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল! গোপনে গোপনে টাকাও নিয়েছে।’
‘আরে দূর, জগদীশ কাকা ভিটাবাড়ি বিক্রি করবে? যৌবনে কাকিমাকে নিয়ে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে। এখন টাকা দিয়ে কি করবে? কি অদ্ভুত মায়াময় কণ্ঠ!’
সব মিলিয়ে তার প্রতি সবার আন্তরিক কষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। এলাকার মুসলমান-হিন্দু সবাই ধারণা করে জগদীশ কাকা স্বর্গে যাবেন।
তিনি স্বর্গে যান আর নরকে যান- তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু দিলীপ চন্দ ফিরে আসার পর বিষয়টি নতুন করে বাঁক নিতে শুরু করেছে। তার মতো মানুষ খুন হতে পারেন না। অথচ কি নির্মম, তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। দাহ করা হয়েছে বংশাই নদী ঘেঁষা প্রাচীন বটগাছের পাশে। চিতাখোলায়। জগদীশ কাকার অস্তিত্ব এখন পৃথিবীতে নেই। অথচ প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে ঢুকতেন। এ ক’দিনে ঠাকুর ঘরসহ বাড়ির আঙিনা লতাগুল্মে ভরে গেছে। মা কালীর বর্শা লতানো গাছে জড়িয়ে নিয়েছে।

দিলীপ চন্দ এলো উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ি চড়ে। চিকন পাড়ের ধুতির সঙ্গে আদির পাঞ্জাবিতে কেতাদুরস্ত কলকাতার বাবু। চন্দবাড়ির ছাওয়াল। তপতোষ স্যারের পুত্র। লম্বা, একহারা পুরুষ। সুস্বাস্থ্য। বাবু বাবু ভাব আছে। তা তো থাকবেই। নেতা না!
উপজেলা চেয়ারম্যান আসবেন- এ খবরে তার সাঙ্গপাঙ্গ, পুলিশ-আনসার, দলীয় লোকজনে সরগরম। গাড়ি থেকে চেয়ারম্যান নামার পরপর দিলীপ চন্দ নামে। উপস্থিত জণগণের দিকে নমস্কার জানায়। বিনয়ী ভঙ্গি। পৌরুষদীপ্ত।
চেয়ার বলে, ‘দাদা এখানে ক’দিন থাকবেন। দাদার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব অনেক। কারণ সরকারের ওপর মহল দাদার ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত। তার কাকার খুনের অগ্রগতি কি? ইত্যাকার বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। ইউপি চেয়ারম্যান বাড়িটা বসবাসযোগ্য এবং তার থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব পালন করবেন।’
বাড়িটা গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে। পরিষ্কার করে বসবাসযোগ্য করাসহ দাদার সব ব্যবস্থার দায়িত্ব পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যানকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান জগদীশ কাকার বাড়িতে গেলেন না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। ইউপি চেয়ারম্যান দিলীপ চন্দকে নিয়ে বাড়ির রাস্তায় গজিয়ে ওঠা মৌডাল ঝোপ পেরিয়ে এগিয়ে যায়। বাড়ন্ত বিষকাটালীর জন্য পথরেখা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর দিলীপ চন্দ ও চেয়ারম্যান সাব দশ মিনিট পর ফিরে আসে।
‘রাতের মধ্যে বাড়িঘর বসবাসযোগ্য করে দাদাকে এখানে নিয়ে আসতে হবে। এই সময়টুকু সে চেয়ারম্যান সাহেবের ওখানেই থাকবে। দু’জন সঙ্গী, একজন পাচকের ব্যবস্থা তিনিই করবেন।’
উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব দিলীপ চন্দের কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে বললেন, ‘আপনার যে ক’দিন ইচ্ছে থাকবেন। সব ব্যবস্থা করা হলো। দু’জন আনসারও মোতায়েন থাকবে। বাদবাকি ইউপি চেয়ারম্যান সাহেব ব্যবস্থা করবেন। আর আমি তো প্রতি মুহূর্ত আপনার সঙ্গে আছি।’
তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
পার্টি কর্মীসহ ইউপি চেয়ারম্যান সাহেব সব ব্যবস্থা করে দীলিপ চন্দকে বললেন, ‘দাদা, আমার হোন্ডায় উঠুন। আমার বাড়িতে রেস্ট নিন।’
দিলীপ চন্দ কোনো কথা বললেন না। এগিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের হোন্ডার পেছনে উঠে বসলেন।

দুই


পরদিন এগারোটার দিকে চেয়ারম্যান দিলীপ চন্দকে নিয়ে চন্দ বাড়িতে ফিরে আসেন। সরাসরি বাড়ির উঠোনে হোন্ডা থামায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চারপাশ। একটা বাড়ন্ত গাছের অস্তিত্ব নেই। তুলসীতলা যেন কতকাল ধরে ব্যবহার করে আসছে। কুয়োতলায় বালতিভর্তি জল রাখা আছে। জগদীশ কাকার অনুপস্থিতি টের পাওয়ার জো নেই। নতুন মাটির কলসিভর্তি জল দাওয়ার সামনে রাখা আছে। জলচৌকির ওপর জগে জল। পাশেই কাকার ব্যবহৃত পিতলের গ্লাস। রান্নাঘরে সবজি কর্তনের ব্যবস্থা।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ‘সারারাত ধরে আপনার জন্য সবকিছু ম্যানেজ করেছি। আপনি খুশি হলে অধমের পাপমুক্তি হবে।’
দিলীপ চন্দ খুব অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আমার খুব কান্না পাচ্ছে। এই ভিটায় জন্মেছিলাম। কৈশোরের স্মৃতি মনে পড়ছে। জন্মভূমি তো! আমি তো কুলাঙ্গার সন্তান। বাবা-জ্যেঠারা অনেক আনন্দময় জীবন কাটিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষ বাংলাদেশ নয়। আলাদা। এখন মনে হচ্ছে আমি ভারতবর্ষের নই।’
চেয়ারম্যান সাহেব, দিলীপ বাবু দুটো চেয়ার দখল করে চালতা গাছতলায় মুখোমুখি বসে পড়েন। চেয়ারম্যান লোকজনদের নির্দেশ দিয়ে সাগরেদ কালুকে চা দিতে বলের।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে চেয়ারম্যান বলেন, ‘দাদা, আপনি সম্মানী মানুষ। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত। চন্দ বাড়ির সুসন্তান। জ্যোতি বাবু পর্যন্ত আপনার কাছের মানুষ। উপজেলা চেয়ারম্যান মজিদ ভাই তো রীতিমত আপনার ফ্যান। তাছাড়া দলীয়ভাবে আপনার প্রতি নজর রাখার নির্দেশ আছে। আপনি অতিথি। নারায়ণ। বাড়ির মালিক। এখন আমি আপনার মেহমান হতে চাই।’
‘না না দাদা, ছিঃ ছিঃ, এ কি বলছেন! পাপিষ্ঠ করবেন না। দেশান্তরী মানুষের সঙ্গে শেকড়ের সম্পর্ক আগলা হয়ে থাকে।’
চা পান শেষ করে আনসারদের থাকা-খাওয়ার জায়গার নির্দেশ দিয়ে দিলীপ চন্দকে বলল, ‘যা লাগবে তা সোমেন্দ্রকে বললেই ব্যবস্থা করে দেবে। তাছাড়া সার্বক্ষণিক কালু তো আছেই। আর আমি আপনার লোক।’
চেয়ারম্যান সাহেব চলে যেতেই দিলীপ বাবুর খুব একা মনে হতে লাগল। চৌকিদার-আনসার-কালু-পাচকসহ চার-পাঁচজন মানুষের কোনো অস্তিত্ব তার চেতনায় ছায়া ফেলল না।
বাড়ির কোন জায়গায় জগদীশ কাকাকে খুন করা হয়েছে! বৃদ্ধ মানুষ। জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা ক’জন? রক্তাপ্লুত কাকা নিথর পড়ে আছেন। চোখ এবং মনের কোণে বিচিত্র আবলুস অন্ধ কষ্ট দিলীপ চন্দকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সজনে গাছে ঘুঘু ডাকে। ওই ডাকের সঙ্গে দূর অতীত থেকে পরিচিত। মায়াময় নিস্তরঙ্গ জীবনযাপন। কলকাতার নাগরিক ছবির সঙ্গে এর মিল নেই।
দিলীপ চন্দকে দেখার জন্য অনেকেই ছুটে এলেন। সবার কণ্ঠে জগদীশ কাকার জন্য সমবেদনা। বিকেলের দিকে মাজম শেখের বড় ছেলে পল্টু আর ওর বউ দিলীপ বাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। পল্টু শেখের বয়স প্রায় দিলীপ চন্দের কাছাকাছি।
প্রণাম জানিয়ে পল্টু শেখ বলে, ‘দাদা তো আমাকে চিনবেন না। আমি ছোট থাকতেই স্যার চলে গেলেন। আপনিও গেলেন। জগদীশ কাকা ছিলেন, তাও কি ভয়ঙ্কর ঘটনা। আমি তার সন্তানের মতো ছিলাম। আমার স্ত্রী রাহেলাকে কন্যা গণ্য করতেন। তাকে দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দিলাম। আমি খুব কষ্ট পাইছি দিলীপ দাদা!’ ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে পল্টু শেখ। রাহেলা আধ-ঘোমটার আড়ালে কান্নায় তলিয়ে যেতে থাকে।
দিলীপ চন্দ হতভম্বের মতো পল্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনারাই তো জ্যেঠার আপনজন ছিলেন। নিকটতম প্রতিবেশী। আপনার কষ্ট অনেক। সে তুলনায় আমি দূরের। শুধু রক্তের কষ্ট পাই।’
দিলীপ চন্দকে ভীষণ বিষণ্ণ লাগছে। গাছে গাছে সন্ধ্যেবেলার পাখিদের বিদায় কলরব। সে একটু শিহরিত হয়।
তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে রাহেলা বলে, ‘বাবু, এই তুলসীতলায় কাকা পূজো দিতেন। আর আমার ছেলেমেয়েদের ঠান্ডা লাগলে এর পাতার রস করে খাওয়াতো।’
ঠিক এ সময় পাড়ার মসজিদে আজান পড়ে। পল্টু শেখ রাহেলাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। চৌকিদার-আনসার-কালু-সোমেন্দ্র যার যার জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকে। রাত নামলেই আলো জ্বেলে দেবে। ধূপ-ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। রাতপোকার ডাক, কুকুরের খিস্তি-খেউর, শেয়ালের হুক্কা ভেসে আসছে। দিলীপ চন্দ চমকায়। বাবা-কাকার সঙ্গে ওর কোনো মিল নেই। একটুতে ভয় পাওয়া ওর জন্মগত। অবাক করা ব্যাপার, মহাবিপ্লবের মতো সময় সে ধারণ করেছে। তার মধ্যে ক্লান্তি চলে আসে। অনেক কালের গণেশের মূর্তির দিকে টর্চ জ্বেলে দিলীপ বাবুর মনে পড়ল, বাবা কাশি থেকে এই পাথর গণেশ এনেছিল কাকার জন্য। জগদীশ কাকা খুন হওয়ার পর এই প্রথম ধূপধোঁয়ায় মাঙ্গলিক প্রশান্তি অনুভূত হয়। দিলীপ চন্দ রুদ্ধ কষ্ট অনুভব করতে থাকে। বাবা-মা, কাকা-কাকি এ গণেশে পূজো দিতেন। মানুষগুলো নেই। গণেশ আছে।
‘দাদা বাবু, ওইখানে গীতা আছে। পাঠ করতে পারেন।’ সোমেন্দ্র বলল।
দিলীপ চন্দ কৌণিক তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বাড়ি কি এখানেই?’
‘জ্বি। পাশের গেরামে। জগদীশ কাকাকে জন্ম থেকে দেখে আসছি। পূজনীয়।’
‘তোমার কোনো ধারণা আছে কেন কাকাকে খুন করা হয়েছে?’
