short-story-farihar-jonmodin

ফারিহার জন্মদিন
রাসয়াত রহমান জিকো


শিল্পপতি আমিনুল ইসলামের মেজাজ আজ অনেক খারাপ। এক জীবনে তিনি যা অপছন্দ করেছেন আশেপাশে তাই ঘটতে দেখে বিরক্ত। তিনি গ্রামের কৃষকের ছেলে ছিলেন সেখান থেকে কঠোর পরিশ্রম করে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। নিজে ইন্টার পাস। বিবিএ এমবিএ করা লোকেরা তাকে স্যার স্যার ডাকেন। তাঁর সব কিছু যে শরীফ সামলায় তাকে বলা হয় সিএসও, সেটার পুরা মানে কি সেটাও আমিনুল সাহেব কখনো জানার চেষ্টা করে নি। তিনি ঢাকা আসার পর ছোট খাটো কাজ করেছেন অনেক, কিন্তু চোখ রেখেছেন উপরে। গ্রামের অনেক কিছু বেচে ছোট এক জমি কিনে গার্মেন্টস ব্যবসা খুব অল্পতে শুরু করেন। এর আগে নিজেই বায়িং হাউজে কাজ করতেন। এক সময় ব্যবসা ধরে ফেলেন। আজ শুধু গার্মেন্টসই তাঁর আছে ছয়টা। তৈরী পোশাক বিদেশে রপ্তানী করার জন্য বিদেশি বায়ার খুঁজতে হয়। এক শ্রীলংকানকে চাকরিতে রেখেছেন নাম চিন্নাহাম। এই চিন্নাহাম সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে। খালি ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সঙ্গে জিতলে দাঁত বের করে হাসে। আমিনুল ইসলাম ক্রিকেট দেখেন না, কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশ হারবে এটাও তাঁর পছন্দ না।

আমিনুল ইসলামের মেজাজ খারাপের মূল কারণ তাঁর ষাটতম জন্মদিন পালনের জন্য তাঁর ছেলে মেয়েরা হাউকাউ শুরু করে দিয়েছে। তিনি আজ যত টাকার মালিকই হোন না কেন অপচয় পছন্দ করেন না। তাঁর ছেলে মেয়ের সেই বোধ নেই। ছেলে দুই দিন পরপরেই গাড়ির মডেল চেঞ্জ করলে তিনিবিরক্ত হন। নিজে লেখাপড়ায় বেশি না আগালেও এর গুরুত্ব বুঝেন। মেয়ে নাকি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে ইনফ্লুয়েন্সার হবে দেখে। তিনি নিজেও বেশি লেখাপড়া ছাড়া সফল ব্যবসায়ী হলেও মনে করেন যে যাই হোক লেখাপড়ার দরকার আছে। আমিনুল ইসলাম সাহেবের সামনে এখন ল্যাপটপ। চিন্নাহাম একেকটা ই-মেইল খুলে পড়ছে। তার ইংরেজিকে বাংলায় অনুবাদ করছে শরীফ। আমিনুল ইসলাম বিরক্ত হচ্ছেন। এই দুই গাধা এখনো পর্যন্ত কোনো জরুরী ই-মেইল বের করতে পারেনি। তিনি ভাবলেন শুধু লেখাপড়ার পাশপাশি বাস্তব জ্ঞানেরও একটা কম্বিনেশন দরকার।

ফারিহার বয়স আট বছর হতে ঠিক তিন দিন বাকি আছে। জন্মদিন তার কখনো হয় নি। সে থাকে তাঁর মায়ের সঙ্গে। বাবা নেই। এই অল্প বয়সে ফারিহা অনেক কঠিন কঠিন কথা শোনে। যেমন তাঁর জীবন অন্যদের মত না। অন্যদের শখ পূরণের জন্য বাবা থাকে ওর নেই। এটা সেটা আবদার সে তাই কাউকে করে না। মা বলে আমি তোমাকে লেখাপড়াই করাতে পারব এর বাইরে কিছু করার সামর্থ্য নেই। এদিকে ফারিহার স্কুলে আজ ঘটে গেছে এক কাহিনি। ফারিহার বন্ধু নিলইয়ের জন্মদিন সাত দিন পর। সে বার্থডে কার্ড বানিয়ে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে ফারিহাকে ছাড়া। ফারিহার জন্মদিনে নাকি কাউকে দাওয়াত দেয় না তাই ফারিহাকে নিলয় দাওয়াত দেবে না। ফারিহা বোঝাতেই পারে না যে, তাঁর জন্মদিন হয়ই না কারণ তাঁর বাবা নেই, আর মায়ের কাছে এত টাকা থাকে না জন্মদিন পার্টি করার মত। ফারিহা খুব মন খারাপ করে বসে ছিল তাঁর মায়ের কাছে। মা ল্যাপটপে কিছু করছেন। হঠাৎ মা বললেন, আমি যাচ্ছি খাবার রেডি করতে ফারিহা তুই হোমওয়ার্ক করো। ফারিহা মন খারাপ করে কি জানি লেখালেখি করল। ল্যাপটপেই টিপাটিপি করে লিখা। উঠার সময় কি জানি চাপও পরে গেল।

আমিনুল ইসলামের মেজাজ আরও খারাপ। তাঁর ছেলে নাকি ঠিক করেছে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে হেলিকপ্টারে করে নেবে। আমিনুল ইসলাম বললেন, আমার কি বিয়া নাকি হেলিকপ্টারে করে যাব? ফাজিল কোথাকার? এদিকে আজকে চিন্নাহাম জানাল ইউরোপের কয়েক দেশে অর্ডার পাওয়া গেছে কাপড় রেডি করতে। কিন্তু শ্রমিকরা নাকি স্ট্রাইক করছে। আমিনুল ইসলাম বলেন এই হচ্ছে দেশের সমস্যা। লাই দিলে মাথায় ওঠে। এর মাঝে চিন্নাহাম ই-মেইল খুলছে আর শরীফ তা বাংলায় অনুবাদ করছে। হঠাৎ এক ই-মেইল দেখে আমিনুল ইসলাম বলেন এটা কি? এই ই-মেইল খুললো না কেন? শরীফ বলে, স্যার এগুলা জাংক ই-মেইল। ক্রেডিট কার্ডের অফার নিয়ে ই-মেইল। আমিনুল ইসলাম, দেখি খুল, কখনো দেখি নাই কি লিখে। খুল দেখি। ই-মেইল খোলা হলো। আমিনুল ইসলাম বলেন, কি লেখা? স্যার কোন গন্ডগোল হয়িছে, ফারিহা নামের এক বাচ্চা বলতেছে তাঁর জন্মদিন হয় না তাই সে খুব মন খারাপ। নিলয় দাওয়াত দেয় নাই। আমিনুল ইসলাম আরও খেপে গেলেন, ধুত্তারিকা ছাতা মাথা। আবার জন্মদিন। এই ই-মেইল কোন ব্যাংক থেকে আসছে খবর নাও। সেখানে আমার সব অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করো।

ফারিহার মা অফিসে গিয়ে জানলেন তাঁর চাকরি নেই। তাঁর অফিসিয়াল যে ই-মেইল যেখান থেকে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য যাওয়ার কথা সেখানে ক্যাজুয়াল ই-মেইল চলে যাওয়ায় ক্লায়েন্ট মনক্ষুন্ন হয়েছে। ফারিহার মা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এগুলা কীভাবে হলো!

আমিনুল ইসলামের জন্মদিনের আগের দিন একটা ভাল খবর পেলেন। শ্রমিকরা পুরোদমে কাজ করতেছে আর নতুন আরো অর্ডার পাওয়া গেছে। আমিনুল ইসলাম বললেন, শরীফ তুমি কাকতালীয় বিশ্বাস করো? শরীফ বলল, জি না স্যার। একদমই করি না। আমিনুল ইসলাম, কেন বিশ্বাস করো না? হয় মাঝে মাঝে। আমার মনে হয় ওই ই-মেইলের সঙ্গে অর্দার ঠিক হওয়ার সম্পর্ক আছে। শরীফ বলেন, এগুলা কি বলেন স্যার? বেশি কথা বইলো না। ব্যবস্থা নিতে বলছিলাম নিছ? জি স্যার, ফারিহার মায়ের চাকরি নট করা হয়িছে। বল কি? ই-মেইল এরকম করছিল কেন? স্যার আসলে ইমেইল করেছিল ফারিহা নামের ৮ বছরের এক মেয়ে। মেয়েটার বাবা নেই। তাঁর জন্মদিন কেউ পালন করে না। বন্ধু-বান্ধবের জন্মদিনে দাওয়াত পায় না। আমিনুল ইসলাম বললেন, ভেরি স্যাড। এক কাজ কর। আমার অপদার্থ ছেলে মেয়েকে দেখা করতে বলো।

ফারিহার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে বিরাট বড় কমিউনিটি সেন্টারে। স্কুলের সব ক্লাসের সবাই এসেছে। বিরাট আয়োজন। ফারিহার মায়ের চাকরি ফেরত পাওয়া গেছে। পুরা আয়োজন করেছেন আমিনুল ইসলাম। তবে তিনি বেশিক্ষণ ছিলেন না, দশ মিনিট ফারিহার সঙ্গে দেখা করেন, বলেন, মা দুনিয়াতে অনেক শিশু আছে ঠিকমতো খেতেও পায় না। সেখানে জন্মদিন করা এমন জরুরী কিছু না। তারপরেও আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা দিছে একজন শিশুর মন ভাল করে দেওয়ার। আমি দিলাম। তুমি যখন বড় হবা, তুমিও এরকম কিছু শিশুদের মন ভাল করে দিও।

কুড়ি বছর পরের কথা। আমিনুল ইসলাম বেঁচে নেই। তবে আমিনুল ইসলামের নামে একটি হাসপাতাল করা হয়েছিল তাঁর ইচ্ছায়। ডাক্তার ফারিহা সেখানে খুব জনপ্রিয়। গরীব শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়াতে তাঁর খ্যাতি আছে। জন্মদিনও সে আর পালন করে না। কোনোরকমে কেক কেটেই ছুটে যান কোনো অসুস্থ শিশুকে চিকিৎসা দিতে।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *