অন্বেষা রায়
গোলাপি আকাশে ভেসে যেতে যেতে নরম চোখে তাকাল বিকেলের সূর্য। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল আপান। বুনো গন্ধ মেখে এক শিষ থেকে অন্য শিষে উড়ে যাচ্ছিল ফিনফিনে ডানার হলুদ ফড়িং। আপানের চোখ লাল। নাকের ডগায় আবছা কাঁপন। ঠোঁটের কষ বেয়ে নামতে নামতে থমকে গেছে রক্তের সরু রেখা। নোনতা জল ফোঁটায় ফোঁটায় জমা হচ্ছে ঘাসের গোড়ায়।
টুবলাই, দাঁত দিয়ে ঘাসের আগা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,
“ছাড় তো ওদের কথা, সবকটা ফালতু ছেলে। তুই মারপিট কেন করতে গেলি?”
টুবলাইদের বাড়িতে টেলিফোন আছে। সারা পাড়ায় একমাত্র ওদের বাড়িতেই আছে। সকলের দরকারি ফোন সেখানেই আসে। টুবলাইয়ের মা, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডেকে দেন নির্দিষ্ট মানুষটিকে। আপানদের ফোন আসে না কখনও। তবু টুবলাই রোজ ডাকতে আসে আপানকে। খেলার জন্য। আপান ভাবে দিদির যদি অন্য শহরে বিয়ে হয়, তাহলে কি টুবলাইদের বাড়িতে ফোন করবে দিদি। তখন ওই কালো ভারিক্কি রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে হ্যালো বলবে আপানও। দিদি ওকে কী বলছে, সেটা সে নিজে ছাড়া আর শুনতে পাবে না কেউই।
ফালতু শব্দটা টুবলাই ঢিলের মতো ছুঁড়ে দিল নিভে আসা বিকেলের আকাশে। যেভাবে ব্যাঙাচি খেলার সময় জলের ওপর পাথর ছোঁড়ে। ‘ফালতু’র ঢিল লাবডুব লাবডুব খায় আপানের মাথার ভেতর।
বাবা বলেছিল, “ফালতু লোক”। অন্ধকার ঘরে, মশারির ঘেরাটোপে শুয়ে প্রথমে বুঝতে পারেনি আপান। কার কথা বলছে বাবা? তারপর দীর্ঘশ্বাস মেখে এসেছিল মায়ের জবাব।
“হ্যাঁ, ফালতু না হলে মেয়ে দেখতে এসে অমন বলতে পারে?”
মহালয়ার রাতের মতো দ্রুততায় কেটে যাচ্ছিল আপানের ঘুম। ওর মনে পড়ছিল। ছোট্টখাট্টো, টাক মাথা, ভুড়িওয়ালা মানুষটা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আফশোসে মাথা নাড়ছে দুদিকে।
“আপনার মেয়ের গায়ে এমন বীভৎস শ্বেতী আছে তা তো জানতাম না।”
বাবার মুখ ঝুলে গিয়েছিল। ফালতু কথাটা হয়তো মনে পড়েনি তখন। মনে পড়লে কি আর লোকটাকেই বলে দিত না? বাবা তো আর আপানের মতো নয়। লোকটা বলেই চলেছিল।
“স্যাড কেস। ছেলেটা তোতলা, মেয়েটারও শ্বেতী। আপনার সন্তান ভাগ্যটা…”
হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উঠে বসে আপান।
রাতের অন্ধকারে, মশারির নিরাপত্তায় বাবা মাকে বলেছিলেন,
“মানুষকে মানুষ মনে করে না। যত্তসব ফালতু লোক।”
টুবলাইও বলল,
“ওরা ফালতু ছেলে।”
দিদিকে দেখলেই ঝুমরি গাই বলে ডাকে ওরা। ঝুমরি গাইয়ের গা বাদামির ওপর সাদা ছোপে ভরা। রোদের মধ্যে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে যখন দাঁড়িয়ে থাকে ঝুমরি, আড়াল থেকে দেখে আপান। নধর, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল প্রাণীটার থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। গায়ে মাছি বসলে লেজ দিয়ে বা কখনও অদ্ভুত কায়দায় গা কাঁপিয়ে মাছি তাড়ায়। সেই কাঁপনে থিরথির করে নড়ে ওঠে গায়ের সোনালি রোদ। ওর নাক দিয়ে বেরোতে থাকা ভুসভুস শব্দের পিছু পিছু বাচ্চা মেয়ের মতো ছুটে আসে ঘণ্টার ঠুং ঠাং আওয়াজ। নোটন ভারি যত্ন করে ঝুমরিকে। সবাই বলে, ঝুমরি নোটনের মেয়ে। নোটন বলে লক্ষ্মী মেয়ে। কত দুধ দেয়। সাদা সাদা ফেনাওয়ালা দুধ। কী গন্ধ! কী সোয়াদ!