‘না। তাকে কেউ খুন করতে পারে না।’
‘উনি খুন হয়েছেন।’
‘জ্বি!’
দিলীপ চন্দ ঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার ঘিরে ধরেছে সারা বাড়ি। রান্নাঘর থেকে ডাল সম্ভারের ক্ষুধা জাগানিয়া সুবাস আসছে। চালতা গাছের ফাঁক গলে নক্ষত্রের মুখ দেখা। দিলীপ বাবু আকাশ দেখে।
পরদিন বিকেলের দিকে উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব এলেন। সঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান। পদ্মার ইলিশ নিয়ে এসেছে। দাদার জন্য। দাদা অতিথি। দিলীপ বাবু বিব্রত হয়। দেশান্তরী মানুষ। এত যত্ন সইবে কেন?
‘চেয়ারম্যান সাহেব, আমার খুব লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে আমাদের চলে যাওয়া ঠিক হয়নি!’
‘না না দাদা, আমরা সেভাবে দেখছি না। আপনি আমাদের সুসন্তান। এই অধিকার আপনার রয়েছে।’
‘না! আমার কোনো অধিকার নেই। ওই যোগ্যতা আমি আগেই হারিয়েছি।’
দিলীপ চন্দের কণ্ঠ ভারি হয়ে এলো। চোখ জলের রেখা।
‘আমাদের স্থানীয় পরিষদ চাইছে আপনাদের পঞ্চায়েত পদ্ধতি নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করতে। আপনার অনুমতি পেলে উদ্যোগী হতে পারি।’ উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন।
দিলীপ চন্দ খুব অবাক হয়ে বলেন, ‘এটা কি ঠিক হবে? কাকা খুন হয়েছেন। জন্মভূমিতে এসে এসব কি আমার ভালো লাগবে?’
‘দাদা, আপনার ইচ্ছে না হলে বাদ। আমাদের শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব জনাব আজাদ নোমান তো আপনাকে আগাম দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন। আপনার সম্মতি পেলে তারাও ঢাকায় একটি সেমিনার করতে চায়।’
চেয়ারম্যান সাহেব চন্দ বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
‘কয়েকদিন যাক চেয়ারম্যান সাহেব। আমি আপনাকে পরে জানাবো।’
সন্ধ্যের আগ দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান চলে যান। দিলীপ বাবু মাঙ্গলিক অর্চণায় নিমগ্ন হন। হেরিকেনের আলোয় ঝুঁকে ঝুঁকে গীতা পড়েন। মাঝে মাঝে ওপরের দিকে দু’হাত তুলে বলে ওঠেন, ‘প্রভু, শান্তি দাও।’
বড় ঘরের বারান্দায় চৌকিতে কালু আর সোমেন্দ্র থাকে। গোয়াল ঘরের বারান্দায় পার্টিশন দিয়ে আনসারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জগদীশ কাকা খুন হওয়ার পর থানার দারোগা তার দুধেল গাভী দুটো থানায় নিয়ে গেছে। ও দুটো তার তত্ত্বাবধানে আছে।
সোমেন্দ্র বলে, ‘বাবুকে কি রাতের অন্ন দেব?’
‘না সোমেন্দ্র, আমি একাদশী পার্বণ করেছি। তোমরা রাতের খাবার শেষ করো।’
সোমেন্দ্র কালুকে নিচু গলায় বলে, ‘কালু ভাই, বাবু সাক্ষাৎ দেবতা।’
কালু কথা বলে না। ওর চোখ হেরিকেনের আলোয় চকচক করে ওঠে।
দিলীপ চন্দ বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘কালু, শেষ প্রহরে ডেকে দিও।’
কালুর হুঁকো গরগরা চলতে চলতে দিলীপ বাবুর নাক ডাকার শব্দ হয়।
রাতের শেষ প্রহরে কালুর ঘুম ভাঙে। উঠোনে দাঁড়িয়ে সময় পরখ করে।
আজান পড়ার বেশি বাকি নেই।
দরজায় টোকা দিয়ে বলে, ‘দাদাবাবু।’
‘সোমেন্দ্রকে ডেকে তোল।’
কালু সোমেন্দ্রকে ডাকে, ‘উঠে পড়, দাদা তোমাকে উঠতে বলছে।’
সোমেন্দ্র হুড়মুড় করে উঠে বসে। চোখ কচলাতে কচলাতে বলে, ‘ও… দাদাবাবু!’
দিলীপ চন্দ বাথরুম থেকে ফিরে এসে বলল, ‘কালু, সূর্য ওঠার আগে স্নান সেরে ঠাকুরকে পূজো দিতে হবে। কতকাল পর বাপ-দাদার ভিটায় অবস্থান। পূর্বপুরুষরা আশা করে। কালু-সোমেন্দ্র স্নানের কাপড় নিয়ে নিও। তোমরাও স্নান করবে।’
‘দাদাবাবু, আনসারদের ডাকবো কি?’ কালু বলে।
চন্দবাবু জবাব দেয়, ‘না!’
ততক্ষণে ঈষৎ আলো দিগন্তজুড়ে।
কালুর পেছনে দিলীপ চন্দ, তারপর সোমেন্দ্র। নিঝুম শেষ রাতের প্রকৃতি। দু’একটা দোয়েলের শিষ জানান দিচ্ছে একটু পরই আজান পড়বে।
বংশাই নদীর কোল ঘেঁষে প্রাচীন বটগাছ। এলাকার ঠিকুজি। ওই বটগাছের কত শাখা-প্রশাখা জল ছুঁয়েছে। ওপাশে চিতাখোলা। মানুষ পোড়ানো হয়। এ পাশটায় স্নানঘাট।
চারপাশটা ভালো করে নজর করে দিলীপ চন্দ বলল, ‘ওখানটায় মন্টব ঘর ছিল। বাবা-মাকে স্নান সেরে পূজো দিতে দেখেছি।’
আবছা মতো মনে পড়ে। ইয়াকুবকে মনে পড়ে। বাল্যের সাথী। বটগাছের নদীর জল ছোঁয়া শাখা বেয়ে জলে ঝাঁপ খেলায় ইয়াকুব সাথী ছিল।
স্নান সেরে বাড়ির পথ ধরতেই আজান পড়ল। দিলীপ চন্দ শাহা ভাইয়ের আজানের সুর খুঁজে বেড়ায়। তার আজানের মাধুর্যের কথা বাবা সারা জনম বলল, ‘নারে শাহা মিয়ার আজান জগতের কোথাও নেই।’
দিলীপ চন্দের মনে হলো, বাবা ঠিক কথা বলেছে। ওই সুর কোথাও নেই।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে চারদিক বেশ ফর্সা। উঠোনে পা দিয়ে চন্দ বাবু বলে, ‘কালু, তুমি নামাজ পড়! সোমেন্দ্র ধূপধোঁয়া নিয়ে ঘরে আয়।’
কালু একটুও চমকায় না। বিছানায় গামছা বিছিয়ে ফজরের নামাজ পড়তে থাকে। ধূপধোঁয়া নিয়ে সোমেন্দ্র ঘরে ঢুকতেই ভেসে এলো মন্ত্রপাঠ। তারপর সূর্য উঠে আসে। কালুর মনে হলো আজ বহুদিন পর সে নামাজ পড়ল।

তিন

পরপর তিন দিন থানার বড় দারোগা দিলীপ চন্দের সঙ্গে দেখা করতে আসে। দিলীপ চন্দ নির্বিকার উত্তর দেয়, ‘আমার কাকা খুন হয়েছে, আমি তার একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী। রাষ্ট্র কেস করেছে। একজন বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ বাড়িতে খুন কেন হলো, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমি তার পক্ষে কোনো অভিযোগ করিনি। যার সম্বল তের শতাংশ পৈতৃক ভিটা। আমি আমার জন্মভিটায় ফিরে এসেছি। ক’দিন অবস্থান করবো। তারপর চলে যাবো। এ জীবনে বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাবো না হয়তো! তবে পারিবারিক সদস্যের এমন করুণ মৃত্যুতে আমি ব্যথিত।’
দারোগা একটু নড়েচড়ে বসেন।
‘বাবু, রাষ্ট্র তো এই হত্যাকা-কে সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। তা থেকে আপনি কি মুক্ত?’
দিলীপ চন্দ জবাব দেয়, ‘না। আইনের হাত অনেক বড়। আমি জেনেই কোনো দাবি করছি না। তবে খুনির বিচার হোক, এটা মনে-প্রাণে আশা করি। তাছাড়া আমি রাজনীতি বুঝি। ভালোমন্দ মিলিয়ে বুঝি। আমি আপনার এসপিকে এ কথাই বলেছি।’
দারোগা কিছুক্ষণ বসে থেকে অনেকটা হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জানি আপনার হাতও অনেক লম্বা।’

পরদিন ইয়াকুবকে খুঁজে বের করার তাগিদ অনুভব করে দিলীপ চন্দ। কালুকে নিয়ে ইয়াকুবের বাড়ির উঠোনে দাঁড়াতেই কালু ডাক দেয়, ‘জেঠা দাদা এইছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে?’
ও পাশের বারান্দা থেকে যে লোকটি ছুটে আসে, তার সঙ্গে বাল্যের সাথী ইয়াকুবের মিল নেই। আধাপাকা দাঁড়ি, একহারা লম্বা গড়ন।
‘আমি ইয়াকুবকে খুঁজছি?’
‘আমি ইয়াকুব!’
‘আমি দিলীপ। ছেলেবেলায় বটগাছের শাখা বেয়ে বংশাইর জলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।’
‘মনে পড়ছে। কত বছর আগের কথা! ভুলেই গেছি।’
ইয়াকুব দিলীপ চন্দকে জড়িয়ে ধরে। বুকের সঙ্গে মিশে থাকে কিছু সময়। জগদীশ কাকা প্রসঙ্গে একটি কথাও বলে না। শুধু জলে ঝাঁপ দেওয়ার গল্প করে।
ইয়াকুবের স্ত্রীকে বলে, ‘পায়েশ খাওয়াতে হবে বৌদি। আমি-ইয়াকুব গফুর কাকিমার ঈদের পায়েশ কত চুরি করে খেয়েছি!’

ইউপি চেয়ারম্যান এলেন। সঙ্গে লীগ নেতা তোফাজ্জল ভাই। তাকে সবাই চেনেন। চেয়ারম্যান সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন, ‘দাদা, আমাদের তোফা ভাই। নেত্রীর কাছের লোক।’
তোফা ভাইকে নমস্কার জানিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিলীপ চন্দ।
‘ভাই, বাংলাদেশের কোনো তরুণ ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি।’
তোফা ভাই লজ্জিত স্বরে বলেন, ‘না না দাদা, আমি ওইরকম না।’
‘না হলে দলীয়ভাবে আপনাকে সম্মান করবে কেন?’
চেয়ারম্যান সাহেব বুঝতে পেরে বলেন, ‘দিলীপ দা, আমাদের রাজনীতি আপনাদের মতোন না। আপনাদের জবাবদিহিতা আছে, আমাদের নেই।’
দিলীপ চন্দ হতাশ হন। রুটস লেবেলে এত মূর্খরা রাজনীতি করে কি করে?
‘দাদা, কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?’
‘কী কষ্ট? আগে জানলে দেশান্তরী হতাম না।’ প্রাণখোলা হাসতে থাকে চন্দ বাবু। ইউপি চেয়ারম্যান কি যেন বলতে চান! বলতে পারেন না। শুধু একবার বলেন, ‘দাদা, উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব কি যে উদ্বিগ্ন! আপনি না থাকলে ভিটেমাটি বারোভূতে খেয়ে ফেলবে।’
দিলীপ চন্দ একটু অবাক হয়। চেয়ারম্যান সাহেব আমার এই মাটিটুকু নিয়ে ভাবছে?
জবাব না দিয়ে বলল, ‘আমি খুব শিগগির ইন্ডিয়া ফিরে যাব। পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে। আর আপনাদের ছাড়া আমি ভাববো কেন? কাকার খুনের একটা বিহিত হোক। তোফা ভাই নিশ্চয়ই আমার মতো পরিস্থিতির শিকার হননি! আমি আমার জন্মস্থানটুকু নিয়ে চিন্তিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বাড়িটি পোড়াতে পারেনি। খালভর্তি জল। এপারে আসতে পারেনি বলে পোড়াতে পারেনি। আমরা দৌঁড়ে চাম্বলতলা চলে গিয়েছিলাম। ওইদিন ছোট কাকিমার পা মচকে গিয়েছিল। রাতে মুক্তিরা আসার পর মা এক টিন মুড়ি দেন। রিয়াজ কমান্ডার তো বাবার পা ছুঁয়ে যুক্তফ্রন্টে যেত। আহারে সোনার মানুষ!’
ইউপি চেয়ারম্যান সাহেব ভাবলেন, দাদার মন আজ ভালো নেই। আরেক দিন আসা যাবে।
সোমেন্দ্রের লাল চা আর টোস্ট বিস্কুট খেয়ে বিদায় নেয় তোফা ভাই এবং চেয়ারম্যান সাহেব।

এমপি সাহেব দেখা করতে এলেন। তরুণ সাংসদ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েই সাংসদ হয়েছেন। বুদ্ধি-শুদ্ধি তরতাজা। এই প্রথম একজন মানুষকে ভালো লাগলো দিলীপ চন্দের।
‘দাদা, আপনাদের ডেমোক্রেসি চর্চার সঙ্গে আমাদের মিল খুঁজে পাবেন না। সামরিকতন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমরা এখনও অসহিষ্ণু।’
‘জ্বি, আমাদের মতপার্থক্য থাকলেই জাতীয় ইস্যুতে এক হতে পারি। আপনাদের তার অভাব।’
‘জন্মভিটা থেকে ইন্ডিয়া ফেরার পথে ঢাকায় আমার অতিথি হয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে যাবেন। তাছাড়া আমাদের লিডার তো আপনাকে দেবতাতুল্য মনে করে। আপনার প্রতি তার পক্ষপাত দেখে টের পাই। আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। শুধু আপনার সমস্যাগুলো বলতে বলেছে?’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি লিডারকে জানিয়েছি।’
এমপি সাহেব দিলীপ বাবুর সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা জানিয়ে চলে গেলেন।

ইন্ডিয়া ফিরে যাবার দু’দিন আগে পল্টু শেখ এবং তার বউ রাহেলা বেগম এলো। পল্টু শেখ প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক।
‘বৌদি, আপনার পায়েস খেতে খেতে চোখে জল এসেছিল। মা’র কথা মনে পড়ছিল। মা এ রকম পায়েশ রান্না করতেন।’
‘আমিও মাসিমার লাড়–র কথা ভুলিনি?’ পল্টু শেখ বলে।
‘পল্টু ভাই, আমি তো ফিরে যাবো। যতটা কষ্ট কাকা খুন হওয়ার পর পেয়েছিলাম, তার চেয়ে যন্ত্রণা ভোগ করছি তার এই তের শতাংশ ভিটাটুকু নিয়ে। একজন মানুষের মৃত্যু কিছুই না। জমিটুকুর কী হবে তা নিয়ে ব্যস্ততার অন্ত নেই!’
