মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় স্ক্রিপ্টরাইটার আমাদের জন্য কী চিত্রনাট্য সাজিয়ে রাখেন তা আগে থেকে বোঝা ভার। নইলে এত বছর পর সঞ্চারীর সঙ্গে যে লিভালপুলের মত জায়গায় এসে দেখা হয়ে যাবে সেটা কি কখনও কল্পনা করেছিলাম আমি!
সঞ্চারী গোস্বামী আমার প্রাক্তন ছাত্রী। বকুলতলা গার্লস স্কুলের ক্লাস ইলেভেনে আমি ছিলাম ক্লাসটিচার। ভীষণ ফর্সা আর অতিরিক্ত রকম রোগা সঞ্চারী ক্লাসঘরের শেষ বেঞ্চে বসত। বেগুনি পাড় সাদা শাড়িটা যেমন তেমন করে পরা, চুল অবিন্যস্ত, দু’চোখে একটা অদ্ভুত চাউনি। আমি যখন ক্লাসে নিবিষ্ট হয়ে শেলি, কিটস, বায়রন বা শেক্সপিয়ার পড়াতাম, গোটা ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার পড়া শুনত, তখন সঞ্চারী অপ্রকৃতিস্থের মতো তাকিয়ে থাকত বেঞ্চের দিকে। কী সব বিড়বিড় করত আর বেঞ্চের ওপর ইরেজার ঘষে চলত। আমি পড়ানো ছেড়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। তাতেও সঞ্চারীর হুঁশ ফিরত না। গোটা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠত মজা পেয়ে। সঞ্চারী সচকিত হয়ে মুখ তুলত। তখনও তার দু’চোখে লেগে থাকত ঘোর অন্যমনস্কতা।
জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে শহরতলির দিকে এই স্কুল। জলপাইগুড়ির অনতিদূরে বেলাকোবা নামে একটা ছোট্ট রেলস্টেশন আছে। সেই স্টেশনের পাশেই সঞ্চারীদের বাড়ি। স্কুল থাকলে সকালের ট্রেন ধরে সঞ্চারী জলপাইগুড়ি পৌঁছত। বিকেলের ট্রেনে বাড়ি ফিরত। মেধাতালিকায় এই স্কুলের মেয়েরা থাকে না কখনও। তবে বকুলতলা স্কুল থেকে আগের বছর মাধ্যমিকে যে হাতে গোনা কয়েকটি মেয়ে স্টার পেয়েছিল সঞ্চারী ছিল তাদের মধ্যে একজন। সেই মেয়ে ক্লাস ইলেভেনে এসে হঠাৎ বদলে গেল। পড়াশোনায় মন নেই। এক কথা জিজ্ঞেস করলে অন্য জবাব দেয়। সবসময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। যখন সঞ্চারী খারাপ থেকে খারাপতর অবস্থায় চলে গেল তখন ডেকে পাঠালাম ওর বাড়ির লোককে।
তলব পেয়ে সঞ্চারীর বাবা এলেন। সাধন গোস্বামী হাফ পাঞ্জাবি আর খেটো ধুতি পরা মাঝবয়সী মানুষ। জীবনবিমার এজেন্সি করেন। অল্প কিছু জমিজিরেত আছে। সাধনবাবু বললেন, “সঞ্চারীর কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছি। কিন্তু সে তো মুখ ফুটে কিছুই বলে না।”
আমি বললাম, “আপনারা গায়ে হাত টাত তোলেননি তো? এই অ্যাডোলোসেন্স পিরিয়ডে কিন্তু…”,
আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন, “সঞ্চারী লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। তাকে বকাঝকা করার প্রশ্ন ওঠে না।”
সঞ্চারীর বাবার সঙ্গে আরও কথা হল। জানা গেল বাড়িতে তাঁরা তিনটি মাত্র প্রাণী। সাধনবাবু আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই নির্বিরোধী মানুষ। ওঁদের ভক্তিমার্গের বাড়ি। কীর্তন হয় রাসপূর্ণিমার সময়। বাড়িতে অষ্টপ্রহরের আয়োজন করেন নিয়ম করে। গোস্বামীবাড়িতে উঁচু গলায় কেউ কথা বলে না। তার প্রয়োজনই পড়ে না।
খটকাটা বেড়ে গেল। প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে বলেই কি ভেঙে পড়েছে সঞ্চারী? আমি তখন ছাব্বিশ সাতাশ। ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুদের মতো মিশি। আমার কথায় মৌমিতা ফিক করে হেসে বলেছিল, “ধুস কী যে বলেন স্যার, ওর মতো মেয়ের সঙ্গে কোন ছেলে প্রেম করবে!”
কথাটা ফেলে দেবার মতো নয়। সঞ্চারী সবসময় একটা খোলসের মধ্যে গুটিয়ে রাখে নিজেকে। তার বয়সি আর পাঁচটা মেয়ের মতো মিশুকে নয়। স্কুলে তার বন্ধুও দেখি না তেমন। সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলে আসে ম্যাটম্যাটে রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। লিপস্টিক অবধি ছোঁয়াতে দেখিনি কখনও। ভাবলাম, মেয়েটাকে কেউ মলেস্ট করেনি তো? মুখোশধারী আত্মীয়স্বজন থাকে অনেক। তাদের কুকীর্তির কথা অনেক সময় ভিকটিম সঙ্কোচ করে বাড়িতে বলতেও পারে না। সঞ্চারীর বাবা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আমার সন্দেহটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলাম। কোনও আত্মীয়স্বজন পা রাখে না গোস্বামীবাড়িতে।”
আমি বললাম, “ওর প্রাইভেট টিউটর ক’জন? সেখানে আবার কিছু…।”
সঞ্চারীর বাবা বললেন, “সায়েন্স আর আর্টস গ্রুপের দুজন টিচার আছে। বাড়িতে এসে পড়ায়। অন্য স্কুলের আর একজন মেয়ে আছে আমাদের ওদিকে। ওরা একসঙ্গে পড়ে।”
আমি বলেছিলাম, “উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার চাপ অনেক বেশি। হতে পারে যে, পড়ার চাপ সামলাতে না পেরে সঞ্চারী ভেঙে পড়েছে। অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে। ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।” সাধনবাবু বললেন, “ওকে কলকাতা নিয়ে যাব ভেবেছি। তবে আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। হার্টে গণ্ডগোল ধরা পড়েছে। লোকাল ডাক্তার বলছে ভাল জায়গায় দেখাতে। সমস্যা হল হাতে বিশেষ টাকাও নেই। যা পুঁজি ছিল সব চিটফান্ডে ঢুকিয়েছিলাম। সেই কোম্পানি উঠে গেছে। তার পর থেকেই হার্টের অসুখটা ধরেছে। এখন ধারবাকি করে দেখি কতটা কী…।” বিমর্ষ মুখে চলে গিয়েছিলেন সাধন গোস্বামী।
সে দিনই শেষবার সঞ্চারীকে আমি দেখি। এর পরদিন থেকে সে আর স্কুলে আসেনি। আমাদের স্কুলে স্টুডেন্টদের ড্রপআউট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। স্কুলে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যায় অনেকের। পড়ার খরচ সামলাতে না পেরে পড়া ছেড়ে দেয় কেউ কেউ। একদিন জানা গেল ওরা বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে কলকাতায়। টিচার্স কমনরুমে ক’দিন আলোচনা হল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব থিতিয়ে গেল। সেই সঞ্চারীর সঙ্গে দশ বারো বছর পর বিলেতের মাটিতে দেখা হয়ে গেল হঠাৎ করে।
আমি বেড়াতে ভালবাসি। সুযোগ পেলেই ব্যাকপ্যাক কাঁধে বেরিয়ে পড়ি। প্ল্যান করে রেখেছিলাম, রিটায়ারমেন্ট বেনফিটের থোক টাকা ভাঙিয়ে একবার অন্তত বিদেশ বেড়াতে যাব। সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া নয়, যাব এশিয়ার বাইরে কোথাও। সেই স্বপ্ন অবশেষে পূর্ণ হল। ভ্রমণের জন্য গাঁটের কড়িও খসাতে হল না। একটা স্কলারশিপ পেয়ে দেশের হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে একটা কর্মশালায় অংশ নেবার জন্য টেমসের তীরে আসার সুযোগ পেয়েছি। অন্য দেশ থেকেও এসেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতীরা। লন্ডন শহরে এক সপ্তাহের ওয়ার্কশপ গতকাল শেষ হয়েছে। এখন দেশে ফিরে যাওয়ার আগে দুটো দিন আমাদের ঘুরে বেড়াবার পালা।
শ্রেয়ার সঙ্গে একসময় আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এখন ব্রেক আপ হয়ে গেছে। শ্রেয়ার দাদা প্রিয়াঙ্কদা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কাজ করে। ওদের চাকরির একটা বড় সুবিধে হল বিশ্বের নানা দেশ ঘোরার সুযোগ পাওয়া যায়। প্রিয়াঙ্কদাকে দেখতাম বছরভর চক্কর মারছে পৃথিবীর নানা দেশে। আজ হেলসিঙ্কি তো কাল জুরিখ, পরশু স্টকহোম তো তরশু বার্সিলোনা। আমি স্বল্পবিত্তের মানুষ। ইচ্ছে থাকলেও সে উপায় নেই। শ্রেয়া মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে বলত, “তুমি প্রেসিডেন্সি থেকে মাস্টার্স করে বেরিয়েছ অথচ একটা কলেজের চাকরি অবধি জোটাতে পারলে না। তোমার মধ্যে অ্যাম্বিশনের ছিটেফোঁটাও যদি থাকত!” শ্রেয়া উচ্চাকাঙ্খী। কয়েক বছর আমাকে সহ্য করার পর বেচারি হাল ছেড়ে দেয়। আমাদের সম্পর্কটা যে টিকবে না সেটা আগেই আঁচ করেছিলাম। অশক্ত বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে বাড়ির বাইরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই স্কুলের শিক্ষকতার চাকরিটা জুটে যাবার পর অন্য কোথাও চেষ্টাও করিনি। শ্রেয়া রেগে গিয়ে বলত, “তুমি একটা ইনকরিজিবল ক্রিয়েচার। এই বাজারেও ওল্ড ভ্যালুজ আঁকড়ে পড়ে আছ!”
শ্রেয়া সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। ওর প্রপিতামহ মহীতোষ রায়চৌধুরী ছিলেন খুলনা নাকি বরিশালের জমিদার। সেই আমল থেকে ওদের বাড়িতে ফি বছর দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। পূর্ববঙ্গ থেকে জলপাইগুড়িতে চলে আসার পরও সেই ট্র্যাডিশন এখনও ধরে রেখেছে ওরা। পরিবারের যে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বছরের সে সময়টা জড়ো হয় জলপাইগুড়িতে। প্রিয়াঙ্কদা দিলদার লোক। সকলের জন্য উপহার নিয়ে আসে। পুরুষদের বরাতে জোটে ব্র্যান্ডেড টি শার্ট, স্কচ, বিদেশি সিগারেট। মহিলাদের জন্য আসে পোশাক-আসাক, দামি হ্যান্ডব্যাগ, বিখ্যাত কোম্পানির পারফিউম। মোটা পে প্যাকেজের জন্য ততটা না হলেও নিয়মিত বিদেশ যাওয়ার সৌভাগ্যের কারণে আমি প্রিয়াঙ্কদাকে ঈর্ষা করি। বিলেতের মাটিতে পা রাখার পর সেই গোপন ঈর্ষাটাকে অ্যাভন নদীর জলে ফেলে দিলাম। আসলে আমার মনটা খুশি খুশি হবার আর একটা কারণ আছে। শ্রেয়ার কাছে না হোক নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণের দায়ও তো আমার একটা ছিল। এঁদো স্কুলের একজন শিক্ষক হয়েও স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন আসাটা বড় কম কথা নয়।
সাউথ প্লেস হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। সকলের মধ্যেই একটা হৃদ্যতা তৈরি হয়ে গেছে। দেশোয়ালি ভাই হলে অন্তরঙ্গতা গাঢ় হয়। চেন্নাইয়ের সুধীর রঙ্গনাথন আর পবন কৃষ্ণমূর্তি দেখছি সবসময় পরস্পরের গায়ে সেঁটে থাকছে। দিল্লির ইশা খান্ডেলওয়াল আর বিপাশা চোপরা এমন ভাব করছে যেন তারা কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া দুই বোন। আমি ছাড়া এই টিমে বাঙালি বলতে একমাত্র পামিরা মিত্র। কানপুরের প্রবাসী বাঙালি। প্রসাধনের পরোয়া করে না। সপ্রতিভতাই এই মেয়ের প্রসাধন। পোনিটেল করা চুল, কাটা কাটা চোখমুখ, পাতলা ঠোঁট, টকটকে গায়ের রঙ, অ্যাথলিটদের মত চেহারা। ত্রিশের কিছুটা কম হবে বয়স। কনভেন্টে পড়েছে বলেই হয়তো ইংরেজি বলে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে। কানপুরের একটা নামী স্কুলে পামিরা পড়ায়। আমাদের প্রথমদিকে হাই হ্যালো চলছিল, তবে শেষদিকে এসে সখ্য গাঢ় হয়েছে পামিরার সঙ্গে। আমার সঙ্গে আধো আধো বাংলা বলছে পামিরা। বেশ লাগছে শুনতে।
পামিরা ডুয়ার্সের কথা জানে। বলেছে সময় সুযোগ পেলে একবার বেড়াতে আসবে এদিকে। জলপাইগুড়ি শহরটাকেও দেখবে। পামিরা খোলা মনের মেয়ে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রাখঢাক নেই। কথায় কথায় বলল ওর একজন স্টেডি বয়ফ্রেন্ড ছিল। প্রীতম ব্যানার্জী। ভাল ক্রিকেট খেলত। দলীপ আর রঞ্জি ট্রোফিতে ঝুড়ি ঝুড়ি রান আছে। পরের বছর আইপিএল খেলার কথা। হায়দ্রাবাদ ফ্র্যাঞ্চাইজির এক স্পটার যোগাযোগও করেছিলেন। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের একটা ম্যাচ চলাকালীন মাঠেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে প্রীতম মারা যায়। হাসপাতালে যাবার সময় পাওয়া যায়নি। প্রীতমের সঙ্গে একসঙ্গে তোলা একটা ছবি ফেসবুকের ডিপি করেছিল পামিরা। একবছর হয়ে গেছে সেটা এখনও বদলায়নি।
উদ্যোক্তারা আমাদের ঘুরিয়ে এনেছেন এখানকার দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো। বিগ বেন, ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে, টেন ডাউনিং স্ট্রীট, সেন্ট জেমস পার্ক, বাকিংহ্যাম প্যালেস দেখা হয়ে গেল এক এক করে। কখনও হাঁটা পথে কখনও মেট্রোয় চড়ে ঘুরে বেড়ালাম আমরা। যেখানেই যাই না কেন, চারদিকে এক আনন্দঘন পরিবেশ। ক্রিসমাস সমাসন্ন যে! ফেরার আগের দিন পামিরা বলল, “প্রীতমের দাদা ঋতম ইঞ্জিনিয়ার। লিভালপুলে থাকে। ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব ভাবছি। লন্ডন থেকে ট্রেনে সোয়া দু’ঘণ্টার পথ। তুমি কোম্পানি দেবে আমাকে?” পামিরা তুখোড় সুন্দরী না হলেও নতুন একটা জায়গা দেখার লোভে আমি রাজি হয়ে যেতাম। হেসে বললাম, “হোয়াই নট!”
ভিক্টোরিয়া টিউব স্টেশন জুড়ে দেখছি ক্রিসমাস লাইটের আলোকঝরনা। চারদিকে ছড়িয়ে আছে ক্রিসমাস ট্রি। আমি আর পামিরা হাঁটছি। অল্পবয়সী তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের পাশ দিয়ে। তাদের গায়ের জাম্পারে বলগাহরিণ আর আইসম্যানের ছবি। এই উৎসব উৎসব পরিবেশের কথা শুনেই এসেছি এতকাল। দুটো হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বড় করে শ্বাস নিলাম। মনটা আনন্দ আর উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে শুরু করল। আমাকে দেখে পামিরা খিলখিল করে হেসে বলল, “শাহরুখ খানকে কপি করছ বুঝি?”
লম্বা মেপল আর বার্চ গাছের সঙ্গে মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। স্লেট পাথরের ঢালু ছাদ। মাথা উঁচিয়ে আছে লাল চিমনি। পাথুরে ছাই ছাই দেওয়াল আঁকড়ে উঠেছে আইভিলতা। সাদা রং করা জানলা-দরজা। যত্নের বাগান সামনে। ফুলের কেয়ারি আর গাছপালার মধ্যিখানে এক টুকরো সবুজ ঘাসজমি। বসার জন্য সাদা রং করা রট আয়রনের বেঞ্চ। সীমানায় নরম কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পিকেট ফেন্স জানান দিচ্ছে এই বাড়ির সীমানা। সিনেমায় বিলিতি বাংলো যেমন দেখায় এই বাড়িটা ঠিক তেমন।
ডোরবেল বাজাল পামিরা। ট্র্যাকপ্যান্ট আর হলদে জাম্পার পরা সুঠাম দেহের এক যুবক নিজে দরজা খুলে দিল। ঋতম হাগ করল পামিরাকে। পামিরা পরিচয় করিয়ে দিল আমার সঙ্গে। ঋতম আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল ‘হ্যালো’। আন্তরিক গলায় বলল ভেতরে আসতে। ঘরের ভেতরে ঢুকে মনে হল ভিক্টোরিয়ান আমলে পৌঁছে গেছি। টানা করিডর। কাঠের সিঁড়ি। বিশাল লিভিং রুম। ওদিকে ডাইনিং হল। পাশ দিয়ে প্যান্ট্রি, কিচেনে যাবার দরজা। অন্য মাথায় একটা ওপেন ফায়ারপ্লেস, মাথায় চিমনির টুপি। তার পাশে একটা বেতের সোফা। মেঝে থেকে সিলিং অবধি কাঠের পাল্লা আর কাচের শার্সি।
আমাদের সোফায় বসিয়ে ঋতম হাঁক দিয়ে ডাকল স্ত্রীকে। খয়েরি হাউসকোট পরা একটি ঝলমলে মেয়ে ঘরে এল। লম্বা একহারা চেহারা, স্টেপকাট করা চুল, আমার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হল মেয়েটির। একটা ঝাঁকি খেলাম। চোখ গোল গোল করে বললাম, “হোয়াট আ সারপ্রাইজ… সঞ্চারী না!”
সঞ্চারী হাঁ হয়ে গেছে আমাকে দেখে। বিস্ময় সামলে একরাশ খুশি উপচে পড়ল তার গলায়। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, “স্যার আপনি একরকম আছেন এখনও। শুধু একটু মোটা হয়েছেন আর চুল একটু কমেছে।”
আমি হেসে বললাম, “তাহলে আর একরকম থাকলাম কোথায়! এবার বল, কেমন আছিস তুই?”
ঋতম আর পামিরা দু’জনেই অবাক হয়ে দেখছে আমাদের। পামিরা আমাকে বলল, “ডু ইউ নো ইচ আদার?”
কী বলব? দশ বারো বছর কি অনেকটা সময়? এর মধ্যে আমাদের স্কুলের ক্লাসঘরে নতুন রঙের প্রলেপ পড়েছে। এগারোর ছাত্রীদের মুখগুলো বদলে গেছে। কিন্তু আমি চোখ বুজলেই এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই ক্লাসঘরের শেষ বেঞ্চে বেগুনি পাড় সাদা শাড়ি পরা ভীষণ ফর্সা আর রোগা এক কিশোরী বসে আছে। মুখ নিচু করে প্রাণপণে ইরেজার দিয়ে বেঞ্চ থেকে ঘষে ঘষে কী যেন মোছার চেষ্টা করছে। মেয়েটির কান্ড দেখে গোটা ক্লাস ফেটে পড়ছে হাসিতে। মেয়েটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কয়েক সেকেন্ড লাগল সম্বিত ফিরতে। ওদের দিকে ফিরে বললাম, “শি ইউজড টু বি মাই স্টুডেন্ট। আমি যে স্কুলে পড়াই সঞ্চারী সেখানে পড়ত একসময়।”
ঋতম আর পামিরা সবিস্ময়ে বলল, “তাই!” আমাকে অপ্রস্তুত করে সঞ্চারী ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিল আমার পায়ে। পারফিউমের মিষ্টি একটা গন্ধ এসে আমার নাক ছুঁয়ে গেল। সঞ্চারী মুখ তুলে বলল, “ভাল আছি স্যার। আপনি ভাল আছেন তো?”
কালো সরু আইলাইনার সঞ্চারীর চোখদুটোকে স্পষ্ট করেছে। আমি ক্লাস ইলেভেনের সেই অগোছালো স্কুলছাত্রীর সঙ্গে এই স্টাইলিশ মেয়েটিকে পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে দেখছিলাম। অতলান্ত স্পর্শ করা বিস্ময় ক্রমশ আমাকে ছেয়ে ফেলছিল। কোনও এক মিডাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেছে এই মেয়েটিকে। বদলে দিয়েছে আগাপাশতলা।
ঋতমের কোনও জরুরি ফোন এসেছে। “এক্সকিউজ মি” বলে ঘরের কোণের দিকে সরে গেল। ল্যাপটপ খুলে মনিটরে চোখ রেখে মৃদু গলায় অফিস সংক্রান্ত কথা বলতে লাগল কারও সঙ্গে। ভেতরে ভেতরে আমার কৌতূহল বাড়ছিল। যে মানসিক বিপর্যস্ত দশায় সঞ্চারীকে আমি দেখেছি সেই ফেজ সে কাটিয়ে উঠল কী করে! সঞ্চারীকে বললাম, “তোর বাবা-মা কেমন আছেন?”
সঞ্চারী বলল, “যেদিন বাবাকে স্কুল থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল তার পরদিন বাবা মারা গিয়েছিল। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। বাবা চোখ বোজার পর মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। শ্রাদ্ধে শুধু কলকাতা থেকে আমার ছোটমামা এসেছিল। সে সময় আমিও একটা দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছি। এভাবে চলল কিছুদিন। এক প্রতিবেশীকে বাড়ি আর জমিজমা বিক্রি করে আমাকে নিয়ে মা চলে এল কলকাতায়। ছোটমামা বাইপাসের ধারে একটা প্রাইভেট হসপিটালে চাকরি করে। কসবায় ছোটমামার কাছে গিয়ে উঠলাম প্রথমে। কসবাতেই একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট সেকেন্ড হ্যান্ডে কিনলাম আমরা। ওদের হসপিটালেই ডক্টর বামনদেব ব্যানার্জী নামে একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাবার ব্যবস্থা করে দিল ছোটমামা।”
আমি আর পামিরা মন দিয়ে সঞ্চারীর কথা শুনছি। পামিরা নড়েচড়ে বসে বলল, “তারপর?”
সঞ্চারী বলল, “ডক্টর ব্যানার্জী আমার জীবন বদলে দিলেন। নিয়মিত কাউন্সেলিং করতেন। আমাকে মেয়ের মতো ভালবাসতেন। পরের দিকে একটা টাকাও ভিজিট নিতেন না। আমার মাথার সমস্ত জট খুলে দিলেন উনি। ধীরে ধীরে ফিরে এলাম স্বাভাবিক জীবনে। ভর্তি হলাম ক্লাস ইলেভেনে। দুটো বছর খেটে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলাম। কলেজে পড়লাম। কলেজ থেকে বেরিয়ে মাস্টার্স করলাম। হারানো আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে ফিরে এল। এই লম্বা সময়টায় কেমন আছি না আছি জানিয়ে ডক্টর ব্যানার্জীকে ফোন করতাম। একদিন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে মায়ের সঙ্গে গেলাম ওঁর বাড়িতে। স্বপ্নেও ভাবিনি সেদিন ডক্টর ব্যানার্জী আমার মায়ের কাছে আমাকে পুত্রবধূ করার প্রস্তাব দেবেন!”
ঋতমের অফিসের কাজ শেষ হয়েছে। ফোন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে এদিকে এল। হেসে বলল, “আমি তখন অন্য একটা কোম্পানিতে চেন্নাইতে পোস্টেড। বাবা ফোন করে বলল তোর জন্য মেয়ে দেখেছি। তুই কলকাতায় এসে তার সঙ্গে দেখা কর। ইভেনচুয়ালি আই মেট সঞ্চারী। কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় আমাদের। বিয়ের পর পুরনো কোম্পানি বদলাই। নতুন অফিস আমাকে পাঠিয়েছে লিভালপুল।”
সঞ্চারী চলে গেল চা করতে। পালিশ করা কাঠের মেঝে। তিব্বতি নকশা করা উলের কার্পেট। দেওয়ালে ম্যান্টল ক্লক সুরেলা গলায় ঘণ্টা দিয়ে জানিয়ে দিল বিকেল চারটে বাজল। ঘরের একদিকে জানলার ধারে রাইটিং ডেস্ক আর চেয়ার। অন্যদিকে জানলার পাশে একটা নিচু আর লম্বাটে টেবিল। তার দু’দিকে বেঁটে চেয়ার। এটা বোধহয় চা খাওয়ার জায়গা। সেদিকে তাকিয়ে আমি পুরনো কথা ভাবছিলাম। সেই সঞ্চারীর সঙ্গে আজকের এই সঞ্চারীর আকাশপাতাল তফাত। ডক্টর বামনদেব ব্যানার্জীকে একটা প্রণাম করতে ইচ্ছে করল। আমি বললাম, “দেশে যাওয়া হয় না?”
ঋতম বলল, “বছরে একবার দেশে যাই। আমার ভাই প্রীতমের কথা হয়তো আপনি শুনেছেন। খুব ভাল ক্রিকেট খেলত। প্রীতম অসময়ে চলে গেছে। এদিকে আমরা এখানে। ফলে আমার বাবা-মা নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। ওঁদের সঙ্গে কানপুরে গিয়ে ওরা কয়েকটা দিন থাকি। কলকাতাতেও যাই কয়েকটা দিনের জন্য। এই তো এবারও পুজোর সময় গিয়েছিলাম আমরা দু’জনে।”
সঞ্চারী চা নিয়ে এসেছে। জার্মান সিলভারের ট্রে। ফিন ফিনে বোন চায়নার কাপ-প্লেট। স্কটিশ চেক চেক নকশা করা ফ্লানেলের টি কোজি ঢাকা দেওয়া জার্মান সিলভারের টি পট। দুধ আর চিনি আলাদা পাত্রে। আমি আর পামিরা বসেছি পাশাপাশি। আমাদের উল্টোদিকে ঋতম আর সঞ্চারী। টি পট থেকে কাপে লিকার চা ঢালল পামিরা। আমি ইশারায় দুধ আর চিনি দিতে বারণ করলাম ওকে। সঞ্চারীকে জিজ্ঞেস করলাম, “তখন তোর কাছে বহু বার জানতে চেয়েছি কারণটা। তুই বলিসনি। বলার মতো অবস্থা তখন ছিল না। অ্যাকচুয়ালি তোর কী হয়েছিল বল তো?”
সঞ্চারী একবার তাকিয়ে নিল ঋতমের দিকে। তারপর বলল, “স্যার আপনার কাছে ঘটনাটা খুবই সামান্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কোন ঘটনা কোন মানুষকে যে ছিন্নভিন্ন করে দেবে সেটা আগে থেকে বলা যায় না। সেটা প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা মানুষের সহ্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। তখন আমি সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। দুনিয়াদারির বোধ তৈরি হয়নি। আপনি তো আমাকে দেখেছেন স্যার, ছোটবেলা থেকেই আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট। লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। আমার বন্ধু ছিল না একজনও। না পাড়াতে, না স্কুলে। আমি ছিলাম চূড়ান্তরকম আত্মবিশ্বাসহীন একটি মেয়ে। সে কারণেই সেদিনের সেই ঘটনাটা আমার ওপর অতটা প্রভাব ফেলেছিল। আমার বয়সী অন্য কোনও মেয়ের ওপরে হয়তো এতটা নাও ফেলতে পারত।”
পামিরা বলল, “আমি প্রীতমের কাছে শুনেছি তুমি একটা আর্কসাম স্পেলের মধ্যে দিয়ে গেছ। তারপর ডক্টর ব্যানার্জীর ট্রিটমেন্টে তুমি সুস্থ হয়েছিলে। কিন্তু তোমার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল সেটা জানি না। প্লিজ ডোন্ট হেজিটেট। বলো, সেদিন কী হয়েছিল?”
সঞ্চারী গলাটা খাকরে নিয়ে বলল, “সেটা ছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই একটা দিন। সকাল সকাল স্নান খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে চলে এসেছিলাম। সকাল সাড়ে ন’টার সময় ফাঁকা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন একটু লেট। আমি মনে মনে অঙ্ক করছি, কখন ট্রেন আসবে আর কখন পৌঁছব স্কুলে। স্টেশনে ইতিউতি লোক। একজন মাঝবয়সী মোটা গোঁফওয়ালা লোক সমানে দেখি আমাকে জরিপ করে চলেছে। আমি সরে দাঁড়ালাম একটু। মনে মনে ভাবলাম কী অসভ্য লোক রে বাবা! যতই ঘুরে দাঁড়াচ্ছি ঠিক কোনও না কোনও অছিলায় লোকটা সামনে চলে আসে। বিরক্ত হয়ে চলে এলাম অন্য প্রান্তে। কায়দা করে দাঁড়ালাম একটা থামের আড়ালে। কেউ বড় একটা নেই এ দিকে। স্বস্তিতে দু’মিনিট দাঁড়ানোর পর একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তি হতে শুরু করল ভেতরে। এমন তো আগে কখনও হয়নি! এমন সময় কী যেন একটা ছিটকে এসে লাগল আমার গায়ে। চকিতে ঘুরে দাঁড়াতেই যেন বাজ পড়ল!”
সঞ্চারী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “গা গুলোনো, ঘেন্না, বিস্ময়, রাগ, অপমান সব মিলে মিশে গেল একসঙ্গে। আমার শাড়ির প্রথমে পেছনে আর ঘুরে দাঁড়াবার পর সামনে এসে লাগল একজন মাঝ বয়সী লোকের বীর্য! মানে একটা লোক, জনসমক্ষে মাস্টারবেট করে আমার গায়ে ইজাকুলেট করে দিল। স্টেশনের প্রায় ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে।”
পামিরা চিৎকার করে উঠল, “হোয়াট !”
সঞ্চারী একটুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকল। তারপর বলল, “এমনটাই হয়েছিল সেদিন। এই প্রবল মানসিক আঘাত এমন অতর্কিতে আসার পর কিছুক্ষণ থম মেরে গিয়েছিলাম আমি। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব। কাঁদব খুব জোরে? লোকটাকে চড় মারব? লোক ডাকব? অপমান করব?”
আমি হতভম্বের মতো বললাম, “আর লোকটা? সে কী করছিল তখন?”
সঞ্চারী বলল, “সে তখন গুটখা খাওয়া দাঁত বের করে হাসতে হাসতে প্যান্টের চেন টানতে টানতে পকেটে হাত মুছতে মুছতে চলে গেল প্ল্যাটফর্মের অন্য প্রান্তে। আমি একা, স্কুল ইউনিফর্ম পরা, নোংরা হয়ে দাঁড়িয়ে। দু’হাতে কাচিয়ে নিয়েছি সব অপমান, সব ওয়াক, আত্মহত্যা না করার শক্তি। কেবল শিরায় শিরায় বইছে অসহ্য ঘেন্না। কেউ যেন অজস্র কাঁচ ফুটিয়ে দিয়েছে আমার শিরা-উপশিরা-মেরুদন্ড আর হৃদপিণ্ডে। এত জোর চিৎকার করতে আমার কোনও দিন ইচ্ছে হয়নি। এত রাগ আমার কখনও হয়নি, এত কষ্ট কখনও পাইনি। আমার মনে হচ্ছিল, গোটা ট্রেন জানে আমার সঙ্গে কী হয়েছে। প্রতিটি মানুষ আমাকে দেখেছে। প্রতিটি মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে – তোমার জামায় ওটা কী লেগে? আমি অস্ফুটে কৈফিয়ত দিয়েছি – আমার অপমান লেগে আছে। আমার নারীত্ব মন্থনে উঠেছে পেস্টের মতো যে লেই, সেটাই লেগে রয়েছে আমার জামায়, আমার আত্মায়।”
ঘরে পিন পড়ার মতো নিস্তব্ধতা। পামিরা মৃদু স্বরে বলল, “তুমি কি তখন ফিরে এলে বাড়িতে?”
সঞ্চারী বলল, “সেদিন স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু কী ভাবে যে বাকি পথ এসেছিলাম আমার তা মনে নেই। এমন থমথমে মুখে বাড়ি ফিরেছিলাম যে, মা ভেবেছিল ‘সাংঘাতিক’ কিছু হয়েছে। যে ভয় সব মেয়েদের মায়েরা পেয়ে থাকে। ঠান্ডা গলায় আমি বলেছিলাম, মা আমার জামাটা ফেলে দিও।” কথাটা বলে ডুকরে কেঁদে উঠল সঞ্চারী। ঋতমের মুখ থমথম করছে। সঞ্চারীর পিঠে একটা হাত রাখল আলতো করে।
সঞ্চারী চুপ করে আছে। ঋতম আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ঘটনার পরের ক’দিন ও শুধু কেঁদে গিয়েছিল। এভাবেই কাচা-ধোয়ার ব্যাপারটা পেয়ে বসল ওকে। একটা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে হয়ে গেল চলন্ত ওয়াশিং মেশিন। যে কিনা সবসময় সবকিছু ধুয়ে ফেলছে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমে ইউনিফর্ম কাচছে। রুমালে এক কণা নোংরা দেখলেই ওয়াক তুলছে। খাতা রাখার আগে বেঞ্চ পাগলের মত ঘষছে। আর তাই দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে তার সহপাঠীরা।”
সঞ্চারী কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আমি কী বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। পামিরার মুখ থমথম করছে। সঞ্চারীর অপমান ছুঁয়ে গেছে তাকেও। নাকের পাটা ফুলছে। নিজের পাতলা ওষ্ঠ চেপে রেখেছে অধর দিয়ে। মুখে কথা নেই। চোখ ছলছল করছে পামিরার। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে পামিরা এগিয়ে গেল সঞ্চারীর দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আলতো করে। মুখে কিছু না বলে জড়িয়ে ধরল সঞ্চারীকে। দু’জন দু’জনের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ।
ঘড়িতে পাঁচটা বেজেছে। ঋতম আর সঞ্চারী আমাদের এগিয়ে দিল বড় রাস্তা অবধি। আমি আর পামিরা হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়েছি লিভালপুল স্টেশনের কাছে। সূর্য অস্ত গেছে একটুক্ষণ আগে। চারদিকে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। একটা ওক গাছের তলায় চলছে ক্যারল সংগীত। জোকাররা বাচ্চাদের সঙ্গে মজা করছে। একটা স্টল থেকে কফি নিলাম দু’জনে। কফিতে চুমুক দিয়ে পামিরা বলল, “সঞ্চারীর সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা অত্যন্ত অপমানজনক তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এইটুকুতে কি জীবন এভাবে ভেঙে যেতে পারে কারও?”
আমি বললাম, “পারে তো। আমি তো সে সময়টায় দেখেছি সঞ্চারীকে। কোন আঘাত কার মনকে কতখানি ছিন্নভিন্ন করবে তা সেই মানুষটার সহ্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। সহ্যশক্তি তো সবার একরকম হয় না। সঞ্চারীর সেনসিটিভিটি অনেক বেশি। সেদিন সকালেও তো জীবনটা অন্যরকম ছিল সঞ্চারীর। হাসছিল। গাইছিল। খেলছিল। জীবনকে চাখছিল নিজের সমস্তটুকু দিয়ে। কিন্তু এই একটা ঘটনা তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিল। আচমকা স্বেচ্ছায় জীবনের স্রোত থেকে সে সরিয়ে নিল নিজেকে। অভিমানী হয়ে অনস্তিত্বের ভিড়ে আত্মগোপন করল সচেতনভাবে। তার চৈতন্যের গলিঘুঁজি দিয়ে ঢুকে পড়ল গাঢ় অন্ধকার। ওর সহ্যশক্তি ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে।”
পামিরা মাথা নেড়ে বলল, “থ্যাংকস টু ডক্টর ব্যানার্জী। ওঁর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছে সঞ্চারী। আই বিলিভ ইন ডেস্টিনি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে সেই ঈশ্বরসম মানুষটির কাছে হয়তো গিয়ে পৌঁছতে পারত না সঞ্চারী। এমন হতেই পারত যে, রাসপূর্ণিমার সময় তাদের বাড়ির কথকতার আসরে, নেড়ামাথার বৃদ্ধাদের সঙ্গে এক পঙতিতে কালি ঢালা মুখে বসে থাকত সঞ্চারী।”
আমি সায় দিয়ে বললাম, “আমিও তোমার মতো ভাগ্যে বিশ্বাস করি। এই যে তোমার সঙ্গে লন্ডনে এসে দেখা হল, একজন চমৎকার বন্ধু পেলাম, সেটা তো ডেস্টিনিই।”
পাশাপাশি হাঁটছি দু’জনে। আমি বললাম, “গত দশ বারো বছরে আমার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করেছে। বললে বিশ্বাস করবে না, স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়ে যাবার পর সঞ্চারীকে আমি বেশ কয়েকবার স্বপ্নেও দেখেছি। মেয়েটা অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিল ভেবে কষ্ট পেয়েছি খুব। ওর জন্য কিছু করতে পারিনি বলে একটা অপরাধবোধ ছিল মনের ভেতর। আজ নতুন সঞ্চারীকে দেখে আমার মনটা ভাল হয়ে গেছে।”
পামিরা হাত বাড়িয়ে দিল। আঙুলে আঙুল রাখল আমার। লিভালপুলের আবহাওয়া এখন মনোরম। বাতাসে একটা শীত শীত ভাব। হিমেল কুয়াশা বিছিয়ে আছে পেঁজা তুলোর মতো। এদিকে এখন পুরোদস্তুর ক্রিসমাসের আবহাওয়া। খাওয়া-দাওয়ার দোকান পথের দু’দিকে। বিলবোর্ডে দেখতে পাচ্ছি আইস-স্কেটিং করার আয়োজন করা হয়েছে আশেপাশে কোথাও। উৎসবের আমেজে গা ভাসিয়ে দেওয়া লোকজন দেখতে দেখতে আমি পামিরাকে বললাম, “থ্যাংকস আ লট।”
পামিরা চোখ সরু করে বলল, “ফর হোয়াট?”
আমি বললাম, “তোমার সৌজন্যেই তো আজ দেখা হয়ে গেল আমার ছাত্রীর সঙ্গে। এবারের ক্রিসমাস তাই আমার কাছে ভেরি ভেরি স্পেশাল। তুমি কী ট্রিট চাও বলো।”
পোনিটেল করা চুল, অ্যাথলিটদের মতো চেহারার মেয়ে পামিরা ব্লাশ করল। আমার আঙুল ছাড়িয়ে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তখন আমি যেমন করেছিলাম ঠিক তেমনি করে দুটো হাত ছড়িয়ে দিল দু’দিকে। আদুরে গলায় বলল, “কী ট্রিট চাই? গিভ মি আ হাগ।”
ব্যাপারটা যেন খুব স্বাভাবিক এমন ভঙ্গিতে আমি দু’পা এগিয়ে গেলাম পামিরার দিকে। এক অদম্য প্রতিবর্ত ক্রিয়া থেকে আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে পামিরা পরম আশ্লেষে আমার ঠোঁটে মিশিয়ে দিল নিজের ঠোঁট। হাজার হলেও মধ্যবিত্ত বাঙালির রক্ত বইছে আমার শরীরে। চোখ পিটপিট করে দেখলাম এদিক ওদিক। আমাদের আশেপাশে আরও কয়েকটা জুড়ি আঁকড়ে ধরে আছে পরস্পরকে। চারদিকে উৎসবমুখর মানুষের ভিড়। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন ধর্মের স্ত্রী-পুরুষ। যেদিকে তাকাই আলোর রোশনাই। শ্রেয়া আমাকে ডাম্প করে চলে যাবার পর ভালবাসার ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। এখন মনে হল আহা জীবন বড় মধুর!
পামিরা মোবাইল বের করে আমাদের গালে গাল ঠেকানো হাসিমুখের ছবি নিল কয়েকটা। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে পাউট করল দু’একবার। আমি বললাম, “কী হল?”
পামিরা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “ফেসবুকের আগের ডিপিটা বদলে দেব ঠিক করলাম। এখন তোমার সঙ্গে যে ক’টা ডুয়েলফি তুললাম তার মধ্যে কোনও একটা পোস্ট করব সোশ্যাল মিডিয়ায়। এতদিন স্টেটাস ছিল সিঙ্গল। আজ থেকে লিখব ‘ইন আ রিলেশনশিপ’।”
পামিরা হাসছে। যেন হাজারটা ঝাড়লন্ঠন জ্বলে উঠেছে। সঞ্চারী যেমন জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছে, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেল, আমি আর পামিরাও এবার ফিরছি, প্রেমে।
টানটান গল্প । খুব ভালো লাগলো ।
খুব ভালো লাগলো। একটা অদ্ভুত ব্যতিক্রমী বিষয়বস্তু নিয়ে একটা অসাধারণ গল্প।
ধন্যবাদ অফুরান।
গল্পটা পড়ে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। দৃশ্যপটে অভাবনীয় না বলা অভিব্যক্তি অপেক্ষা করেছিল। সঞ্চারীর যন্ত্রণা অনুভব করলাম শুধুই কি আমি নারী বলে? অবাক করছে, তাহলে লেখক কতখানি মানবিক ভাবনায় এই গল্প লিখেছেন। কুর্ণিশ জানাই প্রিয় লেখক কে। এই গল্প আজীবন স্মৃতি পটে আঁকা থাকবে।
ধন্যবাদ লেখককে এমন একটা ব্যতিক্রমী
গল্প উপহার দেবার জন্য।