ঝুমরির দোষ বলতে কেবল একটিই। মানুষ দেখলেই তেড়ে আসে। এক নোটন ছাড়া, আর কাউকে যেন সহ্য করতে পারে না। সারা পাড়ায় ঝুমরি তাই ত্রাস। গরু তো নয়, যেন বাঘ। নজরে এলেই হৈ চৈ পড়ে যায় চারদিকে। এলোপাথাড়ি ছুটতে থাকে বাচ্চার দল। এ যাবৎ কতজনকে যে গুঁতিয়েছে হিসেব নেই কোনও।
ছেলেগুলো যখন আপানকে ঝুমরির ভাই বলে ডাকে, তখন অনেক কথা ওর কাঁপতে থাকা ঠোঁটে এসে জড়ো হয়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, “আমার দিদির মুক্তোর মতো হাতের লেখা। একবার কাউকে দেখলে অবিকল তার মুখ খাতায় এঁকে দেবে পেন্সিল দিয়ে। আর কাঁকড়ার ঝোল যা রাঁধে না! খেলে তোদের সব কটার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।”
বলতে পারে না। রেগে গেলে আরও অবাধ্য হয়ে যায় জিভ। কয়েকটা কুশ্রাব্য ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই প্রস্তুত করতে পারে না তখন। অমন জিভের থেকে জোরে ওর হাত পা চলে। ও তাই ছুট্টে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল ছেলেগুলোকে।
জারুল গাছটার পেছন থেকে উঁকি দিতে থাকা কমলা সূর্যটার পেট থেকে আদুরীর মুখটা বেরিয়ে এল আচমকাই।
টুলটুলে গোল। জোড়া ভুরুর দুই প্রান্তে গোলাপি আভা মাখা সাদা সাদা বৃত্ত। ঠোঁটের ডানপাশে আবছা গুজরাটের মানচিত্র। গলা থেকে, জামার ভেতর লুকিয়ে থাকা কাঁধে ছড়িয়ে আছে দক্ষিণ আমেরিকা। সবই গোলাপি আভা মাখা সাদা অংশ। পাশের চামড়া ঈষৎ গাঢ় বলে, তাদের উপস্থিতি সুস্পষ্ট। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে থাকে এক স্থায়ী বিষণ্ণতা। মরে আসা দিনের মতো মনখারাপ।
আপান চোখ বন্ধ করে দিদির মুখটা ভাবে।
সন্ধ্যে নামলেই সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা আপানদের পাড়ায় এসে দাঁড়ায়। যদিও মফস্বল শহর, গাড়ি ঘোড়ার ভিড় কম, তাও একেকদিন একেক শহর থেকে ঘুরে আসা গাড়িটাকে ক্লান্ত দেখায়। নোটন, নেমেই সোজা চলে যায় চৌবাচ্চার দিকে। বালতি বালতি জল এনে ধুয়ে মুছে ঝকঝক করে তোলে যানটাকে। ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে সে আপানের দিকে তাকায়। বলে,
“আরেকটু দাঁড়াও আপান। গাড়ি ধোয়া হলেই দিচ্ছি।”
মোছার প্রাবল্যে গলা কেঁপে যায় নোটনের। আপান মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাত করে।
সন্ধ্যেবেলা ঝুমরির গোয়াল থেকে দুধ আনতে তাকে পাঠায় মা। নীল প্লাস্টিকের ঢাকনাওয়ালা কাঁচের শিশিটা দু’হাতে সামলে ঝুমরিদের বাড়ি আসে আপান। আপান জানে নোটনদার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর প্রায়। বড়দার রেখে যাওয়া অ্যাম্বাসাডার আর ঝুমরিই ওর সব। লেখাপড়া জানে না তো কী, গাড়ি চালাতে ওস্তাদ। রোজই ট্রিপ করছে। ওর মেজদার ট্যুরিজমের ব্যবসা। মা বলে,
“হাড় মাস কালি করা রোজগারের সবটাই তো মেজদার সংসারে ঢেলে দেয়। দুটো ভালোমন্দও খেতে দেয় না। যা মুখ বৌদিটার। তাও ওদের পায়ে পড়ে রয়েছে। ছোটবেলায় মা হারিয়ে একেবারে ভালোবাসার কাঙাল হয়ে গেছে নোটনটা। আচ্ছা বলদ! ভাগ্যিস বিয়ে থা করেনি।”
পাশের বাড়ির টুম্পা কাকিমা উত্তর দেয়,
“করবে কী, কোন বাপ তার মেয়ে ওকে দেবে বলো? গাড়ি চালালে কী হবে আদতে তো গোয়ালা। তার ওপর দাদার সংসার ছেড়ে যাওয়ার সাহস নেই। এত ঠকার পরেও বোধ হয়নি। ওই এক গরু নিয়ে পড়ে আছে। ঘর বলতে তো গোয়ালের পাশের ওই খুপরি। তাতে একটা চৌকি। বৌ কি গরুর পাশে শোবে?”
তারপর গলা নামিয়ে জানাবে,
“মেজদাটা হাড়ে বজ্জাত। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে যত পারে নিয়ে নিচ্ছে। নোটনের বিয়ে হলে তারও অসুবিধে।
টুবলাইয়ের মা তিন চারটে ভালো সম্বন্ধ এনেছিল। ওই মেজদাই নাকচ করে দিয়েছে। ওর ট্যুরিজমের ব্যবসা তো নোটনের দৌলতেই চলছে। এত যে ড্রাইভারি করে ছেলেটা, একটা টাকা ঠেকায়? বড়দাটা সব গুছিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দিলে কী, সে সামলে রাখতে পারলে তো।”
“ঝিলপাড়ের পাকা বাড়িটা তো নোটনের টাকাতেই।” ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আপান। নোটনের ফোলা গাল, চেরা চোখ দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায়, দিদির সালোয়ার কামিজের ভাঁজে লুকোনো কাগজটার কথা। অবিকল এক মুখ। এঁকেছে। কাউকে দেখায়নি। চাপা তারিফ ফুটে ওঠে আপানের দৃষ্টিতে। সেই তারিফ খেয়াল করে নোটন হাসে। আপান ভাবে, কখন আঁকল দিদি? হয়তো ঝিলপাড়ে যেদিন নোটনদার কাঁধে মাথা দিয়ে বসেছিল সেইদিন। অথবা, আপানের জ্বরের সময় যখন ঝুমরীর দুধ আনতে গেছে তখন। কিংবা আপানকে আলুকাবলি কিনতে পাঠিয়ে যখন ঘাটের কাছে কথা বলছিল নোটনদার সঙ্গে, তখন এঁকেছে। ঝুমরিকে দোয়ানোর সময়, অদূরে বাঁধা বাছুরটারকে আদর করে আপান। ওর কাজল কালো চোখ থেকে নজর ফিরিয়ে থেকে থেকে তাকায় ঝুমরি গাইয়ের দিকে। বুক ঢিপ ঢিপ করে। এই বুঝি তেড়ে এল শিং বাগিয়ে। টুবলাইয়ের পিং পং বলের মতো, আপানের হৃৎপিণ্ডটাও পেট থেকে বুক, বুক থেকে পেট লাফাতে থাকে। বাছুরের নরম চোখ আর ঝুমরির বাঁকানো শিং ছাড়া আর কিচ্ছু নজরে আসে না। ঝুমরি ওকে গুঁতিয়ে দিলে কি পেট ফেটে যাবে? মা তখন নিশ্চই খুব কাঁদবে? আর বাবা ছুটে যাবে টুবলাইদের বাড়ি। কালো ভারিক্কি রিসিভার কানে ঠেকিয়ে গোল নম্বরের চাকায় ঘুরিয়ে দেবে হাসপাতালের নম্বর।
নোটন কত কথা বলে যায়।
“দেখো আপান, ঝুমরির পা কিন্তু খোলা। গরুর পায়ে দড়ি বাঁধা মোটে পছন্দ নয় আমার। অবলা বলে কি প্রাণী নয়। পায়ে চোট লাগলে তো আর দাঁড়াতে পারবে না। ভালোবাসা দিলে, লাথি মারবে না। দেখো, আমার কথা কেমন শোনে ঝুমরি।”
আপান ভাবে, ভালোবাসা দিলে কি মনখারাপও সেরে যায়?
দুপুরবেলা আচার চুরি করে দিদিকে খাওয়ায়, ফুরুস গাছের ডালে আটকে থাকা ঘুড়ি পেড়ে এনে দেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দিদির চোখে জল। বড়পিসি বাবাকে বলেছিল,
“এখন থেকে চেষ্টা কর। আঠেরোতে পড়লেই বিয়ে দিয়ে দিবি। বললেই তো আর হয়ে যাবে না।”
সেই কথার পর দু’বছর কেটে গেছে। ওয়ান থেকে থ্রিতে উঠে পড়েছে আপান। দিদির বিয়ে হয়নি।
আদুরীর জলভেজা চোখের ভারে, কাঁঠাল পাতা ঝরে নোটনদের উঠোন জুড়ে। একখানা তুলে দ্বিধান্বিত চোখে নোটনের দিকে তাকায় আপান। নোটন হাসে।
“দিয়ে দেখো, খেতে পারে। এখন বড় হয়েছে তো।”
সেই কাজলকালো চোখজোড়া ঝিকমিক করে। আপান ঝুমরীর বাঁকা শিং-কে মনের কোণে সরিয়ে পাতা ধরা হাতটা বাড়িয়ে দেয়। বাছুরটা কাঁঠাল পাতায় মুখ দেয়। ওর গলকম্বলে হাত বোলাতে বোলাতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আপান। গাল ঠেকিয়ে দেয় কাঁধে। ওর লোম থেকে উঠে আসে উষ্ণ গন্ধ।
টুম্পা কাকিমা বলেছে, গায়ের রঙ ফর্সা হলে শ্বেতীর দাগ চাপা পড়ে যাবে। টুম্পা কাকিমার কথায় মায়ের গভীর প্রত্যয়। দুধের গ্লাসে জাফরানের আঁশ ভাসায় মা। হলুদবাটা সাজিয়ে রাখে দিদির সামনে। আপান জানে, যতই লুকিয়ে দেখা করুক নোটনদা আর দিদি, ওদের বিয়ে হবে না। কারণ, নোটনদার মেজদা চালাক। ঝুমরি না থাকলে কি দিদির সঙ্গে বিয়ে হত নোটোনদার? এই গোয়ালঘরের জায়গায় দিদির ঘর হত তবে। ভাবতে ভাবতে সে চোখ ঘোরায়। চোখাচোখি হয়ে যায় ঝুমরির সঙ্গে। আপানের বুক ছমছম করে।
দুধের বালতি বারান্দায় নামিয়ে আপানের দিকে সরে আসে নোটন। নরম গলায় বলে, “কাল নাকি মারপিট করেছ? টুবলাই বলল।” আপান সাড়া দেয় না। নোটন উবু হয়ে বসে, দুহাতে ওর কাঁধ চেপে ধরে। নরম গলায় বলে,
“তোমার দিদি খুব সুন্দর আপান। লোকেরা কত কীই তো বলে। দেখো না ঝুমরিকে ভালবাসি বলে আমাকে কেমন হতছেদ্দা করে। আমি পাত্তাই দিই না। রাগ করতে নেই আপান।” আপানের ঠোঁট বেঁকে যায়। লোনাজলের বড় বড় ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। নোটন ওকে বুকে টেনে নেয়। নোটনের ঘামে ভেজা গেঞ্জীতে মুখ ডোবাতে ডোবাতে আপান ওকে আঁকড়ে ধরে। মাথা তুলতে ইচ্ছে করে না। ভাবে, নোটনদা ম্যাজিক জানে। ঝুমরিকে বশ করতে পারে, দিদিকে শান্তি দিতে পারে। মা কেন নোটনদার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় না দিদির? নোটনদা না হয় ওদের বাড়ি থাকবে। ঝুমরি কি নোটনদাকে ছাড়া থাকতে পারবে না রাত্রিবেলাটুকু? ভাবতে ভাবতে সে নোটনের কাঁধ থেকে চোখ তুলে ঝুমরির দিকে তাকায়। দেখে কাজলকালো ছলছলে দুটো টানাটানা চোখ তার দিকেই স্থির। ওর গা শিরশির করে ওঠে।
ঝিলপাড়ের বাড়িটা তৈরী হতেই নোটনরা চলে গেল সবাই। সাতদিন আগে থেকেই ঝুমরির দুধ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল আপানরা। স্কুলের পেছনে নোটন আদুরীকে দেখে ফেলেছিল কেউ। সেই থেকে তুলকালাম। নোটনের মেজদা এসে প্রচুর তেতোকথা বলে গিয়েছে। আদুরীর মা, তাকে থামাতে এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় বসিয়েছে মেয়ের গালে পিঠে। আর ওর বাবা অবিকল নিজের আট বছরের ছেলের মতন তোতলাতে তোতলাতে চেপে ধরেছে মেজদার কলার। পাড়ার লোক ফিসফিস করে একে অপরকে বলেছে, “বিয়ে হচ্ছে না, কী করবে যাকে পেয়েছে তাকেই ধরেছে।”
রাতে সেই আগুনপানা দিনের ওপর বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। ঘুমের অন্ধকারে ফুঁপিয়ে উঠল আদুরী। মেঘ ডাকল দূরে কোথাও। আপানের ঝুমরীর কথা মনে পড়ল খুব। আজ প্রথম বড়দের ঝগড়া দেখেছে সে। সেই ঝগড়া বড় কঠিন। বড় ধারালো। ঝুমরীর মতো নয়, যে চলে গেলেই নিশ্চিন্তি। সে ঝগড়া, আদুরীর কান্না হয়ে থেকে যায় সাতদিন পরেও। আপান ভাবে, ঝিলপাড়ে, নোটনদাদের নতুন বাড়িতেও কি থাকবার জায়গা হবে না দিদির?
সে পাশ ফিরে দিদির কপালে আঙুল ছোঁয়ায়। সাবধানে লেখে, নোটনদা তোর বর হবে। তারপর মা কালীকে প্রণাম ঠুকে চোখ বন্ধ করে নেয় চট করে।
ভোরবেলা একটা হৈ হৈ শুনে বাইরে এল আপান। পাড়ার প্রায় সকলেই বাড়ির বাইরে। টুম্পা কাকিমা অবাক হওয়া গলায় বলছে, “কেমন ত্যাঁদড় গরু গো! এতটা পথ ঠিক চিনে চিনে চলে এসেছে!”
মায়ের পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে আপান দেখল, নোটনদা ঝুমরির দড়ি ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কাল রাতে নতুন বাড়ি ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়িতে চলে এসেছে ঝুমরি। একবার পেছন ফিরতেই চোখাচোখি হল আপানের সঙ্গে। নোটন ফিরে তাকাল না একটিবারও। যেন তারই হয়ে একেবারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে অবধি আপানের চোখে চোখ রাখল ঝুমরি।
আদুরী উচ্চমাধ্যমিকে ব্যাক পাওয়ায়, অতিরিক্ত কোনও শোকের আবহ তৈরী হল না বাড়িতে। বিয়ের চেষ্টায় গতি বাড়ল। বড়পিসি একটি সম্বন্ধ আনল কলকাতার। পাত্রের বয়স বেশি, প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন বছর খানেক আগে। তিনটে ছেলেমেয়ে। কাজের লোকের হাতে দেখভাল হচ্ছে না ঠিক মতো তাই বিয়ে।
শরৎ রচনাবলী থেকে উঠে আসা একখানা অসম্পূর্ণ গল্প থমকে দিল বাড়ির বাতাস।
রাতের অন্ধকারে, মশারির পাতলা ঘেরাটোপে ঝাপসা স্বর ভাসে, “দিদিকে কিছু জানালে?” খানিক নিস্তব্ধতার পেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস।
“নাহ, আরেকটু ভাবি।”
“কী যে আছে মেয়েটার কপালে…”
“লেখাপড়াটাও যদি মন দিয়ে করত, তাহলে না হয় একটা চাকরি বাকরির ব্যবস্থা…”
কিছুদিন পর সাদা অ্যাম্বাসাডারটাকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিল আপান। নোটনদা নাকি! ঘরে ঢুকে অবাক। হাসি হাসি মুখে বসে আছে পিসি। প্লেটে প্লেটে খাবার। দিদিকে একটা শাড়ি পরানো হয়েছে লাল রঙের। আদুরী বসে আছে মাথা নিচু করে।
আপান জানে, লোকগুলো কলকাতা থেকে এসেছে। বড়পিসির চেনা। রাতের অন্ধকারে দিদির কানে কানে ফিসফিস করে আপান।
“তুই কলকাতা চলে যাবি, দিদি?”
আদুরী জবাব দেয় না। আপান ভাবে প্রশ্ন করে,
তখন আদুরী তাকে টুবলাইদের বাড়ি ফোন করবে কিনা। সেই কালো রিসিভার কানে ঠেকিয়ে সে গল্প করবে দিদির সঙ্গে। জিজ্ঞেস করে না। চুপটি করে শুয়ে থাকে দিদির পাশে।
আদুরী যে হারিয়ে গেছে সেটা টের পেতে দেরি হল না কারও। বন্ধুদের বাড়ি যায়নি। পাড়ার লোকও দেখেনি অনেকক্ষণ। অতএব মেয়ে নিরুদ্দেশ। কেউ বলল, ইট ভাটার পাশের জঙ্গলে খোঁজ করতে। সেখানে বড় বড় গাছের ডালে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। পুকুরে জাল ফেলার পরামর্শ দিল কেউ। এই বয়সে শ্বেতী ভরা মুখ আয়নায় দেখা, কাঁচা প্রেম ভেঙে যাওয়া, উচ্চমাধ্যমিকে কম্পার্টমেন্টাল কম কথা তো নয়। আহত মন, জীবন নিয়ে নিতেই পারে।
প্রাথমিক বিস্ময়, হৈ চৈ আর আতঙ্ক পেরিয়ে কয়েকঘন্টার মধ্যেই বাড়ির লোক বুঝলেন, মাথা ঠান্ডা করাটাই আপাতত অবস্থা মোকাবিলার প্রাথমিক শর্ত। সুতো ধরে এগোনোর মতো কড়া নড়ল নোটনদের নতুন বাড়িতে। নোটন নেই। বিষ্ণুপুর ট্রিপ আছে বলে সকালে বেরিয়েছে বটে কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিষ্ণুপুর সে যায়নি। কোথায় গেছে কেউ জানে না। দুইয়ে দুইয়ে চার হিসেব মেলানোর পর বিস্তর কথা ছোঁড়াছুঁড়ি হল দু’তরফে। রাগ, আক্রোশ সাত বাসি জঞ্জালের মতো উগরে দিয়ে খানিক শান্ত হল সবাই। প্রতিবেশীদের পরামর্শে থানায় গেল। আপান পড়ার বই খুলে বসেছিল। নোটন বেপাত্তা হওয়ার খবর কানে যেতেই ভাবল, এরপর যদি ঝুমরী এপাড়ায় চলে আসে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে কে?
থানা থেকে বলেছে সাবালিকা মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে চলে যেতেই পারে, কিছু করার নেই। তাছাড়া ছেলেটির তো রেকর্ড ভালো। খোঁজ চালাব। পাওয়া গেলে জানিয়ে দেওয়া হবে আপনাদের। এরমধ্যে বিয়ে থা করে ওরাও ফিরে আসতে পারে।
জলের গ্লাসটা নিয়ে একবারে গলায় ঢেলে দিলেন আদুরীর বাবা। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললেন হু হু করে। তারপর বললেন, “মেয়েটা কি সারাজীবনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেল, সোমা?”
পর্দার আড়ালে জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে রইল আপান। দিদি কি আর ফিরে আসবে না?
আসবে, আসবে না, আসবে, আসবে না’রা দলে দলে কুচকাওয়াজ করে তার মাথার ভেতর। ও দেখে মা কাঁদছে বাবাকে জড়িয়ে। মায়ের কান্না আর বাবার ঝুলে পড়া মুখ দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও চারটে দিন। থানা থেকে আপানের বাবাকে ডেকে পাঠানো হল মাঝে একবার। মর্গে যেতে হবে। একটা লাশ পাওয়া গেছে। যদি…
পাংশুমুখে থানা থেকে ফিরে দুদিকে মাথা নেড়েছিল বাবা। থপ করে বসে পড়েছিল মেঝেতে।
গোলাপি আকাশে ভেসে যেতে যেতে আপানের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় বিকেলের সূর্য। টুবলাই বলে, “আদুরীদি ঠিক ফিরে আসবে দেখিস। তোকে ছেড়ে থাকতেই পারবে না।”
ঘরে ফিরতে থাকা পাখিরা চিৎকার করে বলে, “ফিরে আসবে, ফিরে আসবে। আদুরীদি তোমাকে ছেড়ে থাকতেই পারবে না।”
আজকাল ঝুমরির ভাই বলে তাকে ক্ষ্যাপায় না কেউ। তাকে দেখলে নিচু গলায় কথা বলে। ছোট বড় সবাই। সন্ধের মতো ম্লান স্থিতি নেমে আসে আপানদের বাড়িতে। আদুরী ফেরে না।
একদিন খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল আপানের। বাইরে মেঘ ডাকছে গুমগুম করে। ঘুমন্ত বাবাকে ডিঙিয়ে খাট থেকে নামে সে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে শব্দ না করে। বসার ঘর থেকে জলচৌকি এনে তার ওপর দাঁড়ায়। সাবধানে দরজার ওপরদিকের ছিটকিনি খুলে বাইরে আসে। টুবলাই বলেছে দিদি ফিরে আসবে। কবে? নোটনদাও তো ফেরেনি। সবাই বলছে, নোটনের এটা আগেই করা উচিৎ ছিল। মেজদাটা এবার ঢিট হবে। শুধু আদুরীর কথা বলছে না কেউ। বলছে না আদুরীও ঠিক করেছে, দোজবরে কেন বিয়ে করবে? আপানের মা, বাবাও বলছে না। চুপ হয়ে গিয়েছে।
ভোরের বৃষ্টির মতো নিঃশব্দে কাঁদে আপান। টুবলাই যে বলল, দিদি ফিরে আসবে, কবে? দু’চোখের বৃষ্টি গতি বাড়ায় বড় বড় ফোঁটায়।
কানের কাছে ভুসভুস শব্দ পেয়ে চমকে তাকায়। ঝুমরি। একেবারে সরে এসছে তার কাছে। ভয়ে পাথর হয়ে বসে থাকে। এই বুঝি শিঙে তুলে দিল আছাড়। এখন তো নোটনদাও শহরে নেই। ঝুমরি সরে না। থিরথির করে কাঁপতে থাকা ওর ত্বক থেকে ছিটকে পড়ে বৃষ্টির জল। ওর কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে পায় আপান। রোগা, ফর্সা, ছোট্ট একটা ছেলে। মাথা ভর্তি ঘাপসা চুলের তলায় বড় বড় দুটো চোখ। সেই চোখে ঝুমরি দেখে নিজেকে। ঝুমরির গলায় মাথা ঠেকায় আপান। ওর গা থেকে ভেসে আসে দুধের গন্ধ। গলার ঘণ্টাটা চুপ করে থাকে। দূরে, যেন আকাশের অন্যপাড় থেকে ক্রমাগত বাজতে থাকে টেলিফোন। টুবলাইদের কালো ফোনটা বাজছে। বাজতে বাজতে চুপ করে যায় একসময়। টুবালাইয়ের মা চিৎকার করে ডাকেন। “আপান, এই আপান, মাকে ডেকে দে তাড়াতাড়ি, আদুরী ফোন করেছে। পাঁচ মিনিট পর আবার করবে বলল। এস.টি.ডি। তাড়াতাড়ি ডাক।”
আপান নরম আঙুল দিয়ে খামচে ধরে ঝুমরীর গলা। ওর গালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে। ঝুমরীর গাল বেয়ে নামতে থাকে আপানের কান্না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারণ একটা গল্প।
ভাল লাগল
ভালো লাগলো।
অসাধারণ লেখনি l
নিঃশব্দ বৃষ্টির মতো চোখে জল এনে দিয়ে আবার ডানা মেলল ঝকঝকে রোদ।