‘কেন? কাকা-জ্যেঠা শিক্ষক ছিলেন, তাদের বাড়িতে স্কুল উঠবে!’ রাহেলা বেগম অধিকার নিয়ে বলেন।
দিলীপ চন্দ বেশ সময় রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বৌদি, আপনার কণ্ঠস্বর আমার মায়ের মতোন।’


চার


দিলীপ চন্দ চলে যাওয়ার দিন জেলা পরিষদ প্রশাসক ফারুক ভাই গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আগের দিন থানার দারোগা দিলীপ চন্দের কথামত জগদীশ কাকার গাভী দুটো নিয়ে আসেন। চন্দ বাবু গাভী দুটো রাহেলা বৌদির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দুধ খাবেন। আমি আগামী বছর আসবো, আপনার হাতে পায়েস খাবো।’
রাহেলা বেগম হু হু করে কাঁদতে থাকেন।
দিলীপ চন্দ পল্টু শেখকে বলে, ‘ভাই বৌদিকে নিয়ে যান। গাভী দুটোকে কাকার মতোন যত্ন করবেন।’
উপস্থিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতে একটু সময় লেগে যায়।
ইয়াকুবকে বলে, ‘বন্ধু, এ জীবনে তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি। আমি ভাগ্যবান।’
কালুকে একটু নিরালায় নিয়ে বলল, ‘কালু, তোমার মতো আমিও জানি জগদীশ কাকা কেন খুন হয়েছেন এবং খুনটা কে করেছে। তুমি তো সামান্য মানুষ। চুপচাপ থেকো। আমি আগামী বছর আসবো।’
কালু-সোমেন্দ্র কাঁদতে থাকে। দিলীপ চন্দ বড় ঘরের চাবিটা ইউপি চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে দিয়ে বলল, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, চাবিটা আপনার কাছেই থাক। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনার দায়িত্ব আছে না! আপনাকে মনে রাখবো। তারপরও বলি, আমাদের দেশান্তরী হওয়া উচিত হয়নি। জন্মভূমির প্রতি মমতা থাকতে হয়। আমি সত্যি কুলাঙ্গার।’
চেয়ারম্যান সাহেব কোনো কথা বলেন না। দিলীপ চন্দ হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। জানালা দিয়ে শেষবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে জগদীশ কাকার বড় ঘরের চালে দুটো জালালি কবুতর বসে আছে। দিলীপ চন্দের মনে হলো- বাড়ির মালিক নেই, কে আর ওদের দেখবে!

পাদটীকা
দিলীপ চন্দ ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার দু’সপ্তাহ পর উপজেলা চেয়ারম্যান মজিদ ভাই সিপিএমের অফিসিয়াল প্যাডে একটি চিঠি পান।
দিলীপ চন্দ লিখেছেন, ‘প্রিয় চেয়ারম্যান সাহেব, আপনার-ইউপি চেয়ারম্যান-কালু-সোমেন্দ্রের কথা কখনও ভুলবো না। তারপরও বলি, যে তের শতাংশ জমির জন্য জগদীশ কাকা খুন হয়েছেন, সেই জমিটুকুর বিহিত করেই আপনাকে লিখছি। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। কাকাও শিক্ষিতজন। সর্বজন পূজনীয়। উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার কিছু কর্তব্য আছে। আগামী এক বছরের মধ্যে ওই জমির ওপর তপোতোষ-জগদীশ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। নির্মাণে টাকা ভারত সরকার দেবে। আগামী বছর জ্যোতি বাবু যখন বাংলাদেশ সফরে যাবেন, স্কুলটির উদ্বোধন তিনিই করবেন। বিষয়টি রাষ্ট্রীয়। ইউপি চেয়ারম্যান সাহেবকে বলবেন, ‘মানুষের মৃত্যুর ভার বইতে হয়। নইলে অনুতপ্ত হতে হয়। এই দহনে শান্তি চলে যায়।’
দ্বিতীয় চিঠি পায় পল্টু শেখ। প্রিয় পল্টু ভাই, আমি শুধু আপনাকে-বৌদিকে মনে রেখেছি। আমি রাজনীতি করি। এর কূটকৌশল আমার জানা এবং এও জানি কাকাকে কে খুন করেছে, কী জন্য করেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, তের শতাংশ জমি আমি আপনাদের দিয়ে দেব। নেতাদের লোভ দেখে মনে হয়, আপনাদের দিলে হজম করতে পারবেন না। তাই আমি রাহেলা বৌদির কথা রেখেছি। তার কণ্ঠ আমার মা’র মতোন। আগামী বছর আপনার স্কুল দেখতে আসব। আমাকে পায়েস খাওয়াবেন। স্কুল উদ্বোধনের দিন আপনি এবং রাহেলা বৌদি আমার পাশে বসবেন। সেদিন নিজকে দেশান্তরী মনে হবে না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *