দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
বিকেলে মল্লারের বাড়িতে যাবার জন্য কেয়ুর তৈরী হল। সপ্তাহে একদিন বাজারে তারা দুই বন্ধু প্রায় দেখা করে। কিন্ত আজ সকালে মল্লার আসেনি। তাই একবার খোঁজ নিতে সে যাচ্ছে। সকালেই ভেবেছিল ফোন করবে। কিন্তু সে ভুলে গেছিল। ফোনেও না পেয়ে ওর বাড়ি যাওয়াই সে ঠিক করল।
একসময় তারা এক পাড়ায় থাকত। তখন থেকেই বন্ধুত্ব। বছর পাঁচেক আগে কেয়ুর পাকাপাকিভাবে পুরোনো এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘর করেছে। তবু দুজনে যোগাযোগ রেখেছে। বাজার কমন জায়গা। সেখানেই দেখা হয়, গল্প হয়। দুজনে একটা ছোট কোম্পানীতে কাজ করে। খাওয়াদাওয়া, সিনেমা, খেলা, রাজনীতি সবকিছু নিয়ে তাদের দুজনের পছন্দ–অপছন্দ প্রায় একইরকম। অমিল একটাই। মল্লার বিবাহিত। কেয়ুর এখনো বিয়ে করেনি।
তবে ওর বাড়ি যাওয়া নিয়ে কেয়ুরের একটু অস্বস্তি আছে। বিয়ের পরে সে ওর বাড়ি খুব কম গেছে। এর পেছনে সামান্য একটা ঘটনা আছে। কেয়ুরের জীবনে একবার একটি প্রেমের সম্ভাবনা দেখা গেছিল। একটি মেয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। সে সেসময় এড়িয়ে গেছিল। ঘটনাচক্রে সেই মেয়ে রাকা এখন মল্লারের বিবাহিতা স্ত্রী।
এই ঘটনা মল্লার জানে না। ওদের মধ্যে প্রেম শুরু হয়েছিল তখন এক-আধবার কেয়ুরের মনে হয়েছিল বিষয়টা জানাতে। কিন্তু মল্লারের ঘোর লাগা চোখমুখ দেখে সে চুপ করে গেছিল। না। সে বন্ধুকে দুঃখ দিতে পারবে না। কিন্তু সে মনে মনে বলেছিল ‘ভুল হল মল্লার। ক’দিন আগেই ও আমার কাছে এসেছিল। আজ তোকে প্রেম নিবেদন করেছে। এ তোকে জ্বালাবে। দেখিস।’
কেয়ুরের কথা মেলেনি। বছরদুয়েক মল্লাররা ঘোরাঘুরি করার পর বিয়ে করে দিব্যি আছে। সেও আর এ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে রাকার সামনে এখনও তার অস্বস্তি হয়। শেষবার ওর বাড়িতে যেদিন দেখা হয়েছিল রাকা বিয়ের কথা তুলেছিল। ও জিজ্ঞেস করেছিল ‘কেয়ুরদা তুমি বিয়ে করবে না?’
কথাটার মধ্যে লুকানো একটা ভাব ছিল! রাকা বলতে চেয়েছিল ‘আমাকে বিয়ে তো করলে না। তা বলে বিয়েই আর করলে না!’
সে হেসে জবাব দিয়েছিল ‘খুঁজছি তো। সুন্দরীও দরকার আবার পড়াশুনোও চাই তো।’
রাকার মুখ বদলে গেছিল। পড়াশুনোয় ও ভাল নয়। কোনওমতে এইচএস পাস। আর কথা বাড়ায়নি ও।
কেয়ুর তৈরী হয়ে নিল। দোতলা থেকে নামতে না নামতে কলিং বেল বাজল।
দরজা খুলে সে চমকে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাকা!
রাকা এ বাড়িতে কবে এসেছে তা কেয়ুর মনে করতে পারছে না। বিয়ের পর মল্লার ওকে একবার নিয়ে এসেছিল। প্রধানত মায়ের ইচ্ছায়। মা মল্লারকে ছোটবেলা থেকে দেখেছেন। ওর উপর যথেষ্ট স্নেহ আছে। তার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। তবু দায়ে পড়ে সে নেমতন্ন করেছিল।
মল্লাররা এসেছিল। তবে দুপুরে আসেনি। সন্ধ্যেতে ঘন্টাখানেকের জন্য ঘুরে গেছিল। তারা দুজন গল্প করেছিল। রাকা মায়ের সঙ্গে। যাবার সময় হঠাৎ মল্লার তাকে বলেছিল ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
সে বলেছিল কী?
‘তুই রাকার সাথে একটাও কথা বললি না তো?’
সে বলেছিল ‘কী বলব? মা কথা বলছে।’
‘না। তুই তো মেয়েদের সঙ্গে বেশ কথা বলিস। তাই বলছিলাম।’
তার মনে হয়েছিল হয়ত মল্লার কিছু জানে! ওইজন্য সে বুঝতে চাইছে। সে উত্তর দেয়নি। কথাটা এড়িয়ে গেছিল।
এখন অবাক ভাবটা কেয়ুর কাটিয়ে ফেলল। সে বলল, ‘আরে তুমি! এসো।’
‘বেরোচ্ছিলে?’
ওদের বাড়ি যাবার কথা গোপন রেখে সে বলল ‘ওই আর কী। বসো। মল্লার কোথায়?’
‘ও আসেনি!’
মল্লারের তাহলে সত্যিই শরীর খারাপ। নইলে রাকা একা আসত না। সে ওর দিকে একবার ভাল করে তাকাল। যদিও ওকে তেমন উতলা মনে হচ্ছে না। দুম করে জিজ্ঞেস করাও যাচ্ছে না ও হঠাৎ একা কেন?
একজন মহিলাকে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললে কেমন যেন লাগে! সে ওকে ভেতরে ডাকল। রাকা না বলল না। সহজভাবেই ভেতরে ঢুকল। মাত্র একবার এসেছিল কিন্তু কোনও থতমত ভাব নেই। বাঁদিকের সিঁড়ি ধরে ও দোতলায় উঠে পড়ল।
রাকা ঘরে ঢুকে ডিভানের একপাশে বসল। কেয়ুর ওকে খেয়াল করল। অনেক বদলে গেছে ও! আগের রাকা নেই। আরো রূপবতী হয়েছে। যে রাকা তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল সেই মুখটা সে হঠাৎ একঝলক দেখতে পেল। ওর কি এখনও তা মনে আছে? সে ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। ফিরিয়ে দেওয়ার কারণও অবশ্য তার মনে নেই। সে তখন প্রেমট্রেম নিয়ে ভাবত না। বরঞ্চ সে সময় বিরক্তই হয়েছিল প্রেমের কথায়। এখন কেয়ুর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল, ‘তা কী ব্যাপার। হঠাৎ?’
রাকা হেসে বলল ‘কেন আসতে নেই?’
কথাটা বেখাপ্পা লাগল। সে প্রস্তুত ছিল না। পুরোনো প্রসঙ্গ তুলে আনতে চাইছে রাকা। তবে একটা বিষয় সে খেয়াল করল অনেক কিছু বদলালেও একটা জিনিস বদলায়নি। হাসিটা। রাকার হাসিটা খুব সুন্দর। এমন হাসির দিকে অকারণে চেয়ে থাকা যায়।
সে মাথা নেড়ে বলল ‘আসবে না কেন? সে বাদ দাও। বল!’
রাকা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল ‘হুম। বলার জন্যই তো এলাম।’
কেয়ুর কিছু বলল না। সে ওর দিকে চেয়ে রইল।
রাকা একটা শ্বাস ফেলে বলল ‘তুমি তো জানোই মল্লারের ব্যাপারটা। অনেকদিন ধরেই তা হচ্ছে। ইদানিং আরো বেড়েছে।’
কেয়ুর থতমত খেয়ে গেল। কথাটা কেমন যেন খাপছাড়া শোনাল। মল্লারের শরীর খারাপের কথাই কি ও বলছে? সে অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না রাকা। কী ব্যাপারে বলো তো? ওর শরীর ঠিক আছে তো?’
‘কেন তুমি জান না? সপ্তাহে একদিন তো দেখা হয় ওর সঙ্গে। কিছু বুঝতে পারোনি?’
রাকা জানে তাদের দেখা হবার কথা। কিন্তু ও কী জানার কথা বলছে? মল্লারের কি গভীর অসুখ হয়েছে? নাকি আর্থিক কোনও সমস্যায় ও জড়িয়ে? তেমন কিছু সে টের পায়নি। ও কোনও সমস্যার কথা বলেনি। তাহলে সে জানত। সে মাথা নেড়ে বলল ‘না। কী বুঝব?’
‘মল্লার পাগল হয়ে গেছে!’
‘কী!’
‘হ্যাঁ। তোমার বন্ধু পুরো পাগল হয়ে গেছে।’
রাকা ইয়ার্কি করছে! তার মনে হল। মল্লার আর যাই হোক পাগল হবার মতো নয়। তার কোনও লক্ষ্মণ ওর মধ্যে নেই। ভাবতে ভাবতে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ও আজকাল খুব পুরোনো দিনের কথা বলে। সেদিনও তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর মনে আছে? আমরা কেমন সাইকেল করে এ পাড়া ও পাড়া ঘুরতাম। মজুমদার পাড়া, ঘটক পাড়া। ওই সময়ে মেয়েরা বেরিয়ে আসত। বিকেল বিকেল।’
সে বলেছিল, ‘হুঁ।’
‘তোকে কিন্তু অনেক মেয়ে পছন্দ করত বল!’
সে চুপ করে গেছিল। রাকা মজুমদার পাড়ার মেয়ে ছিল। বিকেলে ছাদে বসে থাকত। মল্লার কি তেমন কিছুর ইঙ্গিত দিতে চাইছিল? একটা শিরশিরানি টের পেয়েছিল। সে উড়িয়ে দিয়ে বলছিল ‘অত দিনের কথা মনে নেই।’
কথাটা এখন মনে পড়তে তার অস্বস্তি হল। রাকা বিষণ্ণ মুখে বসে। সুন্দর মুখটায় বিষাদ লেগে আছে। সে বলল, ‘কী বলছ? পাগল হবে কেন হঠাৎ?’
রাকা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ কী এমন ঘটল যে রাকা কাঁদবে! তবু সে চুপ করে রইল। অপেক্ষা করা প্রয়োজন। তাছাড়া একজন যুবতীকে সে চোখের সামনে এই প্রথম কাঁদতে দেখছে!
একটা ব্যাপারে সে অবশ্য বিরক্ত হচ্ছে। ওদের দাম্পত্য সমস্যা মেটানোর দায় কি তার? এতদিন রাকা কোনও অভিযোগ করেনি। ওকে দূর থেকে নির্বিকার দেখে গেছে। কখনও কিছু বলতে আসেনি। আজ সে কেন এল? তবে চাপা কৌতুহলও সে ঠেকাতে পারছে না। মল্লারের সঙ্গে কথা বলে কোনও সমস্যা বোঝেনি। কিন্তু এখন বুঝছে একটা সমস্যায় ওরা ভুগছে। সমস্যাটি কী তা জানার জন্য তার তীব্র কৌতুহল হচ্ছে। সে বলল ‘আরে। কাঁদছ কেন? কী হয়েছে কী?’
রাকা কান্না গুটিয়ে নিল। সে চোখ মুছে বলল, ‘কদিন ধরেই ও একটা অদ্ভূত ব্যবহার করছে। ওর একটাই কথা কেয়ুরকে আমি ঠকিয়েছি। আজ সকালে বাজার যাওয়ার সময় ব্যাপারটা চরমে উঠল।’
সে অবাক হয়ে বলল, ‘কী? আমাকে ঠকিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন করব। কিন্তু ও ফোন কোথায় লুকিয়ে রেখেছে জানি না। সে যাই হোক, বাজার গেল না ঠিক আছে। সারাদুপুর গোঁজ হয়ে বসে রইল। বিকেলে একই কথা। আমি কেয়ুরকে ঠকিয়েছি।’
সে চিন্তামগ্ন। সে ঠিক বুঝছে না কী বলবে! রাকার সব কথাই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মল্লার তাকে কী ব্যাপারে ঠকিয়েছে তা সে বুঝতে পারছে না।
সে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘কেসটা খুলে বল। মাথায় ঢুকছে না!’
রাকা বলল ‘কেন তুমি জানো না?’
‘না। আমি কী করে জানব?’
‘মনে করে দ্যাখো।’
রাকা হেঁয়ালি করছে। সে গম্ভীরস্বরে বলল ‘না জানি না।’
রাকা বলল ‘আসলে আমারই দোষ। আমি যে কেন বলতে গেলাম হঠাৎ। এতদিন কিছু বলিনি।’
কেয়ুরের বুক ধক করে উঠল। সে বলল ‘কী বলেছ?’
‘ওই আমাদের পুরোনো ব্যাপারটা।’
‘আমাদের?’
‘হ্যাঁ। সেদিন কথা বলতে বলতে মল্লার হঠাৎ জিজ্ঞেস করল বিয়ের আগে তোমার কোনও কিছু ছিল কি? বিশ্বাস কর আমি বলব না বলব না করে বলে ফেললাম। তারপর থেকেই মল্লার কেমন যেন হয়ে গেল!’
সে বলল, ‘কিন্তু আমি তো…!’
রাকা কথাটা ধর্তব্যের মধ্যে আনল না। সে বলল, ‘আমি ভাবিনি এরকম কিছু হবে। ভেবেছিলাম ও হয়ত হেসে ফেলবে। বলবে তাই নাকি, কেয়ুর আমাকে বলেনি কোনওদিন। তার বদলে ওর চোখমুখ বদলে গেল। মাথায় হাত ধরে বসে পড়ল। আর একই কথা ওর, কেয়ুরকে আমি ঠকিয়েছি।’
সত্যিই এমন কিছু ব্যাপার নয়। কোনওকিছু ঘটেনি। তাছাড়া এক্ষেত্রে কেয়ুরের কোনও ভূমিকা নেই। রাকাই সেদিন তাকে প্রপোজ করেছিল। সে এসব কথা ভাবল। কিন্তু মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। সে বিরক্তের স্বরে বলল ‘এসব কথা কেন বলতে গেলে তুমি?’
‘বললাম তো। এমনি। ও জানতে চাইল। আমি বললাম।’
‘অন্যায় করেছ তুমি। প্রচন্ড অন্যায়!’
‘তাই। আমি সত্যি কথাই বলেছি!’
ওর দিকে চেয়ে সে চুপ করে গেল। কী অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে ও। আচ্ছা! সেদিন কি রাকা তাকে কিছু বলেছিল? নাকি সে? কতদিন আগের কথা। ক্ষনিকের জন্য তার মনে হল সে যদি পালটে নিতে পারত! সেদিন কেন সে হ্যাঁ বলল না! মাথা ঝনঝন করে উঠল তার। সে মুখ ফিরিয়ে বলল ‘তুমি এখন যাও রাকা। আমি পরে মল্লারের সাথে দেখা করব।’
কদিন পর কেয়ুর মল্লারের সঙ্গে দেখা করল। সে সরাসরি অফিস থেকে ফেরার সময় ওর বাড়ি ঢুকে পড়ল। তার ইচ্ছে ওকে সে সরাসরি ধরবে। বকুনি দিয়ে বলবে, কী সব ছেলেমানুষী কান্ড। এসব কবেকার কথা। এমন হতেই পারে। আমি কি তার জন্য কিছু মনে করে বসে আছি!
মল্লার ঘরে বসে টিভি দেখছে। তাকে একঝলক তাকিয়ে দেখল। তারপর মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। সে পাশে বসল। বিষয়টা খুব তুচ্ছ। কিন্তু যে ব্যাপারটা সিরিয়াসলি ভাবছে তার কাছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। ও বরাবরই ভাবুক। সুতরাং এখনও অনেক কিছু ভাবছে। ওইজন্য তার সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তিতে ভুগছে। তাছাড়া মল্লারের মনও উদার। যে কোন জিনিস ও তার জন্য রেখে দিত। ভাগ করে খেত। আত্মবোধ ওর একবারে নেই। সেই যন্ত্রনাই হয়ত ওকে এখন কষ্ট দিচ্ছে। তার উপর অভিমানও স্বাভাবিক। কিন্তু প্রেমিকা বা বউকে দিয়ে দেওয়ার কথা ওর মাথায় ঘুরছে না তো! সে ভেবে হেসে ফেলল।
মল্লার এখনও কথা বলেনি। বড় বেশি অভিমানী। ওকে একটু তোষামোদ করতে হবে। কিন্তু কেয়ুরের নিজের কি ছোটবেলার মতো সেই মন আছে? বরং তার বিরক্ত লাগছে। রাকাকেও সে ধারেকাছে দেখছে না।
অনেকক্ষণ বসার পর কেয়ুর নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করল। সে জিজ্ঞেস করল ‘কী রে তুই বাজার যাচ্ছিস না কেন? আমি ভাবলাম শরীর খারাপ হল নাকি? তারপর ক’দিন ফোন করলাম ধরছিস না। কী ব্যাপার রে?’
মল্লার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ‘কিছু না।’
সে নরমস্বরে বলল ‘আরে। কী হয়েছে বলবি তো।’
মল্লার একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল ‘ভাবতে পারছি না আমি!’
কী যে ভাবে না ও সারাক্ষণ! বোকা বোকা। বয়স বাড়ল অথচ চিন্তা পরিণত হল না। এখন কি ওকে পিঠে হাত বুলিয়ে বলবে এমন ভাবিস না! সে বলল, ‘কী ভাবতে পারছিস না?’
‘এতদিন তোর সঙ্গে মিশলাম তুই একবারও বলিসনি তো? তুই তো আমাকে বলতে পারতিস।’
‘এসব বাদ দে। কী সব কথা তুলছিস!’
মল্লার বলল ‘না না। বাদ দেওয়ার ব্যাপার নয়। আমি অনেকদিন ভেবেছি এটা কেন হল? আমার বিয়ের পর আমার বাড়ি তুই আসতিস বল?’
সে বলল ‘না।’
‘আমি তোকে জোর করে নিয়ে আসতাম কি না? তুই আসতে চাইতিস না।’
‘হুঁ।’
‘আমি তোকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি তুই রাকাকে পছন্দ করিস না? তালে এড়িয়ে যাস কেন? বল বলিনি?’
‘হ্যাঁ বলেছিস। তাতে কী? তোর সংসার হয়েছে। আমি সেখানে বিড়ম্বনা তৈরী করব কেন?’
মল্লার বলল ‘বিড়ম্বনা? বিড়ম্বনা কিসের? তুই আমার প্রাণের বন্ধু। তুই বাড়ী আসবি। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করবি। তার বদলে কত দূরে সরে গেলি! সেটার কারণটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। এই ক’দিনে আমি সব জানলাম। জানার পর থেকেই আমার মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল। সত্যি এমনও হয়! আমারই ঘটল!’
মল্লার এক আছে। বদল নেই ওর! কতকিছু বদলে গেল। ওর আবেগ একই জায়গায়। বন্ধুর মূল্য ওর কাছে অনেক বেশী। ও হেলায় সবকিছু দিতে পারে। তার একটু লোভ হয়। ইশ! কেন যে সে বলেনি কথাটা। ওদের প্রেম পর্বে সে যদি কথাটা বলত বড় ভাল হত। কেয়ুর ভাবল।
মল্লার যেন সে কথাটাই তুলল এখন। তার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলল ’আচ্ছা। তুই আমাকে বলিসনি কেন? তখন কেন বললি না। বললে আমি কী করতাম?’
সে বলল, ‘আরে। কী এক ব্যাপার নিয়ে বলছিস। ছাড়।’
মল্লার মাথা নেড়ে বলল ‘না। ছাড়ার কথা নয়।’
সে অবাক হয়ে বলল ‘ছাড়বি না তো কী করবি তুই? এখন কী পারিস আর। ওইসব পুরোনো কথা তুলে আর লাভ আছে?’
মল্লার বলল, ‘লাভ নেই। কিন্তু তোকে যা ভাবতাম তা তুই নোস তা বুঝে গেলাম।’
সে বলল ‘বিরাট বুঝেছিস!’
‘সত্যিই বুঝেছি। রাকা বলার পর আমার বিরাট উপকার হল।’
‘কী রকম উপকার?’
‘বুঝলাম বন্ধু-টন্ধু নেহাত বাজে কথা। সবাই স্বার্থপর। ঠকানোর জন্য অস্থির।’
সে বলল ‘কে কাকে ঠকাল?’
‘তুই আমাকে রোজ রোজ ঠকাচ্ছিস তা জেনে গেছি।’
কেয়ুর অবাক। কুসুমের উল্টো কথা বলছে মল্লার! সে বোকার মত চেয়ে বলল ‘আমি ঠকাচ্ছি মানে?’
মল্লার বলল ‘সব জেনে গেছি রে। সব। রাকা স্বীকার করেছে। ও সব বলেছে।’
মাথা উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে তার। রাকা কী বলেছে ওকে তার সম্পর্কে? সে বলল ‘তুই কি বলতে চাইছিস?’
‘কিছু না।ভাই। এবার তুই আয়। বললাম তো রাকা আমাকে স্বীকার করেছে তুই ওকে প্রপোজ করেছিলিস।’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ। এখনও তুই নাকি ওকে চাস। তোর সাথে নাকি ও দেখাও করে!’
‘এসব মিথ্যে।’
মল্লার উঠে দাঁড়িয়ে বলল ‘মিথ্যে। আচ্ছা। রাকাকে ডাকি। ওর সামনেই যা বলার বল।’
সে বলল, ‘হ্যাঁ। ডাক।’
বলল কিন্তু গলায় তেমন জোর নেই!
খুব ধ্বস্ত হয়ে কেয়ুর ফিরে আসছে। জটিল ধাঁধার মধ্যে সে পড়ে গেছে। মল্লারের সঙ্গে তার আজীবনের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। একটা বিচ্ছিরি সন্দেহ ওর মনের মধ্যে ঢুকে গেছে। সে মিথ্যেটা অবশ্য রাকাই তৈরী করেছে।
রাকা তার সামনে আসেনি। মল্লার হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করেছিল। সে বলছিল, ‘রাকা আসবে কেন? আর কখনও ও তোর সামনে আসবে না। শালা বন্ধু! অমন বন্ধুর মুখে লাথি। আমার বউকে নিয়ে ফুর্তি করা।’
কেয়ুর কিছু বলেনি। সে মাথা নীচু করে ফিরেছিল। বেরোবার সময় রাকাকে একপলক দেখেছিল। ও হাসছিল!
হাসিটা বড় সুন্দর রাকার! চোখ ফেরানো যায় না!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগল।
আগে পড়েছিলাম, আবার পড়লাম। আপনার গল্পগুলো, বারবার পড়লেও পুরনো হয় না। মনস্তাত্তিক ভাবধারা মন ছুঁয়ে যায়। মানুষের মধ্যে থাকা রহস্যময়ী মন, রহস্য গল্পের থেকেও রহস্যময়।